স্মৃতির অন্তরালে

 

যখন ছোট ছিলাম, বেশ কিছু আত্মীয়-বাড়ির অবস্থা আমাদের মতই খারাপ ছিল। কাঁচা মাটির দেওয়াল, উপরে টিনের ছাদ, আর স্থানে স্থানে কিছু ফুটো। বাইরে কিছু ফল বা ফুলের গাছ। একটা সাদা কালো টিভি আর হলভর্তি গ্রামের লোক। রবিবারটা আরো স্পেশাল। সেদিন সিনেমার ব্যাপার থাকতো।

 

বাবার একটা বহু পুরোনো স্কুটার ছিল, ওটাতেই আমাদের সবার দিব্যি যাওয়া আসা হয়ে যেত। আসলে ঠাসাঠাসি করে বসলেও ভেতরে একটা আলাদাই অনুভূতি ও উত্তেজনা থাকতো।  আত্মীয়দের প্রায় সকলের বাড়ির অবস্থা আমাদের মতই মোটামুটি, কিন্তু বাড়িতে খেলার সাথী অনেক। টানটা ছিল হৃদয়ের।

 

হঠাৎ সবকিছু পরিবর্তন হয়ে সবাই খুব আধুনিক হয়ে গেল। বাড়ি ঘর ফটাফট চেঞ্জ হয়ে পাকা হয়ে গেল। ভিতরে টাইলস ও পাথরের জৌলুস মসৃণ মেঝেতে পা পিছলাতে লাগলো। পা পিছলাতে পিছলাতে কখন মনটাও জোর ঠোক্কর খেয়ে সরে এসেছে ওসব বাড়ি থেকে মনে নেই। শুধু মনে আছে আত্মীয়-বাড়ির ভীষণভাবে ভালোবাসার সেই পেয়ারা বা আমগাছটার কথা, যেটা আধুনিকতার চক্করে পড়ে প্রাণ দিয়েছে বেঘোরে। উঁহু, আসলে সেও সরে এসেছে মসৃণ মেঝেতে পা পিছলে যাওয়ার ভয়ে।

 

কিছু সময় মনে হয় আসল টানটা ছিল ওই মাটির বাড়ির, আমাদের বাঁদরামির সঙ্গী কিছু গাছের আর তখন পড়াশোনা লাটে ওঠানো কিছু খেলার সাথীর। অবশ্য পড়াশোনা লাটে ওঠানো মানেই যে জীবনটা লাটে ওঠানো নয় সেটা এখন তাদের দেখলেই বোঝা যায়। তবে তখনকার দিনগুলো আলাদাই ছিল। অন্ধকারে ভরা বর্ষায় গুটিসুটি মেরে বসে আছি ক'জনে। কিম্বা হাড়কাঁপানো শীতে দু'এক জায়গায় তুলো বের হওয়া একটা লেপ নিয়ে মারপিট করতে করতে ঘুমিয়ে গেছি। আর বিকালে এ গাছ সে গাছ করতে করতে ফল পাড়া। আসলে উদ্দেশ্য ফল পাড়া নয়, গাছে উঠে হৈ-হুল্লোড় করা।

 

আসলে সেই বাড়িগুলোর প্রতিটা কোনায় লেগে থাকতো সুখ দুঃখের প্রলেপ। সুখ বলতে মানুষ বুঝতো প্রতিদিনের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা। কয়েকদিনের পরিশ্রমে একটা চেয়ার কেনা হলে সেটাতেই অনেক মায়া লেগে থাকতো এবং আত্মীয় এলে ওটাকেই আগে বাড়িয়ে দেওয়া হতো। এটাই ছিল আন্তরিকতা। তাই তখনকার মাটির বাড়ি, ফুটো টিন , ইঁট কাঠ, সদরে লাগানো গাছ প্রত্যেকটিতে লেগে থাকত সুখ দুঃখের গল্প।

 

কে বলে জড় বস্তুর প্রাণ নেই!! আমি তো তাদের সাথেই দিব্যি হৃদয়ের যোগ পেতাম।


কলমে - সা য় ন  দে

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন