সাঁইরাম সেতু - অপরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 



বিশ্বাস করো, আমি নিজে থেকে রাজি হইনি । বাবা জোড় করল বলেই তো...” কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল পার্বতী

বিশ্বাস করিনা আমি তোমায়, তুমি তো কথা দিয়েছিলে আমায় ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবেনা, প্রয়োজন পড়লে বাড়ির অমতে গিয়েও তুমি আমাকেই বিয়ে করবে। তবে কেন পার্বতী? “ হরনাথ ওরফে হর বলল

জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতায় চকচক করে উঠল পার্বতীর চোখের কোণগুলি

তুমি অবিশ্বাস করলে আমায়?”

আমি তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারবোনা পার্বতী। কেন তুমি এটা বুঝতে চাওনা ? এতো অবুঝ কেন তুমি? পারতে না মুখের ওপর তোমার বাবার প্রস্তাবটাকে প্রত্যাখ্যান করে দিতে?” উন্মুক্ত নদীপথে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল হরনাথের কণ্ঠস্বর

তা সম্ভব ছিল না, হর... উনি আমার বাবা “ - অশ্রুজলে ভিজে উঠল সেতুর রেলিংটা

বেশ । তবে আমার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব “ - এই বলে রেলিং ডিঙিয়ে বহমান ময়ূরাক্ষীর বুকে ঝাঁপ দিল হর

হর...."- আর থাকতে পারলনা পার্বতী। সেও বুক থেকে ভয়ের পাহাড়টাকে কষ্টে সৃষ্টে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁপ দিল সেতু থেকে

 

দু বার ঝুপ ঝুপ শব্দ, তারপর সব নিস্তব্ধ 

-----------------------------------------

 

তুমি গাড়ি চালাও তো, এসব গল্প না শুনিয়ে “ - ধমক দিলাম মণিলালের উদ্দেশ্যে

 

সত্যি কথাই তো বলছি, সেই থেকে এই ব্রিজে কোনো স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক -প্রেমিকা গাড়ি নিয়ে পার হতে গেলেই নাকি ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ে। আবার সকালবেলায় কিছু জাদু করে কেউ ব্রিজটাকে আবার সহি সালামত করে দেয়, যেমনটা আগে ছিল । “

 

তো বলতেটা কি চাইছ, আমি যাবোনা এই রাস্তা দিয়ে? আমার মা অসুস্থ। বারবার আমার নাম ধরে ডাকছেন, শুনলে না? “ কড়া গলায় বললাম

যদিও না আপনার, না আমার শাদী হয়েছে তাও সাবধান করে দিলাম। এই আর কি...” এই বলে আবার স্টিয়ারিং এ হাত দিল মণিলাল

 

 

আমি সৈকত সোম, বাড়ি বীরভূমে হলেও চাকরি সূত্রে কলকাতায় থাকি। হঠাৎ মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় বীরভূমে যেতে হচ্ছে। বোলপুরের রাস্তা খারাপ বলে সিউড়ি হয়ে যেতে হচ্ছে। আর সেখানেই পড়লাম বিপদে, আমার এই অধমের অবতার মণিলাল কিছুতেই যেতে চায়না এই রাস্তা দিয়ে। শুধুই বলে সাঁইরাম সেতু পেরোতে হবে। অবশেষে পকেটে আরও কিছু নগদ গুঁজে দিতে তাও রাজি হয়েছে লোকটা। তবে সারা রাস্তা তাঁর সাবধানবাণী শুনে শুনে কানটা একেবারে পচে যাবার জোগাড়

 

এই তোমার সাঁইরাম না কি রামসেতু বেশ, ওরকম অদ্ভূত নাম কেন তার ?"- খানিক্ষনের নিস্তব্ধতা ভাঙলাম আমি

 

আমার দিকে খানিক্ষন তাকিয়ে তারপর বলল মণিলাল - “ এই সেতুর দুই পারে রয়েছে হিন্দুধর্মের দুই ভগবানের বাস। এইপারে প্রকান্ড এক রামের মন্দির, আর ঐপারে রয়েছে একখান সাঁইবাবার মন্দির। সেই থেকে এর নাম সাঁইরাম, বাবু

 

তার কণ্ঠস্বরে মিশে ছিল তীব্র অনিচ্ছার একটা রেষ।বুঝলাম আমার ধমকে বেশ আঘাত পেয়েছে তার মন। 

 

বুঝলাম। এই তুমি কিছু মনে করলে নাকি আমার কথায়? আসলে বুঝতেই পারছ মায়ের অসুখ, চিন্তায় আছি খানিকটা “

 

না বাবু মনে করিনি, এই রাস্তাও খুব একটা খারাপ নয়। আপনি ঠিক সময়েই পৌঁছে যাবেন

 

আবার নিস্তব্ধতা ।মণিলাল আমার অনেকদিনের ড্রাইভার হলেও সে কথা সাধারনত কমই বলে। তাই নিদেনপক্ষে বাইরে বেরলে একটু আড্ডা দেওয়াটাও হয়না। এখনও ঠিক তাই হল সে নীরবে স্টিয়ারিং ঘোরাতে থাকল আর আমি চেয়ে রইলাম গাড়ির জানলার বাইরে। হঠাৎ চোখ পড়ল রাস্তার ডান পাশে, একটা মন্দির –হ্যাঁ রাম মন্দিরই বটে। ওই তো ফটকের সামনেই পবনপুত্র হনুমানের বিশালাকৃতি দেহটা রক্ষীর মতো ফটকের সামনেটায় দাড়িয়ে আছে

 

হঠাৎ মনিলালের দিকে চোখ যেতে দেখলাম তাকে কেমন যেন চিন্তিত চিন্তিত দেখাচ্ছে। ঠিক যেন কোনরকম অস্বস্তি চেপে ধরেছে তাকে। অথচ তাঁর দৃষ্টি সটান সম্মুখের রাস্তার দিকে।

 

সম্মুখে…!!! আরে, সামনে তো সেই ব্রিজটা!!  যার কথা বলেছিল মনিলাল। কথামত  সত্যিই এই পাড়ে রাম মন্দির মনিলালের সাবধানবাণী গুলো যেন কানে বেজে উঠছিল বারেবারে। লোহার রেলিং দিয়ে বাঁধানো সামান্য একটা নদী পারাপার করার সেতু, তাকে নিয়ে আবার এত আতঙ্ক ছড়াবার কি আছে বুঝলাম না?

 

গাড়ি এগিয়ে চলল ব্রিজের আরও কাছে এসে পড়ল গাড়িটা, এইবার তাঁর চাকাগুলো ব্রিজের ঢালাই লোহাশক্ত বুকের ওপর চেপে বসল। ব্রিজটা যতদূর অব্দি গেছে, ততদুর দুপাশে একটাও স্ট্রিট লাইট নেই। সামনে তাকিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল সেতুর ওই পাড়ে যেন কোন মূর্তিমান অশরীরী বিভীষিকা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। মুখটাকে উইন্ড স্ক্রিনের আরও কাছে নিয়ে গেলাম, তবে কিছুতেই ওই পাড়ের  দুর্ভেদ্য অন্ধকার ভেদ করতে পারলাম না। একরাশ অন্ধকার যেন ডানা মেলে শুয়ে আছে এই সেতুর এপার থেকে ওপার অবধি। মনিলালের মতো আমার মধ্যেও যেন এবার একটা চাপা অস্বস্তি বাসা বাঁধতে লাগল। যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম সেই অস্বস্তিটাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে, এক দৃষ্টে ছেয়ে রইলাম সামনের দিকে

 

হঠাৎ চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য। সামনের দুর্ভেদ্য অন্ধকারে যেন হঠাৎই ফুটে উঠতে লাগল কিছু ছায়ামূর্তি

 

মণিলালের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলাম বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমা হয়েছে তাঁর কপালে। বুঝলাম, চোখের সামনে ঘটতে থাকা দৃশ্যগুলো তাঁরও দৃষ্টি গোচর হয়েছে

 

মণিলাল ? ওগুলো....” - আমার কথা যেন তার কানে ঠেকলই না। সম্মুখের অজানা কোনো মহাজাগতিক বিপদের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সে, গাড়িটাকে

খানিকবাদে স্পষ্ট ফুটে উঠল, মূর্তিগুলো – দুটো মূর্তি, একটি ছেলের ও একটি মেয়ের। স্থানীয় বলেই মনে হলো। তবে তাঁদের শরীর দুটি যেন জমাট বাঁধা অন্ধকার দিয়েই গড়া, তাতে রক্ত মাংস অথবা চামড়ার কোনো অস্থিত্ব নেই। ক্রমশই গাড়ি এগোতে থাকল তাঁদের দিকে। ব্রিজের এক ধারের রেলিং ঘেঁষে তারা যেন নিজেদের মধ্যেই ফিসফিস করে কিসব কথা বলছে

 

অমাবস্যার রাত, তাই চতুর্দিকের যমকালো অন্ধকারের মধ্যে এই গাড়ির হেডলাইটটি যেন এখন একমাত্র বাঁচার সম্বল বলে মনে হচ্ছিল। সেই একটি মাত্র আলোর সূত্রের সাহায্যেই সামনে ঘটতে থাকা দৃশ্যগুলি রুপোলি পর্দার মতো যেন তুলে ধরছিল আমার চোখের সামনে। অল্প আলোয় ভালোভাবে জরিপ করে নিতে চেষ্টা করলাম সেই মূর্তি দুটিকে। তবে আলো পড়লেও যেন তাঁদের শরীরের ওপর থেকে সেই অন্ধকারের আস্তরণটি সরছেনা। কেউ যেন কোনো মায়াবী মন্ত্রবলে এক রাশ অন্ধকার এনে মাখিয়ে দিয়েছে তাঁদের সারা গায়ে

 

হঠাৎ নিঃশব্দে গাড়িটা থেমে গেল। আমি সটান মণিলালের দিকে চাইলাম, তাঁর হাতদুটো স্টিয়ারিং এর ওপরেই যেন জমে কাঠ হয়ে গিয়েছে। পা দুটি থরথর করে কাঁপছে, হাঁটুর সঙ্গে হাঁটু বার বার ঠোকা খাচ্ছে

 

অবস্থা বেগতিক দেখে নিরুপায় হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম গাড়ির সিটে। একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম সামনের সেই মূর্তিগুলোর দিকে। একসময় যেন মনে হলো তুমুল তর্ক বেঁধেছে মূর্তিদুটোর মধ্যে, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে একে অপরকে কি যেন বোঝাচ্ছে তারা। গাড়ির জানলার কাঁচ নামানো থাকা সত্ত্বেও তাঁদের একটি কথাও কেন জানিনা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না

 

এমন ভাবেই খানিক্ষন চলল। তারপর হঠাৎ সেই মূর্তিদুটির মধ্যে একজন চোখের পলকে ব্রিজের রেলিং ডিঙিয়ে ঝাঁপ দিলো ময়ূরাক্ষীর জলে। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় মূর্তিটাও ঝাঁপ দিল নদীতে

 

এবং পরমুহূর্তেই যেন শুরু হলো তান্ডব। হঠাৎ করে কাঁপতে শুরু করল গোটা ব্রিজটা, ঠিক যেন মহাজাগতিক কোনো দানব এসে পড়েছে এই ব্রিজের ওপর

 

বাবু... এবার ভেঙ্গে পড়বে বাবু। বাঁচাবোনা আমরা বাবু। আপনাকে বলেছিলাম আমি, বলেছিলাম এ রাস্তা না ধরতে। শুনলেন না কেন বাবু.... শুনলেন না কেন ? হায় রে হায়...”

 

ঠাৎ করে তারস্বরে বুক চাপড়ে চেঁচিয়ে উঠল মণিলাল। ওর এরকম অদ্ভুত আচরণ দেখে অমিও হতচকিত হয়ে পড়লাম

 

মণিলালের বলা সেই কাহিনীগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। তবে কি সেগুলো মনগড়া গপ্পো ছিলনা ?

 

আর সাত পাঁচ ভাবার সময় নেই, রীতিমতো আদেশ করলাম মণিললকে  - “ গাড়ি স্টার্ট করো মণিলাল। তাড়াতাড়ি। এই ব্রিজ যত জলদি সম্ভব পার হতে হবে, মণিলাল.... “

 

গাড়ির অ্যাকসিলেরে চাপ দিতেই ছুটল গাড়ি। এদিক ওদিক তাকানোর সময় নেই তখন, মনে হতে লাগল যেন ব্রিজের এক একটা ইঁট ঢালাই খসে পড়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে পুরো ব্রিজটাই। পেছনে তাকালে হয়তো দেখবো ব্রিজের অর্ধেক অংশ ইতিমধ্যে ভেঙ্গে গিয়েছে

বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি, সেই মুহূর্তেই একটা বিকট শব্দ করে গাড়ির ব্রেক কষলো মণিলাল

 

চোখ খুলতেই প্রথমেই জানলার বাইরে চোখে পড়ল ধবধবে সাদা থামওয়ালা একটি মন্দির। ভোরের মৃদু আলো মন্দিরের চূড়ার মাথায় প্রতিফলিত হয়ে একটি অপরূপ আলো আঁধারির নকশা সৃষ্টি করেছে। এটাই সেই মণিলালের বলা সাঁইবাবার মন্দির

 

হাতঘড়ি তে সময় দেখলাম, ভোর পৌনে চারটে

 

স্টিয়ারিং-এ মাথা রেখে চেতনা হারিয়েছে মণিলাল। আজ যদি এই মানুষটা না থাকতো তাহলে হয়তো এই জীবনের মতো মাকে আর দেখতেই পেতাম না

 

ধন্যবাদ মণিলাল, ধন্যবাদ “- মনে মনে বললাম

 

গাড়ি থেকে নেমে পেছনে তাকাতেই বুকের রক্ত যেন ঈষৎ ছলকে উঠল। সাঁইরাম সেতু !!  সেতো ভেঙ্গে পড়েছিল ঘন্টা খানেক আগেই। কিন্তু ওই তো জ্বলজ্যান্ত সেতুটা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই মন্দিরের মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টি করে। তবে গত রাতে এসব কি ঘটল আমাদের সাথে? আর  মণিলালের কথা অনুযায়ী সেতু ভেঙ্গে আমাদের গাড়ি জলে পড়ে যাবার কথা, কিন্তু সেটাও তো হলনা

 

মণিলালের বলা আরও একটা কথা মনে পড়তেই মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠল । মনে মনেই বললাম - “ভাগ্গিস বিয়ে টা করিনি.... “।

 

  

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন