১.
‘‘আমি
যদি সুযোগ পাই, ১৮ মাসের মধ্যে আমি ভারতের জন্য পরমাণু
বোমা বানিয়ে দেখাতে পারি।”, ১৯৬৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োকে দেওয়া
এক সাক্ষাৎকারে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
তিনিই ভারতের পরমাণু শক্তি গবেষণার জনক যার হাত ধরে ভারত
প্রবেশ করেছিল পরমাণু গবেষণার জগতে। তিনি ডঃ
হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, ভারতকে সেই
সময় পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে আমেরিকা, চিন বা
রাশিয়ার সমকক্ষ করে তুলতে পারেননি ভাবা। ঊপরোক্ত সাক্ষাৎকার
দেওয়ার মাত্র তিনমাসের মধ্যেই বিমান দুর্ঘটনায়(?) মৃত্যু হয় তাঁর। ১৯৬৬
সালের ২৪ জানুয়ারি লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ১০১ ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মঁ ব্লাঁ-র কাছে ভেঙে
পরে। মারা যান ১১ জন বিমানকর্মী সহ ১০৬
জন যাত্রী, যাদের মধ্যে ডঃ ভাবাও ছিলেন একজন।
বর্তমানে বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রসম্বলিত দেশগুলির তালিকায় ভারত অবশ্যই প্রথম সারিতে অবস্থান করে। শুধুই কি অস্ত্র? পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশের ভেতর আর কোন আশ্চর্য লুকিয়ে আছে, আরও কী কী ভাবে তাকে কাজে লাগানো যায়— তা নিয়ে প্রতিনিয়তই চলছে গবেষণা। ভারতে এই সুবৃহৎ বিজ্ঞানযজ্ঞ শুরুই হত না, যদি বিজ্ঞানী হোমি ভাবা না থাকতেন। জন্মেছিলেন এক বিত্তশালী পার্সি পরিবারে, স্বয়ং দোরাবজি টাটাও ছিলেন তাঁদের ঘনিষ্ঠ। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে জন্মগত সূত্রে প্রাপ্ত আরও একটি জিনিস ছিল তাঁর - মেধা। এই দেশের মাটিকে যেমন ভালোবেসেছিলেন, তেমনই চেয়েছিলেন একদিন গোটা বিশ্বে বিজ্ঞানের জগতে ভারত শ্রেষ্ঠ স্থানটি পাবে। পড়তে পড়তে চলে গেলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। পা পড়ল ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরিতে। একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের কেন্দ্রভূমি ছিল এই ল্যাব। এখানে দাঁড়িয়েই জেমস চ্যাডউইক প্রথমবার আবিষ্কার করেছিলেন নিউট্রন কণা। সেখানে দাঁড়িয়েই পরমাণু ও নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে গবেষণায় মেতে উঠলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। উত্তরণের রাস্তাটা একটু একটু করে যেন সামনে আসতে লাগল।
ইতিমধ্যেই ভারতের ওপর থেকে নেমে গেছে ইউনিয়ন জ্যাক। নতুন সূর্যের আলো এসে পড়েছে ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার ওপর। হোমি ভাবা-ও ১৯৪৭-এর বহু আগেই ফিরে এসেছেন ভারতে। শুরু হল ভারতের নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণার এক নতুন ও অনন্য অধ্যায়। যে রথের প্রধান সারথি ছিলেন স্বয়ং বিজ্ঞানী ভাবা! একের পর এক আধুনিক গবেষণাকেন্দ্র তৈরি হল দেশে। আর তার হাত ধরেই নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্নটাও জাঁকিয়ে বসছিল আমাদের মধ্যে।
২.
ততোদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে মানচিত্র থেকে মুছে গেছে দুটি শহর- হিরোশিমা ও নাগাসাকি। সেই স্মৃতি তখনও মানুষের মনে টাটকা, মানুষ চিনে ফেলেছে পরমাণু বোমার শক্তিকে। পারমাণবিক শক্তিধর আমেরিকা তখন বিশ্বের একমাত্র নিয়ামক, তাঁর পিঠে নিশ্বাস ফেলছে তাঁরই একদা মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। এমনই পরিস্থিতি বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞান মানচিত্র উঠে এল এক সদ্য স্বাধীন দেশ ভারতের বিজ্ঞানী ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। ইতিমধ্যেই তাঁর গবেষণা বৈশ্বিকস্বীকৃতি পেয়েছে, ডঃ ভাবা রয়্যাল সোসাইটির ফেলোও নির্বাচিত হয়েছেন, এমনকি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারে মনোনীতদের মধ্যেও তাঁর নাম উঠে এসেছে বেশ কয়েকবার।
ডঃ ভাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে পারমাণবিক শক্তির বিকাশ দেশের ভবিষ্যতের শিল্প বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শক্তি এবং শক্তির উপলব্ধ উৎস সীমিত ছিল। ব্যবসায়ী জেআরডি টাটার অর্থায়নে, ভারতীয় পরমাণু গবেষণার সূচনা হয় ১৯৪৫ সালে, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর সূচনার সাথে, যার নেতৃত্বে ভাবা। ১৯৪৮ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত ভাবা ট্রম্বেতে পারমাণবিক শক্তি সংস্থাপন স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৫৫ সালে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার সম্পর্কিত জাতিপুঞ্জ সম্মেলনের সভাপতি এবং ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত বিশুদ্ধ ও ফলিত পদার্থবিদ্যার আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
ততোদিনে নেহেরু গত হয়েছেন, ভারত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছে এক দৃঢ়চেতা নেতাকে, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বে একটু একটু করে নিজের পায়ের তলার জমি শক্ত করছে আমাদের দেশ। নতুন দেশ, তার নতুন আশা, অনন্ত সম্ভাবনা। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং হোমি জাহাঙ্গির ভাবা - এই দুজনের ওপর দেশবাসীর অগাধ আস্থা ছিল। আপামর দেশবাসী সেই আশা নিয়েই আকাশে তাদের স্বপ্নের ফানুস উড়িয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন যে তাদের কাছে দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে তার হিসেব বোধহয় একমাত্র বিধাতার কাছেই ছিল। ১৯৬৫ সালের ভারত, পাকিস্তান যুদ্ধে মুখের ওপর জবাব দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পর্যদুস্ত করে। পাকিস্তান শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দেয় এবং সেই চুক্তিতে সই করার জন্য লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দে পাড়ি দেন। ১৯৬৬ সালের ১০ই জানুয়ারী শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবং সেই দিনই গভীর রাতে অসুস্থ হয়ে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু ঘটে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর।
৩.
শাস্ত্রীজীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর ১৩ দিন কেটে গেছে। ডঃ ভাবা ভিয়েনা যাচ্ছেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির এক সম্মেলনে যোগ দিতে। বোয়িং ৭০৭ বিমান, নাম ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। বম্বে (অধুনা মুম্বাই) থেকে নিউ-ইয়র্কের সম্পুর্ণ যাত্রাপথে বিমানটি তিনটি জায়গায় ‘হল্ট’ দেবে। ইতিমধ্যেই দিল্লি ও বেইরুটে হল্ট দিয়েছে, পরবর্তী গন্তব্য ভিয়েনা। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ তখন সূইৎজারল্যান্ডের উপরে, নীচে তুষারশুভ্র মঁ ব্লাঁ। দিব্যি চলছিল প্লেনটি। উনিশ হাজার ফুট নীচে তখন মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের সমাহার। হঠাৎ বিমানের পাইলটরা একটা মৃদু ঝাঁকুনি অনুভব করলেন, সঙ্গে একটা অস্বাভাবিক শব্দ। টার্ব্যুলেন্স? কিন্তু এমন চমৎকার আবওহাওয়ায় তো তা সম্ভব না। এমন সময় এক তীব্র ঝাঁকুনি, বিমানের কন্ট্রোল প্যানেলে একসাথে অনেকগুলো সবুজ ইন্ডিকেটর লাল হয়ে জ্বলতে থাকল, যেন আসন্ন কোনো বিপদের আগাম সংকেত দিচ্ছে তারা।
এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭০৭
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নীচে নামতে শুরু করেছে। পাইলটরা তখন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কিভাবে জরুরি ভিত্তিতে অবতরণ করানো যায়, সেই পরিকল্পনায় ব্যস্ত। তাঁরা মরিয়া হয়ে জেনেভা এটিসির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তা সম্ভব হলনা। বিমান নীচে নামতে নামতেই হঠাৎ ভুমিকম্পের মতো এক প্রবল কম্পন অনুভুত হল। বিমানের পিছনের দিকটা প্রথমে ধাক্কা খেল একটা পাহাড়ের চূড়ার সাথে। সাথে সাথে বিমানটা একটা চক্কর খেয়ে পার্শ্ববর্তী ‘রোচার দে লা তোরনেট’ গ্লেসিয়ারে সজোড়ে ধাক্কা খেল। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল এয়ার ইণ্ডিয়া ফ্লাইট ১০১ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, বরফের মধ্যেই তাতে আগুন জ্বলতে শুরু করল। ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবা সহ মোট ১১৭ জন আল্পসের সেই মনোরম পরিবেশেই মৃত্যুমুখে পতিত হলেন।
৪.
সেই দিনই সকাল ১০টা নাগাদ। নয়া দিল্লির রাইসিনা হিলস। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। দর্শকাসনে রয়েছেন দেশের নতুন মন্ত্রীসভার ভাবী মন্ত্রীবর্গ, বহু রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। এমন সময় একটি ফোন আসে। তারপরই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নেমে আসে বিষন্নতা, উপস্থিত সকলের মুখে ফুটে ওঠে চিন্তার স্পষ্ট ছাপ। খবর এলো সকাল ৭ঃ০২ মিনিটে ফ্রান্স ও ইতালির সীমান্তে আল্পসের মঁ ব্লাঁ পর্বতে বম্বে থেকে লন্ডন গামী এয়ার ইন্ডিয়া ১০১ কাঞ্চনজঙ্ঘা ভেঙ্গে পড়েছে, বিমানের সকলেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের সাথেই মৃত্যু হয়েছে ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবার।
গোটা দেশ ভেঙ্গে পড়লো বিমান দুর্ঘটনায় ডঃ ভাবার আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই শ্রীমতী গান্ধী ডঃ ভাবার অকাল প্রয়াণকে “ব্যাক্তিগত ক্ষতি” হিসেবে ব্যাখ্যা করে বললেন,
“দেশের পারমাণবিক শক্তি বিকাশের এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ডঃ ভাবাকে হারানো আমাদের কাছে এক ভয়াবহ ধাক্কা”।
৫.
দুর্ঘটনাস্থলে বিমানের ধ্বংসাবশেষ
ফ্রান্স সরকার সেই দিনই তড়িঘড়ি তদন্ত কমিটি গঠন করে। মধ্যরাত পর্যন্ত উদ্ধারকার্য এবং তদন্ত চলে। কয়েকজন যাত্রীর মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করা গেলেও খুঁজে পাওয়া যায় নি বিমানের ব্ল্যাক বক্স। উদ্ধার করা দেহাবশেষের মধ্যে থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা গেল না ডঃ ভাবাকে। হয়তো উদ্ধারকার্য আর তদন্ত আরও কিছু সময় চালালে হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত অনেক কিছুই।
কিন্তু বাধ সাধল খারাপ আবহাওয়া। প্রবল তুষারপাতের কারণে সরকার বাধ্য হল উদ্ধারকার্য ও তদন্ত সাময়িকভাবে স্তগিত রাখতে। তদন্ত পুনরায় শুরু হয় সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এবং কমিটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বিমানের পাইলট-ইন-কম্যান্ড জে.টি.ডিসুজা এবং জেনেভা বিমানবন্দরের ট্রাফিক কন্ট্রোলের মধ্যে যোগাযোগের সমস্যাকেই দায়ী করা হয় রিপোর্টে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয় বেইরুট থেকে জেনেভার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার সময়েই বিমানের দুই নম্বর VOR যন্ত্রটি বিকল হয়ে যায়। পাইলট-ইন-কম্যান্ড ডিসুজা সেটি বুঝেছিলেন বেইরুট থেকে ওড়ার কিছুক্ষন পরেই। তাই পাইলট ডিসুজা নিজের মতো করে বিমানের অবস্থান আন্দাজ করে জেনেভা বন্দরের কন্ট্রোলে জানালেন যে তার বিমান এখন মঁ ব্লাঁ পর্বত অতিক্রম করে বিমানবন্দরে অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কন্ট্রোল থেকে তৎক্ষণাৎ তাকে জানানো হয় যে ফ্লাইট ১০১ কাঞ্চনজঙ্ঘা মঁ ব্লাঁ থেকে এখনও ৫ মাইল দূরে রয়েছে। কিন্তু পাইলট সেই সংকেত বুঝতে না পেরে অবতরণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন যার ফলশ্রুতি ইতিহাসের অন্যতম বীভৎস এবং মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ও মঁ ব্লাঁ পর্বতে ডঃ ভাবা সহ ১১৬ জনের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া।
ফরাসী সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির ১৯৬৭ সালের সেই রিপোর্ট তৎকালীন ভারত সরকারও গ্রহণ করে নিল এবং সরকারের অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রকের বিমান সুরক্ষা অধিদপ্তর এই রিপোর্ট টিকেই নথিভুক্ত করে। আর কোন তদন্তে এগোল না ভারত সরকার।
৬.
গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। ভারতীয় বিজ্ঞান সাধনার অন্যতম পথিকৃৎ ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবার মৃত্যু মঁ ব্লাঁ পর্বতে পাইলটের ভুলের কারণে ঘটে যাওয়া একটি বিমান দুর্ঘটনার ফলেই হয়েছে এটাই সত্য হয়ে থেকে যেত। কিন্তু হল না। ফ্রান্সের সরকারের সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এবং ভারত সরকার দ্বারা তার মান্যতা মেনে নিতে পারলেন না অনেকেই। সত্যিই কি বিমান ‘দুর্ঘটনায়’ মারা গিয়েছিলেন ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবা? নাকি এটা পরিকল্পনা করেই করা হয়েছিল? দুর্ঘটনার চেহারার আড়ালে কি জড়িয়ে রয়েছে কোনো জটিল তত্ত্ব? ১৯৬৬ সালে হোমি জাহাঙ্গির ভাবা-র মৃত্যুর পরই সামনে আসতে থাকে প্রশ্নগুলো।
প্রথম খটকা যেখানে তৈরি হল তা হল পাইলট-ইন-কম্যান্ড ডিসুজাকে নিয়ে। পুরনো নথি ঘেটে দেখা গেল ডিসুজা একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ পাইলট ছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৬৬ সালের ২৪ শে জানুয়ারির আগে বহুবার তিনি মঁ ব্লাঁ পর্বত অতিক্রম করে জেনেভা বিমানবন্দরে সফলভাবে বিমান অবতরণ করেছেন। তাঁর মতো একজন সুদক্ষ পাইলটের পক্ষে এরকম ভুল কি সম্ভব? আর তিনি যদি সত্যিই বেইরুট বিমানবন্দর থেকে জেনেভার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার সময়ে বুঝে থাকেন যে দুই নম্বর VOR যন্ত্রটি বিকল হয়েছে, তাহলে তাঁর মতো অভিজ্ঞ পাইলট সেটা কন্ট্রোলকে সাথে সাথে জানান নি এই কথাটি মেনে নেওয়া যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। বিমানের ব্ল্যাকবক্স কিংবা অন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কিছুই পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় খটকা, ফ্রান্সের সেই সময়কার জাতীয় সংবাদমাধ্যম ওআরটিএফের সম্পাদক ফিলিপ রেয়াল ক্যামেরা-সহ কিছু সাংবাদিককে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলেন। সাংবাদিকেরা জানান, তাঁরা মঁ ব্লাঁ-য় গিয়ে একটি বিমানের ভাঙা অংশ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল জুন, ১৯৬০। অথচ এয়ার ইন্ডিয়ার যে বিমানটি ভেঙে পড়ে, তা তৈরি হয়েছিল ১৯৬১ সালে। এ ছাড়া, বিমানের সামনের দিকের আর একটি ভাঙা অংশও পাওয়া গিয়েছিল। দাবি, সেটিও দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের অংশ নয়। ফিলিপ রেয়াল সরকারী তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের কার্যকলাপে এর পর সরকারি হস্তক্ষেপ করা হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু ওই সাংবাদিক দলের এক সদস্য দুর্ঘটনার নেপথ্যে অবশ্য অন্য তত্ত্ব তুলে ধরেন। তিনি জানান, ভাবার বিমানটি পাহাড়ে নয়, ধাক্কা খেয়েছিল অন্য একটি বিমানে।
২০১৭ সালে মঁ ব্লাঁ অঞ্চলে তল্লাশি চালান ড্যানিয়েল রোশ নামে এক ফরাসি ব্যবসায়ী। বিমান দুর্ঘটনা বিষয়ে ব্যক্তিগত তদন্ত করা তাঁর শখ। দীর্ঘ পাঁচ বছর তিনি গবেষণা করেছেন মঁ ব্লাঁর বুকে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে, ১৫ বার গিয়েছেন সেই অভিশপ্ত স্থানে, সংগ্রহ করেছেন ছড়িয়ে থাকা নমুনা। রোশ জানান, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে তিনি একটি মার্কিন বিমানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান, যার ককপিটে একটি পিস্তল, ক্যামেরা ও বেশ কিছু কাগজপত্র পাওয়া যায়। তবে রাউশের মতে, ভাবার বিমান দুর্ঘটনার পিছনে অন্য বিমানের সঙ্গে ধাক্কা লাগার বিষয়টি সত্য। সব নমুনা ও নথিপত্রের ভিত্তিতে তিনি মনে করেন, হোমি ভাবা যে বিমানের যাত্রী ছিলেন, তার সঙ্গে ন্যাটো'র একটি যুদ্ধ-বিমানের সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনা স্থল থেকে কেন মার্কিন বায়ুসেনার বিমানের ক্ষতিগ্রস্ত যন্ত্রাংশের নমুনা মিলেছে, সেই প্রশ্নও তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য যদি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ পর্বতে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে পড়ত সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটত কারণ বিমানে ৪১০০০ টন জ্বালানী মজুত ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি।
তৃতীয় খটকা তখন লাগল, যখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বেইরুট এবং জেনেভা বিমানবন্দরের নথি থেকে দুর্ঘটনার আগে বিমান সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হল। সেখানে পরিষ্কার ভাষায় লেখা বিমানের কোন যান্ত্রিক ত্রুটি নেই এবং জেনেভা বন্দরের কন্ট্রোলের সাথে পাইলটের কথোপকথনের রেকর্ডেও পাওয়া গেল কন্ট্রোলের পাঠানো সংকেতে পাইলট ‘ROGER’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যার কোনটিই তদন্ত কমিটির রিপোর্টে নেই।
বুঝতে বাকি রইলো না দুর্ঘটনার
আড়ালে রয়েছে কোন এক ষড়যন্ত্র। কিন্তু কি কারণে সেই ষড়যন্ত্র যার জন্য ডঃ ভাবার
এরূপ নির্মম পরিণতি হল? সেই সমস্ত
নথিকে মূল্যবান প্রামান্য হিসেবে ভারত সরকারের কাছে আনার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু
যেখানে ষড়যন্ত্র রয়েছে, সেখানে কি করে
এতো সহজে প্রমাণ হাজির করা যাবে? এক রাতের
মধ্যে রাতারাতি সব নথি পাল্টে গেল। পরদিন নথি পরীক্ষা করার সময় দেখা গেল কন্ট্রোল
এবং পাইলটের রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং দুটি বিমানবন্দরেই বিমানের
যান্ত্রিক ত্রুটির কথা লেখা আছে। সুতরাং ডঃ ভাবার বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু আসলে যে
ষড়যন্ত্র তা প্রমাণ করার শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে গেল।
তবে তদন্ত থেমে থাকেনি। যে মানুষটা এতবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন, সোভিয়েত রাশিয়ার বাইরে এশিয়ার প্রথম পারমাণবিক রিয়েক্টর তৈরি করেছিলেন, টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের মতো একটা গবেষণাকেন্দ্র তৈরির পেছনে যার মাথা ছিল— তাঁর এমন মৃত্যু কেউই মানতে পারছিলেন না। সবচেয়ে বড়ো কথা, তদন্ত যত এগোতে থাকে, ততই সন্দেহ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে যে, দুর্ঘটনা নয়, সম্ভবত চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। আর এই যাবতীয় চালচিত্রে উঠে আসে আরও একটি দেশ, আ-মে-রি-কা।
কাট টু ২০০০ সাল।
ততোদিনে ডঃ ভাবার মৃত্যুর পর ৩৪ বছর কেটে গেছে। আমেরিকার ব্যাসিলিস্ক প্রেস থেকে প্রকাশিত
হল একটি বই। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা CIA এর
Directorate of Plans (যা ‘Department of Dirty Tricks’ নামেও কুখ্যাত)-এর
প্রাক্তন অফিসার রবার্ট ক্রাওলি এবং সাংবাদিক গ্রেগরি ডগলাসের ফোনে কথোপকথনই বইটির
মুল বিষয়বস্তু, নাম ‘The Conversations with the Crow’। অবসর নেওয়ার পর ইনি ১৯৯৩ সালে
ডগলাসের সাথে যোগাযোগ করেন এবং সেই ফোনালাপেই পরমাণু বোমার মতোই
বিস্ফোরণ ঘটান ক্রাউলি। তাঁর জবানিতেই ব্যাপারটা জানা যাক-
“ক্রাওলিঃ ‘বুঝতেই পারছ বোধ হয় যে, ছয়ের দশকে ভারতকে নিয়ে আমরা খুবই সমস্যায় পড়েছিলাম। ভারত তখন পরমাণু বোমা বানানোর তোড়জোড় করছে। বাতেলাবাজ গোভক্তের দল নাকি বিশ্বের পরাশক্তি হতে চায়! ভারত তো তখন রীতিমতো রাশিয়ার বিছানা গরম করতো। করবেই তো, পাকিস্তানের জন্য যেমন চিন ছিল; ভারতেরও তো তেমনই একজন সঙ্গী দরকার। এই জন্যই ভারতের হাতে পরমাণবিক অস্ত্র আমরা চাইনি, ভগবানই জানে যে অস্ত্র দিয়ে ওরা কি করবে! হয়তো ওয়াশিংটনের নিগ্রোদের মতো খেমটা নাচ নাচবে, হয়তো পাকিস্তানিদের পরমাণু বোমা ছুঁড়ে মারবে। এমনিতেও, ওঁরা সবাই কালো চামড়াদের পর্যায়েই পরে। ও হ্যাঁ, ওদের যে মাথা সে কি করতে পারে তা আমরা ভালো করেই জানতাম, পরমাণু বোমা বানানোর ক্ষমতা ওর আছে। ওকে আমরা অনেকবার সাবধান করেছি, কিন্তু ও জন্মের ঠ্যাঁটা, মুখের উপর আমাদের বলে দিয়েছিল যে, জাহান্নামে যাও। এমনকি, হোমরাচোমরাদের সাথে ভারতও যাতে আণবিক অস্ত্র তৈরী করতে পারে, নিজের দায়িত্বে সেই ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। বাতেলাবাজ গুলো নিজের ক্ষমতায় এতোদূর এগিয়ে গেছিল। এতোকিছুর খবর তোমরা রাখো?’
ডগলাসঃ ‘আমার ওতে আগ্রহ নেই। কিন্তু ঐ জোকারটা আসলে কে?’
- ‘ছিল, গ্রেগরি, তবে
এখন আর নেই, সে এখন অতীত। ওর নাম হোমি ভাবা।
সত্যি বলছি, লোকটা প্রচন্ড বিপজ্জনক। আমাদের
বিপদ আরও বাড়ানোর জন্য ভিয়েনা যাচ্ছিল। তখন ওর ৭০৭ প্লেনের কার্গো হোল্ডে একটা বোম
ফাঁটে, আর বাছাধনের প্লেন সোজা আল্পসের একটা
পাহাড়চুড়ায় গোত্তা মারে। কোনোরূপ সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই পৃথিবী যেন আগের থেকেও আরও
একটু নিরাপদ হয়ে গেছে।’
- ‘ওই আলিবাবা কি প্লেনে একাই ছিল?’
- ‘আরে না, এয়ার ইন্ডিয়ার একটা কমার্শিয়াল ফ্লাইট ছিল ওটা।’
- ‘আর কতোজন ওর সাথে মারা গেছিল?’
- ‘কে জানে! আর সত্যি বলতে ওই সব চিন্তা করে কোনো লাভ নেই।…সত্যিই ভাবনার কিছু নেই। আমরা চাইলেই কিন্তু ভিয়েনার উপরেই প্লেনটাকে ধ্বংস করে দিতে পারতাম। কিন্তু উঁচু পাহাড়ে প্লেন ভেঙে পড়াটাই বেশি যুক্তিযুত মনে হয়েছিল তখন। গোটা একটা শহরের উপর একটা প্লেন ভেঙে পড়ার থেকে পাহাড়ের দু-একটা পাহাড়ি ছাগল মরাটাই বেশি ভালো।’
- ‘কয়েকটি পাহাড়ি ছাগলের থেকেও তাঁদের জীবনের মুল্য হয়তো বেশিই, রবার্ট।’
- ‘তাই নাকি? তাঁদের জন্য দরদ উথলে উঠছে নাকি?’
- ‘সেটা নয়। আমি শুধু বলতে চেয়েছি এমনটা আমি আশা করিনি। তোমরা বিষাক্ত খাবার পাঠাতে পারতে তাকে, মাঝরাস্তায় গুলি করে দিতে পারতে, কিম্বা ওর গাড়িটাই না হয় উড়িয়ে দিতে। আমি বলতে চাইছি যে, অতজন মানুষকে খুন করার কোনো দরকার ছিল কি?’
- ‘দেখো, যা ঘটেছিল তাই সোজাসুজি জানালাম। ওই পরিস্থিতিতে, ওটাই একমাত্র উপায় ছিল। আমরা তো আরেকজন টুপিপড়া গোভক্ত শাস্ত্রীকেও শেষ করে দিয়েছি। তুমি এদের চেনোনা, গ্রেগরি, এঁরা খুব তাড়াতাড়িই পরমানু বোমা বানিয়ে ফেলতে পারতো। যদি এঁরা পাকিস্তানে ওই বোমা ফেলত তাহলে? ওদের দেশে প্রচুর মানুষ, সাপুড়ে ছোটলোকে ভর্তি, খরগোশের মতো ওরা গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা বিয়োয়। পরমাণু বোমা ফেললেও কোন যায় আসতো না। ব্রিটিশরা কেন যে এদের উপর নজর দিল তা আজ অব্ধি বুঝিনি। বললাম তো, ওরা রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়েছিল। পাকিস্তানের পর যদি আমাদের দিকে নজর দেয়, তাহলে? কে জানে, হয়তো পানামা খাল বা লস অ্যাঞ্জেলসেও বোম ফেলতো। আমরা নিশ্চিত নই বটে, কিন্তু ব্যাপারটা অসম্ভবও নয়।’
- ‘এই শাস্ত্রীটা কে?’
- ‘রাজনীতি
করত, ওই তো এই কাণ্ডকারখানা শুরু করেছিল।
ভাবা সত্যিই প্রতিভাবান আর শাস্ত্রীর কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। কাজেই দুজনকেই
আমরা খতম করেছি।…ভাবা
কে ঠোকার পর ভারতের মুখে এখন আর কোনো কথা নেই।’”)
৪০ বছর আগে বিমান দুর্ঘটনা ও ডঃ ভাবার মৃত্যুর পিছনে যে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব শুধুমাত্র প্রমাণের অভাবে আল্পসের বরফে ঢাকা পড়েছিল, ৪০ বছর পর এই কথোপকথন আল্পসের বুকে সমাহিত সেই প্রমাণকেই মেলে ধরল সর্বসমক্ষে।
৮.
কিন্তু কেন এই ষড়যন্ত্র? কি
এমন করেছিলেন ডঃ ভাবা যার ফলে মার্কিনদের কপালে ভাঁজ দেখা দিয়েছিল? ১৯৪৫
সালে ডঃ ভাবা ভারতে পারমাণবিক শক্তি বিষয়ে গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সেব্যাপারে তিনি সাহায্য প্রার্থনা করেন স্যার দোরাবজী
টাটার কাছে। মিলল সাহায্য। স্যার দোরাবজী টাটা ট্রাস্টের অর্থানুকূল্যে বম্বেতে
গড়ে উঠলো টাটা ইন্সিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ।
ভারতে শুরু হল পরমাণু বিষয়ক গবেষণা। ১৯৪৮ সালে দেশের মাটিতে গড়ে ওঠা গবেষণাগারে
দেশের বিজ্ঞানীদের পরমাণু গবেষণার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নততর পরমাণু
গবেষণার লক্ষ্যে ডঃ হোমি ভাবার তত্ত্বাবধানে তৈরি হল অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন।
ভারতে পরমাণু গবেষণার উদ্দেশ্য একটাই - বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন এবং পারমাণবিক
শক্তিকে দেশের উন্নতিকল্পে সঠিক ভাবে ব্যাবহার করা। ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রী
নেহেরু উদ্বোধন করলেন অ্যাটমিক এনার্জি এস্টাব্লিশমেন্ট ট্রম্বে (AEET),
যার প্রথম ডিরেক্টর ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবা।
ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইন্দো-চীন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ১৯৬৪ সালে চীন পরীক্ষামূলক ভাবে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পারমানবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। শাস্ত্রীজীও দেশে পারমাণবিক শক্তি পরীক্ষার বিষয়ে এবং পারমাণবিক শক্তিতে দেশকে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে হয়ে উঠলেন তৎপর। নেতৃত্বে সেই ডঃ ভাবা। দেশের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষামূলক ভাবে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারবেন কিনা সেই প্রশ্নও শাস্ত্রীজী করলেন ডঃ ভাবাকে।
এরই মধ্যে আবার শীরে সংক্রান্তি। পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার সামরিক চুক্তির কথা তখন আর গোপন নেই। সেই চুক্তির ভিত্তিতে আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করে চলেছে। মার্কিন অস্ত্রে বলীয়ান মারাত্মক আত্মবিশ্বাসী পাক রাষ্ট্রপতি জেনারেল আয়ুব খান কাশ্মীর দখলের পরিকল্পনা নিয়ে করে বসলেন আক্রমণ। কিন্তু শাস্ত্রীজী এবং ভারতীয় সেনানায়কদের তুখোড় পরিকল্পনা, সাথে ভারতীয় সৈনিকদের প্রবল বিক্রমের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে আত্মবিশ্বাসী পাকিস্তান। এই ঘটনায় শুধু পাকিস্তানই যে আঘাত পেল তা নয়, ভয় পেল আরও একটা দেশ, দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা।
১৯৬৫
সালের ভারত পাক যুদ্ধের পর পারমাণবিক শক্তি বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে শাস্ত্রীজী এবং
ডঃ ভাবা সহ বিজ্ঞানীমহলে আরও তৎপরতা দেখা দিল। সেই গবেষণায় জোট নিরপেক্ষ ভারতের
পাশে এসে দাঁড়ালো রাশিয়া। ছবিটা হল এরকম - পাকিস্তান পাশে পেল আমেরিকাকে, ভারত
পাশে পেল রাশিয়াকে আর রাশিয়া আমেরিকা মধ্যে চলছে ঠাণ্ডা লড়াই। এরকম এক উদ্বেগজনক
পরিস্থিতির মধ্যে আমেরিকার উদ্বেগ দ্বিগুণ বাড়িয়ে ডঃ ভাবা ৬৫ সালের অক্টোবর মাসে
অল ইন্ডিয়া রেডিওতে এক সাক্ষাৎকারে বললেন জে সরকারীভাবে সবুজ সংকেত পেলে আগামী ১৮
মাসের মধ্যে ভারত পরমাণু বোমা তৈরিতে সক্ষম। সুতরাং ডঃ ভাবা তাঁর প্রতিভা এবং
সুদক্ষ নেতৃত্ববলে সদ্য স্বাধীন হওয়া তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভারতকে পারমাণবিক শক্তিতে
স্বাবলম্বী করে তুলে সক্ষম হয়েছিলেন যেটা শক্তিধর আমেরিকা কোনোভাবেই মেনে নিতে
পারলো না। ফলত, মরতে হল লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে ও তাঁর মৃত্যুর ১৩ দিনের
মাথায় ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবাকেও।
এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ডঃ ভাবার মৃত্যুর তদন্তের অসঙ্গতিকে কেন্দ্র করে সময়ে সময়ে অনেকেই সরব হয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে পুর্বোক্ত ড্যানিয়েল রোশ বলেছিলেন,
“আমি জানি না এটা ষড়যন্ত্র কিনা কারণ ডঃ ভাবা ভারতকে পরমাণু বোমা দান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই সংগ্রহ করা নমুনার ভিত্তিতে যে সত্য উঠে এসেছে তাকে সকলের সামনে তুলে ধরা আমার কর্তব্য বলে আমি মনে করি। যদি ভারত সরকার চায়, আমি সংগ্রহ করা সকল নমুনা এবং নথি ভারত সরকারের হাতে তুলে দেবো।”
কিন্তু ভারত সরকার নির্বিকার। উপায় কি? ২০০৫ সালে ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে পাশে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যৌথ বিবৃতি দিয়ে ইন্দো-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তির কথা বলে এলেন। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত তার সামরিক ও অসামরিক পারমাণবিক দ্রবসম্ভারের পৃথকীকরণ ও অসামরিক পারমাণবিক দ্রব্যসম্ভার আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার নিরাপত্তায় স্থাপন করতে সম্মত হয়, বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সম্পূর্ণ অসামরিক পারমাণবিক সহায়তাদানে সম্মত হয়। এই চুক্তির পর কি করে একজন প্রাক্তন মার্কিন গোয়েন্দা অফিসারের কথাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করবে ভারত সরকার? তাই নতুন করে আর পুরনো জিনিস নিয়ে কেউ ঘাটাঘাটি করতে রাজি হল না। বিশ্বের প্রথম সারির শক্তিধর দেশকে বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়ে হারানোর বাসনা কারই বা থাকে। তাই ডঃ ভাবার মৃত্যু হয়েছে বিমান দুর্ঘটনায় - এই কথাটি আমাদের শেখানো হয় দিনের পর দিন।
দুর্ঘটনা? নাকি
সুপরিকল্পিত হত্যা? ভারতের উত্থানে কেউ শঙ্কিত হয়ে পড়ছিল? সে বা
তারা মনে প্রাণে চায়নি বিশ্বের দরবারে ভারতের পরমাণু শক্তির চির উন্মেষ ঘটুক? পরমাণু
শক্তিধর রাষ্ট্রের স্বীকৃতির সম্ভাবনা মুছে ফেলতে কোন বিকল্প কসুর ছাড়েনি, তাই
বুঝি পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানী ভাবাকে চিরতরে সরিয়ে দেবার অসাধু চক্রান্তের ছক কষা? বিমান
দুর্ঘটনা কি তারই অঙ্গ? তাদের
পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যবনিকা নেমে আসবে ভারতের পরমাণু গবেষণা প্রকল্পে― এ তো জানা কথা, তাহলে
কে বা কারা ভারতের সেই জাতীয় শত্রু?এতো শত প্রশ্ন। ডঃ ভাবার মৃত্যুর এতো বছর
পরেও যেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি; হয়তো কোনোদিনই যাবেনা। ভারতের পরমাণু গবেষণার
জনক তিনি। তাঁর হাত ধরে ভারতে পরমাণু বিজ্ঞানচর্চায় জোয়ার এসেছিল, তাঁর
মৃত্যুতে অচিরেই যার আপাত সলিল সমাধি ঘটেছিল। তবে বোধহয়
একেবারে অস্তমিত হয়ে যায়নি তাঁর সাধের পরমাণু প্রকল্প। সেজন্য তাঁর মৃত্যুর পরে
১৯৭৪ সালে এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ধূলা দিয়ে পুনরায় ১৯৯৮ সালে পরমাণু
শক্তির সফল বিস্ফোরণ ঘটায় ভারত। রাজস্থানের পোখরানে ভারতের ‘স্মাইলিং
বুদ্ধ' আজও হাসিমুখে ডঃ হোমি
জাহাঙ্গীর ভাবা'র সেই অপূর্ণ
স্বপ্নেরই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
তথ্যসূত্রঃ-
১. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা থেকে লালবাহাদুর শাস্ত্রীঃ মৃত্যুর রহস্যকথা – সুরজিৎ দাশগুপ্ত
২. আগন্তুক
৩. Conversations with the Crow – Gregory Douglas
৪. Your Prime Minister is Dead – Anuj Dhar
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন