অলংকরণ – দেবাশীষ দেব ( আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত)
দেবী ষষ্ঠী বাঙালি হিন্দু পরিবারের মায়েদের কাছে যুগ যুগ ধরে পরম
পূজনীয় ও আদরণীয়।
এই দেবী বাংলার ঘরে ঘরে সন্তানের মঙ্গল কামনায় বিভিন্ন রূপে পূজিত হন। সাধারণত, জ্যৈষ্ঠ, ভাদ্র, অশ্বিন, অগ্রহায়ন, মাঘ ও চৈত্র মাসের শুক্লা
ষষ্ঠী তিথিতে এই দেবীর পূজা হয়। তবে, মাস ভেদে একই দেবীর বিভিন্ন নাম ও বিভিন্ন পূজা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা
যায়।জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই দেবীর পূজা জামাই ষষ্ঠী নামে
অধিক প্রচলিত।এই ষষ্ঠীই আবার পূর্ববঙ্গে “অরণ্য ষষ্ঠী ” নামে পরিচিত।এই ষষ্ঠীর
পূজায় তালপাতার হাতপাখা, আম ইত্যাদি প্রয়োজন হয় বলে একে অনেক জায়গায় “আম ষষ্ঠী”, “পাখা ষষ্ঠী” এই সব নামেও উল্লেখ করা হয়।
আজ আপনাদের বহুকাল পূর্বের এক কাহিনী শোনাতে চলেছি। লিপিকারের নাম বোধকরি কালচক্রে লুপ্ত হয়ে গেছে। তবু যতটা সম্ভব সেই বৃত্তান্ত পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। জামাইষষ্ঠীর তিথিকে কেন্দ্র করে সম্ভবত এই কাহিনী রচিত হয়েছিল।
গ্রাম বাংলার একটি নিস্তরঙ্গ কুটিরে জামাইষষ্ঠী উপলক্ষ্যে আগত সস্ত্রীক চার জামাতা। সেই চারজন জামাতার নাম যথাক্রমে ছিল হরি, মাধব, পুণ্ডরীকাক্ষ এবং ধনঞ্জয়। গৃহস্বামী অর্থাৎ সেই চার ব্যাক্তির শ্বশুর তাদের আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখলেন না। কিন্তু সেই আদর যত্নে তৃপ্ত জামাতারা শ্বশুরালয় ত্যাগ করবার আর লক্ষণ দেখাল না। সামান্যতম চক্ষুলজ্জাটুকু না থাকার দরুন তারা আমোদে আহ্লাদে অহোরাত্র অতিক্রান্ত করতে লাগল। অবশেষে বেগতিক দেখে গৃহস্বামী এদের অপসারণের পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হলেন।
মৃদু উপেক্ষার সহিত সেই বিতাড়ন প্রক্রিয়া আরম্ভ হল। প্রথমত অন্নে ঘৃত দেওয়া বন্ধ হল। এই প্রকার পদক্ষেপে অপমানিত হয়ে বড় জামাতা হরি গৃহত্যাগ করল। ক্রমে তার সহিত যুক্ত হল আহারকালে পিঁড়ির অনুপস্থিতি। পিঁড়ি না থাকায় রাগত হয়ে মেজো জামাতা মাধবও বিদায় গ্রহণ করল। এরপর শুরু হল দুর্গন্ধময় দ্রবীভূত অন্ন দেওয়া। যার ফলে তৃতীয় জামাতা পুণ্ডরীকাক্ষও শ্বশুরালয় ত্যাগ করল।
কিন্তু কনিষ্ঠ বাবাজীবন ধনঞ্জয়ের যেন সব অপমান সহন করবারই অসম্ভব ক্ষমতা আছে। পরিশেষে এতকিছু সত্ত্বেও যখন তার বিদায় নেওয়ার কোন সম্ভাবনাই দেখা দিল না। তখন তার ক্রুদ্ধ শ্বশুর তাকে পিটিয়ে নিজের গৃহ থেকে তাড়ালেন। এই বৃত্তান্তটিকে ভিত্তি করে একটি শ্লোকও উৎপন্ন হয়েছিল যার চারটি পংক্তিতে সম্পূর্ণ কাহিনীটিই অন্তর্নিহিত আছে।
হবির্বিনা হরি যাতি
বিনা পীঠেন মাধবঃ
কদন্নে পুণ্ডরীকাক্ষ
প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ।
যাইহোক, প্রকৃতির আপন নিয়মে কালচক্র থেমে থাকেনি। সময় বদলেছে, যুগঅ বদলেছ, আর বদলেছেন জামাইরাও। সেই যুগের মত নির্লজ্জ কানকাটা তাঁরা হননা হয়ত, তাঁদের বিদায় করতে তাই "প্রহারেণ ধনঞ্জয়" প্রবাদ স্মরণ করে হাটুরে প্যাঁদানির প্রয়োজনও পড়েনা। এই যুগের জামাইরা তাই নিজগুনেই প্রতিভাত। তাই জামাইষষ্ঠীতে জামাই আপ্যায়নে যাতে ত্রুটি না থাকে তাঁর জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে এলাহি খাবারে আয়োজন।
যদিও বঙ্গদেশে এই ব্রত সন্তান কামনায় পূজার বিশেষ আচার বিধি পালনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, কিন্তু কালক্রমে তা জামাইদের ভুরিভোজে পরিণত হয়।জামাই আপ্যায়নে যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে তার জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতি বাড়ীতে খাবার দাবারের ভিন্ন ভিন্ন পদের সমাহার থাকে। যেমন –
প্রাতঃরাশে ফুলকো লুচি বা পুর ভরা বা মুচমুচে স্তরে
স্তরে ভাজা ঢাকাই পরোটা, বেগুন ভাজা, আলুর দম, ছোলার ডাল, ক্ষীরের পায়েস, রাজভোগ, পোড়া আমের শরবত অথবা আম,
জাম, জামরুল, কাঁঠাল প্রভৃতি
মরশুমি ফলের সমাহারে ।
মধ্যাহ্ন ভোজে সরু গন্ধমাখা
চালের ভাত, ঘি, ঝুরঝুরে আলু ও বাদাম ভাজা, শুক্তো, লাল শাক দিয়ে মাছের ডিম ভাজা, মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগ ডাল, মোচার ঘণ্ট,চিংড়ির মালাইকারি, ইলিশ ভাপা, চিতলের
মুইঠ্যা, বাসন্তী পোলাও বা শাহী বিরিয়ানী, রেওয়াজি খাসির কষা মাংস বা পাঁঠার মাংসের
রোগান জোস, আনারস- আমলকির চাটনি,নরম ছানামাখা সন্দেশ, পেস্তা
সন্দেশ, শাহি
রাজভোগ, আমদই, বেনারসি
পান।
বিকালে এলাচ – লবঙ্গ ও মালাই মিশ্রিত চায়ের
আসর জমে ওঠে মাছের কাটলেট, মুরগীর মাংসের পকোড়া বা কুচো চিংড়ির চপ সহযোগে।
সন্ধ্যাবেলা জামাইয়ের হাতে দেওয়া হয় রসবড়া, দইবড়া, পাপড়ি চাট, মালাইকাবাব, আইস্ক্রিম
সাজানো থালা।
নৈশভোজের থালা ভোরে ওঠে রুমালি রুটি, বাটার নান, মাংসের পুর ভরা কুলচা, মুরগীর মাংসের রেজালা,শিক কাবাব, পনীর টিক্কা, ডিমের
দোপিয়াজা, স্যালাড, রসমালাই, মিহিদানা, পানতুয়া, পুডিং এবং
অবশ্যই রুপালী তবক দেওয়া মিষ্টি পানের সমাহারে।
তবে ইদানিং শাশুড়ি মায়েরাও আধুনিকা
হয়েছেন।জামাইদের রসনার স্বাদেরও বদল ঘটেছে। ঐতিহ্যপূর্ণ বঙ্গীয় খাবারের তুলনায়
নিত্য নতুন দেশী বিদেশী খাবার জামাইয়ের পাতে সাজিয়ে তাঁদের উদর ও মনের তৃপ্তির
দিকে নজর দিতে শুরু করেছেন। এই তাগিদেই নতুন নতুন রান্নার খোঁজও শুরু হয়েছে। শুরু
হয়েছে এক শাশুড়ির মায়ের সাথে অন্য শাশুড়ি মায়ের রন্ধন প্রতিযোগিতা। কে কত নতুন
বৈশিষ্টপূর্ণ রান্না খাইয়ে জামাইয়ের মন জয় করতে পারবেন। তাই আজ রইল কিছু অন্যন্য
স্বাদের বাহারি মাছের পদ
ও মিষ্টি, যা জামাই ষষ্ঠীর দিনে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।
ভেটকির মিউনিরে
বাঙালির প্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ
রায়ের প্রিয় একটি পদ এবার জামাই ষষ্ঠীর মূল আকর্ষণ হয়ে উঠুক।
উপকরণঃ
- ভেটকি মাছের ফিলে – ২৫০ গ্রাম
- নুন – পরিমাণ মত
- গোল মরিচ গুঁড়ো - পরিমাণ মত
- ময়দা – ৫০ গ্রাম
- মাখন – ৫০ গ্রাম
- পার্সলে পাতা কুচি – ২ টেবিল চামচ
- লেবুর রস – ১ টেবিল চামচ
প্রণালীঃ
- মাছের ফিলে ধুয়ে নুন ও গোলমরিচ গুঁড়ো মাখিয়ে নিতে হবে। ময়দা দিয়ে ভালো করে মাছের ফিলের গাঁয়ে আস্তরন করে দিতে হবে।
- প্যানে অর্ধেক মাখন গরম করে তার মধ্যে মাছের দুই দিক সোনালী রঙের ভেজে নিতে হবে।
- প্যানে বাকি মাখন দিয়ে গলিয়ে নিয়ে আঁচ বন্ধ করে প্রথমে কুচোনো পার্সলে পাতা ও পরে লেবুর রস দিয়ে একটু মিশিয়ে সস তৈরি করে নিতে হবে।
- ভাজা মাছের টুকরোর উপর পার্সলে পাতার সস ঢেলে দিতে হবে। গরম গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করতে হবে ভেটকির মিউনিরে।
- কেউ পছন্দ করলে অল্প টমেটো কুচি ও পেঁয়াজ
কুচি পার্সলে সসের সাথে মিশিয়ে দিতে পারেন।
ভাপা আম – চিংড়িঃ
চিংড়ি ভাপা বাঙালির হেঁশেলের অতি পরিচিত একটি পদ।তবে গ্রীষ্মের দিনে কাঁচা আম মিশিয়ে রান্না করলে ভাপা চিংড়ির স্বাদ একেবারেই বদলে যায়।
- বাগদা চিংড়ি: ১০-১২টি ( বড় মাপের)
- সর্ষে বাটা: ৩ টেবিল চামচ
- পোস্ত বাটা: ৬ টেবিল চামচ
- কাঁচা আম: ১টি
- কাঁচা লঙ্কা বাটা: ১ টেবিল চামচ
- সর্ষের তেল: ৩ টেবিল চামচ
- চেরা কাঁচা লঙ্কা: ৪-৫টি
- হলুদ গুঁড়ো: ১ টেবিল চামচ
- নুন: পরিমাণ মত
প্রণালী:
- একটি কাঁচা আমের অর্ধেকটা সরু সরু করে কেটে নিতে হবে।বাকি অর্ধেকটা বেটে নিতে হবে।
- একটি পাত্রে ভাল করে পরিষ্কার করা চিংড়ি মাছ নিয়ে একে একে তাতে নুন, হলুদ, সর্ষে বাটা, পোস্ত বাটা, কাঁচা আম বাটা, কাঁচা আমের টুকরো, কাঁচা লঙ্কা বাটা, সর্ষের তেল দিয়ে ভাল করে মাখিয়ে নিতে হবে।
- একটি
শক্ত করে মুখ বন্ধ স্টিলের কৌটোতে মাছ সমেত মিশ্রণটি ঢেলে নিয়ে উপর
থেকে কাঁচা লঙ্কা আর সর্ষের তেল ছড়িয়ে দিতে হবে।
- একটি বড় পাত্রে জল গরম করে মুখ বন্ধ কৌটোটি বসিয়ে মিনিট পনেরো ভাপিয়ে নিতে হবে।
- কৌটোর মুখ খোলার পর দুই চামচ কাঁচা সর্ষে তেল দিয়ে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করতে হবে।
মালাই ইলিশঃ
বাঙালি বাড়ির যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে ইলিশ অপরিহার্য।
ইলিশের সর্ষে ভাপাই সব বাড়ীতে বেশী প্রচলিত। কিন্তু তার মধ্যে আরও অল্প কটি উপকরণ
মিশিয়ে দিলেই নতুনত্ব আনা সম্ভব হবে।
উপকরণঃ
- ইলিশ মাছ – ৮ – ১০ টুকরো
- সাদা সর্ষে ও পোস্ত বাটা - ১ কাপ
- নারকেলের দুধ - ১ কাপ
- টক দই - ১ কাপ
- কাঁচা লঙ্কাবাটা - ২ চামচ
- নুন – পরিমাণ মত
- সর্ষে তেল – ২০০ মিলি
প্রণালীঃ
- মাছের টুকরো ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে নুন ও হলুদ মাখিয়ে নিতে হবে।
- কড়াইতে তেল গরম করে সাদা সরিষা, পোস্ত বাটা, নারিকেলের দুধ, কাঁচা লঙ্কাবাটা ও টক দই একসাথে মিশিয়ে অল্প কষাতে হবে।
- তার সঙ্গে নুন, হলুদ মিশিয়ে দিতে হবে। অল্প জল দিতে হবে।
- নুন হলুদ মাখানো মাছগুলো এর মধ্যে দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। আঁচ কমিয়ে ৫-৭ মিনিট ফুটতে দিতে হবে।
- ঝোল মাখা মাখা হলে আঁচ বন্ধ করে ২ টেবিল চামচ কাঁচা সর্ষে তেল দিয়ে নামাতে হবে।
- গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করতে হবে।
আম
ছানার পায়েসঃ
যে
কোনো শুভ অনুষ্ঠানে পায়েস রান্না করা ভারতীয় ঐতিহ্য বহন করে। শেষ পাতের মিষ্টি হিসাবে
পায়েসও অনেক রকমের রান্না করা হয়। তবে গ্রীস্মকালে আম দিয়ে পায়েস রান্না অভিনবত্ব
অবশ্যই দাবী করে। পাকা আমের মিষ্টত্ব এই পায়েসে পৃথকভাবে মিষ্টি দেওয়ার দরকার
প্রায় পড়ে না। স্বাস্থ্য সচেতন জামাইদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এক রান্না।
উপকরণ
- ছানা: ২৫০ গ্রাম
- পাকা মিষ্টি আম: ৫০০ গ্রাম
- দুধ: দেড় লিটার
- চিনি: ১ কেজি
- ময়দা: ১০ গ্রাম
- জল: আধ লিটার
প্রণালী:
- জল ছাড়া ছানা ও ময়দা এক সঙ্গে মেখে ছোট্ট ছোট্ট রসগোল্লার মত বল গড়ে নিতে হবে।
- অর্ধেক আমের ক্কাথ বানিয়ে নিতে হবে। বাকি আম ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে।
- দুই - তিন চামচ চিনি রেখে দিয়ে সমস্ত চিনি জলে দিয়ে ফুটিয়ে সিরাপ তৈরি করে তার মধ্যে ছোট্ট রসগোল্লাগুলো দিয়ে পাঁচ-সাত মিনিট ফুটিয়ে নরম হলে নামিয়ে রাখতে হবে।বানাতে না পারলে দোকান থেকে ছোট রসগোল্লা কিনে ব্যবহার করলেও হবে।
- বাকি চিনি দিয়ে দুধ ফুটিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানাতে হবে।ঘন দুধ ঠান্ডা হলে আমের ক্কাথ মিশিয়ে নিতে হবে।
- রস থেকে ছোট রসগোল্লাগুলো তুলে আম দুধের মধ্যে দিতে হবে।
- বাটিতে ঢেলে আমের টুকরো সাজিয়ে ফ্রিজে ঠান্ডা হতে দিতে হবে।
- ঠান্ডা ঠান্ডা আম ছানার পায়েস জামাই সহ সকলেরই মন ভরাবে এ কথা বলাই বাহুল্য।
কলমে - বাণী মিত্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন