অভিশপ্ত ভোপাল - কমলেন্দু সূত্রধর


১.

ডিসেম্বর ২-৩, ১৯৮৪ সাল। শীতের রাত। ভোপালের বেশিরভাগ বাসিন্দা গভীর ঘুমে। বড়ো কারখানার পাঁচিলের বাইরে চালাঘরগুলোর বাসিন্দাদের জন্যও সে রাতটা ছিল আর পাঁচটা রাতের মতই। কারখানার গায়ে লাগোয়া বস্তিগুলোতে বাস বহু মানুষের। কাছেই ভোপাল শহরের পুরনো এলাকাতেও থাকে হাজার হাজার মানুষ। আসলে, বছরের এ সময়টায় মধ্যপ্রদেশে জাঁকিয়ে বসার তোড়জোড় শুরু করে দেয় শীত। ভোপাল এমনিতেই আরামপ্রিয়, আমুদে শহর। অতএব এমন শীতে সে রাতঘুম ছেড়ে আর কিছু ভাববে, তেমন অবকাশ নেই। তার উপরে এ হল রবিবারের রাত। রবিবারও ভোপাল ঘুমিয়েছিল। ঘুমিয়েছিল ফাতিমা, তাঁর স্বামী ও তিন ছেলেও। ঘুম ভাঙল মাঝরাতে, মৃত্যুর শমনে

-        ফাতিমা, শোনো, ওঠো ওঠো। দেখো তো কেউ মনে হয় লঙ্কা পোড়াচ্ছে। খুব ধোঁয়া বাইরে।

বাইরে বেরিয়ে এলেন ফাতিমা। প্রথম তাঁর নাকে আসে একটা দুর্গন্ধ – তারপর শুরু হয় চোখ জ্বালাপ্রবল কাশিতে দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ফাতিমা আর তাঁর স্বামী দেখলেন, ধোঁয়ার পাহাড়ে ঢেকে যাচ্ছে আশপাশের বসতি। কেউ কেউ ফ্যান চালিয়েছে ধোঁয়া বের করতে, উল্টে ধোঁয়া আরো বেশি বেশি ঢুকে আসছে ঘরে। ঘরে তখনও ফাতিমার তিন ছেলে ঘুমন্ত।

তখনও ভোপালের অলিগলিতে বিষ-বাতাস যে ঢুকে পড়েছে, তা টের পাননি কেউ। অবস্থা আরো খারাপের দিকে মোড় নেয় - গন্ধ আরো জোরালো হয়ে ওঠে। মানুষ অল্পক্ষণের মধ্যেই নিঃশ্বাস নিতে কষ্টের কথা বলতে শুরু করে। অনেকে বমি করতে শুরু করে। ভুল ভাঙতে দেরি হয়নিরাত এগারোটা নাগাদ রাস্তায় বেরোতে শুরু করেন শহরবাসী। বোঝা যায়, গোলমালের আকার অনেক বড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পাওয়া যায়, ইউনিয়ন কার্বাইডের কারখানায় কিছু একটা বিপত্তি ঘটেছে।

-        ভাগো, ভাগো, গ্যাস বেরোচ্ছে। বাচ্চাকে নাও। পালাও ফাতিমা, পালাও

এ বার বিষ-গ্যাসের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। ফাতিমার কোলে ১০ মাসের বাচ্চা কাঁথায় মোড়া। ফাতিমার স্বামীর কোলে ৮ বছরের ছেলে। দৌড়াচ্ছে ওরা, প্রাণ বাঁচাতেহুড়োহুড়িতে তাঁদের ৪ বছরের একরত্তি ছেলেটি তাঁদের কাছ ছাড়া হয়ে পড়ে।

-        হা আল্লাহ! ছেলেটা তো দাদুর খাটে ঘুমোচ্ছে

-        থাক ফাতিমা থাক, আল্লাহ ওঁকে দেখবে।

মহল্লায়-মহল্লায় দৌড়োদৌড়ি। দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম ধাক্কায় গোটা ভোপাল ঢুকে যায় ঘরের অন্দরে। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে। ঘরে সেঁধিয়েছে মারণ-গ্যাস। ফের পথে নেমে আসে গোটা ভোপাল। বাঁচার উপায়? ঘরে-বাইরে অপেক্ষা করছে দম বন্ধ করা মৃত্যু। অতএব, রাতেই শুরু হয়ে গেল শহর ছেড়ে পালানোর তাড়াহুড়ো। সবারই চোখে জল, তবে তা কান্নার নয়, বিষ বাষ্পের ধোঁয়ায় জল সবার চোখে। ঝাপটা দিচ্ছে, কনকনে ঠাণ্ডায় স্নান করছে, নাহ্ কিছুতেই জ্বলন কমছে না। কাঁচা লঙ্কা বাটা গলায় দিলে যেরকম জ্বলে সেরকম জ্বলছে গলা। গোটা শহর বমি করছে, কেউ গলা টিপে ধরছে নিজের। ডাক্তাররা পর্যন্ত নিরূপায়। কোনো ডাক্তার জানে না, কী হয়েছে এতগুলো লোকের; কোন গ্যাস এটা; কোথা থেকেই বা ঘটল এমন অঘটন।

ঘড়ির কাঁটা মাঝরাত পেরনোর আগেই ঘুমন্ত ভোপাল এইভাবেই জেগে ওঠে সাক্ষাৎ মৃত্যুর ডাকে। শহরের আকাশে-বাতাসে মৃত্যুদূত তত ক্ষণে ডানা মেলেছে। নাগপাশের মতো শহরকে ঘিরে ফেলেছে বিষবাষ্প। পোশাকি নাম মিথাইল আইসোসায়ানেট(MIC)। রাতের অন্ধকারে দম বন্ধ করা গ্যাস চেম্বারে পরিণত হল শহর। পথে তখন একের পর এক ট্রাক। প্রতিটি ঠাসা, সকলে শহর ছেড়ে পালাচ্ছেন। কেউকেউ যানবাহন না পেয়ে পায়ের জোড় সম্বল করেই দৌড়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এক তরুণী রাস্তা ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়লেন। রাস্তায় পড়ে থাকল তাঁর দেহ, তাতে প্রাণ আছে কি নেই, বলা কঠিন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। বিষ-গ্যাস থেকে প্রাণ হাতে পালাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে যান জনৈকা গর্ভবতী মহিলা। বাকিটা বলে দিচ্ছে রক্ত-স্রোত।

ভোপালের সন্নিকটে হামিদিয়া হাসপাতাল ও সুলতানিয়া হাসপাতালে তিলধারণের জায়গা নেই। হাসপাতালের সামনে এক বাবার প্রবল কান্না, তিনি তাঁর শিশুকন্যাকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে চাইছেন, মেয়ে ক্রমশ বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঢলে পড়ছে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে। অনুরোধ শুনবে কে! সকলেই এসেছেন বাঁচতে।

এক লহমায় যেন গোটা শহরটা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। শহর মুড়ে গেছে বেওয়ারিশ লাশে। কারোর বাবা, কারোর স্ত্রী, কারোর বাচ্চা হারিয়ে গেছে। মা জানে না তার সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, সন্তান জানে না তার মাকে সে হারিয়েছে। পুরুষরা জানে না তাদের গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রাস্তার ওপর হাজার হাজার মরা বিড়াল, কুকুর, গরু এবং পাখির স্তুপ- শহরের মর্গ ভরে উঠছে মৃতদের ভিড়ে। সহস্রাধিক মানুষ এক নিমেষেই শেষ। সেই দুর্ভাগা রাতে অবস্থা এমনই হয়েছিল যে, মানুষ শ্বাস নিলে মরবে, শ্বাস না নিলেও মরবে।

২.

আসলে কি এই মিথাইল আইসোসায়ানেট বা MIC?

রসায়ন বলে, এটি এক ধরণের জৈবযৌগ। বর্ণহীন, তীব্র গন্ধযুক্ত tearing agent, দাহ্য, তরল পদার্থজলের সাথে গলায় গলায় বন্ধুত্ব তাঁর। আর এর স্ফুটনাঙ্ক কক্ষ তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশী। এটি প্রস্তুত করা হয় মনোমিথাইল অ্যামিন আর বিষাক্ত ফসজিন গ্যাসের সমন্বয়ে। মূলত এই মিথাইল আইসোসায়ানেট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয় কীটনাশক কার্বারাইল বা সেভিন প্রস্তুতিতে। এছাড়াও রাবার ও আঠা শিল্পে এর ব্যাপক প্রয়োগ।


 MIC থেকে কার্বারাইলের প্রস্তুত প্রণালি


এই MIC কতটা বিষাক্ত থাবা নিয়ে সেই রাতে ঝাপিয়ে পড়েছিল জানেন? American Occupational Safety and Health Administration-এর মতে, একটি আট কর্মঘণ্টার কারখানায় MIC-এর নিরাপদ মাত্রা ০.০২ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। পরিবেশে মাত্র ০.৪ পিপিএম MIC-এর উপস্থিতিতেই কাশি, বুকে ব্যথা, হাঁপানি, ক্রনিক চর্মরোগ, চোখ, নাক আর গলা জ্বলুনির উদ্রেক করে। সেই হতভাগ্য রাতে ভোপাল শহরে কোন মাত্রায় MIC ছড়িয়ে ছিল জানেন? ২৭ পিপিএম! নিরাপদ মাত্রার(০.০২ পিপিএম) চেয়ে যা প্রায় ১,৪০০ গুণ বেশী। ভোপালের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই মাত্রার শক্তি নিয়ে সেই রাতে ও তার পরবর্তীতে তাণ্ডবলীলা চালায় মিথাইল আইসোসায়ানেট।

৩.

ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড, সংক্ষেপে UCIL। প্রথম মহাযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক এই মহামন্দা যখন সর্বোচ্চ শিখরে, ঠিক তখনই ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় UCIL। ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড আসলে একটি যৌথ কোম্পানি ছিল যার ৫০.৯% শেয়ার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের এবং বাকি ৪৯.১% ছিল বিভিন্ন ভারতীয় বিনিয়োগকারীর যাদের মধ্যে খোদ ভারত সরকারও ছিল (সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের মাধ্যমে)।


ইউসিআইএল মূলত তৈরি করতো বিভিন্ন কীটনাশক, কার্বন পণ্য, প্লাস্টিক ও ওয়েল্ডিংয়ের যন্ত্রপাতি। ৯৬৬ সালে ইউসিআইএল ও ভারত সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৬৯ সালে তারা ভোপালে একটি কীটনাশক প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনকে বলা হয়েছিল বাণিজ্যিক হারে বহুল ব্যবহৃত কীটনাশক সেভিন (কার্বারাইলের একটি বাণিজ্যিক নাম) উৎপাদনের জন্য। চুক্তি বাস্তবায়নে খোদ তৎকালীন ভারত সরকার স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সেখানে পূঁজি খাটাতে জোরারোপ করে। এমনকি ভারত সরকার ইউসিআইএলকে ২২% ভর্তুকি পর্যন্ত প্রদান করে এই নিমিত্তে। ভারত সরকার তাদেরকে বছরে ৫,০০০ টন সেভিন উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়। একসময় কোম্পানিটির ভারতজুড়ে পাঁচ জেলায় ছিল মোট ১৪টি প্ল্যান্ট যেখানে কাজ করতো নয় হাজারের মতো মানুষ। অথচ ভোপালের যে জায়গায় এই কীটনাশক প্ল্যান্ট বসানো হয়েছিল সেটা ছিল হালকা ধরণের শিল্পকারখানা আর সাধারণ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য নির্দিষ্ট; কোনোভাবেই কীটনাশক প্ল্যান্টের মতো বিপজ্জনক শিল্পের জন্য নয়। র আশেপাশে ছিল ওরিজা, জয়প্রকাশ নগর আর চোলার বস্তি। নগর কর্তৃপক্ষের বিধানেও স্পষ্টভাবে বলা ছিল, এমন স্থানে কোনো শিল্প-কারখানা বসানো যাবে না যেখান থেকে বাতাসে করে বিষাক্ত ধোঁয়া আশেপাশের ঘনবসতিপূর্ণ জনপদে চলে আসার সম্ভাবনা থাকে।

১৯৭৩ সালে প্রথমবারের মতো তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেভিনের কাঁচামাল অর্থাৎ মিথাইল আইসোসায়ানেট আমদানি করা শুরু করে। কিন্তু পুঁজিবাদী শিল্পব্যবস্থা কখনোই থেমে থাকে না। মানবতা, মূল্যবোধ, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান, সবকিছুকে কাঁচকলা দেখিয়ে তারা ঠিকই তৈরি করে নেয় তাদের অন্যায় অগ্রযাত্রার অবৈধ মহাসড়ক। খোদ নিজেদের নিয়োগ করা উপদেষ্টাদের কথা অগ্রাহ্য করে ১৯৭৯ সাল থেকে কর্তৃপক্ষ ভোপালে তাদের কীটনাশক প্ল্যান্টেই এই বিষাক্ত পদার্থ মিথাইল আইসোসায়ানেটের উৎপাদন ও সংরক্ষণ শুরু করে। কর্তৃপক্ষ এই বলে আশ্বস্ত করে যে, এই প্ল্যান্টটি একটা চকোলেট ফ্যাক্টরির মতোই ‘নিরীহ’ হবে; দুশ্চিন্তা করার কোনোই কারণ নেই! এক জটিল, বিপজ্জনক প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটলো ভোপালের মাটিতে।

৪.

এরই মধ্যে আশির দশকে ভারত জুড়ে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঋণের বোঝায় জর্জরিত কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে তোলে। ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে কীটনাশক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। ১৯৮৪ সালে ইউসিআইএলের সেভিন উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশে নেমে আসে। ফলে সে বছরের জুলাই মাসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ইউসিআইএলের ভোপাল প্ল্যান্ট বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ক্ষতিতে চলা কারখানা কিনবেই বা কে? ফলে ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষ কারখানাটি অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এক ডামাডোলের পরিস্থিতে পরে ভোপালের ইউসিআইএল প্ল্যান্ট। এই সময়ে কারখানাটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা  আর পরিচালনা পদ্ধতির গুণগত মান তলানিতে পৌছায় এবং সেটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয় বলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণা। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নিরাপত্তা মানদণ্ডের এই নিম্নগামিতার বিষয়টি জানার পরও এই ব্যাপারে চুপটি মেরে বসে থাকে।

পদে পদে ছিল অনিয়ম, শৈথিল্য আর কৃপণতা। ২০০২ সালে ইউনিয়ন কার্বাইডের কিছু গোপনীয় দাপ্তরিক কাগজপত্র জনসমক্ষে এলে তাঁর থেকে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খবর জানা যায়- খরচ কমানোর জন্য MIC প্ল্যান্ট নির্মাণে ব্যবহৃত প্রযুক্তির বেশিরভাগই ছিল ‘অপ্রমাণিত এবং অপরীক্ষিত’ তথা বিপজ্জনক। লিক শনাক্তকরণের জন্য কোনো আধুনিক কম্পিউটার চালিত ব্যবস্থা ছিলনা, নানানরকম যান্ত্রিক সুচক বা গেজের সংখ্যা ছিল ন্যুনতম; যাও বা ছিল মাঝেমধ্যেই সেগুলি খারাপ হত, অথচ কর্তৃপক্ষ থেকে তা বদলানোও হতোনা। ভোপাল কারখানারই সমতুল্য ইউনিয়নের কার্বাইডের আরেকটি MIC প্ল্যান্ট ছিল ফ্রান্সে। সেখানে সমস্তরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল স্বয়ংক্রিয়, আধুনিক ও বৈদ্যুতিন। কিন্তু ভোপাল প্ল্যান্টে সবই ছিল মানবচালিত, ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা যাতে সব থেকে বেশি। ১৯৮২ সালের মে মাসে সি.এস. টাইসনের নেতৃত্বে আমেরিকা থেকে বিশেষজ্ঞদের এক দল ভোপালের কারখানা পরিদর্শন করে। তাঁরা গোটা কারখানায় মোট ৬১টি ‘Safety hazards’ বা নিরাপত্তার খামতি তুলে ধরে, এদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০টিকে তাঁরা ‘মারাত্মক বিপজ্জনক’ বলে চিহ্নিত করেছিল। এই ৩০টির মধ্যে ১১টিই ছিল MIC ইউনিটে। তা সত্ত্বেও, খামতিগুলির নিরশন করার কোনো চেষ্টা কর্তৃপক্ষ করেনি। MIC সংরক্ষণেও ছিল গাফিলতি ও নিরাপত্তার মাপকাঠিকে মধ্যমা দেখাবার প্রয়াস। ইউরোপীয় দেশগুলিতে মিথাইল আইসোসায়ানেট মজুদ করার নিরাপদ সীমা ছিল আধ টন মাত্র। ভোপালের প্ল্যান্টে একত্রে ৯০ টনেরও বেশি MIC মজুদ করে রাখা হত।  এমনকি দুর্ঘটনার দিনেও কতটা MIC প্ল্যান্টে মজুদ ছিল আন্দাজ করতে পারবেন? ৬৭ টন।

তাছাড়া, ইউনিয়ন কার্বাইডেরই নিরাপত্তা বিধি মতে, স্টোরেজ ট্যাঙ্কে ৫০% বা অর্ধেক MIC ভরা যাবে আর বাকিটা নিষ্ক্রিয় নাইট্রোজেন গ্যাস দিয়ে ভরা থাকবে, যাতে ট্যাঙ্কে আর্দ্রতা না জন্মায় এবং গ্যাসের চাপে তরল MIC খুব সহজে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেকিন্তু, স্বভাবতই এই নিয়মটাকেও নাকচ করে প্রায় ১২ টন বেশী MIC ট্যাঙ্কে মজুত রাখা হয়েছিল।

১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল- এই চার বছরের ভেতর প্ল্যান্টের কর্মী সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। মেইনটেন্যান্স সুপারভাইসরের পদটি অবলুপ্ত করে ফেলায় কারখানায় এই পদের কেউ ছিল না। কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালার সময় ৬ মাস থেকে কমিয়ে করা হয় মাত্র ১৫ দিন! খরচ কমাতে ১৯৮৩ সালে কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর জগন্নাথ মুকুন্দ ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দুইশ দক্ষ শ্রমিক ও টেকনিশিয়ানকে অবসরে পাঠান। ’৮৪-র সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার সুত্রপাত অনেক আগেই ঘটেছিল। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে কারখানার ফসজিন গ্যাস লিক হয়ে প্ল্যান্ট অপারেটর মোহাম্মদ আশরাফ মারা যান। ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে আরেকটি ফসজিন লিকে ২৮ জন শ্রমিক মারাত্মকভাবে আহত হয়। একই বছরের অক্টোবরে ভাঙা ভালভ দিয়ে মিথাইল আইসোসায়ানেট বের হয়ে চারজন শ্রমিককে আহত করে। এতকিছুর পরও অন্ধ হয়ে ছিল সবাই- সরকার, কর্তৃপক্ষ, এমনকি জনগণও। ৩রা ডিসেম্বরের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সূত্রপাত  একদিনে ঘটেনি।

৫.

২ ডিসেম্বরের রাতের একেবারে শেষভাগরাত এগারোটার মতো বাজে তখন। ৭০ একর জমির উপর নির্মিত ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডে রাতের পালার কাজ শুরু হয়েছে। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা সময়কে নিয়ে যাচ্ছে আঁধার রাতের গহীনে। এমন সময় একজন কর্মীর চোখে পড়ল, ৫০ ফুট উঁচু একটা পাইপলাইন লিক হয়ে সেখান থেকে  হলদেটে সাদা ধোঁয়া বেড়োচ্ছে আর পাইপলাইন থেকে ফোঁটাফোঁটা তরল চুইয়ে নীচে পড়ছে। প্ল্যান্টের সুপারভাইজার শাকিল কুরেসিকে এই খবর জানানো হয়। ‘সামান্য জল লিক করছে হয়তো’ ভেবে কুরেসি ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। ঠিক সেসময় একটা অদ্ভুত শব্দ কারখানার এক অপারেটরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। MIC-স্টোরেজ ট্যাঙ্কের উপরে ৬ ইঞ্চি মোটা ৬০ ফুট লম্বা একটা কংক্রিটের স্ল্যাব রাখা ছিল। তিনি দেখলেন স্ল্যাবটিতে ফাটল ধরছে। স্টোরেজ ট্যাঙ্কের মধ্যে চাপ অনিয়ন্ত্রিত হারে ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

কেন এমন হল? গ্যাস লিকের ঘণ্টা তিনেক আগে,  MIC-ট্যাঙ্কের একটা ‘Jumper line’ জল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছিল। জাম্পার লাইন ও ট্যাঙ্কের সংযোগকারী পাইপের সেফটি ভালভ ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এই ত্রুটিপুর্ণ ভালভ পেরিয়েই জল MIC ট্যাঙ্কে ঢুকে পড়ে। জল ও ট্যাঙ্কের MIC-এর সংযোগে এক অনিয়ন্ত্রিত তাপদায়ী বিক্রিয়া শুরু হয়। তাপের প্রভাবে তরল MIC গ্যাসে পরিণত হয়, যা গুণোত্তরীয় হারে ট্যাঙ্কের ভেতরের চাপ বিপদসীমার থেকে বেশি বৃদ্ধি করে। মিথাইল আইসোসায়ানেট জলের সাথে বিক্রিয়া করে প্রচণ্ড তাপ (প্রতি কিলোগ্রামে তিন হাজার ক্যালরির উপর!) উৎপন্ন করে। যদি কার্যকরী উপায়ে এই জলকে দূরীভূত করা না যায়, বিক্রিয়ার হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যা আর পরিণামে ফুটতে আরম্ভ করবে কীটনাশক কার্বারাইলের মূল উপাদান মিথাইল আইসোসায়ানেট।

মিথাইল আইসোসায়ানেট ইউনিটের ট্যাঙ্ক নাম্বার ৬১০-এর ভেতর চাপ বাড়তে থাকে। চাপ বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে তা বিপদসীমা অর্থাৎ ৫৫ psi এর উপরে চলে যায়। অপারেটর জানতেন, গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরিত MIC-র ট্যাঙ্ক থেকে বের হবার সম্ভাবনা বহুগুণে বেশি। তিনি সাথে সাথে ঘটনাটি তার ঊর্ধ্বতনকে অবহিত করেন। সবাই ছুটে আসে ৬১০-এর সামনে। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ট্যাঙ্কটি এতটাই গরম হয়ে ওঠে যে এর আশেপাশে কেউ দাঁড়াতে পারছিল না। প্ল্যাণ্টের সুপারভাইজার কুরেসি তখন উপয়ান্তর না দেখে পাইপলাইনে জল ছুঁড়ে মারার নির্দেশ দেনকিন্তু এতে কোনো লাভ হয়না।

প্রচণ্ড তাপে গ্যাসে পরিণত হওয়া মিথাইল আইসোসায়ানেট সেফটি ভালভ ভেঙ্গে ৭০ ফিটের এক লম্বা পাইপলাইনে ঢুকে পড়ে। এই পাইপলাইনের শেষ প্রান্তে যুক্ত ছিল গ্যাস স্ক্র্যাবার। এখানে মূলত কস্টিক সোডা দিয়ে মিথাইল আইসোসায়ানেটকে ক্ষতিকর নয় এমন পদার্থে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু এদিন হয়তো মৃত্যু পরোয়ানা নিয়েই এসেছিল ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের ট্যাঙ্ক ই৬১০। আর সে কারণেই গ্যাস স্ক্র্যাবারটিও সেই রাতে কাজ করেনি। সংস্কার করার জন্য এটিকে বন্ধ (Shut Down) রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্ল্যান্টের পাঁচটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার সবকটি সেই রাতে অকেজো হয়ে পড়েছিল। এমনকি, খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে ট্যাঙ্কের হিমায়ন যন্ত্রটিকেও বন্ধ রাখা হয়েছিল।


৬.

ভোপালের কুয়াশামাখা বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণসংহারী বিষাক্ত গ্যাস। ঘন্টায় ১২ কিলোমিটার গতিতে বয়ে চলা বাতাসে ভর করে মৃত্যুদূতের ন্যায় হাজির হয় দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে বাস করা ঘুমন্ত ভোপালবাসীর ঘরে ঘরে। ঘুমন্ত মানুষগুলো বিনা সতর্কতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। একযোগে জেগে ওঠে তারা। প্রতিটি ঘর ধোঁয়াচ্ছন্ন। শিশুরা গলা চেপে ধরে অবিরাম কাশছে, অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় চোখ, গলা, কণ্ঠনালী পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কেউবা পেট চেপে ধরে বসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ ঘরের বাইরে আসার আপ্রাণ চেষ্টায় রত। কেউ পারছে, তো কেউ চৌকাঠ পর্যন্ত যেতে না যেতেই লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। কাশির শব্দ আর ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার অজানা কষ্টে বিদীর্ণ হয়ে ওঠে মধ্যপ্রদেশের ভোপাল। কিছু কঠিন প্রাণের মানুষ কড়িকাঠ মাড়িয়ে বাইরে আসতে পেরেছিল। কিন্তু হতভাগ্য লোকদের চারপাশ তখন বিষাক্ত গ্যাসে আচ্ছন্ন। নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনও ছিল না সে রাতের বাতাসে। রাস্তার ধারে পড়ে ছিল কাঁথা মুড়ি দেওয়া শত শত লাশ। চোখে ভয় আর মুখে ফেনা নিয়ে সবার আগে মারা যাওয়া এই গৃহহীনদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ছিন্নমূল পথশিশু।

ঘিঞ্জি বস্তিগুলোতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে অজানার দিকে। বাঁচতে হবে তাকে; কিন্তু সেই বাঁচার পথ কোথায়! দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে ওঠা মা জানেন না, তার কোলে থাকা আদরের ধন অনেক আগেই মারা গেছে। কান্নাভেজা চোখে একরাশ বিদগ্ধ জ্বালা নিয়ে ছোট্ট শিশুটি মৃত্যুর প্রহর গুনছে পাশেই সদ্য লাশ হয়ে যাওয়া মা-বাবার পাশে। মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে পদদলিত হয়ে মারা যাওয়া শিশুটি ছিল সেই রাতের ‘ভাগ্যবান’; কারণ গ্যাসের ভয়ানক বিষাক্ততা ছোঁয়ার আগেই সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। ভোপাল রেলস্টেশনে হাজির হওয়া লক্ষ্ণৌ-মুম্বাই এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিভীষিকার ঘন সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। ‘ডমিনোস ফেক্টের’ মতো সারি সারি লাশ পড়ছিল ভোপালের রাস্তায়, বাড়িতে, গাড়িতে, রেলস্টেশনে, সবখানে।

ভোপালের সরকারি হামিদিয়া হাসপাতালে বস্তায় বস্তায় রাখা হয়েছিল মৃতদের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। হয়তো কোনোদিন দেখাও হয়নি, হয়তো হয়নি কথা; কিন্তু দুর্ভাগ্যের ফেরে সেদিন তারাই পাশাপাশি থেকে রচনা করেছিল এক বিয়োগান্তক গাথা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বিষাক্ত গ্যাস মৃতদেহের মাথায় ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

এতো মৃত্যুর মধ্যেও ইউনিয়ন কার্বাইড কর্তৃপক্ষের নির্লজ্জতায় সত্যিই হতবাক হতে হয়। সেই ভয়ানক রাতে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্তৃপক্ষের থেকে একরাশ জঘন্য মিথ্যাচার ছাড়া অন্য কোনোরকম সাড়া পাওয়া যায়নি। গ্যাস-আক্রান্তরা তখন হামিদিয়া হাসপাতালে ভীড় করছে। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তাররা। এহেন ডাক্তারদের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয় এই প্ল্যান্টের কর্তৃপক্ষগণ। চরম সংকটের মুহুর্তে ইউনিয়ন কার্বাইডের মেডিক্যাল অফিসার এল.ডি. লোয়া ডাক্তারদের ‘উপদেশ’ দিয়েছিলেন,

গ্যাসটা একদমই ক্ষতিকারক নয়। আক্রান্তদের চোখে ভেজা তোয়ালে জড়িয়ে রাখা ও চোখেমুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপ্টা দেওয়াই এর একমাত্র দাওয়াই।”

হামিদিয়া হাসপাতালের জনৈক ডাঃ মিশ্রের হৃদয় বিদারক স্বীকারোক্তিতে সেই দিনের পরিস্থিতির কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়-

কিসের ট্রিটমেন্ট করবো আমরা? আউটডোর ভরে গেছে পেশেন্টে। কোনো বেড নেই। ফাস্ট ফাস্ট মুভ করো আইসিইউ-তে। রেলওয়ে স্টেশন, জয়প্রকাশ নগর, শান্তি টাউন সব জায়গায় থেকে শয়ে শয়ে রোগী আসছে। ৩০% সারভাইভাল রেট না থাকলে ছেড়ে দাও, মুভ টু অ্যানাদার পেশেন্ট।

এখানেই শেষ নয়। রাত ১টা নাগাদ ভোপালের পুলিশসুপার স্বরাজ পুরী জানতে পারেন যে কারখানার ২ কিমি. দূরে ‘চোলা’ বস্তিতে গ্যাস-লিকের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, বাসিন্দারা বস্তি ছেড়ে পালাচ্ছে। শ্রী পুরী হন্তদন্ত হয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রূমে পৌছালে তাঁর এক সহকর্মীকে গ্যাসের প্রভাবে বেদম কাশতে দেখেন। শ্রীপুরী তখনই বুঝতে পারেন যে, আতঙ্ক নেহাত অমুলক নয়; প্ল্যান্টে কিছু একটা ঘটেছে। অতঃপর রাত ১ঃ২৫ থেকে ২ঃ১০ এর মধ্যে তিনি ইউনিয়ন কার্বাইডের প্ল্যান্টে তিনবার টেলিফোন করেন। দু’বার তাঁকে জানানো হয়, “সবই ঠিক আছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।” তৃতীয়বার তাঁকে বলা হয়, “স্যার, প্ল্যান্টে কি ঘটেছে তা আমরা জানিনা।” এইটুকু বলেই প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ ফোন কেটে দেয়।

এমনকি, রাত পৌনে দুটোয় ভোপালের অতিরিক্ত জেলাশাষক প্ল্যান্টের ওয়ার্কস ম্যানেজার, জে. মুকুন্দকে নিজের বাসভবনে ডেকে পাঠান ও গ্যাস-লিক সম্পর্কে  জিজ্ঞাসাবাদ করেন। শ্রী মুকুন্দও জোর গলায় গ্যাস লিকের খবর কে ভুয়ো বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন,

গ্যাস লিক যদি হয়েও থাকে, তাহলে সেটা আমার প্ল্যান্ট থেকে হয়নি, আমি নিশ্চিত। প্ল্যান্টে তো কাজ বন্ধ আর আমাদের উন্নত প্রযুক্তি ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে। আমাদের প্ল্যান্ট থেকে গ্যাস লিক হওয়া সম্ভবই নয়।”

আসলে, সেদিন প্ল্যান্ট কর্মীরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে লিকের খবর দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি। লিকের খবর জানাজানি হওয়ার অনেক পরে, রাত তিনটে নাগাদ প্ল্যান্ট থেকে জানানো হয় যে, লিক সারানো হয়ে গেছে। পরেরদিন সকালে ওয়ার্কস ম্যানেজার শ্রী মুকুন্দও একজন সাংবাদিককে এই কথাটাই বলেন যে, গ্যাস বের হওয়ার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই লিক মেরামত করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, এগুলো সবই ইউনিয়ন কার্বাইড কর্তৃপক্ষ সমর্থিত মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়। আসলে, সেদিন লিক মেরামত করা বা গ্যাস বের হওয়া আটকানোর চেষ্টা করা- কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।

এমনকি, বিপর্যয়ের ১৫ দিন পরে ভোপাল শহর যখন মৃতের স্তুপে পরিণত হয়েছে, শ্রী মুকুন্দ তখনও নির্লজ্জের মতোই বলে বেড়িয়েছেন,

“MIC-র প্রভাবে শরীরে অস্বস্তি হয় ঠিকই, কিন্তু তা মোটেই মারাত্মক নয়। MIC অনেকটা কাঁদানে গ্যাসের মতোই, এর প্রভাবে কেবল চোখ জ্বলে, চোখে জলের ঝাপটা দিলেই তা উপশম হয়। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের প্ল্যান্ট বা অন্য কোনো প্ল্যান্টে MIC-র জন্য কোনোরকম প্রানহানী কোনোদিনই ঘটেনি, ঘটতে পারেনা।”


 যেসব অঞ্চলে MIC ছড়িয়ে পড়ে


ভারত সহ সমগ্র বিশ্ব হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ভোপালের বিভীষিকা ধীরে ধীরে সবার সামনে উন্মোচিত হতে শুরু করে। বোধে আসে না এমন অকথ্য কষ্টে নিমজ্জিত হয় সমগ্র মানবতা। সারি সারি শিশুর নিথর দেহ দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে পাথরের মতো কঠিন হৃদয়ও। সদ্য বিপত্নীক হওয়া লোকটি কোলে করে নিয়ে যায় তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর নিথর লাশ। মৃত সন্তানের কপালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে তাকে শেষ বিদায় দেন হতভাগ্য পিতামাতা। জীবন সায়াহ্নে সবাইকে হারিয়ে একদম একা হয়ে যান গরীব বৃদ্ধা। ভোপাল অনাথ করে দিয়ে যায় শত শত শিশুকে, সন্তানহারা মায়ের বুকফাঁটা কান্নায় তৈরি হয় ইতিহাসের এক ধূসর অ্যালবাম। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান মানুষের অপলক দৃষ্টি সৃষ্টি করে এক অব্যক্ত বেদনা।

লাশের সৎকার করতে হিমশিম খেয়ে যায় বেঁচে থাকা স্বজন ও প্রশাসন। সাদা কাফনে মোড়ানো সারি সারি লাশগুলোকে বাধ্য হয়ে একসাথে কবর দেওয়া হয়। শ্মশানে একসাথে পোড়ানো হয় শত শত লাশ। অমর চাঁদ আজমেরার মতো সমাজসেবীদের দিনে প্রায় দু হাজারের মতো লাশের সৎকার করতে হয়েছিল। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল শোকের জনপদ ভোপাল।

পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্রিনপিসের ভাষ্যমতে, ভোপালের ঘনবসতিপূর্ণ ৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই গ্যাসে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। তিন হাজার তো মারা যায় সেই রাতের আদিভাগেই, যাদের জীবনে নতুন ঊষালগ্ন আর কখনোই আসেনি। প্রথম ৭২ ঘন্টায় অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে প্রাণ হারায় ৮ হাজার নিরীহ মানুষ। অন্যদিকে আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক, যার প্রায় দুই লক্ষই ছিল ছোট ছোট শিশু। অবশ্য তৎকালীন সরকারের গতানুগতিক চাটুকারিতা হিসেবে ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডিতে মৃতের সংখ্যা ‘মাত্র’ ৫,২০০ জন!

৭.

সবাই সরব হয় এই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও যথোপযুক্ত শাস্তির দাবিতে। ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের তৎকালীন সিইও ওয়ারেন অ্যান্ডারসন ৭ ডিসেম্বর ভারতে আসলে গ্রেফতার করা হয় তাকে। কিন্তু গ্রেফতারের ঘন্টা ছয়েকের ভেতর মাত্র ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে জামিনে ছাড়াও পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘পালিয়ে’ যায় সে। ওয়ারেন আর কখনোই ভারতে ফিরে আসেনি। তাকে ভারতে এনে বিচারের মুখোমুখি করারও কোনো গ্রহণযোগ্য সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যায়নি কোনো আমলের কোনো সরকারের মধ্যে! তবে ১৯৯২ সালের এপ্রিলে তাকে পলাতক আসামী ঘোষণা করে ভারতের আদালত।

ওয়ারেন অ্যান্ডারসন; ইউনিয়ন কার্বাইডের তৎকালীন CEO তথা ভোপাল বিপর্যয়ের প্রধান অভিযুক্ত


মার্কিন সরকারও তাদের এই কুলাঙ্গার নাগরিকেরই পক্ষ নেয়। তাকে মার্কিন কংগ্রেস ঐ মাসেরই ১৪ তারিখে ডেকে পাঠায় এবং “এমন কাজটি কোথাও যেন করিও না আর” এই আহ্লাদি শর্তে ছেড়ে দেয়। তাঁরা আরও বলে, যেহেতু এই দুর্ঘটনা ভারতে হয়েছে, সেহেতু তারা কিছু করতে পারবে না! ১৯৮৯ সালে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশন ভারত সরকারকে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। কিন্তু সেই অর্থের কতটুকুই বা কাজে লেগেছে সৎভাবে, সঠিকভাবে? ভুক্তভোগী প্রত্যেকে মাসিক ১৬০ টাকা (প্রায় ৪ ডলারের মতো) করে পেতেন। কিন্তু এই যৎসামান্য অর্থ তাদের অসামান্য কষ্টকে লাঘব কারার জন্যে যথেষ্ট ছিল কি? ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির প্রায় ২৬ বছর পরে ২০১০ সালের জুন মাসে ভারতের আদালত চূড়ান্ত রায় দেন। আদালত দুর্ঘটনার সময় কর্মরত আটজন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে। এদের সবাই ছিল ভারতীয়। তাদের সবাইকে দু’বছর করে কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ততদিনে সত্তরের কোঠায় চলে যাওয়া এই আসামীরা জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়। এই রায়ের সবচেয়ে আশ্চর্যের দিক ছিল ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে কোনো চার্জশীট দায়ের না করা এবং তাকে কোনোপ্রকার শাস্তির আওতায় না আনা। অ্যান্ডারসন ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে মারা যায়।


৮.

২ ডিসেম্বর প্রতি বছর আসে-যায়। এ বারটা হয়তো কর গুণে অনেকেই বলবেন, ‘সেই তো! ৩ বছর হয়ে গেল!’ ১৯৮৪-র কনকনে ওই শীতের রাতে ইউনিয়ন কার্বাইডের কীটনাশক কারখানা থেকে বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস ‘লিক’ করে ২০ হাজারেরও মতো মানুষকে কী ভাবে চিরঘুমের দেশে পাঠিয়েছিল, তা ভেবে শিউরে উঠবেন কেউ কেউ। শিউরে ওঠারই কথা।  তবে কি না যাঁরা বেঁচে রইলেন এবং তাঁদের থেকে যে পরবর্তী প্রজন্ম পৃথিবীর আলো দেখল, কেমন আছেন তাঁরা?

ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় জীবিতদের অধিকার ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এমন একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দাবি, এখনও উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি কেউ। তার উপর ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ওই কীটনাশক কারখানার ভিতরে ও ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কারখানার বাইরে লাগাতার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার দরুন অন্তত আশপাশের চার কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ভূর্গভস্থ জলস্তর বিষিয়ে গিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলির পরীক্ষাতেও তার প্রমাণ মেলে। ফলে শারীরিক দিক থেকে নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হয়ে চলেছেন বাসিন্দারা। মাটি ও জল পরিশ্রুতকরণের কোনও কাজই হয়নি। অর্থাৎ ভুক্তভোগীরা যে তিমিরে সে তিমিরেই। সাড়ে তিন দশক পুরোনো শিল্প বিপর্যয়ের অভিঘাতে এখনও বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশু জন্মায় ভোপালের ঘরে ঘরে। কখনও তাদের শরীরে সে বিপর্যয়ের চিহ্ন আঁকা থাকে, কখনও আবার মানসিক বৃদ্ধিতে। এ যেন হিরোশিমা-নাগাসাকির ছবি অনেকটা। পরমাণু বোমার অভিঘাত-ও তো বিস্ফোরণে ফুরোয় না। বরং জীবিতেরা শারীরিক যন্ত্রণা ও মানসিক গ্লানিতে জ্বলতে থাকেন। ‘সারভাইভার্স গিল্ট’ ঠোকরাতে থাকে অনেককেই। আর পরের অবুঝ প্রজন্ম সম্পূর্ণ অজান্তে একের পর এক রোগ নিয়ে জন্মায়, যুদ্ধ করে তার পর এক দিন মারা যায়। বিপর্যয়ের উত্তরাধিকার বোধহয় এমনই। না ভারতের কোনো সরকার, না এই দুর্ঘটনার পুঁজিবাদী মূল হোতারা, না সমাজ, সভ্যতার ধারক বাহকেরা- কেউই পারেনি ভোপালবাসীদের সেই দুঃস্বপ্নের অমানিশা থেকে বের করে আনতে; তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনধারায় সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে।

সরকার বদলেছে। কিন্তু অসহায় মানুষের চোখের জল একই রকম নোনতা রয়ে গিয়েছে। যদি এই ট্র্যাজেডি শহরের সম্ভ্রান্ত মানুষদের এলাকায় হত, যেখানে শহরের মন্ত্রীরা বাস করেন তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা একেবারেই অন্য রকম হত। এই ঘটনা যেখানে ঘটেছিল সেখানে বাস করতেন দিনমজুর দুঃখী মানুষরা। তাই চল্লিশ বছর পেরতে চললেও ন্যায়বিচার মেলেনি। তিক্ত সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে কেবল কবীর সুমনের গান বেয়ে আসা সেই প্রশ্নটিকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে আরও একবার, ”কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে, বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে?”





 ভোপালের এক বস্তি; অদুরেই ইউনিয়ন কার্বাইডের কারখানা

 দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরে সুনশান কারখানা চত্বর

গ্যাস দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষরা; এদের ফুসফুস আর চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়; দুর্ঘটনার পরের দিন।

 

মৃত স্ত্রীকে কাঁধে করে সৎকারের জন্য নিয়ে যাচ্ছে এক হতভাগ্য স্বামী; দুর্ঘটনার পরের দিন

 হামিদিয়া হাসপাতালে দুর্ঘটনায় মৃতদের হাড়গোড় বস্তায় ভরে রাখা হয়েছে।

পালমোনারি ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত মহম্মদ আরিফ; এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা ফুসফুস প্রতিস্থাপন।

শিশুদেহের স্তুপে নিজের মৃত সন্তানকে খুঁজছেন এক হতভাগ্য পিতা

ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির নির্মম পরিণাম; গর্ভপাত হওয়া ভ্রূণ গবেষণার স্বার্থে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে

 ভোপালের গ্যাস বিপর্যয়ে মৃতদের একাংশ


 শ্মশানে মৃতদেহের স্তুপ

 গবাদি পশুদের মৃতদেহ ক্রেনের সাহায্যে অপসারণ করা হচ্ছে

 মৃত সন্তানের অন্ত্যেষ্টিতে এক হতভাগ্য পিতা

 ভোপালের এক হাসপাতালে গ্যাস আক্রান্তরা; দুর্ঘটনার ১১ দিন পর

গ্যাস লিকের আতঙ্কে শহর ছাড়ার জন্য ভোপাল স্টেশনে ভয়ার্ত যাত্রীদের ভীড়

ললাটের এই লিখনই কি ছিল চোলা কলোনির ছোট্ট লীলার ভাগ্যে?

 বিষগ্যাসের বলি

       উপায়ান্তর না থাকায় এভাবেই শতশত হতভাগ্যের দেহ একসাথে সৎকার করা হয়েছিল

     আদরের সন্তানকে বাধ্য হয়ে এভাবেই গণকবরে শুইয়ে দিয়েছিল ভোপালের মা-বাবারা

বিষগ্যাসে পঙ্গু রুবেদা বানুর তিন পুত্র; গ্যাস লিকের সময় প্রথম দুজনের বয়স ছিল যথাক্রমে ১ সপ্তাহ ও ১৮ মাস। দুর্ঘটনার একবছর পর ছোটছেলের জন্ম হয়


মারণ গ্যাসের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া; গ্যাস লিকের ১ বছর পর



                   বিষের বলি; MIC গ্যাসের প্রভাবে চিরকালের জন্য অন্ধ হয়ে যান এঁরা

দুর্ঘটনার পরের দিন ইউনিয়ন কার্বাইডের ৬১০ নম্বর স্টোরেজ ট্যাঙ্ক(চিহ্নিত); এই ট্যাঙ্কেই MIC মজুদ করা হয়েছিল

 কারখানা চত্বরে পড়ে আছে ৬১০ নম্বর ট্যাঙ্ক; বর্তমানে।

ভোপাল কাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের গ্রেফতারের দাবীতে পোষ্টার, ১৯৮৫ সাল।



 ভোপাল বিপর্যয়ের প্রতিবাদে ব্যঙ্গচিত্র



তথ্যসূত্রঃ-

১.   roar.media

২.    m.somewhereinblog.net

৩.     www.bhopal.net/

৪.  Five Past Midnight in Bhopal - Dominique Lapierre and Javier Moro

৫.  Bhopal - the Inside Story - T. R. Chouhan, Claude Alvares, Indira Jaising, Nityanand Jayaraman


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন