কো জাগর্তী ? - কমলেন্দু সূত্রধর

দেবী লক্ষ্মী ( ছবি সৌজন্যঃ Calcutta Art Studio in 1883)


কো জাগর্তী? কে জাগে রে? আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি। বাঙালির রাত জাগার রাত। নিশুতি রাতে তিনি সদর দরজায় উঁকি দিয়ে দেখবেন, কোন ঘরে দীপ জ্বলে আছে। আলপনার পাদপদ্মে পা রেখে তিনি সেই ঘরে আপনি বাঁধা পড়বেন। ঘরে আসবে শ্রী, ধন-সৌভাগ্য, শান্তি-সমৃদ্ধি। সংসারে সুখ শান্তি, ধন রত্নের আশা আকাঙ্খা সকলেই করে থাকেন। সকলেই চায় পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে। সংসারে যেন কোন দিন অভাব প্রবেশ করতে না পারে। ধন ও সৌভাগ্যের দেবী মা লক্ষ্মী। লক্ষ্মী দেবীর কৃপায় সংসারে আসে সুখ শান্তি এবং ধন রত্ন। তবে লক্ষ্মী দেবী বড়ই চঞ্চলা। এবং তার মন চঞ্চলা হলে সম্পদ ও সমৃদ্ধির বিনাশ ঘটে। নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালীর ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন,


‘এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা।’

মোটামুটি ভাবে দ্বাদশ শতক থেকেই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর প্রচলন হয়। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের বাদ্যি বেজে ওঠার সঙ্গেই অপেক্ষা শুরু হয় গৃহস্থের। বিশ্বাস, কোজাগরী রাতে ধরাধামে আবির্ভূত হন দেবী। যে ভক্ত রাত জেগে তাঁর উপাসনা করেন তিনি পান মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ। তাঁর জীবনে আসে প্রাচুর্য ও সৌভাগ্য।

পৌরাণিক গল্পগুলিতে লক্ষ্মী বা শ্রী ‘ধনসম্পদের দেবী’, ‘অন্নদায়িনী’ ইত্যাদি রূপে বর্ণীত হলেও আদিতে তিনি তা ছিলেন না তা বলাই বাহুল্য। মনে করা হয় লক্ষ্মী আদপে অবৈদিক মাতৃকা। অনার্য দেবতা রুদ্রের মতোই পরবর্তী কালে বৈদিক সাহিত্যে আত্তীকরণ ঘটেছিল। ঋগবেদে ‘পণি’ নামে এক ব্যবসায়ী শ্রেনীর কথা জানা যায়। ঋগবেদ মতে, এদের পুর্বদিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। লক্ষ্মী প্রথমে এই ঋগবেদোক্ত বণিক শ্রেণী ‘পণি’দেরই পূজ্যা ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।


ঋগ্বেদের আদিম অংশগুলিতে শ্রী বা লক্ষ্মীর উল্লেখ নেই। অপেক্ষাকৃত নতুন বা পরে সংকলিত অংশগুলিতে শ্রী এবং লক্ষ্মী শব্দদুটির উল্লেখ মেলে যদিও তা কোনো বিশেষ দেবীর পরিচায়ক হয়ে ওঠেনি। অবশ্য, পরবর্তী কালে যখন শব্দদুটিতে দেবীত্ব আরোপ করা হয়, তখনও শ্রী ও লক্ষ্মী দুজন ভিন্ন দেবী হিসেবেই পরিচিতা ছিলেন। শ্রী ও লক্ষ্মীর একাত্ম হওয়াটা বৈদিক যুগের দ্বিতীয় ভাগে ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। ‘লক্ষ্মী’ শব্দটি প্রথম পাওয়া যায় ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৭১ সূক্তের দ্বিতীয় ঋকে-

“সক্তুমিব তিতউনা পুনন্তো যত্র ধীরা মনসা বাচমক্রত।
অত্রা সখায়ঃ সখ্যানি জানতে ভদ্রৈষাং লক্ষ্মীর্নিহিতাধি বাচি।।”

অর্থাৎ, “যেমন চালনীর দ্বারা শক্তুকে পরিষ্কার করে সেরূপ বুদ্ধিমান বুদ্ধিবলে পরিষ্ক্রৃত ভাষা প্রস্তুত করেছেন। সে ভাষারে বন্ধুগণ বন্ধুত্ব অর্থাৎ বিস্তর উপকার প্রাপ্ত হন। তাঁদের বচনরচনাতে অতি চমৎকার লক্ষ্মী সংস্থাপিত আছে।”

স্পষ্টতই, ‘লক্ষ্মী’ শব্দটি কোনো বিশেষ দেবীর পরিচায়ক নয়। এখানে লক্ষ্মী শব্দের অর্থ সৌন্দর্য, সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি—যা পরবর্তীকালে দেবী লক্ষ্মীর মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। ‘ঋগ্বেদে’, অন্ততঃ ৮১ বার ‘শ্রী’ শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায়। কিন্তু ‘ঋগ্বেদের’ সমস্ত জায়গায় ‘শ্রী’ বলতে - ‘শোভা’ বা ‘শোভাময়’, ‘সৌন্দর্য’ বা ‘সৌন্দর্যময়’ বোঝানো হয়েছে। অবশ্য, ঋগবৈদিক যুগে দেবীরূপে লক্ষ্মী একেবারেই অনুপস্থিত তা বলা যায়না। বৈদিক দেবী উষার সাথে সহজেই লক্ষ্মীকে একাত্ম করা যায়। বেদে অনেক স্থলে উষা সুৰ্য্যপ্রিয়ারূপে বর্ণিত হয়েছেন। বৈদিক বিষ্ণু সূৰ্য্যের নামান্তর মাত্র। সুতরাং সূৰ্য্যপ্রিয়া বৈদিক উষা বিষ্ণুপ্রিয়া পৌরাণিক লক্ষ্মী হয়েছেন। পৌরাণিক লক্ষ্মী জলধিদুহিতা, মন্থনকালে সমুদ্র হতে উৎপন্না। বেদে সমুদ্র বলতে ক্ষেত্রবিশেষে অন্তরীক্ষকেও বোঝানো হয়, সেই হিসাবে উষাও সমুদ্রদুহিতা। উষাকে বেদে বাঞ্জিনীবতী বা অন্নবতী বলা হয়েছে। লক্ষ্মীও অন্নদাত্রী।

অধ্যাপক উপেন্দ্র কুমার দাস লক্ষ্মীর পূর্বাভাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন–

‘কেউ কেউ মনে করেন ঋগ্বেদের পুরন্ধি, রাকা, সিনীবালী প্রভৃতি দেবীর মধ্যে শ্রী বা লক্ষ্মীদেবীর পূর্বাভাস পাওয়া যায়। পুরন্ধি প্রাচুর্যের দেবী, রাকা ঐশ্বর্যশালিনী এবং সুন্দরী। অথর্ববেদে দেবী সিনিবালীর কাছে ধনধান্য কামনা করা হয়েছে। আবার ঋগ্বেদে তাঁকে বলা হয়েছে পৃথুষ্টকা অর্থাৎ পৃথুজঘনা এবং তাঁর কাছে পুত্রাদি চাওয়া হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় দেবীর সঙ্গে প্রজননের যোগ আছে। ঋগ্বেদের অন্যত্রও এই যোগ লক্ষ্য করা যায়। যাস্ক সিনীবালীর অর্থ করেছেন অন্নবতী। কাজেই সিনীবালী কৃষি ও প্রজননের দেবী।…পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সিনীবালী ও রাকা উভয়ই চন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। পূর্ণিমার অধিষ্ঠাত্রী দেবী রাকা এবং সিনীবালী চন্দ্রকলাযুক্ত অমাবস্যাভিমানিনী দেবতা…ওষধি, বনস্পতি, শস্য ও প্রজননের সঙ্গে চন্দ্রের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ধারণা প্রাচীন জগতে ব্যাপক ছিল। কাজেই সিনীবালী ও রাকা কৃষিপ্রজননের দেবতা ছিলেন বলেই অনুমান হয়…রাকা ও সিনীবালী যে লক্ষ্মীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন কোজাগরী পূর্ণিমায় ও দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধানের মধ্যে তার একটি নিদর্শন যেন পাওয়া যায়।’

অথর্ববেদে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবতী রমণীকে ‘লক্ষ্মী’ বলা হয়েছে। সেখানে লক্ষ্মী কখনও ভাল তো কখনও মন্দ। অথর্ববেদ লক্ষ্মীকে কখনো ‘পাপিলক্ষ্মী’ বলে সম্বোধন করেছে,

“প্র পতেতঃ পাপি লক্ষ্মি নশ্যেতঃ প্রামুতঃ পত।” (৭.১১৫.১)

আবার কখনো ‘পুণ্যা লক্ষ্মী’ও বলেছে,

“রমস্তাঙ পুণ্যা লক্ষ্মীর্যাঃ পাপীস্তা অনীনশম্
অপ ক্ৰামতি সুনৃতা বীৰ্ষং পূণ্যা লক্ষ্মীঃ।” (১২.৫.৬)

শতপথ ব্রাহ্মণেও লক্ষ্মীকে ‘পুণ্যা লক্ষ্মী’ বলা হয়েছে। অবশ্য, ঐ শব্দ দুটি পরবর্তী কালে প্রচলিত লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মীকে বুঝিয়েছে কিনা তা বলা মুশকিল। অথর্ববেদের ভাষ্যকার সায়নাচার্য অবশ্য ঐ শব্দের দ্বারা দেবীকেই বোঝানো হয়েছে বলে মনে করেন। ‘পাপীলক্ষ্মী’ শব্দের তাই তিনি অর্থ করেছেন ‘অলক্ষ্মী’। ব্রাহ্মণ-গ্রন্থেই সর্বপ্রথম শ্রীকে ‘শরীরিণী রূপে’ দেখতে পাওয়া যায়, শ্ৰী এখানে দেবীরূপে কল্পিত, তাঁর ধন-সম্পদ ঐশ্বৰ্য্য সবই আছে। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প আছে, যেখানে শ্রী প্রজাপতি হতে সংযাত হয়েছেন বলা হয়েছে-

“প্রজাপতির্ধৈ প্রজাঃস্বজমানোঽতপ্যত।
তন্মাচ্ছাস্তাত্তেপানাচ্ছ্বীরুদ্রক্রামৎ সা দীপ্যমান৷
ভ্ৰাজমানা লেয়ায়ন্ত্যতিয্ ত্তাং দীপ্যমানাং ভ্রাজমানাং লেলায়ন্তীং দেবা অভ্যব্যাষান্।”( ১১৪.৩.৪)

অস্যার্থ, “প্রজাপতি প্রজাসৃষ্টির জন্য তপ করিলেন। তিনি তপঃশ্রান্ত হইলে শ্রী সঞ্জাত হইলেন। কম্পমানা শ্রীর জ্যোতিষ্মতী মূর্তি দেখিয়া তাঁহাকে পাইবার জন্য দেবতাদের লোভ হয়। তাঁহারা প্রজাপতির নিকট প্রস্তাব করেন যে, তাঁহারা শ্রীকে মারিয়া তাঁহার দানগুলি আত্মসাৎ করিতে চান। প্রজাপতি বলিলেন, - পুরুষ সাধারণতঃ স্ত্রীলোককে মারে ন!, শ্রীকে প্রাণে না মারিয়া তাঁহার দানগুলি তিনি লইতে বলেন। ফলে অগ্নি তাঁহার অন্ন, সোম - রাজ্য, বরুণ - সাম্রাজ্য, মিত্র - ক্ষত্র, ইন্দ্র - বল, বৃহস্পতি - ব্রহ্মবর্চস, সবিতা - রাষ্ট্র, পুষা - ভগ, সরস্বতী - পুষ্টি, ত্বষ্টা - রূপ লইলেন। শ্রী বলিলেন, প্রজাপতি, আমার সকলই ইহারা লইল। প্রজাপতি বলিলেন, যজ্ঞে তুমি এগুলি ফিরাইয়া পাইবে৷ শ্রী সফলকামা হইলেন।”

এই গল্পের একটা ‘প্রতীকী তাৎপর্য’ আছে - একটু তলিয়ে দেখলেই তা বোঝা যায়। মানুষের যা যা চাই, তা সব আছে ‘শ্রী’–র। আর সেগুলোই ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন দেবতারা ‘নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী’। খাবার তৈরি করতে ‘আগুন’ লাগে, তাই অগ্নি পেয়েছিলেন ‘অন্ন’। ‘সোম’ অর্থ ‘চাঁদ’, তাঁর জন্য পৃথিবী ‘রাজ্য’। শুধু ‘জ্যোৎস্না’ ছড়াবার জন্য নয়। সে পৃথিবীর ‘উপগ্রহ’ও বটে। ‘সাম্রাজ্য’ রাজ্যের চেয়ে বড়। পৃথিবীতে ‘জলভাগ’ ভূভাগের চেয়ে বেশি। সেই হিসেবে ‘সাম্রাজ্য’ পেয়েছিলেন ‘জলের দেবতা বরুণ’। ‘সরস্বতী’ মানে ‘বিদ্যাবুদ্ধি’, যা থাকা মানে ‘প্রাণের পুষ্টি’। ‘ত্বষ্টা’ হলেন ‘কারিগর’, তাই তাঁর ‘রূপের দরকার’, ওই নিয়েই তো তাঁর কারবার। ‘মিত্র’ আর ‘ইন্দ্র’র শাসন ক্ষমতা সামলাতে প্রয়োজন ‘ক্ষাত্রতেজ’ আর ‘শক্তি’, তাঁরা সেটাই পেয়েছিলেন। পরিশেষে, আর একটি কথা। ‘যজ্ঞের আহুতিতে’ ‘সবার শ্রেষ্ঠ সামগ্রী দানের প্রথা’ আছে। তা ছাড়া ‘যজ্ঞ’ করলে ‘ঈপ্সিত বস্তু’ মিলবে এরকম বিশ্বাসও আছে। এই দুয়ের ইঙ্গিতপুর্ণ সমর্থন মেলে ‘প্রজাপতির আশ্বাসে’।

যজুর্বেদেও শ্রী দেবীরূপে কথিত হয়েছেন। কিন্তু সেখানে তাঁর রূপের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। বাজসনেয়ী সংহিতা, তৈত্তিরীয় সংহিতা প্রভৃতিতে লক্ষ্মী ও শ্রী ভিন্ন ভিন্ন দেবী, কিন্তু তাঁরা দুজনেই “আদিত্যের পত্নী।”

“শ্রীশ্চ তে লক্ষ্মীশ্চ পত্ন্যাবহোরাত্রে পার্শ্বে নক্ষত্রাণি রূপমশ্বিনৌ ব্যাত্তম্।
ইষ্ণন্নিষাণামুং ম ইষাণ সর্বলোকং ম ইষাণ।।”(৩১/২২)

অস্যার্থ, “হে আদিত্য, শ্রী ও লক্ষ্মী তোমার পত্নীস্থানীয়, দিনরাত তোমার পার্শ্বস্থানীয়, নক্ষত্রগুলি তোমার রূপ, দ্যাবাপৃথিবী তোমার বিস্তৃত মুখ-সদৃশ, এরূপ তোমার নিকট প্রার্থনা করি– পরলোক আমার ইষ্ট হোক, আমি যেন সর্বলোকাত্মক (মুক্ত) হই।”

অতঃপর পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে, ‘সুলক্ষণা’ হিসাবে, শ্রী ও লক্ষ্মীর উল্লেখ একত্রে দেখতে পাওয়া যায়। অন্তত সূত্র গ্রন্থগুলির প্রণয়নের আগে অব্ধি এই ভেদ বর্তমান ছিল বলে মনে করা হয়। শাঙ্খ্যায়্ন গৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে,

“শ্রিয়ং আবাহয়ামি গায়ত্র্যা।” (২.১৪)

শাঙ্খ্যায়ন গৃহ্যসূত্রেই(২.১৪.১০) ‘শ্রী’ দেবীর কাছে বলিদানের বিধিও আলোচিত হয়েছে। এর থেকেই সম্ভবতঃ মনুসংহিতায় লক্ষ্মীর কাছে বলির সূচনা হয়েছিল। মনুও তাই বলেছিলেন

“উচ্চীর্ষকে খ্রিয়ৈ কুৰ্য্যাদ্ভদ্রকাল্যৈ চ পাদতঃ।
ব্রহ্মবাস্তোস্পতিভ্যাস্তু বাস্তুমধ্যে বলিং হরেৎ॥” (৩.৮৯)

অর্থাৎ, “গৃহের উত্তর-পূর্ব কোণে ‘শ্রিয়ৈ নমঃ’, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ‘ভদ্রকাল্যৈ নমঃ’ এবং গৃহমধ্যে প্রাঙ্গণে ‘বাস্তোস্পতয়ে নমঃ’ বলিয়া বলি প্রদান করিবে।”


মনুসংহিতার এই সাক্ষ্য থেকে ভদ্রকালীর সঙ্গে ‘শ্রী’ দেবীর যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তা বোঝা যায়।

তৈত্তিরীয়-উপনিষৎ উপদেশ করে যে

“বাসাংসি মম গাৰ্বশ্চ। অন্নপানে চ সর্বদা। ততো মে খ্রিয়মাবহ।” (১.৪)

অর্থাৎ, “আমার নিকট শ্রীকে আনয়ন কর, কেন না তিনি বাস, গো ও অন্নপান আনিয়া দিয়া থাকেন।”

‘শ্রী’ ও ‘লক্ষ্মী’ অভিন্ন হতে অনেক সময় লেগেছিল। সম্ভবত শ্রীসূক্তেই শ্রী ও লক্ষ্মী প্রথম একাত্ম হয়ে ওঠেন, একে অপরের ‘গুণাবলি’ গ্রহণ করে এক হয়ে গিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই শ্রীসূক্তেই সর্বপ্রথম পদ্মের সঙ্গে শ্রী বা লক্ষ্মীর সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়। এর আগে কোথাও পদ্মের সঙ্গে ‘শ্রী’র কোন সম্বন্ধ পাওয়া যায় না। শ্রীসূক্তে তিনি ‘পদ্মস্থিতা’ এবং পদ্মের উপরে দণ্ডায়মানা।

পৌরাণিকযুগে ও বৌদ্ধযুগে শ্রী প্রধান দেবীগণের মধ্যে পরিগণিতা। বৌদ্ধদের জাতকের কাহিণীতেও শ্রীদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য, বৈদিক দেবী 'শ্রী' পালি ভাষায় হয়েছেন 'সিরি'। সিরি-কালকন্নী জাতকে সিরি উত্তরদিক্‌পাল ধৃতরাষ্ট্রের দুহিতা; পশ্চিম দিক্‌পাল বিরুপাক্ষের দুহিতা কালকন্নী। এই কালকন্নীই সম্ভবত অলক্ষ্মী কারণ, যেখানে লোভ, দ্বেষ, হিংসা, নিষ্ঠুরতা, যেখানে পরনিন্দা, মুর্খতা, ঘৃণা, সেইখানেই কালকন্নীর অবস্থান। অন্যদিকে, ‘সিরিদেবী’কে আমরা বলতে শুনি,

“মানবজাতির ওপর আধিপত্য দেবার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আমি; আমি জ্ঞান, সম্পদ ও সৌন্দর্যের দেবী।” স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডের এক স্থলে কালকন্নী ও অলক্ষ্মীর একত্রে উল্লেখ আছে।

পৌরাণিক যুগে শ্রী এবং লক্ষ্মী এক সঙ্গে মিলে গেছেন। পুরাণে তাই লক্ষ্মীর দ্বাদশ নামের মধ্যে একটি হয়েছে শ্রী। মহাভারতে আছে, মন্থনকালে শ্বেতপদ্মাসীনা লক্ষ্মী ও সুরাদেবী উদ্ভূত হলেন। মহাভারতের লক্ষ্মীবাসর সংবাদে, কি কি অনুষ্ঠান করলে গৃহে লক্ষ্মী অধিষ্ঠান করেন, তারও বিবরণ আমরা পাই। মহাভারত অনুযায়ী ‘শ্রী’ দেবী প্রথমে দানবদের সঙ্গে বাস করতেন, পরে দেবগণের ও ইন্দ্রের সঙ্গে। মনে হয় এর মধ্যেই ইঙ্গিত আছে তিনি গোড়ায় প্রাগার্যগণ কর্তৃক পূজিত হতেন, এবং পরে ব্রাহ্মণ্যদেবতামণ্ডলীতে স্থান পেয়েছিলেন। মহাভারত এক ধাপ এগিয়ে বলছে, এই শ্রী শ্রীকৃষ্ণর সহধর্মিণী রুক্মিণী, ‘তিনিই প্রদ্যুম্নের মা’।

রামায়ণে সুরাদেবী বারুণীর নাম আছে বটে, কিন্তু শ্রীর নামোল্লেখ নেই। ধারণা করা হয়, বহুশতাব্দী পুর্বে শরৎকালে শস্য কৰ্ত্তন হলে সীতাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত এবং তাতে সীতা এবং ইন্দ্র আহুত হতেন। পারস্কর গৃহ্যসূত্রে এই স্থানে সীতাকে ইন্দ্রপত্নী বলা হয়েছে; কারণ, সীতা লাঙ্গলপদ্ধতিরূপিণী শস্যউৎপাদয়িত্রী ভূমিদেবী; ইন্দ্র বৃষ্টি-জলপ্রদানকারী কৃষিকার্য্যের সুবিধাদাতা দেব। লক্ষ্মী যে সীতার রূপান্তর, পক্ষান্তরে, সীতাই যে লক্ষ্মী, তা রামায়ণাদি গ্রন্থে বারবার বলা হয়েছে। বর্তমানে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা আদিকালের সীতাযজ্ঞেরই বিবর্তন। সীতাযজ্ঞে ইন্দ্র আহুত হতেন বলে তিথিতত্ত্বে কোজাগর-পূর্ণিমায় ইন্দ্রের পূজার বিধি আছে। বিষ্ণুপুরাণ মতে, শ্রী ঋষি ভৃগু ও খ্যাতির কন্যা(যেকারণে, শ্রী বা লক্ষ্মীর অপর নাম ভার্গবী) এবং ধর্মের পত্নী। রুষ্ট দুৰ্ব্বাসার অভিশাপে ইন্দ্র শ্রীহীন হলেন, দেবগণ দানবহস্তে পরাজিত হতে লাগলেন, তখন বিষ্ণুর পরামর্শে সমুদ্রমন্থন করে দেবগণ পুনরায় শ্রীকে পেলেন।



বাংলা ও বাঙালি ‘লক্ষ্মী’কে যেভাবে চিনেছে, মেনেছে, পুজো করেছে ও করছে, তাঁর সঙ্গে এসব ‘বেদ–পুরাণ–মহাকাব্যের যোগ’ সামান্যই। বাঙালির কাছে ‘লক্ষ্মী’ হলেন ‘ঘরের মেয়ে’। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের বাদ্যি বেজে ওঠার সঙ্গেই অপেক্ষা শুরু হয় গৃহস্থের। বিশ্বাস, কোজাগরী রাতে ধরাধামে আবির্ভূত হন দেবী। যে ভক্ত রাত জেগে তাঁর উপাসনা করেন তিনি পান মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ। তাঁর জীবনে আসে প্রাচুর্য ও সৌভাগ্য। এই আধুনিক পৃথিবী বেদ-পুরাণ থেকে যতই দূরে সরে যাক, আজও মানুষের মনের স্থির বিশ্বাসে জ্যোৎস্নায় ভরে থাকা উঠোনে পড়ে লক্ষ্মীর শ্রীচরণ। রাত জেগে গৃহস্থ পরিবার অপেক্ষায় থাকে কখন তাঁর বাড়িতেও উপস্থিত হবেন লক্ষ্মী। জানতে চাইবেন, “কে জাগে রে”?





ছবি সৌজন্যঃ সমস্ত ছবি অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত

তথ্যসূত্রঃ

১. লক্ষ্মী বিষয় ইতিবৃত্ত - শ্ৰী ক্ষেত্ৰগোপাল মুখোপাধ্যায়
২. লক্ষ্মী ও গণেশ – অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ
৩. বাঙালীর পূজা-পার্বণ – শ্রী অমরেন্দ্রনাথ রায়
৪. লক্ষ্মী এলেন ঘরে - রানা চক্রবর্তী




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন