“উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তবে, জগন্নাথের প্রসঙ্গে আসার আগে পুরী সম্বন্ধে দু-একটা কথা বলা জরুরী। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, বর্তমানের পুরী অঞ্চল এবং শাস্ত্রোক্ত পুরুষোত্তম পীঠ কি একই? বিষ্ণুপুরাণ ও শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণে সাধু কড়ুর উপাখ্যান পাওয়া যায়, যিনি অপ্সরাদের মোহে পড়ে কিছুকাল সম্ভোগের জীবনযাপন করার ফলে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে সাগরতটবর্তী পুরুষোত্তমক্ষেত্রে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। ইতিহাসের চোখে দেখতে গেলে, প্রাচীন নাট্যকার মুরারী রচিত গ্রন্থ 'অনর্ঘরাঘব'-এই প্রথম নিশ্চিতভাবে বর্ণনা পাই সমুদ্রতীরে অবস্থিত পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের এবং এবং সেখানকার বিখ্যাত রথযাত্রারও। ইতিহাসের চোখে দেখতে গেলে, প্রাচীন নাট্যকার মুরারী রচিত গ্রন্থ 'অনর্ঘরাঘব'- তেই প্রথম নিশ্চিতভাবে বর্ণনা পাই সমুদ্রতীরে অবস্থিত পুরুষোত্তমক্ষেত্রের এবং রথযাত্রাও। ঐতিহাসিকরা মুরারীকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দের সামান্য আগের বা পরের মানুষ বলে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ, সাগরতটে অবস্থান যে পুরুষোত্তমের, যাঁর রথযাত্রায় লক্ষ লক্ষ লোকের হয় সমাবেশ, তিনিই যে আজকের এই জগন্নাথই, সে বিষয়ে কোনো পুরাবিদের মনেই আজ আর কোনো সন্দেহ নেই।
আরও একটি ঐতিহাসিক প্রমাণের কথা উল্লেখ করি। মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলার মাইহারে একটি সরস্বতী মন্দিরে একটি শিলালিপি আছে। পুরাতত্ত্ববিদ দীনেশচন্দ্র সরকার এবং ভি. এস. সুব্রহ্মণ্যম-এর মতে, পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত ওই মন্দির-লিপিটি দশম শতকের মাঝামাঝি সময়ে লাগানো হয়েছিল। তাতে দামোদর নামে জনৈক ব্রাহ্মণপুত্রের নীলাচল-ভ্রমণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। উক্ত কাহিনী মতে, দামোদর পূর্বজন্মে ছিল স্বর্গে দেবী সরস্বতীর পুত্র। সে দেবগুরু বৃহস্পতিকে এক তর্কযুদ্ধে পরাভূত করলে বৃহস্পতির অভিশাপে তাকে মর্ত্যে জন্ম নিতে হয়। সরস্বতীর কাকুতি-মিনতি তুচ্ছ করতে না পেরে অবশেষে বৃহস্পতি বলেন,
“তোমার পুত্রকে দীর্ঘকাল মর্ত্যে থাকতে হবে না। যৌবনের প্রথমেই সে উৎকল দেশে যাবে পুরুষোত্তম দর্শনে। সেখানে গিয়ে পুণ্যার্থী হয়ে যখন সমুদ্রে স্নান করতে যাবে, তখনই সে জলে ডুবে মৃত্যুমুখে পতিত হবে এবং তারপরেই আবার ফিরে আসবে স্বর্গে— মাতা সরস্বতীর সান্নিধ্যে।”
মর্ত্যে তরুণ দামোদরের পিতা ছিলেন দেবধর। তিনি পুত্রের অকালমৃত্যুতে শোকাতুর হয়ে পুত্রের স্মৃতিরক্ষায় মাইহারের ওই সরস্বতী মন্দিরটি নির্মাণ করান। সরকার এবং সুব্রহ্মণ্যম উভয়েই এই লিপি সম্বন্ধে বলেছেন,
“The reference to Damodar's pilgrimage to Puri is very interesting... It is now clear from the present record that the God (Purushottama) was enjoying the same celebrity as early as the middle of the tenth century and probably sometime earlier.” (Epigraphia Indica, Volume XXXV)
ওঁদের অনুমান অনুযায়ী দশম শতাব্দীর মাঝামাঝির কিছু পূর্বেও উৎকলের সমুদ্রতটস্থ পুরুষোত্তম তীর্থের অবস্থিতি নিশ্চয় ছিল। শ্রী জি. সি. ত্রিপাঠী তাঁর ‘On the concept of Purushottama in the Agams' প্রবন্ধে বলেছেন,
"Well, if Purushottama was so famous in such a distant region as Maihar in the middle of tenth century that the people under took long and perilous journeys to see Him, He must have been there for quite some time.”
পুরী ধামের জগন্নাথ দেব
অবশ্য, ‘জগন্নাথ’ নামটির উল্লেখ খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর প্রথম ভাগ সময় অবধি পুরাণে বা ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায়না। তার মানে, আজকে যিনি জগন্নাথ, ভক্তদের হৃদয়ে তিনিই তখনও বিরাজ করেছিলেন পুরুষোত্তমরূপে, জগন্নাথরূপে নয়। নবম শতাব্দী নাগাদ আদি শংকরাচার্য যখন পুরীতে এসেছিলেন, তখনও পুরুষোত্তম জগন্নাথরূপে পরিচিতি পাননি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর কিছু আগে অথবা পরে লিখিত স্কন্দপুরাণীয় ‘পুরুষোত্তম মাহাত্ম্য’-তে একজন দেবতাকেই আমরা পুরুষোত্তম রূপে বর্ণিত হতে দেখেছি। পরে সেই দেবতাকেই 'জগন্নাথ' নামে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পুরুষোত্তমের এই জগন্নাথ নামটি প্রথম রেখেছিলেন কারা? প্রশ্নটা এ-জন্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু জগন্নাথ ছিলেন নানা সম্প্রদায়ের পূজ্য । বৈদিক সবক'টি সম্প্রদায় তো বটেই, বৈদিক কর্মকাণ্ডের ঘোর বিরোধী বৌদ্ধ, জৈন এবং আদিবাসীরাও ভক্তিঅর্ঘ্য নিবেদন করেন পুরুষোত্তমের পাদপদ্মে। তাহলে কে করলেন দেবতার এহেন নামকরণ?
ধারণা
করা হয়, অশোকের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটলে, দেবতা পুরুষোত্তম বৌদ্ধদের
মধ্যেও জনপ্রিয় ও পূজ্য হয়ে ওঠেন। আবার খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে মহামতি খারবেলের রাজত্বকালে উৎকলে
ছড়িয়ে পড়া জৈনধর্মের প্রভাবও পড়ে এই মহাতীর্থে। নেই। ভুবনেশ্বরের অদূরে
উদয়গিরি পাহাড়ের চূড়ায় যে হস্তীগুফা আছে,
সেখানেই খরবেলার একটি প্রস্তর লিপিতে জগন্নাথ এবং তার
রত্নবেদীকে 'জিন্-আসন' বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে,
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম মূলতঃ নাস্তিক ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও পুরীর
মন্দিরে তাদের প্রবেশে কোনো বাধা নেই।
শিবসহস্রনামস্তোত্রে সম্ভবত শিবকে প্রথম জগতাধিপতি জগন্নাথ
বলা হয়। তাই শৈবদের কাছেও তিনি পরমপূজ্য। পুরীতে অবস্থিত সতীপীঠে পূজ্যা
বিমলাদেবীর ভৈরব হলেন স্বয়ং জগন্নাথ। সতীপীঠের ভৈরব শিবই হন। এর থেকেই বোঝা যায়
যে জগন্নাথদেবের সঙ্গে শাক্ত ও শৈবদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই।
ওড়িয়া ভাষায় লেখা 'দার্ঢ্যতা-ভক্তি' নামক গ্রন্থে একটি কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে। কর্ণাট দেশের কানিয়ারি গ্রামে গণপতি ভট্ট নামের এক গাণপত্য ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তিনি স্নানযাত্রার দিন পুরীতে গিয়ে জগন্নাথ বা দারুব্রহ্মকে গণপতি মূর্তিতে দেখতে না পেয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলে উঠেছিলেন,
“বহুদূর থেকে বহু কষ্ট স্বীকার করে আসা এই গাণপত্য
ব্রাহ্মণকে গণেশ মূর্তিতে দর্শন দিলেন না দারুব্রহ্ম! তাহলে আমি ধরেই নিলাম,
নীলাচলে ব্রহ্ম নেই।”
এই কথা শোনার পরেই নাকি দারুব্রহ্ম গণপতি মূর্তিতে আবির্ভূত
হয়েছিলেন সেই গাণপত্য ব্রাহ্মণের সামনে। এখনও প্রতিবছর সেই ঘটনার ঐতিহ্যকে অনুসরণ
করে স্নানযাত্রার সন্ধ্যায় ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু জগবন্ধুকে গণেশ বেশে সাজানো হয়।
মহা আড়ম্বরে। এই বর্ণনার মধ্যে অতিরঞ্জন কিছু থাকতে পারে। কিন্তু ওই কাহিনি থেকে
এটা বোঝা যাচ্ছে যে জগন্নাথকে গাণপত্য-সম্প্রদায়ের লোকেরা গণপতিরূপে মেনে
নিয়েছেন।
শাক্ত লোকাচার হিসাবে জগন্নাথকে নোলক পরিয়ে রাখা হয়। তাঁর
অঙ্গে পরানো হয় শাড়ি। রামনবমী আর জন্মাষ্টমীর আগের দিন জগন্নাথকে নিবেদন করা হয়
জেউড়-ভোগ। জেউড় ফল কিন্তু উৎকলে কেবলমাত্র আসন্নপ্রসবা নারীকে খাওয়ানো হয়,
যাতে তার সন্তান প্রসব ত্বরান্বিত হয়। জগন্নাথের পুজোর
সময় যে দশ-পদাংশের এবং আঠারো পদাংশের গোপালমন্ত্র ব্যবহার করা হয়,
তাতে জগন্নাথকে দুর্গা বলা হয়ে থাকে। ‘দুর্গা
অধিষ্ঠাত্রী দেবী’ এই কথাটি উচ্চারিত হয় জগন্নাথের সব পুজোতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পুরী শক্তিপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলা
উচ্ছিষ্ট-চণ্ডালিনী রূপেও পূজিতা হন। আমরা জানি শিবের
নির্মাল্য চণ্ডেশ্বর ধারণ করেন। বিষ্ণু নির্মাল্য ধারণ করেন বিশ্বকসেন। শক্তির
নির্মাল্য একমাত্র শক্তিই ধারণ করেন উচ্ছিষ্ট-চণ্ডালিনী রূপে। অতএব
উচ্ছিষ্ট-চণ্ডালিনী রূপী বিমলা'র সামনে জগন্নাথের নির্মাল্য দেখানো থেকেই জগন্নাথকে নিয়ে
শাক্ত ভাবনার স্বরূপ বোঝা যায়। এমনকি, শ্রীমন্দিরের সিংহাসনে বলভদ্র, সুভদ্রা ও জগন্নাথ তিনজনই যথাক্রমে তারাযন্ত্র,
ভুবনেশ্বরী যন্ত্র ও কালীযন্ত্রে অধিষ্ঠান করেন।
মহানির্বাণ তন্ত্র
মতে—
“উগ্রতারা শূলপাণি সুভদ্রা ভুবনেশ্বরী।
নীলাদ্রৌ তু সাক্ষাৎ জগন্নাথ দক্ষিণাকালিকা।।"
অর্থাৎ শূলপাণি সদাশিবস্বরূপ বলভদ্র সাক্ষাৎ দেবী উগ্রতারা। সুভদ্ধা মায়াবীজাধিষ্ঠাত্রী দেবী ভুবনেশ্বরী। নীলাদ্রিক্ষেত্রে অবস্থিত জগন্নাথ স্বয়ং পরব্রহ্মস্বরূপ নির্গুণ শুণারূপা দক্ষিণাকালী।
অর্থাৎ, জগন্নাথকে কোনো নির্দিষ্ট গোত্রের দেবতা বলা যায় না।
তিনি একাধারে মহাবিষ্ণু,
যিনি গর্ভগৃহের রত্নবেদিতে বসে আছেন দক্ষিণাকালিকা যন্ত্রের
ওপরে, কামবীজে পূজিত হচ্ছেন,
আবার ভৈরব মন্ত্রেও পূজিত হচ্ছেন। সাধারণক্ষেত্রে
মহালক্ষ্মী তাঁর শক্তি হলেও, বিশেষ মতবাদে বিমলারূপিনী দুর্গা তাঁর শক্তি। তাই জগন্নাথ
বৈষ্ণব, শাক্ত এবং শৈব দেবতাদের সংমিশ্রিত রূপ। আশ্বিনের কৃষ্ণা
অষ্টমী থেকে শুক্লা নবমী পর্যন্ত ১৬ দিন ব্যাপী দেবী বিমলার সঙ্গে তাঁর ভৈরব
জগন্নাথ একত্রে প্রত্যক্ষ পুজো পান। সপ্তমী,
মহাষ্টমী এবং মহানবমীতে ছাগ ও মেষ বলি হয়। তারই সঙ্গে
জগন্নাথ স্নানবেদিতে মহাগণপতি, শয়নে মহাবিষ্ণু, গমনে মার্তণ্ড ভৈরবরূপী সূর্য,
ভোজনে মহাভৈরবরূপে রুদ্র হিসেবে অধিষ্ঠান করছেন। তাঁর গলায় তুলসীর মালা, আবার বিখ্যাত তান্ত্রিক পঞ্চ 'ম'-কারের (মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুন) অনুকল্পে পূজিত হচ্ছেন। শুধু মদ্যের
পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে কচি ডাবের জল, মৎস্যের পরিবর্তে হিং দেওয়া শাক,
মাংসের পরিবর্তে আদা এবং মৈথুনের পরিবর্তে দেবদাসী নৃত্য।
প্রচলিত কাহিনিতে শবর সর্দার বিশ্ববাসু যে মূর্তিটির পুজো করতেন, তাকে বিভিন্ন গ্রন্থে নীলমাধব বলা হয়েছে। আদিবাসীরা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দেবতা হিসেবে পুজো করত গাছ অথবা পাথরকে। গাছ অর্থাৎ দারু। আজ যে বিশ্ববন্দিত দেবমূর্তি কোটি কোটি মানুষের কাছে জগন্নাথরূপে পরিচিত, তা ছিল আদিবাসী এক শবর গোষ্ঠীর আরাধ্য দারু-দেবতা। সেই দেবতাই নানাকালে নানা সম্প্রদায়ের হাতে পূজিত হলেন কখনও দারুব্রহ্ম, কখনও নীলমাধব, কখনও পুরুষোত্তম, আবার কখনও জগবন্ধু রূপে। প্রথমে এই দেবমূর্তি একটিই ছিল প্রাচীনতম পুরী মন্দিরে। সম্ভবত মালবরাজ প্রথম ইন্দ্রদ্যুম্নই সেটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী নাগাদ রাজা জনমেজয়ের পুত্র যযাতিকেশরী ভগ্নদশাগ্রস্ত প্রাচীন পুরুষোত্তম মন্দিরের সংস্কারসাধন করেছিলেন। পুরীর সেই মন্দিরে নতুনভাবে পুরুষোত্তম ও শক্তিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলেই তিনি ইতিহাসে দ্বিতীয় ইন্দ্রদুম্ন্য নামে খ্যাত।
এই দুর্ধর্ষ শবর জাতির কথা ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও পাওয়া যায়। উৎকল এবং দক্ষিণ কোশলে বহু পূর্বকাল থেকেই শবররা অত্যন্ত প্রবল ছিল। মনে করা হয় যে বৈদিক আর্যরাও পরে শবরদের প্রভাবে দারু আর প্রস্তর পুজো আরম্ভ করেছিলেন। জগন্নাথের মতোই, দেবী সুভদ্রাও সেই রকমই দারুস্তম্ভ মুর্তির স্তম্ভেশ্বরী বা খাম্বেশ্বরীর রূপান্তর বলে পণ্ডিতগণ মনে করে থাকেন। ওড়িশারই গঞ্জামের আস্কাতে এখনও এই খাম্বেশ্বরী মূর্তি আছে। বর্তমানে ইনি হিন্দুপূজিতা শাক্তদেবী হলেও, অতীতে একদিন তিনিই ছিলেন আদিবাসীদের আরাধ্য দেবতা। সুভদ্রা নামটি কিন্তু অনেক পরে দেওয়া হয়েছে। বস্তুত, খাম্বেশ্বরী এবং জগন্নাথ পুরীতে এসেছিলেন একই আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে। জগন্নাথ এসেছিলেন আগে, সুভদ্রা পরে। প্রাচীন ইতিহাসে আমরা বার বার দেখতে পাচ্ছি— এঁকেই বলা হয়েছে লক্ষ্মী, বলা হয়েছে কমলা। অর্থাৎ পুরুষোত্তমের শক্তি।
আগেই বলা হয়েছে যে, দেবী সুভদ্রা ভুবনেশ্বরী যন্ত্রে অধিষ্ঠিতা। তাই তাঁর পুজাও ভুবনেশ্বরী মন্ত্রেই করা হয়ে থাকে। মন্ত্র ছাড়াও সুভদ্রার পুজো-প্রকরণে আমরা এমন অনেক কিছুই দেখতে পাই, যা থেকে এই দেবীমূর্তিকে একসময়ে শাক্তদের পূজিতা প্রতিমা বলে চিহ্নিত করা চলে। কিংবদন্তি অনুসারে শোনপুর অঞ্চল থেকে মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা জগন্নাথের দারুমূর্তি উদ্ধার করা হয়েছিল। নবনির্মিত মন্দিরে প্রথম তাঁর নবকলেবর হয়। উৎসবান্তে যযাতি দেবতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনিই সর্বপ্রথম শাক্তপূজিকা খাম্বেশ্বরী দেবীকে পরম শ্রদ্ধাভরে বরণ করে নিয়ে আসেন নীলাচলে পুরুষোত্তমের লীলাসঙ্গিনী শক্তিরূপে। বংশগতভাবে যযাতি ছিলেন শৈব। স্বাভাবিকভাবেই শাক্তদের দেবীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন যযাতিকেশরী। শিবের শক্তি তো দুর্গা তথা কালীই। ইতিমধ্যে খাম্বেশ্বরী বা স্তম্ভেশ্বরী-র কাষ্ঠনির্মিত প্রতিমা কোথাও দুর্গা, কোথাও বা কালীমন্ত্রে পুজিতা হচ্ছিলেন। এখনও পুরীর মন্দিরে সুভদ্রাদেবীর পুজো ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে হওয়ার কারণ এটিই। তাছাড়া, অকস্মাৎ শক্তিরূপী মাতৃমূর্তিকে পুরীমন্দিরের রত্নবেদিতে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে আরও একটি কারণ বোঝা যায়।
ওড়িশার রত্নগিরি এবং ললিতাগিরিতে পাওয়া বৌদ্ধ নিদর্শন থেকে বোঝা যায় যে খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত সমস্ত উৎকল জুড়েই ছিল বজ্রযানতন্ত্রের দুর্দান্তপ্রতাপ। সেই তন্ত্রে নারীপ্রতিমা বা শক্তি পুজো ছিল একটি প্রধান অঙ্গ। দশম শতাব্দীর প্রথমভাগে মূলত এই প্রভাব তথা পরম্পরার প্রতি সম্মানার্থে যযাতিকেশরী সুভদ্রাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন— এমনটা মনে করা স্বাভাবিক। গুপ্তযুগের শেষদিক থেকেই হিন্দু এবং বৌদ্ধ সমস্ত পুরুষ দেবতারই সঙ্গে একটি করে শক্তিপ্রতিমা যুক্ত করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল ভারতজুড়ে। সুতরাং, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে যযাতিকেশরী যে পুরুষোত্তম-বিষ্ণুর পাশে তার শক্তি হিসাবে শাক্তপূজিত দেবী খাম্বেশ্বরীকে এনে বসালেন— এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সেই শাক্ত মাতৃমূর্তিকে পুরুষোত্তমের শক্তি করা হল বলেই সে মূর্তির নাম প্রথমে দেওয়া হয়েছিল লক্ষ্মী বা কমলা। তাঁর বর্ণনা আমরা পুরীর মন্দির নিয়ে লেখা অনেক প্রাচীন গ্রন্থেই পাওয়া যায়।
মহারাজ অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গা ১১৩৫ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমানের সুবিশাল জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণকার্য
শুরু করেছিলেন। তখন তিনি মন্দিরে একজোড়া মূর্তিই,
অর্থাৎ কৃষ্ণ-জগন্নাথ এবং লক্ষ্মী কমলারই প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন— তার প্রমাণ আমরা নানাভাবেই পাই। তাহলে বলরাম?
পুরীর মন্দিরে বলরামের প্রবেশ ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে।
পঞ্চরাত্র দর্শনের 'ব্যূহ' তত্ত্বে বাসুদেবকে সর্বশক্তিমান ভগবান বলা হয়েছে। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী বাসুদেবই তিনটি পৃথক রূপের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। রূপগুলি হল সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন এবং অনিরুদ্ধ। সংকর্ষণের মধ্যে জ্ঞান ও বলের প্রকাশ, প্রদ্যুম্নের মধ্যে ঐশ্বর্যের ও বীর্যের, আর অনিরুদ্ধের মধ্যে শক্তির এবং তেজের। সংকর্ষণের (সম + কর্ষ) কাজ হল সৃষ্টিকে ধ্বংস করা। তিনি নিজের অপ্রতিরোধ্য বল-এর(বলরাম, বলভদ্র) সাহায্যে সৃষ্টিকে ছিনিয়ে নেন। প্রলয় বা ধ্বংসের দেবতা বলেই শিবেরও আর এক নাম সংকর্ষণ। বলরাম বা বলভদ্রকেও সংকর্ষণ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে তাঁকে শেষনাগ বা অনন্তদেব-রূপেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
'মার্কণ্ডেয় পুরাণ' অনুযায়ী, কল্পান্তে সমস্ত জগৎ একসমুদ্রীকৃত হলে বিষ্ণু অনন্তশয্যায় আশ্রয় করে যোগনিদ্রা অবলম্বন করেন। তখন ব্রহ্মার সবে উৎপত্তি ঘটেছে। যোগনিদ্রা দেবী বিষ্ণুর নয়নে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছেন। সৃষ্টির কাজ সবে শুরু হতে চলেছে। অন্য কোনো দেবতা তখন উপস্থিত নন। কিন্তু শেষনাগ রয়েছেন! তাঁর অনন্ত নামের সার্থকতা এখানেই। পূর্বকল্প ধ্বংসের সময়ও যাঁর অন্ত হয় না, তিনিই তো অনন্ত। স্পত অধোভুবনের সর্বনিম্ন স্তর পাতালে(মতান্তরে রসাতল) তাঁর নিবাস, এখানে থেকেই তিনি পৃথিবীকে ধারণ করে থাকেন। আবার, স্কন্দপুরাণ মতে, নরকসমূহের অধোভাগে কালাগ্নির অবস্থান। তার নীচে হট্টক। তারও নীচে অনন্তদেব বিরাজমান। তাঁর মস্তকে সমগ্র বিশ্ব ক্ষুদ্র একটি সর্ষে দানার মতো রয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থে শেষনাগকে বিষ্ণুর অংশস্বরূপ- তামসী তনু বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, পাতালসমূহের অধোভাগে বিষ্ণুর শেষ নামে এক তামসী তনু আছেন। দৈত্য-দানবেরা তাঁর গুণ বর্ণন করতে অশক্ত। দেবর্ষিপূজিত সেই দেবকে সিদ্ধগণ অনন্ত বলে থাকেন। তিনি সহস্রশিরা। তাঁর মস্তকে স্বস্তিকচিহ্ন অমলভূষণ রূপে প্রকাশিত। জগতের হিতের জন্য তিনি সহস্রফণা মণি দ্বারা দিক-সকল সমুজ্জ্বল করে সমস্ত অসুরকে নিবীর্য করছেন।
অনন্তনাগ মদঘূর্ণিতনেত্র। তিনি কুণ্ডল ও কিরীটে শোভিত এবং মালাধারী। অগ্নিযুক্ত শ্বেতপর্বতের মতো রূপবান এই দেবতা। নীলবসনধারী, মদোৎসিত এবং শ্বেতহারে আভূষিত হয়ে কৃষ্ণমেঘ ও গঙ্গাপ্রবাহযুক্ত কৈলাস পর্বতের ন্যায় অবস্থান করেন অনন্তনাগ। স্বয়ং লক্ষ্মী ও বারুণী (সুরার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ও বরুণের কন্যা) তাঁর উপাসনা করেন। ইনি তরুণ সূর্যকিরণবর্ণের ন্যায় অক্ষমালা ধারণ করেন এবং শ্বেতপর্বতের শিরোদেশে বাস করে থাকেন। তিনি যখন শয়ন বা উপবেশন করেন তখন জটাদ্বারা অতীব ভীষণ ও দ্যুতিমান হন। এই দ্যুতিমান শেষনাগই সর্পকূলের অধিপতি। তাঁর বৈষ্ণব সর্পশরীর দ্বারাই পৃথিবীর সীমা নির্দিষ্ট। তাই হয়তো তাঁর অপর নাম 'শেষ' নাগ।
অবশ্য, অনন্তদেবের রূপকল্প কেবলমাত্র সহস্রফণাধারী এক সর্প অব্ধিই সীমাবদ্ধ নয়। বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ অনুযায়ী তাঁর দেহবৰ্ণ চন্দ্রের ন্যায় ধবল, নীলাম্বর পরিহিত চতুর্ভুজ দেহ, রত্নতুল্য উজ্জ্বল ফণিশোভিত মস্তক, ঠিক মাঝখানের ফণিতে অবস্থা করেন ভূদেবী। অনন্তদেবের ডান হাতে থাকে গদা এবং পানপাত্র, বাঁ হাতে থাকে লাঙল ও শঙ্খ। অগ্নিপুরাণ মতে, তিনি চতুর্ভুজ, চারটি হাতে যথাক্রমে লাঙল, মুষল, গদা ও পদ্ম রয়েছে। হরিবংশে নাগরাজ অনন্ত একার্ণবেশ্বর নামেও পরিচিত। তিনি লাঙল ও মুষলধারী, নীলবস্ত্র পরিহিত, এককুণ্ডলশোভিত। তিনি স্বদেহ কুণ্ডলিত শুভ্র আসনে আসীন রয়েছেন, তার মস্তকের মুকুট বামদিকে ঈষৎ বক্র। স্বর্ণময়ী মালায় তাঁর বক্ষস্হল দেদীপ্যমান। তাঁর বর্ণ জলশূন্য মেঘের ন্যায় শুভ্র ও শরীর সমুজ্জ্বল ও ধ্বজায় স্বর্ণতালের প্রতীক বর্তমান।
বিষ্ণুপুরাণ-এ পাই, মদঘূর্ণিতলোচন অনন্ত যখন জৃম্ভণ করেন(হাই তোলেন) তখন গিরি-সমুদ্র সহ এই ভূমন্ডল কম্পিত হতে থাকে। কল্পান্তরে অনন্তের মুখ হতে বিশানল দ্বারা উজ্জ্বল আকৃতিবিশিষ্ট সংকর্ষণ নামক রুদ্র নিষ্ক্রান্ত হয়ে ত্রিজগৎ ভক্ষণ করেন।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, তাঁরই অবতার বলরাম লাঙল দ্বারা যমুনার দিক পরিবর্তন করেছিলেন। কৌরবদের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে লাঙল নিয়ে হস্তিনাপুরের পুরী ভাগীরথীর জলে ফেলে দেবার উপক্রমও করেছিলেন তিনি। এ-সবের ভিত্তিতেই গিরীন্দ্রশেখর বসু অনন্ত-বলরামকে ভূগর্ভস্থ অগ্নুৎপাত তথা ভূমিকম্পের অধিষ্ঠাতা দেবতা বলে উল্লেখ করেছেন। লক্ষণীয় বিষয়, শিবকে ধ্বংসের দেবতা বলা হলেও অনন্তনাগ কিন্তু সৃষ্টি ধ্বংসে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শিব এবং অনন্ত— উভয়েই তমোগুণ সম্পন্ন বিনাশক। আবার মহাদেবের মতো অনন্তের অবতার বলরামও সাদাসিধে ভোলাভালা প্রকৃতির— অল্পে রেগে যান, আবার তুষ্টও হন সহজে। ব্রহ্মপুরাণ-এও পাওয়া যায়, শিবরুদ্রকে 'হলায়ুধ' বলেও ডাকা হয় নানা সময়ে। বলরামের অন্য একটি নাম হলধর বা হলায়ুধ—একথা তো সকলেরই জানা। কিন্তু, কেন হঠাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বলভদ্ররূপী শিবকে(মতান্তরে অনন্তদেবকে) এনে বসানো হল পুরীর মন্দিরের মণিকক্ষে, রত্নবেদিতে মূলত শাক্তদেবী সুভদ্রার পাশে? এই প্রশ্নের উত্তর চমৎকারভাবে দিয়েছেন—ভারত-জার্মানী মিলিত উদ্যোগের গবেষকবর্গ। তাঁদের ভাষ্যই উদ্ধৃত হল এই প্রসঙ্গে -
"The relationship between Krishna and Durga, Durga
as the Sakti (Nidra, Yoganidra, Yogamaya) of Visnu / Krishna... was clear to
the reformer (or the reformers) who introduced the image of Balabhadra in the
temple in the 13th century in order to suppress (or to sublimate) the erotic
element between the male and the female deity of the Purushottam Temple. They
introduced Balabhadra additionally into the sanctum in order to,
a) change the character and the concept of the two deities
from husband and wife to brother and sister,
b) to introduce indirectly a new deity whose worship was
very popular and widespread in Orissa, namely Shiva who is identified with
Samkarsana/Balarama in the Vaishnava Agamas, and finally,
c)
to re-interpret to reassert and emphasize the original character of the female
deity who had been Stambheswari/Durga but was being worshipped at this time as
Lakshmi. This introduced Durga in the Jagannatha Temple and satisfied Her
millions of followers in Orissa." (A. Eschmann, H. Kulke and G. C.
Tripathi's-The Formation of the Jagannath Triad)
পুরীর মন্দিরে প্রতিদিন সকাল, মধ্যাহ্ন এবং সন্ধ্যায় জগন্নাথদেবের তিনটি ‘ধূপ'
হয়। এই তিন ধূপেরই জগন্নাথ-প্রসাদের থালা পূজারীদের নিয়ে
যেতে হয় শাক্তদের একান্ন পীঠের একটি পীঠের অধিষ্ঠাত্রীদেবী বিমলা'র সম্মুখে। ওড়িশার যাজপুরে দেবী বিমলার অবস্থান। বিভিন্ন
তন্ত্রে এই দেবীকেই জগন্নাথের মহাশক্তিরূপে
বর্ণনা করা হয়েছে। জগন্নাথদেব এঁরই ভৈরব। জগন্নাথদেবের
মন্দিরের পেছনেই রয়েছে বিমলা দেবীর মন্দির,
যেখানে তিনি দুর্গারূপে বন্দিতা। ‘বিমলা'
অর্থাৎ যিনি পূতচরিতা বা নির্মলা,
পবিত্রতাস্বরূপিণী। তিনি একা,
অদ্বিতীয়া ও স্বতন্ত্রা। সৃষ্টির যাবতীয় উপাদান সেই
চিৎশক্তি হতেই নির্গত এবং তাঁর দ্বারা পরিব্যাপ্ত। প্রতিটি জীবের শরীরে উনপঞ্চাশ
রকমের বায়ুরূপে এই মহিমাময়ী দেবীই ক্রিয়াশীলা। পীঠনির্ণয়
তন্ত্রে বলা হয়েছে—
“উৎকলে নাভিদেশশ্চ বিরজাক্ষেত্রমুচ্চতে।
বিমলা সা মহাদেবী, জগন্নাথস্তু ভৈরবঃ।।”
অর্থাৎ, উৎকলে পড়েছিল সতীর নাভিদেশ। দেবীর নাম বিমলা। ভৈরব হলেন আর কেউ নন, স্বয়ং জগন্নাথদেব। ব্রহ্মযামলের অন্তর্গত 'আদ্যাস্তোত্রে'-ও এই পীঠের নাম পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে- “বিমলা পুরুষোত্তমে, বিরজা ঔড্রদেশে চ।"- অর্থাৎ পুরুষোত্তমক্ষেত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলা ও বিরজাক্ষেত্রে নিবাসিনী দেবী বিরজা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিমলা ও বিরজা দু'জন পৃথক দেবী নন। ১৮০৬ সালে শম্ভুনাথ কর বৈতরণী-তীরবাসী যাজপুরের এক ব্রাহ্মণের কাছ থেকে অষ্টাদশ পীঠের নাম সংগ্রহ করেছিলেন। তাতে উৎকলের প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, "উৎকলে বিরজাদেবী মাণিক্যাং চক্রকোটিলে।” দেবীভাগবতে অষ্টোত্তর শতপীঠের মধ্যে এই পীঠ ছত্রিশতম। কুব্জিকাতন্ত্রে বিয়াল্লিশটি পীঠের মধ্যে এই পীঠও রয়েছে। প্রাণতোষিণী তন্ত্র এবং বাচস্পত্যপীঠ গ্রন্থে এই পীঠের নাম পাওয়া যায়। মাতৃপ্রতিমা এখানে দ্বিভুজ, ত্রিনয়নী ও বীর্যরূপিণী। তাঁর এক হাতে ত্রিশূল ও অন্যহাতে মহিষের লাঙ্গুল বা লেজ। ত্রিশূল দিয়ে মহিষের বক্ষদেশ বিদীর্ণ করেন। বলে দেবী এখানে মহিষাসুরমর্দিনী নন বরং মহিষমর্দিনীরূপেই পূজিতা। দেবীর পাশে হনুমান, বামে গণেশ, বগলামুখী, একপাদ ভৈরব, দক্ষিণাকালী ও উত্তরে স্কন্দ একযোগে অধিষ্ঠান করছেন। দেবীর ঈশানকোণে রয়েছেন ঈশানেশ্বর বটুক ভৈরব। এই বিরজা ক্ষেত্রে ১০৮ জন শিব উপস্থিত থাকলেও জগন্নাথকেই দেবীর ভৈরবরূপে চিহ্নিত করা হয়।
দেবী বিমলা সারা বছর বৈষ্ণব মতে পুজো পান। তবে শরৎকালে
দুর্গাপুজোর সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী- এই তিন দিন তন্ত্রমত অনুসরণ করা হয়।
মহারানীতে ছাগ বলি হয়, মহানবমীতে হয় মহিষ বলি। প্রভু জগন্নাথের শয়ন হয়ে গেলে ওই
তিনদিন মন্দিরের দক্ষিণদিকের একটি দরজা দিয়ে একটি ছাগশিশুকে এনে বলি দেওয়া হয়
এবং আমিষ ভোগের ব্যাবস্থা করা হয়। কিন্তু সূর্যোদয়ের পূর্বে জগন্নাথের উত্থানের
আগেই চুন-জল দিয়ে ওই বলির রক্ত ও ভোগের স্থানটি পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। এছাড়াও
দেবী'র প্রতিষ্ঠা মাসে ভেড়া বলি হয়। বলি হয় ভৈরবপুজো ও
দীপান্বিতা কালীপুজোর সময়েও। এইভাবেই শাক্ত-বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ
ঘটেছে এই পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে।
জগন্নাথের প্রসাদ দেবী বিমলা গ্রহণ না করা পর্যন্ত সে প্রসাদ মহাপ্রসাদ বলে গণ্য হয় না। অনির্দিষ্টকাল থেকে চলে আসা এই নিয়মের পেছনে কি কোনো কাহিনি আছে? আছে বই কি, তবে পৌরাণিক নয় বরং লৌকিক কাহিনি সেটি।
একবার বৈকুণ্ঠে নারায়ণ ভোগ গ্রহণ করার পর মা লক্ষ্মী নিজে সেই এঁটো পাতে খেতে বসেছেন। এমন সময় নারদ এসে উপস্থিত। প্রভু'র প্রসাদ দেখেই নারদের লোভ জেগে উঠল। বারবার তিনি লক্ষ্মীদেবীকে মিনতি করতে লাগলেন, অন্ততপক্ষে প্রসাদের একটি কণা যেন তাঁকে দেওয়া হয়। কিন্তু লক্ষ্মীদেবী দিতে নারাজ। অবশেষে নারদ সখীবেশে দীর্ঘদিন লক্ষ্মীদেবীকে পরিচর্যা করলেন। প্রীত দেবী বর দিতে চাইলে নারদ সেই বিষ্ণুপ্রসাদ ভিক্ষা করলেন। নিরুপায় দেবী নারদের ইচ্ছা পূর্ণ করলেন। নারদ সেই প্রসাদ খেয়ে মহাভাব প্রাপ্ত হলেন।
ভাবে বিভোর নারদ টলতে টলতে কৈলাসে গেলেন। শিব নারদের এই পরিবর্তন দেখে হতবাক্। তিনি ভাবলেন, “অহর্নিশ রামনামে মগ্ন থেকেও যে মহাভাব লাভ করতে পারছি না— তা নারদ কীরূপে অর্জন করল?" নারদকে প্রশ্ন করতে তিনি আগাগোড়া সব বললেন। শিব তিরস্কার করে তাঁকে বললেন, “অধম! আমার জন্য আনতে পারলে না একবিন্দু নারায়ণের প্রসাদ? দেখো তোমার হাতে কোথাও লেগে আছে নাকি!”
অনেক খুঁজে নখের ভেতরে একটি দানা পাওয়া গেল। শিব সেই দানটি খেয়েই মহাভাব প্রাপ্ত হলেন। অতঃপর তাঁরা দু'জনে মিলে উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম করতে লাগলেন। এমন সময় দেবী পার্বতী সেখানে এসে মহাদেব ও নারদের এই উন্মাদবৎ অবস্থা দেখে বুঝলেন, মহাভাবের লক্ষণ স্পষ্ট। অন্তর্গামিনী দেবী ভগবতী সবকিছু জানতে পারলেন এবং মহাদেবের কাছে সেই প্রসাদ চাইলেন। শিব ভাবের ঘোরে বলে উঠলেন, “তুমি এই প্রসাদ ভক্ষণের যোগ্য নও হে ভবানী।
শিবের এ-হেন বাক্যে ক্ষুব্ধা দেবী সেই মুহূর্তেই প্রতিজ্ঞা করলেন, “কলিযুগে আমি এই হরিপ্রসাদ সবাইকে খাওয়াব। এমনকি কুকুরেও এ-প্রসাদ ভক্ষণ করবে। আর আমাকে নিবেদন না করা পর্যন্ত এই প্রসাদ ভক্ষণের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আমি মুখে দিলে তবেই তা হয়ে উঠবে মহাপ্রসাদ।”
সেই সূত্র ধরে কলিযুগে যখন জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণের কথা উঠল, তখন রাতের অন্ধকারে জগন্নাথ পায়ে হেঁটে বিমলাদেবী'র মন্দিরে গেছিলেন স্থান ভিক্ষা করার জন্য। বিমলাদেবী শর্ত দিলেন, জগন্নাথের প্রসাদ এনে প্রতিদিন তাঁকে নিবেদন করতে হবে। তবেই সেটি সর্বসাধারণ গ্রহণ করতে পারবে। জগদীশ্বরীর কাছে হার মানলেন জগদীশ্বর!
যখন সমস্ত কলিঙ্গ রাজ্যে শবর রাজগণের আধিপত্য বিস্তৃত ছিল, তখন জগন্নাথ ক্ষেত্রও ছিল শবরদেরই অধিকারে। শবররাজের অধীনে দ্বিতীয় ইন্দ্রদ্যুম্ন উপাধিকারী রাজা যযাতিকেশরী ওড়িশাকে শাসন করতেন। তাঁর আগে শবর সেবকরাই জগন্নাথের পুজো ও ভোগ প্রস্তুত করতেন। যযাতির সময়ে ব্রাহ্মণরা জগন্নাথের পুজো করার অধিকার পেয়েছিলেন। কিন্তু ভোগ রান্নার দায়িত্ব রয়ে গেল শবরদের উপরেই। শবর-আধিপত্যের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে শবর-পাচকদের অপসারিত করা ছিল দ্বিতীয় ইন্দ্রদ্যুম্নের সাধ্যের বাইরে। তখন থেকে, অর্থাৎ খ্রিস্টীয় নবম বা দশম শতক থেকে মহাপ্রসাদের আদরের সূত্রপাত হয়। যযাতি'র আবির্ভাবের আগে মহাপ্রসাদ ভক্ষণের প্রথা আদৌ ছিল কি না— তাই নিয়ে সন্দেহ আছে। যযাতির রাজত্বের পরবর্তীকালে রচিত উৎকলখণ্ড এবং কপিলসংহিতাতে বলা হয়েছে, “ত্রৈবণিক হোক বা শূদ্রই হোক, যে কেউ-ই পাক করুক, তোমরা জানবে স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীই পাক করেছেন এই মহাপ্রসাদ। সুতরাং, একে যে কেউই স্পর্শ করুক, তাতে কোনো দোষ হয় না। সমস্ত জাতি মহাপ্রসাদ ভোজনে পবিত্র হয়। যেমন গঙ্গাজল চণ্ডাল-স্পর্শে অপবিত্র হয় না, তেমনি এই মহাপ্রসাদও অপবিত্র হয় না কিছুতেই।"
জগন্নাথের ব্রাহ্মণ সেবকরা দেখলেন, তীর্থযাত্রীরা পরম পরিতোষে মহাপ্রসাদ গ্রহণ করছেন। তখন তাঁরা সেই শবর পাচকদেরকেই যজ্ঞোপবীত প্রদান করে। এক স্বতন্ত্র প্রকার ব্রাহ্মণের সৃষ্টি করলেন। এখনও জগন্নাথের সুপকারগণ সকলেই বলভদ্র গোত্রীয় এবং শওয়র নামে পরিচিত। শওয়র শবর শব্দেরই অপভ্রংশ।
তবে এই মহাপ্রসাদ নিয়েও আছে এক বিদ্বেষভাব। নারদপুরাণ বা ব্রহ্মপুরাণের মতো প্রাচীন গ্রন্থে মহাপ্রসাদের নামোল্লেখ মাত্র না থাকায় ভারতবিশ্রুত পণ্ডিত রঘুনন্দনের মতো স্মার্ত পণ্ডিত- কেউই তাঁদের রচনায় মহাপ্রসাদের কথা উচ্চারণ পর্যন্ত করেননি, যদিও জগন্নাথের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন তারা সকলেই। এঁরা কেউই মহাপ্রসাদ গ্রহণও করেননি। রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের প্রধান পণ্ডিত সুপ্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক সার্বভৌম ভট্টাচাৰ্য্য চৈতন্য দর্শনলাভের আগে কখনও মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেননি। চৈতন্যের দিব্যরূপ, প্রখর পাণ্ডিত্য আর আশ্চর্য ভক্তিবাদে মুগ্ধ হয়ে তিনি চৈতন্য-ভক্তে রূপান্তরিত হন। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে- একদিন প্রত্যুষে শ্রীমন্মহাপ্রভু সার্বভৌমের হাতে মহাপ্রসাদ তুলে দিয়েছিলেন। ভট্টাচার্যের তখনও স্নানাহ্নিক কিছুই হয়নি। তবু, চৈতন্যের হাত থেকে সানন্দে মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে উচ্চকণ্ঠে তিনি পদ্মপুরাণ থেকে একটি অংশ আবৃত্তি করেছিলেন—
“শুষ্ক পর্য্যসিতং বাপি নীতং বা দূরদেশতঃ।
প্রাপ্তিমানে ভোক্তব্যং না কালবিচারণা।।
নদেশ নিয়মস্তত্র ন কাল বিষয় স্তথা।
প্রাপ্তমন্নং দ্রুতং শিষ্টের্ভোক্তব্যং হরির ব্রবীৎ।।”
সার্বভৌমের এই ভাব প্রত্যক্ষ করে মহাপ্রভুও প্রেমানন্দে বলে উঠেছিলেন-
"আজি দুই অনায়াসে জিতিসু ত্রিভুবন।
আজি মুই করিনু বৈকুণ্ঠ আরোহন।
আজি মোর পূর্ণ হল সর্ব অভিলাষ।
সার্বভৌমের হল মহাপ্রসাদে বিশ্বাস।"
এই ভোগ প্রসঙ্গে অন্য একটি জনশ্রুতিও শোনা যায়। জগন্নাথ নাকি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন-কে শর্ত দিয়েছিলেন, “আমাকে নিয়ে গেলে কিন্তু রাজকীয় সমাদরে রাখতে হবে। আমাকে দৈনিক রাজভোগ হিসেবে ছাপান্ন ভোগ দিতে হবে। আমি খাওয়ার পর হাত শুকোবে। তার আগে নতুন করে আবার ভোগ দিতে হবে।” সেজন্যই জগন্নাথের রাজকীয় সেবাপুজোর অঙ্গ হল ছাপ্পান্ন ভোগ।
ভাব থেকে ভোগ অবধি বিস্তৃত এই যাত্রা থেকে কি কি বোঝা গেল? আদিবাসীদের আরাধ্য দারুদেবতা বেদবিধির সংস্পর্শে এসে প্রথমে হলেন দারুব্রহ্ম। নারদপুরাণ ও ব্রহ্মপুরাণ থেকে এ-সত্যের রূপকটি পাওয়া যায়। পরে, খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত এই দারুব্রহ্মই সর্বস্তরের ভক্তসাধারণের দ্বারা পুরুষোত্তমরূপে পূজিত হলেন। এই পুরুষোত্তম ছিলেন বজ্রযানিক এবং তান্ত্রিক ধ্যানধারণায় বিষ্ণুর মূর্ত প্রতীক তথা বিষ্ণু আর কামদেবের মিলিত বিগ্রহ। এই কারণেই জগন্নাথের পুজোতে কামবীজ 'ক্লী' রয়ে গেছে আজও।
এই পুরুষোত্তমের মধ্যে বিষ্ণুর প্রেম ও রতির সবকটি গুণই
বিধৃত। ফলে বিষ্ণুর সঙ্গে প্রেমকলায় অনন্য বলে পরিচিত কৃষ্ণ নামেও অভিহিত করা
শুরু হল পুরুষোত্তমকে। পুরী মন্দিরে কৃষ্ণের প্রবেশ ঘটে প্রথমে বিষ্ণুর এক অবতার
রূপেই— যা বোঝা যায় সারদাতিলকা-এ বর্ণনা থেকে। পরে পূর্ব ভারত কৃষ্ণ- সংস্কৃতি
এবং কৃষ্ণপুজোর প্রাবল্যে প্লাবিত হয়। এর পেছনে দক্ষিণ ভারতীয়
বিষ্ণু-আরাধনার প্রভাব অনস্বীকার্য। বিষ্ণু পুজোর প্রথম ঢেউ
উৎকলে এসেছিল বিষ্ণুভক্ত মালবরাজ প্রথম ইন্দ্রদ্যুম্নের সঙ্গে। দ্বিতীয় তরঙ্গ বহন
করে এনেছিলেন শৈব বংশজাত যযাতিকেশরী স্বয়ং। তৃতীয় প্রবাহটি উৎকলের মাটিতে বহন
করেছিলেন দুই অসাধারণ সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব— অসমসাহসী রণনিপুণ শাসক অনন্তবর্মণ
চোড়গঙ্গা (১০৫৭ ১১৪৭) এবং দেশবরেণ্য ধর্মসংস্কারক আচার্য রামানুজ (১০৫৬-১১৩৭)।
যযাতিকেশরী'র উদ্যোগে শাক্তদেবী অম্বেশ্বরী দেশের পশ্চিমাঞ্চল থেকে এসে
বিষ্ণু বা কৃষ্ণের লীলাসহচরী লক্ষ্মী বা কমলারূপে প্রতিষ্ঠিত হন। পরে তিনিই
সুভদ্রা নামে পরিচিত হন। পুরীর মন্দিরের রত্নবেদিতে শুধু একটি পুরুষ ও একটি
নারীদের জন্যেই আসন সংস্থাপন করেছিলেন মহারাজ অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গাদেব। তৃতীয়
দেবতা, অর্থাৎ সংকর্ষণ বলরামের আবির্ভাব ঘটল অনেক পরে খ্রিস্টীয়
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে।
পুরুষোত্তম নামের লোকপ্রিয়তার ভিত্তিতে ফাটল দেখা দিল
প্রথমে। দেবতা ক্রমেই কৃষ্ণ নামে অভিহিত ও পূজিত হলেন। তারই পাশাপাশি জনমানসে তাঁর
অন্য এক নাম ক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হল। সে নাম আগেও ছিল,
তবে ক্রমে পুরাণ, সাহিত্য, কাব্য থেকে ধীরেধীরে
পুরুষোত্তম নাম সরিয়ে দেখা দিল সেটিই। জগন্নাথ!
এই যে বিশ্বরূপ পুরুষোত্তম ভগবানের রূপ প্রকাশ তা তো
বিশ্বময়তায় একাকার। তাকে কোনো রূপের সীমায় আবদ্ধ করা যায় না। তাই জগন্নাথদেবের এই
অদ্ভূত দারুব্রহ্মময় মূর্তি ভগবানের অনন্ত লীলাপ্রকটনের এক অসীম প্রকাশ। সেই
পুরুষোত্তম সত্যসুন্দর নিরঞ্জন ভগবান জগন্নাথদেব নানা দিব্যালঙ্কারে বিভূষিত হয়ে
তার অসম্পূর্ণ হস্তপদ, বড় বড় দুটি গোলাকার উদ্গত চক্ষু নিয়ে যেন জগৎ কল্যাণে
পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। এটিই তার স্বরূপ-মাধুর্য। তাকে স্মরণ করেই ভক্তরা চায়
পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পরিত্রাণ। আর তার জন্য আজকের এই রথযাত্রা উৎসব। এ যেন এক অনন্ত
যাত্রা, যেন মানুষকে মনে করাতে চায় যে,
জীবনের যাত্রা কখনো থামে না,
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা চলতেই থাকে। জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা
যেন সেই সময়ের যাত্রাকেই সূচিত করে, জীবনের চলমানতাকে বোঝায়। তাই সব বিতর্ক সরিয়ে, তিনজন দেবদেবীর মাধ্যমে হোক বা একজনের দিকে তাকিয়ে,
আমরা সবাই তাঁর উদ্দেশেই বলি—
“নীলাচল নিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে
বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ।”
তথ্যসূত্রঃ-
১. নাথ হে মোর – প্রীতম বিশ্বাস
২. দারুব্রহ্ম রহস্য – জয়দেব মুখোপাধ্যায়৩. প্রভু জগন্নাথ – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪. পৃথিবীর ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড – দুর্গাদাস লাহিড়ী
৫. পুরীতীর্থ – শ্রী নগেন্দ্রনাথ মিত্র
৬. জগন্নাথ কাহিনী – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৭. হিন্দুদের দেবদেবীঃ উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় পর্ব – ডঃ হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য
৮. The Formation of the Jagannath Triad - A. Eschmann, H. Kulke and G. C. Tripathi
৯. The Cult of Jagannath and the Regional Tradition of Orissa - A. Eschmann, H. Kulke and G. C. Tripathi
১০. Antiquities of Orissa – Rajendra Prasad
১১. Domain of Jagannatha: A Historical Study – Bikram Das
১২. Origin & Antiquity of the cult of Lord Jagannath – Avinash Patra
১৩. The Cult of Jagannath – K.C. Mishra
১৪. Origin and Evolution of the Cult of Jagannath – Benudhar Patra
১৫. Rathas and Rajas: The Car Festival at Puri – Hermann Kulke
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন