১৮৭৩ সালের মে মাস। ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায় একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়,“একটি এগারো বছরের মেয়েকে তার বয়স্ক স্বামী চুলের মুঠি ধরে নির্দয় প্রহার করে এবং মেয়েটির মৃত্যু হয়। কারণ মেয়েটি যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অরাজি হয়েছিল।”
১৮৭৫ সালে ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার জুন মাসের সংস্করণেও অনুরূপ একটি খবর প্রকাশিত হয়, “সহবাসে অসম্মতি জানানোয় বয়স্ক স্বামী তার অতি অল্পবয়সি স্ত্রীকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।”
উভয় ক্ষেত্রেই স্বামীকে অত্যন্ত সামান্য সাজা দেয় আদালত। দুজন স্বামীই ছাড়া পেয়ে যায় অতি সহজেই। হিন্দু বিবাহ-কেন্দ্রিক সমস্ত আলোচনাই সেদিন আবর্তিত হচ্ছিল প্রজননবিদ্যা, প্রধানত মেয়েদের ও কিছুটা হলেও পুরুষের যৌননৈতিকতা, স্ত্রীর শিশুপালনপদ্ধতি এবং পরিবার, দাম্পত্য ইত্যাদি বিষয়ে। সেখানে বিবাহে নারীর যৌনসম্মতি বা কমবয়সি স্ত্রীর যৌনসহবাসে শারীরিক, মানসিক অসুবিধা, অসম্মত স্ত্রীর সঙ্গে বলপূর্বক সহবাসও যে ‘ধর্ষণ’ ইত্যাদি বিষয় ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি।
সেই যুগে উপরোক্ত ঘটনাদুটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা
ছিল না। প্রায়শই এই ধরণের ঘটনায় শিশুকন্যাদের মৃত্যু হত যা সমাজের চোখে অত্যন্ত
সামান্য – সাধারণ ঘটনার মধ্যে গণ্য হত। সেসময়ের দৈনিক পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠা
উল্টিয়ে দেখলে কুমারীত্বে পৌঁছনোর আগেই স্বামীর যৌনপ্রহার,
বলপূর্বক সহবাস করা অথবা অন্যবিধ অত্যাচারে বালিকাবধূর
মৃত্যু ঘটেছে, এই প্রকারের খবর
দেখতে পাওয়া যেত।
বিংশ শতকের সূচনাকালেও বাংলার সমাজে
বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। নিজেদের কৌলীন্য বজায় রাখার মিথ্যা প্রচেষ্টায় ও প্রাচীন
রীতিকে আঁকড়ে রাখার মানসিকতায় বৃদ্ধ পুরুষের সাথে শিশু কন্যাদের বিবাহ দেওয়া হত।
যদিও উনবিংশ শতকের শেষের দিক থেকেই নারীদের বিবাহের সঠিক বয়স ও সহবাসের বয়স
নির্ধারণ করা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সমাজের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলে তর্ক বিতর্ক
শুরু হয়ে গেছিল। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মতের উত্থাপনে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া
সম্ভব হয়নি। এই টানাপোড়েনের সময়েই এক নৃশংস ঘটনা ঘটে। যা ধীরে ধীরে গণ আন্দোলনের
চেহারা নেয়।
১৮৮৯ সাল। প্রায় ১৩৫ বছর আগের ঘটনাকাল। যেসময় ১৪
বছর বয়স পার হলেই অবিবাহিতা কন্যা অরক্ষণীয়া তকমা প্রাপ্ত হত এবং কন্যার পরিবারকে
এই অপরাধে সামাজিকভাবে একঘরে করা হত। সেই সময় পরলোকগত ‘ওড়িয়া কৈবর্ত’ কুঞ্জবিহারী
মাইতির দশম বর্ষীয়া কন্যা ফুলমণির সাথে পঁয়ত্রিশ বছরের হরিমোহন মাইতির বিবাহ হয়।
ফুলমণির বাবা বউবাজার অঞ্চলে বাজার সরকারের চাকরি করতেন। সচ্ছল পরিবারের হওয়ায়
তাঁরা দাবী করেন নিজেদের জাতিগত রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী তারা বরাবর বাল্যবিবাহের
পক্ষে হলেও মেয়েদের ঋতুস্রাব না হওয়া অবধি তাদের ঘরের মেয়েদের স্বামী-সহবাস করতে দেওয়ার
প্রথা না থাকায় ফুলমণিও ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত বাবার বাড়িতেই থাকবে এবং স্বামী
সহবাস করবে না। দাবী মেনে নেওয়া সত্ত্বেও হরি মাইতি রাত্রিবেলা শ্বশুরবাড়িতে এসে
লুকিয়ে তাদের মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়ে এবং প্রাক্-রজঃস্বলা ফুলমণিকে বলপূর্বক ভোগ করে।
ফুলমণির করুণ আর্তনাদে বাড়ির সকলেই জেগে ওঠে। ত্রস্ত পায়ে মা ছুটে যান ফুলমণির
শোবার ঘরে। গিয়ে দেখেন ফুলমণির কাপড়-বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। শুয়ে ছটফট করছে
ফুলমণি। মেয়ে এমন করছে কেন জিজ্ঞাসা করায়, পাশে বসে থাকা জামাই হরিমোহন নির্বাক, নিশ্চল পাথরের মত হয়ে থাকে। কোনো উত্তরই জোগায় না তার মুখে।
সে রাতেই সবাই জানলে ঘটনাটি। কোবরেজ-বদ্দি এলেন
বাড়িতে। কিন্তু না, ফুলমণিকে
বাঁচানো গেল না। পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসের স্বামী হরিমোহনের সঙ্গে দশ-এগারো বছরের
বালিকা ফুলমণির সহবাসের নিদারুণ পরিণতি হল বালিকা বধুর মৃত্যুতে।
থানা থেকে দারোগা এল। ডাইরি লেখা হল। কেস উঠল
কোর্টে। সরকার বনাম স্বামী-আসামী হরিমোহন। হরিমোহনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অঋতুমতী বালিকার সঙ্গে সহবাস। হরিমোহন
কাঠগড়ায় উঠে সহবাসের কথা অস্বীকার করল। বললো,
“গরমের রাত। আমার
স্ত্রী ফুলমণি ঘরের বারান্দায় তার বোনদের সঙ্গে ঘুমুচ্ছিল, আমার পাশে নয়। হঠাৎ গভীর রাতে সে রক্তাপ্লুত
অবস্থায় ছুটে আসে ঘরে এবং আমার বিছানায় শুয়ে পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।”
জুরিরা আসামীর কথা বিশ্বাস করেনি। ফুলমণির মাকে
সাক্ষী দিতে ডাকা হয়েছিল আদালতে। সাক্ষ্যে মা বলেছিলেন, তার জামাই-ই মেরে ফেলেছে তার মেয়েকে।
‘বালিকার মাতা বলিয়াছে
যে, কৈবর্ত্তজাতির বালিকাদিগের
যৌবনের পূর্বে স্বামীর শয়নগৃহে পাঠাইবার রীতি নাই। বালিকাটি গ্রীষ্মনিবন্ধন
বারান্দায় তাহার আর দুইটি ভগিনীর সহিত শয়ন করিয়াছিল। রাত্রি দুই প্রহরের সময়
চিৎকার শুনিয়া তিনি দেখিলেন, ফুলমণির
স্বামীর বিছানা রক্তে ভাসিতেছে। সে ছটফট করিতেছিল।’ (নব্যভারত, শ্রাবণ ১২৯৭)।
যদিও আদালতে হরিমোহন নিজপক্ষ সমর্থনে জানায়, যে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে বিগত এক পক্ষকালে
ইতিমধ্যেই একাধিকবার মিলিত হয়েছে, অতএব
এটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার স্ত্রী যৌনসঙ্গমে অনভিজ্ঞ ছিল না। এমনকী সে
এটাও বলে ওই নির্দিষ্ট দিনে সে স্ত্রীর সঙ্গে আদৌ মিলিতই হয়নি।
কিন্তু মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদের পরে কোর্টে যে
ডাক্তারি রিপোর্ট জমা পড়েছিল, তা
শিউরে ওঠার মতোঃ
ফুলমণির যোনি ছিল ক্ষতবিক্ষত। স্পষ্টতই তাকে
ধর্ষণ করা হয়েছিল। রিপোর্টে লেখা ছিল,
“...মেয়েটির যোনিতে তিন
ইঞ্চি লম্বা, দেড় ইঞ্চি চওড়া এক
গভীর ক্ষত... (যোনির) ঊর্ধ্বাংশের এক তৃতীয়াংশ কয়েক ভাগে ফালাফালা হয়ে গেছে। তিন
ইঞ্চি গভীর ক্ষত মেয়েটির শ্রোণিদেশে। যোনি, ডিম্বাশয় ও জরায়ু অসম্পূর্ণ ও অপরিণত। মেয়েটির তখনও সন্তান জন্ম দেবার
ক্ষমতা তৈরি হয়নি....”
কোর্ট কেসে সময় গড়াল। স্বামী দ্বারা বলপূর্বক
ধর্ষণের ফলে মারা গেলে হিন্দু বিবাহে মেয়েদের বয়স এবং জীবনের নিরাপত্তাজনিত আলোচনা
জোরদার হয়ে ওঠে পত্রপত্রিকায়। চুয়াল্লিশ জন ব্রিটিশ মহিলা-ডাক্তার গোটা বাংলা জুড়ে
ঘটে চলা দাম্পত্য-ধর্ষণে মৃত মেয়েদের এক লম্বা তালিকা প্রকাশ করেন।
কিন্তু সেইসময় অব্দি ভারতে মেয়েদের বিবাহের
সরকারি বয়স ছিল দশ, যা ফুলমণি
পেরিয়ে এসেছিল। ব্রিটিশ জাজ উইলসন ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বলে যে কোনও কিছুর অস্তিত্ব
থাকতে পারে তা মানতে অস্বীকার করেন এবং আগাগোড়া হরির জবানীকেই সমর্থন করেন। তিনি
ফুলমণির পরিবারের তিন নারী- মা রাধামণি, পিসি ভোঁদামণি ও ঠাকুমা সোনামণির বয়ান সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।
পরিশেষে ইংরেজ বিচারকের যে ভাষ্য পাওয়া যায়, তাতে লেখা ছিল,
‘এই মৃত্যুকে মেয়েটির
দুর্ভাগ্য বলেই মানতে হবে। হিন্দুদের বাল্যবিবাহের দেশজ রীতিকে ব্রিটিশ আইন
মান্যতা দেয় এবং আইন এটাও মনে করে স্ত্রীর কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মতিনিরপেক্ষ ভাবে
যৌন-আনন্দ দাবি করা পুরুষের স্বাভাবিক অধিকার’।
স্পষ্টতই বিচারকের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ
এক্ষেত্রে ভারতীয় এবং ইউরোপীয় পুরুষের মধ্যে কোনও পার্থক্য করেনি। একই সঙ্গে এটাও
মনে রাখতে হবে, হিন্দু আইনের
বিরোধিতা করা ব্রিটিশ রাজের উদ্দেশ্য নয়, এ কথাও তৎকালীন বিদেশি প্রশাসকেরা বারবার বলেছেন। এমনকী লর্ড মেকলের
‘বাদামি সাহেব’ তৈরির ঔপনিবেশিক পরিকল্পনাও উনিশ শতকের শেষে এসে অন্তত দেশীয়
সমাজের রক্ষণশীলতার গায়ে আঘাত না করার সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। একইসঙ্গে ব্রিটিশ
পিতৃতন্ত্র এক্ষেত্রে নেটিভ পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে কোথাও একাত্ম বোধ
করেছে। তাই এরকম একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনাও ব্রিটিশ প্রশাসনকে তৎক্ষণাৎ কোনও র্যাডিকাল
পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়েছে। এই ঘটনা যখন ঘটছে তখন ব্রিটেনে নারীবাদী আন্দোলন এবং
মেয়েদের অধিকার-সংক্রান্ত লড়াই একেবারে ভ্রূণাবস্থায় রয়েছে। শাসক-শাসিত উভয় জাতির
ক্ষেত্রেই নারীর শরীরের উপর নারীর নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠার কল্পনা সুদূরপরাহত।
ইতিহাসের সেই টানাপোড়েন পেরিয়েও সেদিন সত্য হয়ে উঠেছিল দশ-এগারো বছরের এক অসুখী
বালিকা ফুলমণি দাসীর অসহায় মৃতদেহ। যে মেয়েটি নিজের চেয়ে পঁচিশ বছরের বড়ো এক
সদ্য-পরিচিত পুরুষের যৌনপ্রহার সহ্য করতে না পেরে মারা গিয়েছিল। মেয়েটির পিসি
ভোঁদামণি কোর্টে দাবি করেন, হরি
মাইতি নাকি আগে থেকেই বিবাহিত ছিল, ফুলমণি
তার দ্বিতীয় স্ত্রী। সমকালীন সব ডাক্তারি রিপোর্টেই অবশ্য বলা হয়েছিল ফুলমণির শরীর
তখনও অব্দি নিয়মিত যৌনমিলনের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। তেরো ঘণ্টা একটানা রক্তক্ষরণের পর
তার মৃত্যু হয়। মা রাধামণির বয়ানে,
“আমি দেখলাম আমার মেয়ে
বিছানায় শুয়ে আছে, রক্তাক্ত
অবস্থায়। বিছানা, মেয়ের পরণের শাড়ি, এমনকী জামাইয়ের গায়ের কাপড়ও রক্তে মাখামাখি
ছিল”।
তবে ফুলমণির ঘটনা সেদিন কোনও বিচ্ছিন্ন নিদর্শন
ছিল না। ১৮৫৬ সালে ডাক্তার শেভর এবং ডাক্তার ম্যাকলয়েডের পর্যবেক্ষণ থেকে এ রকম
অন্তত চোদ্দটি নমুনা লিপিবদ্ধ হয়েছিল, যেখানে রজোদর্শনের আগেই মেয়েরা স্বামীসহবাসে বাধ্য হচ্ছে। জনৈক ভারতীয়
ডাক্তারের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে কমপক্ষে তেরো শতাংশ মেয়ে তেরো বছর বয়স হবার আগেই
মা হয়েছে। ঢাকা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, বর্ধমানের ডিভিশনাল কমিশনারদের বয়ান অনুযায়ী সেদিন বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল
জুড়ে বাল্যবিবাহই ছিল অত্যন্ত প্রচলিত রীতি। রাজশাহি জেলার কমিশনার তাঁর লেখায়
বলছেন, আদিবাসী, রাজবংশী এবং মুসলমান কৃষিজীবী ছাড়া উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে
বাল্যবিবাহই একমাত্র প্রচলিত রীতি। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষিত
পরিবারগুলোতে কিছুটা চেতনা জেগেছে বলে আর নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে যারা জমির
উপর নির্ভরশীল, তাদের বাড়ির মেয়েরাও
কৃষিকাজে অংশ নেয় বলে মেয়েদের বিয়ের বয়স খুব ধীরে হলেও বাড়ছিল। বিয়ের বয়স বাড়তে
থাকার আরেকটি কারণ ছিল বিবাহে পণের আধিপত্য বাড়তে থাকা। চট্টগ্রামের ডিস্ট্রিক্ট
ম্যাজিস্ট্রেট কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বাঙালি হিন্দু পরিবারে দুই বিবাহের কথা। যদি
রজোদর্শনের আগেই একটি মেয়ের বিয়ে হয়ও, তাকে প্রাথমিকভাবে বাপের বাড়িতেই রাখা হত। রজঃস্বলা হয়ে শারীরিকভাবে
প্রস্তুত হওয়ার পর তাকে স্বামীর কাছে পাঠানোর চল ছিল। একে বলা হত ‘দ্বিতীয় বিবাহ’।
তখনই ‘গর্ভাধান’ অনুষ্ঠান হত। অর্থাৎ স্বামীসহবাসের পর মেয়েটি এবার গর্ভধারণের
জন্য প্রস্তুত। এবং এই রীতির প্রচলনের পিছনে শাস্ত্রীয় ও লোকাচারঘটিত সমর্থনও ছিল।
অথচ এরপরেও বহুক্ষেত্রেই স্বামীর বাড়ি থেকে জোর করা হত কমবয়সী মেয়েটিকে পাঠানোর
জন্য। নবীনচন্দ্র সে এই শাস্ত্রীয় রীতিকেই ব্রিটিশ আইনের আওতায় আনার কথা বলেছিলেন।
যদিও মেয়েদের ঋতুমন্ত্রী হবার উপযুক্ত বয়স নিয়ে
হিন্দুসমাজে সেদিন এক স্পষ্ট বিতর্কও দানা বেঁধেছিল। সামান্য ঋতুস্রাব বেরোনোর
মুহূর্তকেই মেয়েটির ঋতুমন্ত্রী হওয়ার প্রমাণ হিসেবে না দেখার কথাও বলা হয়েছিল।
প্রগতিশীল এবং হিন্দু রক্ষণশীল শিবির যেহেতু মেয়েদের বিয়ের বয়স দশ বছর করাকে এক
রকম মেনেই নিয়েছিল, তাই প্রকৃত
ঋতুমতী হবার বয়স দশ থেকে বারো হবার মাঝামাছি- এ রকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইলেন
সবাই। কিন্তু প্রগতিশীল শিবির মেয়েদের বিয়ের বয়স বারোতে বেঁধে দেবার সরকারি
প্রস্তাবের উপর সিলমোহর দেবার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁদের কাছে একটি মেয়ের ঋতুমতী
হওয়াই বিবাহের জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁরা যৌন পরিণতির কথাও তুললেন। অর্থাৎ মেয়েটির
শারীরিক গঠন সহবাসে লিপ্ত হওয়ার উপযোগী কি না সেটাই তাঁদের আছে গুরুত্বপূর্ণ মনে
হয়েছিল। ‘সহবাস সম্মতি আইন’-এ মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর প্রস্তাবকে সমর্থন করবেন তাঁরা।
কিন্তু রক্ষণশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল, ঔপনিবেশিক
প্রভুরা কেউই সেদিন বিবাহে মেয়েদের মানসিক অনুভূতি, স্বেচ্ছায় স্বামী নির্বাচন এবং যৌনসম্মতিতে মেয়েটির স্বাধিকারের পক্ষে
একটাও কথা ব্যয় করেননি, অর্থাৎ পুরো
ব্যাপারটাই দেখা হয়েছিল নিছক যৌনমিলনে লিপ্ত হবার শারীরিক সক্ষমতার জায়গা থেকেই।
তবে ফুলমণির মৃত্যু এবং ঔপনিবেশিক আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে সেদিন
বাঙালি সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। এক অভূতপূর্ব সামাজিক আন্দোলনের জন্ম হয় যার
সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক
গুরুত্ব অপরিসীম।
রুকমাবাই
বাংলায় এই আন্দোলন যখন বিদ্রোহের আকারে পরিণত
হচ্ছে ঠিক সেই সময়েই একটি সমসাময়িক ঘটনা লোকনজরে উপস্থাপিত হয়। ১৮৮৫ সালে, ইতিহাস তৈরি করার রাস্তায় ভারতীয় নারী সমাজকে
এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মেয়েটির নাম রুকমাবাই। রুকমাবাই-এর বিয়ে হয় ন’বছর বয়সে।
হিন্দু আইনের বিধানমতে এগারো বছর বয়সে তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় হয়। কিন্তু
গররাজি হয় মেয়েটি— স্বামীর কাছে যেতে রাজি হয়না সে। স্বামী বয়সে খুব বেশি বড়ও
ছিলেন না — মাত্র ন’বছরের মেয়েটির বিয়ের সময় তার স্বামীর বয়স ছিল সতেরো। মা আর
মায়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্বামীর সঙ্গে থাকে সে। মেয়েটির বাবা জনার্দন পান্ডুরং মারা
যান, যখন তার মায়ের বয়স ষোলো। তারা
সুথার সম্প্রদায়ের অংশ, বিধবা বিবাহ
সেই সম্প্রদায়ে বহু কাল ধরেই প্রচলিত। তাই স্বামীর মৃত্যুর ছ’বছর পরে আবার বিয়ে
করেন মেয়েটির মা, জয়ন্তীবাই।
রুকমাবাইয়ের নতুন পিতা ডাক্তার সখারাম অর্জুন ছিলেন ব্যতিক্রমী পুরুষ।
স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী ও নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাঁর উৎসাহেই মেয়েটির লেখাপড়া
শুরু হয়েছিল ফ্রি মিশনারি চার্চের সহায়তায়। প্রার্থনাসমাজেও যাতায়াত শুরু করে সে।
ন’বছর বয়সে ডাঃ অর্জুনের দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গেই বিয়ে হয় তাঁর। ছেলেটিকে
মেয়েটির বাড়িতেই থাকতে হবে, এই
শর্তে। মেয়েটির স্বামী, দাদাজি
ভিকাজি এক বছর থাকেও শ্বশ্রূগৃহে। তারপর সেই শর্ত লঙ্ঘন করে ফিরে যায় তার নিজের
বাড়িতে। হয়তো সে ফিরেও আসত না। কিন্তু নানা ভাবে দেনাগ্রস্ত হয়ে বিয়েতে না নেওয়া
পণের কথা মনে পড়ে। তার স্ত্রীকে, সেই
মেয়েটিকে ডেকে পাঠায় সে, কারণ বৌকে
স্বামীর কাছে আসতে হলে আসতে হবে যথাযথ নিয়মে, পণ ও আদানপ্রদানের বিধি মেনে। মেয়েটির বয়স তখন এগারো বছর। সে বেঁকে বসে।
তার পিতা ডাক্তার অর্জুন তাকে সমর্থন করেন। মার অসমর্থন সত্ত্বেও সে শ্বশুরবাড়ি না
যাওয়ার সিদ্ধান্তেই অনড় থাকে। তার স্বামী ভিকাজি মামলা করেন তার বিরুদ্ধে। তৎকালীন
ব্রিটিশ আইনের এক নিয়ম ছিল ‘রেস্টিটিউশন অব কনজুগাল রাইটস’— যেখানে স্ত্রী কোনও
কারণ ছাড়া স্বামীর সঙ্গে না থাকলে, তা
ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেই আইনের ভিত্তিতেই মামলা করেন ভিকাজি। দমে যায় না
মেয়েটি। পিতার সমর্থনে সেও একটি মামলা করে— স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত জীবন যাপন না
করার অনুমতি চেয়ে। শুধু স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত জীবন শুরুতে আপত্তি জানিয়ে আইনের
পথে যাওয়া নয়, আইনের পরিবর্তন চেয়ে
‘দ্য হিন্দু লেডি’ ছদ্মনামে ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় কলম ধরেন তিনি। লিখতেন ইংরেজি
ভাষায়। টানা তিন বছর ধরে চলে সেই লেখা। এত জনপ্রিয় হয়, এত আলোড়ন ফেলে এই লেখা যে, তিনি
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এবং ম্যাক্স মুলারের সমর্থন পান। দেশের রাজনীতিতেও এর প্রভাব
পড়ে। হিন্দুত্ববাদী নেতারা মুখে স্বদেশি আন্দোলনের কথা বললেও, দেশের মেয়েটির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়েন। যেমন
বালগঙ্গাধর টিলক ও বিশ্বনাথ নারায়ণ মণ্ডলিক। তাঁরা সংবাদপত্রে মতামত দেন, রুকমাবাই যা করছেন, তা হিন্দু ধর্মের এবং ভারতের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।
বম্বে হাইকোর্টে শুনানি চলে তিন বছর। ১৮৮৮ সালে
হিন্দু আইন অনুসারেই ফয়সালা শোনানো হয়— রুকমাবাইকে স্বামীর কাছে যেতে হবে, নয়তো ছ’মাসের কারাদণ্ড মেনে নিতে হবে। ছ’মাসের
কারাদণ্ড মেনে নেন রুকমাবাই। রুকমাবাই জেল থেকে ছাড়া পান ১৮৮৯ সালে। সেই বছরই তিনি
বিলেতযাত্রা করেন ডাক্তারি পড়বেন বলে। অর্থের জোগান দেয় ‘রুকমাবাই ডিফেন্স ফান্ড’।
১৮৯৪ সালে, কাদম্বিনী, আনন্দীবাই যোশীদের ঠিক আট বছর পরে, রুকমাবাই ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করেন।
১৮৯১ সাল। টনক নড়লো ইংরেজ সরকারের। এ তো শুধু
একজন মাত্র ফুলমণির ব্যাপার নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন
গোটা হিন্দু সমাজের ব্যাপার। ফুলমণি তো গোঁড়া হিন্দু সমাজের ‘চাইল্ড-ওয়াইফ’-এর
প্রতীক। এগিয়ে এলেন বড়লাট লর্ড ল্যান্সডাউন। বললেন, হিন্দুসমাজে এ প্রথার সংস্কারসাধন করা উচিত। ১৮৮২ খ্রীস্টাব্দের আইন
সংশোধন করে সরকার তাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ‘সহবাস সম্মতির বয়স আইন’ (The Age of Consent Bill) পাস করাতে। প্রস্তাবটি
তুললেন সরকারের পক্ষে স্যার অ্যান্ড্রু স্কোবল। বললেন, এতদিন মেয়েদের বিয়ের বয়স ছিল দশ, এখন থেকে কম পক্ষে বারো বছর করতে হবে। কিন্তু প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থায়
আঘাত করবেন কি করে! বাল্যবিবাহের পরিণাম যতই ভয়াবহ হোক না কেন, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে, ভালোভাবে খুঁটিয়ে না দেখে হিন্দু সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসের ওপর আঘাত
হানবেন না ল্যান্সডাউন।
শোনামাত্র গোঁড়া হিন্দুসমাজ হইহই করে উঠলো।
তাঁরা কিছুতেই ‘সহবাস-সম্মতি বিল’ পাস হতে দেবেন না। স্বভাবতই বিলের পক্ষে এবং
বিপক্ষে দুটি দল গড়ে উঠলো। বিপক্ষে গেলেন একদল প্রাচীনপন্থী গোঁড়া হিন্দু –
বিশেষ করে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ পণ্ডিতসমাজ, আর পক্ষে রইলেন প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারকের দল। প্রথম পক্ষে যোগ দিলেন
স্যার রমেশচন্দ্র মিত্র, ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি, চন্দ্রনাথ বসু, পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ প্রমুখ ব্যক্তি এবং বঙ্গবাসী, দৈনিক অমৃতবাজার, হোপ, অনুসন্ধান, হিন্দুরঞ্জিকা, ঢাকাপ্রকাশ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা। এঁরা বললেন, বিল হিন্দুশাস্ত্রবিরোধী। রঘুনন্দনের স্মৃতিশাস্ত্রে গর্ভাধান ব্যবস্থার
যে বিধি আছে তারও বিরোধিতা করছেন সরকার। অতএব শুরু হলো বিল-বিরোধীদের তুমুল
আন্দোলন। ল্যান্সডাউনকে এঁরা ‘ব্রিটিশ আওরঙ্গজেব’ নামে আখ্যাত করলেন।
অন্যদিকে দাঁড়িয়ে গেলেন প্রগতিশীল নব্য
সংস্কারকের দল। এঁরা রায় দিলেন বিলের সপক্ষে। শুধু রায় দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না।
এঁরা ‘ক্যালকাটা কমিটি ইন সাপোর্ট অব দি এজ অব কনসেণ্ট বিল’ গঠন করলেন, এবং আট হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে
‘মেমোরিয়্যাল টু হিজ একসেলেন্সি দি ভাইসরয় অ্যাণ্ড গভর্নর জেনারেল’ পাঠিয়ে
দিলেন। এই সমিতির পক্ষ নিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রাসবিহারী ঘোষ, কৃষ্ণকমল
ভট্টাচার্য, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল
সরকার, প্রমুখ। এই কমিটির
প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রখ্যাত পণ্ডিত ও সংস্কৃত কবি রামনাথ তর্করত্ন। পক্ষ-বিপক্ষ — দুই
দলই চেষ্টা করতে লাগলেন তাঁদের ঈপ্সিত কামনার সাফল্যের জন্য। উভয় পক্ষেরই প্রচার
পূর্ণ উদ্যমে চলতে লাগলো। উভয়সংকটে পড়লেন বড়লাট ল্যান্সডাউন। তাঁর নির্দেশে
১৮৯১ খ্রীস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি গভর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারি স্যার এডগার এই
বিলের শুভ-অশুভ নিরূপণ করার জন্য মতামত চেয়ে এক চিঠি লিখলেন বিল-বিরোধী
রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও বিদ্যাসাগর এবং বিল-পক্ষীয় রামনাথ তর্করত্নের কাছে।
বিলকে স্বাগত জানালেন পণ্ডিত রামনাথ। তিনি সব
শাস্ত্রগ্রন্থ বিচার করে সরকারকে জানালেন,
“স্ত্রীর ষোল বৎসর ও
পুরুষের পঁচিশ বৎসর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত উহাদের সংযোগে যে গর্ভসঞ্চার হয় তাহা
বিপন্ন হইয়া থাকে। যদিও বিনষ্ট না হয়, তথাপি সন্তান দীর্ঘজীবী ও বলিষ্ঠ হয় না।”
তিনি মনুসংহিতা, সুশ্রুতসংহিতা, আয়ুর্বেদশাস্ত্র
এবং রঘুনন্দনের স্মৃতিশাস্ত্র থেকে পাঠ উদ্ধৃত করে তার ব্যাখ্যা করে দেখালেন যে, সরকার যে সংস্কার করতে চলেছেন তা শাস্ত্র বা
ধর্মবিরোধী তো নয়ই পরস্তু ধর্মশাস্ত্র এবং আয়ুর্বেদশাস্ত্র এই সংস্কারকে সমর্থন
করে। শ্রীনাথ দত্ত ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ‘নব্যভারত’-এর সংখ্যায় তাঁর অগ্রহায়ণ
‘মনুসংহিতানুসারে অরজস্কা স্ত্রীসহবাস দণ্ডনীয় কিনা’ নিবন্ধে বললেন,
“মহর্ষি মনু যেন
ভবিষ্যৎ দর্শনবলে বঙ্গদেশের বর্তমান অবস্থা জানিতে পারিয়াই শাস্ত্র প্রণয়ন
করিয়াছিলেন। অনৃতুমতী সহবাসে অস্মদ্দেশে স্ত্রীলোকের নিতান্ত কষ্টদায়ক
দুশ্চিকিস্য রোগ জন্মিতেছে, প্রাণবধ
পর্যন্ত হইতেছে। শিশু বালিকাশ্রেণীর দুর্দশার একশেষ হইতেছে; কোথায় বালিকারা মাতার স্নেহে পরিবর্ধিত হইয়া
সুখে গৃহকার্য শিক্ষা করিবে, না
কোথায় অকালে স্বামীসহবাস করিতে শ্বশুরগৃহে আনীত হইয়া কতপ্রকার যন্ত্রণাই সহ্য
করিতেছে। অনেকে ইহজীবন ভারবহ মনে করিয়া আত্মহত্যা পর্যন্ত করিতেছে। বস্তুত সবল
ব্যক্তিরা শাস্ত্রের মস্তকে পদার্পণপূর্বক জঘন্য কামরিপুর বশবর্তী হইয়া শূলে
মৎস্য ভাজিবার ন্যায় দুর্বলা অসহায়া বালিকা স্ত্রীদিগকে ভাজাপোড়া অনূতুমতী
করিতেছেন।”
রমেশচন্দ্র মিত্র, বিদ্যাসাগর এবং রাজেন্দ্রলাল এই বিলের বিরোধিতা করায় অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। প্রকৃতই যে ঈশ্বরচন্দ্র সমাজসংস্কারক হিসেবে সাধারণের মনে গভীর রেখাপাত করেছিলেন তিনি সমাজের এই কল্যাণকর বিলের বিরোধিতা করলেন কেন? তিনি সরকারের চিফ সেক্রেটারি এডগারের পত্রের উত্তরে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি যে অতিমত প্রকাশ করেছিলেন তাতে দেখা যায় ‘conflicting with religious usage’ এবং ‘interfering with a religious observance’- এর কারণই তাঁকে এই বিলের বিরোধী করেছে।
বাল্যবিবাহের পক্ষপাতী বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় কিন্তু মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তাঁর যুক্তি, তঁর বিচার আইন প্রবর্তিত হওয়া-না হওয়ার বহু
ঊর্ধ্বে। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ২৯ আশ্বিন তিনি যে চিঠিখানি লিখেছিলেন ঠাকুরদাস
মুখোপাধ্যায়কে তা উদ্ধারযোগ্য,
“...বিবাহিতাদিগের
সম্মতির বয়ঃক্রম সম্বন্ধে যে আন্দোলন হইতেছে, আমি ইহাকে কতকটা বৃথাড়ম্বর মনে করি। যতদূর জানি,
এদেশীয়া বালিকারা দ্বাদশ বৎসরের পূর্বে সচরাচর ঋতুমতী হয় না।
এবং হরি মাইতির ন্যায় পাষণ্ড বড় বিরল। সুতরাং, এ বিষয়ে কোন আইনের প্রয়োজন আছে বলিয়া আমার বিশ্বাস নাই। তবে, ইহাও বক্তব্য যে, দ্বাদশ বৎসর সম্পূর্ণ হইবার পূর্বে বালিকাদিগের স্বামীসংসর্গ অবিধেয়, এবং ইহা আমাদিগের দেশের প্রাচীন রীতিবিরুদ্ধ।
তাহার নিষেধজন্য, যদি কোন আইন হয়, তাহাতে আমি ক্ষতি দেখি না। ঈদৃশ রাজনিয়ম
প্রাচীন দেশাচারবিরুদ্ধ হইবে না, কাজেই
তাহাতে কোন আপত্তি উত্থাপিত করাও আমার মত নহে। এক্ষণে আইনমতে সম্মতিদানের বয়স দশ
বৎসর; দশ বৎসরের স্থানে বারো বৎসর
হয়, ইহা আমার অভিমত নহে। কিন্তু
বারো বৎসর অধিক হওয়া কোনক্রমেই উচিত নহে। বাল্যবিবাহের আমি পক্ষপাতী। কিন্তু
বাল্যবিবাহ অর্থে বাল্যকালে বয়সের অনুচিত সংসর্গ বুঝি না। তাহার পক্ষপাতী নহি।
কোন কোন বালিকা দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হইবার পূর্বেই ঋতুমতী হইয়া থাকে। তাহাদের সম্বন্ধে
কোন শাস্ত্রোক্তি যে লঙ্ঘিত হইবে না, এমন কথা বলা যায় না। ...আমার মতে, আইন হইবার প্রয়োজন নাই। হইলেও বিশেষ কোন ক্ষতি নাই।”
এখানে উল্লেখ করতে বাধা নেই, সহবাস-সম্মতি নিয়ে, এদেশে যখন তুমুল আন্দোলন চলছে, বঙ্কিমচন্দ্র তখনও সরকারি কাজের সঙ্গে যুক্ত। ১৮৯১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর
তিনি সরকারি দপ্তর থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সম্মতির বয়স ‘বারো বৎসরের অধিক হওয়া কোনক্রমেই
উচিত নহে’ — বঙ্কিমের এহেন উক্তি কিন্তু ‘সহচর’ পত্রিকা মেনে নেয়নি। মৃত ফুলমণির
কথা মনে করিয়ে দিয়ে সহচর বলছে,
“আমরা পূর্বে বলিয়াছি, পুনরায় বলিতেছি, দ্বাদশ বৎসরে ফল হইবে না। এই বালিকাটির (ফুলমণির) দ্বাদশ বৎসরের কয়েক মাস
মাত্র বাকী ছিল। দশ ও বারোর মধ্যে প্রভেদ এই, বারো বৎসরে বিপদের সম্ভাবনা কিঞ্চিৎ — কিঞ্চিৎ মাত্র কমে। কিন্তু সে
কোথায়? স্বামীর বয়স ১৭/১৮ বৎসর
হইলে কার্যত এই বয়সের প্রভেদ নাই। যথার্থ যৌবন চতুর্দশ বৎসরের পূর্বে আরম্ভ হয়
না। অতএব যথার্থ কাজ করা যদি ব্যবস্থাপক সভার গভীর ইচ্ছা থাকে, তবে সম্মতির বয়েসের ঐ সীমা করিতে হইবে।
গভর্নমেন্ট সমাজের উপর হস্তক্ষেপ করিতেছেন। তথাপি পরম্পরা সম্বন্ধে বাল্যবিবাহ
কুপ্রথার মূলে আঘাত লাগিবে। লাগাও উচিত।”
বলা বাহুল্য প্রভাবপ্রতিপত্তিশালী ও সমাজের
নেতৃস্থানীয় বিদ্যাসাগর-রাজেন্দ্রলালের সমর্থনে বিলের বিরোধীপক্ষ সরকারের
বিরোধিতায় অসীম জোর পেয়েছিলেন। অন্য পক্ষে বিলের সমর্থনকারীরা ও প্রচণ্ড উৎসাহে
প্রচারে নেমেছিলেন।
১২৯৭ বঙ্গাব্দের ‘নব্যভারত’ পত্রিকার পৌষ
সংখ্যায় সম্মতির বয়স স্বদেশীয়গণের নিকট নিবেদন’-এ বললেন,
“যদি গভর্নমেন্ট ও
ইংরাজ জাতির দুরভিসন্ধি থাকিত, তাহা
হইলে ত আমাদিগকে দুর্বল রাখা তাঁহাদিগের স্বার্থ হইত। অতএব স্বদেশীয়গণ! কুসংস্কার
ও কাল্পনিক ভয়ের বশবর্তী হইয়া আপনাদিগের যথার্থ স্বার্থ হারাইও না। কার্যত
এক্ষণে ব্রাহ্মণ কায়স্থ কন্যাগণের ১২/১৩/১৪ বৎসরে বিবাহ হইতেছে। কিন্তু
নিম্নশ্রেণীর লোকেরা ৫/৬/৭ বৎসরের অধিক ঘরে অবিবাহিত কন্যা রাখে না। এই সকল লোকের
প্রতি কটাক্ষ করা কি আমাদিগের কর্তব্য নহে? হিন্দুধর্মের যথেষ্ট স্থিতিস্থাপকতা গুণ আছে। আমাদিগের শাস্ত্রকারেরা
নির্বোধ ছিলেন না। যদি প্রাচীনকালের অষ্টাদশ বিংশতি বৎসর পর্যন্ত অবিবাহিত
থাকিয়া ধর্ম রক্ষা করিতে পারিতেন, এখনও
তাহা হইবে না কেন? এক্ষণে সতীত্বের
কি এত কম মূল্য হইয়াছে? তাহা নহে।
অকালে বালিকাদিগকে কিলাইয়া কাঁঠাল পাকান হয় বলিয়া এক্ষণে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী
স্ত্রীলোকেরা পুরুষের আস্বাদ পাইতেছেন। অতএব সাহস ও অধ্যাবসায় অবলম্বন কর।
...পরের মুখে ঝাল খাইও না।”
না। পরের মুখে ঝাল খাওয়া প্রতিরোধ করতে পারলেন
না নবীন সমাজসংস্কারকের দল। বিলের সপক্ষে রামনাথের বক্তব্য সরকারের হাতে পেঁৗছাবার
পর সনাতনপন্থীর দল বিরাট প্রতিবাদসভা ডাকলেন কলকাতার গড়ের মাঠে (১৪ ফাল্গুন, ১২৯৭, বুধবার)। প্রখ্যাত বঙ্গবাসী পত্রিকার যোগেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ ছিলেন এই প্রতিবাদসভার
মুখ্য আহ্বায়ক। লক্ষাধিক মানুষ এই সভায় যোগ দেয়।
এই সভাকে অনেকেই বলেছেন ‘ভারতের প্রথম বৃহৎ
জনসভা’। বিরাট এই জনসভায় এরা ঘোষণা করলেন, হিন্দুধর্ম আজ বিপন্ন। আসন্ন এই বিপদ থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করতেই হবে।
কিছুতেই ধর্মের ওপর এই আঘাত আমরা সহ্য করব না। অবশেষে ১৮৯১-এর ১৯ মার্চ
বৃহস্পতিবার বড়লাটের আইনসভায় এই বিলের বিতর্কের দিন স্থির হয়। এ সংবাদ শুনেই
রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থীরা ১৫ মার্চ রবিবার কালীঘাটে গিয়ে কালীমন্দিরে পুজো দেন।
প্রার্থনা করেন সহবাস-সম্মতি বিল যেন পাস না হয়। নিজেদের নামে স্বতন্ত্র সংকল্প
করে পৃথক পৃথক পূজা দেন বঙ্গবাসী পত্রিকা, রমানাথ ঘোষ এবং রাজা ইন্দ্ৰচন্দ্ৰ সিংহ। দু’-তিন মণ সন্দেশ ও বাতাসা ‘হরির
লুঠ’ দেওয়া হয়। পঞ্চাশটি সংকীর্তনের দল কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে
ভবানীপুরে স্যার রমেশচন্দ্র মিত্রের বাড়ি যায়, তারপর কালীঘাটে এসে মিলিত হয় মহাপূজা-প্রাঙ্গণে। এখানেও উপস্থিতির সংখ্যা
কয়েক হাজার। এই সব রাজসিক আয়োজন দেখে স্বভাবতই শঙ্কিত হয়ে পড়লেন নব্য
সংস্কারপন্থীরা। এদের সকলেরই মনে এক ভয়, তা হলে কি আইন পাস হবে না? বাল্যবিবাহের
এই কুপ্রথা কি সমাজের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকবে? না। তা হলো না। কালীঘাটের মা-কালী প্রসন্ন
হলেন না বিল-বিরোধীদের ওপর। ইতিপূর্বে রামনাথ তর্করত্ন-লিখিত বাংলা অভিমতটি
ইংরেজিতে অনুবাদ করে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য, এই বিলের পক্ষে জনমত গঠন করা। এর পেছনে ছিলেন
রাসবিহারী ঘোষ। দেখা গেল, ডঃ আর.
জি. ভাণ্ডারকর, জাস্টিস তেলং, দেওয়ান রঘুনাথ রাও প্রমুখ ব্যক্তি বিলের পক্ষে
রায় দিলেন। ব্যবস্থাপকসভায় ১৯ মার্চেই বিলটি পাস হয়ে গেল। গভর্নর-জেনারেল
উপস্থিত হলে স্যার স্কোবল বলেছিলেন,
“এক পক্ষে আইন ও আচার
অনুসারে বারো বৎসর কাছাকাছি সময়কে সহবাসের গড় বয়স বিবেচনা করা যাইতে পারে এবং
আর এক পক্ষে শারীরিক যোগ্যতা সম্বন্ধে ঐ সময়কে সর্বাপেক্ষা কম নিরাপদ বয়স
বিবেচনা করা যাইতে পারে। অতএব আমি বিবেচনা করি যে, ঐ বয়সটিকে সীমা করিলে সমাজের কোনো অংশের কোনো আস্থাযোগ্য সামাজিক রীতির
বা ধর্মব্যবস্থার অপমান করা হইবে না।”
বিরোধী পক্ষের এত সভাসমিতি, হোম-পুজো; সবই ব্যর্থ হলো। চাপা আক্রোশে এরা ফুঁসতে লাগলেন। বললেন, ঠিক আছে, এর প্রতিকারের জন্যে বিলেত যাবো।
এই উপলক্ষে রাজসাহীতে বিরাট ধর্মসভা বসলো। রাজা
শশিশেখরেশ্বর রায় প্রস্তাব করলেন, এই
আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রতিকার চাইতে কয়েকজন সদস্য বিলেতে যাবেন। কিন্তু
শেষ পর্যন্ত যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া বিদ্যাসাগর এবং রাজেন্দ্রলাল এই বিল
পাস হওয়ার চার মাসের মধ্যে মারা গেলেন। ফলে প্রাচীনপন্থীদের ‘খুঁটির জোর’ অনেকটা
কমে এসেছিল। যদিও বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত খবর ভুয়ো বলেই পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়।
কারণ প্রস্তাবিত বিলের বয়ানে আপত্তি জানিয়ে বিদ্যাসাগরমশাই সরকারের কাছে এক পত্রে
লেখেন, বয়স নির্দিষ্ট করার বদলে...
“I should like the measure to be so framed
as to give something like an adequate protection to child wives, without in any
way conflicting with any religious usage. I would propose that it should be an
offence for a man to consummate marriage before his wife has had her first
menses. As the majority of girls do not exhibit that symptom before they are
thirteen, fourteen or fifteen, the measure I suggest would give larger, more
real and more extensive protection than the Bill.”
অর্থাৎ বিদ্যাসাগর পক্ষান্তরে বিলটিকে সমর্থন
জানিয়েছিলেন। তিনি বয়স উল্লেখের পরিবর্তে একটা শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য (নারীর
বয়ঃপ্রাপ্তি কালে মাসিক ঋতুর আবির্ভাব)-কে নিষেধের মানদণ্ড করতে চেয়েছেন, এবং বলেছেন, তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী, যাদের
ক্ষেত্রে তের, চোদ্দ বা পনের বছর
বয়সে এই বৈশিষ্ট্য প্রকট হবে, তাদের
সঙ্গে সেই সেই বয়সের আগে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করা স্বামীদের ক্ষেত্রে আইনত
দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে বলে ব্যবস্থা রাখা হোক।
১৯ শে মার্চ, ১৮৯১ “এজ অফ কনসেন্ট বিল” বা “সহবাস সম্মতি বিল” পাশ হয়। কিন্তু গোড়া
থেকেই এই বিল ছিল নানাভাবে ত্রুটিপূর্ণ। মেয়েদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও বালিকা
বধূদের মৃত্যুরোধ এই বিলের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও সেই লক্ষ্যপুরণে সফল হওয়া এই
বিলের মাধ্যমে ছিল খুবই কঠিন। যদি এই আইন লঙ্ঘনও হত তাহলেও উপযুক্ত প্রমানাভাবে
শাস্তি প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ বৈবাহিক ধর্ষণের ফলে যদি মেয়েটির মৃত্যু হয়, অথবা মেয়েটি বেঁচে যায় এবং পরিবার বা বধূটি
নিজেও যদি পুলিশের কাছে অভিযোগ দাখিলও করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সহানুভূতি ঝুঁকে থাকত
অভিযুক্ত পুরুষটির দিকেই। তার চেয়েও বড় কথা এই একবিংশ শতাব্দীতেও ভারতের মতো দেশে
বহু জায়গায় মেয়েদের জন্ম অবাঞ্ছিত, সেখানে
আঠেরো শতকে প্রায় কোনও মেয়েরই জন্ম নিবন্ধীকরণ করা হত না। ফলে, বালিকা বধূটির সঠিক বয়স যে বারোর কম, এটা প্রমাণ করাই ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। এমনকী, যদিওবা কোনক্রমে মেয়েটির পরিবার যথেষ্ট প্রমাণ
সমেত আদালতে পৌঁছেও যেত, ব্রিটিশ
বিচারক ও জুরিরা দেশীয় লোকাচার বিরুদ্ধাচারন করতে রাজী হত না।
১৮৯১ সালেই অত্যাচারী স্বামীর বিরুদ্ধে একটি
মেয়ের মা আদালতের দ্বারস্থ হলে সরকারি ডাক্তার মেয়েটির দাঁত পরীক্ষা করেও নিশ্চিত
হতে পারেননি, মেয়েটির বয়স বারো বছর
হয়েছে কিনা। ফলত অভিযুক্ত স্বামী অতি সহজেই খালাস পেয়ে যায়। এর পর রক্ষণশীল হিন্দু
সমাজে ‘সহবাস সম্মতি বিলে’র বিরুদ্ধে অতি দ্রুত গণ বিক্ষোভ গড়ে উঠলে তৎকালীন
ভাইসরয় লর্ড ল্যান্সডাইন সার্কুলার জারি করেন, এই বিশেষ বিষয়গুলি কেবল নেটিভ ম্যাজিস্ট্রেটরাই বিচার করবেন এবং এক্ষেত্রে
কোনও মীমাংসায় পৌঁছানো অসম্ভব হলে তদন্ত মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
পরবর্তীকালে সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই বিলের
বিরোধিতা করে তুমুল বিক্ষোভ করা হয়। ধর্মীয় রীতি নীতির দোহাই দিয়ে বিল পাশের
বিরোধিতা তুমুল আকার নেয়। অথচ যেখানে মনু সংহিতায় নারীর ঋতুকাল ষোল বলে উল্লেখ করা
আছে সেখানে হিন্দু নারীর দৈহিক শুদ্ধতা, যৌনবিধি, চিকিৎসাশাস্ত্র, নীতিবিদ্যা ও আচারগত বৈশিষ্টকে হাতিয়ার বানিয়ে
যৌনতায় নারীর সম্মতিকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করা হতে থাকে। বলা হয় বাংলার উষ্ণ
আবহাওয়ায় ঋতুকাল অনেক আগেই এসে যায়। এই বিষয়ে তখনকার পত্রিকারাও সমানভাবে সঙ্গত
করে। এই গণ- অসন্তোষ সদ্য প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেসি আন্দোলনমূলক রাজনীতির সমার্থক হয়ে
উঠতে পারে, এরকম আশঙ্কা তৈরি হয়। যে
তিনটি পত্রিকা এই বিক্ষোভে সবচেয়ে বড় নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা হল ‘বঙ্গবাসী’, ‘দৈনিক সমাচার চন্দ্রিকা’ ও ইংরেজি ‘দ্য
অমৃতবাজার পত্রিকা’। এদের মুল বক্তব্য ছিল ‘সহবাস সম্মতি বিল’ পাশ করিয়ে ইংরেজ
সরকার হিন্দুর পবিত্র, সনাতন
গার্হস্থ রীতিতে আঘাত হেনেছে, জাতির
অভিমানে আঘাত করেছে। ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকার একটি লেখায় বলা হল,
“বাঙালি মেয়েরা
বাল্যকাল থেকেই স্বামীর সন্নিকটে থাকে। তারা স্বামী ব্যাতীত অন্য কোনও পুরুষের
মুখদর্শন করে না। হিন্দু শাস্ত্রের নিহিত অর্থ তাই বিদেশিদের কাছে অগম্য। এর অর্থ
একমাত্র সাত্ত্বিক হিন্দুরাই বোঝেন।...কোনও বিদেশির পক্ষে হিন্দু রীতি নীতি, আচার অনুষ্ঠাণের অর্থ বোঝা অসম্ভব। হিন্দু
বিধান অনুসারের একটি মেয়ের বাল্যকাল শেষ হয় আদ্যঋতু অনুযায়ী, তার বয়স অনুযায়ী নয়।”
‘দৈনিক সমাচার
চন্দ্রিকা’ লেখে, "সারাদিন একফোঁটা
জলও না খেয়ে হিন্দু মেয়েরা একাদশী ব্রত পালন করে। তাদের মধ্যে যারা দুর্বল শরীরের, তারা একাদশী পালন করতে গিয়ে মরমরও হয়ে যায়। এটি
স্মার্ত রঘুনন্দনের বিধান। এবার কি ইংরেজ ও ইংরেজি শিক্ষিত বাবুরা একাদশী পালনও
নিষিদ্ধ করবেন।"
অর্থাৎ, তাদের যুক্তি ছিল খুব স্পষ্ট। দরকার হলে আরও বহু হিন্দু মেয়ে ফুলমণির মতো
মৃত্যুবরণ করবে। কিন্তু আদ্যঋতুর পর স্বামীসংসর্গের যে ‘গর্ভাধান’ রীতি চালু আছে, তা মান্য করতেই হবে। যদি কেউ অন্যথা করে, সে সাচ্চা হিন্দু নয়। বিয়ের বয়স বারো বছরে
বাধ্যতামূলক করে বিদেশি শাসক হিন্দুধর্মে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ করছে। বারো বছর হবার
আগেই, দশ বছরেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে
যাওয়া কাঙ্ক্ষিত, কারণ, অপবিত্র নারীর গর্ভে জন্মানো সন্তান পিণ্ডদানে
অসমর্থ হয়।
‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা এই
সময় বাল্য বিবাহের সমর্থনে স্মার্ত রঘুনন্দনের বিধান প্রচার করতে থাকে। তারা লেখে,
“নিজের সন্তানের মরামুখ
দেখার চেয়েও হিন্দুর কাছে নিজের ধর্ম ও কৃষ্টি বাঁচিয়ে রাখা ঢের বেশী
গুরুত্বপূর্ণ।”
এই বিক্ষোভকালে বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায় হিন্দু
ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কিত তথ্য প্রমাণ হিসাবে দাখিল করে প্রতিবাদ করা হতে থাকে।
যার ভিতরে কোনও একটিও সারগর্ভ যুক্তি থাকত না। শুধুমাত্র গা-জোয়ারি ফতোয়াই একমাত্র
উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। এবং এই ফতোয়ার চরিত্র সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ছিল। হিন্দু রমণীর
শরীর এই প্রথম পাশ্চাত্য শাসকের বিরুদ্ধে এক চলমান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছিল।
কিন্তু এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল ফুলমণির মতো আরও অনেক বালিকাবন্ধু, দাম্পত্য ধর্ষণের শিকার হয়েছিল তারা। তাদের
অশ্রুত কণ্ঠস্বর আর কোনওদিনই শোনা যায়নি।
২৫ জুলাই, ১৮৯১-এর ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় এ রকমই এক হতভাগিনীর কথা প্রকাশিত হয়েছিল, যে বয়স্ক স্বামীর দ্বারা যৌন অত্যাচারিত হয়ে
কেস ফাইল করে-
“আমি জানি না আমার সঠিক
বয়স কত। আমি বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছইনি এখনও। আমি ঘুমোচ্ছিলাম, যখন আমার স্বামী আমার হাত টেনে ধরে... আমি চিৎকার করে উঠি। সে নিজের হাত
দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে। তার পাশবিক শক্তিতে আমি জ্ঞান হারাই। আমার স্বামী আমায়
ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে। যখন আমি কেঁদে উঠি সে আমার পেটে লাথি মারে। স্বামী
কোনওভাবেই আমায় সমর্থন করে না। সে আমায় তিরস্কার করে ও নিয়মিত মারধর করে। আমি তার
সঙ্গে থাকতে পারছি না”।
কিন্তু তৎকালীন কোর্ট এইরূপ এজাহারের পরেও
স্বামীটিকে নির্দোষ মেনে রেহাই দেয় এবং মেয়েটিকে ওই স্বামীর সঙ্গেই থাকতে বাধ্য
করে।
বিশ শতকের শেষ দশক থেকে ভারতে যে হিন্দুত্ববাদী
রাজনীতির ক্রমান্বয়ী উত্থান আমরা দেখি, তার সূত্র খুঁজতে গেলে উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলা থেকে উত্তর ভারত জুড়ে
হিন্দু জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির উত্থানকে বুঝতে হবে। হিন্দু পরিবার, দাম্পত্য, মেয়েদের বিবাহ ও কঠোর অনুশাসন সম্পর্কে যে যে যুক্তির অবতারণা সেদিন করা
হয়েছিল, অবিকল সেই ভাবনারই
রাষ্ট্রবাদী বিস্তার পরবর্তীকালে পরিলক্ষিত হয়।
বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘অপরাধ’ হিসাবে গণ্য করা যায় কি
না, সে বিষয়ে ২০২২ সালে দিল্লি হাই
কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ দ্বিখণ্ডিত রায়দান করে। যে প্রশ্নটিতে দুই বিচারপতি
ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি, তা হল, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারার এক্সেপশন টু বা দ্বিতীয়
ব্যতিক্রমকে (যেখানে বলা হয়েছে যে, স্ত্রীর
অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও কোনও স্বামী যদি তাঁর সঙ্গে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হন, তা ধর্ষণ নয়) অসাংবিধানিক বলা যায় কি না।
বিচারপতি রাজীব শকধেরের মতে, এই
ছাড়টি সংবিধানের ১৪, ১৯ ও ২১ ধারার
মতো অংশে আলোচিত মৌলিক অধিকারের প্রাথমিক ধারণাটির পরিপন্থী। বিচারপতি হরি শঙ্কর
এই ছাড়টিকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে অসম্মত, কারণ তাঁর মতে, দণ্ডবিধিতে
এই ছাড়টি রাখা হয়েছে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের গায়ে যাতে ধর্ষণের অভিযোগের কলঙ্ক না
লাগে, তা নিশ্চিত করতে, এবং বৈবাহিক প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে। ১৮৯১
সালে ফুলমণির মৃত্যু নিয়ে যে প্রবল জনআন্দোলন হয়েছিল তার ফলে একটাই পরিবর্তন হল—
বিবাহিত জীবনে যৌনতায় সম্মতি জানানোর বয়স ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করা হল।
তারপর কেটে গিয়েছে ১৩৫ বছর। ধর্ষণ বিষয়ে একাধিক আইন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত
হয়েছে, আইনসভায় পাশ হয়েছে একাধিক
সংশোধনী। কিন্তু এখনও আইন সংশোধন করে ৩৭৫ ধারার দ্বিতীয় ব্যতিক্রমটিকে বাদ দেওয়ার, অথবা বিচারবিভাগীয় পদ্ধতিতে এই ব্যতিক্রমটিকে
অসাংবিধানিক ঘোষণা করার কথা উঠলে সমাজের ঠিকাদারদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। কারণটা
বিচারপতি হরি শঙ্করের কথাতেই আছে— বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
ঘটনা হল, আইন কমিশনের ৪২তম এবং ১৭২তম রিপোর্টে এই ব্যতিক্রমটিকে বহাল রাখার পক্ষেই
মত দেওয়া হয়েছে। চোখে পড়ার মতো একমাত্র ব্যতিক্রম বিচারপতি বর্মা কমিটির রিপোর্ট—
২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পর ধর্ষণ আইনের বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য এই কমিটি
গঠিত হয়েছিল। কমিটির প্রায় সব সুপারিশই গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিষয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি বৈবাহিক
ধর্ষণকে ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থাটিকে তুলে দেওয়ার সুপারিশটিকে প্রত্যাখ্যান করে।
ভারতীয় দণ্ডবিধিতে বৈবাহিক ধর্ষণকে ছাড় দেওয়ার
প্রথাটি ঢুকেছিল ঔপনিবেশিক আমলের ভিক্টোরীয় নৈতিকতার হাত ধরে। দু’টি যুক্তির উপর
এই ছাড়ের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল— আইনের ভাষায় যে যুক্তি দু’টির নাম যথাক্রমে
কনভার্চার এবং ইমপ্লিসিট কনসেন্ট। ‘কনভার্চার’ কথাটির অর্থ হল, বিবাহ সম্পন্ন হলে স্বামী ও স্ত্রী আইনের চোখে
অভিন্ন সত্তায় পরিণত হন— কাজেই, স্বামীর
পরিচয় ব্যতিরেকে স্ত্রীর আর স্বতন্ত্র কোনও পরিচয় থাকতে পারে না। এই ধারণাটি
দাঁড়িয়ে আছে একটি ভিন্নতর ধারণার উপর— জীবনের প্রতিটি ধাপেই মহিলাদের কারও না
কারও দেওয়া নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়। কনভার্চারের এই ধারণাটি স্ত্রীকে কার্যত
স্বামীর সম্পত্তি হিসাবে দেখে। কাজেই, স্ত্রীর যৌনতাও স্বামীরই সম্পত্তি। অন্য কেউ যাতে সেই সম্পত্তিতে দখল না
বসাতে পারে, ধর্ষণ আইন তা নিশ্চিত
করবে। কিন্তু, স্ত্রীর যৌনতার উপর
স্বামীর অধিকার সর্বদাই প্রশ্নাতীত! তেমনই, ইমপ্লিসিট কনসেন্ট বা অন্তর্নিহিত সম্মতির তত্ত্ব বলে যে, বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি, যেখানে স্ত্রী স্বেচ্ছায় তাঁর শরীর এবং
সত্ত্বার অধিকার স্বামীর হাতে তুলে দেন, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। স্পষ্টতই, এই দুই গোত্রের যুক্তির কোনওটিই স্বামী ও স্ত্রীকে একটি সম্পর্কের সমান
অংশীদার হিসাবে দেখে না। মহিলাদের সব সময়েই দুর্বল হিসাবে দেখার যুক্তিটি
পরিবর্ধিত হয়ে পৌঁছে যায় ‘স্ত্রী হলেন স্বামীর সম্পত্তি’,
এই ধারণাটিতে। এবং, সেখান থেকে কিছু গোলমেলে পূর্বানুমানে পৌঁছে যাওয়া যায়। যেমন, নারীর যৌন এবং শারীরিক স্বাধিকারের প্রশ্নটি
নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ভাবে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জুড়ে যায়। ধরে নেওয়া হয়
যে, কোনও নারী বিবাহ নামক
সম্পর্কটিতে প্রবেশ করেছেন মানেই তিনি তাঁর শরীর ও যৌন পছন্দের স্বাতন্ত্র্য সঁপে
দিয়েছেন তাঁর স্বামীর কাছে। বিবাহে আবদ্ধ হলেই স্ত্রী তাঁর স্বাতন্ত্র্য স্বামীর
হাতে তুলে দেন, ভারতীয় সুপ্রিম
কোর্ট এই অবস্থানটিকে তার সাম্প্রতিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বিষয়ক রায়ে কঠোর ভাবে
নস্যাৎ করেছে ঠিকই, কিন্তু বৈবাহিক
ধর্ষণের প্রসঙ্গে এই ধারণাটি এখনও কেন্দ্রীয় অবস্থানে রয়েছে— দিল্লি হাই কোর্টের
রায়ের একটি অংশ অন্তত সে কথাই বলে।
সেদিনের এক অখ্যাত অকালমৃত বালিকাবধূ ফুলমণির
মৃত্যু তাই আজকের গো-বলয়ে নারীধর্ষণের স্বাভাবিকীকরণের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। ফুলমণি
মরে যায়। তবু, ফুলমণিরা বেঁচে থাকে।
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। অল্প স্বল্প হলেও কিছু সামাজিক পরিবর্তনের পট পরিবর্তিত হয়।
কিন্তু আইনের ফাঁক রয়েই যায়। সেই ফাঁকের দাম চোকাতে থাকে ভারতের বিভিন্ন শহরের
মেয়েরা। হত্যাকারী নির্দ্বিধায় নারী শরীরকে করে চলে ছিন্নভিন্ন কখনও দিল্লী, কখনও উন্নাও, কখনও কামদুনি, কখনও
সন্দেশখালি আবার কখনও খাস কলকাতাতেই। সম্প্রতি কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া চিকিৎসক
‘অভয়া’র নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের জন্যও তাই সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়, আন্দোলন করতে হয়। পটভূমি পালটে যায়, শরীর পালটে যায়, নরপিশাচের চেহারা – অত্যাচারের ধরণও পালটে যায়, পাল্টায়না শুধু এই দেশের
আইন। আজও তাই বিচার পায়না ফুলমণির উত্তরসুরীরাও। বিচারের বাণী পূর্বের মতই এখনও
নীরবে নিভৃতে কাঁদে। শুধু ইতিহাসের অন্ধকার কালো পৃষ্ঠায় যুক্ত হতে থাকে আরেকটি
নতুন নাম।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
১. জনৈকা বালিকা বধুর
মৃত্যু – অর্ণব সাহা
২. https://en.wikipedia.org/wiki/Rukhmabai
৩. Phulmoni’s body: the
autopsy, the inquest and the humanitarian narative on child rape in India -
Ishita Pande
৪. Inventing
Subjects: Studies in Hegemony, Patriarchy and Colonialism - Himani Bannerji
৫. Colonial
Masculinity - Mrinalini Sinha
৬. নারীর যৌনতার অধিকার
- শমীক সেন
ভীষণ তথ্যবহুল লেখা। অবশ্য আইন থাকলেই সমাধান হয়ে যাবে না। তার সঙ্গে আইনের অপব্যবহার। এই বিষয়টা এমন একটা বিষয় যেখানে যতক্ষণ না মারাত্মক কিছু ঘটছে, অপরাধ প্রমাণ করাই মুশকিল। কারণ অপরাধী উভয় লিঙ্গেরই হতে পারে।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন