আমরা ছোটোবেলায় গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। মনসা পুজো
ঘুরে ঘুরে দেখতাম। মা বলতেন,এই কাঁচা দেবীকে রোজ স্মরণ করবি। তিনিই সাপ, বিষাক্ত
কীটের দংশন থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখেন। তারপর ঝাপান গান শুনতে গানের দলের পিছনে
পিছনে ঘুরে বেড়াতাম। জাতি,ধর্ম
নির্বিশেষে এই মা মনসার পুজো এখন খুবই জনপ্রিয়।
দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর । ছুটে গিয়ে দেখলাম
জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে । আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে
ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে, “ভাদু
আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না”। অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য
অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ। ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায়
চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান দাদা।
ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো, “আলে
আলে যায় রে কেলে , জলকে
করে ঘোলা । কি ক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম “ । গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি
গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হতো। বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে
গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন । অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে ম ম করে
উঠতো সারা বাড়ি । তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেত উদ্ধারণপুরের গঙ্গায় স্নানের
উদ্দেশ্যে । কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়ত । এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিল
আনন্দ ঘ্রাণ । তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেত অন্যমনস্ক
কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী । ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার
সুর । আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয় ?
রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে
বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে ।
ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ ।
নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম,
ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া ।
অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ । পরের দিনে
রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা । বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা । সে এক অনির্বচনীয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের
প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি ।
আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের
খেলা। শিল্পী একমাটি, দু’মাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে।
আগে থেকে চোখ দেখতে নেই । আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না। পাঠক মশাইয়ের
ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার। সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে
যায় জলছবি। কি যেন বলেছিলো সেই চোখ । আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে
বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায় । ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব
দিয়েছে কে জানে।
দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে
চলে আজও আমার মায়ের চোখ। হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে।
হয়তো আমার জন্যই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায়।
আজ তিরিশ বছর পরে আমার মনে পড়ছে খড়ের চাল, মাটির
দেওয়াল ভেদ করে সে এসেছিলো জ্যোৎস্না রঙের ফ্রকে। হাত দিতেই একরাশ মুক্ত ঝরে পড়েছিল তার রক্ত রাঙা দেহ মাটিতে ।
-
“পলাশ
তোমার পরশ থেকে আমাকে ছিন্ন কোরোনা, আমি মরে যাবো।”
-
“এসো আমার আনন্দ জীবন, আমার
করবী।”
কে যে মরে আর কে যে হা পিত্যেশ করে বোঝা যায় না এই পৃথিবীতে। সেদিন খড়ের চাল ফুঁড়ে
জ্যোৎস্না আমার উপর উঠে বিপরীত ক্রিয়াতে হেসেছিলো নেশাতে। আমি শুধু অবাক হয়েছিলাম
প্রথম সমুদ্র দেখার মতো।
তারপর জয় পরাজয়, উত্থান পতনের ঢেউ আছাড় মেরেছে জীবন সৈকতে । কোনোদিন
ভেঙ্গে পরেনি মন। হঠাৎ পাওয়া জ্যোৎস্না বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলো । না ছাড়ার
প্রতিজ্ঞার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বয়ে বেড়ালাম তিরিশ বছর।
এখন জলপাইগুড়ির প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়েছি খুব।
আমার এক স্প্যানিয়াল বন্ধুকে নিয়ে ঘর করি । কোনো কথা নেই , কোনো
ঝগড়া নেই। ভালোবাসার চোখে দেখি একে অপরকে। আপন মনে থাকতে থাকতে মনে চলে আসে
জ্যোৎস্নার কথা। বৃষ্টির এক দুপুরে তার চিঠির কথা আজও মনে পড়ে। সে লিখেছিলো ,ধনী
পিতার একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবার যেমন নজর বন্দী করে রাখে পাছে ছেলে ভালোবাসার
খপ্পরে পরে পর হয়ে না যায়। ঠিক তেমনিভাবেই রেনকোট, ছাতার আড়াল করে আমরা নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করেও
বৃষ্টির ভালোবাসা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি না। বৃষ্টি বলে সুন্দরী যেমন একমাত্র
সুন্দর ছেলেকে পরিবারের নজর থেকে নিজের করে নেয় , ঠিক একইভাবে বৃষ্টি আমাদের একমাত্র সুন্দর দেহ জামার
কলারের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে। তারপর হাঁটা পথে চলার রাস্তায় জল পরম মমতায়
পায়ে জলের শেকল পরিয়ে রাখতে চায়। বৃষ্টির সময় চোখে মুখে জল আদরের প্রলেপ লাগায়।
ঠোঁট চুম্বন করে শীতল স্পর্শকাতর জল। তার আদরে প্রেমজ্বরে পড়তে হয় মাঝে মাঝে। আমি
ভালোবেসে তাকে বলছি, তুমি
আমার জ্বরের মাঝে ঝরঝর ঝাঁপিয়ে পড়ো। আমিও বৃষ্টি হয়ে যাই।
তারপর জানতে চেয়েছিল কেমন হয়েছে তার চিঠি। তখনও আমি
কিছুই বলতে পারি নি। আমি ও
জ্যোৎস্না যে গ্রামে ভালোবাসার বয়সটা কাটিয়েছি তার কথা আজ মনে সবুজ সর ফেলছে ।
শুধু মনে আছে আজ জ্যোৎস্না খোঁজ নিয়ে আমার
জলপাইগুড়ির বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। এসেই নিজের ঘরের মতো এলোমেলো জীবন সাজাতে
চাইছে। আর কথা বলে চলেছে অনবরত। ভালো করে তৈরি হয়ে এসে
বিছানায় বসে শরীরটা এলিয়ে দিল। তারপর শুরু করলো, মনে
আছে তোমার সব ঘটনা। জানো আমি সুখী নই । কথাটা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আবার
আমার দুর্বল জায়গা জাগিয়ে তোলার জন্য পুরোনো কথা শুরু করলো। ও জানে না আমি স্মৃতি
জড়িয়ে ধরে বেঁচে আছি।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনাতে লাগলাম পুরোনো বাল্য
ভারত, তুমি
শোনো জ্যোৎস্না, ছোটোবেলার
সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো। পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু
টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পীকে। তারপর প্যান্ডেলের জোগাড়। বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে
মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল। তার একপাশে বানানো
হত আমাদের বসার ঘর। পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনো
কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত। একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব। তারপর সেই ছোট্ট
কাপড়ের পাখির নীড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ
জানতে পারতাম না। মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়ত না। তবু সকালে
উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ। মা বাবার সাবধান বাণী , ডেঙ্গু
জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।
হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে, আমাদের
আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে
ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে। পুরোহিত এসে পড়তেন
ইতিমধ্যে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে
পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই ।
জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি
দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে। তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা
সকলেই পুলকিত হতাম। প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে। আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি
বেশি হয়ে যেত, ফলে
দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম। সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ, ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম। পরের দিন
দধিকর্মা। খই আর দই। পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল। তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের
পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।
এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন। কাছেই একটা পুকুর। রাত
হলে সিদ্ধিলাভে (দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচতে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে
উঠতো। মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই
যাবি বিসর্জন।
তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার
ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে…
কথা শুনতে শুনতে জ্যোৎস্না আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমার
প্রবল কামনাকে কামড়ে ধরে নীলকন্ঠ হয়ে আছি। জ্যোৎস্না বলল, জানো
বিদেশে এটা কোনো ব্যাপার নয়। এসো আমরা এক হই পরম সুখে। আমি হাত ছাড়িয়ে বাইরে এলাম
।
জ্যোৎস্না কি ভুলে গেছে মনে ভাসা সবুজ সর নিয়ে, দুঃখকে
জয় করার মানসিকতায় এক ভারতবর্ষীয় যাপনে আমি ডুব দিয়েছি জীবন সমুদ্রে….।
বাবুল ছোট থেকেই একরোখা জেদি ছেলে। কোনো ভয়ডর তার
হৃদয়ে নেই। এক ডুবে সাঁতরে পুকুর পার হওয়া, গাছে ওঠা সবেতেই সে সিদ্ধহস্ত। সব বন্ধুরা তার বশ্যতা
স্বীকার করে নিত অনায়াসে। তবু দেখতো বাবুল, দু একজন বন্ধু তার পিছনে নিন্দা করছে। একদিন রবি এসে
বলল, ‘জানিস
বাবুল তোর নামে হিরু খুব খারাপ কথা বলে।’ বাবুল বললো, ‘তোকে বিশ্বাস করে হিরু যা বলার বলেছে। তুই আবার কেন
সেই কথাগুলো প্রকাশ করছিস?’ রবি লজ্জিত হলো, ‘বললো,আর
কখনও এরকম ভুল হবে না। তোর কাছে মস্ত শিক্ষা পেলুম।’
বাবুল বাড়িতে দেখেছে, তার বাবার দাপট। বাড়িতে একটু দেরি করে ঢুকলেই তার
কৈফিয়ৎ দিতে হত হাজারটা। বাবার দু’বেলা তিন ঘন্টা করে মোট ছ’ঘন্টা আহ্নিকের সময় সবাইকে
চুপ করে থাকতে হতো। কথা না বলে ধীরে সব কাজ সারতে হত মাকে। বাবুল পড়তে বসে হারিয়ে
যেত বইয়ের ছবিতে। ওর চোখে ভেসে উঠত আমেরিকার ঝলমলে শরীর, টরেন্টোর
বিলাস বহুল শহুরে আদব কায়দা। মাঝে মাঝে সে ঘুমের ঘোরে বলে উঠত, ‘আমি
যাবো, আমি
যাবো, আমেরিকা,টরেন্টো।’ তার মা ডেকে বলতেন, ‘কি সব
বলছিস তুই। কোথায় যাবি?আমাদের
ছেড়ে কোথায় যাবি তুই।’
তারপর সুখে,দুখে,শোকে কেটে গেছে অনেকটা সময়। বাবুল হায়ার সেকেন্ডারি
পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করেছে। সবাই খুব আনন্দিত। কিন্তু বাবুলের মনে অন্য
চিন্তা। সে একদিন রাতে মায়ের আলমারি খুলে সব গহনা হাতিয়ে নিল। তারপর রাতের
অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো বাবুল। তার মা সকালে উঠে দেখলেন,আলমারি
হাট করে খোলা। কোথাও কিছু নেই। সোনাদানা, টাকা পয়সার থেকেও দামি তার সোনার ছেলে বাবুলও কোথায়
যেন হারিয়ে গেলো। বাবুলের মা, বাবা পরামর্শ করলেন, চুরি যাওয়ার ঘটনা চেপে যেতে হবে।
তারা একটা চিঠি পেলেন টেবিলের উপর। তাতে লেখা,
“ মা ও বাবা,তোমরা
আমাকে ভুল বুঝো না। আমি পড়াশোনার জন্য বিদেশ চললাম। বাবা যেতে দেবেন না বলে আমি
নিজেই ম্লেচ্ছ হতে যাচ্ছি। তোমাদের নেওয়া জিনিসের আমি সদ্ব্যবহার করবো। তোমরা আমার
জন্য দুঃখ কোরো না। ভালো থেকো।
ইতি —তোমাদের বাবুল।”
তারপর সময়ের স্রোতে কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। কিন্তু বাবুলের কোনো খবর পাওয়া গেল না। এদিকে বাবুল
সোনাদানা,টাকা
পয়সা নিয়ে চলে এলো কলকাতায়। সেখানে সোনাদানাগুলো সোনাপট্টিতে বিক্রি করলো। তারপর
একটা ঘর ভাড়া করলো। তার সঙ্গে পার্ক স্ট্রীটের এক ইংরেজ মহিলার সঙ্গে পরিচয় হলো।
পড়াশোনার জন্য সে বিদেশ যেতে চায় শুনে মহিলাটি তাকে সব রকমের সাহায্য করলেন। বাবুল
সময় ঠিক করে একদিন সুইজারল্যান্ডে পাড়ি দিলো। সেদিন তার খুব আনন্দের দিন। জাহাজে
তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক ভদ্রলোকের। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই কলকাতা
আসেন। বাবুল বললো, ‘আপনি
আমাকে একটা কাজ দেবেন। আপনার যে
কোনও কাজ করে দেব।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘সুইজারল্যান্ডে
তার হোটেল আছে। সেখানে তাকে একটা কাজ নিশ্চয় দেওয়া হবে।’
বাবুল ভাবতে পারে নি, এত সহজে সব কাজ হয়ে যাবে। জাহাজের বাইরে পাটাতনে বসে বাবুল
সমুদ্র দেখছে। এক নীল অসীম সমুদ্রের হাতছানিতে তার হৃদয় দুলে দুলে ওঠে। বাঙালী
ঘরের ছেলে হলেও অন্তর তার শক্ত। এখন তার আর মায়ের মমতা কিংবা বাবার শাসন কিছুই মনে
পড়ছে না। এগিয়ে যাওয়ার এক নেশায় সে মশগুল।
জাহাজ নোঙর বাঁধলো। চলে এলো অন্যদেশে,অচিনপাড়ে।
জাহাজের সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক বাবুলকে নিয়ে চলে এলেন নিজের বাসভূমিতে। বাবুল কাজের
ছেলে। নিজের ঘরটা বুঝে নিয়ে মালপত্তর দু’চারটে যা ছিল গুছিয়ে রাখলো। প্যান্টের পকেটে টাকাগুলো রাখলো। এখন টাকাই বল, ভরসা।
এখানে তো আর টাকা চলবে না। ভদ্রলোক বললেন, ব্যাংকে গিয়ে এক্সচেঞ্জ করিয়ে নেবেন। খাওয়াদাওয়ার পরে
একঘুমে সকাল। তারপর কাজ আর কাজ।
এই কাজের দেশে এসে বাবুল বুঝে গেছে কাজ করতে পারলে
সুইজারল্যান্ডে খাওয়ার অভাব হয় না। ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কাছে জেনেছে সে, কেউ
কারও দাসত্ব করে না এদেশে। খাটো খাও মৌজ করো। রাতে কলেজে পড়াশোনা করে বাবুল।
পড়াশোনার জন্যই এখানে আসা তার, সেকথা সে ভোলে নি।
আজ পাঁচ বছর কেটে গেলো বাবুলের স্বপ্নের মত। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী
সে হাসিল করেছে এতদিনে। আর তাকে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। একটা বড় কম্পানী তাকে
চাকরী দিয়েছে। ফ্ল্যাট দিয়েছে। মাইনে অনেক টাকা। আর তার কোনো চিন্তাই নেই। এক
বড়লোক মহিলাকে সে বিবাহ করেছে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য। বিশাল সম্পত্তির মালকিন সেই
মহিলা। একদিন গাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় মহিলার আ্যক্সিডেন্ট হয়। একদম স্পট ডেথ। তখন
বাবুল অফিসে ছিল। এসেই দেখলো চারদিকে পুলিশের ভিড়। বাবুলর চোখে জল রক্ত দেখে। বড়
ভালোবাসত মহিলাটি তাকে। তার স্ত্রী আজ আর নেই। হিসেবমত বডি সৎকারের কাজকর্ম মিটে
গেলে সম্পত্তির একমাত্র মালিক হলো বাবুল।
বাবুল লোভি নয়। সে এখন ভালোই রোজগার করে। তবে হাতের
সম্পত্তি তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। বাবুলের ওই বাড়িতে আর ভালো লাগতো না। একটা কান্না ঘুরে
বেড়াতো বাড়িটা জুড়ে। তাই সে বাড়িটা বিক্রি করে দিল। গাড়িটাও বিক্রি করে দিল। সব
টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত করে রেখে দিল। তারপর একটা কম বয়সী মেয়ে দেখে আবার বিয়ে করলো।
বছর দুই পরে ফুটফুটে একটি মেয়ে হোল।
দেখতে দেখতে মেয়ে দশ বছরের হয়ে গেল। বাবুলের এবার একবার দেশের বাড়ি যাবার ইচ্ছে হল।
সবাইকে নিয়ে চলে এলো নিজের দেশ ভারতবর্ষে। দেশের মাটিতে পা দিয়েই বাবুল একমুঠো
ধুলো গায়ে হাতে পায়ে মেখে নিল। বলল, ‘আঃ কি সুন্দর গন্ধ। পৃথিবীর কোনো পারফিউমের গন্ধ এর থেকে সুন্দর নয়।’ বাবুলর দেখাদেখি মেমসাহেব আর মেয়ে
ধুলো নিয়ে গন্ধ শুঁকলো। কিন্তু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হোল না। হবে কি করে? তারা
তো আর এই মাটির গর্ভে মানুষ হয় নি। তারপর কোলকাতা থেকে সোজা মায়ের কাছে চলে এল বাবুল।
বাবুলকে দেখে মা কেঁদেই আকুল। মা বললেন, ‘তোর
বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। আমি তোকে একবার শেষ দেখা দেখবো বলে বেঁচে আছি।’ বাবুল বললো,’এই নাও
মা তোমার সব গহনা,টাকা, পয়সা
সব। আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।’ মা বললেন, ‘তুই
মানুষের মত মানুষ হয়েছিস। আমার আর কোনো দুঃখ নেই। তুই আমাকে কলকাতার বাড়িতে তোর
ভাইয়ের কাছে রেখে যা। আর এই বাড়ি গ্রামের স্কুল গড়ার কাজে দান করে দে। তোর বাবার
নামে এই স্কুলের নাম হবে, মহেন্দ্র
বিদ্যাপীঠ।’ বাবুল বললো, ‘তাই
হবে মা। তোমার কথার অন্যথা হবে না। তারপর সেই বাড়ি আজ বিরাট বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।’
প্রায় ছ’মাস ভারতে কাটিয়ে আবার ফিরে এলো সুইজারল্যান্ডে। বৃষ্টিভেজা এই দেশে
সবুজের সমারোহ। টইটম্বুর জলাধার মনে দাগ কাটে। শীতের মরশুমে জানালার কাঁচে রেখে
যায় বরফের ছাপ। এদেশের বেশির ভাগ বাড়ির চাল ঢালু। বৃষ্টি বা বরফ গড়িয়ে পড়ে। কিছু
ঐতিহাসিক স্থান দেখে মন জুড়িয়ে যায়। এদেশে থাকতে থাকতে বাবুলের কেমন একটা ভালোবাসা জন্মে গেছে মনে।
বাবুল সেদিন অফিসে গেছে। রাতে ফিরে এলে তার সুখের
সংসারে আগুন লাগল। বাবুল দেখলো তার স্ত্রী ও মেয়ে একসাথে এক অপরূপ সুন্দর যুবকের
সাথে যৌনক্রিড়ায় মত্ত। বাবুলের মেয়ে কুড়ি বছরের। বৌ এর বয়স বিয়াল্লিশ। আর বাবুলের
বয়স আটান্ন। বাবুল ভারতবর্ষের ছেলে। সেখানকার সভ্যতা তার মনে প্রাণে। এই দৃশ্য
দেখার পরে সে আর বাড়ি ঢোকে নি। অন্য এক বাড়ি ভাড়া করে ছিল কয়েকবছর। তারপর ডিভোর্স
দিয়ে ছাড়াছাড়ি করে নেয় তাদের সম্পর্ক। মেয়ে থেকে যায় মায়ের কাছে। বাবুলের আর কোনো বাধা নেই। এবার সে ভারতবর্ষে বাকি জীবনটা কাটাবে শান্তিতে। ভারতবর্ষের
মাটির গন্ধ সে ভুলতে পারেনি। ফোর জি বা ফাইভ জির সুবিধা, আরাম
তাকে দেশের মাটির গন্ধ ভোলাতে পারে নি।
চলে এলো বর্ধমানের গাংপুরে। তার মা, বাবা
কেউ আর বেঁচে নেই। ভাইরা নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বাবুল দশটা কাজের ছেলে
রাখলো আর পাঁচটা কাজের মেয়ে। প্রায় কুড়ি বিঘে জমির উপর পুকুর,বাড়ি,বাগান।
এসব দেখাশোনার জন্যই সে এত লোক রাখলো। আর নিজে অবসর কাটানোর জন্য প্রচুর পড়াশুনা
করে। বিগত জীবনের কোনো মায়া তাকে আটকে রাখতে পারে না। বাবুল এখন দেখতে পায় আলোর
ফুলকি। ফুলকিগুলো লাল,সবুজ,নীল
হরেক রঙের আলো ছড়িয়ে নিরাকার এক মূর্তি মনে তৈরি করে। বাবুল এখন তার সাধনায় পরশ
পাথরের খোঁজ করে। একদিন হয়ত তার সন্ধান পাবে…
পুরুলে গ্রামের মদন কাকা আমাকে দেখে বললেন, ‘কি গো
কেমন আছ?’ তিনি
কথা বলতে ভালোবাসেন। তিনি শুরু করলেন তার বক্তব্য – ‘বুঝলে বাবা কবরের পোকাগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মরা পোড়ানোর ঝিলগুলো
কোনো সময় খালি নেই। পাটা ঝিলের বাইরে থাকলে বাঁশ দিয়ে গুটিয়ে আগুনে দেবে। আত্মীয়
স্বজনরা বলবে, আর
কতক্ষণ লাগবে,একটু
তাড়াতাড়ি করো না ভাই। তবে কার জন্য এত মারামারি, কাটাকাটি,জাতিবিদ্বেষ! এত টাকা টাকা করে আমরা মরার আগে মরি কেন? যারা
খেতে পায় না, কোটি
টাকার মালিক হলেও তাদের খেতে দিতে পারি না কেন? কোটিপতি, আপনাকে বলছি,কত টাকা নিয়ে আপনি কবরে প্রবেশ করবেন? কত
টাকা নিয়ে আপনি ঝিলে চাপবেন। বিরুদ্ধে অনেকে অনেক কথা বলবেন জানি। কিন্তু একটু
ভাবুন তো, কোনো
কিছুই নিশ্চিত নয়, কিন্তু
মৃত্যু নিশ্চিত।
আপনার দোষ, অকৃতকার্যতা, আপনার সংসার নিয়ে অনর্থক টেনশন সব বৃথা। মরণ যখন চলে
আসবে আরও কিছুক্ষণ বাঁচার জন্য আপনি ছটফট করবেন। আপনি ভুলে যাবেন আপনার অহংকার,সংসার,স্ত্রী,কন্যা,পুত্র
সকলের কথা। জীবন একবার চলে গেলে আর ফিরবে না। যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ আসুন আনন্দে
থাকি। ভুলে যাই ঝগড়া,খুনোখুনি,চিটিংবাজি।
টাকার পাহাড় গড়ছে যারা তার ভাবুন তো, কত টাকা আপনি সঙ্গে নেবেন। কত টাকা আপনাকে পোড়াতে
লাগবে?’ কাকা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন।
-
“একজন গরীব রোগীর বিনা পয়সায় চিকিৎসা
করেছেন তো? একজন
ছাত্রকে বিনা পয়সায় সত্যিকারের মানুষ করেছেন তো? একজন শ্রমিককে শান্তিতে খেতে দিয়েছেন তো? শুধু
পয়সা পয়সা করে সারাজীবন অসার হয়ে যায় নি তো? বিবেককে প্রশ্ন করুন। ওর থেকে বড় আদালত আর নেই। তবে
কেন এত লোভ,হিংস্রতা,বর্বরতার
নিষ্ঠুর পরিহাস। এগুলো তো রক্তমাংসের মানুষরাই করে। তারা তো সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ
বুদ্ধিমান প্রাণী। তারা তো সব জানে। আমার ফালতু বোকামি। বকবক করে জ্ঞান দেওয়ার
পাগলামি। তবু যদি এই পাগলের লেখা পড়ে একটা মানুষেরও উপকার হয় তাহলে দুঃখ থাকবে না। যারা
পুত্র,কন্যা, তোমরা
বাবা মাকে দুঃখ দিও না। স্বামী,স্ত্রী অকারণে সম্পর্ক ভেঙ্গো না। বন্ধু তুমি বন্ধুকে
ঠকিও না। নিশ্চিত মরণকে মনে রেখে সমাজে সকলে মিলে শান্তির পরিবেশ গড়ে তুলি। জয় হোক
মানুষের। জয় হোক মানব ধর্মের। জয় হোক মনুষ্যত্বের।” ভারতবর্ষের মূল আদর্শ কাকা তার বক্তব্যে তুলে ধরলেন।
গলা ভারি হয়ে এল। কিছু উত্তর দিতে পারলাম না।
কাকার কথা শেষ হলে আমি এগিয়ে গেলাম। দেখি আরও এইরকম
অখ্যাত মানুষের সন্ধান পাই কি না…
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন