কেন যে আজ নবারুণের রমলার কথা এত মনে পড়ছে! সেই রূপটা, সেই লাল কস্তা পাড় গরদের শাড়ি অল্প ঘোমটা দিয়ে সাধারণ করে পরা, ঠোঁট রাঙানো পানে, কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ। আহা! দেবী মূর্তি। মনে হল যেন সামনেই দোলনাতে বসে আছে। ভাবনায় ছেদ পড়ল রান্নার মাসী চিন্তার কথায়
“ দাদা টিফিন খেলেন না? ঠান্ডা হয়ে গেল যে!”
“নাহ্! ভালো লাগছে না। নিয়ে যা।”
“অন্য কিছু বানিয়ে দেব?”
“না। কিছু লাগবে না।”
আজ আর ভালো লাগছে না কথা বলতে। অন্য দিন ছোট ছোট কথা বলেন যদিও।
রমলার ইচ্ছেতেই এই বাড়ি। ছেলে, মেয়ে, তাঁদের নিজেদের আলাদা আলাদা ঘর, কিচেন, ডাইনিং, সামনে পেছনে ছোট্ট বাগান, দোতলার এই ঝুলবারান্দা যেখানে এখন তিনি বসে, এখানের চায়ের ব্যবস্থার জন্য বেতের ছোট নীচু গোল টেবিল, চেয়ার, দোলনা, সব রমলার ইচ্ছা অনুযায়ী।
কিন্তু, কি লাভ হল? ছেলে বস্টনে। বিয়েও ওখানে। এদেশে আর আসবে কিনা সন্দেহ। মেয়ে নিউ ইয়র্কে। ওরা কালে ভদ্রে আসে। অবশ্য দুজনেই বারে বারে বলেছিল ওখানে গিয়ে থাকতে। ওঁরা ছেলে মেয়ের কাছে বেড়িয়ে এলেও। থাকার ইচ্ছে হয় নি।
আজকাল নবারুণের একটু একা একা বোধ হয়। কেউ নেই যার সঙ্গে দুটো কথা বলা যায়! রমলার হাসি মুখটা যেন দেখতে পাচ্ছেন নবারুণ।
রমলার অনুযোগ যেন উনি শুনতে পেলেন। সত্যি রমলা বড় একা একাই চলে গেল! যত দিন চাকরি করেছেন, তত দিন তো সময়ই ছিল না। সংসার, সন্তান, বাড়ি, সব রমলা বিনা অনুযোগে একা হাতে সামলেছেন। কিন্তু, অবসর গ্রহণের পরও নবারুণ নিজেকে নানা অকাজের কাজে ব্যস্ত রেখেছিলেন। প্রধান ছিল পাড়ার ক্লাব। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্র জয়ন্তী, রক্ত দান ইত্যাদি অজস্র অনুষ্ঠান ও ব্যস্ততা। বাড়িতেও প্রায় দিনই জন সমাগম লেগে থাকত। আর, রমলাও নিপুণ হাতে অতিথি পরিচর্যা করত। শেষাশেষি বিরক্ত হত। কিন্তু, ওনার সময় ছিল না গিন্নির অনুযোগ শোনার জন্য।
তবে যেদিন ক্লাব মিটিং শেষে বাড়ি ফিরে দোর ভেঙে রমলাকে নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে
হল, তার পর পনের দিন উনি ওঁর এতকালের সাথী গিন্নির পাশ
ছেড়ে ওঠেন নি। কিন্তু, রমলা আর চোখ খুলে তাকান নি।
আজও বুঝতে পারেন না এমন ভুল কি করে করলেন! রমলার বিরক্তি আর অসুস্থতার মধ্যে তফাৎ বুঝতে
পারলেন না? নিজেকে ক্ষমা করা কঠিন বোধ করেছিলেন যখন এক অল্পবয়শী
যুবকের বেফাঁস কথায় প্রকাশ পেয়েছিল যে ওঁর বাড়ির জন সমাগম পুরোটাই ওঁর জন্য নয়, অনেকটাই রমলার অতিথি সৎকারের অতুলনীয়তায়। আর এখন, যখন কালে ভদ্রে কেউ এসে উঁকি দেয়, তো নিজেই সেটা বুঝতে পারছেন।
“দাদা চা দিলাম”।
“দোরটা টেনে দিয়ে যাস।”
“আচ্ছা। কিন্তু আপনি আজ জল খাবার খেলেন না। তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে নেবেন। দেরী করবেন না যেন।” বলে চিন্তা চলে যায়।
টুক টুক আওয়াজ পেয়ে নবারুণ দেখেন তাঁর হাতটা থিরথির করে কাঁপছে। চায়ের কাপটা আস্তে করে সাবধানে নামিয়ে রাখেন। রেখে খবরের কাগজটা খোলেন। হাতটা কাঁপছে। কাগজটা নামান টেবিলে। আবার শুনতে পান রমলার অনুযোগ
“এখন কাগজ রেখে দেওয়া কেন? পড়!”
দু তিনখানা খবরের কাগজ নিত্য পাঠ করা চাই তাঁর। এখন মনে হল সময়ের কি অপচয়! আস্তে আস্তে ভাঁজ করে কাগজটা টেবিলে রাখেন। তার ওপর চশমাটা খুলে রাখেন।
বড় অস্থির লাগছে। বুকটা খামচে ধরলেন। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলেন একটু। তারপর উঠে এলেন ওখান থেকে। রমলা এসে তাঁর হাতটা ধরলেন। দুজনে রওনা হলেন অসীমের উদ্দেশে।
পড়ে থাকল একটি শরীর।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন