ওঁ অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যের্মা অমৃতং
গময়।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ
শান্তিঃ।
হে পরমেশ্বর! আপনি আমাদের এই নশ্বর অসত্য জীবনকে সত্যের পথে উন্নত করুন। মোহময় অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোকময় পথে উন্নীত করুন যাতে এই পার্থিব মৃত্যুলোক থেকে আমরা আধিভৌতিক আধিদৈবিক এবং অধ্যাত্মিক এই তিন অশান্তি থেকে মুক্ত হয়ে অমৃতের পথে পাড়ি দিতে পারি।
সত্য-অসত্য, আলো-আঁধার, মৃত্যু -অমৃতত্ব এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই এ যেন সব জীবেরই কামনা। আর কামনা পুরণের একটিই অন্তরায় আর তা হলো…. অজ্ঞানতা। জীবের বাস্তব অজ্ঞানতা হরণ কল্পেই তো দেবী সরস্বতীর রূপরেখা। সারদা’র বন্দনা। মা দুর্গার কন্যা হিসাবে লক্ষ্মী বা সরস্বতী সম্পর্ক পুরাণাদি কল্পিত হলেও তা কখনোই আমাদের বেদ অনুমোদিত নয়। সরস্বতী স্বয়ং ঋগ্বেদ বন্দিত এক বৈদিক দেবতা। ঋগ্বেদের ১ম মন্ডল এর ৩য় সূক্তের ১০ম থেকে ১২শ ঋক্ থেকে পাই,
“পাবকা
নঃ সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী।
যজ্ঞং বষ্টূ
ধিয়াবসু।।
চোদয়িত্রী সুনৃতানাং
চেতন্তী সুমতীনাং।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।
মহো অর্নঃ সরস্বতী
প্রচেতয়তি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি।।”
অর্থাৎ, পবিত্রা, অন্নযুক্তষজ্ঞবিশিষ্টা, ও যজ্ঞফলরূপধনদাত্রী সরস্বতী আমাদের অন্নবিশিষ্ট যজ্ঞ কামনা করুন। সত্য ও প্রিয়বাণীর (মঙ্গলজনক বা মানব হিতকর কথা) প্রেরণাদাত্রী এবং সৎবুদ্ধির চেতনাদাত্রী মাতা সরস্বতী শুভকর্মকে ধারণ করে আছেন।জ্ঞানদাত্রী মাতা সরস্বতী প্রজ্ঞাশক্তি দ্বারা মহান জ্ঞান সমুদ্রকে প্রকাশ করেন এবং ধারণাবতী বুদ্ধি সমূহকে দীপ্তি দান করেন। সরস্বতী প্রবাহিত হয়ে প্রভূত জল সৃজন করেছেন, এবং সকল জ্ঞান উদ্দীপন করেছেন।
লক্ষণীয়, এই সূক্তের প্রথমে অশ্বিনী-দ্বয়কে, ইন্দ্রদেবকে এবং বিশ্ব দেবগণের উদ্দেশ্যে মঙ্গল প্রার্থনা করে ক্ষান্ত হননি বিশ্বামিত্র ঋষির পুত্র মধুচ্ছন্দা। শেষে, সেই সরস্বতীর আরাধনা। কারণ, তিনি যে ‘চোদয়িত্রী’……. মানে সুমেধার প্রেরয়িত্রী, জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী। তাঁরই কৃপাবলে সত্যের প্রেরণায় সু-মেধার উন্মেষে ও বিদ্যার নিত্য অনুশীলনেই অভীষ্ঠ লাভ করা সম্ভব হয়।
ঋগ্বেদে দুই ধরনের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। সরস্ ধাতু তদুত্তরে অস্থর্থে বতু এবং স্ত্রী লিঙ্গে ঈ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী– এ মত স্বামী নির্মলানন্দের। ঋগ্বেদের ভাষ্যকার সায়ণাচার্যের মতে,
“দ্বিবিধা হি সরস্বতী
বিগ্রহদ্দেবতা নদীরূপা চ।”
তবে, শংকরনাথ ভট্টাচার্যের মতে, সরস + বতী = সরস্বতী। অর্থ জ্যোতিময়ী। অর্থাৎ কিনা, বিকাশে ব্যাকুল গতিময় যে জ্যোতি তিনিই প্রকৃত সরস্বতী। আলোকময়ী বলে সর্বশুক্লা। স্বর্গীয় উমেশচন্দ্র বটব্যালের মতে,
“এক্ষণে যে সকল বৈদিক শব্দ অপ্রচলিত হইয়া দাঁড়াইছে,- তন্মধ্যে ‘সরস’ একটি। ‘সরস’ শব্দের আদিম অর্থ জ্যোতিঃ ; এবং তজ্জন্য সূর্যের একটি বৈদিক নাম “সরস্বান”। সরস্বতী,- অর্থাৎ ‘জ্যোতির্ময়ী দেবতা’।”
বস্তুত, ‘সরস্বৎ’ শব্দটির উপস্থিতি ঋগ্বেদে মাত্র তিনবারের- প্রথম, সপ্তম ও দশম মন্ডলে। প্রথম মন্ডলে এর অর্থ সূর্য হলেও, সপ্তম ও দশম মন্ডলে এর অর্থ পরিবর্তন হয়ে দাঁড়ায় ‘জলাধিপতি’ হিসেবে। যদিও ঋগ্বেদের সংহিতাকারদের মধ্যে এ বিষয়ে অল্প বিস্তর মতান্তর আজও আছে।
বিদ্যা-বুদ্ধি সৃজনীপ্রতিভা চারুকলা বিজ্ঞান তথা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির দেবী সরস্বতী। বেদ আর সরস্বতী অভিন্ন। বেদ-বেদাঙ্গ-বিদ্যার প্রসূতি সরস্বতী। ভূঃ ভুবঃ স্বঃ এই ত্রিলোক জুড়ে জ্ঞানময়ী রূপে তিনি সর্বত্রব্যাপিনী। এই বিশ্বভুবন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শুক্লজ্যোতিতে। তাই সরস্বতীর বিশেষ অর্থ - জোতির্ময়ী।
আবার রূপে লক্ষ্মী হলেও গুণে সরস্বতী। দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক। তাই তিনি শ্বেতবর্ণা, শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা। বীণা ও পুস্তকধারিণী মহাশ্বেতা। বৈদিক জনগোষ্ঠী ভরতদের আরাধ্য বলেই তাঁর আরেক নাম ভারতী। তিনি ‘ব্রাহ্মণ’-এ বাক্ নামে পরিচিতা। দেবী সরস্বতীর সঙ্গে নদী সরস্বতীর এই একাত্মতা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সরস্বতীকে ব্রহ্মার মানসকন্যা হিসাবে কল্পনা করা হয়। অন্যদিকে বেদ বিশেষ করে সামবেদ তো সঙ্গীতরসে সিক্ত সূক্তাবলী। যজ্ঞস্থলে সারস্বত বীণাধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত প্রতিটি স্তোত্র। আবার কেউ কেউ বলেন গন্ধর্ব কিন্নরদের সঙ্গে দেবী সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলেই সরস্বতীর অপর নাম বীণাপাণি। ঋগ্বেদে এবং যর্জুবেদে অনেক জায়গায় ইড়া, ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি। দেবীভাগবতে সরস্বতী জ্যোতিরূপা। ভৃগুপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে। এই উপনিষদে জলে জ্যোতি প্রতিষ্ঠিত, জ্যোতিতে জল প্রতিষ্ঠিত। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী সারদামঙ্গল কাব্যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতীর আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন। রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মতো প্রকাশিত হয়েছিলেন।
খ্রি.পূর্ব তৃতীয়-চতুর্থ সহস্রাব্দে উত্তরপশ্চিম ভারতে এক সুবিশাল তটিনী সরস্বতী। সেখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল। যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্ণাবৃক্ষের নিকটে, তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্ণাবতরণ। জলপ্রবাহ নির্মল স্বচ্ছ পবিত্র। নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠে বৈদিক সভ্যতার প্রধান প্রধান তীর্থক্ষেত্র। এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত বৈদিক সারস্বত যজ্ঞ। এই নদীর জলে পিতৃতর্পণ করা ছিল অতি পুণ্যের কর্ম। ঋকবেদে অবশ্য সরস্বান নামে এক নদীদেবতার কথা আছে। তারই স্ত্রীলিঙ্গ কি এই সরস্বতী? যিনি দেবীশ্রেষ্ঠা ও নদীশ্রেষ্ঠা রূপে স্তূত হয়েছেন – “অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতী।” সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। তাই হয়ত শিক্ষার সঙ্গে সরস্বতীর অচ্ছেদ্য বন্ধন এবং এর জন্যই পৌরাণিক যুগে সরস্বতী বিদ্যার দেবী হয়ে উঠেছেন।
আসলে, ঋগ্বেদের আমলে গঙ্গা বা যমুনার চেয়ে সরস্বতী নদীর প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি। সেইজন্যই হয়তো সরস্বতীর স্তুতি ঋগ্বেদে আছে ৪৫বার যেখানের গঙ্গার উল্লেখ মাত্র দুবার আর যমুনার মাত্র তিনবার। নদীদের মধ্যে তিনি শুদ্ধা, ‘নদীনাং শুচির্যতী’, আসমুদ্র তার ধারপথ, ‘গিরিভ্য আসমুদ্রাৎ’। নিত্যদিন ঊষাকালে সরস্বতী নদীর তট আশ্রমবাসী ঋষি-কুমার আর সাম গায়কেরা তাদের বেদমন্ত্র উচ্চারণে মুখর করে তুলতেন। সনাতন ভারতীয় ধ্রুপদী ঝঙ্কারের সেই শান্ত সামগীতি’র প্রতিক–ই হয়তো এই বীণা। সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত (প্রাচীন ভারতবর্ষ) ছিল গুরুকূল-বাসীদের সাধন এবং অনুশীলনের আদর্শ স্থান। এ তো গেল সরস্বতী নামের পিছনে থাকা বৈদিক ছোট্ট ইতিহাস। আবার, মহাভারত থেকে এমনও জানা যায় যে সরস্বতী এবং দৃষদ্বতি (বর্তমানে লুপ্ত) এই দুই নদীর মধ্যবর্তী পবিত্র সমভূমিতে “সারস্বত যজ্ঞ” অনুষ্ঠিত হতো।
ভারতবিশেষজ্ঞ এইচ. ডি. গ্রিসওয়ল্ড ১৮৯৭ সালে ‘রিলিজন অব দ্য ঋগ্বেদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, সরস্বতী নদীর সন্নিহিত এলাকায় পাঁচটি আর্যগোষ্ঠীর লোকরা সবচেয়ে বেশি সময় থেকেছিলেন, ঋগ্বেদের আদি মন্ত্রগুলি এখানেই জন্ম নিয়েছিল। মিশরের নীলনদ বা মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের মতো আদি বৈদিক সভ্যতার ভরকেন্দ্র হল সরস্বতী। আর্যরা যখন এই নদী পার হলেন, তখনই আর্য ও অনার্যের মিলন ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ভারতীয় সভ্যতার সূচনা হল। বেদের যুগের লোকেরা তার উভয় তীরে বাস করেন, ‘অধিক্ষিয়ন্তি পূরবঃ’। তাঁরা জানেন সরস্বতীর গর্ভে আছে যাবতীয় রত্নসম্ভার, বরেণ্য সম্পদ। তাই তারা সরস্বতীর জলকে মাতৃস্তন্যের মতো পান করতে চেয়েছে- ‘যস্তে স্তনঃ... সরস্বতী তমিহ ধাতবে কঃ॥’ আবার সেই সরস্বতীর বন্যার সময় দুকূল প্লাবিত করে তাদের যাতে উৎখাত না–করে, সে প্রার্থনা করতেও সেই মানুষগুলো ইতস্তত করেনি— ‘মা অপস্ফরীঃ পয়সামান আধক্’।
সারস্বত সমভূমি ছিল অতি ঊর্বরা। কৃষিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। এই কারণে সরস্বতী একসময় কৃষিদেবী হিসাবে পূজিত হয়েছেন। মেয়েরা ‘সারস্বত ব্রত’ পালন করতেন উত্তম ফসল প্রাপ্তির আশায়। আবার সরস্বতী আরোগ্য শুশ্রুষারও দেবী। শুক্লযজুর্বেদে সরস্বতী দেববৈদ্য অশ্বিদ্বয়ের স্ত্রীরূপে পরিচিত। ইন্দ্র তাঁর পুত্রসন্তান। একদশ শতকে রচিত কথাসরিৎসাগর গ্রন্থ থেকে জানা যায় পাটুলীপুত্রের নাগরিকরা রুগ্নব্যক্তির চিকিৎসার জন্য যে ঔষধ ব্যবহার করতেন তার নাম ছিল সারস্বত। দেবীর সঙ্গে চিকিৎসাশাস্ত্রের এখনো যোগ লক্ষ্য করা যায়। পুজোর উপকরণে বাসক ফুল ও যবের শিষ আম্রমুকুল প্রদানে। আয়ুর্বেদে এগুলির ভেষজ মূল্য অপরিসীম।
কাজেই বৈদিকসভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সরস্বতী নদী। দুই তীরে গড়ে উঠেছিল লতাকুঞ্জে ঘেরা সারস্বত তপোবন। ঋষিরা সেখানে বেদপাঠ করতেন। সূচনা ও সমাপ্তিতে করতেন সরস্বতী নদীর বন্দনা। রচনা করতেন বৈদিক সূক্ত। মহাজাগতিক ভাবরসে পুষ্ট মন্ত্রগাথা। কালক্রমে নদী হয়ে গেলেন বিদ্যার দেবী। বেদের দেবী। একসময় অভিনয়ের দেবী হিসাবেও সরস্বতী পূজিত হতেন। বাৎসায়নের কামশাস্ত্র থেকে জানা যায় তৎকালীন রঙ্গমঞ্চের সাধারণ নাম ছিল সারস্বতভবন। বেদের উষাকেও পরবর্তীতে সরস্বতী রূপে পাই। তাই উষার মতো সরস্বতীও শুভ্র এবং জ্ঞানের প্রতীক। সেই কারণে সরস্বতী একদিকে সূর্যের কন্যা ও অন্যদিকে স্ত্রী।
অবশ্য এই দেবায়নের অন্যতম কারণটি হলো ধীরে ধীরে সরস্বতী নদীর অবলুপ্তি। মহাভারত রচিত হওয়ার আগেই নাকি সরস্বতী নদী লুপ্ত হয়ে যায়। তবে কয়েকটি স্রোতধারা প্রবাহিত হয় ভিন্ন নামে যেমন চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ নামে। রবীন্দ্রনাথ যেন সরস্বতীকে স্মরণ করেই লিখেছিলেন – ‘যে নদী মরুপথে হারালো ধারা...’। রাজস্থানের মরুভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতী অদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়, আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়। তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লক্ষ্ণপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে, সেইস্থানটি বর্তমানে রাজস্থানের ভটনোর মরুভূমির মধ্যে পড়ে। মনুসংহিতা ও মহাভারতেও বিনশন তীর্থে সরস্বতী নদীর বিলুপ্তির কথা আছে। ‘তাণ্ড্যমহাব্রাহ্মণ’ অনুসারে দিনরাত ঘোড়া ছুটিয়ে গেলে বিনশন থেকে প্লক্ষপ্রসবণে পৌঁছোতে সময় লাগত চুয়াল্লিশ দিন। লাট্যায়ণের শ্রৌতসূত্র মতে, সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিতা, তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন যা কেউ দেখতে পায় না, তাকেই বিনশন বলা হয়। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে, একমতে খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে। মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে। নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে। বোট, লুভ্ডিগ, গ্রাসমান–রা বলেন আজকের সিন্ধুই সেদিনের সরস্বতী। সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী। আবার কারও কারও মতে, সরস্বতী ভারতে নয়, প্রবাহিত হত আফগানিস্তানে। ‘আবেস্তা’–তে ‘হরকতী’ নামে একটা নদীর উল্লেখ আছে। ভারতীয় উচ্চারণে একদা আফগানিস্তানে প্রবহমান ‘হরকতী’–ই সরস্বতী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়টা বেশ জটিল, বিতর্কিতও বটে।
“গঙ্গে
চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি।
নর্মদে সিন্ধু কাবেরি
জলেস্মিন্ সন্নিধিং কুরা।।”
গঙ্গা,
যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু ও কাবেরী এই সাতটি ভারতবর্ষের সবচেয়ে পবিত্র নদী। সংস্কার এরুপ যে স্মরণ করলেই এদের আবির্ভাব
হয়। সরস্বতী ছাড়া বাকিরা দৃশ্যমান। কেবল সরস্বতী অদৃশ্য। তবে লুপ্ত হয়ে
গেলেও ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আজও তাঁর নাড়ির টান অটুট। লোকবিশ্বাসে গঙ্গা ও
যমুনার সঙ্গে সরস্বতী যুক্তবেণী রচনা করেছে এলাহাবাদের প্রয়াগে। মুক্তি ঘটেছে
হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে। সরস্বতী নাম নিয়ে আদিসপ্তগ্রাম অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে
চলেছে। গবেষকরা মনে করেন, বর্তমান সরস্বতীর খাতেই প্রবাহিত
হত প্রাচীন ভাগীরথী। সরস্বতী নদীর তীরে ত্রিবেণী মগড়া আদিসপ্তগ্রামে সরস্বতী পুজোর
ব্যাপকতা কি এই কারণে?
এরপরে এলো পুরাণ এর আধিপত্য। বৈদিক সরস্বতী অভিন্ন হয়ে ওঠেন পৌরাণিক বাগদেবী বরদা বাগেশ্বরীর সঙ্গে। কালক্রমে সরস্বতী হয়ে ওঠেন ভাষার দেবী। বাক্য দিয়ে সজ্জিত হয়ে ওঠে ভাষা। সরস্বতী তাই বাক্যদেবী। এই কারণে বলা হয়েছে – ‘বাক হি সরস্বতী’। স্কন্দপুরাণে সরস্বতীর উৎস হলেন বিষ্ণু এবং সরস্বতীর অবস্থান হল বিষ্ণুর জিহ্বাতে। নারদপুরাণে বলা হয়েছে, চরম অবস্থায় রাধা এবং কৃষ্ণ একই দেহে বিরাজ করেন এবং তাঁদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। এই অবস্থায় রাধা থেকে পাঁচটি রূপ আবির্ভূত হয়। তাঁরা হলেন– লক্ষ্মী, দুর্গা, সাবিত্রী, সরস্বতী এবং রাধার নিজেরই আর-একটি রূপ। কারও কারও মতে শক্তির রূপভেদ পাঁচটি নয় আটটি। যেমন –শ্রীদেবী, ভূদেবী, প্রীতি, কৃতি, শান্তি, তান্তি এবং পুন্তি।
বামনপুরাণে বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠের কোন্দলের ঘটনা উল্লেখ আছে। বশিষ্ঠ তাঁর আশ্রমে একটি প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ এবং সরস্বতীর একটি বিরাট মূর্তির পুজো করতেন। বশিষ্ঠের ওখানে এভাবে পুজো করা বিশ্বামিত্রের মনে ক্রোধ উৎপন্ন হওয়ায় তিনি নদী সরস্বতীকে বলেন বশিষ্ঠকে ধরে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। যাতে উপযুক্ত সাজাটা তিনি বসে বসেই দিতে পারেন। সরস্বতী বিশ্বামিত্রের ক্ষমতা জানতেন। তাই তিনি বিশ্বামিত্রের কাছে বশিষ্ঠকে নিয়ে যেই হাজির হলেন অমনি বিশ্বামিত্র তাঁকে (বশিষ্ঠকে) হত্যার জন্য একটা অস্ত্র আনতে গেলেন। ইত্যবসরে সরস্বতী, যিনি ছিলেন নদী, তিনি নিজের জলধারার মাঝে বশিষ্ঠকে লুকিয়ে রাখলেন। বিশ্বামিত্র রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলেন সরস্বতীকে– সরস্বতী এবার রক্তনদী হবেন। আর যত অসুর রাক্ষস আছে, তাঁদের পান করে স্ফুর্তি করবে। সেটাই ফলে গেল! শেষে একদল সাধুর প্রার্থনায় সৃষ্টি হল প্রয়াগে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গম –আর যত দুরাত্মা সেখানে স্নান করল এবং সবাই পবিত্ৰাত্মা হয়ে গেল।
'পদ্মপুরাণ’, ‘বায়ুপুরাণ’. ‘গরুর পুরান’, ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ সহ আর ও অনেক পুরাণেই সরস্বতী নামের উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পড়ে। পদ্মপূরাণে তিনি দক্ষকন্যা, কাশ্যপ মুনির স্ত্রী। বায়ু পুরাণে ব্রহ্মা’র হৃদয় থেকে সৃষ্ট এই দেবী প্রজাপিতা ব্রহ্মারই ঘরনী। যা থেকে নাকি এই বিশ্ব-সংসারের রচনা। গরুর পুরাণে ইনি “অষ্ট কলা-যুক্তা”.….. শ্রদ্ধা-ঋদ্ধি -কলা -মেধা-তুষ্টি-পুষ্টি-প্রভা ও স্মৃতির একমাত্র আধার। আর পদ্মপুরাণ এর বর্ণনার সাথে মনের মাধুরি মিশায়ে–ই তো আমাদের দেবী প্রতিমার নির্মাণ।
শিবপুরাণের সরস্বতী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, চতুর্ভূজা, ত্রিনয়না, শিরে চন্দ্রকলাশোভিতা, বর ও অভয়মুদ্রা-শোভিতহস্তা, সর্বলক্ষণসম্পন্না, শ্বেতপদ্মে উপবিষ্টা, নীলকুঞ্জিত কেশশোভিতা।
গড়ুর পুরাণে দেবী সরস্বতীর শক্তি আট প্রকার। যথা শ্রদ্ধা, ঋষি, কলা, সেবা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও মতি। তন্ত্রশাস্ত্রে এই আটশক্তি হলেন যোগা, সত্যা, বিমলা, জ্ঞানা, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা।
স্কন্দপুরাণে সুসংহিতায় সরস্বতীর মস্তকে জটা, মুকুটে চন্দ্রকলা, ত্রিনয়না ও নীলগ্রীবা। দেবী এখানে শিবশক্তিরূপে বর্ণিতা।
বায়ুপুরাণে সরস্বতী চতুর্ভূজা, হংসারূঢ়া, বামদিকের দুই হাতে গ্রন্থ ও বরমুদ্রা, আর ডানদিকের দুই হাতে যথাক্রমে জপমালা ও বরমুদ্রা। দেবী এখানে ব্রহ্মশক্তি হিসেবে বর্ণিতা হয়েছেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেবী চতুর্ভূজা, পীতবসনা, নানা অলঙ্কারে অলঙ্কৃতা, বীনাপুস্তকধারিণী, ব্যাখ্যা মুদ্রা ও বরমুদ্রাধারিণী। এই বর্ণনা থেকে মনে হয় চতুর্ভুজা, পীতবসনা অর্থাৎ বিষ্ণুর শক্তি রূপে সরস্বতী বর্ণিত হয়েছেন।
আদিতে সরস্বতী কৃষিদেবী হিসেবেও পুজিতা হয়েছেন- এই কথা আগেই বলা হয়েছে। তাছাড়াও, সরস্বতীর সঙ্গে প্রজনন এবং উর্বরতার সম্পর্ক, বন্ধ্যাত্ব মোচনের সম্পর্ক, আদৌ দুর্লক্ষ্য নয়। তিথির কথাই ধরা যাক। জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন,
“শীতকাল হল জড়তার কাল। মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথি থেকেই শীতের জড়তা কেটে যেতে থাকে, ঋতুতে লাগে প্রথম বসন্তের ছোঁয়া। সরস্বতীর আবির্ভাবে সকল জড়তামুক্তি, মনেরও, ঋতুরও।”
সরস্বতীর নানা রূপভেদের কথাও জানা যায় বেদ, পুরাণ ও তান্ত্রিক গ্রন্থগুলিতে। উদাহরণস্বরুপ, মহাসরস্বতী সিংহবাহিনী। এই রূপে তিনি স্বয়ং দুর্গা। নীলসরস্বতী বা তান্ত্রিক সরস্বতী রূপে তিনি তারা। অন্নদাত্রীরূপে তিনি বারবার সম্বোধিত হন তিনি কাজেই অন্নপূর্ণা। সরস্বতী ঋকগুলিতে তিনি মরুৎগণের সখা। সরস্বতী বৃষ্টিও প্রদান করেন, তাই ঋকসমূহে তিনি ঐন্দ্রী। শুক্ল যজুর্বেদ সরস্বতীকে ভিষক আখ্যা দেয়, তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী। তিনি বাক, এই রূপেও তিনি সিংহবাহিনী। অন্যত্র তিনি ধনদাত্রী, তাই তিনি লক্ষ্মীও বটেন। আবার সরস্বতী দানবদলনী বলেও খ্যাত হয়েছেন ঋগ্বেদে। বহু পরে তন্ত্রধর্মীয় বৌদ্ধদের মধ্যে তারার বিভিন্ন রূপে তো সরস্বতী বিরাজ করেছেনই। প্রজ্ঞাদায়িনী প্রজ্ঞাপারমিতা পুস্তকের মূর্তি হিসেবে যে রূপ পালযুগে তন্ত্রাশ্রয়ী বাঙালি উপাসনা করত, সেই রূপের স্মৃতি আজও আমাদের উপাস্য সরস্বতী প্রতিমায় প্রতিভাত।
পালযুগের একটি বজ্রসারদা মূর্তি পাওয়া গেছে, তাতে মায়ের সঙ্গে চার অনুচর/সন্তান, যেরকম আবহমানকালের দুর্গামূর্তির বৈশিষ্ট্য। তিনি সার প্রদান করেন বলে সারদা। কিন্তু মা দুর্গার একটি নাম শারদা, শরতে পুজো হয় বলে। সারদা ও শারদা অভিন্নতা ঘোষিত হয়েছে, যা পূর্ব ভারতীয় ব্রাত্য আর্য ভাষার সুপ্রাচীন বৈশিষ্ট্যও বটে। আদিমধ্যযুগে চণ্ডীদাস বীরভূমের নানুরে যে বিশালাক্ষী মায়ের উপাসনা করতেন তিনি বস্তুত বীণাপাণি সরস্বতী।
প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতীসদৃশা দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। শ্রীশ্রীচণ্ডী’তে মহাকালী মহালক্ষ্মী আর সরস্বতী এক ও অভিন্ন তত্ত্ব। অং থেকে ক্ষং এই পঞ্চাশটি বর্ণই দেবীর সারা দেহ হিসেবে কল্পিত হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভূজা - বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবটি হানি ঘটেনি, কেননা তিনি 'একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা' বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন। “মধুকৈটভ বধ্” অধ্যায়ে মোহে অন্ধ, রাজা সুরথ’কে দেবী মেধা-ঋষি’র মুখ দিয়েও শুনিয়েছেন সেই জ্ঞানেরই বাণী। ‘সা বিদ্যা পরমা মূক্তির্হেতুভূতা সনাতনী’ অর্থাৎ অবিদ্যা মায়াতে ভরা এই মৃত্যুলোক থেকে চির মুক্তির পথ একটাই, তা হলো সনাতনী ব্রহ্মবিদ্যা।
কালিকাপুরাণে সরস্বতীর বাম হাতে বীণা ও পুস্তক আর দক্ষিণহাতে মালা ও কমণ্ডলু, শুক্লবর্ণধারিণী, মহাচলের পৃষ্ঠেস্থিতা,শ্বেতপদ্মের ওপর উপবিষ্টা, শুক্লবস্ত্রা ও শুভ্র অলঙ্কার ভূষিতা। প্রাচীন ভারতবর্ষে মা সরস্বতী সিংহের ওপর আসীনা ও হাতে শূল ধারণ করে আছেন এই মূর্তিতে পূজিত হতেন। আমাদের সমাজে মা সরস্বতী শুধু শুক্লাবর্ণা জ্ঞানদাত্রীরূপেই নয়, অন্য রূপে আলাদা মন্ত্রেও পূজিত হন। যেমন তন্ত্রমতে নীল তারা বা নীল সরস্বতী রূপ পূজিত হন। এই দেবীর উপাসনা করলে ভক্ত অপার জ্ঞানের অধিকারী হন। দশমহাবিদ্যার নবম ‘দেবী মাতঙ্গী’ আসলে তন্ত্রমতে সরস্বতী।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে উল্লেখ আছে, গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী নদীরূপ পরিগ্রহ করে পৃথিবীতে সরস্বতী দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। স্কন্দ পুরাণে প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে। বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহৃত পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টি সূচনা।
হিন্দুদের স্বীকৃত দেবী হয়েও বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মানুষদের কাছেও তিনি সমানভাবে বরণীয়া আদরণীয়া। কারণ, পঞ্চম শতাব্দী থেকে ভারতের বেদ-পুরাণের দেবদেবীরা ছিলেন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটা বড় রফতানির বস্তু। বৌদ্ধধর্মের মতোই তাঁদের প্রভাব ছিল বিপুল। বস্তুত, এই বৈদিক ও পৌরাণিক দেবদেবীদের উপরেও কালক্রমে মহাযান বৌদ্ধধর্মের বড় ছায়া পড়েছিল। গান্ধারে পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে। অনেক বৌদ্ধ উপাসনালয়ে পাথরের ছোট ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, অবিকল সরস্বতীমূর্তি। বৌদ্ধধর্মেও পরে যখন বুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য দেব-দেবীর আমদানি হল, দেখা গেল আমাদের সরস্বতী সেখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছেন। অবশ্য তখন তাঁর নাম হল বজ্রতারা ও জাঙ্গুলীতারা। এছাড়াও ছিলেন সরস্বতীর আদলে কল্পিত বিদ্যার অধিষ্ঠাতা মঞ্জুশ্রী।
মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদন ছিল। জৈনদের চব্বিশজন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতমা হলেন সরস্বতী। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর উভয় জৈন সম্প্রদায়েই সরস্বতীর স্থান হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীতা একজন প্রধান দেবীরূপে। জৈন ভাস্কর্যে প্রচুর সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া যায়। জৈনরা কার্তিক মাসের শুক্ল পঞ্চমীতে সরস্বতীর পুজো করে, যাকে বলা হয় জ্ঞানপঞ্চমী। জৈন ধর্মীয় সাহিত্যে সরস্বতীর অভিধা: ‘শ্রুতদেবী’। ‘শ্রুতভক্তি’, ‘শ্রুতপূজে’, ‘শ্রুতসুন্দর ব্রত’, ‘শ্রুতজ্ঞান ব্রত’ ইত্যাদির উল্লেখ থেকে শ্রুতদেবীর গুরুত্ব সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু জৈন সরস্বতীর একটি বিশেষত্ব হল তিনি ময়ূরবাহনা।
হিন্দু জনজাতির এক একটি কুলের কুলদেবী রয়েছেন। সরস্বতী হলেন বাংলার আদি বুদ্ধিজীবী কায়স্থকুলের কুলদেবী।
রাজহংস কেন সরস্বতীর বাহন?সাধারণত দেখা যায়, দেবতার যে বাহন, দেবপত্নীও সেই বাহনও নির্বাচন করে থাকেন। ব্রহ্মার বাহন হংস, সেই সূত্রে ব্রহ্মাণী সরস্বতীরও প্রিয় বাহন হংস। আবার কিছু পুরাণাদিতে আছে, সরস্বতী মানস-সরোবর হতে উৎপন্না। মানস সরোবর ব্রহ্মার প্রিয় স্থান, মানস সরোবরের রাজহাঁসও চিরপ্রসিদ্ধ। কাজেই হংসের সাথে সরস্বতীর সম্পর্ক ঘটা বিচিত্র নয়। কলহণ তাঁর ‘রাজতরঙ্গিণী’র সূচনায় কাশ্মীরের বর্ণনা দিয়েছেন যাতে আছে, সরস্বতী হংসরূপে ভেড়গিড়িশৃঙ্গের সরোবরে দর্শন দান করেছিলেন।
একে আধ্যত্মিক ভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই হাঁসের সমান গতি, যেমন জ্ঞানময় পরমাত্মা সর্বব্যাপী - স্থলে, অনলে, অনিলে সর্বত্র তাঁর সমান প্রকাশ। হংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুগ্ধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুগ্ধ বা ক্ষীরটুকুই গ্রহণ করে, জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রেও হংসের এ স্বভাব তাৎপর্য বহন করে। সংসারে নিত্য ও অনিত্য দুটি বস্তুই বিদ্যমান। বিবেক বিচার দ্বারা নিত্য বস্তুর বিদ্যমানতা স্বীকার করে তা গ্রহণ শ্রেয়, অসার বা অনিত্য বস্তু সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। হাঁস জলে বিচরণ করে কিন্তু তার দেহে জল লাগে না। মহাবিদ্যা প্রতিটি জীবের মধ্যে থেকেও জীবদেহের কোন কিছুতে তাঁর আসক্তি নেই, তিনি নির্লিপ্তা।
সাধারণভাবে রাজহাঁসকে আমরা সরস্বতীর বাহন হিসেবে জানলেও, মেষ, ময়ূর ও সিংহকেও বাহন হিসেবে দেখা যায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে মেষবাহনা মূর্তি আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক এন এস ভট্টসারি একটি লেখায় বলেছেন, “একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন। সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রূষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে। সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন। সেই থেকেই সরস্বতীর সঙ্গী এই মেষ। মুম্বই অঞ্চলে ময়ূরবাহনা সরস্বতীর পূজা বেশি। পুরাতাত্ত্বিক কানিংহামের মতে প্রাচীনকালে সরস্বতীর তীরে ময়ূরের প্রাচুর্যই একে দেবীর বাহন করেছে। রাজা রবি বর্মা সরস্বতীর যে ছবি এঁকেছিলেন, সেখানেও সরস্বতীর বাহন রূপে রয়েছে একটি ময়ূর। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর পূজা-পার্বণ গ্রন্থে বলেছেন পুরাণে তন্ত্রে হংসবাহনা সরস্বতীর উল্লেখ অপেক্ষাকৃত কম। নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস-এ লিখেছেন, “বাঙলা দেশের কোথাও কোথাও সরস্বতী পূজার দিনে এখনও ভেড়ার বলি ও ভেড়ার লড়াই সুপরিচিত।” নলিনীকান্ত ভট্টশালীও এই মত সমর্থন করেছেন। তবে পূর্বে উল্লিখিত এই চার বাহনের মধ্যে কে আগে কে পরে তা বলা মুশকিল। তবে বৈদিক সূত্র বলছে, সিংহ এবং মেষ সরস্বতীর আদি বাহন ছিল। পরবর্তী কালে সিংহ দুর্গার বাহন হল, কার্তিকেয় নিলেন ময়ূর। তাই ব্রহ্মার শক্তি হিসেবে সরস্বতীর ব্রহ্মার বাহন হাঁসকেই বেছে নিলেন। খিদিরপুরে হংসবাহনা মনসা বা সরস্বতীর মূর্তি আছে। একই মূর্তিতে দুই দেবী কৃষ্ণপক্ষে ও শুক্লপক্ষে আলাদা করে পূজিতা হন।
পণ্ডিতদের মতে সরস্বতী হলেন সৃজন শক্তি, আপন সত্তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গুণাবলি। তাঁর চারটি হাত। এক হাতে গোলাপ, এক হাতে বই –এ দুটি হল পিছনের হাত। সামনের দু-হাতে তিনি বীণা বাজাচ্ছেন। তাঁর পরিধানে সাদা বস্ত্র, যা শুদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক। বীণাবাদন জাগতিক কর্ম আর পদ্মধারণ আধ্যাত্মিক জগতের প্রতীক বলা হয়েছে। পদ্ম পরম সত্তার প্রতীক। এর দ্বারা মনোযোগ, ধ্যানসমাধি এবং পরম সত্তার সঙ্গে একাত্মতা বোঝায়। তাঁর কাছ একটি ময়ুর থাকলেও বাহন রাজহাঁস। ময়ুরের মেজাজ আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। তাই তিনি পছন্দ করেননি। অপরদিকে রাজহাঁস অসার-সার একসঙ্গে মেশানো দ্রব্য থেকে অসার দ্রব্য নিখুঁতভাবে ত্যাগ করে সারদ্রব্য গ্রহণ করে বলে বাহন হিসাবে বেশি পছন্দ।
বর্তমানে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজো আয়োজিত হলেও পঞ্চমী তিথি প্রথমে সরস্বতীর জন্য নির্দিষ্ট ছিলনা। বরঞ্চ কৃষ্ণ যজুর্বেদ মতে, সরস্বতীকে উৎসর্গ করার প্রশস্ত তিথি ছিল নবমী, পঞ্চমী নয়। শতপথব্রাহ্মণে আছে, পূর্বকালে পূর্ণিমা তিথিতে সরস্বতীর নিকট অঞ্জলী দেওয়া রুদ্রজামলে আশ্বিন শুক্লা অষ্টমীর মুলা নক্ষত্রে সরস্বতী পূজা ও শ্রবণা নক্ষত্রে বিসর্জনের কথা বলা আছে। যদিও কালের নিয়মে তা বর্তমানে মাঘমাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে পরিণত হয়েছে। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। তবে শ্রীপঞ্চমীর ‘শ্রী’ অর্থে বর্তমানে লক্ষ্মীকে বোঝায়, যদিও বৈদিক যুগে শ্রী ও লক্ষ্মী দুইজন পৃথক সত্ত্বা হলেও পৌরাণিক যুগে সেই পার্থক্য ঘুচে দুজনেই অভিন্ন দেবী হিসেবে পরিণত হন। আর সেই সাথে শ্রীপঞ্চমীও লক্ষ্মীপঞ্চমীর দ্যোতক হয়ে ওঠে। কিন্তু মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথির নাম ‘শ্রীপঞ্চমী’ হল কেন? মহাভারতে এর উত্তর পাওয়া যায়। বনপর্বে পাওয়া যায়, এই দিনই ব্রহ্মার মানসকন্যা দেবসেনার সাথে কার্তিকেয় বা স্কন্দের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। এই দেবসেনার ওপর নাম ছিল লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর বিবাহের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র যোগ্য পাত্রের অন্বেষন করছিলেন। ইন্দ্র যখন দেখলেন, কার্তিকেয় ছয়দিনে সকল স্থান জয় করেছেন, তখন তিনি কার্তিকেয়র সাথেই লক্ষ্মীর বিবাহ স্থির করেন। এই বিবাহে বৃহস্পতি পৌরোহিত্য করেছিলেন। পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী কার্তিকেয়কে আশ্রয় করেছিলেন বলে, এই উৎসবের স্মারক হয়ে তিথির নাম হয় শ্রীপঞ্চমী। কাজেই শ্রীপঞ্চমীতে লক্ষ্মীরই পুজার বিধি হওয়া উচিত। ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’তেও মাঘী শুক্লা চতুর্থীতে গৌরী ও পঞ্চমীতে শ্রীর পূজা করার বিধান আছে। বরাহপুরাণও পঞ্চমীতে শ্রীর পূজা করার পক্ষে সায় দেয়। কিন্তু, ‘পুরাণ-সমুচ্চয়’ গ্রন্থে শ্রী নয়, মাঘী শুল্কা পঞ্চমীতে রতি ও কামদেবের পূজা ও তারপরে বিরাত মহোৎসবের কথা বলেছেন। যাইহোক, স্মার্ত পন্ডিত রঘুনন্দন তাঁর ‘সংবৎসর-প্রদীপ’ গ্রন্থে নিদান দেন যে-
মস্যাধ্যারং লেখনীঞ্চ পূজয়েন্ন
লিখেত্ততঃ।।
মাঘে মাসি সিতে পক্ষে পঞ্চমী
যা শ্রিয়ঃ প্রিয়া।”
অর্থাৎ, মাঘমাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী
তিথি লক্ষ্মীর বড়ো প্রিয়। সুতরাং পুষ্প, ধুপ, অন্ন, বারি দিয়ে লক্ষ্মীপূজা করতে হবে।
কিন্তু, ‘মস্যাধারং লেখনীঞ্চ পুজয়েন্ন লিখেত্ততঃ’ কেন? শ্রীলক্ষ্মীর সাথে তো
দোয়াত-কালি-কলম এইগুলি সম্পর্কীত নয়। সম্ভবত, লিখিতভাবে এই “সংবৎসর-প্রদীপ” গ্রন্থেই
শ্রী পঞ্চমী তিথিতে বিদ্যারও আরাধনার একটা আভাস পাওয়া যায়। হয়তো পরে বিদ্যার আরাধনার
সুত্রতেই পরবর্তীতে লক্ষ্মীকে স্থানচ্যুত(‘তিথিচ্যুত’ বলাটাই হয়তো যুক্তিযুত) করে শ্রীপঞ্চমী
তিথির অধিকার একা বাগদেবীই গ্রহন করেছেন। তবে অপেক্ষাকৃত আধুনিক পুরাণ ব্রহ্মবৈবর্ত
মহাপুরাণে্র প্রকৃতিখণ্ডে এর একটা দোহাই আছে। সেখানে আছে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মুখ
থেকে বাগদেবী আবির্ভুতা হলেন ও শ্রীকৃষ্ণকে তিনি পতিরূপে পাওয়ার কামনা প্রকাশ করলেন-
কৃষ্ণ বলেন, তাঁকে পাওয়ায় যা, বিষ্ণুকে
পাওয়াও তাই- বিষ্ণু কৃষ্ণেরই স্বরূপ। অতএব তিনি যেন নারায়ণকে পতিত্বে বরণ করেন যাতে
তিনি চিরকাল পরমসুখে মনের আহ্লাদে কালযাপন করতে পারেন। এতে তাঁর মঙ্গলই হবে। তাঁর পর
পরমেশ্বর আরও বললেন,
“প্রতিবিশ্বেষুতে পূজা
মহতীন্তে মুদান্বিতাঃ।
মাঘস্য শুক্ল পঞ্চম্যাং
বিদ্যারম্ভেষু সুন্দরি।।
………
মদ্বরেণ করিষ্যন্তি কল্পে
কল্পেন যাবিধিঃ।
ভক্তিযুক্তাশ্ব দত্বা বৈ
চোপচারাণি ষোড়শ।।”
অর্থাৎ, হে সুন্দরি, সারা ব্রহ্মান্ডে
যত বিশ্ব বিরাজমান, প্রত্যেক বিশ্বে, প্রতি মাঘ মাসের শুক্লপঞ্চমী বিদ্যারম্ভ দিবসে
কল্পে কল্পে তোমাকে সকলেই মহানন্দে ভক্তিসহকারে ষোড়োশোপচারে যথাবিধি পূজা করবে।
প্রকৃতিখণ্ডে আরও আছে-
অর্থাৎ, সর্বপ্রথম স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ সরস্বতীর পূজা করেন।
দেখা গেল, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই প্রথম সরস্বতীর
অর্চনা করেন ও মাঘমাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথিতে পুজার বিধান দেন। তাসত্ত্বেও, পুজার তিথির
নামটা কিন্তু লক্ষ্মীর নামেই রয়ে গেল। তাঁর পণ্ডিত রঘুনন্দন রফা করলেন যে, শ্রীপঞ্চমী
লক্ষ্মীরই তিথি, লক্ষ্মীই পূজা পাবেন; তবে সরস্বতীর সম্মানার্থে জন্য সেই দিন দোয়াত-কলমেরও
পূজা হবে, আর কেউ সেদিন কিছু লিখতে পারবেন না। এটুকুও সাব্যস্ত হল যে, পঞ্চমীর গোড়ার
দিকে পুর্বাহ্নে সারস্বত উৎসব হবে-
কালক্রমে, লক্ষ্মীর থেকে সরস্বতীর গুরুত্ব
বৃদ্ধি পেতে লাগলে। যার নামে তিথি, তাকেই কেউ আমল দিলনা। একসময়, লক্ষ্মী তাঁর পূজার
ভাগ থেকে একরকম ব্রাত্যই হয়ে গেলেন, তাঁর কপালে জুটলো কেবল দুটো মন্ত্রের সাথে একটুকরো
ফুল। ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদি’তেও পরে যোগ করা হয়-
অমরসিংহের সময় পর্যন্ত প্রাচীন কোনো কোশগ্রন্থে ‘শ্রী’ শব্দের অর্থ সরস্বতী না থাকলেও মধ্যযুগের আচার্য রেদিনীবর হেমচন্দ্র প্রমুখের অভিধানে সরস্বতী আরও একটি নাম হলো ‘শ্রী”; কাজেই শ্রীপঞ্চমীতে সরস্বতীপূজা ক্রমশ খাপ খেয়ে গেল।
সেকালের সরস্বতী পূজা কেমন হতো? ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্ররা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। ইংরেজি ম্লেচ্ছ ভাষা হওয়ায় সরস্বতী পূজার দিন ইংরেজি বইয়ের পূজা নিষিদ্ধ ছিল। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। দেবী নিজে শ্বেতবর্ণা-কাজেই তাঁর পুজায় শ্বেত উপাচারের ব্যবস্থা ছিল- সাদা চন্দন, সদা ফুল, সাদা থান। খোয়াক্ষীর, মাখন, দই, খই-এগুলিও সাদা। পুজায় আমের মুকুল, অভ্র, আবীর, কাঞ্চনফুলেরও দরকার হতো। এইদিন থেকে কুল খাওয়া আরম্ভ হতো। পূজার পরদিন মায়েরা সন্তান্দের মঙ্গলকামনায় ষষ্ঠী পালন করতেন।
তখনকার দিনে সরস্বতীর প্রতিমা নির্মান করে পূজার প্রচলন খুব একটা ছিলনা। টোলের অধ্যাপক, পাঠশালার অধিকারী পণ্ডিত ও শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পুজো করতেন। বর্ধমান মহারাজার পূজায় বিশেষ সমারোহের আয়োজন করা হয়। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পুজোর বিসর্জন দেখতে আসত। পুজো উপলক্ষে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সরস্বতী দেবী হলেও মেয়েরা অঞ্জলি দিতে পারত না। কিছু পণ্ডিতের মতে সমাজপতিরা ভয় পেতেন হয়তো এই সুযোগে ধর্মের নামে মেয়েরা দাবি করে বসেন লেখাপড়ার স্বাধীনতা! তবে কলকাতার উপকন্ঠে গণিকালয়গুলিতে কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে সরস্বতীর পূজা বিখ্যাত(অথবা কুখ্যাত ছিল) যা সমকালীন সাহিত্যকর্মগুলি থেকে জানা যায়। ইংরেজি শিক্ষিত বাবু সমাজের নানান কাজের মতোই যুগপৎ নিন্দিত ও নন্দিত কলকাতায় সরস্বতী পুজোর ইতিহাস।
১৮৭২ সালে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাবু' প্রবন্ধ। বাংলার নব্যবাবুদের নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ। আর সেখানে তিনি লিখেছেন,
“যিনি রূপে কার্তিকেয়ের কনিষ্ঠ, গুণে নির্গুণ পদার্থ, কর্মে জড়ভরত এবং বাক্যে সরস্বতী তিনিই বাবু। যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।”
লাইন দুটির আলঙ্কারিক অর্থ, সামাজিক ব্যঞ্জনা অনেক। সে সব সরিয়ে রেখে সাদা চোখে দেখলেও কিন্তু দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। এক, সরস্বতী বাগ্দেবী। দুই, তিনি মূলত পূজিতা হতেন পতিতাপল্লীতে। নিষিদ্ধপল্লীতে দেবী সরস্বতী! অবাক করা মনে হলেও এটা সত্যি। বাৎসায়নের যুগ থেকে বাবু–বিলাসের কলকাত্তাইয়া সংস্কৃতি, সর্বযুগেই বিষয়টা সত্যি। বাৎসায়ন লিখছেন, কামদেবের পুজো করতে হলে চৌষট্টি কলা শিখতে হবে। আর সেই শিক্ষার শুরু সরস্বতী পুজোর দিন। চৌষট্টি কলার মধ্যে গীত, বাদ্য, নৃত্য, ছন্দোজ্ঞান যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ছলিতকযোগ, দ্যূতক্রীড়া, আকর্ষক্রিয়া প্রভৃতিও। এক কথায় নাচ–গান–বাজনা থেকে ছলকলা, জুয়ো খেলা, কবিতা লেখা ও বোঝা, সব কিছুই চৌষট্টি কলার মধ্যে পড়ে। আর এসব কিছুরই অবিসংবাদী দেবী সরস্বতী। দেবীর শাস্ত্রসম্মত গায়ত্রী মন্ত্রেও তাই কামদেবের অনিবার্য উল্লেখ-
বাৎসায়ন প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার ব্যাপারস্যাপার। প্রায় শ’দেড়েক বছর আগেকার কলকাতাতেও সেই অভিন্ন ছবি। সরস্বতী পুজোতে শহরের নিষিদ্ধপল্লীর ঘরে ঘরে আনন্দ–আসরের চিত্র। নেবুতলা থেকে রামবাগান, হাড়কাটাগলি থেকে হালসিবাগান, সর্বত্র একই লহরী। ‘সমাজ কুচিত্র নকশা’য় সেই আনন্দলহরীরই হদিশ দিয়েছেন হুতোম প্যাঁচা, অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ-
“সরস্বতী পুজোর আর পাঁচদিন আছে। রাত্রি ঘোর অন্ধকার, তথাপি ইয়ার দলের শঙ্কা অথবা বিরামের নাম নাই। ... সকল বেশ্যাবাড়ির দরজাতেই প্রায় জুড়ি, তেঘুড়ি, চৌঘুড়ি খাড়া রয়েচে। গৃহমধ্যে লালপানির চক্চক্, চেনাচুরের ছপ্ছপ্ ও বোতল গেলাসের ঠন্ঠন্ শব্দ শুনা যাচ্ছে। ... সরস্বতী পুজোর খরচের কল্যাণে অনেকস্থলে গাঁটকাটা, রাহাজানি, সিঁদ, হত্যা, ডাকাতি, জুয়াচুরি ইত্যাদি ঘটনা হচ্ছে। শহর টল্টোলে।”
অর্থাৎ, শ্রীপঞ্চমী আসার দিন পাঁচেক বাকি থাকতেই নিষিদ্ধ পল্লীতে পল্লীতে সরস্বতী পুজোর আনন্দে নিষিদ্ধ কর্মের বাড়াবাড়ি। প্রতিপদ থেকে বদলাতে থাকত শহরের চালচিত্র। কুমোরটুলির ছবিটাও। সে সবও মিলবে ওই ‘সমাজ কুচিত্র নকশা’য়, সৌজন্যে অবশ্যই হুতোম।
“কুমোরটুলির নগ্দা সরস্বতীরা বেধড়ক বিক্রি হয়ে মুটের মাথায় উঠচেন, কুমোরেরা শেষকালে আর জোগাতে না পেরে, বাড়তি দোমেটে করা জগদ্ধাত্রী ঠাকুরুনের হাতি ও সিঙ্গি ভেঙে দুখানি হাত কেটে ও ঘাড় বেঁকিয়ে সাদা করে স্থান পূর্ণ কচ্চে। রাজপথ যেন সরস্বতীময় বোধ হচ্চে। ডাকের সাজকর, মিঠাইকর, শোলার পদ্মফুল ও গাঁদাফুলের দোকানে আজ অসঙ্গত খদ্দের।”
চারিদিকে ব্যস্ততা অন্তহীন। সরস্বতী পুজোর দিনই তো নিষিদ্ধপল্লীর ঘরে ঘরে নতুন নতুন নৃত্য প্রদর্শন, গীত পরিবেশনের শুরু। সেইসঙ্গে বারঙ্গনা ও তাদের বাবুদের নিজস্ব মনোরঞ্জনের জন্য যাত্রাপালার বন্দোবস্ত। প্রতিবেশে ব্যস্ততার প্রসৃতিতে মিশে থাকত সে সব অনুষঙ্গও। হুতোম জানাচ্ছেন,
অর্থাৎ, একদিকে যেমন পুজো–উপলক্ষে নাচ–গান–যাত্রার মহড়া চলছে, অন্যদিকে তেমনই চলছে পুজোর উপচার কেনাবেচা। তৃতীয়ায় বাড়ি বাড়ি প্রতিমা আসার পর ব্যস্ততার ছবিটা বদলায়-
“বাড়ি বাড়ি প্রতিমে সাজানো আরম্ভ হয়েচে। এক বাড়ির বিবির আগে উজ্জুগ হয় নাই, দিন গ্যালো দেখে তিনি তাঁহার বাবুর গলায় অভিমানে গামছা দিয়েছেন। বাবু তাঁহার পিতামহীর সিঁদুক ভেঙে দুছড়া চাঁদি কাটা পৈঁছে ও একটা সিঁদুর চুপড়ি চুরি করে তাড়াতাড়ি মাটির কাজ আরম্ভ করে দিলেন। ... মোসাহেব ও উমেদারেরা আজ নিমেষমাত্র বাবুর কাছছাড়া হচ্চে না।”
“আসার সাজানো, দেবীঘট, নারকেলের মুচি ও আম্রশাখা সংগ্রহ কর্ত্তেই দিন শেষ হল। রাত্রিতেও অনেক কাজ গুছিয়ে রাখা হল। অনেকের নিদ্রাই হল না।”
কিন্তু বাবুদের সুখী শরীর বিনিদ্র রজনী যাপনে সে শরীরে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই-
“রেজিমেন্টের মতো ফুলবাবুর ঝাঁক গড়া গড়া শুয়ে পড়লেন; কিন্তু শয়ন কর্ত্তে কর্ত্তেই শৃগাল, কাক ও কুক্কুট ডেকে উঠল।” ভোর হতে “একটি কামিনী হাই তুলে আলস্য ত্যজে দেখলেন, তিনি তাঁহার দোলন নথের বিলিতি মুক্তোর নোলকটি ভক্ষণ করে ফেলেছেন।”
নাকের নোলক ঘুমের ঘোরে গিলে ফেলার ঘটনাটা কতদূর সত্য, সেকথা জানার উপায় নেই। তবে একটা কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। সরস্বতী পুজো উপলক্ষে সেকালের কলকাতার যাবতীয় ব্যস্ততার কেন্দ্রস্থল আজকের মতো স্কুল–কলেজ নয়, ছিল বারঙ্গনাগৃহ। এ নিয়ে ১৮৬৫–র ‘সমাজ কুচিত্র দর্পণ’–এর জানুয়ারি সংখ্যায় যথেষ্ট শ্লেষ লক্ষ্য করা যায়। ওই পত্রিকার ‘সরস্বতী পূজা’ শীর্ষক নক্শায় লেখা হল,
“পাঠকগণ মনে করুন, আশ্বিন মাসের শারদীয় পঞ্চমীর মতো এ পঞ্চমীর তত মাহাত্ম্য নাই, তথাপি শহরে আমোদের স্রোত ধরচে না। ... বারঙ্গনা পল্লীর কথাই এক স্বতন্ত্র। সেখানে শহরের রকমারি আমোদের ও আমোদপ্রিয় দলের মানচিত্র অঙ্কিত হয়েচে। হিন্দুধর্ম যেন ইয়ং বেঙ্গলদের ভয়ে, ধুনো, শাঁখ, গঙ্গাজল ও পবিত্রতায় আচ্ছাদিত হয়ে ওই সকল কুঞ্জে লুকিয়ে রয়েচেন।”
“দর্শকেরা এইরূপ রাজবেশে দশ বাড়ির ঠাকুর দেখে আমোদ করে বেড়াতে লাগলেন। ... আতরদান গোলাবপাশ হস্তে এক এক জন লম্বোদর প্রায় সকল বাড়ির প্রতিমের সমুখে হাজির আছেন। তাঁরা নিমন্ত্রিতদের মুখে, চোখে, বুকে গোলাপবৃষ্টি কচ্চেন, আর আড়ে আড়ে হাসছেন।”
শ্রীপঞ্চমীর রাতে এসব ছবি বদলে গিয়ে অন্য দৃশ্যপট। তখন কৌমার্যহরণের অনুষ্ঠান, ‘নথভাঙা’র আয়োজন। যাবতীয় নান্দনিকতা, সরস্বতীর সঙ্গে সম্পর্কিত যাবৎ সৌকর্য সরিয়ে তখন কামের বহ্ন্যুৎসব। দাউ দাউ আগুন তখন বড্ড স্থূল হয়ে জ্বলত। সেই সঙ্গে মদের নেশায় তাবৎ বেসামাল আকুতি। ‘এক বাবু তালে তালে নাচতে নাচতে জড়িত জিহ্বায়’ গান জুড়েছেন। কখনও গাইছেন ‘দিবানিশি তোরো লাগি, ঝরে আমার দু–নয়ান’, কখনও আবার ‘ক্যান্ লো এমন হলি প্রাণপিয়াসী সই।’ বাবু গাইছেন আর ঘুরে ঘুরে নাচছেন, ‘বিবি তবলা বাজাচ্চেন।’ দূরে ফেরিওলার কণ্ঠে ভেসে আসছে, ‘বেলফুল, চাই বরোফ।’ এমন সময় পাঁচ মাতাল বাবু দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। তাঁদের গলায় একটাই কথা ‘মদন আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ।’ এমন গান আর দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ঘরের ভেতরকার বাবুর গান বদলে গেল। তিনি ‘কালোয়াতি আওয়াজে’ ধরলেন ‘কে এলি শঙ্করী এলি উমা এলি মা’। বাবু দরজা খুলতে পা বাড়ালেন। ‘আর কর্রো কি?’ বলে পেছন থেকে বাবুর কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করলেন বিবি। বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে বিবিকে দেখতে পেলেন। ‘কে মা শুভঙ্করি! পদ্ম থেকে উঠে এলি ক্যান বাপ?’ বলে বিবিকে নিয়ে প্রতিমের উপর বসাতে চল্লেন।’ প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এসব নাটক চলল। বাইরে তখনও অপেক্ষমাণ পঞ্চ মাতাল। দরজা খুলে দেওয়ামাত্র তাঁদের প্রবেশ। প্রতিমা দেখেই তাঁদের সাষ্টাঙ্গ প্রণাম শুরু। সেই সঙ্গে মুখে বুলি, ‘মা আমার বসে রয়েচেন যেন লম্বোদরী দশানন।’ বাড়ির কর্তা তখন অতিথিদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত। তিনি বললেন, ‘কাম হিয়ার মাই জলি ফ্রেন্ডস’। আর বলার সঙ্গে করমর্দন অব্যাহত। বাড়িওয়ালি তখন বোতল ও গেলাস হাতে ‘এই এসো!’ বলে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
“বাবুদের একজন তাঁর লবঙ্গ মাসির রান্নাঘর থেকে একটি ঝাড়ানো লাঙ্গুলবিশিষ্ট সাদা দধিমুখী মেনি বেড়াল চুরি করে এনেছিলেন, সেইটি মা সরস্বতীর শ্রীপাদপদ্মে উপহার দিলেন। একটা হাসির গর্রা উঠল।”
আর পরদিন?
“আমোদের খোয়ারিতে চক্ষু
মহাদেবের মতো ঢুলু ঢুলু কচ্চে। ... বৈকালে পুলিসের পাসের নিয়মমতো মাকে বিসর্জন
করে নিশ্চিন্ত হলেন। তাঁরাও বাঁচলেন সরস্বতীরও এক বৎসরের মতো হাড় জুড়ুলো।”
১৮২২ থেকে ১৮২৫–এর মধ্যে কলকাতার নিষিদ্ধপল্লী নিয়ে তিন–তিনটে বই লিখেছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রন্থত্রয়ের নাম ‘নববাবু বিলাস’, ‘নববিবি বিলাস’ এবং ‘দূতী বিলাস’। তিনটে বইতে আছে সরস্বতীবন্দনা। ‘বঙ্গদর্শন’–এ ‘বাবু’ প্রকাশিত হওয়ার ছ’বছর পর, ১২৮৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত ‘আর্য্যদর্শন’ পত্রিকা। সেখানে বাঙালি স্তুতিতে লেখা হয়েছিল,
“সরস্বতী তোমার দুহিতা, কন্যাদায়ে তুমি সদাই বিব্রত, তাহাকে অন্যের ঘাড়ে ফেলিতে পারিলেই তুমি দায় হইতে নিষ্কৃতি পাও, তোমাকে নমস্কার।”
সেখানে ‘বেশ্যাগৃহ’কে বাঙালির ‘মঠ’ বলা হয়েছে। কেন মঠ? সে ব্যাখ্যাও দিয়েছে ‘আর্য্যদর্শন’। “সেখানে থাকিয়া যখন তুমি সন্ন্যাস অবলম্বন কর, তখন সংসার মায়া তোমাকে কিছুতেই অভিভূত করিতে পারে না, স্ত্রী–পুত্রের নয়নজল তোমাকে ফিরাইতে পারে না।”
বেদ থেকে বাল্মীকি, বেদব্যাস থেকে কালিদাস, বিদ্যাপতি থেকে কৃত্তিবাস বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল থেকে প্রভাবতী দেবী সহ বর্তমান শতাব্দীর কবি সাহিত্যিক কে নেই এই বাণী-বন্দনার তালিকায়? মাইকেল মধুসূদন দত্ত দেবীর কাছে কৃপাপ্রার্থনার মাধ্যমে শুরু করেছিলেন তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-
“আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে
ভারতি! যেমতি, মাতঃ,বসিলা আসিয়া,
বাল্মিকীর
রসনায়(পদ্মাসনে যেন)
যবে খরতর শরে, গহন কাননে,
ক্রৌঞ্চবধূ সহ
ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,
তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি।”
কবিগুরু’র
“জীবনস্মৃতি” থেকে জানা যায়, বালক
রবীন্দ্রনাথের সাথে ২১ বছরের যুবক বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম দেখা হয়েছিল সরস্বতী
পূজার মঞ্চেই, সেই ৩১শে জানুয়ারি, সালটা
ছিল ১৮৭৮। আবার, “পুরস্কার”
সভার “পাত্র-মিত্র অমাত্য আদি” উঠে গেলে কবিগুরু তাঁর “সোনার তরী” তে চেপে
একান্তে এভাবেই জানাচ্ছেন তার হৃদয়ের আকুতিঃ
প্রসন্ন মুখছবি।
বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুক্লহাসিনী
বীনাগঞ্জিত
মঞ্জূভাষিণী
কমলাকুঞ্জাসনা……”
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ব্রহ্মবাদীর চোখে এই “প্রসন্ন মুখ ছবি” টি তবে কার? বৈষ্ণব পদাবলীকারদের বাদ দিলে মাতা সরস্বতীর সাথে কালিদাসের সম্পর্কও নাকি বড়ই নিবিড়। কথিত আছে, বিদুষী পত্নী বিদ্যাবতীর লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে মূর্খ কালিদাস পুকুরে প্রাণ বিসর্জন করতে গেলে স্বয়ং মা–ই নাকি তাঁর জীবন রক্ষা করেন। তাঁরই আশীর্বাদে নাকি মহাপন্ডিত হয়ে ‘মেঘদূত’, ‘রঘুবংশ’, ‘কুমারসম্ভব’ কাব্য এবং ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ এর মতো আরো বহু নাটক রচনা করেন সেই কালিদাস।
নানুরের এক প্রাচীন ঢিবি খনন করে পাওয়া গেছে গুপ্ত যুগের মুদ্রা,বেশ কিছু ব্যবহৃত সামগ্রী, খন্ডিত সরস্বতীর প্রস্তর মূর্তি সহ এক প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। লোকশ্রুতি, দস্যু কালাপাহাড় একদিন মা’কে খন্ডিত করলেও আজও ৬ খন্ডের দেবী সরস্বতী সেখানে নিত্য পূজিতা হন। মহাকবির স্মৃতি রক্ষার্থে এই ঢিবির উপরে গড়ে উঠেছে মহাকবি কালিদাস উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিবার সরস্বতী পুজোতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য বিদ্যার্থীদের উপস্থিতিতে আজও খ্যাতির শিরোপা পায় অখ্যাত এই বেলুটি গ্রাম অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ এর কল্যাণে।
আর হুগলীর চন্দননগরে? “সন্তান- সংঘ ক্লাব” এর সরস্বতী পূজার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে স্বয়ং কাজী নজরুল রীতিমতো শুনিয়ে গেছেন স্বরচিত কবিতা। কোথাও আবার ইসলাম ধর্মের লোক হয়েও তিনি সরস্বতীর সেবককেই উদ্দেশ্য করে জানিয়েছেন তাঁর অনুযোগ।
“পূজারী কাহারে দাও অঞ্জলি
মুক্ত ভারতী ভারতে কই?”
কোথাও আবার ‘রবিহারা’
হয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজেরই মনোবেদনা……
” তব
রসায়িত রসনায় ছিল নিত্য
যে বেদ-বতী
তোমার লেখনী
ধরিয়াছিলেন
যে মহা সরস্বতী…….”
আবার প্রখ্যাত কোনও
লেখক বা প্রথিতযশা কোনও সাহিত্যিক না হয়েও সারদ বন্দনা থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি
স্বয়ং আমাদের নেতাজীও। রামমোহন ছাত্রাবাসে এসে কলকাতার সিটি কলেজের ৫০ বছর পূর্তি
অনুষ্ঠানে সরস্বতী পুজোতে নিষেধাজ্ঞা জারির কথা শুনে পূজা-পন্থী ছাত্রদের
উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করতে ভুলে যাননি সেদিন।
তাইতো সারা ভারতজুড়েই
মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমী মানে মহাসমারোহে মহানন্দে শুরু হয় হংসবাহিনী’র আরাধনা।
ভারতবর্ষ বাদ দিয়েও বাংলাদেশ, নেপাল,
জাপান, ভিয়েতনাম, মায়ানমার
ইন্দোনেশিয়াতে ও সারদার সাদর সম্ভাষণ। এছাড়াও গ্রীক দেবী আথেনা,
মধ্যপ্রাচ্যের ইস্তার, রোমের মিনার্ভা ও আইরিশ ব্রিঘিদ্ প্রভৃতিদের রূপকল্পনায়
সরস্বতীর প্রভাব দেখা যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি সি শহরে
ম্যাসাচুসেট্স্ অ্যাভিনিউ বলে একটি রাস্তা আছে। এই রাস্তা এমব্যাসি রো নামেও
পরিচিত,
কারণ এই রাস্তায় এবং এর আশেপাশেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের
দূতাবাসগুলি রয়েছে। প্রায় প্রতিটি দূতাবাস ভবনের সামনেই রয়েছে সে দেশের কোন না কোন
বিখ্যাত মানুষের মূর্তি। ২০১৩ সালের জুন মাসে, ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের সামনে,
কোন মানুষের বদলে স্থাপন করা হয় জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর এক
পনেরো ফুট উঁচু মূর্তি। সাদায় আর সোনালিতে সাজানো এই দেবীর পায়ের কাছে বসে বই পড়ছে
তিনটি ছেলেমেয়ে।
জাপানে ষষ্ঠ শতাব্দীতে
অন্য নানা দেবদেবীর সঙ্গে সরস্বতীও পৌঁছেছিলেন, অষ্টম শতাব্দী অবধি তাঁর আরাধনা হয়েছে। জাপানে এই দেবীকে
বেনজাইতেন বলা হয়, কথাটি
এসেছে চিনা বিয়ান-চাইতেন থেকে। দেবীর হাতে ম্যান্ডোলিন জাতীয় একটি বাদ্যযন্ত্র,
নাম ‘বিবা’। তিনি সুর ও সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী।
দুটি স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্ট দুই ভিন্ন দেশের দেবীর হাতে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়
দেবী সরস্বতীর মতো বেনজাইতেনও জ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত ও অন্যান্য ললিত কলার
পৃষ্ঠপোষক। সম্ভবত ভারত থেকে চিন হয়ে জাপানে প্রচলিত হয় সরস্বতীর আরাধনা।
জাপানের হাসেদারা মন্দিরে আছে বেনজাইতেন গুহা। যেখানে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য
জাপানি সরস্বতীর মূর্তি। দেবী জাগ্রত, তাই এখানে অনেকেই গোপনে নিজের মনের ইচ্ছা পূর্ণ করার
প্রার্থনা দেবীকে জানিয়ে আসেন। সে দেশে তিনি সৌভাগ্যের
অধিষ্ঠাত্রী সপ্তদেবীর অন্যতমাও। মূলত তিনি জলের দেবী,
যা কিছু জলের মতো প্রবাহিত, যেমন শব্দ, বাক্য বা গান, তারও। তাঁর সঙ্গে আবার সাপেরও একটা যোগ আছে,
সচরাচর তাঁর সঙ্গে সর্প-ড্রাগনের বিয়ে হয়।
কম্বোডিয়ায় আংকরভাট
মন্দিরে গেলে বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীর আদলে কিছু প্রাচীন মূর্তি নজরে আসবে।
দীর্ঘকাল ধরে এখানে হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজারা রাজত্ব করতেন। দশম ও একাদশ শতাব্দীর
একটি পুঁথি থেকে জানা যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর পুজো করা হত। এই
অঞ্চলে খেমার বংশের কবিরা দেবী সরস্বতীর গুনগান করতেন। কামবোডিয়ায় দেবী
সরস্বতীকে বিবাহিত গণ্য করা হয়। বলা হয় প্রজাপিতা ব্রহ্মা হচ্ছেন দেবীর স্বামী।
কামবোডিয়াতে এই দেবীকে বাগেশ্বরী ও ভারতী বলে ডাকা হয়। বিশেষ করে খেমার সাহিত্যে
রাজা যশবর্মণের রাজত্ত্ব কালে এই নাম দুটোরই উল্লেখ আছে। থাইল্যান্ডে দেবী
সরস্বতীর বর্ণ সবুজ আভা যুক্ত। এখানেও জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী হিসাবে আরাধনা করা হয়
সরস্বতীকে। তবে হংসের বদলে ময়ূর এখানে দেবীর বাহন।
তাইল্যান্ডে তিনি বাক্
এবং বিদ্যার দেবী (প্রো)সুরতস্বরী, অনেক মন্দিরে তাঁর মূর্তি আছে। তবে ভারতের বাইরে প্রধান এক
জন দেবতা হিসেবে সরস্বতীর আরাধনা যেখানে প্রচলিত, তার নাম বালি। বালির মানুষ তাঁকে জলের অধিষ্ঠাত্রী মনে করেন,
এই দিনটিতে তাঁরা নদী বা সমুদ্র বা পবিত্র ঝরনায় স্নান
করেন। আবার স্কুলকলেজে তাঁর বিরাট বিরাট প্রতিমা গড়ে পুজোও হয়।
তিব্বতে এই দেবীকে বলা
হয় ইয়াং চেন মা বা সঙ্গীতের দেবী। তিব্বতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে
মিলিয়ে দেবীকে এখানে ২১ জন তারার একজন বা দেবী মঞ্জুশ্রীর সঙ্গী হিসেবে বর্ণনা
করা হয়।
আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি বলেন তাহলে তো বলতেই হয়, বিদ্যালয়- মহাবিদ্যালয়- বিশ্ববিদ্যালয়- গ্রন্থাগার টপকে দেবী নিজেই চলে আসেন যেন গ্রাম বাংলার মাটির দাওয়াতেই।
পদ্মপুরাণ এর বর্ণনা
অনুযায়ী,
“শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত- পুষ্পোপশোভিতা
শ্বেতাম্বরা ধরানিত্যা
শ্বতগন্ধানুলেপনা।
শ্বেতাক্ষর সূত্রহস্তা
শ্বেত চন্দনচর্চিতা
শ্বেতবীণা ধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কার
ভূষিতা।”
অর্থাৎ, শুভ্রবসনা দেবী সাদা চন্দনের চর্চিতা শ্বেত অলংকার যুক্তা। হাতের অক্ষ মালাটি ও সাদা। এক হাতে থাকে বই অন্য হাতে অভয় মুদ্রা। আর কোলে রাখা আলতো করে আদর এর বীণা। শান্ত বদনে শ্বেতহংসের ওপর স্মিত হাস্যে বিরাজিতা।
সরস্বতীর মূর্তিকল্পনার ইতিহাস কত পুরোনো? সরস্বতী মূর্তি দ্বিভুজা না চতুর্ভুজা? প্রশ্ন যদি কেবল বর্তমানকালের মূর্তি নিয়ে ঘটে তবে বাংলায় সরস্বতী দ্বিভুজা বটেন। কিন্তু অতীতে চতুর্ভুজা মূর্তির প্রমাণ আছে। তন্ত্রেও চতুর্ভুজা মূর্তির ধ্যান আছে। তবে সরস্বতীর আদি মূর্তিরূপ কি ছিল, জানা যায় না। গৌড়ের উত্থানের আগে তাঁর মুর্তিরূপের বর্ণনাও পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে উজ্জয়িনীর বরাহমিহির প্রতিমালক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেছেন বৃহৎ সংহিতায়, যেখানে সরস্বতীর কোনো উল্লেখ নেই। তারও একশ বছর আগে চতুর্থ শতকে মহারাষ্ট্রের মৎস পুরাণের প্রতিমালক্ষণ আলোচনায় সরস্বতীর উল্লেখ নেই, যদিও লক্ষ্মীর আছে। এরও আগে খ্রিষ্টপূর্ব যুগে মগধে কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে দেবদেবীর মন্দির নির্মাণ সংক্রান্ত আলোচনা আছে এবং স্বভাবতই সরস্বতীর উল্লেখ নেই সেখানে। সরস্বতীর মূর্তিরূপের ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে সপ্তম অষ্টম শতকের পর থেকে, যখন প্রবল পরাক্রান্ত গৌড়ের উত্থান ঘটেছে। সরস্বতীর মূর্তিরূপ নবম শতকের অগ্নিপুরাণ (মধ্যপ্রদেশে রচিত সম্ভবত) যা দিচ্ছে তাতে দেবী চতুর্ভুজা। অগ্নিপুরাণ অনুযায়ী, পুস্তক, অক্ষমালা ও বীণা আছে এই চতুর্ভুজা মায়ের হাতে। বীরভূমের নানুরে এরকমই একটি প্রাচীন মূর্তি আছে যাকে স্থানীয়রা বিশালাক্ষী বলে পুজো করেন, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি জানিয়েছিলেন, নানুরে এটিই চণ্ডীদাসের আরাধ্যা বাশুলীরূপে পরিচিত। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম মধ্যযুগে সরস্বতীর চতুর্ভুজা মূর্তির কথা বলেছেন। ডানদিকের দুই হাতে পুস্তক ও মসীপাত্র। বাঁদিকে জপমালা ও শুক-শিশু।
তবে, বাংলায় তান্ত্রিক সাধকরা কিন্তু চতুর্ভুজা বাগীশ্বরীর আরাধনা করতেন, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থ সাক্ষ্য দিচ্ছে। সেখানে রঘুনন্দনকৃত উদ্ধৃত শারদাতিলকের ধ্যান বাদ দিলে বাকি সবকটিতেই মায়ের চতুর্ভুজা মূর্তি: একটি মূর্তির চার হাতে ব্যাখ্যা অক্ষসূত্র সুধাকলস ও বিদ্যা। আরেকটি মূর্তির চার হাতে বীণা অক্ষসূত্র সুধাকলস ও বিদ্যা। আরেকটি মূর্তির হাতে ব্যাখ্যা পুস্তক সুধাকলস ও বর্ণমালা। তন্ত্রোক্ত আরেকটি মূর্তির হাতে জপবটী পুস্তক ও দুটি পদ্ম। প্রসঙ্গত হংসবাহিনী সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায় এই বৃহৎ তন্ত্রসারের একটি বাগীশ্বরী ধ্যানেই। বাগীশ্বরী মূর্তির বর্ণনা অগ্নিপুরাণেও আছে, সেখানেও চতুর্ভুজা মূর্তি, এক হাতে পুস্তক অন্য হাতে অক্ষসূত্র, এছাড়া বরদা ও অভয়া মুদ্রা।
তাহলে, দ্বিভুজা বীণাপাণি হংসারূঢ়া সরস্বতী মূর্তির বিবর্তন কিভাবে হল?
পালযুগে বীরভূমের নানুরে যে চতুর্ভুজা সরস্বতী মূর্তি পাওয়া গেছিল সে মূর্তি অষ্টম শতকের বলে মত আছে। সেক্ষেত্রে ভারতে আদিতম সরস্বতী মূর্তি সম্ভবত সেটাই। পালযুগের একদম শুরু বা মাৎস্যন্যায় যুগের শেষ। বলা দরকার গোপাল যে চুন্দামাতৃকার উপাসনা করতেন তিনিও প্রজ্ঞার প্রতীক। গোপাল ছিলেন অধ্যাপক দয়িতবিষ্ণুর নাতি, এটি ইতিহাসের ইঙ্গিত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এই মূর্তির হাতে বীণা আছে। পালযুগের অপর দ্বিভুজা সরস্বতী মূর্তির হাতেও বীণা আছে। অতএব বীণা এখান থেকেই একটি অবিচ্ছিন্ন ঐতিহ্য।
চতুর্ভুজা মূর্তি বিভিন্ন সময়ে বাংলায় প্ৰচলিত ছিল, সে প্রমাণ আমরা ওপরে দিয়েছি। স্মার্ত রঘুনন্দন যে লেখনী ও পুস্তকধারী দ্বিভুজা মূর্তির প্রচলন করেন শারদা তিলক থেকে, সে মূর্তিকল্পনার কিছুটা প্রভাবেই মধ্যযুগের স্মৃতিশাসিত বাঙালি ওই দ্বিভুজা মূর্তি উপাসনা করেছে, শুধু লেখনী ও পুস্তকের বদলে আমাদের দীর্ঘ ঐতিহ্য মান্য করে মায়ের হাতে বীণা এসেছে। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, দ্বিভুজা মূর্তির পেছনে রঘুনন্দনের ব্রাহ্মণ্যকেন্দ্রিক স্মৃতির ভূমিকা থাকলেও পালযুগে যে মায়ের দ্বিভুজা বীণাপাণি মূর্তির প্রচলন ছিল তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়, আগেই বলেছি। এছাড়া সঙ্গের ছবিটি দ্রষ্টব্য।
যাই হোক, অন্তত আগমবাগীশের সমকালে যে বাংলার তন্ত্র মূলত চতুর্ভুজা বাগীশ্বরীর উপাসনায় লিপ্ত ছিল, তার প্রমাণ আছে। অন্যদিকে সরস্বতী মূর্তির দ্বিভুজা রূপ ও বীণাপাণি রূপ প্রথমবার উত্থিত হয়েছিল নিঃসন্দেহে পালযুগের অবদান হিসেবে। বাঙালি সঙ্গীতপ্রিয় জাতি সন্দেহ নেই, সেজন্য বীণা। বৃহৎ তন্ত্রসারে মায়ের বাহন হাঁসের সাথেও তন্ত্রের যোগসূত্র আছে।
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে যদিও দেবীকে ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা মূর্তিতেই দেখতে পাওয়া যায়।
“উর
দেবি সরস্বতি স্তবে কর অনুমতি
বাগীশ্বরি
বাক্যবিনোদিনি
শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস
শ্বেত বীণা শ্বেত হাঁস
শ্বেতসরসিজনিবাসিনি
বেদ বিদ্যা তন্ত্র
মন্ত্র বেণু বীণা আদি যন্ত্র
নৃত্য গীত বাদ্যের
ঈশ্বরী
…
আগমের নানা গ্রন্থ আর
যত গুণপন্থ
চারিবেদ আঠার পুরাণ
ব্যাস-বাল্মীকাদি যত
কবি সেবে অবিরত
তুমি দেবি প্রকৃতি
প্রধান
ছত্রিশ রাগিনী মেলে
ছয় রাগ সদা খেলে
অনুরাগ সে সব রাগিণী
সপ্ত স্বর তিন গ্রাম
মূর্চ্ছনা একুশ নাম
শ্রুতিকলা সতত সঙ্গিনী
…
তুমি নাহি চাহ যারে
সবে মূঢ় বলে তারে
ধিক্ ধিক্ তাহার জীবন
তোমার করুণা যারে সবে
ধন্য বলে তারে
গুণীগণে তাহার গণন
…”
ভারতের ভারতী ভরসা আর
মাতা সরস্বতী সম্পর্কে ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির পরম্পরা টি ও বড়োই প্রাসঙ্গিক,
“বন্দিতা
সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ
পূজিতা মুনিভিঃ
সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।”
…………মুনি’রা যার
কৃপালাভে নিত্য পূজা করেন, বৈদিক ঋষিরা যাঁকে তুষ্ট করতে সদা
ব্যস্ত থাকেন সিদ্ধ বা গন্ধর্বেরা পর্যন্ত যে দেবীর অর্চনা করেন সেই বাগদেবী’কে
বাদ দিয়ে বেদ উপনিষদ্ এর সনাতন ভারত-ভাবনা মনে আসবেই বা কী করে? প্রজ্ঞা- সৃজনশীলতা সুমেধা-সমৃদ্ধি’র নাম–ই যে সরস্বতী। সরস্বতী যে–ই হোন আর যারই দেবী হোন, শিক্ষার্থীর কাছে তাঁর পুজো মানে স্রেফ পড়াশোনার দেবীর পুজো
নয়। সে কথাটা ভালভাবেই বুঝেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাই জয়গোপাল তর্করত্নের
বাড়িতে বসে তিনি যে সরস্বতী বিষয়ক শ্লোকটি লেখেন, সেটি এরকম,
"লুচি কচুরি মতিচুর
শোভিতং
জিলেপি সন্দেশ গজা
বিরাজিতম।
যস্যাঃ প্রসাদেন ফলার
মাপ্লুমঃ
সরস্বতী সা
জয়তান্নিরস্তরম্॥"
জয়তু বাক্ দেবী।
কলমে - কমলেন্দু
সূত্রধর
তথ্যসূত্রঃ-
- সরস্বতী - শ্রী অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ
- বাঙ্গালীর পুজা-পার্ব্বণ - শ্রী অমরেন্দ্রনাথ রায়
- পূজা-পার্বণ - শ্রী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি
- পূজা-পার্বণের উৎসকথা - পল্লব সেনগুপ্ত
- নদীতমার রূপান্তর- প্রভাতকুমার চৌধুরী
- জ্যোতির্ময়ী বিদ্যাদেবী - সরস্বতীরাণী পাল, ভারতবিচিত্রা পত্রিকা, জানুয়ারী, ২০১৭ সংখ্যা
- শ্বেতাম্বর ধরা নিত্যা....- ডাঃ রঘুনাথ ষড়ঙ্গী
- কিভাবে এলেন এই সরস্বতী- বঙ্গদর্শন
- সরস্বতী পুজো ঘিরে বিতর্কে রবীন্দ্রনাথ-সুভাষ, চাকরি খোয়ালেন জীবনানন্দ- প্রহর
- সরস্বতী পুজোর ধুমধাম শুরু যৌনপল্লীতেই, বঙ্কিম-হুতোমের ব্যঙ্গের শিকার কলকাতার বাবুরা- প্রহর
- দেবী সরস্বতী: পৌরাণিক ও লোকজ - বীরেন মুখার্জী
- শুধু কি বিদ্যার দেবী? কৃষি সভ্যতা থেকে নিষিদ্ধপল্লী, প্রেম থেকে প্রজনন—বন্দিত তিনি- আজকাল
- নানারূপে মা সরস্বতী- তমাল দাশগুপ্ত
- সরস্বতী মুর্তি দ্বিভুজা না চতুর্ভুজা?- তমাল দাশগুপ্ত
- দেবী সরস্বতী – তিনি আসলে কে- সনাতন ধর্মতত্ত্ব
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন