এক আত্মকথাঃ না-লেখা পুলিশ ডাইরি

 


 

বই – না-লেখা পুলিশ ডাইরি

লেখক – সুব্রত বসু।

প্রকাশক – কিশলয়

প্রকাশকাল – জানুয়ারি, ২০২১

পৃষ্ঠা – ১৩৮

প্রচ্ছদ – সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়

 

ইদানিং কালের গোয়েন্দা কাহিনী -  রহস্য রোমাঞ্চ – তন্ত্র – মন্ত্র – অলৌকিক কাহিনীর ভিড়ে কোনো বইয়ের নামের সাথে পুলিশ শব্দ শুনলেই মনে হয় এটিও আর পাঁচটি তদন্ত কাহিনীই হয়ত হবে। কিন্তু সুব্রত বসুর লেখা “ না লেখা পুলিশ ডাইরি” বইটি এই সমস্ত বইয়ের ভিড়ে এক ছন্দপতন। পঞ্চানন ঘোষাল, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সুপ্রতিম সরকারের লেখা বই সমুহের কথাও মনে আসতে পারে। যে হয়ত পুলিশের কর্ম কাণ্ডের সত্য ঘটনার ধারা বিবরণী লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু না তাও নয়। তাহলে এই বইয়ের বিষয় বস্তু কি?

এটি কি কল্পকাহিনী? এটি কি রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর কোনো গোয়েন্দা কাহিনী? নাকি এটি শুধুই আত্মজীবনী?এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই এই বই পড়া শুরু। পড়তে পড়তে বুঝলাম এক অনন্য স্বাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার বই হাতে এসেছে। বইয়ের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত। ডাইরি লেখা বা রোজনামচা বলতে আমরা যা বুঝি এই বই প্রকৃতপক্ষে তাই।অর্থাৎ আত্মকথা।

পুলিশ শব্দটার সঙ্গে সবারই পরিচয় ঘটে ছোটবেলা থেকে কিন্তু তা এক ভয়ের বাতাবরণের মধ্যে দিয়ে । ছোটবেলায় প্রায় সব শিশুকেই ভয় দেখানো হয় - দুষ্টুমি করলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে , অন্ধকার জেলে ভরে দেবে , খুব মারবে, খেতে দেবেনা, বাবা – মাকে দেখতে দেবে না, আর বাড়ি ফেরা যাবেনা, ইত্যাদি ইত্যাদি ।এই সমস্ত ভয়ানক কল্পনার ঘূর্ণিপাকে আমরা ভুলে যাই যে পুলিশ আমাদের মতো রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ। তাঁদের আপাত কঠোরতার আড়ালে যে একটা কোমল মন থাকে তা আমরা মনে রাখি না । সুব্রত বসুর এই বই আমাদের ভাবতে শেখায় - পুলিশের জীবনের সেই লুকিয়ে থাকা অন্য আরেকটি দিক । দেখি রক্ষক নিজেও কখনো কখনো সমাজের নিয়মের কাছে কেমন অসহায় ভাবে মাথা নত করতে বাধ্য হ

লেখক সুব্রত বসু  অবসরপ্রাপ্ত ডি এস পি (ডেপুটি সুপারিটেন্ডেন্ট অফ পুলিশ)। কর্মজীবনে প্রবেশের পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রশিক্ষন পর্বের কঠিন অনুশীলন ও নিয়মানুবর্তিতা এবং এই সমস্ত কিছুর মধ্যেও যে ফাঁক ফোঁকর দিয়ে নিয়ম ভঙ্গ করা যায় তার বিস্তারিত বর্ণনা অত্যন্ত সুললিত ও হাস্যরস মিশিয়ে পেশ করেছেন। প্রশিক্ষনের বিভিন্ন ধাপের কঠোর পরীক্ষা প্রণালীও যে কি ভাবে উত্তীর্ণ হওয়া যায় তাও বলেছেন।  


কর্মজীবনের প্রথমেই লেখকের পোস্টিং হয়েছিল নদিয়ার করিমপুর থানায় ।সেই অল্প বয়সেই তিনি অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন যে , একটা খাল মানুষের জীবনকে কেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারে । কারণ এই খাল এমনি পার হওয়া যায় না । তা পার হতে বৈধ কাগজপত্র লাগে । খালের দুইপারের মানুষের চেহারা এক ,জামাকাপড় এক , ভাষাও এক , কিন্তু আইনের চোখে তারা দুটো পৃথক দেশের মানুষ । ইচ্ছে করলেই তারা একে অপরের সঙ্গে মিলতে পারে না । খুব সুন্দরভাবে লেখক এইসব মানুষের জীবিকা তথা অসামাজিক জীবিকা নিয়ে খুব বিস্তারিতভাবে কোনও কিছু না লুকিয়ে আলোচনা করেছেন । এই সমস্ত অসামাজিক জীবিকাধারী মানুষদের আইনের শাসনে আনা যে কত কঠিন , তাও তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। এবং অনেক ক্ষেত্রে যে পুলিশের ক্ষমতা এই সমস্ত অসামাজিক অপরাধীদের কাছে হাড় স্বীকার করতে বাধ্য হয়, তাও অকপটে লিখেছেন।সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাদের ধারণা হল যে পুলিশ অদৃশ্য ক্ষমতার অধিকারী - তাঁদের ক্ষমতার কোনো সীমা নেই, তাঁরা ইচ্ছা করলে এমন কোনও কাজ নেই যা করতে পারেন না । কিন্তু এই বইয়ের বহু ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি বাস্তব তা নয় । পরিবার- পরিজন থেকে বছরের পর বছর দূরে থাকা তাঁদের জীবন খুবই বৈচিত্র্যহীন । ফলত নৈতিকতা ও অনৈতিকতার দোলাচলে তারা দুলতে থাকে । অনেক সময় পানসে জীবনে বৈচিত্রের স্বাদ পেতে নৈতিকতা ও রুচিবোধকেও বিসর্জন দেন কেউ কেউ।

 
যদিও লেখক বলেছেন যে , এটি তাঁর কর্মজীবনের ডাইরি কিন্তু বারেবারেই লেখার মধ্যে তাঁর সাহিত্যিক সত্ত্বা উঁকি দিয়েছে । বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কখনো তিনি 'সধবার একাদশী' আবার কখনো রবীন্দ্রনাথের 'চিরকুমার-সভা'র প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন । কাশ্মীরি মেয়ে শান্তি ও তার স্বামী রাজিন্দার মন্ডল কিভাবে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল এবং তাঁদের জীবনকাহিনী কি ভয়ংকর পরিণতি পেয়েছিল তার বর্ণনা আমাদের চোখে জল এনে দেয় । হাজিবুল কাজীর মতো অলৌকিক পুরুষ আমরা গল্প-উপন্যাসে অনেক পড়েছি কিন্তু বাস্তবেও যে এমন কেউ আছে , যে রসগোল্লা চাইলে কয়েক মিনিটের মধ্যে মন্ত্রবলে রসগোল্লা এনে দিতে পারে , তা আমরা কি কেউ জানতাম ?অন্তত প্রত্যক্ষ করেছেন এমন ঘটনা সে দাবী কাউকে করতে সচরাচর শোনা যায় না। লেখক এই বিরল ঘটনার সাক্ষী থেকে নিজেই হতবাক হবার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
লেখক তাঁর নানান ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা অত্যন্ত সাবলীল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । এইভাবে তিনি আমাদের সামনে এঁকে চলেছেন একের পর এক  গ্রামীণ জীবনের সরলতা থেকে শুরু করে  ঘৃণ্যতা-বর্বরতা-অসহায় নগ্নতাকেওসমস্ত বর্ণনার এত সুন্দর ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যে পাঠকও নিজের কল্পনায় পৌঁছে যান সেই সমস্ত ঘটনা প্রবাহের মধ্যে


তবে বইয়ের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা অনুভব করতে পারি , এই লেখা শুধু তাঁর কর্মজীবনের দলিল নয় । এর মধ্যে রয়েছে তাঁর কর্মজীবনের প্রতিদিনের পাওয়া-না পাওয়া , চাওয়া-না চাওয়ার দীর্ঘশ্বাস ও অপারগতা, সফলতা - ব্যর্থতাও । যা তাঁর অবসর-জীবনকেও ব্যথিত করে তুলে তাকে অসুস্থ করে তুলেছেসাধারণত আত্মকথা সর্ব সমক্ষে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিজের ভুল – ত্রুটি – ব্যর্থতা – লজ্জার কথা লুকিয়ে রাখা হয়।লেখক এক্ষেত্রে অসম্ভব ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রেখেছেন। স্থানীয় নির্বাচনের সময় ভোটকর্মীর বাড়ীতে ডাকাতি ও হত্যার ঘটনায় লজ্জায় অপরাধ বোধে নির্বাক হয়ে যেতে দেখে বিস্ময় জেগেছে।নিজের হাড় স্বীকার করেছেন হারিয়ে যাওয়া এক বালিকাকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেন নি বলে। অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ঘটনাচক্রে উদ্ভিন্নযৌবনা সুন্দরী নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন কিন্তু শুধুমাত্র সাহসী হতে পারেন নি বলে ঘটনা অন্যখাতে গড়ায়নি। নিজেকে সাধু বলে প্রচার করার পরিবর্তে নিজের মানসিক দুর্বলতার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি।পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে যে বারংবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতে বাধ্য হয়েছে তাও ব্যক্ত করেছেন। এই বই অতীত সময়ের এক জীবন্ত দলিল। পুলিশের চাকরি জীবনের সমাপ্তিতে অবসর জীবনেও যে পুলিশ কর্মীরা সেই অতীত কর্মকাণ্ড – স্মৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন না।ব্যাথা জাগে মনে যখন বইয়ের শেষের পর্বে জানান  সেই ফেলে আসা অজস্র তিক্ত – ভয়ংকর – অসফল স্মৃতির থেকে মুক্তি লাভের জন্যতাঁরা  এক অনন্ত লড়াই করে যান আজীবন। ক্ষত বিক্ষত দেহে ও মনে তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন পরাজয়ের স্মৃতি শয়নে – সপনে – জাগরণে রোমন্থন করতে থাকেন। যার রেশ ধরে রেখে রচনা করা যায় এক অভিনব আত্মকথন, যেমন লেখক সুব্রত বসু করেছেন তাঁর এই বইয়ের মাধ্যমে।রেশ রয়ে যায় পাঠকের মধ্যেও।    

 

কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় 


চিত্র ঃ সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন