ফিরে দেখাঃ প্রাচীন কলকাতার নববর্ষ উদযাপন - ডঃ দীপ সরকার

 



উৎসব পালনের ব্যাপারে বাঙালি সম্পর্কে একটা সুবিদিত উক্তি হল “বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ”| যদিও এই “তেরো পার্বণের” মধ্যে দুর্গাপুজোই সম্ভবত সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছে, নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রেও বাঙালির শহর কলকাতা একটা অনন্যতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে, যা তুলনায় কম চর্চিত হলেও বাঙালি সমাজকে জানার জন্য মনোযোগ পাওয়ার দাবিদার বললে অত্যুক্তি হবে না |


পাঠক এইটুকু পড়ে ভাবতে পারেন – এরকম পারম্পরিক নববর্ষ তো ভারতবর্ষের প্রত্যেক রাজ্যের মানুষই তাঁদের নিজস্ব রীতি অনুযায়ী পালন করে থাকেন | এতে “অনন্যতার স্বাক্ষর” কোথা থেকে আসছে? এর উত্তর হল – এই দাবীটা কেবলমাত্র বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের উদযাপন নিয়ে নয় | এটা কলকাতা শহরের নববর্ষ উদযাপন নিয়ে | ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের রাজধানী হওয়ার সুবাদে কলকাতা শহরে নববর্ষ কেবলমাত্র বাঙালি ঐতিহ্যকে নয়, সেইসাথে ইংরেজ এবং একাধিক অবাঙালি ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে | তবে এঁদের মধ্যে ইংরেজদের বর্ষবরণের উৎসব বাঙালীর সংস্কৃতিতে যেভাবে গ্রাহিত হয়েছে তেমনটা আর কারো ক্ষেত্রেই হয়নি |


এই প্রসঙ্গে একেবারে প্রথমেই যেটা উল্লেখ করার প্রয়োজন তা হল কালীপ্রসন্ন সিংহের “হুতোম প্যাঁচার নকশা”তে বর্ণিত বাঙালিদের বর্ষবরণ ও ইংরেজদের বর্ষবরণের তুলনা –

 

আজ বৎসরের শেষ দিন | [] আজ বুড়োটি বিদায় নিলেন, কাল যুবটি আমাদের উপর প্রভাত হবেন | বুড়ো বৎসরের অধীনে আমরা যে সব কষ্ট ভোগ করেচি, যেসব ক্ষতি স্বীকার করেচি – আগামীর মুখ চেয়ে আশার মন্ত্রণায় আমরা সে সব মনে থেকে তাঁরই সঙ্গে বিসর্জন দিলাম | ভূত কাল যেন আমাদের ভ্যাঙচাতে ভ্যাঙচাতে চলে গেলেন – বর্তমান বৎসর স্কুলমাস্টারের মত গম্ভীরভাবে এসে পড়লেন – আমরা ভয়ে হর্ষে তটস্থ ও বিস্মিত! জেলার পুরোনো হাকিম বদলি হলে নীল প্রজাদের মন যেমন ধুকপুক করে, স্কুলে নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন মাস্টারের মুখ দেখলে ছেলেদের বুক যেমন গুর গুর করে – [] পুরোনোর যাওয়াতে নতুনের আসাতে আজ সংসার তেমনি অবস্থায় পড়লেন |

ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন | আগামীকে দাঁড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে নেন – নেশার খোয়ারির সঙ্গে পুরোনোকে বিদায় দেন | বাঙালীরা বছরটি ভাল রকমেই যাক আর খারাবেই শেষ হোক, সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরোনোকে বিদায় দেন | কেবল [] নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন |

                                                                      - (হুতোম প্যাঁচার নকশা/কালীপ্রসন্ন সিংহ)



এই “খাতাওয়ালা”দের সাথে বাঙালীকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই | পয়লা বৈশাখে হালখাতার খাওয়া-দাওয়া ভোজনরসিক বাঙালিমাত্রেরই মুখে হাসি এনেছে | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্ট টেনিদার একটি গল্পই হালখাতার ভূরিভোজকে কেন্দ্র করে লেখা | তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বাংলা সাহিত্যে সেই প্রাচীন কাল থেকে বাঙালীর নববর্ষ পালনের স্বাক্ষর বহন করছে এই খাতাওয়ালারা |


পয়লা বৈশাখে হালখাতার উৎসবের গুরুত্বের তাৎপর্য বোঝা যায় এর ইতিহাসের দিকে তাকালে | পয়লা বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিনটি ছিল ধান ওঠার দিন, যার ফলে ঐ দিনটিকেই সারা বছরের বকেয়া খাজনা আদায়ের দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (পয়লা বৈশাখের প্রাক্কালে খাজনা আদায়ের এই ব্যবস্থাকে “পুণ্যাহ উৎসব” বলেও অভিহিত করা হয়) | পয়লা বৈশাখে রীতি ছিল ভূমি মালিকরা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে আপ্যায়ন করবেন | আর সম্ভবত সেখান থেকেই পরবর্তীকালে ব্যবসায়ীরা চৈত্রের শেষ দিনে সারা বছরের ধার বাকি খরচের হিসেব মিটিয়ে পয়লা বৈশাখে নতুন খাতা (অর্থাৎ “হালখাতা”) খোলার ও পান-ভোজন সহকারে খদ্দেরকে আপ্যায়ন করার প্রথা চালু করে| [১].


সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল


ক্রমে যথারীতি ইংরেজদের ক্রিস্টমাস ও নিউ ইয়ার উদযাপন আরম্ভ হয় কলকাতা শহরে | এই দুটি উপলক্ষে ইংরেজরা শহরের দুটো জায়গায় জড়ো হতেন – একটি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল, অন্যটি রাজভবন | থাকতো খাদ্য, পানীয় ও গান-বাজনার আয়োজন।[২]. ইংরেজদের বড়দিনের ভাবটা ছিল বাঙালীদের দুর্গাপুজোর মতো | সাহেবরা তাঁদের ঘরবাড়ি চুনকাম-মেরামত করাতেন, ঘর সাজাতেন দেবদারু গাছের ডালপালা, ফুল, লতাপাতা দিয়ে | কলকাতা শহরের বুকে সাহেবদের কাছে দেবদারু গাছই হয়ে উঠতো বড়দিনের ক্রিস্টমাস ট্রি | এছাড়া মোমবাতির আলোকসজ্জায় সেজে উঠতো বাড়ি| [৩] .


বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ - হুতুমপ্যাঁচা


উল্লেখযোগ্য, ইংরেজদের এই যাবতীয় উৎসব পালনের সিদ্ধান্ত সরকারের তরফ থেকে নেওয়া হয় মূলত সাহেবদের জন্মভূমি থেকে দূরে থাকার কষ্টকে লাঘব করতে | সাহেবদের এই নস্টালজিয়া ছাপ ফেলেছিল তাঁদের ক্রিস্টমাস কার্ডে, যাতে আঁকা থাকতো ইউরোপের স্মৃতিবিজড়িত ছবি |


বেশ, কিন্তু বাঙালির কাছে কতটা গ্রহণীয় হতে পেরেছিল বড়দিন ও নিউ ইয়ার? প্রথমদিকে বাঙালির কাছে খুব একটা পাত্তা না পেলেও পরে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের দরুন বাঙালির মাঝেও জায়গা করে নেয় বড়দিন ও নিউ ইয়ার | শুধু তাই নয়, বাঙালির হাতে নতুন রূপ পায় এই দুটি উৎসব – ক্রিস্টমাস ক্যারলের পরিবর্তে জায়গা হয় সংকীর্তনের, আর ব্রিটিশ আমলে কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানীর হাত ধরে নিউ মার্কেটের ছবি দিয়ে ছাপানো হয় একেবারে কলকাত্তাইয়া ভাবের গ্রিটিংস কার্ড |


বড়দিনের ভূরিভোজে টার্কি যে একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা এখন ইংরেজি চলচ্চিত্র তথা সিরিজের মাধ্যমে অনেকেই জানেন | কিন্তু কলকাতার বড়দিনের ভোজের যেটা অন্যতম বড় আকর্ষণ ছিল তা হল আপেল ও রোজমেরি সহযোগে ঝলসানো শূকরের মাথা, যাকে “Boar’s Head” বলা হত | পানীয়ের মধ্যে ব্যবস্থা থাকতো ওয়াইন, হুইস্কি, শ্যাম্পেনের, শেরির মতো মদিরা সহযোগে চুরুট ও সিগারেটের | গানবাজনার আসর মাতাতে আসতেন দেশ-বিদেশের শিল্পীরা | এঁদের মধ্যে উল্লখযোগ্য ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত ইতালীয় গায়িকা সিনীয়রা ভেঞ্চুরা (Signora Ventura)তথা দ্য ক্যালকাটা টাউন ব্যান্ড (যারা গায়িকার সাথে যোগ দেয়)| [৪]. এছাড়াও থাকতো “masquerade” নামে মুখোশ-পরিহিত বলনাচের আয়োজন, যা জনপ্রিয় হয়েছিল |


তবে মদ্যপান ব্যাপারটা বাঙালি কিন্তু ইংরেজদের থেকে শেখেনি (ভারতে মদ্যপানের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং সিন্ধু সভ্যতার একেবারে গোড়া থেকে মদের প্রচলন ছিল বলে আন্দাজ করা হয়, কিন্তু বাঙালীর সামাজিক জীবনের ঠিকঠাক ইতিহাস পাওয়া যায় একমাত্র খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে) | বরং এক্ষেত্রে ব্যাপারটা খানিকটা উল্টোই হয়ে গিয়েছে – উনিশ শতকে বাঙালী ইংরেজদের থেকে বিদেশী মদের স্বাদ পেলেও সাথে-সাথে ভিক্টরীয় নৈতিকতার কবলে পড়ে মদ্যপানের বিরোধিতাও করেছে| [৫] যদিও এই বিরোধিতা খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখেনি, মদ্যপানের ব্যাপারে বাঙালী একেবারে স্বাভাবিকও হতে পারেনি | অর্থাৎ মদ্যপান সম্পর্কে বাঙালী ইংরেজদের কারণে খোলামেলা হওয়ার পরিবর্তে ট্যাবুতেই যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে বেশি |এর নেপথ্যে যে তৎকালীন বাঙালি বাবুদের পানাসক্তির কারণে উচ্ছৃঙ্খল ও ব্যয়বহুল জীবনযাপন (প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিশেষভাবে উল্লেখ্য) দায়ী ছিল না এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না |

  

 

 

 


তথ্যসূত্রঃ 

 [১] https://www.bongodorshon.com 

[২] https://prohor.in/the-way-british-kolkata-celebrated-new-year

[৩] https://www.aaroananda.com

[৪] https://scroll.in

 [৫] https://www.anandabazar.com

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন