প্রাচীন ভারতের বিদেহ (ভিন্নমতে মিথিলা) রাজ্য। সেই রাজ্যের রাজা জনক ছিলেন দর্শনের গুণগ্রাহী। রাজসূয় যজ্ঞের পরে তাঁর রাজসভায় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আমন্ত্রিত পণ্ডিত, বিদ্বান ও দার্শনিকদের বিশাল আসর বসে। সভার বিশেষ আকর্ষণ একহাজার গাভী যেগুলির প্রত্যেকটির শিং দু'খানি স্বর্ণাবৃত অর্থাৎ সোনা দিয়ে মোড়া। রাজা ঘোষণা করলেন, উপস্থিত ব্রাহ্মণগণের মধ্যে যিনি সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মজ্ঞানী তিনি এই গাভীগুলি স্বচ্ছন্দে নিয়ে যেতে পারেন।
ব্রাহ্মণগণ নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। নিজেকে ব্রহ্মিষ্ঠ বলে দাবী করা সাংঘাতিক ব্যাপার। এতখানি সাহস দেখাবে কে! এমনসময় উঠে দাঁড়ালেন ব্রহ্মতেজদীপ্ত ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। শান্ত অথচ আত্মবিশ্বাসের স্বরে তাঁর প্রিয় শিষ্যকে নির্দেশ দিলেন নিজের আশ্রমে গাভীগুলি নিয়ে যেতে।
সভায় উপস্থিত অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ যারপরনাই ক্ষুব্ধ। যাজ্ঞবল্ক্যর এতখানি স্পর্ধা তিনি কিনা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মজ্ঞানী বলে দাবী করেন! যাজ্ঞবল্ক্যর সরস জবাব, "নমঃ বয়ং ব্রহ্মিষ্ঠায় কুর্মো, গোকামা এব বয়ং স্মঃ ইতি", অর্থাৎ, "বাপুরা, ব্রহ্মিষ্ঠকে নমস্কার করি, কিন্তু এই গাভীগুলি আমার বিশেষ প্রয়োজন।"
কিন্তু পণ্ডিতরা এতে সন্তুষ্ট হলেন না। সভায় এই নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করা হচ্ছে, এদিকে কেউ তাঁকে চ্যালেঞ্জ করছেন না, এমনটা হওয়া তো নিয়মবিরুদ্ধ। অবশেষে রাজা নিজেই আটজন পণ্ডিতকে নির্বাচন করলেন যাঁরা প্রশ্ন করবেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে এবং নির্ধারণ করবেন তিনিই শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত কিনা। শুরু হয়ে গেলো একের পর এক কঠিন প্রশ্ন।
প্রথমে ঋষি অশ্বল প্রশ্ন করলেন, "হে যাজ্ঞবল্ক্য, সমস্ত কিছুই যখন মৃত্যুর অধীন তাহলে মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির উপায় কি?"
যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন, "হোতা নামক ঋত্বিক, অগ্নি ও বাক্য দ্বারা। কারণ বাক্যই যজ্ঞের হোতা, বাক্যই অগ্নি, বাক্যই মুক্তির উপায়।"
ঋষি অশ্বলের পর একে একে বড় বড় পণ্ডিতেরা যেমন অর্থভাগ ভূজ্য, উদ্দালকূ উষস্ত এর মতো দার্শনিককে পরাস্ত করলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। পালা এলো সপ্তম পণ্ডিতের প্রশ্নের। সপ্তম পণ্ডিত পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন শুরু করলেন।
সপ্তম পণ্ডিত : ঋষিবর, আমাকে বলুন, যদি সবকিছু জলে ওতপ্রোতভাবে অধিষ্ঠিত আছে, তাহলে এই জল কিসে অধিষ্ঠিত?
যাজ্ঞবল্ক্য : বায়ুতে।
সপ্তম পণ্ডিত : বায়ু কিসে ওতপ্রোত?
যাজ্ঞবল্ক্য : অন্তরীক্ষলোকে।
সপ্তম পণ্ডিত : অন্তরীক্ষলোক কিসে ওতপ্রোত?
যাজ্ঞবল্ক্য : গন্ধর্বলোকে।
সপ্তম পণ্ডিত : গন্ধর্বলোক কিসে ওতপ্রোত?
যাজ্ঞবল্ক্য : আদিত্যলোকে।
সপ্তম পণ্ডিত : আদিত্যলোক কিসে ওতপ্রোত?
যাজ্ঞবল্ক্য : চন্দ্রলোকে।
সপ্তম পণ্ডিত : চন্দ্রলোক কিসে ওতপ্রোত?
যাজ্ঞবল্ক্য : দেবলোকে।
সপ্তম পণ্ডিত : দেবলোক কিসে ওতপ্রোত?
যাজ্ঞবল্ক্য : ইন্দ্রলোকে।
সপ্তম পণ্ডিত : ইন্দ্রলোক কিসে ওতপ্রোত?
যাজ্ঞবল্ক্য : প্রজাপতিলোকে।
সপ্তম পণ্ডিত : প্রজাপতিলোক কিসে ওতপ্রোত?
যাজ্ঞবল্ক্য : ব্রহ্মলোকে।
সপ্তম পণ্ডিত : ব্রহ্মলোক কিসে ওতপ্রোত?
স্তব্ধ হয়ে গেলেন যাজ্ঞবল্ক্য। সপ্তম পণ্ডিতকে বললেন, "মা অতিপ্রাক্ষীঃ", অর্থাৎ, "অতিরিক্ত প্রশ্ন কোরো না।" সাবধানবাণী শোনালেন, "যে দেবতাদের বিষয়ে বেশী প্রশ্ন করা উচিত নয় তুমি সেই বিষয়ে অতিপ্রশ্ন করছ। আর প্রশ্ন করলে তোমার মাথা খসে পড়বে।"
সপ্তম পণ্ডিত স্বস্থানে ফিরে এলেন। এবার প্রশ্ন করার পালা অষ্টম তথা সর্বশেষ পণ্ডিত উদ্দালকের। তাঁর প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলে পুনরায় উঠে দাঁড়ালেন সপ্তম পণ্ডিত। সভায় উপস্থিত সকলের সামনে ঘোষণা করে দিলেন, "ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে আমি আরো দু’টি প্রশ্ন করবো। তার উত্তর দিতে পারলে বোঝা যাবে যাজ্ঞবল্ক্যই আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।"
সব পণ্ডিতেরা অনুমতি দিলে প্রশ্ন করলেন সপ্তম পণ্ডিত, "ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য, যা এই দ্যুলোক ও ভূলোকের মধ্যে, যা অতীত, যা বর্তমান, যা ভবিষ্যৎ রূপে বিদ্যমান, তা কিসে ওতপ্রোত আছে?"
যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন, "অনন্তলোকে।"
"অনন্তলোক কিসে ওতপ্রোত?"
তার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য শোনালেন, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড যাতে অধিষ্ঠিত, সেই অবাঙ্মানসগোচর অক্ষর ব্রহ্মের কথা। যার প্রশাসনে প্রতি নিমেষ, সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলমান। এঁকে দেখা, শোনা বা জানা না গেলেও ইনি সমস্ত দেখতে পান, শুনতে পান ও জানতে পারেন। নান্যদতোহস্তি দ্রষ্টূ, নান্যদতোহস্তি বিজ্ঞাত্রেতাস্মিন্ – ইনি ভিন্ন কেউ দ্রষ্টা নেই, শ্রোতা নেই, বিজ্ঞাতা নেই।
এখানে যাজ্ঞবল্ক্যর উত্তর সমস্ত জ্ঞানের সীমানা অতিক্রম করে গেল। এই জ্ঞানই প্রকৃত অনন্ত বা ভূমা, যা ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ে উল্লেখিত। যাজ্ঞবল্ক্য যে প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী, এক প্রকৃষ্ট জ্ঞানযোগী, এই প্রশ্নের উত্তরে তা স্পষ্ট বোঝা গেল। এই উত্তর শোনার পর সপ্তম পণ্ডিত সমবেত বিদ্বজনের উদ্দেশ্যে বললেন, "হে ব্রাহ্মণগণ, আপনারা যদি এঁকে শুধুমাত্র নমস্কার করেই পার পেয়ে যান তাহলেই যথেষ্ট মনে করবেন। ব্রহ্মবিদ্যায় এঁর সমকক্ষ কেউ নেই।"
সেদিনের সভায় যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা দূরে থাক, তাঁর সাবধানবাণী শোনার পরেও দ্বিতীয়বার তাঁর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পুনরায় তাঁকে প্রশ্ন করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন একমাত্র সপ্তম পণ্ডিত। এই সপ্তম পণ্ডিতই ছিলেন গার্গী। ব্রহ্মজ্ঞানী যাজ্ঞবল্ক্যকে যথোপযুক্ত প্রশ্নের মাধ্যম তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে সভাস্থলে প্রকৃত সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন একমাত্র এই ব্রহ্মবাদিনী। সেদিন রাজ্যসভায় যাজ্ঞবল্ক্য জয়লাভ করলেও বিদূষী গার্গীর জ্ঞান ও বিদ্যা সকলের নিকট ভূয়সী প্রশংসা ও সম্মান লাভ করেছিল।
মহাঋষি গর্গের বংশে জন্ম হয়েছিল বলে এই বিদূষীর নাম রাখা হয়েছিল গার্গী। সম্পূর্ণ নাম গার্গী বাচাক্নাবী। ঋষি বাচাক্নুর কন্যা তিনি। তাঁর জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে। পিতার কাছেই শুরু হয়েছিল গার্গীর দর্শনশিক্ষা। দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করানো হয় বিজ্ঞানসাধনার সারিতে। গার্গীর মতো অসাধারণ বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানের অধিকারী নারীর পদচারণে মুখর ছিল শাস্ত্রচর্চা স্থল ও বিভিন্ন তর্কসভা।
শুধুমাত্র গার্গীই নন, পুরাতন যুগে মহিলা বেদজ্ঞর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। শাস্ত্রচর্চা ছাড়াও তাঁরা যজ্ঞে অংশ নিতেন, অন্যান্য পণ্ডিতদের সাথে শাস্ত্র নিয়ে সমানতালে তর্ক-বিতর্ক করতেন। এঁদের বলা হত ব্রহ্মবাদিনী। গার্গী ছিলেন এইরকম একজন। তাঁর চরিত্রের যে বিশেষত্বগুলি বৃহদারণ্যক উপনিষদে ফুটে উঠেছে তা হলো, তিনি ছিলেন অসামান্য মেধাবী, আত্মবিশ্বাসী, নির্ভীক ও পূজ্যপাদে সম্মান জানাতে সদাপ্রস্তুত।
বর্তমানে আমাদের দেশে দিকে দিকে নারীশিক্ষার প্রচার করে জনসাধারণকে সচেতন করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করার অভিপ্রায়ে রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার নানারকম প্রকল্প শুরু করেছেন। প্রাচীনকালে এই ছবিটা ছিল অন্যরকম। সেইসময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা স্বাধীনচেতা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও শিক্ষিতা ছিলেন। শাস্ত্র অধ্যয়নে নারী পুরুষ নির্বিশেষে অংশ নিতে পারতেন। এই ব্যাপারে নারীদের অথবা তাদের পরিবারের কোনরকম আপত্তি বা অনীহা ছিল না। বেদপাঠ হোক অথবা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, সর্বক্ষেত্রে গ্রাহ্য ছিল নারীর অংশগ্রহণ। সেইসময় নারী ঋষিরা পুরুষ ঋষিদের মতোই জ্ঞানের শিখরে আরোহণ করে শ্লোক নির্মাণ করতে পারতেন।
তবে এই আশা আমরা সকলেই রাখি, বৈদিক যুগের নারীদের মতোই জ্ঞানচর্চা অক্ষুণ্ন রেখে নিজগুণে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সকল মেয়েরা।
___________________
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
তথ্য ও চিত্র সৌজন্য ঃ অন্তরজাল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন