শক্তিদেবী কালিকা ও তাঁর বিবর্তন- বৈদিক থেকে আধুনিক যুগ


তখন বৈদিক যুগ। এক গভীর রাত্রের কথা। রাত্রের সেই নিকষ অন্ধকারের দিকে অপলক ধ্যানদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ঋষি কুশিক । তাঁকে আবৃত করে হিল্লোলিত হচ্ছে গভীর কৃষ্ণ অন্ধকার । সহসা তাঁর অন্তরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রাত্রির সত্য, ও তার স্বরূপ । তিনি প্রত্যক্ষ করলেন রাত্রি রুপিনী মহা শক্তিকে । চিৎকার করে তিনি বলে উঠলেনঃ-

 

ওঁ রাত্রীব্যখা দায়তী পুরুত্রা দেব্যক্ষভিঃ।

বিশ্বা অধি শ্রিয়োহধিত।।

ওর্বপ্রা অমর্ত্যা নিবতো দেব্যুদ্বতঃ।

জ্যোতিষা বাধতে তমঃ ।।

নিরু স্ব্সারমস্কৃতোবসং দেব্যায়তী।

অপেদু হাসতে তমঃ।।

সা নো অদ্য যস্যা বয়ং নি তে যামন্ন বিক্ষ্ণহি।

বৃক্ষে ন বসতিং বয়ঃ ।।

নি গ্রামাসৌ অবিক্ষত নি পদ্বন্তো নি পক্ষিণঃ ।

নি শ্রেনাস শ্চিদর্থিনঃ ।।

যাবয়া বৃকাং বৃকং যবয় স্তেনমূর্ম্যে ।

অথা নঃসুতরা ভব ।।

উপ মা পেপিশত্তমঃ কৃষ্ণং ব্যক্তমস্তিত ।

উষ ঋণেব যাতয়ঃ ।।

উপ তে গায়বাকরং বৃনীষ দুহিত র্দিবঃ ।

রাত্রি স্তোমং জিগুষে ।। (ঋগ্বেদ-১০/১২৭)

 

অর্থাৎ, হে রাত্রি দেবী আপনি সর্ব দেশানুকুলে সর্বত্র বিরাজমানা । আপনি যে আসছেন প্রতিটি মুহর্তে আমি তার প্রকাশ পাচ্ছি, রাত্রি দেবী নক্ষত্র সমূহের দ্বারা প্রকাশমানা , রাত্রিদেবী সর্বশ্রী সর্ব কল্যাণ রূপ প্রদান করছেন সমগ্র বিশ্ব চরাচরে।

 অমর্ত্যা রাত্রিদেবী বিস্তীর্ণ নিখিল প্রপঞ্চকে অন্ধকারে পরিপূর্ণ করলেন; তারপর স্বীয় তেজ দ্বারা আবৃত করলেন নিম্ন লতা গুল্মাদিকে, এবং উচ্চ বৃক্ষাদি কে।। আর গ্রহ নক্ষত্রাদি রূপে জ্যোতির দ্বারা ত্বমো গুন কে নাশ করলেন ।।

রাত্রিদেবী আসছেন। নিজের বোন উষাকে আলোকমালায় সুসজ্জিত করলেন, উষা দেখা দিলে রাত্রির আঁধার দূর হয়। যার প্রাসাদে আমরা সুখে দুঃখে গৃহে অবস্থান করি, পাখিরা বৃক্ষে বাস করে সেই রাত্রী দেবী আজ আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। দেবীর কৃপায় গ্রামবাসীরা সুখে ঘুমায়, পশুপাখিরা সুখে ঘুমায়, দ্রুতশ্যেনাদিও সুখে থাকে ।।

মা রাত্রিদেবী, হিংসাদ্বেষ প্রভৃতিকে আমাদের কাছ থেকে দুরে রাখো, তস্করদের ও কাছ থেকে দুরে রাখো । তার পর আমাদের ভবসাগরে ত্বরান্নিত করিয়ে দাও ।।

সকল বস্তুর ওপর ঘন হয়ে আছে কালো অন্ধকার । সেই কালো স্পষ্ট রূপ নিয়ে এসেছে আমার কাছে , ওগো উষা , ওগো রাত্রিদেবী, একে ঘুচিয়ে দাও, যেমন করে ঘুচিয়ে দাও তোমার স্তবকারীদের ঋণ ।

ওগো রাত্রিদেবী, ওগো দ্যুতিমানের মেয়ে, দুগ্ধবতী গাভীর মতো স্বচ্ছতুমি , তোমার স্তব করছি, প্রসন্ন হও।তোমার প্রসাদে আমরা শত্রু জয় করব, আমাদের স্তবস্তুতি এবং হবি গ্রহন কর।।

ঋকবেদের ‘ শাকলসংহিতার’ অন্তর্গত উপরের এই রাত্রিসুক্তের রাত্রি দেবীই পরবর্তীতে দেবী কালীকাতে বিবর্তিত হয়েছেন। স্বামী অভেদানন্দ বলেন,

“এই রাত্রি দেবীই পরে করালবদনা রুপী কালী নামেই প্রসিদ্ধা হইয়াছেন’’।

ঋগ্বেদে যে রাত্রি, সেখান থেকে কালরাত্রি, সেখান থেকে কালী, এরকম একটা মত আছে। সেক্ষেত্রে কার্তিকী অমাবস্যায় এই যে মায়ের পুজো আমরা করি, সে এই উপমহাদেশে অন্তত চার-সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো। এছাড়া ঋগ্বেদে নক্‌ৎ-কৃষ্ণী উল্লিখিত হন। তিনিও কালীর একটি পারসেপশন।

 মানবসভ্যতায় দেবীপূজার ইতিহাস অতি প্রাচীন। পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতিগুলির মধ্যেও প্রাচীন কালে দেবীপূজার প্রচলন ছিলো। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, ভূমধ্যসাগরের তীরে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে মাতৃদেবীর পূজার সর্বব্যাপক প্রচলন ঘটেছিলো। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে সব প্রত্ন-উপাদান পাওয়া গেছে, তা থেকে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, প্রাক্-আর্যযুগে ভারতবর্ষে মাতৃদেবীর পূজার ব্যাপক প্রসার ছিলো। মূর্তিতে মাতৃপূজা কেবল মাত্র সিন্ধুযুগেই প্রচলিত ছিলো না, কৃষ্ণসাগরের তীরে এবং দানিয়ুব উপত্যকাতেও একইভাবে মূর্তির মাধ্যমে মাতৃদেবীর পূজা হতো।

হরপ্পায় প্রাপ্ত মাতৃদেবী মূর্তি 

 অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে,– ‘পণ্ডিতদের মতে হিন্দুদের শক্তি উপাসনা এসেছে অনার্যদের কাছ থেকে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে শক্তি বা মাতৃকা উপাসনা প্রস্তর যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। ইয়োরোপে সুপ্রাচীন যুগে (Palaeolithic and Neolithic ages) ভেনাসের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। দুইটি সন্তান ও স্বামী সহ মাতৃকামূর্তির আবিষ্কারও ঐযুগে শক্তিপূজার প্রমাণ দেয়। সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, প্যালেষ্টাইন, সাইপ্রাস, ক্রীট্ ও মিশরে মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে। মার্শাল সাহেবের মতে নীলনদ থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগ মাতৃকা পূজার ক্ষেত্র ছিল।’– (হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ- তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-১৬০)

 শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থের নিবেদনে বলেছেন– ‘মাতৃপূজার প্রচলন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কালে নানারূপে দেখা যায়, এখনও হয়ত স্থানে স্থানে কিছু কিছু অবশেষ রহিয়া গিয়াছে; কিন্তু ইহার কোথাওই ভারতবর্ষের অনুরূপ শক্তিবাদ বা শক্তিসাধনা গড়িয়া উঠিতে দেখি না। শক্তিবাদ এমন করিয়া আমাদের ভারতীয় চিন্তাধারার একটি বৈশিষ্ট্যের দ্যোতক বলিয়া এবং আমাদের জীবনের উপর এমন করিয়াই ইহার একটি সামগ্রিক প্রভাব বলিয়া ইহা বিশেষ করিয়া আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।’… ‘শাক্ত ধর্মমত ও সাধনা নানাভাবে এখনও ভারতবর্ষের প্রায় সব অঞ্চলেই অল্পবিস্তর দেখা যায় বটে, কিন্তু যেটুকু তথ্য আমার অধিগত হইয়াছে তাহাতে মনে হইয়াছে, এই সাধনা বাঙলাদেশে যেরূপ জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে, এমন অন্যত্র কোথাও নহে; এবং প্রকারে ও পরিমাণে বাঙলাদেশে যে শাক্ত সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহাও অন্যত্র কোথাও পাওয়া যায় না।’

 শাক্ত-তান্ত্রিক ভাবধারার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে সর্বোচ্চ দেবতা একজন নারী, যিনি নানা নামে ও নানা রূপে কল্পিতা।– ‘শাক্ত পুরাণসমূহের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী স্বয়ং আদ্যাশক্তিই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতীকস্বরূপ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে সৃষ্টি করেন। এই আদ্যাশক্তি বা শক্তিতত্ত্বের মূল সুপ্রাচীন যুগের মানুষের জীবনচর্যার মধ্যে নিহিত। আদিম চেতনায় নারী শুধুমাত্র উৎপাদনের প্রতীকই নয় সত্যকারের জীবনদায়িনীর ভূমিকাও তারই। সামাজিক বিবর্তনের প্রাথমিক স্তরগুলিতে তাই এই মাতৃত্বের ভূমিকাই ছিল প্রধান, জীবনদায়িনী মাতৃদেবীই ছিলেন ধর্মজীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এই নারীশক্তির সঙ্গে পৃথিবীর, মানবীয় ফলপ্রসূতার সঙ্গে প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার, সমীকরণ সাংখ্য ও তন্ত্রোক্ত প্রকৃতির ধারণার উদ্ভবের হেতু, যা থেকে পরবর্তীকালের শক্তিতত্ত্বের বিকাশ ঘটে। পৃথিবীর সর্বত্রই আদিম কৃষিজীবী কৌমসমাজে ধরণীর ফলোৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে নারীজাতির সন্তান-উৎপাদিকা শক্তিকে অভিন্ন করে দেখার রীতি বর্তমান। সংস্পর্শ বা অনুকরণের দ্বারা একের প্রভাব অন্যের উপর সঞ্চারিত করা সম্ভব এই বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই আদি-তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বতত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতির রহস্য মানবদেহেরই রহস্য, কারণ মানবদেহই বিশ্বপ্রকৃতির সংক্ষিপ্তসার।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট)

 এই বঙ্গদেশে শক্তিসাধনা মূলদুইভাগে বিভক্ত– প্রথমটা হলো দুর্গা-কেন্দ্রিক, আর দ্বিতীয়টা কালী-কেন্দ্রিক। পার্বতী উমা, সতী এবং দুর্গা-চণ্ডিকার ধারা মিলে পুরাণ-তন্ত্রাদিতে যে দুর্গাকেন্দ্রিক এক মহাদেবীর বিবর্তন দেখতে পাই, তার সাথে এসে মিলেছে কালী, করালী, চামুণ্ডা, তারা ও অন্যান্য দশমহাবিদ্যাকে নিয়ে আরেকটি ধারা, তা হলো দেবী কালিকা বা কালীর ধারা। এই কালী বা কালিকাই বাংলা অঞ্চলের শক্তিসাধনার ক্ষেত্রে দেবীর অন্য সব রূপ পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত সর্বেশ্বরী হয়ে উঠেছেন। তাই বাংলার শক্তি-সাধনা ও শাক্ত-সাহিত্যকে বুঝতে হলে এই কালী বা কালিকার ধারাটির প্রাচীন ইতিহাস একটু অনুসন্ধান করা প্রয়োজন বলে মনে হয়।

১৯ শতকের কালীঘাট পটচিত্রে দেবী কালী  


 ব্রহ্মযামলে’ আদ্যাস্তোত্রে আদ্যা দেবী কোন্ দেশে কী মূর্তিতে পূজিতা হন তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’, বঙ্গদেশে দেবী কালিকারূপে পূজিতা। উক্তিটিকে ইতিহাসের দিক থেকে গভীরার্থব্যঞ্জক বলে মনে হয়। কেননা বাংলা অঞ্চলই শক্তিসাধনার প্রধান কেন্দ্র। শুধু পূজার দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলায় কালীপূজা থেকে দুর্গাপূজা প্রাচীনতর। এখনও পর্যন্ত ধর্মোৎসব হিসেবে দুর্গাপূজাই অনেক বেশি জাকজমকপূর্ণ ও জনপ্রিয় হলেও বাঙালির এই শাক্ত-প্রবণতা শুধুমাত্র ধর্মোৎসবের মধ্যেই সীমায়িত নয় মোটেও; এর বীজ নিহিত আছে সাধনার অন্তরালে। আর এই সাধনার শুরু– প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। এর পরে ঐতিহাসিক যুগের সূচনার আদি-মধ্য ও নব্য পর্যায়ে এই সাধনার ধারা ব্রাহ্মণ্য ও অব্রাহ্মণ্য (প্রাকৃত বা অবৈদিক) এই দুই ধারাস্রোতে ক্রমবিবর্তিত হতে হতে বর্তমানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেই সাধনার দিক থেকে বিচার করলে, খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত এতদঞ্চলের শক্তিসাধনার কেন্দ্রে কালী। দেবী তারাকেও কালীস্থানীয়া করে নেয়া হয়েছে, এমনকি দশমহাবিদ্যার মধ্যকার অন্যান্য মহাবিদ্যাগণের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।

             কালিকা দেবী কী করে মহাদেবীর সঙ্গে মিলে গেলেন তার ইতিহাস বহু পুরাণের মধ্যেই পাওয়া যায়। বেদের কোথাও কালী বা কালিকা দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় না, অর্থাৎ, কালী বৈদিক কোনও দেবী নন। আবার বৈদিক ঋষিদের মধ্যেও একটা অদ্ভূত সংশ্লেষণী প্রবণতা দেখা যায়। যখনই কোনও অঞ্চলের লৌকিক দেব-দেবী বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে লৌকিক স্তর থেকে উত্তরিত হয়ে আঞ্চলিক বা আরও বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পায়, তখনই সেই দেব-দেবীকে বৈদিক দেবমণ্ডলীতে একীভূত করে দার্শনিকতার মোড়কে মহিমান্বিত করে নেওয়ার একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়। তাই ঋগবেদের রাত্রিসূক্তকে অবলম্বন করে পরবর্তীতে যে এক রাত্রিদেবীর ধারণা গড়ে উঠেছে, কারও কারও মতে সেই অন্ধকাররূপিণী রাত্রিদেবীই পরবর্তীকালে কালিকা রূপ ধারণ করেছেন। শুক্লযজুর্বেদে রাত্রির উপাসনা করা হচ্ছে। অথর্ববেদেও রাত্রি উপাসনা আছে (শশিভূষণ ৩০)। রাত্রিকে প্রকৃতি ভাবার কবিকল্পনা ও তন্ত্রকল্পনার পেছনে একাধিক যুক্তি আছে। আবার শতপথ(৭/২/৭) ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে(৪/১৭) উল্লেখিত পাশহস্তা কৃষ্ণা, ভয়ঙ্করী নির্ঋতি দেবীও কালীর সঙ্গে একীভূত হয়েছেন বলে মনে করা হয়। এই নির্ঋতি দেবীর পরবর্তীকালের ইতিহাস সম্ভবত বৌদ্ধ দেবী নৈরাত্মা।

 বৈদিক সাহিত্যে ‘কালী’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে। এই উপনিষদে অগ্নির সপ্তজিহ্বার দুইটি কালী ও করালীর নামে উল্লিখিত হয়েছে–

 

কালী করালী চ মনোজবা চ

সুলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা।

স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচি চ দেবী

লেলায়মানা ইতি সপ্তজিহ্বাঃ।। (মুণ্ডক-১/২/৪)


অর্থাৎ : যজ্ঞাগ্নির সেই লেলিহান শিখা আকাশপানে ওঠে সাত শিখা হয়ে। শৌনক, সেই সাতটি শিখার নাম– কালী, করালী, মনোজবা (মনের মতো দ্রুতগামী), সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী আর বড় সৌন্দর্যশালিনী বিশ্বরূচী। এই সাতটি শিখা হলো অগ্নিদেবের সাতটি জিভ। টলটলে, লকলকে এই জিভ দিয়ে অগ্নিদেব যজ্ঞের আহুতি দেন।

           এখানে ‘কালী’ আহুতি-গ্রহণকারিণী অগ্নিজিহ্বা মাত্রই; মাতৃদেবীত্বের কোনও আভাসই এখানে নাই। শুধু বিশ্বরূচীর ক্ষেত্রে দীপ্যমানা অর্থে দেবী কথাটির ব্যবহার দেখা যায়। মহাভারতেও (আদিপর্ব-২৩২/৭) যজ্ঞাগ্নির এই সপ্তজিহ্বার উল্লেখ পাওয়া যায়। দার্শনিক মতে পঞ্চ ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও মন– এই সাতটিকে অগ্নির সপ্তজিহ্বা বলে গ্রহণ করা হয়েছে।

মহাভারতে একাধিক স্থলে ‘কালী’র উল্লেখ পাওয়া যায় এবং পৌরাণিক কালী-দেবীর সাথে মহাভারতে বর্ণিত কালী-দেবীর বেশ মিল লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে দেখা যায়– কুরুক্ষেত্রে অন্যতম কৌরব-সেনাপতি আচার্য দ্রোণের মৃত্যুর পরে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা যখন গভীর রাত্রে পাণ্ডব-শিবিরে প্রবেশ করে নিদ্রিত বীরগণকে হত্যা করছিলেন তখন সেই হন্যমান বীরগণ ভয়ঙ্করী কালী-দেবীকে দেখতে পেয়েছিলেন। এই কালী-দেবী রক্তাস্যনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, পাশহস্তা এবং ভয়ঙ্করী। কালীর ভীষণ স্বরূপ সংহারের প্রতীক; কালরাত্রিরূপিণী এই দেবী বিগ্রহবর্তী সংহার।

পরবর্তীকালের যোজনা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এসব বর্ণনায় কালীর কোনও দেবীত্বের আভাস নাই; কালী এখানে অত্যন্ত ভীত মনের একটা ভয়ঙ্করী ছায়ামূর্তি দর্শনের ন্যায়। কবি কালিদাসের সময়েও কালী কোনও প্রধানা দেবী বলে গৃহীতা হননি। কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে উমার সাথে মহাদেবের বিবাহ-প্রসঙ্গে বরযাত্রার বর্ণনায় দেখা যায়, কৈলাস-পর্বতের মাতৃকাগণ বিবাহযাত্রায় মহাদেবের অনুগমন করেছিলেন; আর–

 

তাসাঞ্চ পশ্চাৎ কনকপ্রভাণাং কালী কপালাভরণা চকাশে।

বলাকিনী নীলপয়োদরাজী দূরং পুরঃক্ষিপ্তশতহ্রদেব।।– (কুমারসম্ভব-৭/৩৯)

 

অর্থাৎ– কনকপ্রভা তাঁহাদের (সেই মাতৃকাগণের) পশ্চাতে কপালাভরণা কালী অগ্রে বিদ্যুৎপ্রসারকারিণী বলাকাসমন্বিতা নীলমেঘরাজির ন্যায় শোভা পাইতেছিলেন।

            মাতৃকাগণের পশ্চাৎগামিনী এই কালী-দেবী কালিদাসের যুগেও একজন অপ্রধানা দেবী বলেই মনে হয়। ‘রঘুবংশে’র মধ্যে একটি উপমাতেও এই কালী বা কালিকা-দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন–

 

জ্যানিনাদমথ গৃহ্নতী তয়োঃ প্রাদুরাস বহুলক্ষপাচ্ছবিঃ।

তাড়কা চলকপালকুণ্ডলা কালিকেব নিবিড়া বলাকিনী।।– (রঘুবংশ-১১/১৫)


অর্থাৎ– রাম-লক্ষ্মণের জ্যা-নিঃস্বন শুনিয়া ভয়ঙ্করী তাড়কা রাক্ষসী যখন আত্মপ্রকাশ করিল তখন সেই ঘনকৃষ্ণ রাত্রির ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা তাড়কাকে মনে হইতেছিল চঞ্চলকপালকুণ্ডলা বলাকাযুক্তা কালিকার মত।

আবার, কুলচূড়ামণি তন্ত্রে কালীপুজোয় পঞ্চদশ নিত্যার ধ্যানমন্ত্র দেওয়া আছে। কালীর এই পঞ্চদশ নিত্যার মধ্যে একজনের নাম বলাকা। পঞ্চদশ নিত্যার নামঃ কালী, কপালিনী, কুল্লা , কুরুকুল্লা , বিরোধিনী, বিপ্রচিত্তা, উগ্রপ্রভা, দীপ্তা, নীলা, ঘনা, ভীমা, বলাকা, মাত্রা, মুদ্রা ও মিতা। পঞ্চদশ নিত্যার প্রত্যেকের বর্ণনা কালীর মতই। নিত্যা নাম থেকেও বোঝা যায় যে এঁরা আদিমাতৃকার সমার্থক। অর্থাৎ বলাকা কালীর রূপভেদ।

এই প্রসঙ্গে আর-একটি তথ্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কবি কালিদাসের ‘কালিদাস’ নামটির ব্যুৎপত্তি কি? ‘কালীর দাস’ এই অর্থে কি কালিদাস? কালিদাসের লেখার মধ্যে কালী তেমন কোনও প্রসিদ্ধ দেবীত্ব লাভ করেন নাই বটে, কিন্তু কালিদাস নামের ব্যুৎপত্তিতে মনে হয়, কালীর দেবীত্ব তখন যত সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রেই হোক, প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৫)

              এখানে উল্লেখ্য, ‘মহাভারতের বর্তমান রূপগ্রহণের আগেই অর্থাৎ আনুমানিক চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে দুর্গার সঙ্গে কালী অভিন্নতা লাভ করে। এরই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে। শিবের স্ত্রী দুর্গার সঙ্গে কালের (অর্থাৎ শিবের) শক্তিরূপে যাঁকে কল্পনা করা হয়, সেই কালীর অভিন্নতার কল্পনা তাঁকে মাতৃদেবীরূপে স্বীকৃতি দেয়। তিনি শুধুমাত্র অসুর নিধনের ভূমিকায় ভয়ংকরী রণোন্মাদিনী ধ্বংসের দেবী নন– তিনি একাধারে অশুভ শক্তিনাশিনী ও পরমমঙ্গলময়ী ও মাতৃস্বরূপিণী। তাই ভদ্রকালী রূপের মধ্যে দিয়েই দেখা যায় তাঁর পরমমঙ্গলময়ী মাতৃরূপের প্রকাশ।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২৩০-৩১)

            কালিদাসের পর সংস্কৃত সাহিত্যের স্থানে স্থানে এক রক্তলোলুপা ভয়ঙ্করী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তা তখনও ব্রাহ্মণ্যধর্মে জায়গা করে নিতে পারেনি।

অন্যদিকে– ‘খিল হরিবংশে’ মদ্যমাংসপ্রিয়া এক দেবীকে বর্বর, শবর ও পুলিন্দদের দ্বারা পূজিত হতে দেখা যায়। ষষ্ঠ শতকে সুবন্ধুর বাসবদত্তায় দেখি দেবী গঙ্গাতীরে কুসুমপুরে পূজিতা হন, ইনি শুম্ভ নিশুম্ভ মহাবন দাবজ্বালা, এবং বেতালাভিধানা। এর পরে (৭ম শতকে) বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’তেও বনের মধ্যে শবর পূজিত নরমাংস ও রক্তস্নাত দেবীর কথা পাই। আবার (আনুমানিক ৭ম শতাব্দী) ভবভূতির ‘মালতী মাধব’ নাটকে নরমাংস বলিদানে পূজিতা ভয়ংকরী শ্মশানবাসিনী এক করালা দেবীর বর্ণনা পাই। বলাই বাহুল্য ইনি কৃষ্ণবর্ণা ও উগ্রা। ৮ম শতাব্দীবাক্‌পতিরাজ গউড়বাহো (গৌড়বধ, গৌড়/মগধসম্রাটের নিধন ছিল কাব্যের বিষয়) প্রাকৃত কাব্যে দেবীকে শবর পূজিতা পর্ণপত্র পরিহিতা বলা আছে।

এরপরে পৌরাণিক যুগে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে– দেবী কালিকা অসুরবধের প্রয়োজনেই ধরাধামে অবতীর্ণা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের সাত শত শ্লোক নিয়েই সপ্তশতী ‘চণ্ডী’ গ্রন্থ। আর এই ‘চণ্ডীর প্রথম অধ্যায়ে ৭০ থেকে ৮৭ সংখ্যক মন্ত্রকেও রাত্রিসূক্ত বলা হয়, কারণ সেখানে দেবীকে কালরাত্রি বলা হয়েছে। এখানেই (উত্তর চরিতে) আছে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্যে হিমালয়স্থিতা দেবীর কাছে অনুরোধ করলে দেবীর শরীরকোষ থেকে আর এক দেবী সমুদ্ভূতা হলেন। শরীরকোষ থেকে নিসৃতা বলে তিনি ‘কৌশিকী’ নামে পরিচিতা হলেন। এদিকে কৌশিকী দেবী বিনির্গত হওয়ায় পার্বতী নিজেই কৃষ্ণবর্ণা হয়ে হিমাচলবাসিনী ‘কালিকা’ নামে সমাখ্যাতা হলেন। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, এই যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দেবী কালিকা কিঞ্চিৎ প্রতিষ্ঠা ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাই তাঁকে হিমাচলবাসিনী দেবীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। এই কৌশিকীদেবী মূলে কুশিক জাতির পূজিতা দেবী ছিলেন বলে ভান্ডারকরের অভিমত। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে তাঁকে গৌরবর্ণা অনিন্দ্যসুন্দরী বলা হলেও পদ্মপুরাণ ও কালিকা পুরাণে অন্য কথা বলা আছে। সেখানে বলা আছে, দেবীর দেহ থেকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা যে রাত্রিদেবী বা কালরাত্রি দেবী বার হলেন– তিনিই কৌশিকী। এই কৌশিকী দেবীকে ব্রহ্মা বিন্ধ্যাচলে প্রতিষ্ঠিতা হতে বললেন। এই সব পরস্পরবিরোধী উপাখ্যানগুলো থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, কৌশিকী নামে যে স্বতন্ত্র দেবী ছিলেন, তাঁকে মহাদেবীর সঙ্গে এক করে দেওয়ার এ এক অনলস, পৌরাণিক প্রচেষ্টা।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২২৮-২৯)

এখানে ‘কালিকা’র আবির্ভাব-রহস্য এভাবে দেখা গেলেও একটু পরেই আবার অন্যরূপে দেখা যায়। যেমন, অসুর শুম্ভ-নিশুম্ভের অনুচর চণ্ড-মুণ্ড এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্য অসুরেরা দেবীর নিকটবর্তী হলে–

 

ততঃ কোপং চকারোচ্চৈরম্বিকা তানরীন্ প্রতি।

কোপেন চাস্যা বদনং মসীবর্ণমভূৎ তদা।।

ভ্রূকুটীকুটিলাৎ তস্যা ললাটফলকাৎদ্রুতম্ ।

কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/৫-৬)


অর্থাৎ– তখন অম্বিকা সেই শত্রুগণের প্রতি অত্যন্ত কোপ করিলেন; তখন কোপের দ্বারা তাঁহার বদন মসীবর্ণ হইল। তাঁহার ভ্রূকুটীকুটিল ললাটফলক হইতে দ্রুত অসিপাশধারিণী করালবদনা কালী বিনিষ্ক্রান্তা হইলেন।

 এই কালী-দেবী–

 

বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা।

দ্বীপিচর্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।।

অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা।

নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্মুখা।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/৭-৮)


অর্থাৎ– বিচিত্র নরকঙ্কালধারিণী, নরমালাবিভূষণা, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা, শুষ্কমাংসা (মাংসহীন অস্থিচর্মময় দেহ), অতিভৈরবা, অতি বিস্তারবদনা, লোলজিহ্বা-হেতু-ভীষণা, কোটরাগত রক্তবর্ণ-চক্ষুবিশিষ্টা– তাঁহার নাদে দিঙ্মুখ আপূরিত।

অষ্টমাতৃকাদের সাথে রক্তবীজকে নিধন করছেন দেবী চামুণ্ডা

 

           এর পর দেবীর সঙ্গে চণ্ড-মুণ্ডের ভয়ঙ্কর যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন– ‘দেবী হইতে বিনিষ্ক্রান্ত হইয়াই সেই কালী-দেবী বেগে দেবশত্রু অসুরগণের সৈন্যমধ্যে অভিপতিতা হইয়া সেখানে মহা-অসুরগণকে বিনাশ করিতে করিতে তাহাদের সৈন্যবলকে ভক্ষণ করিতে লাগিলেন। সেই দেবী পৃষ্ঠ-রক্ষক, অঙ্কুশ-গ্রাহক, যোদ্ধা ও গলঘণ্টাদিসহ হস্তীগুলিকে হস্তে লইয়া মুখে গ্রাস করিতে লাগিলেন। শুধু হস্তুগুলিকে নয় ঘোড়ার সহিত যোদ্ধাকে, সারথির সহিত রথকে মুখে ফেলিয়া দিয়া দন্তদ্বারা অতি ভীষণভাবে চর্বণ করিতে লাগিলেন। কাহাকেও চুলে ধরিলেন, আবার কাহাকেও গ্রীবায় ধরিলেন; কাহাকেও পায়ের দ্বারা আক্রমণ করিয়া অন্যকে বক্ষের দ্বারা মর্দিত করিলেন। সেই অসুরগণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত শস্ত্রগুলিকে এবং মহাস্ত্রগুলিকে তিনি মুখে গ্রহণ করিলেন এবং রোষে দন্তদ্বারাই মথিত (চূর্ণ) করিলেন। অসুরদলের কতকগুলিকে তিনি মর্দন করিলেন, কতকগুলিকে ভক্ষণ করিলেন, কতকগুলিকে বিতাড়িত করিলেন। 

দেবী চামুণ্ডা

অসুরগণ কেহ কেহ অসিদ্বারা নিহত হইল, কেহ কেহ কঙ্কালের দ্বারা তাড়িত হইল, কেহ কেহ দন্তাঘাতে বিনাশ প্রাপ্ত হইল। ক্ষণকালমধ্যে সমস্ত অসুরসৈন্য নিপতিত দেখিয়া চণ্ড সেই অতিভীষণা কালীর দিকে ধাবিত হইল। সেই মহাসুর চণ্ড মহাভীম শরবর্ষণের দ্বারা এবং মুণ্ড চক্রসমূহের দ্বারা সেই ভীষণ-নয়নাকে ছাইয়া ফেলিল। কিন্তু কালমেঘের উদয়ে যেমন অসংখ্য সূর্যবিম্ব শোভা পায় সেইরূপ চক্রসমূহ তাঁহার মুখগহ্বরে প্রবিষ্ট হইয়া শোভা পাইল। অতঃপর ভৈরবনাদিনী কালী অতিরোষে ভীষণভাবে অট্টহাস্য করিলেন– তাঁহার করাল বক্ত্রের অন্তঃপাতী ভীষণদর্শন দশনগুলি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তাহার পরে মহাখড়্গ উত্তোলনপূর্বক দেবী হুঙ্কারনাদে (হং শব্দে) চণ্ডের প্রতি ধাবিত হইলেন, এবং তাহার চুলে ধরিয়া সেই খড়্গের দ্বারাই তাহার শিরশ্ছেদ করিলেন। চণ্ডকে নিপতিত দেখিয়া মুণ্ড দেবীর প্রতি ধাবিত হইল; দেবী ক্রোধে তাহাকেও খড়্গরে দ্বারা আহত করিয়া ভূমিতে পাতিত করিলেন। হতশেষ অসুরসৈন্য চণ্ড-মুণ্ডকে নিহত দেখিয়া ভয়ে চতুর্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৭-৮)

নৃত্যরত চামুণ্ডা মূর্তি ,পালযুগ,উত্তর ভারত

এরপর চণ্ড-মুণ্ডের ছিন্ন মুণ্ড হাতে নিয়ে দেবী কালিকা চণ্ডীকে তা উপহার দিলেন। দেবী চণ্ডিকা তখন কালীকে বললেন–

 

যস্মাৎ চণ্ডঞ্চ মুণ্ডঞ্চ গৃহীত্বা ত্বমুপাগতা।

চামুণ্ডেতি ততো লোকে খ্যাতা দেবি ভবিষ্যসি।।– (মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী-৭/২৭)


অর্থাৎ– যেহেতু তুমি চণ্ড ও মুণ্ডকে (তাহাদের ছিন্ন শির) লইয়া আসিয়াছ, সেই কারণে তুমি লোকে (জগতে) চামুণ্ডা নামে খ্যাতা হইবে। পালযুগে এই চামুণ্ডা মূর্তির প্রভূত উপাসনা হত। বাঙালি সেযুগে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে যেত খুব সম্ভবত চামুণ্ডার চিত্রাঙ্কিত পতাকা হাতে, শত্রু ভয় পেত। চামুণ্ডার আরেকটি রূপ চর্চিকা বা চর্চা নামেও পরিচিত (রাজশাহী অঞ্চলে একটি পালযুগের প্রস্তরমূর্তি মিলেছে, সেটি চর্চার নামাঙ্কিত, ইনি বৃক্ষতলে শবের ওপরে উপবিষ্ট, সে ছবিটি দিলাম)। চর্চা অর্থে চাঁছাছোলা, অর্থাৎ কঙ্কালসার দেবী (এ ব্যুৎপত্তি সুকুমার সেনের। কিন্তু ডাক্তার রক্তিম মুখুজ্যে বলছেন এই দেবী তাঁর রক্তলিপ্ত জিহ্বা চর্চন করেন বলেই এই নাম)।

               এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, চণ্ড ও মুণ্ড শব্দদ্বয় থেকে খুব গোঁজামিল না দিলে ব্যুৎপত্তিগতভাবে চামুণ্ডা শব্দ হয় না। আসলে পুরাণকারেরা কালীদেবীর সঙ্গে চামুণ্ডা দেবীকে এক করে দিয়ে অম্বিকা-চণ্ডী-পার্বতী-কালী ও চামুণ্ডাকে দেবী মহামায়ার রূপভেদ মাত্র বলে, সমস্ত দেবীকে মহাদেবীর সঙ্গে এক ও অভিন্ন করে তুলতে চেয়েছেন।

এরপরে রক্তবীজ বিনাশের সময়ও কালী-দেবী চণ্ডিকাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। কারণ রক্তবীজের রক্তধারা ভূমিস্পর্শ করলেই তা থেকে শত শত রক্তবীজ জন্মাবে। তাই দেবীচণ্ডী কালীকে বদন বিস্তার করে রক্তবীজের দেহ থেকে নির্গত সমস্ত রক্তবিন্দু মুখব্যাদানের দ্বারা গ্রহণ করতে বললেন– এবং সেই রক্তনির্গত অসুরগণকেও ভক্ষণ করতে বলে শূল দিয়ে তাকে আহত করলেন, কালীও মুখের দ্বারা তাঁর রক্ত লেহন করলেন। কালী-চামুণ্ডার মুখে পতিত শোনিত থেকে যত অসুর সমুদ্গত হয়েছিল তাদেরকেও চামুণ্ডা ভক্ষণ করলেন। চামুণ্ডার এরূপ রক্ত পানের ফলে রক্তবীজ নিরক্ত হয়ে গেল, দেবী তখন সহজেই তাকে হনন করলেন। এভাবেই কালী-চামুণ্ডার রক্তলোলুপতা ও ভয়ঙ্কর ভয়ালরূপ ‘চণ্ডী’তে প্রকাশ পেল। 

অষ্টভুজা চামুণ্ডা,একাদশ শতক,পালযুগ,এটি চামুণ্ডার চর্চারূপও বটে।পদতলের শব এখানে শিবে রূপান্তরিত হয়নি ।


এ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী–

রক্তলোলুপা কালীর এখানে যে ভয়ঙ্করী রণোন্মাদিনী রূপ দেখিতে পাইলাম অন্যান্য পুরাণে এই জাতীয় বহু বর্ণনা দেখিতে পাই। উপ-পুরাণগুলিতে ইহার আর কিছু কিছু বিস্তারও দেখিতে পাই। পরবর্তী কালের পুরাণতন্ত্রাদিতে আমরা কালী ও চামুণ্ডাকে এক করিয়াও পাই, পৃথক্ করিয়াও পাই। উভয় দেবীর ধ্যানেও পার্থক্য আছে। চামুণ্ডা চতুর্ভুজা নন, দ্বিভুজা; আলুলায়িত-কুন্তলা নন, ‘পিঙ্গলমূর্ধ্বজা’ (জটাধারিণী?); উলঙ্গিনী নন, শার্দূলচর্মাবৃতা; (কোন কোন পুরাণে গজচর্মাম্বরা); সর্বস্থলের বর্ণনাতেই দেখি, চামুণ্ডা-দেবী নির্মাংসা এবং কৃশোদরী, তাঁহার চক্ষু কোটরাগত। কোন স্থলেই কালিকার এইরূপ বর্ণনা দেখিতে পাই না। সংস্কৃত সঙ্কলন-গ্রন্থগুলিতে কালিকার বর্ণনায় মাঝে মাঝে দেখিতে পাই যে কালিকা অজিনাবৃতা। ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ ধৃত উমাপতি ধরের একটি শ্লোকেও কালীকে অজিনাবৃতাই দেখিতে পাই। ইহা পরবর্তী কালের মিশ্রণের ফলে ঘটিয়াছে বলিয়া মনে করি। চামুণ্ডার বর্ণনায় একটা জিনিস প্রায় সর্বত্রই লক্ষ্য করি, চামুণ্ডা অতি ক্ষুধায় কৃশোদরী। কবিগণ কর্তৃক কালীর বর্ণনায়ও স্থানে স্থানে কালীকে ক্ষুধার্তারূপে দেখি। ভাসোক কবি কালীকে ‘ক্ষুৎক্ষামা’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৯) কিন্তু শশিভূষণের পর্যবেক্ষণে কিঞ্চিৎ ভ্রান্তি দেখা যায় যেমন,  চতুর্ভূজা চামুণ্ডা মূর্তি পালযুগে পাওয়া গেছে। অষ্টভূজা চামুণ্ডা মূর্তিও পাওয়া গেছে। চামুণ্ডা কদাচিৎ দ্বিভূজা, প্রায়শঃ তাঁর বাহুসংখ্যা বেশিতবে মিলও প্রচুর। সর্বাধিক মিল দুজনেই লোলজিহ্বা, এবং দুজনেই শব>শিবকে পদতলে রাখেন। পালযুগের চামুণ্ডা মূর্তি দেখলে শব থেকে শিবে রূপান্তরের রূপরেখাটি বোঝা যায়।

 

              পুরাণ, উপপুরাণ ও তন্ত্রাদির মধ্যে কালী বা কালিকার যে বিস্তার ও বিবর্তন দেখা যায়, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো কালীর শিবের সঙ্গে যোগ। শিব কালীর পদে স্থিতা, কালীর এক পা শিবের বুকে ন্যস্ত। সাধকের দিক থেকে এ তত্ত্বকে নানাভাবে গভীরার্থক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি উপাদান মুখ্যভাবে এই শিবারূঢ়া দেবীর বিবর্তনে সাহায্য করেছে বলে শ্রীদাশগুপ্তের ধারণা–

প্রথমতঃ, সাংখ্যের নির্গুণ পুরুষ ও ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির তত্ত্ব। দ্বিতীয়তঃ, তন্ত্রের ‘বিপরীতরতাতুরা’ তত্ত্ব। তৃতীয়তঃ, নিষ্ক্রিয়া দেবতা শিবের পরাজয়ে বলরূপিণী শক্তিদেবীর প্রাধান্য এবং প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা প্রধান কারণ যাহা মনে হয় তাহা হইল এই, প্রাচীন বর্ণনায় কালিকা শিবারূঢ়া নন, শবারূঢ়া; অসুরনিধন করিয়া অসুরগণের শব তিনি পদদলিত করিয়াছেন, সেই কারণেই তিনি শবারূঢ়া বলিয়া বর্ণিতা।– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭০)

দক্ষিণাকালীর প্রচলিত ধ্যানের মধ্যেও দেখা যায়–

 

শবরূপ-মহাদেব-হৃদয়োপরি-সংস্থিতাম্ । … … …

মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্ ।।

 

              পরবর্তীকালের দার্শনিক চিন্তায় শক্তি-বিহনে শিবের শবত্ব-প্রাপ্তির তত্ত্ব খুবই প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। মনে হয় তখন শিবই পূর্ববর্তীকালের বর্ণিত শবের স্থান গ্রহণ করেন, শবারূঢ়া দেবীও হয়ে ওঠেন শিবারূঢ়া। অসুরের শবারূঢ়া বলেই যে দেবী শিবারূঢ়া বলে কীর্তিতা বাংলাদেশের শাক্ত পদাবলীর মধ্যে এই সত্যটির প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। তাই শ্রীদাশগুপ্তের উল্লেখকৃত সাধক রামপ্রসাদের গানে দেখতে পাই, বলা হয়েছে–

 

শিব নয় মায়ের পদতলে।

ওটা মিথ্যা লোকে বলে।।

দৈত্য বেটা ভূমে পড়ে,

মা দাঁড়ায়ে তার উপরে,

মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহ

শিবরূপ হয় রণস্থলে।।

 

               মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহও শিবরূপতা প্রাপ্ত হয়– কথাটার আসল অর্থ হলো, এ কথার মধ্যে দিয়েই শক্তিতত্ত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। এ ছাড়াও তন্ত্রে শিবের বুকে কালীর প্রতিষ্ঠা বিষয়ে বহুরকম দার্শনিক ব্যাখ্যা দেখা যায়। যেমন, মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে–

 

কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ।

মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা।।

কালসংগ্রহণাৎ কালী সর্বেষামাদিরূপিণী।

কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়সে।। –(মহানির্বাণতন্ত্র)


অর্থাৎ– তিনি মহাকাল, তিনি সর্বপ্রাণীকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন বলিয়াই মহাকাল; দেবী আবার এই মহাকালকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন, এই নিমিত্ত তিনি আদ্যা পরম ‘কালিকা’। কালকে গ্রাস করেন বলিয়াই দেবী কালী। তিনি সকলের আদি, সকলের কালস্বরূপা এবং আদিভূতা, এই নিমিত্তই লোকে দেবীকে আদ্যাকালী বলিয়া কীর্তন করে।

 শিব ও শক্তির সম্পর্ক আমরা নিত্য ভাবি। কালিদাস লিখেছেন যে বাক্য ও অর্থের মতই শিব ও শক্তির সম্পর্ক। কিন্তু শশিভূষণ দাশগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, সমগ্র চণ্ডীতে (মার্কণ্ডেয়পুরাণের চণ্ডী) শিবের অনুপস্থিতি, এবং শিবের সঙ্গে দেবীর সম্পর্কহীনতা লক্ষণীয়। বরং দেবীকে বিষ্ণুশক্তি হিসেবেই পাচ্ছি , বিষ্ণুমায়া হিসেবেও। দেবীকে বারবার “…নারায়ণী নমোহস্তুতে বলে প্রণাম করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে এই গ্রন্থ রচনার সময় বিষ্ণুভাগবতধর্মীয় হস্তক্ষেপ ঘটেছে।

 দেবী যখন শুম্ভের সঙ্গে যুদ্ধরত, তখন শিবকে গৌণভাবে পাওয়া গেল, মহেশ্বরের শক্তি হিসেবে মাহেশ্বরী আসেন দেবীকে সাহায্য করতে। আরও অন্যান্য দেবতার শক্তিও আসেন এই সময়। অর্থাৎ দেবীর পার্শ্বে শিবের কোনও এক্সক্লুসিভ স্থান এখনও স্বীকৃত নয়।

 শিব ও শক্তির প্রথম সাযুজ্যসাধন সম্ভবত গুপ্তযুগে, স্কন্দগুপ্তের সময়কার উমা ও শিবের যুগলমূর্তি দ্রষ্টব্য। এই যুগ থেকেই লিঙ্গ সর্বদা যোনিপট্টের দ্বারা আশ্রিত (কেবলমাত্র লিঙ্গের উপাসনা গুপ্ত-পূর্ব যুগে হত বটে, তারপর বন্ধ হয়ে যায়)। এক্ষেত্রে লকুলীশ শিবের কোনও একটা ভূমিকা থাকতে পারে। সম্ভবত শিব ও শক্তির বিবাহের একটি উৎসব শশাঙ্কযুগে শুরু হয়েছিল, বাঙালির নতুন বছর এই শিব ও নীলাবতী (নীলসরস্বতী বা তারা)-র বিবাহের কাহিনী উদযাপন করে, প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনের উদযাপনে পালিত হত। সম্ভবত শশাঙ্কযুগেই শক্তির নারায়ণী রূপটি মুছে তাঁকে শিবের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত করা হয়েছিল, সে কাজ পালসেনযুগে অবিচ্ছিন্নভাবে চলেছে। শিব ও চামুণ্ডা/কালীর পরিবার পরিকল্পনা কাজেই তুলনায় আধুনিক।

 

জব্বলপুর থেকে প্রাপ্ত বেলেপাথরের কালীমুর্তি


কালীর পায়ের তলায় শিবকে নিয়ে নানা চমৎকার কবিকল্পনা। কমলাকান্ত লিখেছিলেন, মায়ের রাঙা পদযুগল ছাড়া তো আর কিছুই নেই, কিন্তু সেও বাবা ভোলানাথ দখল করেছেন, তাই সাহস-ভাঙা হলাম। কবিওয়ালা ঈশ্বর চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন শিব সম্পর্কে, “সদা চক্ষু মুদে রয়, ওই পদদ্বয় ছাড়ে না”। রামপ্রসাদের ভাষায়, “যেমন শিব জেনেছেন কালীর মর্ম, অন্য কে বা জানে তেমন”। ঝিনুকে যেমন বালি ঢুকে গিয়ে মুক্তো জন্মায়, তেমন এই মাতৃকা-উপাসক জাতির পরিসরে পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের রুদ্র আর বিষ্ণু এসে কালী-শিব, রাধা-কৃষ্ণের কল্পনার জন্ম দিয়েছেন। সে অত্যাশ্চর্য রকমের সুন্দর।

 

                বিভিন্ন পুরাণ-তন্ত্রাদির মধ্যে ‘কালীতন্ত্র’-ধৃত কালীর বর্ণনাই কালীর ধ্যানরূপে কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে গৃহীত হয়েছে। তন্ত্রসারে বর্ণিত কালীর এ রূপই এখন সাধারণভাবে বাংলা অঞ্চলের মাতৃপূজায় গৃহীত। তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী দেবী কালীর রূপ হলো–

দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। বামহস্ত-যুগলের অধোহস্তে সদ্যশ্ছিন্ন শির, আর ঊর্ধ্বহস্তে খড়্গ; দক্ষিণের অধোহস্তে অভয়, ঊর্ধ্বহস্তে বর। দেবী মহামেঘের বর্ণের ন্যায় শ্যামবর্ণা (এইজন্যই কালী-দেবী শ্যামা নামে খ্যাতা) এবং দিগম্বরী; তাঁহার কণ্ঠলগ্ন মুণ্ডমালা হইতে ক্ষরিত রুধিরের দ্বারা দেবীর দেহ চর্চিত; আর দুইটি শবশিশু তাঁহার কর্ণভূষণ। তিনি ঘোরদ্রংষ্ট্রা, করালাস্যা, পীনোন্নতপয়োধরা; শবসমূহের করদ্বারা নির্মিত কাঞ্চী পরিহিতা হইয়া দেবী হসন্মুখী। ওষ্ঠের প্রান্তদ্বয় হইতে গলিত রক্তধারা-দ্বারা দেবী বিস্ফুরিতাননা; তিনি ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী– শ্মশানগৃহবাসিনী। বালসূর্যমণ্ডলের ন্যায় দেবীর ত্রিনেত্র; তিনি উন্নতদন্তা, তাঁহার কেশদাম দক্ষিণব্যাপী ও আলুলায়িত। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা; তিনি চতুর্দিকে ঘোররবকারী শিবাকুলের দ্বারা সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সহিত ‘বিপরীতরতাতুরা’, সুখপ্রসন্নবদনা এবং ‘স্মেরাননসরোরুহা’।– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭১)মহানির্বাণতন্ত্রে মহাদেব ব্যাখ্যা দেন যে কালীর কালো রঙ, কারণ শ্বেতপীতাদিবর্ণ সবই কালোতে এসে লয় পায়। সেরকম সর্বভূত এসে কালীতে মেশে (শশিভূষণ ৭২)। এই ব্যাখ্যাটি সুন্দর।

 

কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ-সঙ্কলিত এই সুপ্রসিদ্ধ ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীপূজার বিধান সংগৃহীত হয়েছে। বাংলা অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ‘কালী’ আছেন। তন্ত্রসারে বিভিন্ন প্রকার কালীর সাধনার পদ্ধতি দেখা যায়। এখানে কালী– বা শ্যামা-পূজার বিধি ছাড়াও তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, বগলা প্রভৃতি মহাবিদ্যাগণের সাধনবিধিও সঙ্কলিত হয়েছে। কৃষ্ণানন্দকে ষোড়শ শতকের লোক বলে ধরা হয়। কৃষ্ণানন্দ ছাড়া তান্ত্রিক সাধনা ক্রিয়াকলাপবিধি সম্বন্ধে গ্রন্থরচয়িতারূপে ব্রহ্মানন্দ ও সর্বানন্দের প্রসিদ্ধি রয়েছে। ব্রহ্মানন্দ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম বা মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘শাক্তানন্দতরঙ্গিণী’তে শাক্তদের আচার-অনুষ্ঠান বিশেষভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘তারারহস্যে’ তারার উপাসনা বিবৃত হয়েছে। ব্রহ্মানন্দের শিষ্য পূর্ণানন্দ পরমহংস ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লোক। তাঁর রচিত ‘শ্যামারহস্যে’ কালীর উপাসকের আচার-অনুষ্ঠান বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও আরও একজন গ্রন্থকার গৌড়ীয় শঙ্কর (শঙ্কর আগমাচার্য, ১৬৩০) তার উপাসনার আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে রচনা করেন– ‘তারারহস্যবৃত্তিকা’।

 

বর্তমানে নিত্য কালীপূজার প্রথা রয়েছে বা বিশেষ কোন উপলক্ষে ‘মানসিক’-করা কালীপূজার ব্যবস্থা হয়। এ ছাড়া দীপালি-উৎসবের বা দীপাবলির দিনে যে সাংবাৎসরিক কালী বা শ্যামাপূজার জনপ্রিয় প্রচলন রয়েছে তার সর্বপ্রথম বিধিব্যবস্থা পাওয়া যায় কাশীনাথ (১৭৬৮) রচিত ‘কালীসপর্যাবিধি’ গ্রন্থে। শ্রীদাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী, এ গ্রন্থে কাশীনাথ যেভাবে কালীপূজার সপক্ষে যুক্তি-তর্কের অবতারণা করেছেন তাতে মনে হয়, তখন ‘বাংলাদেশে’ এই সাংবাৎসরিক দীপাবলির দিনে কালীপূজা বা শ্যামাপূজা যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল না। কালীপূজা বিষয়ে প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই এই পূজার প্রবর্তন করেন এবং তিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁর প্রজাদের মধ্যে যারা কালীপূজা করতে অস্বীকৃত হবে তাদেরকে কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হবে। এ আদেশের ফলে প্রতি বছর দশ হাজার করে কালীমূর্তি পূজিত হতো বলে জানা যায়। কথিত আছে, পরবর্তীকালে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র সহস্র সহস্র মন নৈবেদ্য, সহস্র সহস্র বস্ত্র ও সেই পরিমাণ বিভিন্ন উপচার সহযোগে কালীপূজা করেছিলেন। এছাড়া রটন্তী চতুর্দশীর রাত্রিতে (মাঘের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে) কালীপূজার কথা ‘স্মৃতিসমুচ্চয়’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই দেবীকে অবলম্বন করেই বাংলায় তন্ত্র-সাধনা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের বর্ণনায়–

এই দেবী-পূজার ইতিহাসটাই বাংলাদেশের শাক্তধর্মের ক্ষেত্রে প্রধান কথা নহে; প্রধান জিনিস হইল দেবীকে অবলম্বন করিয়া বাংলার তন্ত্র-সাধনা, এই তন্ত্র-সাধনা মুখ্যভাবে যুক্ত হইয়া গিয়াছিল কালী-সাধনা এবং দশমহাবিদ্যার সাধনার সঙ্গে, এবং খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতক হইতে আমরা কালী এবং অন্যান্য দশমহাবিদ্যার সাধনা অবলম্বনে বিখ্যাত শক্তি-সাধকগণের কথা জানিতে পারি। আমরা পূর্বে কালীপূজার বিধান রচয়িতৃরূপে কৃষ্ণানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, পূর্ণানন্দ প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছি; ইঁহারা সাধকও ছিলেন। অন্যান্য সাধকগণের মধ্যে ষোড়শ শতকের সর্বানন্দ ঠাকুর অতিশয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। ত্রিপুরা জেলার মেহার গ্রামে তাঁহার আবির্ভাব হয়। তিনি শবরূপী ভৃত্য পূর্ণানন্দের দেহের উপরে বসিয়া সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন এবং দশমহাবিদ্যার সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। তান্ত্রিক সাধনার ক্ষেত্রে তাঁহার বংশধর তান্ত্রিক সাধকগণ ‘সর্ববিদ্যা’র বংশ বলিয়া খ্যাত। তন্ত্র-সাধনার ক্ষেত্রে ‘অর্ধকালী’রও প্রসিদ্ধি আছে। প্রায় তিন শত বৎসর পূর্বে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত মুক্তাগাছার সমীপবর্তী পণ্ডিতবাড়ি গ্রামে দ্বিজদেব-নামক সাধকের গৃহে ইনি কন্যারূপে আবির্ভূতা হন। তাঁহার নাম ছিল জয়দুর্গা, তিনি স্বয়ং মহেশ্বরী বলিয়া প্রবাদ। তাঁহার দেহের অর্ধেক কৃষ্ণবর্ণ ও অর্ধেক গৌরবর্ণ ছিল বলিয়া তাঁহার অর্ধকালী নাম হইয়াছিল। গোঁসাই ভট্টাচার্য নামে খ্যাত রত্নগর্ভ-নামক সাধক ঢাকা জেলার মায়ৈসারের দিগম্বরীতলায় বীরাচারে সিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। কথিত হয়, ইনি প্রসিদ্ধ ‘বারভূঞা’র মধ্যে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের গুরু ছিলেন। প্রায় শত বর্ষ পূর্বে বীরভূম জেলার তারপীঠের নিকট আটলাগ্রামে সাধক বামাক্ষেপার জন্ম হয়; তারাপীঠ তাঁহার সাধনা ও সিদ্ধির স্থান।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৭৬)

আর অশোক রায়ের বর্ণনায়– ‘সাহিত্যে ও সাধনার শাক্তধারায় জোয়ার আসে অষ্টাদশ শতকে। সাধক রামপ্রসাদ সেন বাংলা ভাষায় শাক্ত পদাবলীর সূচনা করেন। তাঁর পরে, কমলাকান্ত ও গোবিন্দ চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়াও প্রায় একশত বছর ধরে বীরভূম জেলার তারাপীঠের সাধক বামাখ্যাপার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারপরে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দিরের সাধক পূজারি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ প্রমুখেরা শাক্ত-সাধনাকে সারা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যোগীপুরুষ শ্রীঅরবিন্দ শক্তি সাধনার গূঢ় তত্ত্ব ও রহস্যকে তাঁর ‘অখণ্ড মহাযোগে’র সঙ্গে সংযুক্ত করে এক সূক্ষ্ম ও ব্যাপক দার্শনিক রূপদান করেন। এ ছাড়াও এই সময়কালে বহু সাধক-সাহিত্যিক গায়ক (কালীকেন্দ্রিক) শাক্তসাধনাকে চরমোৎকর্ষতার স্তরে উত্তরিত করেন। শ্যামাসংগীত গেয়ে বাঙালির মনজয় ও জনপ্রিয় হয়েছিলেন দুই ভাই শ্রীপান্নালাল ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য আর দুর্গাকেন্দ্রিক শাক্তধারাতে সাম্প্রতিক কালের শ্রেষ্ঠ সাধকেরা হলেন শ্রীশ্রীসত্যদেব, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ ও মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, এঁরা ‘চণ্ডী’ গ্রন্থের নবরূপকার।’– (মাতৃকাশক্তি, পৃষ্ঠা-২৩৯)

 

                বাংলা অঞ্চলে মাতৃপূজার যে ইতিহাস তাতে দেখা যায় যে, দুর্গাপূজা কালীপূজা অপেক্ষা প্রাচীনতর কালে এদেশে প্রবর্তিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পূজাকে অবলম্বন করে ধর্মোৎসবের ব্যাপকতায় দুর্গাপূজা এখনও বাঙালি হিন্দুর সর্বপ্রধান পূজা। দুর্গাপূজা সাংবৎসরিক উৎসব-বিশেষ মাত্র। সাংবৎসরিক পূজা ছাড়া দুর্গার কোনও নিত্যপূজার প্রচলন তেমন কোন অঞ্চলে দেখা যায় না। রোগে, শোকে, দৈব-দুর্বিপাকে সংকল্পপূর্বক চণ্ডীপাঠ বা দুর্গানাম জপের ব্যবস্থা শান্তি-স্বস্ত্যয়নের অঙ্গরূপে দেখা যায়। কিন্তু এসব ছাড়া সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গার তেমন কোনও প্রাধান্য দেখা যায় না। শারদীয়া দুর্গাপূজার পর থেকে শুরু করে বসন্তকাল পর্যন্ত দেবীকে নানারূপে পূজা করা হয়ে থাকে। লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, অন্নপূর্ণাপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, সরস্বতীপূজা– সর্বশেষ বসন্তকালে দেবীর বাসন্তী মূর্তির পূজা– এর মধ্যে এক কালীপূজা ছাড়া আর সবই সাংবৎসরিক পূজা। শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রাধান্য লাভ করলেন সাধারণভাবে কালী– বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দশমহাবিদ্যার অন্য কোনও রূপ।

 এখানে প্রশ্ন আসে, বাংলা অঞ্চলে শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গাকে পেছনে ফেলে এই যে কালী-দেবীরই প্রাধান্য দেখা যায়, তার কারণ কী? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পণ্ডিতদের অভিমত হলো,– শারদীয়া দুর্গাপূজায় পূজা অপেক্ষা উৎসব-আনন্দের দিকটাকেই বড় করে দেখা হয়। এই উৎসব-আনন্দের রূপটা যে ভক্তিহীন জাঁকজমক-প্রধান বিংশ শতাব্দীতেই প্রধান হয়ে উঠেছে তা নয়, শারদীয়া পূজার প্রথমাবধিই এ জিনিসটি আমরা লক্ষ্য করি। দুর্গাপূজাকে আমরা শস্য-সম্পদ্-শক্তি-রূপিণী মায়ের আগমনী-উৎসব বলেই জানি। শ্রদ্ধেয় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় মনে করেন, শারদীয়া পূজার মূলে সবটাই উৎসব,– শরৎকালীন নববর্ষের উৎসব। শরৎ ঋতু প্রবেশ জনিত উৎসব– শরদোৎসব। অতএব, শারদীয়া দুর্গাপূজা যে শুধু দুর্গাপূজা নয়– মূলেও যে এর একটি উৎসব-প্রকৃতি ছিল এবং পরবর্তীকালেও যে নানা উৎসব এর সাথে নানাভাবে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। দুর্গাপূজায় এই উৎসব প্রাধান্যের জন্যেই মনে হয় সাধনার ক্ষেত্রে দুর্গা প্রাধান্য লাভ করেননি, করলেন কালী এবং দশমহাবিদ্যার অন্যান্য দেবীরা।

 

শুধু এটুকুই নয়, বাংলা শক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে কালী-প্রাধান্যের ভিতরে আরও অনেক তথ্য নিহিত আছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। অতএব, শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্তের ভাষ্যে–

বিভিন্ন পুরাণ এবং উপপুরাণের মধ্যে কালীর কথা যেভাবে পাওয়া যায় তাহাতে মনে হয়, প্রথমতঃ এই উপপুরাণকারগণ নানাভাবে দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন কালী এবং পার্বতী-দেবী (তাঁহার উমা, দুর্গা, গৌরী, চণ্ডী সর্বরূপে) অভিন্না এবং এই করিয়া কালী-দেবীকে প্রথমে মহাদেবীরূপে স্বীকৃতা এবং প্রতিষ্ঠিতা করিয়া লইতে হইয়াছে। ইহার পরে দ্বিতীয় রকমের চেষ্টা দেখিতে পাই, কালীই যে মূল দেবী এবং পার্বতী দেবী তাঁহার উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী প্রভৃতি সর্বরূপেই এই সর্বমূলা কালী-দেবী হইতেই প্রসৃতা, সেই মূলা দেবীরই রূপভেদ মাত্র। এইভাবেই কালিকা বা কালী-দেবীকে প্রধানা করিয়া উমা, গৌরী, দুর্গা, চণ্ডী রূপধারিণী দেবীকে মূল হইতে প্রসৃতা দেবী করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইয়াছে।’– (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৮০-৮১)

 কালীবিবর্তনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ চর্চা। সুকুমার সেন থেকে উদ্ধৃত করছি

 চর্চিকা (চর্চা) মূর্তি ক্ষুধিত হিংস্র ডাকিনীর। নামটির ধাতুগত অর্থ হল ‘ভয়দেখানে, ক্ষতিকর’’। ত্রয়োদশ শতাব্দীর থেকে চর্চিকার পরিবর্তে চামুণ্ডা নামটি বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে। কালরাত্রি (বা কালী) ভৈরবের সঙ্গিনী…” (সুকুমার প্রবন্ধ সংকলন ৪র্থ, ৩৫৮)

 বিদ্যাকরের একটি শ্লোকে চর্চা হলেন শিবের পরিবারের অন্তর্গত, যদিও এখানে চর্চা আর চণ্ডী পৃথক। এই শ্লোকে কল্পনা করা হয়েছে যে শিব নিজের অসীম কৌশলে সদ্যনৃমুণ্ডমালা চর্চার গ্রাস থেকে রক্ষা করেন, চণ্ডীর সিংহ থেকে নিজের বৃষটিকে রক্ষা করেন, পুত্রের ময়ূরের থেকে নিজের সাপগুলোকে রক্ষা করেন।

 সযুক্তিকর্ণামৃতের এই শ্লোক চর্চাকে নিয়ে, নীলাঙ্গ রচিত। এই শ্লোকে চর্চাই শিবগৃহিণী। বলা হয়েছে, গৃহিণী চর্চা সর্বদাই খাই খাই করেন, পুত্রটিরও ছয়টি মুখ, লম্বোদর নিজেও বিরাট উদরের অধিকারী। কিন্তু এই সংসারের সম্বল একটি মাত্র ষাঁড়, এই দুর্ভাবনায় ভৃঙ্গীর পাঁজর শুকিয়ে এলো (সুকুমার ৩য় ৩৫৯-৬০)।

 

আদিযুগের চর্চা/চর্চিকা উপাসনা পালযুগ থেকে সেনযুগে অব্যবহিতভাবে চললেও এরপর মধ্যযুগে আর পাই না। তুর্কি আক্রমণ এর একটা কারণ হতে পারে।

 সদুক্তিকর্ণামৃতে একটি কালীস্তব পাই, ভাসোক রচিত, সেখানে কালীকে চণ্ডী, ভৈরবী ও কালরাত্রি বলা হয়েছে (শশিভূষণ ৬৪)।

 আরেকটি অনামা কালীস্তব আছে সদুক্তিকর্ণামৃতে, সেখানে কালীর মাথায় ময়ূরপুচ্ছচূড়ায় খণ্ড ইন্দু লেগে আছে (আমার মতে কালী ও কৃষ্ণের যৌথরূপের প্রথম অভিব্যক্তি হিসেবে এটাকে চিহ্নিত করা যায়), কর্ণযুগলে চন্দ্র সূর্য দুই কুণ্ডল। গলায় তারার হার। কুচযুগলে তারকাচক্র। তড়িৎ তাঁর কাঞ্চী। সন্ধ্যা তাঁর ছিন্ন মলিন বসন (শশিভূষণ ৭২)।

 উমাপতিধরের একটি শ্লোকের কালীকল্পনা এরকম “সদ্য নিহত দেব ও অসুরের আর্দ্র মুণ্ডের রক্তকমল–মালাধারী, ঘন রুধিরকণায় সিক্ত চর্মাম্বর পরিহিত, ত্রিভূবনের জীব জীবন-রস যথেচ্ছ গ্রাস কাজে যাঁর মুখ হাঁ করা, কালরাত্রির কুচকুম্ভ আলিঙ্গনকারী সে ভৈরবের আনন্দ জয়ী হোক।

 এ শ্লোকে সুকুমার সেন বৌদ্ধতান্ত্রিক যুগনদ্ধ কল্পনা খুঁজে পেয়েছেন। রক্তচর্চিকা যে বৌদ্ধতন্ত্রে পূজিতা, এবং অপরদিকে কালরাত্রি–ভৈরব সাধনা যে বৌদ্ধ অদ্বয়বজ্র রচিত বজ্রবারাহী-সাধনে রয়েছে সেটা সুকুমার উল্লেখ করেছেন (৪র্থ ৩৫৯-৬০)।

 কিন্তু মাতৃকার আরেকটি রূপ আছে, যেখানে তিনি সর্বকারণকারণম্‌ (দেবীভাগবত)। অনেকটা বেদের পুরুষসূক্তের মত সেখানে তিনিই অনাদি ও অদ্বয়। বেদের নাসদীয় সূক্তের মত দেবী ভাগবত বর্ণনা করছে যখন সৃষ্টির আদিতে বেদ ছিল না, বিষ্ণু বা বাসব ছিলেন না, জল, বায়ু, অম্বর ছিল না, মন ছিল না, বুদ্ধি ছিল না, শুধু দেবী ছিলেন। এই রূপটি বাঙালির প্রকৃতির রূপ। তিনি উৎস, তিনি সমাপ্তি, তিনি ছাড়া আর কিছু নেই।

 ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত মাতৃপূজার মধ্যে প্রধান যে কয়েকটি ধারা রয়েছে আমরা দেখলাম, এই প্রধান ধারাগুলির সাথে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে স্থানীয় মাতৃদেবীরা মিলেমিশে মূল ধারাকেই সুবিচিত্র এবং পরিপুষ্ট করে তুলেছে। তাই ‘দেবী-ভাগবতে’ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলা হয়েছে–

 

কলা যা যাঃ সমুদ্ভূতাঃ পূজিতাস্তাশ্চ ভারতে।

পূজিতা গ্রামদেব্যশ্চ গ্রামে চ নগরে মুনে।।


অর্থাৎ– ভারতবর্ষের যত নগরে এবং গ্রামে যত দেবী রয়েছেন তাঁরাও বিধিপূর্বক মহাদেবীরূপেই পূজিতা হয়ে থাকেন– কারণ, মূলে তাঁরা আদ্যাদেবী থেকে কিছু পৃথক নন, তাঁরাও সবাই একই মহাদেবীর বিশেষ বিশেষ কলামাত্র।

 পালযুগ, সেনযুগের পরে মধ্যযুগের অন্ধকার ক্ষণে, মধ্যযুগের বধ্যভূমিতে কালীর পুনরায় উত্থান ঘটেছিল। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে কালী ছাড়াও অন্যান্য মহাবিদ্যার উপাসনার কথা বলা আছেঃ তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, বগলা, ছিন্নমস্তা। কৃষ্ণানন্দ চৈতন্যের সমসাময়িক নন, কিছুটা পরে (শশিভূষণ ৭৫)। এরপর ষোড়শ শতকে মধ্যভাগে ব্রহ্মানন্দের শাক্ততরঙ্গিণী এবং তারারহস্য অপর দুটি মহাগ্রন্থ। ব্রহ্মানন্দের শিষ্য পূর্ণানন্দ লেখেন শ্যামারহস্য। ষোড়শ শতকেই পূর্ববঙ্গে ত্রিপুরা অঞ্চলে সর্বানন্দ ঠাকুর শবসাধনা করে দশমহাবিদ্যার দর্শন লাভ করেন বলে কিংবদন্তী আছে। এছাড়া গৌড়ীয় শঙ্কর নামে একজন ১৬৩০ সালে লেখেন তারারহস্যবৃত্তিকা।

 কাশ্মীরে দশম শতকে অভিনবগুপ্তের তন্ত্রালোক গ্রন্থে তেরো রকমের কালীরূপের উল্লেখঃ সৃষ্টিকালী, সংহারকালী, স্থিতিকালী, রক্তকালী, সুকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, ভদ্রকালী,পরমারককালী,মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোরচণ্ডকালী।


উনিশ শতকের কলকাতায় মুদ্রিত কালীচিত্র


 বাংলায় রঘুনাথের (রঘুনাথ ভট্টাচার্য, এঁর উপাধি ছিল তর্কবাগীশ) তন্ত্রসার ও আগমতত্ত্ববিলাস এই রূপগুলোর উল্লেখ করছেঃ দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, গুহ্যকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, সিদ্ধকালী, হংসকালী, কামকলাকালী (নরেন্দ্রনাথ ১৩৬)।

 বারোভুঁইয়ার অন্যতম চাঁদ ও কেদার রায়ের গুরু ঢাকার গোঁসাই ভট্টাচার্য বীরাচারে কালী উপাসনা করে সিদ্ধ হয়েছিলেন বলে প্রসিদ্ধ। যশোরের প্রতাপাদিত্যও শক্তির উপাসনা করতেন, যশোরেশ্বরী কালীর স্থাপনা করেন তিনি। এই যশোরেশ্বরী কালীকে কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত এক ভীষণদর্শনা প্রাচীন চামুণ্ডা মূর্তি বলে মনে হয়, সতীশ চন্দ্র মিত্রের বর্ণনা পড়লে (৬০৫)।

 পশ্চিমবঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের যুগে কালী উপাসনার প্রাবল্য বিশেষ করে ছড়িয়ে পড়ে।

 এই সময়েই কাশীনাথ লেখেন কালীসপর্যাবিধি, – শশিভূষণ এভাবে নামটি দিচ্ছেন এবং রচনাকাল দিচ্ছেন ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দ; নরেন্দ্রনাথ নামটি দিচ্ছেন শ্যামাসপর্যাবিধি এবং গ্রন্থরচনার সময় দিচ্ছেন ১৬৬৯ শকাব্দ অর্থাৎ ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৬) – দীপাবলি উৎসবের দিন কালীপুজো প্রচলনের বিধি এই গ্রন্থে সর্বপ্রথম পাওয়া যায়, যদিও রটন্তী চতুর্দশীর রাত্রিতে, মাঘের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে কালীপুজোর বিধান পাওয়া যায় স্মৃতিসমুচ্চয় গ্রন্থে (শশিভূষণ ৭৫)।

 এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের উদ্যোগে কালীপুজো প্রচলনের উল্লেখ শশিভূষণ করেছেন। সিরাজপতনের পর দুর্গাপুজো শুরু করার কথা বলা হয় বটে। কিন্তু বোধহয় তারও আগে থেকে ক্রমশঃ বেগবান হচ্ছিল এই কালীপুজোর প্রাবল্য। কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে রাজ্যমধ্যে দশ সহস্র কালীমূর্তি স্থাপিত করে পুজো শুরু হয়েছিল (শশিভূষণ ৭৫)। কিন্তু আসল কাজটা সম্ভবত করেছিল রামপ্রসাদের ভক্তিগীতি। এ প্রসঙ্গে কমলাকান্তের নামও করতে হয়। এরপর দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের স্থাপনা করেন রাণী রাসমণি। তিনি ছিলেন কালীপদ-অভিলাষী, সেভাবেই নিজের সমস্ত সীলমোহরে তাঁর নাম লেখা থাকত।

 এই ইংরেজ আমলেই তারাপীঠে বামাখ্যাপার আবির্ভাব ঘটবে। তারার মূল বৌদ্ধকল্পনা একদমই পৃথক ছিল। বস্তুত তারা ও লোকনাথের অনেক পীঠস্থান ছিল পালযুগে। কিন্তু বর্তমানে তারার রূপকল্পনা কালীর সঙ্গে এক হয়ে আছে। দুজনেই লোলজিহ্বা। মধ্যযুগে বারংবার আগ্রাসনের ফলে তারাপীঠে তারাকল্পনার বিবর্তন ঘটেছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। প্রাচীন কালেও একই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সৌম্যমাতৃকা বহিরাগত আগ্রাসনের প্রত্যুত্তরে লোলজিহ্বা রক্ততৃষ্ণার্তা রূপ ধারণ করেন। কালী বাঙালিকে পালন করেন এবং বাঙালির শত্রুকে দমন করেন।

 রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা আন্দোলনেও মা কালীর বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। অন্যদিকে বঙ্কিমের আনন্দমঠ, “মা যা হইয়াছেন” এবং সেখান থেকে অগ্নিযুগের মা কালী এক বিস্ফোরণ। বিপ্লব নিজের সন্তানদেরই গ্রাস করে, এই মর্মে ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে। কালী নামক এই বিপ্লবের কালস্রোতে নিজেদের বিলীন করে বাঙালির অগ্নিযুগের নায়করা অমর হয়েছেন।

 বাঙালি আধুনিক যুগে যখন সারা ভারতে ও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, সর্বত্র সে একটি করে কালীবাড়ি স্থাপন করে। একটি ভূমিকে আমরা নিজস্ব করে নিই সেই ভূমিতে মা কালীর স্থাপনা করে।

 বাঙালির জাতি নির্মাণে, বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের কাল্পনিক সম্প্রদায় গঠনে (কাল্পনিক কারণ সবাই সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে না, তাও তারা একটি সম্প্রদায় কল্পনা করে নেয় কিছু শেয়ারড কালচারাল ন্যারেটিভ ও ফেইথ সিস্টেমের মাধ্যমে) বা ইউভাল হারারির বৃহৎ সম্প্রদায় গড়ে তোলার মধ্যে, মা কালী বাঙালির এই প্রকৃতিকেন্দ্রিক শেকড়ের গভীরতম অঞ্চলে প্রোথিত আছেন।

 বাঙালি জাতি মধ্যযুগে অনবরত আগ্রাসনে বিধ্বস্ত, সেজন্যও বাংলাজোড়া বধ্যভূমি শ্মশানভূমিতে মা কালীর উত্থান ঘটেছে। কবি রামলাল দাসদত্ত লিখেছিলেন মা কালীর উদ্দেশ্যে, শ্মশান ভালোবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি।

 এ পংক্তিতে আক্রান্ত বাঙালির আবাহনে মা কালীর উত্থানের স্বরলিপি লেখা আছে। মা কালী শুধু অব্যক্ত নন, তিনি অসীম। তিনি কবিতার মত। তিনি তাই অনেককে একসূত্রে বাঁধতে পারেন। পালযুগে চর্যা থেকে চর্চা মিশে মা কালীর রূপকল্পনা ঘটেছে, তিনিই চণ্ডালী, ডোম্বী, তিনিই শবরী, সহজসুন্দরী। তিনি রামপ্রসাদ ও তৎপরবর্তী ভক্তি আন্দোলনের সারাৎসার। মধ্যযুগে শ্যামরূপা ও আধুনিকযুগে কালীকৃষ্ণরূপে বৈষ্ণবেরও উপাস্য। তিনি যোগীর পরমতত্ত্ব। এবং কালী বাঙালি মাত্রেরই উপাস্য। তমাল দাশগুপ্তের কথায়,

মা কালী লাকানিয়ান দর্শনের রিয়েল, কান্ট যাকে বলেছেন অজ্ঞেয় বস্তুর নিজস্বতা (unknowable things in themselves), বার্ক যাকে সাব্লাইম বলেছেন, হেগেল যাকে বলেছেন গাইস্ট (Geist), আর ফ্রয়েড বলেন ইড বা আনকনশাস। এক কথায় মানবিক ভাষা, যুক্তি, দর্শনের সীমাবদ্ধতার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা রহস্যময় দিগন্ত। মার্ক্স একেই বলেছিলেন আত্মাহীন জগতের আত্মা, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, মানব অস্তিত্বের কেন্দ্রস্থলে থাকা বিরাট শূন্যতা-ক্ষতের মরমিয়া ওষুধ। মা কালী আমাদের আশ্রয়।

 তাঁকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, প্রকৃতি অব্যক্ত। কিন্তু বাঙালির পূর্বমানুষ বুদ্ধিমান ছিলেন বলে মা কালীর এই মূর্তি বানিয়েছেন। উৎসে ও সমাপ্তিতে থাকা নিত্য ও অব্যক্ত প্রকৃতির এই যোগ্য রূপকল্পনা।



কলমে  - ক ম লে ন্দু  সূ ত্র ধ র 


 

তথ্যসুত্রঃ- 

১। ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্যঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত

২। প্রবন্ধ সংকলন তৃতীয় খণ্ড, সুকুমার সেন

৩। প্রবন্ধ সংকলন চতুর্থ খণ্ড, সুকুমার সেন

৪। বাঙ্গালীর ইতিহাসঃ আদি পর্বঃ নীহার রঞ্জন রায়।

৫। বাঙ্গালার ইতিহাস প্রথম ভাগ- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

৬। শক্তি-সাধনা-১২ : শক্তিদেবী কালী ও তাঁর পূজার ইতিহাস 

৭। দেবী-কল্পনার বিবর্তন 

৮। বাঙালির তন্ত্রধর্মের বিবর্তনের একটি রূপরেখা

৯। কালী পূজার বিবর্তন- তুষারকুমার মুখোপাধ্যায়

১০।  প্রসঙ্গ মা কালী কথা

১১।  কৃষ্ণচন্দ্রের উৎসাহেই দীপাবলি উৎসব 

১২। উপাসনার প্রধান প্রতীক মা কালীর বিভিন্ন রূপ- তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta 

১৩। মা কালীর উৎসরণঃ কালীর মূর্তিরূপের উৎস ও বিবর্তন- ডঃ তমাল দাশগুপ্ত

১৪।  মা কালীর উত্থান- ডঃ তমাল দাশগুপ্ত

১৫।  কালী : একটি অনার্য অডিসি


চিত্র সৌজন্যঃ ইন্টারনেট 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন