কাছ থেকে দেখা

 

 

-দাদুন, পরশু আমার স্কুলে 'গ্র্যান্ড প্যারেন্টস ডে'। আমি আমার টিচারকে বলে দিয়েছি যে তুমি আর দিদুন স্কুলে আসবে।

- না দাদুভাই, আমার পায়ে খুব ব্যথা যে, আমি কি করে যাব।

- সে কি করে হয়? প্রতি বছর এই দিনটাতে কত বাচ্চাদের দাদু, দিদান, ঠাম্মিরা আসত, কিন্তু আমার সাথে কেউ থাকত না। দাদাই-ঠাম্মিও অন্য শহরে থাকে, তোমরাও এখানে থাক না। আমি কাকে নিয়ে যাব? পাঁচ বছরের দীপ ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদ কাঁদ  গলায় বলল।

- বাবা, ঘটনাক্রমে এই বছর তোমরা এই সময়ে এখানে আছ, নয়ত প্রত্যেকবার দীপ এই দিনে স্কুলে বড্ড বঞ্চিত অনুভব করে। তোমরা পরশু ওর সাথে যেও, ওর ভাল লাগবে।

প্রতুল দত্ত জামাই শৌভিকের কথা শুনে আর প্রতিবাদ করলেন না, কিন্তু পরে একলাতে স্ত্রী জয়িতাকে নিজের মতামত তীব্রভাবে জানালেন।

- আমার দাদুভাইয়ের ওই বড়লোকি স্কুলে যাবার কোনও ইচ্ছা নেই। জয়ী, তুমি জান, ওর স্কুলের এক মাসের মাইনে প্রায় আমার পেনশনের সমান। ওর টিচারদের ছবি দেখেছি, সব যেন পটের বিবি। আমরা মফস্বলের মানুষ, তার ওপর আমাদের পড়াশোনা হয়েছে গ্রামের টিনের ছাত দেওয়া স্কুলবাড়িতে.... আমরা যে বড় বেমানান ওই ইংরেজি স্কুলে।

- আহা , নাতি অত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছে, তেমন হলে বেশি কথাবার্তা বলব না ওখানে। যাব, ঘুরে চলে আসব।

পরের দিন নিমরাজি প্রতুলবাবু এবং জয়িতাকে নিয়ে দীপ স্কুলে হাজিরা দেয়।

বিশাল বড় গেটের ওপর 'ঐতিহ্য প্রাকৃতিক স্কুল' লেখা দেখে মুখ বেজার করে প্রতুল জয়িতার কানে বললেন,

- দেখছ, ভন্ডামীর শেষ নেই।

- আহ! চুপ কর তুমি, কেউ শুনে ফেললে কি ভাববে?

 দীপের টিচার মিস শ্রেয়াকে দেখে প্রতুলবাবু অপ্রস্তুতভাবে যথাসম্ভব ইংরেজির ভান্ডার হাতড়ে বললেন,

- উই আর দীপ গ্র্যান্ড প্যারেন্ট।

- হ্যাঁ স্যার, জানি। দীপ কাল সারাদিন আপনাদের কথা বলে গেছে। স্পষ্ট বাংলাতে মিস শ্রেয়াকে উত্তর দিতে শুনে প্রতুল-জয়িতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

আরও অনেক দাদু-দিদারা এসেছেন এবং স্কুলের টিচাররা অশেষ চেষ্টা করছেন সবাইকে আপ্যায়ন করতে। দাদু-দিদাদের দিন বিশিষ্টভাবে উদযাপন করতে কয়েকপ্রস্থ কার্যক্রম রাখা হয়েছে। প্রথমে হবে 'নেচার ওয়াক' বা 'প্রকৃতি ভ্রমণ'। স্টুডেন্টরা নিজেদের দাদু-দিদাদের সাথে কাছের বাগানে যাবে এবং সাথে কিছু বস্তু কুড়িয়ে আনবে যেমন - পাতা, পল্লব, নুড়ি, ফলের শুকনো বিচি, পাখির পালক ইত্যাদি। 

ক্লাসে ফিরে আবার ওই জিনিসগুলি দিয়ে ক্রাফটের কাজও হল। প্রতুলবাবু নিজের অজান্তেই রূপনারায়ণ নদীর তীরে ছোট স্কুল বাড়িতে পৌঁছে গেলেন, যেখানে এইভাবেই কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস দিয়ে নৌকা তৈরি করে ছোটবেলায় জলে ভাসাতেন।

তারপর নাচ-গান ইত্যাদির পর এবার দাদু-দিদাদের বাড়ি ফেরার পালা। মিস শ্রেয়ার ইঙ্গিতে প্রত্যেক বাচ্চা নিজেদের দাদু-দিদাদের কব্জিতে উলের বোনা ব্যান্ড বেঁধে দিল। আপ্লুত জয়িতা জিজ্ঞেস করে জানলেন যে এইটা নাকি 'ফিঙ্গার নিটিং' বা বাংলায় বললে উলের কাঁটার জায়গায় শুধুমাত্র নিজের আঙ্গুল উপযোগ করে এই ধরনের বোনা করা হয়। বাচ্চাদের পেন্সিল ধরার জন্য আঙ্গুলে জোর আনতে এই বোনা টিচার ওদের দিয়ে করিয়েছেন।

মিস শ্রেয়া খুব আন্তরিকভাবে বললেন, "আজকাল এমনিতেই সব একার সংসার। এই একটা দিন পুরোনো প্রজন্মের সাথে সময় কাটিয়ে আমরাও অভিভূত।"

ফেরার পথে ট্যাক্সিতে প্রতুলবাবু বলেই ফেললেন, "জয়ী, আমরা অনেক সময় নিজেদের মস্তিষ্কে গাঁথা ধারণাগুলিকে সত্য বলে বিশ্বাস করি। কাছ থেকে না দেখলে অনেক সময় হিরের টুকরোকেও কাঁচ ভেবে ফেলে দিতে যাই, যেমনটা আমি করছিলাম।"


কলমে - নি বে দি তা  বো স


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন