বই – কৃষ্ণপক্ষ
লেখক – তমোঘ্ন নস্কর
প্রকাশক – শব্দ প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারী ২০২২
প্রচ্ছদ – সৌম্যদীপ গুঁই
পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৪৫
মুদ্রিত মূল্য – ২২৫/-
তমোঘ্ন নস্করের লেখার সাথে পরিচয় ওঁর লেখা বিখ্যাত বই ‘দেও’-র মাধ্যমে। বইটি যদিও ক্ষেত্রে সমীক্ষা ভিত্তিক বিষয়ের উপর। কিন্তু গবেষণা লব্ধ তথ্যকে নিরস বর্ণনায় পেশ না করে উনি তা ছোট ছোট গল্পের আকারে পাঠকের দরবারে পেশ করেছিলেন। গল্পের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছিলেন আধি-ভৌতিক অলৌকিকত্বের পাঁচফোড়ন। ফলে যে বিষয়টি হতে পারত আদ্যন্ত তথ্যভিত্তিক নিরস ও গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ, লেখনীর গুণে সেটিই হয়ে উঠেছিল সরস গল্পের ভাণ্ডার। এবং গল্পগুলি কিশোর বয়স্ক থেকে বৃদ্ধবয়সী অবধি সমান জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তখনই বাংলা সাহিত্যের পাঠককূল তমোঘ্নের রহস্য – রোমাঞ্চ ঘরানায় বিশেষ প্রতিভার পরিচয় পেয়েছিলেন। অতঃপর তাঁর লেখা আরও বেশ কিছু বই সেই প্রতিভার সপক্ষে প্রমাণ দিয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ের বইয়ের মধ্যে “কৃষ্ণপক্ষ” ভৌতিক গল্পগুচ্ছ সংকলনরূপে প্রকাশিত হওয়ায় পাঠকমহলে কৌতূহল সৃষ্টি করে সমাদৃত হয়েছিল। একজন বিজ্ঞান ও প্রকৌশলী বিশারদ হওয়া সত্ত্বেও ভৌতিক ও অলৌকিক বিষয়কে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে আধুনিক পাঠককে মুগ্ধ করা সহজ কাজ মোটেই নয়। সেই দিক থেকে লেখক অনেকটাই সফল নিঃসন্দেহে। ইদানিংকালের সম্ভাবনাময় লেখকদের মধ্যে তাই শীর্ষস্থান অধিকার করে নিয়েছেন অবলীলায়। নিত্যদিনের লৌকিক আচার – বিচার – সংস্কারসমূহ নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণমূলক লেখা নিয়মিত পাঠকদের অবাক করে চলেছে। সেই সমস্ত নিত্যদিনের জীবনপথে কখনও কখনও পরিচিত অনুভুতির গণ্ডী পার হয়ে ধরা দেয় অচেনা – অজানা কিছু গা ছমছমে মুহূর্ত। যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান বা বুদ্ধির দ্বারা দেওয়া সম্ভব হয়না। সেই সমস্ত ব্যাখ্যাহীন অনুভূতির মুহূর্ত গ্রন্থিত করে লেখকের বই “কৃষ্ণপক্ষ”।
বইয়ে মোট পনেরোটি গল্প আছে। বইয়ের প্রচ্ছদেই বলা আছে “ অন্ধকারের পনেরো আখ্যান”। তবে পনেরোটি গল্পই যে রোমহর্ষক,ভয়ে গলা শুকিয়ে দেওয়া, অন্ধকার দেখলেই আঁতকে ওঠার মত তা নয়। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন মোড়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা অভিজ্ঞতা অন্ধকারময় ছায়াপথ রচনা করে যায়। এই গল্পগুলি সেই সমস্ত অনুভূতির খণ্ড চিত্র রচনা করে। অনুভূতির বিষয়ে কথা বলতে গেলে শুরুতেই বলতে হয় যে, যে কোনও অনুভূতিই ব্যক্তিনির্ভর হয়। একজনের বিষম ভয় লাগার ঘটনা যে অন্যজনের কাছেও ভয়ের হবে তা নয়। এই বইয়ের ভূমিকা বা অন্যান্য বর্ণনা পড়লে যে ভয়ানুভুতির আশা করা যেতে পারে, তা হয়ত সবার ক্ষেত্রে সত্য হবে না। আমার ব্যক্তিগত মতানুযায়ী প্রতিটি গল্প ভয়ের নয়। যেমন বইয়ের প্রচ্ছদের বর্ণনা অনুযায়ী ‘আলোময়’ প্রথম গল্পটি আশ্চর্যের হতে পারে, কিন্তু অলৌকিক – ভৌতিক বা ভয়ের না বলে বরং এক সুন্দর ভালোবাসাময় অভিজ্ঞতার বলা যায়। এই ধরণের অভিজ্ঞতা তুলনামুলকভাবে কম হলেও বিরল নয়। বিশেষ করে যারা পশু – পাখীদের সংসর্গে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাঁদের কাছে বেশ একটু সাধারণ ঘটনা মনে হবে। ভয় বা গা ছমছমের বদলে মন ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয়।
বাকি গল্পগুলোর মধ্যে কিছু ঘটনা অতীতকে জাগ্রত করে, কিছু ভবিষ্যৎ বদলে দেয়, কিছু ভাবতে বাধ্য করে, কিছু পড়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ছোট ছোট গল্পগুলো পড়তে পড়তে সময় গড়িয়ে যায়। কোথাও সন্তানহারা পিতা – মাতার দীর্ঘশ্বাস যেমন অন্তরাত্মাকে বিদীর্ণ করে তেমনি কোথাও সঙ্গীহারার কান্না কর্ণকুহরে যেন প্রবেশ করে যায়। এমনকি ইতিহাসও যেখানে সাক্ষী দিয়ে যায়, গল্পের ছলে জানিয়ে যায় কিছু অজানা রহস্যময় অধ্যায়ের। ভালো লাগে বিদেশের লৌকিক তথা অপদেবতাদের বিয়ে লিখিত গল্প। বিদেশের ভিন্ন ধর্মের ভিনদেশীয় রীতিতেও যে বহু অপদেবতা – ভূত – প্রেতের আচার বর্তমান তা পাঠক মনে কৌতূহল জন্ম দিতে বাধ্য। যারা ভূত বিশ্বাসী তাঁরা কয়েকটি গল্প পড়ার পর অন্ধকারে অজানা পদধ্বনি শুনতে পেলেও পেতে পারেন। যুক্তিবাদী অবিশ্বাসীরা মুচমুচে মুড়ি মাখার সাথে নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত স্বাদ বর্ধনের খোরাক পাবেন। তাই সব পাঠকের কাছেই পছন্দের বই হবে এটি।
পনেরোটি গল্পের মধ্যে খুব ভালো লাগে ‘দল’, ‘অন্ধকার’, ‘ইম্পেরিয়াল’, ‘ও স্যার’, ‘প্রজাপতি’,’রেঘো’ গল্পগুলো। প্রতিটি গল্পের সাথে আশীষ ভট্টাচার্য, সৌম্যদীপ গুঁই ও পৃথ্বীরাজ পালের অলংকরণও যথোপযুক্ত হওয়ায় গল্পের আকর্ষণও বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। বইয়ের অন্ধকারময় দিক চিহ্নিত করার জন্য প্রচ্ছদে ব্যবহৃত নীলচে কালো জমাট অন্ধকার পশ্চাৎপটে আঁকা ছবি যথেষ্ট রহস্যময়তা ও আকর্ষণ তৈরি করতে পেরেছে।
বইয়ের ত্রুটির বিষয়ে বলতে গেলে খুব সামান্যই কথা বলতে হয়। প্রথমত কিছু গল্পের বাঁধন একটু হালকা লাগে। বা বলা ভালো অন্য গল্পের তুলনায় হালকা মেজাজের হয়ে গেছে যেন।
দ্বিতীয়ত স্বল্প সংখ্যক বানান ভুল পাত্তা না দিলেও কয়েকটি গল্পের অসংশোধিত প্রুফ অসম্ভবভাবে তাল ভঙ্গ করে। যেমন ‘শ্বাস’, ‘প্রজাপতি’, ‘রেঘো’, ’ভাটি’, ‘বাকু’। এই গল্পগুলোর অধিকাংশ অংশেই উদ্ধৃতি সম্পূর্ণ নেই।
এছাড়া ‘ভাটি’ গল্প প্রথম পুরুষে বর্ণিত কাহিনী ১০১ পাতার একটি অনুচ্ছেদে উত্তম পুরুষে পরিবর্তিত হয়েছে। আশা করব তৃতীয় মুদ্রণে এই সামান্য ত্রুটিগুলো আর থাকবে না।
আগামী দিনেও লেখকের থেকে আরও মুগ্ধকরা গল্পের জন্য রইল শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন