আজ
আমি আপনাদের বলবো আম্রপালীর কাহিনী। সেই কাহিনীতে রয়েছে পুরাণের ছোঁয়া, এক
নগরবধূর জীবনবৃত্তান্ত, পুরাকালের সমাজব্যবস্থার নিয়মকানুনের
সংক্ষিপ্ত নিদর্শন, পিতা পুত্রের ঘাত প্রতিঘাত, গৌতম
বুদ্ধের আগমন,
তাঁর
তরুণ শিষ্য শ্রমণের প্রলোভনের সম্মুখীন হওয়া এবং পরিশেষে শান্তির বাণী। তাহলে
শুরু করা যাক।
কাহিনীর
কেন্দ্রবিন্দুতে আম্রপালী। আম্রপালী আমের নাম তো আমরা সকলেই শুনেছি। প্রায় সাড়ে
তিনশো প্রজাতির মধ্যে অন্যতম খ্যাতনামা আম হলো আম্রপালী। এই আমের নাম কিন্তু একজন
নারীর নামানুসারে দেওয়া। আজ আমরা জেনে নেবো সেই কাহিনী।
আম্রপালী
বাস করতেন বৈশালী শহরে। বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের গণতান্ত্রিক একটি শহর যেটি
বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের অর্ন্তগত। আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগের কথা।
মহানামন নামে এক ব্যক্তি নিজ কাজে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই লক্ষ্য করেন সামনের আমগাছের
নীচে ও কী?
দ্রুত
কাছে গিয়ে দেখেন, কী আশ্চর্য্য! একটি শিশু তো! সেই শিশুর নাম
তিনি দিলেন
"আম্রপালী"। তাঁর আসল বাবা মা কে তা জানা
যায়নি। যেহেতু তাঁকে আমগাছের নীচে পাওয়া গিয়েছিল, তাই নাম রাখা হয় আম্রপালী।
সংস্কৃতে আম্র মানে আম এবং পল্লব হল পাতা, অর্থাৎ আমগাছের নবীন পাতা।
এদিকে
শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিতেই আম্রপালীকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়, তার
রূপে সকল মানুষ মুগ্ধ। দেশ বিদেশের রাজপুত্র রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তার
জন্য উন্মাদপ্রায়। নানা জায়গায় এ নিয়ে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া বিবাদের খবরও আসতে
থাকে। সবাই তাকে একনজর দেখতে চায়, বিয়ে করতে চায় । এ নিয়ে আম্রপালীর মা বাবা খুব
চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাঁরা তখন বৈশালীতে সকল গণমান্য ব্যক্তিকে এর একটি সমাধান করার
জন্য বলেন। কারণ সবাই আম্রপালীকে বিয়ে করতে চায়। তখন বৈশালীর সকল ক্ষমতাবান ধনবান
ব্যক্তি মিলে বৈঠকে বসে নানা আলোচনার পর যে সিদ্ধান্ত নেয় তা হল, আম্রপালীকে
কেউ বিয়ে করতে পারবে না, কারণ তাঁর রূপ। আম্রপালী হবেন একজন নগরবধূ। এই
নগরবধূ কিন্তু সামান্য গণিকা বা দেহপসারিণী নন। তিনি হবেন নৃত্যগীতে পারদর্শী, অভিজাত
আদবকায়দায় রপ্ত এক সুন্দরী। তিনি নিজেই নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারবেন এবং
উচ্চবংশের পুরুষই পেতে পারবেন তাঁর সান্নিধ্য, সাহচর্য। কিন্তু বিয়ে
কোনোদিনও নয়।
আম্রপালী
সে সভায় পাঁচটি শর্ত রাখেন। তাঁর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপ :
(১)
নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় তার ঘর হবে
(২)
তাঁর দর্শণী হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(৩)
একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে পারবে
(৪ )
শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে প্রয়োজনে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার তাঁর গৃহে প্রবেশ
করা যাবে
(৫)
তাঁর গৃহে আগত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না
সবাই
তাঁর শর্তগুলি মেনে নেয়। এভাবে দিনে দিনে আম্রপালী বিপুল ধনসম্পদের মালিক হয়ে
ওঠেন। আম্রপালীর রূপের কথা দেশ বিদেশে আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
সে
সময়ে ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। তিনি তাঁর এক সভাসদের কাছ থেকে
আম্রপালীর কথা শুনে তাঁকে দেখার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে পড়লেন। কিন্তু চাইলেই
তো আর হলো না! আম্রপালী অপরূপা, অনন্যা। কারুর কথায় চলেন না তিনি। তাঁর যাকে
মন চায় তাকে তিনি দর্শন দেন। আকাঙ্ক্ষা করলেই দেখা পাওয়া যায় না তাঁর। তাহলে
উপায়? তখন
বিম্বিসার অনেক ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করবেন। এভাবেই
বৈশালী রাজ্যে যাবেন এবং গিয়ে আম্রপালীকে দেখে আসবেন। রাজার কৌতূহল এটাই, কী
এমন বিশেষত্ব আছে আম্রপালীর মধ্যে, কেন তাঁর জন্য সকলে এমন
পাগল। তারপর বহু চড়াই উৎরাই শেষে রাজার আম্রপালীর সাথে দেখা করার সুযোগ আসে।
আম্রপালীর
প্রাসাদ আম্রকুঞ্জে। অশেষ প্রতীক্ষার পর রাজা যখন তাঁর দেখা পেলেন, চমকে
উঠলেন তিনি। অনন্যসাধারণ রূপ আম্রপালীর। তবে রাজার আরও বিস্মিত হওয়া বাকি ছিল, কারণ
আম্রপালী প্রথম দেখাতেই তাঁকে মগধরাজ্যের রাজা হিসাবে চিনে ফেলেন এবং তাঁকে জানান
যে তিনি বহুদিন ধরেই রাজার প্রেমাসক্ত। এ কথা শুনে রাজার বিস্ময়ের সীমা থাকে না।
তিনি সাথে সাথে তাঁকে তাঁর রাজ্যের রাজরাণী বানানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু আম্রপালী
জানেন যে তাঁর রাজ্যের মানুষ এটা কখনোই মেনে নেবে না। এ নিয়ে যুদ্ধ হবে, বহু
মানুষের জীবন যাবে, রক্তপাত হবে। তাই তিনি রাজাকে দ্রুত সেখান থেকে
চলে যেতে বলেন। রাজা বিম্বিসার পরাক্রমশালী। আম্রপালীকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে বৈশালী
আক্রমন করতে তিনি সদাপ্রস্তুত। কিন্তু আম্রপালী সম্মত হন না। নিজের রাজ্যের কোনো
ক্ষতি চান না তিনি। তাই তিনি রাজাকে তাঁর নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠান এবং বৈশালীতে কোন
আক্রমণ হলে তিনি তা মেনে নেবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন।
এদিকে
বিম্বিসারের সন্তান অজাতশত্রুও আম্রপালীর প্রেমে মগ্ন। তিনি বিম্বিসারকে আটক করে
নিজে সংহাসন দখল করেন এবং আম্রপালীকে পাওয়ার জন্য বৈশালী রাজ্য আক্রমণ করে বসেন।
কিন্তু সবকিছু তো এত সহজ নয়! বৈশালী রাজ্য দখল করতে তিনি সক্ষম হন না, সাথেই
খুব খারাপভাবে আহত হন। পরবর্তীকালে আম্রপালীর সেবায় সুস্হ হয়ে ওঠেন তিনি এবং গোপনে
তাঁর নিজের রাজ্যে ফেরত যান। বিদায়ের পূর্বে অজাতশত্রু আম্রপালীকে বিবাহের
প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু আম্রপালী নিজ সিদ্ধান্তে অটল, বিয়ে
তিনি করবেন না। অজাতশত্রুর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন তিনি।
এবার
এলো গৌতম বুদ্ধর সময়কাল। গৌতম বুদ্ধ তাঁর কয়েকশো সঙ্গী নিয়ে বৈশালী রাজ্যে এলেন।
একদিন বারান্দায় বিচরণ করতে গিয়ে আম্রপালীর দৃষ্টি পড়লো এক বৌদ্ধ তরুণ
সন্ন্যাসীর উপর। শান্ত সৌম্যদর্শন সন্ন্যাসীকে দেখে আম্রপালী মুগ্ধ হয়ে গেলেন, সত্বর
দেখা করলেন গৌতম বুদ্ধর সঙ্গে। সেই সন্ন্যাসীর ব্যাপারে জানতে চাইলেন, বড়ো
ভালো লেগেছে যে তাঁকে। আম্রপালী গৌতম বুদ্ধর কাছে সবিনয়ে অনুরোধ জানালেন
সন্ন্যাসীকে চারমাস নিজের কাছে রাখার জন্য। সবাই ভাবলো বুদ্ধ কখনোই সম্মত হবেন না।
কিন্তু গৌতম বুদ্ধ রাজি হলেন এবং এটাও বললেন "আমি শ্রমণের (তরুণ সে
সন্ন্যাসীর নাম) চোখে কোন কামনা বাসনা দেখছি না। সে চারমাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়েই ফিরে
আসবে এটা আমি নিশ্চিত।"
চার
মাস অতিক্রান্ত। গৌতম বুদ্ধর তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বৈশালী থেকে বিদায় নেওয়ার সময়
এসেছে। কিন্তু তরুণ শ্রমণের কোন খবর নেই। সকলের চোখে মুখে প্রশ্ন, বিস্ময়, উদ্বেগ।
তবে কি আম্রপালীর রূপের কাছে হেরেই গেলো শ্রমণ?
কিন্তু
না, সবাইকে
অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে এলেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে অনুসরণ করে এলেন একজন
নারী। সেই নারী ছিলেন আম্রপালী। স্মিত হেসে বলেন, তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে
কোনও চেষ্টাই তিনি বাকি রাখেননি। কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষের উপর প্রভাব বিস্তার
করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালী। আজ সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের চরণে
আশ্রয় চান আম্রপালী। আম্রপালীর সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। নিজের সব সম্পত্তি, প্রাসাদ, উদ্যান
বৌদ্ধ সঙ্ঘে দান করে দিয়েছিলেন তিনি। বাকী জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন
ইতিহাস বিখ্যাত সেই রমণী। এই আম্রপালীর নামেই ১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা দশোহরি
ও নিলাম — এই দু'খানি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এক নতুন
জাতের আম উদ্ভাবন করেন এবং নাম রাখেন আম্রপালী।
এবার
বলুন, কেমন
লাগলো আম্রপালীর ইতিকথা? এরকম অনেক কাহিনীই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুর সঙ্গে।
কলমে - ত মা লি কা ঘো ষা ল ব্যা না র্জী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন