নিরুদ্দেশের পথিক - কমলেন্দু সূত্রধর

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ( সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রতিকৃতি )


“এই কঠিন বিপদসংকুল পথে যাত্রা করার আগে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস আমি এর ফলাফল সম্বন্ধে নিবিষ্টচিত্তে চিন্তা করেছি। বাইরে না এলেও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ সম্ভব হবে - এমন আশা যদি আমার বিন্দুমাত্র থাকত, তাহলে এই সংকটময় মুহূর্তে আমি কখনওই ভারতবর্ষ ত‍্যাগ করতাম না। যদি আমার মনে একটুও আশা থাকত যে, আমাদের জীবদ্দশায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের এমনি আর একটি সুবর্ণ সুযোগ আমরা পাবো তাহলে বোধহয় আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তাম না।”

- নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু

১.

১৯৪০ সালের ১৮ই জানুয়ারি। রাতের অন্ধকার চিরে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে কালকা মেল। ট্রেনের ভেতরের অধিকাংশ যাত্রীরাই নিদ্রাচ্ছন্ন। কিন্তু ঘুম নেই কেবল একজনের চোখেই। পরনে শেরওয়ানী ও আঁটসাঁট পায়জামা। মাথায় ফেজ। সারা মুখে একদঙ্গল দাড়ি। দেখেই মনে হয় ঠিক যেন কোন খাটি মৌলবি সাহেব। মন অচঞ্চল, স্থির কিন্তু তাঁর দৃষ্টির সজাগ। তাঁর গন্তব্য পেশোয়ার। এমন সময় কামরায় ঢুকলেন এক সম্ভ্রান্ত শিখ ভদ্রলোক। তিনিও অনেক দুরের যাত্রি। “আপনি কোথায় যাবেন সাহেব?”, সহজ, অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন শিখ ভদ্রলোক। “আমি? আমি যাব রাওয়ালপিন্ডি।” চোস্ত উর্দুতে জবাব দিলেন। সচেতন ভাবেই মিথ্যাটা বললেন তিনি। শিখ ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “ওখানেই থাকেন বুঝি?”

- না, দেশ আমার লক্ষ্ণৌতে। পেশায় ইনসিওরেন্স এজেন্ট। তাই মাঝে মাঝে এখানে-ওখানে যেতে হয় কাজের সূত্রেই।

- আপনার নাম?

- জিয়াউদ্দিন। মহম্মদ জিয়াউদ্দিন।


২.

১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। ফ্যুয়েরার হিটলারের নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসে। যে কালো মেঘ ইউরোপ মহাদেশের ঈশান-নৈঋতে সঞ্চিত হচ্ছিল দিন কে দিন, তা যেন সহসা বজ্রবিদ্যুৎ সহ বিদারিত হল। আর এক রক্তক্ষয়ী তুফান গ্রাস করল প্রথমে ইউরোপ, তারপর গোটা বিশ্বকে।

৩রা সেপ্টেম্বর মাদ্রাজে সমুদ্রতীরে প্রায় দুলক্ষ লোকের সামনে উদাত্ত কণ্ঠে বক্তৃতা দিচ্ছেন তিনি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরই ভীড়ের মধ্যে থেকে একটা লোক এগিয়ে এসে তাঁর হাতে একটা সান্ধ্য দৈনিক পত্র ধরিয়ে দিল। খবরের কাগজে চোখ বুলিয়েই চমকে উঠলেন সুভাষ। এ যে দারুণ সুসংবাদ। ইংল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। জার্মানিও নিশ্চয়ই ছেঁড়ে কথা বলবেনা। তাঁর যেমন প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য, নিশ্চই প্রখর সমরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই তো ভারতবর্ষের কাছে সুবর্ণ সু্যোগ। স্বাধীনতা ছাড়া ভারতের আর কী স্বপ্ন আছে! সুভাষ এতোক্ষন নিজের বক্তৃতায় বিদ্রোহের কথাই বলছিলেন। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত, লোহা গরম থাকতে থাকতেই হাতুড়ির ঘা মারা দরকার। সুভাষ তখন স্থিরপ্রতিজ্ঞ। দেশের যা অবস্থা তাতে দেশে বসে থেকে কিছু করা অসম্ভব। অতএব, বাইরে যেতে হবে, হিটলারের হাতে মার খেয়ে ইংরেজ এখন নিজের ঘর সাড়াতে ব্যস্ত। এই অপুর্ব সুযোগটিকে কাজে লাগাতে হবে। প্রচণ্ড আঘাত হেনে ওদের ওই সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু তা এখানে থেকে সম্ভব নয়। ভারত এখন অগ্নিগরভ। বাইরে থেকে যথাযথ ভাবে আঘাত হানতে পারলে ভিতরে মহাবিপ্লবের আবির্ভাব সুনিশ্চিত। সুতরাং সর্বাগ্রে দরকার বাইরে যাওয়া।

ফরোয়ার্ড ব্লকের অন্যতম নেতা সর্দার নিরঞ্জন সিং তালিবকে কথাটা একদিন খুলেই বললেন সুভাষ, “আমি বাইরে যেতে চাই সর্দারজী। এ ব্যাপারে আপনার সহযোহিতা প্রয়োজন। বলুন কী করা যায় এখন।” নিরঞ্জন সিং এই প্রস্তাব জামশেদপুরের বিশিষত ব্যবসায়ী বলদেব সিংকে জানান। শুনতে শুনতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বলদেব সিংয়ের মুখ। এরকম দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা একমাত্র সুভাষ বাবুর মতো লোকের পক্ষেই বুঝি সম্ভব। কিন্তু কাজটা শক্ত, বিপজ্জনকও বটে। অবশ্য তাবলে পিছিয়ে গেলে তো হবেনা। ঝুঁকি নিতেই হবে। তার জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একজন অতি বিশ্বস্ত কর্মী, যিনি এ ব্যাপারে পুরোপুরি দায়িত্ব নিতে সক্ষম। কাকতালীয় ভাবে পাঞ্জাবের ‘কীর্তি কিষান পার্টি’র বিশ্বস্ত কর্মী কমরেড অচ্ছর সিং তখন পলাতক অবস্থায় বলদেব সিংয়ের বাড়িতেই আত্মগোপন করে আছেন। তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখলেই হয়।

ভগৎরাম তলওয়ার

শুনে সানন্দে রাজী হলেন অচ্ছর সিং। তখনই তিনি খবর পাঠালেন কীর্তি কিষান পার্টির কাছে। যথাসময়ে খবর এল। পার্টি এ ব্যাপারে রাজি হয়েছে। কমরেড রামকিষণের উপর যাবতীয় ভার দেওয়া হল। দিন কয়েক বাদে রামকিষণ ও অচ্ছর সিং দুজনেই পেশোয়ারের মর্দান জেলার উদ্দেশ্যে পাড়ী দিলেন। উদ্দেশ্য ‘খেল্লা ডের’ গ্রামে পার্টির কমরেড ভগৎরাম তলওয়ারের সাথে যোগাযোগ করা। ভগৎরাম শুধু কীর্তি কিষান পার্টিরই সভ্য নন, ফরোয়ার্ড ব্লকেরও একজন উৎসাহী কর্মী। পাহাড়ি এলাকার সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। একমাত্র তিনিই পারেন সভাষ বাবুকে নিরাপদে সীমান্তের ওপারে পৌছে দিতে। সুভাষবাবুর কথা শুনেই ভগৎরাম লাফিয়ে উঠলেন। দুরন্ত দুঃসাহসী কর্মী এই ভগৎরাম। বড়ভাই হরিকিষেণ পাঞ্জাব গভর্ণর হত্যার চেষ্টার মামলায় ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছেন। তবুও ভগৎরাম সমান বেপরোয়া। দায়িত্ব বুঝে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠলেন ভগৎরাম। যে করে হোক, সুভাষ বাবুকে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দিতেই হবে। তাঁর স্বপ্ন সার্থক হোক, ভারত স্বাধীন হোক।

৩.

প্রস্তুতি পর্ব প্রায় শেষের মুখে। এমন সময় নেমে এলো বিপর্যয়। হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলনের তারিখ ধার্য করা হয়েছিল ১৯৪০-এর জুলাই মাসের ৩ তারিখ। তাঁর আগের দিন ২রা জুলাই সুভাষকে গ্রেপ্তার করা হল। ৩০ অগস্ট ফরওয়ার্ড পত্রিকায় The day of reckoning’ প্রবন্ধটি লেখার জন্য সুভাষের বিরুদ্ধে আলিপুর ফৌজদারি আদালতে মামলা দায়ের করা হল। বন্দি করা হল লৌহকপাটের অন্তরালে। গোটা ব্যাপারটাই ফলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত হয়ে গেল।



সুভাষকে রাখা হল প্রেসিডেন্সী জেলে। তবে শাপে যেন বর হল। সহবন্দী হিসেবে তিনি সেখানে পেলেন হেমচন্দ্র ঘোষ, সত্যরঞ্জন বক্সী, মণীন্দ্রকিশোর রায়, পরেশ রায় প্রমুখ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার দলের বিপ্লবী নায়কগণকে। ফলে, আবার মন্ত্রণা শুরু হল নতুন করে। কি করা যায় এখন। এতোদুর এগিয়েও কি সব কিছু পণ্ড হবে এমনি করে? অসম্ভব, তা হতে পারে না। কিন্তু সুভাষ যে বিনা বিচারে জেলে বন্দি, ইচ্ছে করলেই তো আর ইংরেজদের কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায় না। অবশেষে জেলেই সত্যরঞ্জন বক্সী ও পরেশ রায়ের সাথে গোপনে শলা পরামর্শ করলেন সুভাষ। বিপ্লবী পরেশ রায় তাঁকে অসুস্থ হওয়ার পরামর্শ দিলেন, একমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী না হলে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কোনো উপায়ই নেই।

ইতিমধ্যেই, ২৮ অক্টোবর সুভাষ জেল থেকেই কেন্দ্রীয় আইনসভায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর একমাস বাদে ২৯ নভেম্বর ঘুম থেকে উঠেই সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে গেল একটি অভাবনীয় খবর শুনে।

মুক্তির দাবীতে সুভাষচন্দ্র বসু অনশন শুরু করেছেন। আমরণ অনশন।


অনশন শুরুর প্রাক্কালে বাংলার গভর্নরকে লেখা সুভাষের চিঠি

প্রতিবাদের ঝড় উঠলো সর্বত্র। বিনা বিচারে সুভাষকে আটকে রাখা যাবেনা। সে দাবীকে আরও জোরালো করে তুললেন সুভাষচন্দের মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসু। বে-আইনি ভাবে সুভাষকে বন্দি করা ও অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবীতে দেশ উত্তাল হয়ে উঠল। অবশেষে ৫-ই ডিসেম্বর,স্বাস্থ্যহানির জন্য মুক্তি দেওয়া হল সুভাষকে, তবে গৃহবন্দি করে রাখা হল তাঁকে। এবার শুরু হল সুভাষের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। কারো সঙ্গে দেখা নয়। এমন কি অন্তরঙ্গ সহচরদের সাথেও নয়। রুদ্ধদ্বার কক্ষে সাধন-ভজন আর ধর্মচর্চার মধ্যেই তিনি নিমগ্ন হয়ে উঠলেন সর্বক্ষণ। আলাদা ঘরে পর্দার আড়ালেই দিন কাটছে তাঁর। তবে ভেতরের আগুন কিন্তু এখনও স্তব্ধ হয়নি। তাকে যেতে হবে, অনেক দূরে যেতে হবে। এ সুযোগ হারালে চলবেনা। কিন্তু আগেকার সেই যোগাযোগ এতোদিনে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কোথায় সেই দুরন্ত দুঃসাহসী কর্মী ভগৎরাম? বিরাট এই ভারতবর্ষের বিপুল জনসমুদ্রের মাঝে কিভাবে পাওয়া যাবে তাকে?

শুরু থেকে আবার শুরু করা হল। এবার যোগাযোগ করা হল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিশিষ্ট ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা পেশোয়ারের আকবর শাহের সঙ্গে। সুভাষের সেই একই বক্তব্য, একই দাবী, দেশের স্বার্থেই তাকে দেশ ছেড়ে পাড়ি দিতে হবে অজানার উদ্দেশ্যে। কিন্তু একজন বিশ্বস্ত লোক চাই, চাই এমন একজন দুঃসাহসীকে যে সমস্তকিছু তুচ্ছ করে তাকে সীমান্ত পারও করে দিতে পারবে। অনেক খুঁজে পাওয়াও গেল একজন কে। তাঁকে পরখ করে দেখে খুশিই হলে আকবর শাহ। কিন্তু কি আশ্চর্য! খুঁজে খুঁজে যে ব্যক্তিটিকে শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত হিসেবে নির্বাচিত করলেন আকবর শাহ, সেই দুরন্ত দুঃসাহসী কর্মী স্বয়ং ভগৎরাম ছাড়া আর কেউ নন। সুভাষের মতোই ভগৎরামের মুখেও সেই একই ধ্বনি, “জবান দিচ্ছি, আমি নিজে তাকে কাবুল পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আসব, সুভাষবাবুর জন্য জান কবুল।” ভগৎরামের সুত্রেই এই বৃহৎ পরিকল্পনায় আবার ফিরে এল পাঞ্জাবের কীর্তি কিষান পার্টি।

মিঞা আকবর শাহ

ওদিক থেকে কলকাতাতেও তৎপরতার অন্ত নেই। ইতিমধ্যেই কীর্তি কিষাণ পার্টির তিনজন সদস্য চলে এসেছেন কলকাতায়। সত্যরঞ্জন বক্সীর মারফত বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নেতৃস্থানীয় ও সুভাষচন্দ্র বসুর অন্যতম বিশ্বাসভাজন বিনয় সেনগুপ্ত তাঁদের সাথে যোগাযোগ করলেন। ঠিক হল দিন সাতেক বাদে এখান থেকে একজনকে যেতে হবে লাহোরে। তাঁর সুত্রেই ভবিষ্যতের কর্মপন্থা সম্বন্ধে সব কিছু জানিয়ে দেওয়া হবে বিস্তারিতভাবে।

নির্দিষ্ট দিনে দলের একজন কর্মী লাহোরে গেলেন ছদ্মবেশে, ছদ্মনামে, ছদ্মপরিচয়ে। দিনতিনেক পরেই কর্মীটি গিরে এলেন যাবতীয় আলাপ আলোচনা শেষ করে। খবর শুভ। কলকাতা থেকে কাবুল যাবার সমস্ত প্ল্যান প্রস্তুত। এমন কি দিন-তারিখও ঠিক হয়ে গেছে। কীর্তি কিষাণ পার্টির সভ্যদের মধ্যে কে, কবে, কোথায় সুভাষকে রিসিভ করে কাবুল সীমান্ত অবধি পৌছে দেবেন, তাও একেবারে পাকা। এখন শুধু অপেক্ষা মাত্র।

৪.



জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নিজের ঘরে সুভাষ

এক দুপুরে পরিচারককে দিয়ে তরুণ শিশিরকে ডেকে পাঠালেন সুভাষচন্দ্র। কিছুক্ষণ পরেই এলগিন রোডের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন শিশির। রাঙাকাকাবাবুর ঘরে পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছেন সুভাষচন্দ্র। শিশিরকে দেখেই নিজের ঘরটা খালি করিয়ে দিলেন সুভাষ। ভাইপোকে বিছানায় তাঁর পাশে বসতে বললেন সুভাষ। তারপর কয়েক মুহূর্ত তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আমার একটা কাজ করতে পারবে?’’ দ্বিধান্বিত ভাবে মাথা নাড়লেন শিশির। ‘‘তুমি কেমন গাড়ি চালাতে পারো?’’ রাঙাকাকাবাবুর প্রশ্ন শুনে শিশির জবাব দিলেন, ‘‘এই, একরকম মোটামুটি ভালই পারি।’’ সুভাষচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কখনও লং ডিসট্যান্স গাড়ি চালিয়েছো?’’ শিশির জবাব দেন, ‘‘না।’’ রাঙাকাকাবাবু এবার ভাইপোকে বলেন, ‘‘দেখো, একদিন রাত্রে তোমাকে গাড়ি করে আমাকে বেশ কিছু দূরে পৌঁছে দিতে হবে। কেউ কিন্তু জানতে পারবে না। পারবে?’’ কোন কথা না বলে মাথা নাড়লেন শিশির। আর একে সুভাষ সম্মতি হিসেবেই ধরে নিলেন সুভাষ। রাঙাকাকাবাবু সেদিনই ভাইপোকে জানালেন, তিনি গোপনে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছেন। এলগিন রোডের বাড়িতে সেকথা শুধুমাত্র জানবে শিশিরের খুড়তুতো বোন ইলা। এসব কথা বলার পর শিশিরকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন সুভাষচন্দ্র। বললেন পরদিন সন্ধেয় আসতে। এ বিষয়ে আলোচনা হবে।



মহানিষ্ক্রমণের কয়েকদিন আগে এলগিন রোডের বাড়ীতে সুভাষ; সঙ্গে কলকাতার তৎকালীন মেয়র আবদুর রহমান সিদ্দিকি, দাদা সতীশচন্দ্র এবং মা প্রভাবতী দেবী।


পরদিন সন্ধেয় এলগিন রোডে ফিরে এলেন শিশির। শুরু হল সুভাষচন্দ্রের জীবনে একটি নতুন অধ্যায় শুরুর প্রস্তুতি। এলগিন রোডের বাড়ি থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, তার নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বললেন দু’জনে। সামনে এল বেশ কয়েকটা পরিকল্পনা। প্রথম প্রস্তাব, সুভাষচন্দ্র খোলাখুলি ভাবে ঘোষণা করবেন, শরীর সারানোর জন্য উনি কলকাতা থেকে ষোল মাইল দূরে গঙ্গার ধারে রিষড়াতে দাদার বাগানবাড়িতে গিয়ে থাকবেন। তারপর শিশির কোনও এক রাতে সেখান থেকে মোটর গাড়ি করে তাঁকে বর্ধমান বা আসানসোল পৌঁছে দেবেন।

দ্বিতীয় পরিকল্পনা, সুভাষচন্দ্র ঘোষণা করেই এক নম্বর উডবার্ন পার্কের বাড়িতে গিয়ে উঠবেন আর তিনতলায় ছাদের দিকের একটা ঘরে থাকবেন। অজুহাত হবে, শরীর সারানোর জন্য যথেষ্ট আলো-হাওয়া দরকার, এলগিন রোডের বাড়িতে যা পাওয়া যাচ্ছে না। সুভাষ ভেবেছিলেন, তিনি যদি উডবার্ন পার্কে থাকেন তা হলে নিশ্চিন্ত মনে পালানোর পরিকল্পনা করতে পারবেন। এত আত্মীয়-পরিজন ও তাঁর বৃদ্ধা মা-র চোখে ধুলো দেবার ব্যবস্থা করতে হবে না।

কিন্তু দু’টো পরিকল্পনাই বাতিল হয়ে গেল। শিশির পাল্টা যুক্তি দিয়ে বললেন, এভাবে বাড়ি থেকে বের হলে পুলিশ জানতে পারবে, সুভাষচন্দ্র বসুর এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাবার মতো স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। তারা তখন আরও সতর্ক হয়ে যাবে। কারণ, জেল থেকে ছাড়া পাবার পর সুভাষ ঘর থেকেই বার হচ্ছিলেন না। তার ফলে সকলের, বিশেষ করে পুলিশের ধারণা হয়েছিল, তিনি বড় রকমের কোন কাজে হাত লাগাতে পারবেন না। শিশির আরও বললেন, উডবার্ন পার্কে তাঁদের বাড়িতে সব ব্যাপারে কড়াকড়ি আর শৃঙ্খলা। প্রত্যেক গেটে লোক দাঁড়িয়ে থাকে, দারোয়ান ঠিক সময়ে গেট বন্ধ করে ইত্যাদি। আর এলগিন রোডের বাড়িতে সব কিছু ঢিলেঢালা। ফলে রাঙাকাকাবাবুর সেখানে থাকাটাই সুবিধাজনক। ভাইপোর যুক্তি মেনে নিলেন সুভাষচন্দ্র। এখন তৃতীয় একটি সম্ভাবনার কথাও ভাবা হল। শিশিরের বড়দাদা ডাঃ অশোকনাথ বসু ধানবাদের কাছে কাজ করেন। তিনি মাঝে মাঝে নিজের মোটর গাড়িতে কলকাতায় আসেন। ভাবা হল, অশোকনাথ কলকাতা থেকে ধানবাদ ফিরে যাবার সময় রাঙাকাকাবাবুকে ওঁর গাড়িতে লুকিয়ে চাপিয়ে দিতে পারেন শিশির। কিন্তু সেই পরিকল্পনাও বেশি দূর এগোলো না। কারণ, তখন বাড়ির অন্যান্যরা অশোকনাথের কাছে গিয়েছেন আর তাঁর কলকাতা আসারও কোন কথা নেই।


শিশির বসু

সব ভেবেচিন্তে ঠিক হল, এলগিন রোডের বাড়ি থেকেই গোপনে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন সুভাষ। সেটা কী ভাবে সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা চলতে লাগল। শুধু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ফাঁকি দেওয়াই নয়। বাড়ির লোকজনও যাতে ক্ষুণাক্ষরে সন্দেহ না করতে পারে, সেদিকেও নজর দেওয়া হল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলোচনায় এমনকি চিঠিপত্রেও সুভাষচন্দ্র বারবার বলতে লাগলেন, তাঁকে শিগগিরই আবার জেলে যেতে হবে। কারণ, যুদ্ধ শেষ না হলে ইংরেজ তাঁকে ছাড়বে না। ফলে তাঁর অনুপস্থিতিতে কাজকর্ম কীভাবে এগোবে— তা নিয়েও কথাবার্তা বলছিলেন তিনি। আলিপুর কোর্টে সুভাষের বিরুদ্ধে দু’টো মামলা চলছিল। একটা রাজদ্রোহমূলক ভাষণ দেওয়ার জন্য। অন্যটা ফরওয়ার্ড পত্রিকায় লেখা নিয়ে। ভগ্নস্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে আদালতে হাজিরা এড়িয়ে চলছিলেন তিনি। সুভাষ একদিন শিশিরের কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে বললেন, ‘‘সকালে উঠেই গাড়ি চালিয়ে বর্ধমান চলে যাও। তারপর সেখানে স্টেশনের পাশের কোনও দোকানে খাওয়া দাওয়া করেই কলকাতা ফিরে এসো। দেখতে চাই, কতটা ধকল তুমি সহ্য করতে পারো।’’ সেই মতো নিজের গাড়ি চালিয়ে বর্ধমানে গেলেন শিশির। ফিরে এসে রিপোর্ট দিলেন, তাঁর অবস্থা ঠিকই আছে।

এরই মধ্যে একদিন রাঙাকাকাবাবুর কাছে গিয়ে শিশির দেখেন, ঘরভর্তি লোকজন। ভাইপোকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতরে ডাকলেন সুভাষ। তারপর একজন সুদর্শন পাঠানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, “ইনি মিয়া আকবর শাহ”। রাতেই মিয়াসাহেব দেশে ফিরে যাচ্ছেন। সুভাষচন্দ্র তাই তাঁর সেক্রেটারিকে আগেই হাওড়া স্টেশনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন রেল টিকেট ও রিজার্ভেশনের ব্যবস্থা করতে। শিশিরকে সুভাষচন্দ্র বললেন, “তোমার গাড়িতে করে মিয়াসাহেবকে প্রথমে কেনাকাটার জন্য বাজারে নিয়ে যেতে হবে। তারপর তাঁর হোটেল থেকে মালপত্র তুলে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেবে।” এসঙ্গেই সতর্ক করলেন, শিশির কোনওভাবেই যেন স্টেশনের ভিতরে না যায়। তাঁর সেক্রেটারিই হাওড়া স্টেশনের সামনে থাকবেন। তিনিই মিয়াসাহেবকে রওনা করে দেবেন।

সেদিন গাড়ির পিছনের সিটে বসে মিয়াসাহেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন শিশির। মিয়াসাহেব জানালেন, সুভাষচন্দ্র তাঁর ওপর সীমানা পার করার দায়িত্ব দিয়েছেন। আর এ প্রান্তে সাহায্যকারী হিসাবে শিশিরকে বেছে নিয়েছেন। শিশিরকে মিয়াসাহেব বললেন তাঁকে ধর্মতলার ওয়াছেল মোল্লার দোকানে নিয়ে যেতে। নেতাজির ছদ্মবেশের জন্য উনি টুপি আর পাজামা কিনবেন। তরুণ শিশিরকে মিয়াসাহেব এবার ফিসফিস করে বললেন, তিনি যখন হাওড়া স্টেশনে নেমে যাবেন তখন ইচ্ছাকৃত ভাবে প্যাকেটটা ভুলে ফেলে যাবেন। শিশির যেন সেটা বাড়িতে নিয়ে যায়। শিশিরের মনে পড়ল, রাঙাকাকাবাবুর ঘরে দর্জির একটা জামা-কাপড় মাপার ফিতে পড়ে আছে।

১, উডবার্ন পার্কের বাড়ি

মিয়া আকবর শাহের সঙ্গে ওয়াছেল মোল্লার দোকানে ঢুকলেন শিশির। উনি কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন, আর দূর থেকে নিরাসক্তভাবে ব্যাপারটা দেখতে লাগলেন শিশির। মিয়াসাহেব এক জোড়া ঢিলে পাজামা আর একটা কালো ফেজ টুপি কিনলেন। প্যাকেটটা অবহেলায় গাড়ির পিছনের সীটে ফেলে রাখা হল। এবার মির্জাপুর স্ট্রীটে যে হোটেলে মিয়া সাহেব উঠেছেন, সেখানে গেলেন দু’জনে। তারপর ওঁর মালপত্র তুলে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে। সেখানে দাঁড়িয়ে সুভাষচন্দ্রের সেক্রেটারি। তিনি মিয়াসাহেবকে নামিয়ে নিলেন। ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে যেতে বললেন শিশির। কিন্তু স্টেশন চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগেই ড্রাইভারের নজরে পড়ল প্যাকেটটা। সে বলল, ‘‘আমি দৌড়ে গিয়ে এখনও প্ল্যাটফর্মে প্যাকেটটা পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।’’ কিন্তু শিশির এমন ভাব দেখালেন যে এসব ঝামেলা তার ভাল লাগছে না ৷ পরে ডাক মারফত ভদ্রলোককে জিনিস পাঠিয়ে দিলেই চলবে। ড্রাইভারকে সোজা বাড়িতে যাওয়ার জন্য বললেন শিশির। গাড়ি প্যাকেটটি নিয়েই হাওড়া স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

এরপর একদিন হাতে কিছু টাকা দিয়ে ভাইপোকে আরও কয়েকটা জিনিস কেনার দায়িত্ব দিলেন সুভাষ। হ্যারিসন রোডের দোকান থেকে একটা মাঝারি সাইজের স্যুটকেস, একটা অ্যাটাচি কেস, বিছানার জন্য হোলড-অল্ কিনলেন শিশির । স্যুটকেস ও অ্যাটাচি কেসের উপর M. Z. অক্ষর দু’টি লিখিয়ে নিলেন। নিউ মার্কেট থেকে কেনা হল একজোড়া ফ্লানেলের শার্ট আর টয়লেটের জিনিসপত্র। কাকার নির্দেশে সব দেশি জিনিস ত্যাগ করে কেবল ব্রিটিশ কোম্পানির মালপত্র কিনলেন শিশির। বালিশ, বিছানার চাদর, লেপ ইত্যাদি জোগাড় করলেন চাঁদনী চক থেকে। তবে সুভাষচন্দ্র যে ধরনের সুগঠিত কাবুলী চপ্পল চাইছিলেন, তা পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল। শেষ পর্যন্ত নিউ মার্কেটের একটা চীনা দোকান থেকে এক জোড়া চপ্পল কিনে ফেললেন শিশির। সুভাষচন্দ্রের গরম জামাকাপড় রাখা উডবার্ন পার্কের বাড়িতে। সেগুলিও আনানো হল জেলে গেলে প্রয়োজন হবে— এই অজুহাতে। জামাকাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছাড়া, অ্যাটাচি কেসে ঢোকাবার জন্য শিশিরের হাতে দু’কপি পবিত্র কোরান, কিছু ওষুধ, মৃতসঞ্জীবনী সুধা, ভাজা মশলার কৌটো দিলেন সুভাষচন্দ্র।

রাঙাকাকাবাবুর জন্য ভিজিটিং কার্ড ছাপাতে গিয়েও অভিনয় করতে হল শিশিরকে। কার্ডে কী লেখা থাকবে, তা নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। বললেন, তাঁর হাতের লেখাটা নষ্ট করে ফেলতে হবে। আর শিশির যখন ভিজিটিং কার্ডের অর্ডার দেবে, তখন যেন মনে হয়, নিজের জন্যই দিচ্ছে। ফলে একদিন সন্ধেবেলা স্যুট পরে, মাথায় ফেল্‌ট হ্যাট দিয়ে সাহেব সেজে বাড়ি থেকে বের হলেন শিশির। সে সময়ে কম বয়সি ছেলের পক্ষে এই ধরনের পোষাক পরার প্রচলন ছিল না। বাড়ি থেকে বার হবার মুখেই এক মাসতুতো দাদার সঙ্গে দেখা। তাঁকে মিথ্যে বলতে হল। শিশির জানালেন, ডিনারের নেমতন্ন আছে— তাই এমন পোশাক পরতে হয়েছে। তারপর চৌরঙ্গী থেকে ট্যাক্সি নিয়ে রাধাবাজার। একটি দোকানের কাউন্টারে বসা লোকটির সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে কার্ডের অর্ডার দিলেন। কার্ড নেবার দিনেও একই ভাবে সেজেগুজে ডেলিভারি নিলেন ও কার্ড মালিকের হাতে সেসব পৌঁছে দিলেন। ভিজিটিং কার্ডে লেখা হল-

MOHD. ZIAUDDIN

Travelling Inspector,

The Empire of India Life Assurance Co. Ltd.

Permanent Address:

Civil Lines

Jubbulpore

রাঙা কাকাবাবুর মালপত্র চুপিচুপি উডবার্ন পার্কে নিজের তিনতলার ঘরে জমা করছিলেন শিশির। সে-সময় তাঁর বাবা, মা কলকাতার বাইরে থাকায় মালপত্র তুলতে কোনও অসুবিধা হয়নি। এবার আলোচনা হল কোন গাড়িটা নেওয়া হবে, তা নিয়ে।

মহানিষ্ক্রমণের গাড়িঃ ১৯২৪ অটো ইউনিয়ন ওয়ান্ডারার W24

শিশিরদের দু’টো গাড়ি। একটা খুব বড় স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট— মায়ের নামে রেজিস্ট্রি করা। অন্যটা জার্মান গাড়ি— ওয়ান্ডারার। সেটা শিশিরের নামেই রেজিস্ট্রি করা রয়েছে। এলগিন রোড থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার জন্য সেই গাড়িটাকেই বেছে নেওয়া হল। যাত্রাপথে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেজন্য সেই গাড়ির সবকিছু চেক আপ করালেন শিশির। তারপর ধানবাদে দাদা অশোকনাথের বাড়িতে চলে গেলেন। সেই জায়গাটা আর রাস্তাঘাট দেখার প্রয়োজন ছিল। সুভাষচন্দ্রের নির্দেশ মতো সেবার ফিরে আসার সময় দাদাকে শিশির বললেন, ‘‘রাঙাকাকাবাবুর কোনও কাজে কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে এদিকে আসতে হবে, তখন আবার আসবো।’’

এলগিন রোডের বাড়ি থেকে সুভাষচন্দ্র কীভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন— সব স্থির হয়ে গেল। একরাতে বিরাট আয়নায় পশ্চিমি মুসলমানের পোশাক পরে নিজেকে দেখলেন সুভাষ। পরদিন শিশির আসতেই উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘‘ছদ্মবেশ খুব ভাল হয়েছে, ভিড়ের মধ্যেও কেউ আমাকে চিনতে পারবে না!’’ রাঙাকাকাবাবুর কথা শুনে হাসলেন শিশির। সাহস করে বললেন, ‘‘যত ছদ্মবেশই থাকুক না কেন, সুভাষচন্দ্র বোসের চেহারা ও ব্যক্তিত্বকে লুকনো সম্ভব নয়।’’

কথাটা শুনে যেন কিছুটা হতাশ হলেন সুভাষ। তারপর জানালেন সকলের চোখে ধুলো দিতে তাঁর নতুন পরিকল্পনার কথা। ব্যাপারটা হল, তিনি ঘোষণা করবেন যে কিছুদিনের জন্য লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছেন। এই স্বেচ্ছাকৃত অবসর-ব্রত যাপনের সময় তিনি কারও সঙ্গে দেখা করবেন না, কথাও বলবেন না। তাঁর ঘরের মধ্য দিয়ে দু’টি পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে, যাতে ঘরের উত্তর দিকটা সম্পুর্ণভাবে আলাদা হয়ে যায়। তিনি ঘরের সেই দিকটায় থাকবেন এবং তাঁর ব্রত উদ্‌যাপন করবেন। সময় মতো তাঁর খাবার পর্দার তলা দিয়ে ঠেলে দিতে হবে। খাবেন নিরামিষ— তরকারি, দুধ, ছানা, মিষ্টি আর ফল। তিনি চলে যাওয়ার পর ইলাকে এই ভাওতাটা চালিয়ে যেতে হবে। খাবারগুলো খেয়ে নিতে হবে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে।

যাত্রার সেই বহু প্রতীক্ষিত দিনটি কাছে এসে যাচ্ছে। ঠিক হয়েছে, সদর দরজা ব্যবহার না করে বাড়ির পিছনে রান্নাঘরের যে ছোট সিড়ি রয়েছে— সেটা দিয়েই নীচে নামা হবে। কিন্তু শিশিরের ডাক্তার কাকাবাবুর অ্যালসেশিয়ান কুকুরটি আবার রাত্রে সেখানে ছাড়া থাকে, তাই সমস্যা হতে পারে। তাই রাঙাকাকাবাবুর তরফ থেকে ইলা ডাক্তার কাকাবাবুকে গিয়ে বলল, রাতের দিকে কুকুরটা বেঁধে রাখলে ভাল হয়। কারণ, অনেকেই রাত করে রাঙাকাকাবাবুর কাছে যাওয়া-আসা করেন। কুকুর বাঁধার ব্যবস্থা হল। রাতে বাড়ির বাইরে কোন আলো জ্বালানো থাকে না। সেটা কিছুটা স্বস্তির ব্যাপার। সুভাষচন্দ্রকে অবশ্য একটা দীর্ঘ করিডর পার হয়ে যেতে হবে। তাতে আশপাশের বাড়ি থেকে দেখে ফেলার ভয় থাকবে। বাড়ির বাইরে সাদা পোশাকে পুলিশের লোকেরা নজরদারি করে— দিনকতক তাদের হাবভাবের উপর নজর রাখলেন শিশির। রাঙাকাকাবাবুকে জানালেন, গোয়েন্দারা মনে হয় এখন বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছে। একটু রাত হলেই তারা কাজে ঢিলে দিচ্ছে। এখন শুধু দেখতে হবে, গাড়ি করে যখন তাঁরা বেরিয়ে যাবেন, তখন গেটের কাছাকাছি কেউ না থাকে।

১৬ জানুয়ারি। রাত আটটা নাগাদ এলগিন রোডের বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলেন শিশির। উডবার্ন পার্কের বাড়ির গ্যারেজ থেকে ওয়ানডারার গাড়িটা বের করে এনে প্যানট্রির দরজার সামনে এনে রাখলেন। মালপত্র ভাগে ভাগে এনে আগেই তাতে তুলে নিয়েছেন। এবার গাড়ি বারান্দায় এসে পরিচারককে বললেন, ‘‘রিষড়ার বাগানবাড়িতে যাচ্ছি। দেরি হয়ে গেলে রাত্রিটা ওখানেই কাটাবো। রাত এগারোটা পর্যন্ত দেখে গেট বন্ধ করে দিও।’’ এবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোডের একটা পেট্রল পাম্পে ঢুকে তেল ভরলেন। চাকার প্রেশার, ব্যাটারি চেক করে সোজা এলগিন রোড। গাড়িটি পার্ক করলেন বাড়ির পিছন দিককার সিড়ির কাছে।

বাড়িতে ঢুকে শিশির দেখেন, সুভাষচন্দ্র জামাকাপড় ছেড়ে সিল্কের ধুতি ও চাদর পরে নিচ্ছেন, নির্জনবাসের যে ব্রত তিনি গ্রহণ করবেন বলে ঘোষণা করেছেন, সেই ব্রত শুরু করার আগে মা ও পরিবারের অন্যদের সামনে উনি শেষবার আহার গ্রহণ করবেন। ইলা, তাঁর জেঠতুতো দাদা দ্বিজেন ঘরে পর্দা লাগাবার ব্যবস্থা করছে। ঘরের উত্তর প্রান্তে মাটিতে বসে সুভাষচন্দ্র তাঁর বিশেষ আহার গ্রহণ করলেন । তাঁকে ঘিরে মা, বউদিরা আর ভাইপো-ভাইঝির দল– শিশিরও সেখানে গিয়ে বসলেন। খাওয়া শেষ হলে সবাই চলে গেলেন একে একে। তাঁরা ঘুণাক্ষরেও জানলেন না রাতে কী ঘটনা ঘটতে চলেছে।

সুভাষের মুখ থমথমে, তবু তিনি নিজেকে সংযত রেখেছিলেন। রাত্রি ক্রমশ গভীর হলে বাড়ির সবাই তিনতলায় যে যার ঘরে শুতে গেলেন। সুভাষচন্দ্রের ঘরের পাশেই নিজের শোবার ঘরে চলে গেলেন তাঁর মা। কিন্তু শিশিরের দুই জ্যাঠতুতো ও খুড়তুতো দাদা কেবলই ঘুরঘুর করতে লাগলেন। ইলার শোবার ঘরে তাদের একজনের সঙ্গে বসে রেডিও শুনতে লাগলেন শিশির। নানারকম গালগল্প করে তাঁকে ভুলিয়ে রাখার ও ক্লান্ত করে দেবার চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি শুতে যাবার জন্য উঠে পড়লেন, শিশিরও বাড়ি ফিরে যাবার ভান করলেন। তখন অন্য দাদাটির মনে সন্দেহ কাজ করছিল। শিশিরকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এত রাত অবধি বাড়ি যাচ্ছে না। আর একবার প্রশ্ন করলেন, শিশির আজ গাড়ি নিয়ে এসেছে কেন। একবার উপরতলায় নিজের ঘরে চলে গিয়েও একটু পরে ফিরে এলেন দাদাটি। একবার তো শিশির বাড়ি যাচ্ছেন বলে নীচে নেমে এসে ফের চুপিচুপি ওপরে ওঠার সময় তাঁর সামনাসামনি পড়ে গেলেন। এদিকে চঞ্চল হয়ে উঠেছেন সুভাষচন্দ্র। শেষপর্যন্ত দ্বিজেনকে ডেকে তিনি বললেন, সন্দেহগ্রস্ত দাদাটিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুতে এবং যেমন করে পারে আটকে রাখতে।

বাড়ির পরিস্থিতি অনুকূলে আসতেই বাইরে যাবার লম্বা টানা করিডর ও বাড়ির পিছন দিককার সিড়ি আর একবার দেখে নেওয়া হল। নাা, সব ঠিক আছে। ঘরের পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে সুভাষচন্দ্র এবার মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের পোশাক পরে নিলেন। বাদামী রঙের গলাবন্ধ লম্বা কোটের সঙ্গে ঢোলা পায়জামা আর মাথায় কালো ফেজ টুপি। তবে ছদ্মবেশের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তে একটা পরিবর্তন করলেন তিনি। শিশিরকে বললেন, বাজার থেকে কেনা কাবুলী চপ্পল জোড়া পরে হাঁটা-চলা করা তাঁর পক্ষে কষ্টকর। তাই পুরোনো ফিতে বাঁধা মজবুত যে জুতো ইউরোপে ব্যবহার করতেন, সেটাই পরে নিচ্ছেন। আর যে চশমাটা তিনি সে সময় পরতেন, সেটা ছেড়ে রেখে বছর দশেক আগের রোল্ডগোল্ডের ফ্রেমওয়ালা গোল কাঁচের চশমাটা সঙ্গে নিলেন। বললেন, যখন একলা থাকবেন বা অন্ধকারে, তখন চশমা ব্যবহার করবেন, নয়তো চশমা ছাড়াই চলবেন। বিরাট বলিষ্ঠকায় এক পাঠান যুবকের আড়ালে এত দিনকার চেনা সুভাষ যেন নিঃশেষে হারিয়ে গেছেন। মনে হয় এ যেন কোন ভিন্ন সত্ত্বা, চেনাই যায় না।

দ্বিজেনকে ভার দেওয়া হয়েছিল, গেটের কাছে সিআইডি-র কেউ রয়েছে কি না, তা দেখার। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই গলা খাঁকারি দিয়ে সংকেত দেবে সে। পথ পরিষ্কার দেখে শেষপর্যন্ত রওনা দেওয়ার কথা ভাবলেন সুভাষচন্দ্র। পর্দার এপাশে এসে ইলার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তারপর তাঁকে বললেন, তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরও যেন তাঁর ঘরের আলো জ্বালানো থাকে। এবার শিশিরকে সঙ্গে নিয়ে দেওয়াল ঘেঁষে করিডর দিয়ে পা টিপে টিপে হেঁটে এলেন সুভাষচন্দ্র। সতর্ক তাঁরা, বাইরে ফুটফুটে জোৎস্নায় দেওয়ালে যেন কোনও ছায়া না পড়ে। নিঃশব্দে গাড়িতে উঠলেন সুভাষ। পাছে শব্দ হয়, সেজন্য গাড়ির দরজাটা না লাগিয়ে ধরে বসে রইলেন। এবার গাড়িতে উঠে বসলেন শিশির। ১৭ই জানুয়ারি রাত তখন একটা বেজে পঁচিশ মিনিট নাগাদ গাড়ি বেরিয়ে গেল এলগিন রোডের বাড়ি থেকে।

রাঙাকাকাবাবু শিশিরকে বলে দিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে যেতে হবে, যদিও তাঁদের গন্তব্য উত্তরে। তাই ডান দিকে মোড় নিয়ে এলগিন রোড ছেড়ে আবার ডান দিকে ঘুরল গাড়ি। এলেনবি রোড দিয়ে ফের ডান দিকে এগোল। মনে গচ্ছিল, কাছাকাছি কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। এলগিন রোড ও উডবার্ন রোডের মোড়ে তক্তাপোশ কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে সিআইডি-র লোকেরা। তাদের অজান্তেই পাখি উড়ে গেল। একটু একটু করে ছোট হতে হতে গাড়িটা একসময় মিলিয়ে গেল কুয়াশাচ্ছন্ন গাঢ় অন্ধকারের আড়ালে।

মহানিষ্ক্রমণের যাত্রাপথ

এলেনবি রোড ধরে খানিকটা এগিয়ে বাঁ হাতে জাস্টিস চন্দ্রমাধব রোড, তারপর ল্যান্সডাউন রোডে পড়ল গাড়ি। সুভাষচন্দ্র সেই যে গাড়ির দরজা ধরে বসেছিলেন, এলেবি রোডে পড়বার পর তিনি সেটি বন্ধ করলেন। ল্যান্সডাউন রোড ধরে উত্তরে ঘুরে লোয়ার সার্কুলার রোড। কিছুক্ষণ পর পরই শিশির নজর রাখছিলেন, কোন গাড়ি তাঁদের অনুসরণ করছে কিনা। পরদিন সকালেই ধানবাদে পৌঁছনোর কথা ছিল। কিন্তু এত দেরি করে বের হওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়ছিলেন শিশির। লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে এসে শিয়ালদার কাছে গাড়ির গতি কমিয়ে দিতে হল। কারণ, এক ঝাঁক ঘোড়ার গাড়ি রাস্তায় ইতস্তত ঘুরছে। এরা গাড়ির গতি কমিয়ে দেবে ভেবে অস্থির ভাবে টর্চের আলো ফেলে ড্যাশবোর্ডে রাখা ঘড়িতে সময় দেখলেন শিশির। রাঙাকাকাবাবু বললেন, ‘‘টর্চের আলো ফেলো না। ড্যাশবোর্ড থেকে আলো আমার মুখে এসে পড়ছে।’’ হ্যারিসন রোড ধরে এগিয়ে যেতে যেতে দু’জনে দেখলেন সারা কলকাতা ঘুমোচ্ছে। হাওড়া ব্রিজের কাছে গোটা দু’য়েক ট্যাক্সি আর কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি চোখে পড়ল। বালি ব্রিজে উঠলে টোল দিতে হবে। পয়সা নিতে সেখানকার কর্মীরা কাছাকাছি এসে যাবে। সেকথা ভেবে বালি ব্রিজের ভাল রাস্তায় না যাওয়ারই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। গাড়ি চলল হাওড়ার এবড়োখেবড়ো পথ দিয়ে। শিল্প এলাকা পার হওয়ার পথে মাঝে পথে পড়ল পুলিশ। তারা চলন্ত গাড়ির দিকে চেয়ে রইল নির্লিপ্ত ভাবে। গাড়ি দ্রুতগতিতে চলছে, একে একে পেড়িয়ে যাচ্ছে কলকাতা, তারপর হাওড়া... বেলুড়... বালি... উত্তরপাড়া... চন্দননগর...

আসবার সময় ইলা কফি বানিয়ে দিয়েছে। থামোর্ফ্লাক্স থেকে সেই কফি খেলেন দু’জনে। হঠাৎই রাঙাকাকাবাবু শিশিরকে বললেন, ‘‘আজ রাতে বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান একটু হলে আমি বাতিল করে দিতাম।’’ পরিবারের কয়েকজনের কাছে তাঁর গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হয়েছে— সেটা বুঝেই এমন কথা ভেবেছিলেন সুভাষ। বর্ধমানের কাছে রেলের বন্ধ লেভেল ক্রসিং-এ হঠাৎ ব্রেক কষায় পেট্রল বেশী এসে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। উৎকন্ঠিত হয়ে উঠলেন সুভাষ। শিশির তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘‘দু-এক মিনিট অপেক্ষা করলেই ঠিক হয়ে যাবে।’’ গাড়ি স্টার্ট নিল। কিন্তু তার পরেও বিপত্তি। ট্রেন চলে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু লেভেল ক্রসিং-এর গেট আর খোলে না। শীতের রাত। লেভেল ক্রসিংয়ের লোকটি ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ি থেকে নেমে দরজায় ধাক্কাধাক্কি হাঁকডাক করে লোকটিকে প্রায় টেনে বার করলেন শিশির।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। সুভাষচন্দ্র বুঝিয়ে দিলেন, বারারিতে ভাইপো অশোকনাথের বাড়িতে উনি কীভাবে ঢুকবেন আর ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট হিসাবে কী অভিনয় করবেন। হঠাৎই তাঁদের চলে আসার ব্যাপারে কিছুই জানেন না অশোকনাথ। শিশির তাঁর দাদাকে কী বলবেন, সেটাও শিখিয়ে দিলেন রাঙাকাকাবাবু।

বর্ধমান পৌঁছতে প্রায় চারটে বেজে গিয়েছিল । বর্ধমানের পর গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিলেন শিশির। গাড়িটাও যতই গরম হল, ততই যেন ভাল চলতে লাগল। একসময় ডাকাতির জন্য কুখ্যাত দুর্গাপুরের জঙ্গলও পার হয়ে গেল। চারপাশে লাল মাটি ও আর বড় বড় গাছ। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। গাড়ি বেশ জোরেই চলছে, হঠাৎই সামনে এসে পড়ল একপাল মোষ। ব্রেক কষে কর্কশ গর্জনে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। একটু হলেই মোষের দলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যেত। মোষগুলি ছত্রভঙ্গ হয়ে গাড়ির চারপাশে দাঁড়িয়ে। তারপর একসময় রাস্তা থেকে নীচে নেমে গেল। শিশিরের বুক ধকধক করছিল। কিন্তু রাঙাকাকাবাবু শান্ত, নির্বিকার।

তাঁরা যখন ধানবাদের পথে, সকালবেলার রোদ উঠে গিয়েছে। শিশিরের এই প্রথম মনে হল, রাঙা- কাকাবাবুর ছদ্মবেশটা সত্যিই ভাল। এখানে রাস্তা সোজা কিন্তু উঁচুনিচু —সমুদ্রের বড় বড় ঢেউয়ের মতো। গাড়িঘোড়া কিছু কিছু চলতে আরম্ভ করেছে। উল্টো দিক থেকে বেশ কয়েকটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে গেল। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে রাস্তা যেখানে ধানবাদের দিকে বেঁকে গিয়েছে তার কিছু আগে গোবিন্দপুর গ্রামে একটা চেকপোস্ট। সেখানে পৌঁছতেই পথ আটকে বাঁশের গেট বন্ধ হয়ে গেল। একটি লোক পাশের ছোট ছাউনি থেকে পেনসিল, নোটবই হাতে তাঁদের গাড়ির দিকে এগিয়ে এল। তারপর লোকটি সরেও গেল, গেট উপরে উঠে গেল। গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলেন শিশির। রাঙাকাকাবাবুকে বললেন, ‘আমাদের গাড়ির নম্বর নিল।’ কথাটা শুনে উদ্বিগ্ন হলেন সুভাষচন্দ্র। শিশিরকে বারবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘ঠিক দেখেছো? নম্বর নিয়েছে?’ তাঁকে আশ্বস্ত করে শিশির বললেন, ‘‘এটা রুটিন ব্যাপার।’’

দিনের আলোয় ধানবাদের মধ্য দিয়ে চলছে গাড়ি। চেনা শহর, যদি দেখে ফেলে— তাই অস্বস্তি। তবে তেমন কোনও চেনা লোক সামনে পড়ল না। এবার ধানবাদ ছেড়ে বারারির পথে ছুটল গাড়ি। দূরে দেখা গেল অশোকনাথের বাড়ি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন দু’জনে। সেদিনের মতো যাত্রা বিরতি। আবার যাত্রা শুরু হবে সুর্যাস্ত হবার পর।

পাশাপাশি ঠিক এক ধরনের দু’টি বাড়ি, একটি অশোকনাথের, অন্যটি এক ইংরাজ অফিসারের। ভুল হলে আর নিস্তার নেই। রাঙাকাকাবাবুকে অশোকনাথের বাড়িটি চিনিয়ে দিলেন শিশির। সকাল আটটা বেজে গেছে। ঠিক ছিল, অশোকনাথের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি থেকে নেমে পড়বেন সুভাষচন্দ্র। আর গাড়ি নিয়ে সোজা বাড়িতে ঢুকে রাঙাকাকাবাবুর আসার ব্যাপারে অশোকনাথকে আগেভাগে খবর দেবেন শিশির। বাড়ি থেকে প্রায় চারশো গজ দূরে গাড়ি থামালেন শিশির। নেমে পড়লেন সুভাষ। তারপর গাড়ি ঢুকে গেল অশোকনাথের বাড়িতে।


বারারিতে শিশির বসুর দাদা অশোক বসুর বাংলো

ওই বাড়িতে তখন কাজ করছিলেন দু’জন। তাঁরা দেখলেন, একাই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন শিশির। অশোকনাথ তখন শোবার ঘরে। দরজায় নক করলেন শিশির। দরজা খুলে ভাইকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন অশোকনাথ। দাদাকে শিশির বললেন, ‘‘রাঙাকাকাবাবুকে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। উনি একটা বিশেষ গোপন মিশনে যাচ্ছেন, ছদ্মবেশে এসেছেন। আমি ওঁকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে এসেছি যাতে আমরা একসঙ্গে এসেছি সেটা কেউ জানতে না পারে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবু এসে পড়বেন।’’ রাঙাকাকাবাবু যে একজন ইন্সিওরেন্স এজেন্ট হিসেবে দাদার সঙ্গে ব্যবসায়িক কথা বলতে চান— সেকথাও জানালেন শিশির। সেই সঙ্গে জানালেন, অশোকনাথকে বলতে হবে— এখন ওঁর কাজে বার হবার সময় হয়ে গিয়েছে, তাই কথাবার্তা বলার সুবিধা হবে না। তখন রাঙাকাকাবাবু বলবেন, তিনি অনেক দূর থেকে আসছেন। কাছাকাছি থাকার জায়গা নেই এবং ফেরার ট্রেনও নেই, ফলে উনি অপেক্ষা করতে চান, কথাবার্তা পরে হবে। আজকের দিনের মতো অশোকনাথের আতিথ্য ভিক্ষা করবেন রাঙাকাকাবাবু। সব কথাবার্তাই হবে ইংরেজিতে আর এমন করে হবে যাতে পরিচারকেরা সব শুনতে পায়। আর রাত্রির পরিকল্পনা নিয়ে তাঁদের মধ্যে পরে কথা হবে।

ওদের কথোপকথন শেষ হতে না হতেই পরিচারক এসে খবর দিল, অপরিচিত পরদেশী একজন লোক অশোকনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। শিশির এমন ভাব দেখালেন যে এতে তাঁর কোনও উৎসাহই নেই। তিনি বউদির সঙ্গে কথা বলতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলেন। বারান্দায় বেরিয়ে ‘অপরিচিত’ আগন্তুকের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন অশোকনাথ। তারপর অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে বসার ঘরে এলেন। পরিচারককে ডেকে বলে দিলেন, আগন্তুক আজকের দিনটা এই বাড়িতেই থাকবেন, বাড়তি শোবার ঘরটায় তাঁর ব্যবস্থা করতে হবে। খাওয়াদাওয়া ঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে।

১৭ই জানুয়ারি, ১৯৪১। গোটা দিন ধরে চলল নাটক। পরিচারককে নানা নির্দেশ দিচ্ছিলেন অশোকনাথ। হঠাৎ শিশির সেই ঘরে ঢুকতেই তিনি আগন্তুকের সঙ্গে তাঁর ‘পরিচয়’ করিয়ে দিলেন। বললেন, এই আমার ভাই শিশির বোস। অতিথিকে বসার ঘরে চা দেওয়া হল, খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হল ঘরে। অশোকনাথ কাজ থেকে ফিরলে বেয়ারার মারফত অতিথি খবর পাঠালেন, এবার একটু কথা বলতে চান । বাইরের বারান্দায় কথাবার্তা হল। আর বসবাব ঘরে নির্লিপ্তভাবে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে লাগলেন শিশির। সুভাষের ঠাই হল বাইরের ঘরে। উপায় কি! হলই বা ইন্সিওরেন্স কোম্পানির একজন শিক্ষিত এজেন্ট, তবু আসলে সে অচেনা অজানা একজন পাঠান। জেনে শুনে তো তাকে অন্দরমঝলে ঠাই দেওয়া যায়না। তাছাড়া, বাংলো ভর্তি চাকরবাকর। কার মনে কি আছে কে বলতে পারে! সুতরাং, সাবধানতা দরকার আছে বৈকি।


আনন্দবাজার পত্রিকা- ২৭ জানুয়ারি, ১৯৪১

সুভাষচন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলেন, আসানসোল নয়, গোমো স্টেশন থেকে তিনি ট্রেন ধরবেন। সেকথা শুনে শিশির বললেন, ‘‘গোমোর রাস্তা আমার অচেনা, আর এমন পথে রাতে গাড়ি ড্রাইভ করতে অসুবিধা হবে। দাদা সঙ্গে গেলে ভাল হয়।’’ সুভাষচন্দ্র রাজি হলেন। কিন্তু অশোকনাথ বললেন, এসব জায়গায় স্ত্রীকে একা ফেলে যাওয়া নিরাপদ নয়। শুনে রাঙাকাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, ওঁকেও সঙ্গে নেওয়া যাবে। পরিচারকদের জানানো হল, অতিথি রাতের ট্রেন ধরবেন, তাঁকে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে হবে। আর রাতেই ভাই আর স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে বের হবেন অশোকনাথ।

শীতের সন্ধ্যায় পরিচারকদের সামনেই লোক-দেখানো বিদায় নিলেন সুভাষচন্দ্র। কথা ছিল— সুভাষচন্দ্র যে পথে এসেছেন কিছু দূর গিয়ে সেই পথেই অপেক্ষা করবেন। অশোকনাথরা তিনজন একটু পরে গাড়ি নিয়ে তাঁকে তুলে নেবেন। টর্চ হাতে এগোচ্ছিলেন সুভাষ। অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি এসে তুলে নিল ছদ্মবেশীকে। রাস্তা চিনিয়ে দিচ্ছিলেন অশোকনাথ। গাড়ি চালাচ্ছিলেন শিশির। ত্রিশ মাইল পথ। তবে হাতে অনেক সময়। কালকা মেল গোমো স্টেশনে আসে মধ্যরাত্রির পর। ধীরে সুস্থেই গাড়ি নিয়ে এগোচ্ছিলেন ওরা। রাস্তার এক পাশে গাছের নীচে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল ওরা। দ্বিতীয়বার গাড়ি থামল গোমোর কাছাকাছি। চারিদিকে ধানের ক্ষেত চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। কিছু দূরে আবছা আলোয় চোখে পড়ছে পরেশনাথ পাহাড়।

গোমো জংশন। একপাশে উঁচু পাহাড়ের সারি। নীচ দিয়ে এঁকেবেঁকে রেললাইন চলে গেছে বহুদুর পর্যন্ত। স্টেশনের বেশ খানিকটা দূরে অন্ধকারে আত্মগোপন করে অপেক্ষমান একটি গাড়ি। ভেতরে মোট চারজন যাত্রী। হাওড়া থেকে আগত দিল্লী-কালকা মেলের তখনও অনেকটা দেরি। মনে হয় আরও ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করতে হবে।

যুগান্তরঃ ২৮ জানুয়ারি, ১৯৪১


ঘুমন্ত গোমো জংশনটা জেগে উঠল মধ্যরাত্রিতে। গাড়ির সময় হয়েছে, এরই মধ্যে ইঞ্জিনের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে প্ল্যাটফর্ম। আস্তে আস্তে প্রাইভেট গাড়িটা এবার এগিয়ে এল স্টেশনের দিকে। গোমো স্টেশন চত্বরে যখন ওরা পৌঁছল, ট্রেন আসার সময় হয়ে গিয়েছে। শিশির আর অশোকনাথ মালপত্র, হোল্ড-অল্, স্যুটকেস আর অ্যাটাচি নামিয়ে কুলির জন্য হাঁকডাক করতে লাগলেন। ঘুমন্ত চেহারার একজন কুলি এসে মালগুলো তুলে নিল। বিদায়ের লগ্ন আসন্ন। এবার ইন্সিওরেন্স এজেন্ট মহম্মদ জিয়াউদ্দিনরূপী সুভাষকে বিদায় নিতে হবে। নিমেষে প্রস্তুত হয়ে নিলেন তিনি। তারপর ওদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে রাঙাকাকাবাবু বললেন, ‘‘আমি চললাম, তোমরা ফিরে যাও’’। এদিক ওদিক ভাল করে দেখে পরক্ষণেরই তিনি প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেলেন দৃঢ় পদক্ষেপে। রাত্রির অন্ধকারে তিনটি প্রাণী অসাড়, নিষ্পন্দ হয়ে তাকিয়ে রইলেন দূরে অপসৃয়মান সুভাষের বলিষ্ঠ দেহটার উপর।








তথ্যসূত্রঃ-

১. স্বাধীনতার অন্যকথা – অঞ্জন সাহা

২. মহানিষ্ক্রমণ – শিশিরকুমার বসু

৩. আমি সুভাষ বলছি – শৈলেশ দে

৪. উদ্যত খড়্গ সুভাষ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

৫. সুভাষ ঘরে ফেরে নাই – শ্যামল বসু

৬. His Majesty's Opponent: Subhas Chandra Bose and India's Struggle Against Empire - Sugata Bose

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন