শিবুদার ব্যাচেলার তকমা বোধহয় আর ঘুচল না। একবার তো ব্যাচেলরেট পার্টি পর্যন্ত থ্র করল। বাওয়ালী ফার্মহাউসে খানাপিনা ভালোই হল। বন্ধুদের মধ্যে সব্যসাচী ছাড়া আর সবাই এসেছিল। সব ঠিকঠাক, হঠাৎ একদিন পাত্রী নিজেই ফোন করে সব কেঁচিয়ে দেয়।
- হ্যালো...শিবশঙ্কর বাবু। আমি প্রিয়াঙ্কা বলছিলাম। মানে আপনার প্রিয়াঙ্কা। চিনতে পারছেন?
- কে প্রিয়াঙ্কা! আমি তো ও নামে কাউকে চিনি না। রং নাম্বার ফোন রাখুন।
- আরে আমি প্রিয়াঙ্কা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানে যার সঙ্গে আপনার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে।
- ও তাই বলুন।
- একটা অনুরোধ করব। প্লিজ রাখবেন বলুন।
- না শুনে বলতে পারবো না।
- মানে বলছিলাম আপনি আর এই সম্বন্ধটা নিয়ে এগোবেন না। আসলে আমি একজনকে ভালোবাসি এবং তাকেই বিয়ে করবো।
- ও, সে তো ভালো কথা। বাবা-মা কে জানিয়ে দিন।
- সমস্যাটা তো সেখানেই। ওঁরা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না যে আমার পক্ষে আবির ছাড়া অন্য কাউকে একসেপ্ট করা সম্ভব নয়। আপনি যদি একটু হেল্প করেন। প্লিজ।
- ঠিক আছে আমি ওদের জানিয়ে দিচ্ছি যে আপনি ইচ্ছুক নন, অন্যত্র এনগেজড।
- সর্বনাশ! তাহলে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। আবিরের চাকরি পেতে একটু সময় লাগবে। তাই বলছিলাম আপনি যদি বলেন আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি, তাহলে সব দিক বাঁচে।
- ওকে।
- ধন্যবাদ।
এরপর থেকে বাড়ি লোকজন বা বন্ধুরা কেউই শিবুদাকে বিয়ের জন্য আর চাপাচাপি করেনি। আগাগোড়া মেসির ভক্ত শিবুদা বলেছিল – যবে মেসির শাপমোচন হবে, হাতের মুঠোয় ধরা থাকবে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি সেদিন তারও ব্যাচেলর জীবন শেষ হবে। কিন্তু আগের বার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও ফ্রান্সের কাছে হেরে চোখের জলে মেসিকে বিদায় নিতে হয়। শিবুদাও ঠিক করে ফেলে ছাদনা তলায় যাবে না।
২।
শিবুদারা দু’ ভাই। বড় ভাই দেবশঙ্কর চক্রবর্তী ইনকাম ট্যাক্স কনসালটেন্ট। বয়স বাহান্ন। শিবুদার বয়স সাতচল্লিশ। মাথায় ইডেন গার্ডেনের মত বিশাল টাক। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হলেও এনার্জিতে ভরপুর। ঠিক যেন ডুরা সেল ব্যাটারি। বেলাগাছিয়া আদর্শ বিদ্যালয়ের টিচার। আমি ওই স্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। উনি আমাদের স্যার ডাকতে নিষেধ করেছেন। বলেন তোদের সব সমস্যার কথা আমায় বড় দাদা হিসাবে বলবি। শিবুদা আমাকে খুব ভালোবাসে। হইহই করতে খুব পছন্দ করে। স্কুলের পিকনিকে শিবুদা ছাড়া চলবে না। সেবার স্কুল থেকে সান্দাকফু ট্রেক করতে ছাত্রদের নিয়ে গিয়ে নিজে এক সাধুর পাশে বসে ধ্যান করতে শুরু করে। সবাই ওনাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। পরে জিজ্ঞাসা করলে বলে - দেখছিলাম এখানে কতটা মনঃসংযোগ বেশি করা যায়। ক্লাসেও পড়াতে পড়াতে শিস দিয়ে গান করতে আরম্ভ করে। বলে – একঘেয়ে পড়ানোর মধ্যে একটু বৈচিত্র্য দরকার বুঝলি। ব্রেনটা শার্প থাকে। কখনো আবার নিজেই নাকে নস্যি দিয়ে হাঁচতে থাকে। ভীষণ মুডি।তবে পড়ায় এক ঘর।তাই ছাত্র এবং অভিভাবক সবাই ওঁর ক্ষ্যাপামো সহ্য করে। ছেলেদের মোবাইল না ঘেঁটে ফুটবল খেলার পরামর্শ দেয়। একদিন ক্লাসে কেন ব্রাজিলের থেকেও আর্জেন্টিনাকে বেশি পছন্দ করে তাই নিয়ে গোটা পিরিয়ড কাটিয়ে দিল। দ্যাখ, ব্রাজিলের ফুটবল দৃষ্টিনন্দন, শিল্পীর ছোঁয়া কিন্তু আধুনিক ফুটবলে স্কিলের সঙ্গে পাওয়ারের মিশেল না ঘটাতে পারলে ওই নেইমারের মত অবস্থাই হবে। স্কিল তো অসাধারন কিন্তু টাচ লাগলে ফুলের মত মূর্ছা যায়। মারাদোনাকে দেখেছিস যেন কাজিরাঙ্গার একশিঙ্গা গণ্ডার ছুটছে। ওকে ধাক্কা দিয়েও সহজে ফেলা যায়না। মেসির মধ্যেও সেটা আছে। আমাদের ফুটবলারদের মধ্যেও স্কিল আছে কিন্তু সেই শারীরিক শক্তি নেই। তাই পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল বড় জোর আফগানিস্থানকে হারিয়ে লাফালাফি করে।
৩।
এবার কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসেছে। আশায় বুক বেঁধে আর্জেন্টিনার জয় দেখার জন্য শিবুদা স্কুলের ছেলেদের বার্ষিক পরীক্ষার খাতা তাড়াতাড়ি দেখে তৈরি। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে মাঠ ছাড়লে শিবুদা প্রচণ্ড হতাশ। ফাইনালে উঠলেও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আগের বারের মত হারবে কিনা কে জানে! তাই ঠিক করল দুদিন আগেই কাছে ধারে কোথাও বেড়াতে চলে যাবে। পিটি টিচার বিপুল স্যার বললেন দু রাত তিন দিনের ট্যুরে ঘাটশিলা যাওয়া যেতে পারে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল। ১৬ই ডিসেম্বর কাটাবাঙ্গি ইস্পাত এক্সপ্রেসে এসি চেয়ার কারে সিট খালি আছে। শুধু শীতকাল বলে সকাল ৬-৩৫ একটু চাপের। শিবুদা তাতেই রাজী। সব্যদা, বিপুল স্যার আর আমি শিবুদার সঙ্গী হলাম। ঘাটশিলা স্টেশনে সকাল ৯-৩০ নাগাদ নেমে স্টেশনের কাছে একটা ভালো হোটেলে উঠলাম। হোটেল থেকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলে তাতে চেপেই ঘাটশিলা ভ্রমনে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গৌরী কুঞ্জ, বরেণ্য সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের বাড়ি দেখে চোখ সার্থক করা হল। ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘আরণ্যক’ -এর মত অমর সৃষ্টির আঁতুড়ঘর দেখে বড় করুণ অনুভুতি হল। ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না। তারপর চোখে পড়ল রাজবাড়ীর ভগ্ন দশা । নদীতে এত শিলা খণ্ড দেখে শিবুদা বলল এই জন্যই এই জায়গার নাম ঘাটশিলা। বুরুডি লেকের পাশে দিশী মুরগির ঝোল, লেকের টাটকা মাছ খেয়ে শিবুদা অভিভূত। পরন্ত বিকালে ফিরতি পথে সুবর্ণ রেখা নদীর উপর স্বর্গীয় সূর্যাস্ত দেখে হোটেলে ফিরে বন ফায়ারের মজা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া হল।
পরের দিন সেই ব্রেজা গাড়িতেই গালুডি ব্যারাজ, রাত মোহানা, রঙ্কিণী দেবীর মন্দির, ডিমনা লেক, দলমা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি, চান্দিল লেক দেখে জামশেদপুর শহরে ঢুকে জুবিলি পার্ক, টাটার তৈরি জু-গার্ডেন এবং ছিমছাম সাঁই বাবার মন্দির দেখে রাত দশটা নাগাদ আবার ঘাটশিলা ফিরে আসা হল।
৪।
আজ রবিবার ১৮ ই ডিসেম্বর। বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল। তাই দুয়ারসিনি,এবং রাঁচির দশম ফলস আর পত্রাতু ভ্যালি দেখে তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে গরম জলে স্নান সেরে ফিস ফ্রাই অর্ডার দিয়ে গুছিয়ে খেলা দেখতে বসল শিবুদা,সঙ্গে সব্যদা, বিপুল স্যার আর আমি। মেসি গোল করতেই শিবুদা আনন্দে দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর আবার গোল। নাহ এবার কাপ মেসির হাতেই উঠছে। বিরতির পর পাশা পাল্টে গেল। এম্বাপে দুটো গোল শোধ করে খেলায় সমতা ফেরাল। শিবুদার মাথায় হাত। অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ালে মেসি আবার গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেয়।কিন্তু খেলার একেবারে শেষ সময়ে ফ্রান্স চেপে ধরে গোল শোধ দিয়ে দেয়। এবার টাইব্রেকারেই ঠিক হবে কার হাতে কাপ উঠবে। সব্যদা বলল – কি রে শিবু, এরা ফিস ফ্রাইয়ের কথা কী ভুলে গেল নাকি?
- দাঁড়া, রিসেপ্সনে ফোন করছি।
- হ্যালো রিসেপ্সন… কি ব্যাপার বলুন তো! রুম নম্বর ২০৮ থেকে ছটা ফিস ফ্রাইয়ের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। এখনো তো এল না।
- আজ্ঞে এই যাচ্ছে, স্যার। আসলে স্টাফ আজ কম এসেছে কিনা। সরি স্যার।
এবার দরজায় বেল বাজলো। শিবুদা বলল নিশ্চয়ই ফিস ফ্রাই এসেছে। এদিকে পেনাল্টি শুট আউট শুরু হয়ে গেছে। সবার চোখ তখন টিভির পর্দায়। গোল গোল পেঁয়াজ দিয়ে ফিস ফ্রাই গুলো ঢাকা। মাঝখানে টম্যাটো এবং চিলি সস। মেসি পেনাল্টি থেকে গোল করতেই শিবুদা মাছ মুখে এমন জোরে লাফিয়ে উঠল যে একটা y আকৃতির কাঁটা গলার মাঝখানে আটকে গেল। আর শিবুদা বোয়াল মাছের মত মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ নেই। ভিনিগার, কলা, মুড়ি, সাইলেশিয়া সবই ট্রাই করা হল। কিন্তু তিনি এমিলিয়ানো মারতিনেজের মত দুর্ভেদ্য হয়ে দণ্ডায়মান। বিপুল স্যার হোটেলের ম্যানেজার কে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তার আনতে বেরলেন। অনেক খোঁজা খুঁজি করে একজনকে ধরে আনলেন।
- এক কেটলি গরম জল পাওয়া যাবে? যন্ত্রপাতি গুলো স্টেরিলাইজ করতে হবে। হ্যাঁ, দুজন দুটো হাত শক্ত করে ধরে থাকুন।
ডাক্তারবাবু ব্যাগ হাতড়ে চিমটে পেলেন না। তখন নীচে হোটেলের রান্নাঘর থেকে বড় সাঁড়াশিটা নিয়ে আসা হল। এবার উনি চশমার কাঁচ মুছে ম্যানেজার বাবুকে মোবাইলের টর্চের আলোটা মুখের ভিতর ফেলতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তেনাকে কিছুতেই নাড়ানো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত মেসি কাপ হাতে সবার সঙ্গে নাচতে শুরু করলে শিবুদাও মেসি, মেসি বলে চিৎকার করে ওঠে। আর তাতে কাঁটাটা আলগা হতেই ডাক্তারবাবু শিকারি বাঘের মত সাঁড়াশি দিয়ে টেনে কাঁটাটা বের করে আনলেন। শিবুদার গলায় আওয়াজ শোনা গেল- আর্জেন্টিনা, আর্জেন্টিনা। মেসির শাপমোচন হল। ম্যানেজারবাবু ডাক্তারবাবুকে ফিজ দিয়ে বিদায় করে জোর হাত করে শিবুদার কাছে ক্ষমা চাইলেন - স্যার ভেটকি ছিল না বলে লেকের টাটকা রুই মাছ চালের গুড়ো দিয়ে মুচমুচে করে ভেজে দেওয়া হয়েছিল।
- আমি কিছু বুঝতে চাইনা। আমি এফ আই আর করবো। এটেম্পট টু মার্ডার চার্জ আনবো।
সব্যদা বলল- শিবু, এখন ওসব ছাড়। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ কর। মেসিকে দ্যাখ, মেস আপ করিস না।ব্যাগ থেকে শ্যাম্পেনের বোতলটা খোল। নাকের বদলে নরুন পেয়ে মাছ ভাজা হাতে নিয়ে সবাই আমুল দুধের জন্য সিধুর গাওয়া নতুন গানটা গাইতে লাগলো। বিপুল স্যার মহেন্দ্রক্ষণ দেখে বললেন- এবার তাহলে আন্তনেল্লার খোঁজ করাই যায়, কি বল। শিবুদা নিরুত্তর। ঘাড় ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।সবাই বুঝল ‘মৌনং সম্মতি লক্ষনম’।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন