একজন
শিশুর জন্ম তার মাকেও নতুন জীবনদান করে। সদ্যজাত অবস্থায় শিশুর পুষ্টি সম্পর্কিত বহু
ব্যাপারেই বহু ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য নতুনমাকে রীতিমত উদ্বিগ্ন করে তোলে। সদ্যজাত
শিশুর ক্ষেত্রে মাতৃদুগ্ধ নাকি বাজারজাত দুগ্ধ বেশি পুষ্টিকর, এই নিয়েও বিভিন্ন মতামত
প্রচারিত হতে থাকে। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রমতে সদ্যজাতের জন্য মাতৃদুগ্ধের কোনো বিকল্প নেই। এর মাধ্যমেই একজন শিশুর পুষ্টির যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি
পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।নিয়মিত
ও প্রয়োজন অনুযায়ী মাতৃদুগ্ধ পান করানো প্রতিটি শিশুর জন্য দরকার।
শিশুর জন্মের পরমুহূর্তেই স্তন নিঃসৃত গাঢ় হলুদাভ যে দুধ উৎপন্ন হয়, তাকে কলোস্ট্রাম (colostrum ) বলে। এটি সদ্যজাতের শ্রেষ্ঠ খাবার। ভূমিষ্ঠ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে এই দুধ পান করানো আবশ্যকীয়। শিশু জন্মের পর থেকে সাধারণত তিনদিন অবধি স্তন থেকে কোলোস্ট্রাম নিঃসৃত হয়।কোলোস্ট্রামে তুলনামুলকভাবে ফ্যাট ও ল্যাকটোজ কম থাকে এবং সোডিয়াম, ক্লোরিন ও জিঙ্ক বেশি থাকে,এতে অধিক পরিমাণে অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ প্রোটিন ইমিউনোগ্লোবিন A(lgA) এবং ল্যাক্টোফেরিন থাকে, যা শিশুকে বিভিন্ন প্রকারের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। ইমিউনোগ্লোবিন A শিশুর নাক, গলা ও পৌষ্টিকতন্ত্রে একটি প্রতিরক্ষা আবরনী তৈরি করে, যা শিশুকে বিভিন্ন অসুখ থেকে রক্ষা করে। এছাড়া এটি শিশুর দেহ থেকে মিকোনিয়াম ( Meconium) বা সদ্যজাতের কালো রঙের প্রথম মল নির্গত হতে সাহায্য করে। পরিণত দুধের তুলনায় কোলোস্ট্রাম PUFA ( polyunsaturated fatty acids ) বেশি থাকে।এছাড়া ট্রিপটোফ্যান নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিড যা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক তাও কোলোস্ট্রামে বেশি থাকে।তাই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এই দুধ ফেলে না দিয়ে শিশুকে যত বেশী পরিমানে সম্ভব পান করানো উচিত।
শিশুর
মাতৃদুগ্ধ পানের উপকারীতা
জন্মের পর থেকে ছয়মাস পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধই শিশুর পর্যাপ্ত পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সক্ষম।অন্য কোনো খাবারের প্রয়োজন হয় না, এমনকি আলাদা ভাবে জলও পান করানোর প্রয়োজন হয়না। তাই শিশু বিশেষজ্ঞরা কঠোরভাবে প্রথম ছয়মাস শিশুকে মাতৃদুগ্ধ ব্যাতিরেকে অন্য কিছু খাওয়াতে নিষেধ করে দেন। ছয়মাসের পর থেকে অন্যান্য খাবার স্বল্পপরিমানে করে ধাপে ধাপে শুরু করা হলেও কমপক্ষে দুই বছর বয়েস অবধি মাতৃদুগ্ধ পান করানো প্রয়োজন।
· প্রি-ম্যাচিউর, অসুস্থ, সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ বা কম ওজনবিশিষ্ট শিশুকেও মায়ের দুধ পান করানো বাধ্যতামুলক। সেই শিশু যদি হাসপাতালের ইনকিউবেটরে বা আইসিইউতে থাকে, তাহলেও তাকে মাতৃদুগ্ধই দিতে হয়। প্রয়োজনে মাতৃদুগ্ধ পৃথকভাবে বার করে নিয়ে টিউবের মাধ্যমে বা অন্য প্রক্রিয়ায় শিশুকে পান করানো হয়।
মায়ের দুধে থাকা উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে সাহায্য করে এবং এটি ভিটামিন ডি তৈরিতেও সহায়ক হয়।ভিটামিন ডি ( vitamin D) মানসিক ও শারীরিক বিকাশের একটি অন্যতম গুরত্বপূর্ণ উপাদান।
বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর আকস্মিক মৃত্যু (sudden infant death syndrome), সর্দি–কাশি বা জ্বর, কান পাকা, হাঁপানি, একজিমা, টাইপ-১ ডায়াবেটিস, দন্তরোগ, স্থূলতা, শিশুদের ক্যানসার এবং পরবর্তী জীবনে মানসিক রোগ প্রভৃতি সমস্যা প্রতিরোধে মাতৃদুগ্ধ পানের উপকারিতা অসীম।
· মায়ের দুধে নানা রকম ইমিউনোগ্লোবিউলিন (immunoglobulin), অ্যান্টিবডি (antibody) এবং রোগপ্রতিরোধক
(immunity) থাকে, যা শিশুকে সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়। যেসব
শিশু জন্ম পরবর্তী প্রথম ছয়মাস শুধুমাত্র ব্রেস্ট ফিডিং করেনি, তাদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া
প্রভৃতির সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা
বেশী হয়।
· মায়ের দুধের ওপর নির্ভরশীল শিশুর প্রথম বছরে তিনগুণ ওজন বৃদ্ধি হয়—এটা
গবেষণালব্ধ সত্য। তাই স্তনদুগ্ধে স্বাস্থ্য হয় না, এই
ধারণা ভুল। যখন অন্যান্য খাবার শুরু হয়ে যায়, তখনো বুকের দুধ চালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ
নবজাতক ও আরেকটু বড় শিশুও (১-৩ বছর বয়সী) এর থেকে উপকার পেয়ে থাকে।
· মাতৃদুগ্ধে
উপস্থিত DHA শিশুর বুদ্ধির বিকাশের সাথে সাথে দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে।
· মাতৃদুগ্ধ
পানকারী শিশুদের অত্যাধিক ওজনবৃদ্ধির (childhood obesity) সমস্যায় ভুগতে হয়না। এদের
ওজন সঠিকমাত্রায় বৃদ্ধি পায়।
· শিশুর পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্র মায়ের দুধের ভিটামিন, খনিজ ও
এনজাইম সম্পূর্ণরূপে শোষণ করতে ও কাজে লাগাতে সক্ষম ও প্রস্তুত; অন্য
কোনো দুধের হজমের জন্য প্রস্তুত নয়। মায়ের দুধে শিশুর বদহজম বা অ্যালার্জি হওয়ার
ঝুঁকি নেই।
· মাতৃদুগ্ধ
পান করা শিশুর অন্ত্রে উপকারী gut bacteria বেশী পরিমানে থাকায়, ফ্যাট সঞ্চয় বাধাপ্রাপ্ত
হয়। এক্ষেত্রে স্তনদুগ্ধে leptin হরমোন থাকায় শিশুর ক্ষুধাও নিয়ন্ত্রিত হয়।
· শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণে ও শারীরিক গঠন বৃদ্ধিতে যে অ্যামাইনো অ্যাসিড, প্রোটিন, শর্করা ও চর্বির সুসমন্বয় দরকার, তা মায়ের দুধেই আছে আর বয়স অনুপাতে এর পরিমাণ মাত্রা পরিবর্তিত হয়। তাই মায়ের দুধই আদর্শ ও সুষম খাবার।
মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশুদের অধিক বুদ্ধিমত্তা মাত্রা প্রমাণিত হয়েছে।
ভেজাল, রাসায়নিকের সংযুক্তি, সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত দ্রব্যাদি না থাকার দরুন এটি সর্বাধিক নিরাপদ বিকল্প।
স্তন্যপান করানোর ফলে মা-ও নানাভাবে উপকৃত হন
মা ও শিশুর আভ্যন্তরীণ আবেগ-অনুভূতির বন্ধন তৈরি করে।
· যত বেশি স্তন্যপান করানো হবে, তত দ্রুত জরায়ু সংকুচিত হয়ে আগের অবস্থানে
ফিরে আসবে।
· প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত কম হয়, শারীরিক দুর্বলতা দ্রুত
হ্রাস পায়।মা
দ্রুত আগের ওজনে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
· বয়সের সাথে সাথে অস্টিওপরোসিস হবার সম্ভাবনা কমায়।
· মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে শর্করার পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পায় ।
· ডিম্বাশয়
ও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।
· মাতৃদুগ্ধ উৎপাদনকারী হরমোন কিন্তু প্রজনন হরমোনের
নিঃসরণ দমন করতে পারে বলে, গর্ভ নিরোধকের ভূমিকা পালন
করে।
· এছাড়া বাজারজাত দুধের খরচের
সাশ্রয় হয়।কোনো রকম পাত্র বা বোতল ব্যবহৃত হয়
না বলে স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমে যায়, শিশুরা আমাশয় বা অন্যান্য সংক্রমনজনিত অসুখে কম ভোগে।
মায়ের দুধের গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি
সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে ১৯৯২
সাল থেকে ১লা থেকে ৭ই অগাস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব
মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’(world breastfeeding week) । World Alliance
for Breastfeeding Action- এর উদ্যোগে UNICEF
ও WHO এর সহযোগিতায় এই বিষয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে সারা বছর বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়।
“বিশ্ব
মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ" পালনের মাধ্যমে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।
শিশু জন্মের
প্রথম এক ঘন্টার মধ্যে মাতৃদুগ্ধ পান করানো আবশ্যক।জন্ম পরবর্তী প্রথম ছয় মাস স্তনদুগ্ধই শিশুর একমাত্র খাবার,
এই সম্পর্কে সকলকে অবহিত করা।
ছয় মাসের
পর থেকে অন্তত দু'বছর পর্যন্ত শিশু অন্যান্য খাবার খেলেও, মাতৃদুগ্ধ পান করানো প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যকর্মীদের
উপযুক্ত ট্রেনিং ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর জন্য প্রসূতি মাকে
প্রয়োজনীয় সাহায্য করা। একই সঙ্গে এই ব্যাপারে উৎসাহিত করা।
শিশুর জন্য
মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তাকে
প্রাধান্য দিয়ে এবং তা নিশ্চিত করার জন্য কর্মরত প্রসূতি মহিলাদের সুবিধা
প্রদান করার জন্য সরকারী নীতি প্রয়োগ করা।
সামাজিক তরে এই সম্পর্কিত সচেতনতা
বৃদ্ধি করা। প্রকাশ্যে জনসাধারণের মধ্যে মা যাতে শিশুকে দুধ পান
করাতে সক্ষম হন, তা নিশ্চিত করা।
এই সকল বিষয়কে গুরুত্ব
দিলেই গড়ে উঠবে এক সুস্থ সুন্দর আগামী প্রজন্ম।
কলমে - পা র মি তা ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন