বই
– হত্যাশাস্ত্র
লেখক
– অভিজ্ঞান গাঙ্গুলী
প্রকাশক
– বুকফার্ম
প্রকাশকাল
– ডিসেম্বর ২০২১
প্রচ্ছদ
– সপ্তদীপ দে সরকার
অলংকরণ
– গৌতম কর্মকার
মুদ্রিত
মূল্য – ৩৪৯ /-
অনেকদিন
ধরে এই বইয়ের নাম শুনছিলাম।পড়ার ইচ্ছা তীব্র হয়ে ওঠার কারণ অবশ্য বইয়ের বিষয়ে শোনা
প্রশংসাসুচক প্রতিক্রিয়া নয়। বইয়ের ট্যাগলাইনটি – “চাণক্য সিরিজ”।কৌতূহল ছিল এটা জানার
যে গোয়েন্দার নামই শুধু চাণক্য নাকি মৌর্য সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থপতি চাণক্যকে নিয়ে
কাহিনী! কিন্তু বর্তমানে আমি এমন জায়গায় থাকি
যেখানে বাংলা অনেক দূরের কথা ইংরাজি বইও ঠিক মত পাওয়া যায় না। তাই হাপিত্যেশ করে বসে
থাকা ছাড়া গতি ছিল না।অতঃপর গতমাসে হঠাৎ কলকাতায় যাওয়া এবং দৌড়ে কলেজস্ট্রিট ভ্রমণ,
অনেক বইয়ের সাথেই “হত্যাশাস্ত্র” নিয়ে ঘরে ফেরা এবং এক দু’পাতা পড়ে দেখি বলে শুরু করে
এক নিঃশ্বাসে রাত জেগে গোগ্রাসে পড়ে ফেলা। এবং তারও পরে আরও একবার পুরো বইটা পড়া। কারণ
অনেক বছর পর সত্যিই খুব সুন্দর আকর্ষণীয় বেশ কয়েকদিন মুগ্ধ করে রাখার মত বই পড়তে পেলাম।
শুরুতেই
বলব যারা ইতিহাস নির্ভর বই ভেবে এই বই পড়তে চাইছেন, তাঁরা পড়া থেকে বিরত থাকবেন। যারা
টানটান উত্তেজনায় ভরপুর নিখাদ রহস্য গল্পে আগ্রহী তাঁদের জন্যই অত্যন্ত উপাদেয় এই বই।বইয়ের
শুরুতে লেখক যে ভুমিকা লিখেছেন সেটা পড়ে মন ভালো হয়ে গেল। কোথাও কোনও জ্ঞান গর্ভ বক্তৃতা
নেই, স্বচ্ছ ঘরোয়া ভাষায় যেন বন্ধুদের সাথে কথা বলছেন, এমনভাবে অল্প কথায় ভুমিকা লিখেছেন।
বইটির উৎসর্গ বাক্যও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। পড়ে হেসে ফেললাম, যে এমন উৎসর্গও কেউ করতে পারেন?
লেখকের প্রতি ভালবাসা তৈরি হল সূচনাতেই। শুরু
হল বই পড়া।
ভারতবর্ষের
ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্য পৃথকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে এবং থাকার অন্যতম
কারণ অবশ্যই কৌটিল্য ওরফে চণকপুত্র চাণক্য। ইতিহাস বিখ্যাত কূটনীতিজ্ঞ সেই চাণক্যকেই
লেখক তাঁর গল্পের মূল চরিত্র অর্থাৎ নায়ক রূপে পেশ করেছেন।৩২২ খ্রিস্টপূর্বে ভারতবর্ষে
নন্দবংশের পতন ও মৌর্য সাম্রাজ্যের সূচনা হয় আচার্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যের দ্বারা। নিজের
অপমানের প্রতিশোধ নিতে তিনি নন্দ বংশের ধ্বংসে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্যের মাধ্যমে। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্য পরামর্শদাতা রূপে রাজসভা
অলংকৃত করার পর চাণক্য স্থির করেন অবসর নেবেন। সেইমতই তিনি অবসরযাপনে রাজ্যের থেকে
অনতিদূরে নিভৃতবাসে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং “অর্থশাস্ত্র” রচনাতে মনোনিবেশ করেন।কিন্তু
রাজ্যের বিপদের সময় তিনি সর্বদা রাজার পাশে সহায়তার জন্য উপস্থিত থাকেন। এই প্রেক্ষাপটেই
লেখক অভিজ্ঞান গাঙ্গুলী রচনা করেছেন তাঁর চাণক্য সিরিজ। বইতে তিনটি বড়গল্প ও একটি উপন্যাসে সমৃদ্ধ।
শলাক-শাস্ত্র: মৌর্য সম্রাটের চিরশত্রু গান্ধারের
রাজা সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়ে দূত প্রেরণ করেন।রাজমহলের অতিথিশালায় সেই দূতের হত্যা হয়।
সন্ধিদূতের মৃত্যু রাজ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করতে অবশ্যম্ভাবী। এই বিপদ থেকে উদ্ধার
করতে চাণক্যকে স্মরণ করেন রাজা । চাণক্য হত্যারহস্যের সমাধানে এসে খুঁজে পান একটি বিষাক্ত
শলাক।যা হত্যাশস্ত্র রূপে চিহ্নিত হয়। কড়া সুরক্ষা ব্যবস্থার মাঝেও কিভাবে এই শলাক দিয়ে হত্যা করা হল, কেনই
বা হল এবং কে করলেন ?
শীল-শাস্ত্র: তোসালির রাজার মৃত্যুতে রাজ্যাভিষেক হবে। মগধের প্রতিনিধি হিসাবে তোসালির দুর্গে অতিথি হয়েছেন চাণক্য। কিন্তু
সেখানে মৃত্যু হল ভাবী রাজার। রাজার মৃত্যু কি স্বাভাবিক
নাকি হত্যা?পরিবেশ – পরিচর্যাকে
ছাপিয়েও যে জিনগত স্বভাব প্রকট হয়ে ওঠে তারই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে এই কাহিনী গড়ে
উঠেছে।
হত্যা-শাস্ত্র: সেই যুগেও ছিল সিরিয়াল কিলার?
এই গল্প সেই রকমই এক ধারাবাহিক হত্যাকারীর যে রাজধানী পাটলিপুত্রর
পথে, গভীর রাত্রে নৃশংস ভাবে
হত্যা করে
একের-পর-এক গণিকাকে।তাঁর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা চাণক্য কিভাবে বুঝবেন?
কনক-শাস্ত্র: 'কনক' অর্থাৎ সোনা। কিন্তু সোনালী বস্তুও কি কনক হতে পারে? কিভাবে? সোনার বিকল্প কিছু কি আছে? এই গল্পে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন কৌটিল্য। প্রাচীনতম
বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশিলায় অতিপ্রাকৃত ভৌতিক ক্রিয়া কলাপে ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রধান আচার্য
চাণক্যের সাহায্য চান। সেই রহস্য সন্ধানে চাণক্য সেখানে গেলে মৌর্য সাম্রাজ্যে গুপ্তহানা
শুরু হয়। কিভাবে চাণক্য দূরে থেকেও সেই খবর পান এবং কিভাবে সমস্ত রহস্যের জাল সরিয়ে
মৌর্য সাম্রাজ্যকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেন তার চমকপ্রদ কাহিনী এই রহস্য উপাখ্যানের
মূল উপাদান।
চারটি গল্পই টানটান উত্তেজনায় ভরা তা বলাই বাহুল্য। বইয়ের কয়েকটি বিষয় পৃথকভাবে ভালো লেগেছে।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল টিকা লিখন।সময়কালকে ধরে রাখার জন্য সেযুগের বিশেষ কিছু শব্দ প্রয়োগ বাঞ্ছনীয় ছিল, তাই তা করা হয়েছে। লেখক প্রতি পাতায় সেই শব্দগুলির অর্থ সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছেন।সেই যুগে ব্যবহৃত প্রচুর নতুন শব্দ ও তাদের অর্থ শিখতে পারলাম।
বিস্তারিত গল্প বলে আমি রহস্য উন্মোচন করতে চাইনা।ইদানিংকালের যে কোনও ইতিহাস নির্ভর গল্পের মত অতিরিক্ত তথ্যের যোগান দিয়ে পাঠককে ক্লান্ত করার থেকে লেখক অব্যাহতি দিয়েছেন। অথচ ঠিক ঠিক জায়গায় সঠিক পরিমাণে তথ্য জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে গল্পের গতি রোধ পায়নি কিন্তু পাঠক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়েছেন।প্রাচীন যুগের সাথে বর্তমানের বিজ্ঞানের এক অনবদ্য মিশেল ঘটিয়েছেন লেখক, কিন্তু তা পাঠককে মূল গল্পের রস আহরণে বাধা দেয় না।
এমন
এক যুগের ঘটনা রচিত হয়েছে যখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়নি। ফরেন্সিক সাইন্স,
মোবাইল লোকেশন ডিটেকশন, হাতের ছাপ,লাই ডিটেক্টর প্রভৃতি এত উন্নত ছিল না বা আবিস্কারই
হয়নি। তাহলে হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার জন্য কি কি পন্থা নেওয়া হত?এই ব্যাপারে অবশ্যই
উল্লেখযোগ্য হল রহস্যভেদীর নিখুঁত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সময় নির্ধারণ, বিচক্ষণতা, বিভিন্ন
বিষয়ে জ্ঞান। সেই পদ্ধতিগুলোর বর্ণনা মুগ্ধ করে দিল।
ঐতিহাসিক
প্রেক্ষাপটে রচিত কাহিনীতে সাধারণত যে ধরণের ভাষার ব্যবহার করা হয় তার থেকে সরে এসে
সহজ সরল স্বচ্ছ ভাষায় লেখক গল্প রচনা করেছেন। যা আমাদের মত সাধারণ পাঠকের পাঠপর্বকে
গতিশীল করে তুলেছে।
টানটান গদ্যে, রহস্যময়, ইতিহাসের তথ্য অবিকৃত রেখে,অতিরিক্ত তথ্যের কচকচানি না
রেখে, যুক্তিনির্ভর ও বিজ্ঞানভিত্তিক এই ধরণের লেখা বাংলা সাহিত্যে সত্যিই কম লেখা হয়েছে। প্রচ্ছদও বেশ রহস্যময় ও
মানানসই। শুধু অলঙ্করন একটু বিসদৃশ্য লাগল।যেমন আঠেরো উনিশ বছরের তরুনদের চেহারা যদি
মধ্যবয়স্কদের মত হয়, তখন আমার মত পাঠক যারা অলংকরণ দেখেই কল্পনায় চরিত্রদের মাধ্যমে
গল্পের পরিবেশ রচনা করে থাকেন তাঁরা একটু ক্ষুন্ন হবেন বৈকি।এই বিষয়ে আর একটু যত্নশীল
হলে বড় ভালো হয়।
বইয়ের পৃষ্ঠার গুণগত মান অত্যন্ত ভালো। পড়ার সাথে সাথে পাঠক বইয়ের পাতাও স্পর্শ করেও যেন আনন্দ পাবেন।
মুদ্রণের বিষয়ে একটি ছোট্ট ত্রুটি নজরে এল। খুব কম সংখ্যক বানান ভুল আছে যা পরবর্তী সংস্করণে আশা করি ত্রুটি মুক্ত হবে। এছাড়া দু'-তিনটি পৃষ্ঠা ঝাপসাভাবে মুদ্রিত হওয়ায় ( double printing / Blurry printing), পড়তে বেশ অসুবিধা হল। এই বিষয়ে যত্নশীল হওয়া দরকার।
আগামী দিনে চাণক্য সিরিজের বইয়ের
অপেক্ষায় থাকব তা বলাই বাহুল্য। লেখককে ধন্যবাদ যে গল্পের ছলে তিনি প্রাচীন ভারতের
এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন যার সম্পর্কে অনেকেই হয়ত জানেন না। যেমন আমি জানলাম কৌটিল্যের
অর্থশাস্ত্রে ফরেন্সিক সাইন্সও আছে। এবং এতদিন এই বইটি কেন পড়িনি তা ভেবে আপসোস করার
সাথে সাথে বইটি পড়াও শুরু করলাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন