“হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে”
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কালপ্রবাহের না আছে কোনো শুরু, না আছে কোনো সমাপ্তি। তা সত্ত্বেও কালপ্রবাহকেই ভাগ করে
নেওয়া হয় বর্ষ-মাস-দিন-ক্ষণে। এই ভাগের বিভিন্ন রীতি রয়েছে যেগুলির কোনোটির
সম্পর্ক জ্যোতিষ গণনার সাথে, কোনোটির সম্পর্ক ইতিহাসের সাথে আবার কোনোটির সম্পর্ক বৈষয়িক
চাহিদার সাথে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস গড়িয়ে আসে পহেলা বৈশাখ। চৈত্র অবসানে বর্ষ
হয় শেষ। আসে নতুন বছর নববর্ষ। পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ‘ট্রাডিশন বা প্রচলিত
সংস্কৃতিধারা’। আদিকাল থেকেই যে কোনো বছরের প্রথম দিনটি ‘নববর্ষ’ নামে
পরিচিত হয়ে আসছে। পুরাতন বছরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি’-র অন্তিম প্রহর সমাপ্ত হয়।
তিমির রাত্রি ভেদ করে পূর্বদিগন্তে উদিত হয় নতুন দিনের জ্যোতির্ময় সূর্য।
প্রকৃতির নিসর্গ মঞ্চে ধ্বনিত হয় নব-জীবনের সঙ্গীত। আকাশ সজ্জিত হয় অপরূপ সাজে।
পত্রে পত্রে তার পুলক-শিহরন। গাছে গাছে তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস। পাখির কণ্ঠে কণ্ঠে নব
প্রভাতের বন্দনা-গীতি। দিকে দিকে মানুষের বর্ষবরণের উৎসব-আয়োজন।
অভিনন্দন-শঙ্খধ্বনিতে হয় নতুনের অভিষেক। রাত্রির তপস্যা শেষে এই শুভদিনের উদার
অভ্যুদয়ে মানুষের হৃদয়-উৎসারিত কলোচ্ছাসে ভরে যায় পৃথিবী। নতুন দিনের কাছে
আমাদের অনেক প্রত্যাশা, প্রার্থনা দুঃখ জয়ের।
জীবনের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণের সাথে নববর্ষের উৎসব জড়িত। বহু
আগে থেকেই নানা জাতিগোষ্ঠী নববর্ষ পালন করছে। প্রথম নববর্ষ উদযাপনের খবর পাওয়া যায়
মেসোপোটেমিয়ায়। খ্রীস্টপূর্ব ২০০০ সালে। তখন কখনো মার্চ,
কখনো সেপ্টেম্বর, কখনো ডিসেম্বর থেকে নববর্ষ গণনা করা হতো। খ্রীস্টপূর্ব ৪৬
সালে জুলিয়াস সিজার কর্তৃক ক্যালেন্ডার সংস্কার করে (জুলিয়ান ক্যালেন্ডার)
জানুয়ারি মাসে বছর গণনা শুরু করার পর থেকেই পহেলা জানুয়ারিতে জাঁকজমক আর আনন্দ
উল্লাসের সাথে নববর্ষ পালন আরম্ভ হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ
পালন করতেন। এখনো এই ভিন্নতা বিদ্যমান। প্রাচীন মিশরীয়,
ফিনিশীয় আর ইরানীগণ নববর্ষ উদযাপন করতেন শারদীয় বিষুব-দিনে
(Autumnal Equinox) ২১শে সেপ্টেম্বর; প্রাচীন গ্রীক ও রোমকগণ খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত
এ উৎসব পালন করতেন সূর্যের দক্ষিণ অয়নান্ত দিনে (Winter
Solstice) ২১শে ডিসেম্বর; প্রাচীন ইহুদীগণ নববর্ষ পালন করতেন বাসন্ত বিষুব-দিনে (Vernal
Equinox) ২১শে মার্চে;
ইংল্যান্ডের অ্যাংলো-স্যাক্সনগণ সূর্যের দক্ষিণ অয়নান্ত
দিনে (Winter Solstice) ২৫শে ডিসেম্বর নববর্ষ পালন করতেন। তিব্বত,
থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে চান্দ্র মাসের সাথে মিলিয়ে
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে, মাঝে বা শেষে নববর্ষ পালন করতেন। প্রাচীন আরবগণ চান্দ্র
বছরের প্রথম মাস মহরমে উকাজের মেলায় যোগ দিয়ে খেলাধুলা পানাহারে মেতে নববর্ষের
উৎসব পালন করতেন। প্রাচীন ইরান আর ভারতের আর্যরা সৌরমাস সমন্বিত চান্দ্র মাসের
হিসাবে নববর্ষ উৎসব পালন করতেন। ইরানে ছয়দিন ব্যাপী ‘নওরোজ’ আর ভারতে তিনদিন ধরে ‘দোল’
উৎসবের মাধ্যমে নববর্ষ পালন করা হতো।
বাংলা নববর্ষ কবে থেকে পালন শুরু হয়েছে তার কোন হদিশ নেই। কারণ বাংলা সন কবে
থেকে চালু হয়েছে সেটারই প্রকৃত খবর কেউ জানেন না। মূলত বঙ্গাব্দ হলো বঙ্গদেশের
বর্ষগণনার একটি ধারাবাহিকতার একটি ফসল। কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের
দ্বারা বঙ্গাব্দ নামের অব্দ শুরু হয়েছিল, তা বলা যায় না। তবে,
বঙ্গাব্দ-সহ ভারতীয় সকল অব্দের ধারণার সুত্রপাত হয়েছিল মূলত
বৈদিক ঋষিদের দ্বারাই। আর্যরা যখন বঙ্গদেশে প্রবেশ করেছিল,
তখন এই অঞ্চলের আদিবাসীরা বর্ষগণনা করতেন কি না তা জানা যায়
না। সেকালের বৈদিক ঋষিরা ছিলেন সর্বভারতীয়। তাই সেকালের অর্জিত সকল জ্ঞানই ছিল,
সকল ভারতবাসীর।
আর্য ঋষিরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা করতেন জানার আগ্রহে। সেই জ্ঞান আবার একই সাথে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড প্রতিপালনের জন্য ব্যবহার করতেন। এই সূত্রে আর্য ঋষিরা, খালি চোখে দেখা যায় এমন নক্ষত্র, সূর্য, গ্রহাদি, চন্দ্র ইত্যাদির গতিপথ এবং পৃথিবীর ঋতুচক্র ইত্যাদি মিলিয়ে পঞ্জিকার পত্তন ঘটিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত বলা দরকার, উপমহাদেশে পঞ্জিকা বা বর্ষপঞ্জীর প্রচলন বহু প্রাচীন, সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে বর্ষপঞ্জীর প্রচলন। বৈদিক আর্যরাও হিসেব রাখতেন, যদিও ছয় ঋতু ও বারো বাসের হিসেব ছিল না তাঁদের কাছে। ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলে মাত্র তিনটি ঋতুর উল্লেখঃ শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা।। তৈত্তিরীয় সংহিতা দশমাসের বছর ধরেছে, নাম এরকমঃ শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ঈষ, উর্জ, সহস্, সহস্য, মধু ও মাধব। যে কোনও উন্নত সভ্যতা বিশেষ করে যেখানে কৃষিকার্যের প্রাবল্য, যেমন বাঙালির সভ্যতা, সেখানে বর্ষপঞ্জি বা অব্দ ছাড়া কাজ চলবে না।
ভারতের একটি অন্যতম অব্দ ‘বিক্রমাব্দ’ শুরু হয়েছিল ৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এই অব্দের মাসগুলো বাংলা মাসের নামের মতোই। এরপরে আমরা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো অব্দ পাই ‘শকাব্দ’। এক সময় বঙ্গদেশে এই অব্দ অনুসরণ করা হতো। ১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিক্রমাব্দ এবং শকাব্দ বিশেষ স্থান দখল করে ছিল। বাংলার স্বাধীন শাসক হিসাবে সেন বংশীয় লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে একটি নতুন অব্দের প্রচলন শুরু হয়। এই অব্দটি “লক্ষ্মণাব্দ” নামেই পরিচিত। এক সময় এই অব্দটি বাংলা, বিহার ও মিথিলাতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। আবুল ফজল তাঁর আকবরনামা গ্রন্থে লিখেছেন ‘বঙ্গে লক্ষ্মন সেনের রাজ্য-প্রাপ্তির প্রারম্ভ থেকে সংবৎ গণনা করা হচ্ছে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত ৪৬৫ বৎসর হয়েছে।’ এ থেকে বোঝা যায়, বঙ্গদেশে লক্ষ্মণাব্দ-এর একটি বিশেষ স্বীকৃতি ছিল।
নববর্ষ তথা বঙ্গাব্দের ইতিহাস আলোচনাতে বাংলা মাসগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে কিছু না বললেই নয়। বাংলা মাসের নামগুলো গৃহীত হয়েছে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্রমধারার সূত্রে। আদিগ্রন্থ বেদের আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে ছয় প্রকার শাখা তৈরি হয়েছিল। এই শাখাগুলি বেদাঙ্গ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। শাখাগুলি হল যথাক্রমে- শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, কল্প ও জ্যোতিষ। এগুলির মধ্যে জ্যোতিষ প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত। এই ভাগগুলো হলো– গণিত, হোরা এবং সংহিতা। জ্যোতিষশাস্ত্রের গণিত দুই ভাগে বিভক্ত। এই ভাগ দুটি হলো– সিদ্ধান্ত ও করণ।
৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বরাহমিহির পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হয়। পঞ্চসিদ্ধান্তিকার মতে পাঁচটি সিদ্ধান্ত হলো– সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশসিদ্ধান্ত, রোমকসিদ্ধান্ত ও ব্রহ্মসিদ্ধান্ত। এর ভিতরে প্রাচীন ভারতের দিন, মাস, বৎসর গণনার ক্ষেত্রে ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল।
এই সূর্যসিদ্ধান্ত মতে, সৌর-মাস নির্ধারিত হয়, সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। সূর্যের ভিন্ন অবস্থান নির্ণয় করা হয় আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের বিচারে। প্রাচীন কালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এর একটি ভাগকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছিল রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হলো– মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন।
আবার অন্যদিক থেকে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সমগ্র আকাশকে একটি বৃত্তাকার চক্র হিসাবে কল্পনা করে ২৭টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগগুলোকে নক্ষত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এই নক্ষত্রগুলো হলো– অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্বভাদ্রপদা, উত্তরভাদ্রপদা এবং রেবতী।
সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য কোনো না কোন রাশির ভিতরে অবস্থান করে। আর সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে সংক্রান্তি বলা হয়। এই বিচারে এক বৎসরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়। লক্ষ্য করা যায়, সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের রাশি অতিক্রমের সময় হতে পারে– ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন। সেই কারণে একটি বৎসরের ১২ মাসের দিন সংখ্যা সমান হয় না।
মাসের নামকরণের ক্ষেত্রে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মূল তিনটি সূত্রকে অনুসরণ
করেছিলেন। সূত্র তিনটি হলো–
১. প্রথম বিবেচনা করা হয়, সূর্য কোন রাশিতে অবস্থান করেছে।
২. ওই রাশিতে সূর্য কখন প্রবেশ করেছিল এবং কবে /
৩. ওই রাশিতে অবস্থানকালে পূর্ণিমার সময় সূর্য কোন নক্ষত্র বরাবর ছিল।
এই তিনটি সূত্রের উপর ভিত্তি করে মাসের দিন সংখ্যা এবং নাম বিবেচনা করা হয়েছে। ধরা যাক বৎসরের কোনো এক সময় সূর্য মেষ রাশিতে আছে। যে মুহূর্তে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করবে, সেই মুহূর্ত থেকে মেষরাশির মাস শুরু হবে। যে মুহূর্তে সূর্য মেষ রাশি অতিক্রম করে, পরবর্তী বৃষ রাশিতে প্রবেশ করবে, সেই মুহূর্তে মেষ রাশির মাস শেষ হবে যাবে।
তৃতীয় সূত্রানুসারে, মেষরাশির পূর্ণিমার সময় সূর্য বিশাখা নক্ষত্রের উপর অবস্থান করেছিল, এই কারণে বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে মেষ রাশির মাসটির নামকরণ করা হয়েছিল– বৈশাখ। এই সূত্রে ১২টি মাসের নামকরণ করা হয়েছিল যে সকল নামে, তা হলো-
এবার মূল বৃত্তান্তে আসা যাক। বঙ্গদেশে কবে থেকে বঙ্গাব্দ গনণা শুরু হয়েছিল, তার যথাযথ ইতিহাস জানা যায় না। অন্যান্য সনগুলোর উৎস যতটা হুটহাট বলে দেওয়া যায়, বঙ্গাব্দের ক্ষেত্রে বিষয়টা অতো সহজ না। বঙ্গ তো আর কোনো শাসকের নাম না, যে শিলালিপি দেখে শাসনকাল খুঁজে একটা কিছু বলে দিলেই কেল্লাফতে। বঙ্গ একটা আঞ্চলিক পরিচয়। হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা এক জনপদের নাম। বিক্রামাব্দ, লক্ষ্মণাব্দ ইত্যাদির মতো অত সহজে বলা যায় না অমুকে অমুক সময় বঙ্গাব্দ নামে একটি অব্দ চালু করেছিলেন। প্রাচীনকাল থেকেই স্থানীয় মানুষেরা জীবনযাপনের তাগিদে ঋতুর হিসেব রাখতো, তেমন ভাবনা স্বাভাবিক। তারপরেও বঙ্গাব্দের জন্মকথায় চারজন শাসকের দাবি নিয়ে পণ্ডিতেরা বিভাজিত। তিব্বতিয় রাজা স্রং সন, গৌড়রাজ শশাঙ্ক, সুলতান হোসেন শাহ এবং সম্রাট আকবর।
তিব্বতীয় রাজার দাবিটা আসে ফরাসি পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভির কাছ থেকে। ভদ্রলোক ‘লে নেপাল’ নামক পুস্তকে বলেছেন, রাজা স্রং সন ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্য ও পূর্ব-ভারত জয় করেন। সিলভ্যাঁ লেভিকে অনুসরণ করে একাধিক বাঙালি গবেষক, যেমনঃ- ব্রতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পঞ্চানন মণ্ডল প্রমুখ মনে করেছিলেন স্রং সন গাম্পোর জন্ম যে বছর হয়েছিল, সে বছর থেকেই তাঁর পিতা স্রং সন, যিনি সাময়িকভাবে পূর্ব ভারতের কিছু অংশ দখল করেছিলেন, তিনি পুত্র স্রং সন গাম্পোর জন্মকে স্মরণীয় করে রাখতে এই সন প্রচলন করেন। এ তত্ত্বটি চমকপ্রদ এবং সত্যি হলে বাংলা সনের এই “সন” শব্দটির আরবি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় আগমনের যে দাবি তোলা হয়, সেটি নস্যাৎ হয়ে যায়।
বৃহৎ বঙ্গের নানা অংশের সঙ্গে এই সময় তিব্বতের আদান প্রদান ঘটেছে বটে। গাম্পো নিজে এরপর লিচ্ছবিবংশীয় রাজকন্যা বিবাহ করবেন, ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব তিব্বতে যাবে। গাম্পো তিব্বতি লিপি এবং ধ্রুপদী তিব্বতি ভাষা এবং সেই সঙ্গে তিব্বতের সাম্রাজ্যনির্মাতা ছিলেন।
গাম্পোর জন্ম ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হয়ে থাকতে পারে, যদিও আরও কয়েকটি সালের উল্লেখও পাওয়া যায়। মাৎস্যন্যায় যুগে কামরূপ অঞ্চলে গাম্পোর নেতৃত্বে তিব্বতের সামরিক অভিযান ঘটেছিল বলে জানা যায়, ভাস্করবর্মার রাজবংশ এই তিব্বতসম্রাট স্রং সন গাম্পোর আক্রমণেই বিলুপ্ত হয়েছে বলে অনেক ইতিহাসবিদ অনুমান করে থাকেন। তিব্বতের আক্রমণ পালযুগে কয়েকবার বাংলার বুকে আছড়ে পড়েছে। একজন তিব্বত রাজ তো গঙ্গাসাগর অবধি বিজয়যাত্রা করেছেন বলে দাবি করা হয়েছে লাদাখের রাজবৃত্তে। এছাড়া অতীশ দীপঙ্করের আগে থেকেই বাংলার বৌদ্ধদের সঙ্গে তিব্বতের যোগাযোগ ছিল। অতএব একটি তিব্বতি অব্দ বাংলায় প্রচলিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পাল বংশের আমলের কোনও নথিতে এই বঙ্গাব্দের উল্লেখ নেই, তাঁরা প্রত্যেক রাজার রাজত্বকালের হিসেবে বছর গণনা করতেন। সেনযুগে শকাব্দের প্রচলন ছিল, কিন্তু সেসময়কার নথিতে বঙ্গাব্দ মেনে বছর গণনার কোনোরুপ উল্লেখ পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় মতবাদ অনুসারে, প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯৩-৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন ৷ 'বঙ্গাব্দের উৎসকথা' বইয়ের সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর সমর্থনে তোড়জোড় চালিয়েছেন। তার দাবি, ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল থেকে বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়। সেদিন নাকি শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহন করেছেন। কিন্তু আগের সমস্যা থাকছে, যেটা স্রং সন গাম্পোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদিও সে সমস্যার একটি পূরণ ঘটতে পারে। যদি বঙ্গাব্দ ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দেই প্রচলিত হয়ে গিয়ে থাকে, কিন্তু পাল ও সেনরা তাঁদের নথিতে ব্যবহার না করে থাকেন, তার একটা যুক্তি হতে পারে এটি হয়তো তেমন প্রচলিত হয়নি তখনও। কেন তখন হয়নি, কেন পরে হল, এগুলো ইতিহাসের ধাঁধা হতে পারে। যারা প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন, তারা এরকম ধাঁধার সঙ্গে সুপরিচিত।
তবে, ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শশাঙ্ক সিংহাসনে বসেছিলেন কিনা, অথবা তাঁর যৌবরাজ্যে অভিষেক ঘটেছিল কিনা এগুলো কিছুটা অনুমানের বিষয়। শশাঙ্ক মারা গেছিলেন ৬৩৭/৩৮ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তাতে সন্দেহ নেই। কারণ ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হিউয়েন সাং আসবেন বাংলায়, তখন শশাঙ্ক বিগত হয়েছেন। সুতরাং, মাৎস্যন্যায় যুগ, পাল যুগ, সেন যুগ - এবং তারপরে বখতিয়ার আগমনের ফলে মধ্যযুগের যে সূচনা, এই সময়গুলোতে বঙ্গাব্দ যদি প্রচলিত হয়েও থাকে তাও কিন্তু সেটি হয়তো মূলধারার বর্ষগণনা ছিলোনা।
অথচ এই সময়ের বহু তারিখ যুক্ত উপাত্ত আমাদের হাতে আছে। তার চেয়ে বড় কথা, “শশাঙ্কের অধীনস্থ মাধব বর্মণ তার গঞ্জাম লেখতেই গুপ্তাব্দ ব্যবহার করেন। ”(এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা- ১৪৫)। বঙ্গব্দের প্রচলন যদি শশাঙ্কই করতেন, তবে সেখানে বঙ্গাব্দ না হয়ে গুপ্তাব্দ কেন? বঙ্গাব্দের আর কোনো নজির নেই কেন? পরিশেষে, শশাঙ্কের সময় যদি বঙ্গাব্দ প্রচলিত হয়েও থাকে তবে, এত রাজনৈতিক উত্থান পতনের পর এত শত বছর ধরে কি টিঁকে থাকতে পারে? বিশেষত যখন মাৎস্যন্যায়, পাল, সেন, বখতিয়ার, পাঠান, মোগল - এতগুলো যুগ কেউই বিশেষ করে শশাঙ্ককে মনে রাখেনি, মনে রাখার সেভাবে প্রয়োজন বোধ করেনি।
সুলতান হোসেন শাহ তৃতীয় মতবাদের নায়ক। যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের দাবি এটি। এ কথা সত্য, সুলতান হোসেন শাহ শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তারপরেও বঙ্গাব্দ প্রচলনের কোনো নজির সেসময় দেখা যায় না। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায়ও এই দাবির সত্যতা খুঁজে পাননি। তার বদলে পাওয়া যায় হিজরি ও শকাব্দের ব্যবহার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হোসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহ ‘নসরৎশাহী সন’ নামে একটি সংবৎ প্রবর্তন করেছিলেন। বঙ্গাব্দ যদি হোসেন শাহই প্রচলন করতেন, তাহলে তাঁর পুত্রের দ্বারা আবার অন্য একটি সংবৎ প্রবর্তিত হত কি?
এইবার আমি চতুর্থ ও পন্ডিতগণের কাছে সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য মতবাদটি সম্বন্ধে আলোচনা করবো। এই ধারণা অনুসারে, মোগল সম্রাট আকবর হলেন বঙ্গাব্দের প্রচলক। আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে একটি নতুন ধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেন। এই ধর্মের নাম দেওয়া হয়েছিল দীন-ই-ইলাহি। এই ধর্মের আদর্শে তিনি মুদ্রা থেকে কালিমা তুলে দেন। মুদ্রা ও শিলালিপি থেকে আরবি ভাষা তুলে দিয়ে ফারসি ভাষার প্রবর্তন করেন। একই সাথে তিনি আরব দেশীয় চান্দ্রবৎসরের পরিবর্তে পারস্যের অনুকরণে সৌর বৎসরের প্রচলন করেন।
প্রচলিত হিজরি সন পুরোপুরি চন্দ্র নির্ভর হবার কারণে ভারতের ঋতুর সাথে মিলতো না। রাজস্ব আদায়েও অসুবিধা হতো। এজন্য মাসগুলোকে চন্দ্রনির্ভর রেখে বছরকে সৌর করে ঋতুর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া হয়। ফসলি সন হিসেবে এর কার্যকারিতা ছিল যুগোপযোগী। প্রাথমিকভাবে এই বৎসর-গণন পদ্ধতির নাম দেওয়া হয় তারিখ-ই-ইলাহি। এই ইলাহি সনকে ভারতবর্ষের আদর্শে নতুন করে সাজানোর জন্য আকবর ৯৯২ হিজরি সনে, তাঁর রাজসভার রাজ জ্যোতিষী আমির ফতেউল্লাহ শিরাজীর উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন। আকবর ৯৬৩ হিজরি সনের রবিউল আখির মাসের ২ তারিখে (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) সিংহাসনারোহণ করেন। হিজরি সনের মর্যাদা দেখিয়ে, ৯৬৩ সংখ্যাকে ইলাহি সনের প্রথম বৎসরের মর্যাদা দেন। এর পরবর্তী বৎসর থেকে সৌরবৎসর হিসাবে গণনা শুরু করেন।
আকবর এই নতুন বর্ষ-গণন পদ্ধতি প্রচলনের আদেশ জারি করেন ৯৯২ সালের ৮ই রবিউল তারিখ। খ্রিষ্টাব্দের বিচারে এই তারিখ ছিল ১০ মার্চ ১৫৮৫। যদিও আকবর-এর সিংহাসন আরোহণের দিন থেকে ইলাহি বর্ষের শুরু হওয়ার আদেশ জারি হয়েছিল, কিন্তু কার্যত দেখা গেল, পারস্যের পঞ্জিকা অনুসারে বৎসর শেষ হতে ২৫ দিন বাকি রয়ে যায়। তাই ইলাহি সন চালু হলো– আকবরের সিংহাসন আরোহণের ২৫ দিন পর। এই নির্দেশানুসরে বিষয়টি কার্যকরী হয়– ২৮ রবিউল আখের ৯৬৩ হিজরী, ১১ মার্চ, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ। আকবরের দরবারি ঐতিহাসিক আবুল ফজলও তার আকবরনামাতে এই সন প্রবর্তনের কথা বলেছেন।
ইলাহি সনের প্রথম দিনটিকে প্রাচীন পারস্যের রীতি অনুসারে নওরোজ (নতুন দিন) হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। এছাড়া ইলাহি সনের মাসগুলোর নাম গ্রহণ করা হয়েছিল প্রাচীন পারস্যের পঞ্জিকায় প্রাপ্ত নামগুলো থেকে। পারস্যের এই মাসগুলোর নাম ছিল- ফারওয়ারদীন, আর্দিবিহশ্ত, খুরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহরীয়ার, মেহ্র, আবান, আজার, দে, বাহমান এবং ইসপন্দর।
তবে, এই তত্ত্বেরও কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, আকবরের সমসাময়িক কোনও নথিতে বঙ্গাব্দের প্রচলন নিয়ে একটা কথাও নেই। মুঘলরা এমন নীরবে কাজ করতেন না। যে কাজই করতেন, তার উল্লেখ অবশ্যই থাকত। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি গ্রন্থটি আকবর কর্তৃক বঙ্গাব্দ প্রচলনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব।
দ্বিতীয় সমস্যা এই তত্ত্বের, এই তারিখ-ই-ইলাহির সঙ্গে ৯৬৩ হিজরিকে ভিত্তিবর্ষ ধরে নেওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। তারিখ-ই-ইলাহি কিন্তু হিজরি বছর থেকে গণনা করা হয়নি, সেটার প্রথম বছরই ছিল আকবরের সিংহাসনপ্রাপ্তির বছর। অর্থাৎ সেটা কিন্তু প্রথমেই ৯৬৩ দিয়ে শুরু হয়নি। সেক্ষেত্রে, তারিখ-ই-ইলাহির সঙ্গে বঙ্গাব্দকে এক করে দেখাটা খুবই দুর্বল যুক্তি।
শেষ এবং সর্ববৃহৎ সমস্যা হল, আকবর বাংলা জয় করেন ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে। ১৫৮৪ সালে বাংলার অতি অল্প অংশ আকবরের মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৫৭৬ সালে শেষ পাঠান সুলতান, দাউদ কররানীর মৃত্যু ঘটেছে, গৌড়ে আকবরের প্রতিনিধি অতীব অসহায়, এবং গৌড় বঙ্গে তখন বারো ভুঁইয়ার রাজত্ব চলছে। ১৫৭৫ থেকে ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলেছে মোগল-বাংলা সংঘর্ষ। ততদিনে মোগল মসনদে আকবর গিয়ে জাহাঙ্গীর উঠেছেন। এমতাবস্থায় যে রাজস্ব আকবরের প্রায় কিছু আদায়ই হয় না, সে রাজস্বের জন্য আকবর নতুন অব্দ তৈরি করে ফেলবেন? এও বলার, আকবর রাজস্ব আদায়ের জন্য যদি কোনও নতুন ফসলি সন শুরু করেন, সেটা কিন্তু বৈশাখে শুরু হওয়ার কথা নয়, কারণ বৈশাখে কোনও নতুন ফসল ওঠে না। সুতরাং, কোনও নতুন রাজস্ব আদায় হওয়ার সম্ভাবনাও অত্যন্ত নগণ্য।
সুতরাং, আকবরের ইলাহি সনকে যেভাবে ঢালাওভাবে বঙ্গাব্দের উৎস বলে সাক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে, তা অসম্পূর্ণ, বড়জোড় তারিখ-ই-ইলাহিকে “বঙ্গাব্দ” ধারণার একটি অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বলা যেতে পারে। তাছাড়া, বঙ্গাব্দের উল্লেখ আকবরের সিংহাসনারোহণের অনেক আগেও পাওয়া যায় অল্পবিস্তর। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মৃন্ময়ী মাতার মন্দির ৪০৪ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দির শুধু আকবর নয়, বখতিয়ার খিলজিরও আগমনের আগে প্রতিষ্ঠিত। আকবর যদি বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতাই হন, তাহলে আকবরের বহু শতাব্দী আগের মন্দির গাত্রে এবং তাম্রলিপিতে বঙ্গাব্দের উল্লেখ কোত্থেকে এলো? এ ছাড়াও বাঁকুড়ার একটি মন্দিরে ১০২ বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে, বাঁকুড়ারই ডিহারগ্রাম ও সনাতপন গ্রামে প্রাচীন টেরাকোটার মন্দিরে ৯৬৩ খৃষ্টাব্দের আগের বঙ্গাব্দের উল্লেখ রয়েছে, বৃন্দাবনচন্দ্র পুততুণ্ড রচিত “চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস” গ্রন্থে ৬০৬ বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে। তা ছাড়াও, এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত যে দেওয়া যায়, শুধুমাত্র তাইই নয়, যারা পাণ্ডুলিপি বা পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন, তারা দেখেছেন বা দেখবেন যে, সম্রাট আকবরের সময়ের বা ১৬ শতাব্দীপূর্ব পাণ্ডুলিপিগুলিতে অনেক স্থানেই বঙ্গাব্দের নিদর্শন পাওয়া যায়। বাংলা অঞ্চলে পাওয়া পাণ্ডুলিপিতে অধিকাংশ স্থানেই শকাব্দ এবং কিছুকিছু স্থানে শুধুমাত্রই তারিখ দেওয়া আছে, সেই তারিখগুলি সুস্পষ্টরূপে বঙ্গাব্দের।
ইতিহাসে বাংলা সন চালুকরণ বা নববর্ষ পালন নিয়ে তেমন কোন সূচনা চিহ্ন মেলে না। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীণতম নিদর্শন চর্যগীতিকায় বাঙ্গালীর কথা থাকলেও বাংলা সনের কোন কথা নেই। মধ্যযুগে বাংলা, সংস্কৃত, আরবি-ফারসি ভাষার সব ধরনের রচনায় প্রধানত হিজরি সন ও শকাব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু লেখকগণ শকাব্দের এবং মুসলমান লেখকগণ হিজরি সনের ব্যবহার করেছেন। মুসলমানদের ধর্মকর্ম চান্দ্রমাসের দিন-ক্ষণ অনুযায়ী নির্ধারিত হতো; হিন্দুদের পূজাচার ও শুভাশুভ কাজে দিন-ক্ষণ, বার-তিথি, লগ্ন বিচার করতে চান্দ্র এবং সৌর উভয় মানের দিনপঞ্জীর ব্যবহার ছিল। শকাব্দে চান্দ্র ও সৌর উভয় মানে বর্ষ গণনা করার রীতি ছিল। তাঁরা প্রাচীনকাল থেকেই এরূপ দিনপঞ্জী ব্যবহার করে আসছেন; মধ্যযুগে নতুন কিছু করার প্রয়োজন বোধ করেন নি। সুতরাং দিনপঞ্জী ব্যবহারের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় ব্যতিক্রম ছাড়া দুই ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হেঁয়ালি ভাষায় রচনাকাল দেওয়ার রীতি ছিল। সেকালে রচিত পান্ডুলপিতে এর ভুরিভুরি প্রমাণ রয়েছে। হিন্দু কবিগণ শকাব্দ ছাড়াও ‘লক্ষণাব্দ’ ও ‘ত্রিপুরাব্দ’ ব্যবহার করেছেন। মধ্যযুগের কাব্য ‘জঙ্গনামা’য় রচয়িতা মহম্মদ ইয়াকুব বাংলা সনের কথা বলেছেন। তিনি হেঁয়ালিবর্জিত ভাষায় কাব্যের রচনাকাল দিয়েছেন এভাবে-
মাঘ মাসের জুমাবার সময় ফজর।।”
কবি ১১০১ সালের মাঘ মাসের কোনো এক ‘জুমাবার’ তথা শুক্রবার ‘ফজরের সময়’ অর্থাৎ
ঊষাকালে গ্রন্থরচনা সমাপ্ত করেন।
বাংলা সনের বারো মাসের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ‘বারমাস্যা’ গুলিতে। বারমাস্যা মধ্যযুগের কাব্যের এক প্রকার ‘ফর্ম’ বা আঙ্গিক। লিখিত ও মৌখিক উভয় ধারার বহুসংখ্যক বারমাস্যা রচিত হয়েছে। প্রধানত নায়িকার নামে বারমাস্যার নামকরণ হয়ে থাকে। আখ্যানকাব্যের নায়িকারা মাস ধরে ধরে নিজেদের বিরহবেদনার কথা বর্ণনা করে থাকেন। ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’ মঙ্গলকাব্যে ‘বেহুলার বারমাস্যা’ আছে, যা বৈশাখ মাস দিয়ে শুরু, আর চৈত্রমাস দিয়ে শেষ হয়েছে।
“প্রথম বৈশাখ মাসে সোসর রাত্রিদিবা।
আপন মন্দিরে সোনা আমার করে সেবা।।
…
এইত চৈত্র মাসে আনিয়া ঝড় বাও।
অতি কোপে ডুবাইলাম চান্দর চৌদ্দ নাও।।”
চৈত্রের শেষ ও বৈশাখের প্রথম দিকে ঝড়বৃষ্টি তখনও হতো,
এখনও হয়। ‘প্রথম বৈশাখ মাসে’র উল্লেখ থেকে এটাও প্রমাণিত হয়
যে, ঐ
মাস দিয়ে বছরের শুরু হতো। আনুমানিক ১৫৯৪ সালে রচিত মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গল’
কাব্যের ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’ও বৈশাখ মাস দিয়ে শুরু,
আর ‘মধুমাস’ বা চৈত্রমাস দিয়ে শেষ হয়েছে। বিজয়গুপ্ত ও
মুকুন্দরাম উভয়ে কাব্যের রচনাকাল দিয়েছেন শকাব্দে। বিজয়গুপ্তের সময় ফসলি হিজরি বা
বাংলা সন চালু হয় নি, কিন্তু মুকুন্দরামের কাব্যরচনার অল্পকাল পূর্বে এর প্রচলন
শুরু হয়। মুকুন্দরাম তাঁর লেখায় বাংলা মাসের নাম ব্যবহার করলেও গ্রন্থের রচনাকাল
দিয়েছেন শকাব্দতে। মুহাম্মদ ইয়াকুব ‘জঙ্গনামা’ (১৫৯৪) কাব্যে বাংলা সন ব্যবহার
করেছেন। অর্থাৎ ঐ সময় পর্যন্ত বাংলা সন সম্পর্কে একটা মিশ্র চেতনা কাজ করেছে।
আবার, ষোলো শতকের গোড়ার দিকে রচিত শাহ মোহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যের ‘জোলেখার বারমাস্যা’ মাঘমাস দিয়ে শুরু এবং পৌষমাস দিয়ে শেষ হয়েছে।
মাঘ হৈল পরকাশ কানন কুসুম হাস
শুভ ছিরি পঞ্চম প্রকাশ।
…
পৌষ আইল ওসা ঋত ভুবনে পুরিত শীত
খোহাময় জেহ্ন বৃষ্টি করে।”
আরাকানের রাজধানী রোসাঙ্গের কবি আ্লাওলের ‘পদ্মাবতী’ (১৬৪৮) কাব্যে ‘নাগমতীর
বারমাস্যা’ শুরু হয়েছে আষাঢ় মাস এবং শেষ হয়েছে জ্যৈষ্ঠমাস দিয়ে।
“প্রথম আষাঢ় মাস বরিষা প্রবেশ।
মোর খণ্ড ব্রত ফলে পহু নাহি দেশ।।
…
জ্যৈষ্ঠেতে আনল রবি বরিখে সদাএ।
যুগ সম অহ দীর্ঘ সহন না যাএ।।”
সগীরের মতে বছরের প্রথম মাস হয় মাঘ, আর আলাওলের মতে আষাঢ়। সগীর ফসলি হিজরি চালু হওয়ার পূর্বকালে
এবং আলাওল পরবর্তীকালে আবির্ভূত হন। রোসাঙ্গের অপর কবি কাজি দৌলত বারমাস্যার স্থলে
‘ঋতু-পরিক্রমা’ রচনা করেন। তাঁর রচিত ‘সতীময়না-লোর-চন্দ্রানী’ কাব্যের নায়িকা
ময়নাবতী; তিনি স্বামীর অবর্তমানে বিরহজনিত
দুঃখবেদনার কথা বারো মাসের স্থলে ছয় ঋতুতে প্রকাশ করেছেন। সিলেট থেকে সংগৃহীত
আবিরার বারমাস্যাতে বলা হয়েছে,
তুমি নি আইছরে বন্ধু এমন পাষাণ
…
কার্তিক মাসের দিনে বছরের শেষ।
না আইলা আবিরার সাধু ছাড়িয়া বৈদেশ।”
এখানে দেখা যায়, বাংলা সনের সূচনা হচ্ছে ‘আগন’ বা অগ্রহায়ন মাসে ও শেষ
হচ্ছে কার্তিক মাসে।
সকলেরে রান্ধে শাগ রে, নীলার অঙ্গ তিতা।।”
অতএব, দেখা যাচ্ছে, পুরো বিষয়টিই গোলকধাঁধায় ভরা। কবে থেকে বাংলা সন চালু হয়েছে
তার যেমন কূলকিনারা মেলে না, তেমনি কবে থেকে বৈশাখে বাংলা নববর্ষ শুরু তারও হদিস মেলে
না।
ধারণা করা হয়, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই আকবর ইলাহি সনের প্রবর্তন করেন। সেই সনকে ভিত্তি ধরে ঠিক রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই মুর্শিদকুলী খানের সময় সম্ভবত বাংলা সনের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। এ কারণে ইলাহি সন থেকে উৎপত্তি ঘটলেও বাংলা সালের মাস এবং দিনের নাম পূর্বপ্রচলিত শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। আবার স্মরণ করা দরকার, মুর্শিদকুলী খান প্রথম জীবনে দক্ষিণভারতীয় ব্রাহ্মন ছিলেন(তাঁর আসল নাম ছিল সুর্যনারায়ন মিশ্র)ও স্থানীয় হিন্দু অভিজাত এবং সংস্কৃতির প্রশংসনীয় পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
রাজস্ব আদায়ের জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে চাপ আসতো প্রায়ই। সাধারণ মানুষেরা ফসল না কেটে তো আর খাজনা দিতে পারতো না। অনেকটা সে কারণেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব মুর্শিদকুলি খান (১৭১৭-২৭) চৈত্র মাসের শেষে এবং বৈশাখ মাসের শুরুর দিকে মুর্শিদাবাদ দরবারে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এতে রাজা, মহারাজা, জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার প্রমুখ রাজপুরুষ ও ভূস্বামীগণ নিজ নিজ এলাকার খাজনা স্বয়ং অথবা তাঁদের প্রতিনিধি দরবারে হাজির হয়ে রাজকোষাগারে জমা দিতেন। বিনিময়ে নবাব তাঁদের খেতাব-খিলাত-উপহারাদি প্রদান করে সম্মানিত করতেন। নবাবের অনুসরণে রাজা, মহারাজা, জমিদারগণ নিজেদের কাছারিতে পুণ্যাহর আয়োজন করে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। ভারতচন্দ্র রায় ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি; তাঁর রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ (১৭৫২) কাব্যে আছে-
“হায়নের অগ্র অগ্রহায়ণ জানিয়া।
শুভদিনে পুণ্যাহ করিলা বিচারিয়া।।”
‘অগ্র’ অর্থ প্রথম; ‘হায়ন’ অর্থ অব্দ বা বৎসর। এখানে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনে
পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের দুটি ভিন্ন সময়ের কারণ এমন হতে
পারে যে, জমিদারগণ অগ্রহায়ণ মাসে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন,
কারণ এটি প্রধান ফসল আমনধান ঘরে তোলার সময় ছিল। আসলে
পুণ্যাহ অনুষ্ঠানটি ছিল বকেয়া খাজনা পরিশোধ করা এবং নতুন করে ভূমি-বন্দোবস্ত
নেওয়া। নবাবের বাড়িতে উৎসব ও খাবার দাবারের আয়োজন থাকতো আর সাধারণ মানুষ তাতে যোগ
দেবার পাশাপাশি রাজস্ব পরিশোধ করতো। নবাবের বাড়িতে অতিথি হিসেবে আপ্যায়িত হওয়াটা
কম কথা না। রীতিমতো উৎসবে পরিণত হয়ে গেল দিনটা। নববর্ষ চালুর ইতিহাসের পূণ্যাহের
তাৎপর্য ব্যাপক। ১লা বৈশাখে বাংলার নবাবের আমন্ত্রণে জমিদার বা তাঁদের উকিলেরা নৌকো
বা পালকি চড়ে মুর্শিদাবাদে যেতেন খাজনার শেষ কিস্তি জমা দিতে। খাজনা দেওয়ার পর
সোনার মোহর নজরানা দিলে, নবাববাহাদুর পদমর্যাদা অনুসারে খেলাৎ বা শিরোপা অর্থাৎ
পাগড়ি, পোশাক ও কোমরবন্ধ দিয়ে সম্মান জানাতেন। আলিবর্দী খাঁয়ের সময় একটি পুণ্যাহ
অনুষ্ঠানে বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৪০০ জমিদার ও রাজকর্মচারী মুর্শিদাবাদে
গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। খুব সম্ভবত ব্যবসায়ীরা সেখান থেকেই হালখাতার অনুপ্রেরণা
পেয়েছে। ইংরেজ সরকার পুণ্যাহর আয়োজন করেন নি,
তবে জমিদারগণ তা অব্যাহত রাখেন। প্রতি বছর চৈত্র
সংক্রান্তিতে প্রজাদের বকেয়া কর-খাজনার খাতা ফেলে দিয়ে নতুন খাতা চালু করতেন
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ও। ফলে সেদিন
রাজবাড়িতে ধুমধাম করে পালিত হত হালখাতা উদযাপন। এই অনুষ্ঠানে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি
আমন্ত্রিত থাকতেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন লর্ড ক্লাইভ,
বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরাম,
শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণদেব প্রমুখ। সেদিন গৃহদেবতা বড়
নারায়ণকে ঘিরে হত পুণ্যাহ, কপিলা গীতি। এছাড়াও বসত কাব্য সম্মেলন ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের
আসর। বিশিষ্ট কোনও পণ্ডিতকে নির্বাচন করে দান করা হত স্বর্ণ গাভী। গীতিকারদের
দেওয়া হত পঞ্চশস্য।
এদিন দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ খাজনার হিসাব দিতে আসতেন। আগত প্রজাদের হাতে তুলে দেওয়া হত বকেয়া খাজনার হিসাব। বছরে এই একটি দিনেই প্রজারা সরাসরি রাজার হাতে কর নিবেদন করার সুযোগ পেতেন। তাই প্রজারা নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসতেন কিছু নজরানাও। সেইসঙ্গে রাজার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা নিজেদের সুখ দুঃখের কথাও সারতেন এদিন। খাজনা পর্ব মিটে গেলে বারোদুয়ারির প্রাঙ্গণেই পংক্তিভোজনে বসতেন প্রজারা। তদারকি করতেন রাজা স্বয়ং! এছাড়াও কৃষ্ণনগরের ব্যবসায়ীদের দীর্ঘকালের সংস্কার ছিল রাজবাড়ির ঠাকুর দালানে ব্যবসার নতুন খাতা ছুঁইয়ে আনা। সেই প্রথাও বহু বছর ধরেই চলে এসেছিল। এ যুগেই কোনো এক সময়ে ১লা বৈশাখ উৎসবের দিন ধার্য হয়, যা জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের (১৯৫০) পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল।
চৈত্র শেষে বাংলার প্রান্তে প্রান্তে হত গাজন, চড়ক। এটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা প্রধানত নিম্নবর্গের মানুষরা পালন করতেন। চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক পূজা, সঙ্গে চলে গাজনের মেলা। এই গাজনের মেলা চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ী পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন,“আগেকার দিনে চৈত্রমাস পড়িলেই গাজনে সন্ন্যাসীদের বড় হুড়োহুড়ি পড়িত। গাজনের দিন তাহারা ঢাক বাজাইয়া রাস্তা দিয়া যাইত। সেই সময় পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা রাস্তার ধূলায় কাঠি দিয়া একটা দাগ টানিয়া দিত। তারপর লোকে প্রশ্ন করিত যথা -
‘শুনরে সন্ন্যাসী ভাই আমার বাখান
উত্তর দিয়া তুমি যাও অন্যস্থান।
এরণ্ড আর থাম খুঁটি, ভেরেণ্ডার বেড়া,
তার মাঝেতে পড়ে আছে মস্ত এক নোড়া।
বাটনা বাটিতে শিবের পুটকি হল ক্ষয়
সেই শিবকে গড় করলে কি পুণ্য হয়?’”
শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এইদিনে স্নান,
দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্য বলে মনে করা হয়। চৈত্র
সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। এই উপলক্ষে একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু
করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, আবার কোন স্থানে দেখা যায়,
প্রতিটি সনাতন হিন্দু ঘরের উঠানে শিব-গৌড়ী নেচে নেচে
চাল-ডাল-ফল-অর্থ সংগ্রহ করে। একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং তার সাথে
অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে। চৈত্র
সংক্রান্তির মেলাতে সাধারণত শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছের ঘোরা,
আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য দৈহিক কলাকৌশল
দেখানো হতো। এখনও কিছুটা গ্রামের মেলায় দেখা যায়। চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় বাঁশ,
বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরী বিভিন্ন ধরণের তৈজসপত্র ও খেলনা,
বিভিন্ন রকমের ফল-ফলাদি ও মিষ্টি ক্রয়-বিক্রয় হয়। বায়াস্কোপ,
সার্কাস, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে।
এই সবকিছুর বাইরে একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনেও নতুন বছর এসে পৌঁছাত ধীর পায়ে। অজিতকুমার গুহ তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখছেন— ‘...চৈত্রের সংক্রান্তি আসার কয়েক দিন আগে থেকেই আমাদের ঢেঁকিঘরটা মুখর হয়ে উঠতো। নববর্ষের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে নাড়ু-মোয়া, ছানার মুড়কি ও সরভাজা দিতে হবে; তারই আয়োজন চলতে থাকতো। বাড়ি থেকে অনেক দূরে শহরের এক প্রান্তে আমাদের ছিল মস্ত একটা খামারবাড়ি। সেখান থেকে বাড়ির বাইরে গোলাবাড়িতে চৈতালী ফসল উঠতো। আর আঙিনার প্রান্তে তৈরি হতো বড় বড় খড়ের গাদা। উঠানের একধারে বড় দুটো কনকচাঁপার গাছ। এই শেষ বসন্তেই তাতে ফুল ধরতো। আর এলোমেলো বাতাসে তারই গন্ধ বাড়িময় ঘুরে বেড়াতো। কোনো কোনো দিন কালবোশেখি আসত প্রলয় রূপ নিয়ে। সারাদিন রৌদ্র দাবদাহে প্রতপ্ত মাটিকে ভিজিয়ে দিত। কচি কচি আমগুলো গাছ থেকে উঠানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো আর ভেজা মাটি থেকে একটা সোঁদা গন্ধ নাকে এসে লাগতো। তারপর পুরনো বছরের জীর্ণ-ক্লান্ত রাত্রি কেটে গিয়ে নতুন বছরের সূর্যের অভ্যুদয় ঘটতো...। ‘
দীনেন্দ্রকুমার রায়-এর ‘পল্লীচিত্র’ গ্রন্থে ধরা পড়েছে বৈশাখী মেলার বিচিত্র এক রূপ— ‘দোকান পশারীও কম আসে নাই…। দোকানদারেরা সারি সারি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থায়ী চালা তুলিয়া তাহার মধ্যে দোকান খুলিয়া বসিয়াছে। ...এক এক রকম জিনিসের দোকান এক এক দিকে। কোথাও কাপড়ের দোকান, কোথাও বাসনের, কোথাও নানাবিধ মনিহারি দ্রব্যের দোকান। এত রকম সুন্দর পিতল-কাঁসার বাসন আমদানি হইয়াছে যে, দেখিলে চক্ষু জুড়ায়। কৃষ্ণনগর হইতে মাটির পুতুলের দোকান আসিয়াছে; নানা রকম সুন্দর সুন্দর পুতুল...। জুতার দোকানে চাষীর ভয়ঙ্কর ভিড়। কাপড়ের দোকানে অনেক দেখিলাম। ...লোহালক্কড় হইতে ক্যাচকেচের পাটী পর্যন্ত কত জিনিসের দোকান দেখিলাম…। এসব মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ, মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, কদমা-খাগরাই, জিলিপি-রসগোল্লা। সবই চাই।...’
আবার নববর্ষের ভিন্ন রূপ দেখি আহমদ ছফা-র লেখায়, ‘...আমরা ছোটবেলায় দেখেছি বেলা আট-নয়টা বাজার সাথে সাথে বাড়িতে আচার্য বামুন আসতেন। তিনি পাঁজি খুলে অনেকটা আবৃত্তির ঢঙে বলে যেতেন, এই বছরের রাজা কোন গ্রহ, মন্ত্রী কোন গ্রহ, এ বছরে কত বৃষ্টি হবে, কত ভাগ সাগরে আর কত ভাগ স্থলে পড়বে, পোকামাকড়, মশা-মাছির বাড় বৃদ্ধি কত। তারপর আমাদের কোষ্ঠী দেখে দেখে গণকঠাকুর বলে যেতেন। এ বছরটি কার কেমন যাবে। সমস্ত মুসলিম বাড়িতে কোষ্ঠী রাখা হতো না— সব বাড়িতে গণকঠাকুরও আসতেন না।
...আমাদের পরিবারের সঙ্গে যেসব হিন্দু পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল
সেসব বাড়ি থেকে মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, নাড়ু এগুলোর হাঁড়ি আসতো। এ হাঁড়িগুলো ছিল চিত্রিত। আমাদের
গ্রামে এগুলোকে বলা হতো ‘সিগ্যাইছা পাতিল’। আমার মা এ হাঁড়িগুলো যত্ন করে ছাদের
ওপর রেখে দিতেন। আমরা সুযোগ পেলেই চুরি করে খেতাম।... কৃপণ সাধু ময়রা পর্যন্ত
সেদিন দাম না নিয়ে দু-একটা কদমা অথবা দু-চারখানা গজা অম্লান বদনে খাইয়ে দিত। তখন
এইটুকু সৌভাগ্যের জন্যেই পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা হয়নি।’
আজ আমরা পয়লা বৈশাখের যে দিনটিকে নববর্ষ বলি, দুশো বছর আগে বাংলায় তার প্রচলন ছিল না। সে সময়ে নববর্ষের উৎসব বলতে ইংরেজি নববর্ষকে বোঝানো হত। সে কালের কবি ঈশ্বর গুপ্ত এই উপলক্ষে একটি কবিতা লিখেছিলেন,
খ্রীস্ট মতে নববর্ষ অতি মনোহর।
প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর॥
চারু পরিচ্ছদযুক্ত রম্য কলেবর।
নানা দ্রব্যে সুশোভিত অট্টালিকা ঘর॥
এর আগে বাংলা নববর্ষে এই অট্টালিকা সুশোভিত করার কথা কোথাও পাওয়া যায় না।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে
ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা
করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে
১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
তখন চৈত্র শেষে বাংলার প্রান্তে প্রান্তে হত গাজন, চড়ক। এটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা প্রধানত নিম্নবর্গের মানুষরা পালন করতেন। অন্য দিকে ফসল তোলা শেষ হওয়ার পর যে পুণ্যাহ উৎসব পালন করা হত, তার সঙ্গে জড়িত ছিল মানুষের অর্থনৈতিক জীবন। এক দিকে রাজস্ব জমা দেওয়া হত, তার সঙ্গে বাকি রাজস্ব ছাড় করা হত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কারণে রাজস্ব দিতে না পারলে তাও মকুব করা হত। জমিদাররা এই সময় প্রজাদের ঋণ দিতেন। রায়তরা জমিদারের কাছারিতে একত্রিত হয়ে জমিদার বা নায়েবের কাছ থেকে পান বা পানপাতা উপহার পেতেন। এই দিনটি ছিল সামাজিক আদানপ্রদানের দিন। স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে সেই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে ওঠে। ক্রমে তা গোটা সমাজ জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে যা ছিল শুধু কৃষি উৎসব বা রাজস্ব আদায়ের বিষয়, এক সময় তা হয়ে উঠল নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা, তার সঙ্গে নব জীবনের আহ্বান। যা কিছু অসুন্দর, জীর্ণ, পুরাতন, তা শেষ হয়ে যাক। পয়লা বৈশাখ সেই শুভ সূচনার দিন।
বঙ্গবাসী বাংলা ও ইংরেজি দুটো নববর্ষ উনিশ শতকে কীভাবে পালন করত তার অনবদ্য বর্ণময় বিবরণ পাওয়া যায় হুতোম–এর নকশায়-
‘ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন।... বাঙ্গালিরা বছরটী ভাল রকমেই যাক আর খারাবেই শেষ হক্, সজ্নে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়ে পুরাণকে বিদায় দ্যান। কেবল কল্সি উচ্ছুগ্গু কর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।’
উনিশ শতকে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় সে কালের বর্ষশেষের ভারী সুন্দর বর্ণনা রয়েছে—
“এদিকে আমাদের বাবুদের গাজনতলা লোকারণ্য হয়ে উঠল, ঢাক বাজতে লাগল, শিবের কাছে মাথা চালা আরম্ভ হল, সন্নাসীরা উবু হয়ে বসে মাথা ঘোরাচ্ছে, কেহ ভক্তিযোগে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে পড়েছে— শিবের বামুন কেবল গঙ্গাজল ছিটুচ্ছে, আধ ঘণ্টা মাথা চালা হল, তবু ফুল আর পড়ে না।”
হুতোম বাংলা নববর্ষ উৎসব উদ্যাপনকে দুটি পর্বে ভাগ করেছেন, একটি পর্ব নববাবুদের উৎসব পালনের বিষয়। ধর্মীয় পূর্ণকলস উৎসর্গের মতো নববাবুরা বছর শেষকে বিদায় এবং মদের কলসী উৎসর্গ করে বাগানবাড়িতে নববর্ষকে স্বাগত জানাত। অন্য পর্ব দোকানদারদের হালখাতার মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করা।
চৈত্র সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যায় বাবুরা কেউ যাবেন রক্ষিতার বাড়িতে, কেউ যাবেন বাগানবাড়ি। বাবু আমোদ করতে যাবেন, তাই বাবুর স্ত্রীকে চুনট করা উড়ুনিটা, সোনায় কাজ করা হাতির দাঁতের ছড়িটা, রুমালটা হাতের উপর তুলে দিতে হত। রুমালটা হাতে নিয়ে হয়ত বাবু দেখলেন তাতে বোকে মাখানো নেই। ব্যাস্! বাবু রেগে লাল, বললেন, বোকেটা আবার গেল কোথায়? বাড়ির ‘মেয়েছেলেটা’ এটুকুও খেয়াল রাখতে পারে না। সে কি রাজকার্য্য করে! কিসের জন্য তা হলে বিয়ে করা?’
পান থেকে চুন খসলেই স্ত্রীদের এমন গালিগালাজ আর হেনস্থার মুখে পড়তে হত। তাই
তাঁরা সব সময় তটস্থ হয়ে থাকতেন। তাঁরা যখন দুঃখে ভেঙে পড়তেন,
তখন ঠানদিদিরা বলতেন,
‘রাগ করিসনে নাতবৌ। মেয়েছেলে হয়ে
জন্মেছিস— সব সইতে হয়। তোর শ্বশুরের বাবা,—সেও রোজ সন্ধেবেলা এমনটি করেই বেরিয়ে যেত! আমি সাজিয়ে
গুজিয়ে দিতাম! তিনি রামবাগানে যেতেন। আর যখন ফিরতেন তখন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেছে।
বছরে যে কটা দিন রাত তাঁর সান্নিধ্য পেতাম তা হাতে গুনলে এক আঙুলেই শেষ হয়ে যাবে।’
চৈত্র সংক্রান্তি হল বাংলা বছরের শেষ দিন। সেই দিনটিরও মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন হুতোম। বলছেন,
‘এদিকে শহরে সন্ধ্যাসূচক কাঁসর ঘণ্টার শব্দ থাম্লো। সকল
পথের সমুদায় আলো জ্বালা হয়েছে। ‘বেল ফুল!’ ’বরফ’! ‘মালাই’! চিৎকার শোনা
যাচ্চে। আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েচে অথচ খদ্দের ফিচ্চে
না।
...মেছোবাজারের হাঁড়ি হাটা– চোরবাগানের মোড়, যোড়াসাঁকোর পোদ্দারের দোকান, নতুন বাজার, বটতলা, সোনাগাছির গলি ও আহিরিটোলার চৌমাথা লোকারণ্য— কেউ মুখে মাথায় চাদর জড়িয়ে মনে কচ্চেন কেউ তাঁরে চিনতে পার্বে না; আবার অনেকে চেঁচিয়ে কথা কয়ে, কেশে, হেঁচে, লোককে জানান দিচ্চেন যে, তিনি সন্ধ্যার পর দুদণ্ড আয়েস করে থাকেন।
আজ নীলের রাত্তির। তাতে আবার শনিবার; শনিবারের রাত্তিরে শহর বড় গুলজার থাকে— পানের খিলীর দোকানে
বেল লণ্ঠন আর দেওয়াল গীরি জ্বল্ছে। ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে বেলফুলের গন্ধ ভুর ভুর
করে বেরিয়ে যেন শহর মাতিয়ে তুলচে।...’
বছরের শেষ রাতটি শেষ হতে চলেছে, ‘এদিকে গিজ্জার ঘড়িতে টুং টাং ঢং টুং টাং ঢং, করে রাত চারটে বেজে গ্যালো— বারফ্টা বাবুরা ঘরমুখ হয়েছে।’
হুতোম ঠিকই বলেছেন, ‘কলকেতা শহরের আমোদ শিগ্গির ফুরায় না।’ রাজবাড়ির মতো ১লা বৈশাখেও নববাবুদের বাড়িতে পুরাতনী গান, ভক্তিগীতি, বৈঠকী বা ধ্রুপদী গানে আসর জাগিয়ে রাখতেন শিল্পীরা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রথম থেকেই নববর্ষের উৎসব কোনও ধর্মের বাঁধনে বাঁধা পড়েনি। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ এই উৎসবে বাংলার মানুষ— সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান— মহানন্দে যোগ দিতেন। একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা, বিনিময়, খাওয়াদাওয়া, আনন্দ উৎসব মিলে সারা বছরের অন্য দিনগুলির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে উঠত এই দিনটি।
রাজা বা জমিদারবাড়িতেও আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য সন্ধ্যায় শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের আসর বসত। এর সূত্র ধরেই কলকাতার নববাবুরা সঙ্গীতের আয়োজন করতেন। পরবর্তীকালে দোকানে খদ্দেরদের মনোরঞ্জনের জন্য দোকানে দোকানে সন্ধ্যায় গানের আসর বসত। তখনও মাইক্রোফোনের চল হয়নি, খালি গলাতেই শিল্পীরা আসর মাত করতেন। বিখ্যাত সব শিল্পীর গান শুনতে রাস্তায় ভিড় জমে যেত। পরের দিকে কলের গান বাজিয়ে নববর্ষে দোকানে অনুষ্ঠান করা হত। পথচলতি মানুষ অবাক হয়ে দেখতেন ও শুনতেন কলে মানুষ গান গাইছে!
১৯৩৮–৩৯ সাল নাগাদ আকাশবাণীতে নববর্ষের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়; সেখানে গান, আড্ডা, গীতিআলেখ্য ইত্যাদি নানান অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। কাজী নজরুল ইসলাম নববর্ষ উপলক্ষে গান করেছেন। এছাড়া, মহিলামহল বা গল্পদাদুর আসরেও নববর্ষের অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। নববর্ষকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের ডালি সাজিয়ে সুন্দরভাবে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন আকাশবাণীর কর্মকর্তারা।
বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে শুরু হয়েছিল প্রথম সাহিত্যবাসর। ভাবনাটা ছিল এম সি সরকার অ্যান্ড সন্সের প্রাণপুরুষ সুধীরচন্দ্র সরকারের। ওঁর নববর্ষের দিন সাহিত্যিক ও সাহিত্য–রসিকদের নিয়ে গল্প–আড্ডায় মিলনবাসরের স্বপ্ন পূর্ণ হল ১৩৬২ সালে ( ইংরেজি ১৯৫৫)। এই নববর্ষে প্রথম সাহিত্যবাসরের সভাপতি হন ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার। পরের পরের বছর, অর্থাৎ ১৩৬৪ সালে (ইংরেজি ১৯৫৭) সাহিত্যবাসরের সভাপতি ছিলেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত। সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। আর তাঁর এক বক্তব্যের জেরে শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। সভায় উপস্থিত তুষারকান্তি ঘোষ জানিয়ে দিলেন, প্রতি বছর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও গবেষণা কাজের জন্য এক হাজার টাকা করে দুটি পুরস্কার দেবেন। আরেক সংবাদপত্র গোষ্ঠীও প্রতি বছর উৎকৃষ্ট সাহিত্যের জন্য এক হাজার টাকার দুটি পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে। মৌচাক পত্রিকার পক্ষে সুধীরচন্দ্র সরকার শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যের জন্য এবং উল্টোরথ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ শ্রেষ্ঠ কবিতার জন্য ৫০০ টাকার একটি করে পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
পরের বছর, মানে ১৩৬৫ সালে প্রথম বছর সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া শুরু হল। অমৃতবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর পুরস্কার পান হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আরেক সংবাদপত্র গোষ্ঠীর পুরস্কার পেলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় এবং সমরেশ বসু। হেমেন্দ্রকুমার রায় পেলেন মৌচাক পুরস্কার আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যুগ্মভাবে পেলেন উল্টোরথ পুরস্কার। উল্লেখ্য, সেই সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের এবার ষাট বছর পূর্ণ হল।
নববর্ষ মানে পত্র পত্রিকা বই প্রকাশের সময়। ১ লা বৈশাখ ১৩২০ তারিখে উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী সম্পাদিত “সন্দেশ “ পত্রিকার আর্বিভাব, ১৩৩০ সালে “ কল্লোল” পত্রিকা, এমনকি সম্ভবত গুপ্ত কবি ও একবার পয়লা বৈশাখে ‘ সংবাদ প্রভাকর’ এর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে মহাভোজের আয়োজন করে অনেককে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। পয়লা বৈশাখের দিন বই পাড়ায় প্রায় সকল বিখ্যাত সাহিত্যকদের আনাগোনা ছিলো।
বাঙালি ভোজনরসিক। খাওয়া ছাড়া তার কোনও উৎসবই জমে না। তাই নববর্ষের ভোজন–আয়োজনেও ঘাটতি পড়েনি। একবার দেখে নেওয়া যাক, সেকালে খাবারদাবারের আয়োজন কেমন ছিল। রবিদাস চট্টোপাধ্যায় আত্মজীবনীতে নববর্ষের দিন বাহান্ন রকম পদের কথা লিখেছেন। ‘ভাজা মুগ ডাইল, আমড়া মিশ্রিত টকডাল, শাকভাজা, প্রচুর নিরামিষ তরকারি। মাছের মধ্যে আমোদি, পুঁটি, মৌরলা, বেলে, শোল। মাংসের আয়োজনে পাঁঠার ঝোল। এছাড়া কাঁচা আমের চাটনি, ঘরে বানানো মিষ্টি আর পান–সরবত। পাশে রাখা কর্পূর দেওয়া জল।’ ভাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন, ‘চালের স্বর্গীয় সৌরভের লড়াই চলিতেছে ঘৃতের সহিত।’
উনিশ শতকে দোকানে কিন্তু এখনকার মতো ‘ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’ বোর্ড ঝুলত না। উল্টে ধার–বাকিতেই ক্রেতা–বিক্রেতার আত্মীয়তা গড়ে উঠত। হালখাতার খাতা তো আসলে ধারের খাতা। বছরভর মাল ধারে নেওয়া, সুবিধা অনুযায়ী টাকা খাতায় জমা করা। চৈত্রসংক্রান্তি পর্যন্ত ধার নেওয়া যাবে, পয়লা বৈশাখ পুরনো দেনা শোধ করে, নতুন খাতা উদ্বোধন। নতুন খাতা উদ্বোধন তো আর ধারে হবে না, তাই কিছু টাকা নতুন খাতায় জমা দিয়ে রাখা— এই হল হালখাতার অতীত–ভবিষ্যৎ। ১৮৭৮ সালে মহেশচন্দ্র দাস দে ‘প্রণয় পরীক্ষা’ নামে একটি প্রহসন লিখেছিলেন। এই প্রণয় প্রেমিক–প্রেমিকার প্রণয় নয়, ধারীবাবু এবং খরিদ্দারদের প্রণয়। ধার দিয়ে দোকানদারের দুশ্চিন্তা, ধার শোধ না হওয়া পর্যন্ত কেমনটি হয়, সেই ‘প্রণয়’–এর পরীক্ষাই হল প্রহসনের মূলকথা। একটু নমুনা পেশ করি—
‘ধারীবাবু। ধার ধার ধার! ধারে দুনিয়া চলিতেছে। আপনি না ধার দিলে অপর দোকান খোলা, হাঁকিতেছে, হাতছানি দিতেছে। চলিয়া যাইবার সমস্ত পথ খোলা। দোকানীবাবু।— ধারও দিব মিষ্টান্নও খাওয়াইব! আপনি প্রণয়িনী আমার। টাকা না দিলে এ বিবাহ ভাঙিয়া দিব। আগে ধার মিটান, তাহার পর জবান ফুটান।’
নববর্ষে দোকানে খদ্দেরকে পেট ভরে মিষ্টি খাওয়ানোর একটি বর্ণনা ১৮৮৬ সালে
হরিমোহন পাল তাঁর ‘রসিক নাটক’–এ দিয়েছেন—
পেটুক।— খালি পেটে মহাশয় একটি মাত্র মনোহরা ভক্ষণ সম্ভব। তাহার পর একশতটী।
গদীবাবু।— হে–হে। আপনি বুদ্ধিমান বটে। আজি হালখাতার দিনে যতগুলি ইচ্ছা তথা
একশতটী মনোহরা খান!
বুদ্ধিমান বাঙালি গদীবাবুকে সমুচিত জবাব দিয়ে খুশি মনে মনোহরা খাচ্ছে।’
বাংলার নববর্ষ বৈশাখ, গ্রীষ্মকাল প্রভৃতি তখন নিদারুণ দাবদাহে দগ্ধ হতে থাকে। কাজেই কৃষিজীবী মানুষের মনে ভয়ভীতি, উত্তপ্ত পৃথিবী নবজলধারায় স্নিগ্ধ হবে কি না, ফসল ফলবে কি না। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গাওয়া হতো সূর্যবঞ্চনার গান—
‘ওপর দুইটি বাওনের কন্যা মেল্যা দিছে শাড়ি
তারে দেখ্যা সূর্যই ঠাকুর ফেরেন বাড়ি বারি।
ওগো সূর্যাইর মা— তোমার সূর্যাই ডাঙর হইছে বিয়া করাও না। ‘
পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ঐতিহ্য। এটি এমন একটি ঐতিহ্য,
যার বয়সের কোনো গাছ পাথর নেই। গোড়ায় কোনো সুনির্দিষ্ট বছরের
সঙ্গেও এর কোনো যোগ ছিল বলে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ বছরের প্রথম দিনটি ‘নববর্ষ’
নামে পরিচিত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে ‘নববর্ষ’ একটি
নির্দিষ্ট উৎসবের দিন। বাঙালির ঐতিহ্যের স্মারক। বাংলা নববর্ষের সর্বজনীন
অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে চিরায়ত হয়ে ধরা পড়ে বৈশাখী মেলা,
পহেলা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠান। এটি ব্যবসায়ী শ্রেণীর কাছে
একটি আচরণীয় রীতি। আর গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধেবেলায় লোকজ ছড়া কেটে কেটে হতো
আগুন মশাল উৎসব—
মশা-মাছির মুখ পুড়া যায়। ‘
আমার বাজে কাজে সময় নাই।
দিনের বেলা নানান হালে
কোর্ট কাচারি মুন্সীপালে
কেটে যায়রে দিন আমার...। ‘
জীবনের এই টুকরো আনন্দের মধ্যে ধরা পড়ে রূপ-বৈভবের চেতনামিশ্রিত নতুন অনুভবের
উল্লাস। এ রূপ চিরন্তন, এ রূপ জন্ম দেয় এ দেশের সংস্কৃতির,
যা মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বর্ষ শেষে
চৈত্র বিদায় নেয় আকাশে কালো পুঞ্জমেঘ বিস্তার করে। সে মেঘে কখনো আকাশ আবৃত হয়ে যায়
মেঘলায়; কিন্তু মানুষের জীবনে প্রত্যাশার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না।
বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ঠিক কী কী হতো নববর্ষে? কেমন করে বছরের প্রথম দিনটাকে নিজে হাতে সাজাতেন রবীন্দ্রনাথ? তাঁকে ঘিরে আর কে কে থাকতেন? চৈত্রের শুরু থেকেই ঠাকুরবাড়ির ছাদে অথবা অবনীন্দ্রনাথের দোতলার ঘরে শতরঞ্চি পেতে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের মহড়া শুরু হয়ে যেত।রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা গান, কবিতা, নাটক, গানের সঙ্গে নৃত্য প্রভৃতির রেওয়াজ চলত নিয়ম করে। সঙ্গে থাকতেন দীনেন্দ্রনাথ, ইন্দিরাদেবী, নলিনী দেবী, মনীষা দেবী, অবনীন্দ্রনাথের কন্যা সুরূপা, গগনেন্দ্রনাথের কন্যা হাসিদেবী প্রমুখেরা।
নববর্ষের খাওয়াদাওয়া হতো দোতলার টানা বারান্দায়। খাদ্য নিয়ে ঠাকুরবাড়ির বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা কমবেশি সবাই জানেন। নববর্ষের পাতেও সেসব গবেষণার ছায়াপাত হতো। একবার নববর্ষে মৃণালিনী দেবী জনপ্রিয় মিষ্টি “এলোঝেলো” বানিয়েছিলেন। কবির সে মিষ্টি পছন্দ হলেও নামটা পছন্দ হয়নি। উনি নাম পাল্টে রাখলেন “পরিবন্ধ”। মৃণালিনী দেবীর সেই বিখ্যাত কচুর জিলিপি ও এক নববর্ষেরই গবেষণাপ্রসূত।
এই দিনে এমন কিছু পদ রান্না হত, যেগুলিকে এক কথায় প্রত্নপাক বলা চলে। যেমন, এঁচোড় ও মুসুরির ডাল বেটে বড়া করে তার রসকদম্ব। এই পদটি সমস্ত অনুষ্ঠানে প্রজ্ঞাসুন্দরী গুরুদেবকে রেঁধে খাওয়াতেন।সেদিন কিছু সাবেকি রান্নাও হতো। যেমন, ছোলা ও ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাক, কাসুন্দি দিয়ে পাটপাতার ঝোল, ডুমুরের রসা, পুঁই মিটুলির চচ্চড়ি, মসুর ডালের বড়া, মোচাঘন্ট, লাউডগা দিয়ে মটর ডাল, সজনে শাক প্রভৃতি।
শেষ পাতে থাকতো এক অতি বিচিত্র খাদ্য, পাঁঠার হাড়ের অম্বল। এটি আবার দ্বিজেন্দ্রনাথের ভীষণ পছন্দের পদ ছিল। আমিষ পদের মধ্যে এমন কিছু থাকতো, যা আজ বাঙালির হেঁসেলের জাদুঘরে ঠাঁই পেতে পারে, যেমন- আম শোল, মাছের পোলাও, চিতল আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল, কাঁচা ইলিশের ঝোল। আবার নারকেল চিংড়ির মত কালজয়ী পদও থাকতো।
চৈত্র সংক্রান্তির শেষ লগ্নে নববর্ষের সূর্যাস্তের আগে ঘটে আতপ চাল ভিজিয়ে তাতে কচিপাতাযুক্ত আমডাল ডুবিয়ে রাখা হতো। পরদিন পরিবারের সবাইকে সেই ভেজানো চাল খাওয়ানো হতো এবং সেই আমডাল দিয়ে জল ছিটিয়ে সারা বাড়িতে ও সকলের গায়ে দেওয়া হতো। এরপর সকলের কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে জলখাবার দেওয়া হতো। জল খাবারে থাকতো নুন আর আদাকুচি দিয়ে মাখা ভিজে মুগডাল, নুন লেবু দিয়ে মাখা শসা নারকেল, কাঁঠালি কলা, দই-মিষ্টি ইত্যাদি।
একদিন শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে নববর্ষের ভাষণ শেষে প্রবল কালবৈশাখী ধেয়ে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঝোড়ো হাওয়ায় ভিজতে ভিজতে গেয়ে উঠেছিলেন, “তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে”। এই ছিল স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে, নিক্কনে, সুরমূর্ছনায় হর্ষগীত-উচ্ছ্বসিত ঠাকুরবাড়ির পয়লা বৈশাখ। সেই সুর, সেই স্বাদ, সেই গন্ধ আজও বাংলার নতুন বছরের বাতাসে ফিরে ফিরে আসে বেলফুলের সাজিতে, তালপাতার হাতপাখায়।
পয়লা বৈশাখকে যিনি বাঙালির প্রাণের সঙ্গে জুড়ে দিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। যা ছিল বাণিজ্যিক, তা চিরকালের জন্যে ধরা পড়ল আমাদের চিন্তা-চেতনার মধ্যে। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটকে বার বার এসেছে নতুন বছরের স্বাগতবাণী। এ তাঁর কাছে নবজন্ম। পুরনো জীর্ণ জীবনের অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশের আনন্দ অনুভূতি। ১৯৩৯ সালের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) শ্যামলী-প্রাঙ্গণে সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘নববর্ষ-ধরতে গেলে রোজই তো লোকের নববর্ষ। কেননা, এই হচ্ছে মানুষের পর্বের একটা সীমারেখা। রোজই তো লোকের পর্ব নতুন করে শুরু।’
পয়লা বৈশাখ সব বাঙালিরই জন্মদিন। সময়েরও যে প্রাণ আছে, সেই প্রাণ যে মানুষের মিলনমেলায় চঞ্চল হয়ে ওঠে, সব ভেদ-বুদ্ধির আবরণ ভেঙে উষ্ণ সেই প্রাণের ছোঁয়া যে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-নির্বিশেষে সবাইকেই উদার ও বিকশিত আহবান জানায়। সে কথাটি পহেলা বৈশাখের ভোরেই ভালোভাবে অনুভব করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩০ সনের পয়লা বৈশাখে শান্তিনিকেতনে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন,
‘…নতুন যুগের বাণী এই যে,
তোমার অবলোকের আবরণ খোলো, হে মানব,
আপন উদার রূপ প্রকাশ কর। ‘
বাঙালির লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সমন্বিত অন্তরঙ্গ পরিচয় প্রকাশিত হয় বৈশাখের
মেলাকে ঘিরে। আজ থেকে প্রায় শতাধিক বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
ওই মেয়েটির হাসি,
এক পয়সায় কিনেছে ও
তালপাতার এক বাঁশি। ‘
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ইতিহাসে উৎসবরূপে পালিত হতে থাকে বাংলা নববর্ষ আর রচিত হতে থাকে অসংখ্য গল্প, কবিতা, গান— এই বৈশাখ আর নববর্ষকে নিয়ে। নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক অনন্যবৈশিষ্ট্য মিলে নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির এক প্রাণের উৎসব— প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা।
‘বর্ষশেষ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
‘ধাও গান, প্রাণ-ভরা ঝড়ের মতন ঊর্ধ্ববেগে
অনন্ত আকাশে।
উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা
বিপুল নিশ্বাসে।
হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে—
ছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত-আঘাতে
উড়ে হোক ক্ষয়
ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত
নিষ্ফল সঞ্চয়। ‘
একটি বছরের নিরাশা আর বেদনাকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতে চায়
বৈশাখের ঝড়ে দূরে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়। নববর্ষ মানুষকে দেয় আশা আর পরিতৃপ্তির
কামনা, মন বারবার বলে ওঠে—
‘ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ
ভাঙিয়া মধ্যাহ্ন তন্দ্রা জাগি উঠে বাহির ধারে।’
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে যোগ হয়েছে বৈশাখী পালনের নানান গান,
কবিতা ও গল্পের আখ্যান। সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও নানা পালাবদলের
মাত্রিকতায় নববর্ষে একটি মৌলিক ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। তাহলো নবজন্ম,
পুনরুজ্জীবনের ধারণা,
পুরনো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক
জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখতে পাই
আরেক নান্দনিক উচ্চারণ;
তাপসনিশ্বসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করে দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাখ
মায়ার কুজ্ঝটিকাজাল যাক দূরে যাক। ‘
বৈশাখ যুগে যুগে বাঙালির কাছে হাজির হয়েছে নতুন নতুন রূপে, বাঙালি বৈশাখকে নানা সময় নানভাবে গ্রহণ করেছে। নববর্ষে জাতিকে আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান করে যখন রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দেন -
‘নববর্ষে করিলাম পণ
সব স্বদেশের দীক্ষা। ‘
এভাবে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে, গানে এই কল্যাণ প্রার্থনাই বারবার ঝংকৃত। বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘নববর্ষ
উৎসব : রূপ-রূপান্তর’ প্রবন্ধে লিখেছেন—
“প্রান্তরের মধ্যে পুন্যনিকেতনে নববর্ষের প্রথম নির্মল আলোকের দ্বারা আমরা অভিষিক্ত হই”।
প্রসঙ্গত, ১৩৪৪ সালের পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনের চীনাভবনের উদ্বোধন হয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে শেষ নববর্ষ ছিলো ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে। সেদিন “সভ্যতার সংকট” পাঠ করা হয় এবং “ওই মহামানব আসে “ গানটি গাওয়া হয়। ১৯৪১ সালের ১৪ ই এপ্রিল প্রসঙ্গে রানী চন্দ লিখেছিলেন,
ঐ বৈশাখী ঝড় এলো এলো মহীয়ান সুন্দর।
পাংশু মলিন ভীত কাঁপে অম্বর,
চরাচর থরথর
ঘন বনকুন্তলা বসুমতী
সভয়ে করে প্রণতি,
পায়ে গিরি-নির্ঝর
ঝর ঝর।
ধূলি-গৈরিক নিশান দোলে
ঈশান-গগন-চুম্বী
ডম্বরু ঝল্লরী ঝনঝন বাজে
এলো ছন্দ বন্ধ-হারা
এলো মরু-সঞ্চয়
বিজয়ী বীরবর। ‘
১৯২৩ সালের ১৪ ই এপ্রিল ছিলো ১৩৩০ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ। সে সময় কাজী নজরুল ইসলাম রাজদ্রোহের অপরাধে
হুগলির জেলে বন্দী ছিলেন। পয়লা বৈশাখের দিন তিনি জেলের বন্দীদের প্রতি অত্যাচারের
প্রতিবাদে অনশন ঘোষনা করেন। নজরুলের সাথে
সেই অনশনে সামিল হন একুশ জন বন্দী। সারাদেশ যখন নতুন বছরকে বরণে মাতোয়ারা সেই সময়
কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি চলছিলো ইংরেজদের বর্বরোচিত আচরণ।
নজরুলের গানেও প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে পুরনোকে দূর করে নতুনের আবাহনী সুর উচ্চারিত। দীর্ঘদিন ধরে বাঙালির সৃষ্টিশীলতায় বৈশাখ এভাবেই উপস্থিত হয়েছে। কবিরা-গীতিকাররা বৈশাখকে দেখেছেন নতুনের অনন্ত উৎস হিসেবে। এভাবে দেখা যায়, বৈশাখ বা নববর্ষ বাঙালি কবি-শিল্পীদের কাছে যুগে যুগে যুগান্তরে নতুন নতুন ভাবের উৎস হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বাঙালির আত্মবিকাশের সঙ্গে, বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের উৎস ধারায় বৈশাখ বা নববর্ষ সব সময় জড়িয়ে ছিল, জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। ছন্দের গীতিতে কাজী কবি কালবৈশাখী দেখে গেয়ে উঠেন;
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর,
তোরা সব জয়ধ্বনি কর—
ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’
মোহিতলাল মজুমদারের লেখা “কালবৈশাখী”
কবিতার লাইনগুলো এ প্রসঙগে উল্লেখ
করা যায়-
“নববর্ষের পূর্ন বাসরে কালবৈশাখী আসে,
হোক্ সে ভীষণ ভীষণ ভয় ভুলে যাই অদ্ভুত উল্লাসে
ঝড় বিদ্যুৎ বজ্রের ধ্বনি
দুয়ার জানালা উঠে ঝন ঝনি,
আকাশ ভাঙিয়া পড়ে বুঝি, তবু প্রাণ ভরে আশ্বাসে।”
কিন্তু আজ আর নববর্ষ নতুন চেতনার আলোকবর্তিকা নিয়ে আসে না। উৎসব আছে,
প্রাণ নেই। এক সময় সব ধর্মের মানুষ বিভেদ ভুলে উৎসবের দিনে
একই সঙ্গে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন। সেখানে এখন ধর্ম আর রাজনীতির প্রচ্ছন্ন শাসন
মানুষের থেকে মানুষকে আলাদা করে দিচ্ছে। অথচ পয়লা বৈশাখ তো দ্বিধাহীন মহামিলনের
উৎসব। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, শামসুর রহমানরা এই দিনটিকে কেন্দ্র করে মিলনের গান গেয়েছেন,
অশুভকে দূর করে শুভর বার্তা।
আবছা তুমি ছিলে কবে?
নতুন বছর, নতুন ভোরাই, সুর হয়ে আজ বাজে।
পুরাতনে মলিন যেসব, ধূলায় মিশে যাক,
বর্ষ শেষের পয়লা দিনে, নতুন জীবন পাক।
কান্না ভেজা চোখের কোলে অল্প আশার আঁচ,
হালখাতা আর নতুন শপথ ভাসিয়ে নেবে রাত।
মাঝে মধ্যে আশা খুঁজি,
হাত বাড়িয়ে জলে,
ভালো থাকার স্বপ্ন ফুটুক, ভালোবাসার কোলে।
দেশ ভাঙছে,ঘর পুড়ছে বছর বছর পার,
প্রতিবছর সংযোজনে রক্ত ইতিহাস।
তবু জেনো পয়লা এলে পাখির কলোতানে,
ভালোবাসা, ভালো থাকা, নববর্ষ মানে।
যেমনভাবে সূয্যি ওঠে, যেমন নামে ছায়া,
তেমনভাবে ঘনায় বুকে নববর্ষের মায়া।।
শুভ নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি, হার্দিক শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জানাই।
কলমে - কমলেন্দু সূত্রধর
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল
তথ্যসূত্রঃ-
২ পূজা-পার্বণ - শ্রী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি
৩. পূজা-পার্বণের উৎস কথা - পল্লব দেনগপ্ত
৪. বর্তমানে প্রচলিত "বঙ্গাব্দ" প্রচলনের ইতিহাস কী?- Quora বাংলা
৫. কবিতা ও গানে বৈশাখ - ABIRVAB NEWS 24
৬. বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ ও নববর্ষ - হাসান ইকবাল
৭. বিবর্তনের ধারায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন - এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল
৮. বঙ্গাব্দের উৎস - ডঃ তমাল দাশগুপ্ত
৯. কখনও শরৎ, কখনও অগ্রহায়ণ বার বার বদলেছে বাঙালির নববর্ষ - আনন্দবাজার পত্রিকা
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন