“মন করীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।... সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতিকে জব্দ করে রেখেছে।”
- শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস
অগ্নির মতো আত্মদম্ভী
দেবতারা একবার ব্রহ্মকে অস্বীকার করতে চাইলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন,
যুগে যুগে অসুরদের বিরুদ্ধে তাঁদের যে যুদ্ধ হয়েছে,
তাতে জয়ের সমস্ত কৃতিত্ব একমাত্র তাঁদেরই! তাঁরা প্রচার
করতে লাগলেন যে, নিজেদের বাহুবলেই এতদিন তাঁরা জিতেছেন, ভবিষ্যতেও জিতবেন! এই ধরণের কথা শুনে,
ব্রহ্ম স্মিত হাসলেন। অবোধ ঔদ্ধত্যের জন্য দেবতাদের ক্ষমা
করলেন। স্বয়ং এলেন তাঁদের কাছে, সত্যপথ দেখিয়ে দেবার জন্য। তিনি তাঁদের অহং বিনষ্ট করার
জন্য সামনে রাখলেন একটি ঘাসের টুকরো। বললেন, টুকরোটিকে সরিয়ে দিতে। দম্ভী দেবতারা তখন অহংকারে অন্ধ।
সামান্য ঘাসের টুকরো সরানোর আহ্বান তাঁদের কাছে নিতান্তই বালখিল্য বলে মনে হল।
বিকৃতবিভঙ্গে হাসতে হাসতে ব্রহ্মকে তাঁরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে লাগলেন। ব্রহ্মর
ঠোঁট থেকে স্মিত হাসি তবু সরল না। এমনকি পূর্ব-আহ্বান থেকেও তিনি সরে দাঁড়ালেন না।
তখন দেবতারা ব্রহ্মকে বোকা প্রমাণ করতে তৎপর হলেন। তাচ্ছিল্য করতে করতে প্রথমে
এগিয়ে এলেন অগ্নি, তিনি তাঁর লেলিহান আগুনে ঘাসের টুকরোটিকে ছাই করে দিতে
চাইলেন নিমেষে। পারলেন না। তখন পবন এলেন প্রবল হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে। কিন্তু,
তিনিও পারলেন না। বরুণ এলেন, চাইলেন উত্তাল জলস্রোতে ভাসিয়ে দিতে। হ্যাঁ,
তিনিও ব্যর্থ হলেন। তবু তাঁরা ব্রহ্মকে চিনতে পারলেন না।
রাগে অন্ধ হয়ে ব্রহ্মকেই বিনষ্ট করতে চাইলেন! কিন্তু, সে তো অসম্ভব। অবধারিত শোচনীয়রকমভাবে পরাজিত হলেন। বাধ্য
হলেন নতিস্বীকার করতে। তখন ব্রহ্ম থেকে উদ্ভূত হয়ে আবির্ভূত হলেন হৈমবতী দেবী উমা,
'জগদ্ধাত্রী'। তিনিই দেবতাদের দান করলেন পূর্ণব্রহ্মের জ্ঞান। পরাজিত
দেবতারা সেই দেবীর শরণে আসলে, প্রকৃত সত্য বুঝলেন- ভগবতীর কৃপাতেই তাঁরা শক্তি পেয়েছেন।
সমস্ত শক্তি ভগবতীর, তাঁরা নিমিত্ত মাত্র।
১৮৯৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি,উপরে ডানদিকে কোণায় দেবী জগদ্ধাত্রী, বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত
সামবেদীয় কেনোপনিষদে
উল্লিখিত এই উপাখ্যানের অনুরূপ একটি গল্প ‘কাত্যায়নীতন্ত্র’ এ ৭৬ পটলে দেখা যায়-
এই কাহিনি অনুসারে : একদা ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র – এই চার দেবতা অহংকার-প্রমত্ত হয়ে নিজেদের
ঈশ্বর মনে করতে শুরু করলেন। তারা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাদের স্বতন্ত্র কোনও
শক্তি নেই – মহাশক্তি পার্বতীর শক্তিতেই তারা বলীয়ান। দেবগণের এই ভ্রান্তি
অপনয়নের জন্য দেবী জগদ্ধাত্রী ( পার্বতী) কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের
প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। এর পরের কাহিনি কেন
উপনিষদে বর্ণিত তৃণখণ্ডের কাহিনির অনুরূপ। দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে
তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে অসমর্থ হলেন। দেবগণ
নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন। তখন দেবী তার তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি
ধারণ করলেন। এই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ও দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এক
মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তি। সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে দেবী দেবগণকে এই মূর্তি
দেখালেন; দেবগণও তার স্তবে প্রবুদ্ধ হলেন। ‘কোটিসূর্যপ্রতীকাশং চন্দ্রকোটিসমপ্রভম্’ এই
জ্যোতির্ময়ী দেবী হলেন মা জগদ্ধাত্রী যিঁনি ‘ব্রহ্মশক্তিস্বরূপিণী’।
দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী। একই মাতৃশক্তির তিন রূপ। দুর্গা রণরঙ্গিনী মহিষমর্দিনী যুদ্ধদেবী। কালী রক্তপিপাসু রনোন্মত্ত উগ্রচন্ডা। কিন্তু জগদ্ধাত্রী জগৎধারিনী। শান্ত প্রসন্নময়ী। সিংহবাহিনী মাতৃমূর্তি। তিনদেবী যথাক্রমে রজো, তমো আর সত্ত্বগুণের প্রতীক। বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশভাবনাতেও এই ত্রয়ীমাতৃশক্তির প্রভাব পড়েছে। তবে মূর্তি সাক্ষ্যে কালীর মতো জগদ্ধাত্রীও অর্বাচীন দেবী।বরিশাল থেকে প্রাপ্ত যে প্রস্তরমূর্তিটি জগদ্ধাত্রীর বলে দাবী করা হয় বিশেষজ্ঞদের মতে চতুর্দশ শতকের। সেই দিক থেকে দুর্গার প্রাচীনত্ব অনেক দিনের।
কার্তিকেহমলপক্ষস্য
ত্রেতাদৌ নবমেহহনি।
পূজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং
সিংহপৃষ্ঠে নিষেদুষীম।।
-ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে
কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে সিংহপৃষ্ঠে সমাসীনা দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা
করিবে।
সর্বদেবহিতার্থায়
দুর্বৃত্তশমনায় চ।।
আবিরাসীৎ জগচ্ছান্ত্যৈ
যুগাদৌ পরমেশ্বরী।।
-দেবগণের
হিত, দুর্বত্তের
প্রশমন এবং জগতের শান্তিবিধানের জন্য যুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের
মঙ্গলবারে পরমেশ্বরী (জগদ্ধাত্রী) আবির্ভূতা হলেন।
শূলপাণির পূর্বে রচিত
স্মৃতিসাগরগ্রন্থে কার্তিকমাসে উমাপুজোর উল্লেখ রয়েছে। মহামহোপাধ্যায় পঞ্চানন
তর্করত্ন মনে করেন কেনোপনিষদে উল্লিখিত উমা-হৈমবতীই হলেন জগদ্ধাত্রী। (দ্রষ্টব্যঃ
হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ তৃতীয় পর্ব, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য পৃ--৩০৮) কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের
সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। তাঁকে অষ্টাদশ শতকের বলে মনে করা হলেও অনেকেই দাবী করেছেন
তিনি ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকের তন্ত্রসাধক। তাঁর লেখা জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্রে দেবীর
রূপটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেবী ত্রিনেত্র, চতুর্ভূজা, দুটি বামহাতে যথাক্রমে শঙ্খ আর ধনুক। ডানহাত দুটিতে চক্র ও
তীর। দেবীর বাহন সিংহ। ললিতাসনে উপবিষ্ট। দেবী করিন্দ্রাসুরকে নিহত করেছিলেন। তাই
পদতলে হস্তীমুণ্ড। মোটামুটি এই ধ্যানের বর্ণনানুযায়ী জগদ্ধাত্রীর প্রতিমাগুলি আজও
নির্মিত হচ্ছে। তবে সহায়ক মূর্তির বৈচিত্র দেখা যায়। কোথাও কোথাও জয়া বিজয়া। কোথাও
নারদ ও বশিষ্ঠমুনি। অনেক মূর্তিতে চালির দুপাশে চামর হাতে উড়ন্ত জোড়া বিদ্যাধরী।
লোকমুখে যার পরিচিতি পরী বা অপ্সরা।
জগদ্ধাত্রীকে দেবীদুর্গার নামান্তর বলা হয়। মুলত জগদ্ধাত্রী পূজা হল প্রকৃত ভাবে একদিনের নিষ্পাদ্য দুর্গাপূজা। অধ্যাপক চিন্তাহরণ চক্রবর্তীও এই কথা বলেছেন। তবে বোধন ষষ্ঠাদি সংকল্প আর নবপত্রিকার বিষয়টি নেই। সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর পুজো হয় একদিনে। যথারীতি দুর্গাপুজোর মতোই কুমারীপুজো সিঁদুরখেলা ও বিজয়া দশমী রয়েছে। এছাড়া দুর্গা যেমন মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, জগদ্ধাত্রী তেমনি করিন্দ্রাসুরকে নিহত করেছিলেন। অনেকেই বলেন দেবীদুর্গার অপর নাম জগদ্ধাত্রী।পার্থক্য বলতে জগদ্ধাত্রীপুজো হয় দুদিনে আর দুর্গাপুজো চারদিনের। জগদ্ধাত্রী পূজার নিয়মটি একটু স্বতন্ত্র। দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজার ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। কোথাও কোথাও প্রথম বা দ্বিতীয় পূজার পর কুমারী পূজারও আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার ন্যায় জগদ্ধাত্রী পূজাতেও বিসর্জনকৃত্য বিজয়াকৃত্য নামে পরিচিত। এমনকি পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্রও দুর্গাপূজার অনুরূপ।
যেসব পুরাণে মহিষাসুর বধের ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে, সেই অধ্যায়গুলো ভালোমত পড়লে দেখা যায় দেবী দুর্গা আবির্ভূত হওয়া থেকে মহিষাসুর সংহার পর্যন্ত আগাগোড়া দশভূজা ছিলেন না। প্রকটকালে নিজ ইচ্ছায় তিনি কখনো দশভূজা, কখনো অষ্টাদশভূজা, পুনরায় হয়েছেন সহস্রভূজা। সুদক্ষ সংগীতশিল্পী যেমন বিভিন্ন রাগরাগিনীর সুরতান নিয়ে অবলীলায় খেলা করে শ্রোতাদের বিস্মিত করে, দেবী দুর্গাও আপন অনন্ত শক্তি ও ঐশ্বর্য এইভাবে একের পর এক প্রকাশ করে দেবতাদের তাক লাগিয়ে দিলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হলে দেবী তখনো বিভিন্ন অসুরকে বধ করার সময় যুদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়েই ইচ্ছানুযায়ী বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে অধ্যায়ের শুরুতে কিছু ধ্যানমন্ত্র এর প্রমাণ বহন করে। অসুরেরা মায়ের পরাক্রম দেখে হতচকিত, মায়া দেখে আরোই স্তম্ভিত। যুদ্ধ চলাকালীন হাতের সংখ্যা বাড়া বা কমার সাথে বদলেছে হাতে থাকা অস্ত্রশস্ত্রের ধরণ, সংখ্যা এবং বিন্যাসও, সঙ্গে বদলেছে দেবীর গাত্রবর্ণও। আমার ধারণা, মহিষাসুর যখন মায়াবলে সিংহরূপ ছেড়ে হস্তীরূপ ধারণ করে, দেবীও তখন "দ্যাখ আমিও পারি" বলে দশভূজা থেকে চতুর্ভূজা হয়ে গেলেন।
দশটা হাতের অস্ত্র তো আর চারহাতে আঁটবে না, তাই ত্রিশূল, খড়্গ, ইত্যাদিকে স্বল্পকালের জন্য বিদায় দিয়ে চারহাতে দেবী রেখে দিলেন শঙ্খ, চক্র এবং ধনুক ও বাণ। আর হাতে যে নাগপাশখানা ছিল, সেটা গলায় জড়িয়ে নিলেন। ওই বউ-ঝিরা ঝগড়া করার সময় রেগে গেলে যেমন শাড়ীর আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নেন আর কি, ঠিক তেমন। হস্তীরূপী মহিষকে পদদলিত করে সিংহ দেবীকে পিঠে নিয়ে দাঁড়ালো তার উপর। জগৎ পেল এক নবীন মাতৃরূপের দর্শন, নারদাদি ঋষিগণ গদগদচিত্তে সেই রূপের স্তবে ব্যাপৃত হলেন, শাস্ত্র সেই রূপকে সম্বোধন করলো "জগদ্ধাত্রী" নামে।
প্রচলিত কিংবদন্তীতে জগদ্ধাত্রীপুজোর উদ্ভবের প্রেক্ষাপটেও দুর্গার যোগ নিবিড়। কথিত আছে নদিয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র রায় একবার মুর্শিদাবাদে নবাবের কোষাগারে সময় মতো রাজস্ব দিতে না পারার জন্য কাররারুদ্ধ হন। তখন ছিল দুর্গাপুজোর সময়। দুর্গাভক্ত রাজা অত্যন্ত ব্যথিত হলেন দেবীপুজো যথাসময়ে না করতে পারার জন্য। দেবীদুর্গা স্বপ্নে রাজাকে জানিয়ে দিলেন চিন্তার কিছু নেই। কার্তিক নবমীতে তাঁকে জগদ্ধাত্রী রূপে আরাধনা করলেই চতুর্বর্গ লাভ করবেন। লোকবিশ্বাস-সেই থেকে বাংলাদেশে জগদ্ধাত্রীর পুজো চালু হয়ে যায়; বিশেষ করে জমিদারি মহলে ও ধনাঢ্য শাক্তপরিবারে।
দেবীর আরেক নাম শাক্তপ্রিয়া। নবমীতিথি শাক্তসংস্কৃতিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ। আষাঢ় নবমী তিথিতে অধিকাংশ গ্রাম্যদেবী চণ্ডীর পুজো হয়। এই তিথিতে রাঢ় অঞ্চলে যোগাদ্যা গন্ধেশ্বরী শিবাখ্যা শাকম্ভরী প্রভৃতি প্রাচীন শাক্তদেবীর বিশেষ পুজো হয়। সবমিলিয়ে দুর্গাপুজো বছরে তিনবার হলো যথা বসন্তকালে বাসন্তি দুর্গা। শরৎকালে শারদ দুর্গা। আর হেমন্তকালে হৈমন্তিক দুর্গা অর্থৎ জগদ্ধাত্রী পুজো।
তবে দুর্গার সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর পার্থক্য আছে যথেষ্ট। জগদ্ধাত্রী রণরঙ্গিনী যুদ্ধদেবী নন। তিনি প্রসন্ন মাতৃমূর্তি। দুর্গাপুজো রাজসিক উৎসব। দশেরা উৎসবে দশ দিন ধরে এই যুদ্ধাদেবীর পুজো হয়। যদিও বাঙালীর কাছে দুর্গা ক্রমশ ঘরের মেয়ে উমা হয়ে উঠেছে। তবে যতই আদরের কন্যা হয়ে উঠুক দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী রূপেই পূজিত। কিন্তু জগধাত্রী সাত্ত্বিক পুজোর দৃষ্টান্ত। প্রসন্নময়ী মাতৃ রূপে তিনি ধরা দিয়েছেন। কার্তিক পুজো বা রাস উৎসবে দেবদেবীকে নিয়ে নাটকীয় ভাবে মূর্তি সাজিয়ে যে বিশেষ শিল্পরূপ "থাকা"র আয়োজন করা হয় তার সর্বোচ্চে থাকে থাকেন শিশুকোলে জগদ্ধাত্রী।
পুরাতাত্ত্বিকদের মতে মূর্তিগত দিক থেকে দুর্গার মহিষমর্দিনী ও মহিষাসুরমর্দিনীমূর্তির পার্থক্য আছে। মহিষমর্দিনীমূর্তিতে মহিষকে দেবী নিহত করেছেন। এই মূর্তি প্রাচীন। মৌর্য পরবর্তী যুগ থেকে ভাস্কর্যে দেখা গেছে। তারপর সময়ের অগ্রগতিতে মহিষ থেকে ক্রমশ মহিষাসুরে পরিণত হয়েছে। ফলে দেবীর পরিচিতি তখন মহিষাসুরমর্দিনী।এই মূর্তি অপেক্ষাকৃত নবীন। দেবীর বাহন সিংহও বদলেছে। প্রচলিত সিংহর পরিবর্তে ঘোড়ামুখো সিংহ হয়েছে। যা টেরাকোটা দুর্গাফলকে বা বনেদি বাড়ির দুর্গা মূর্তিতে আজও দেখা যায়। পাশাপাশি চতুর্ভূজা আরেক ধরনের পাথরের তৈরি মাতৃমূর্তি গুপ্ত পরবর্তী সময় থেকেই মিলেছে। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে দেবীর নাম- সিংহবাহিনী। বাংলাদেশ ও বিহার ঝাড়খন্ডে প্রচুর এই 'সিংহবাহিনী' মূর্তি পাওয়া গেছে। কাটোয়া থানার কড়ুই গ্রামে সংরক্ষিত আনুমানিক দশম শতকের একটি সিংহবাহিনী মূর্তি রুদ্রানী নামে পূজিত হয় এখানে দেবীর বাহন সিংহ রয়েছে। এই মূর্তি মহিষমর্দিনীর মতোই প্রাচীন। দিল্লীর এ এস আই ডেপুটি সুপার-ইন-টেনডেন্ট আর্কিওলজিস্ট শুভ মজু্মদারের মতে -"মহিষমর্দিনী বা মহিষাসুরমর্দিনী নয়; প্রাচীন সিংহবাহিনীর দেবীর সঙ্গেই আধুনিক জগদ্ধাত্রীর প্রভূত মিল রয়েছে। জগদ্ধাত্রীকে মহিষমর্দিনী বা মহিষাসুরমর্দিনীর সংগে একাত্ম করার জন্যই পরবর্তীকালে মহিষাসুরের সাদৃশ্যে করিন্দ্রাসুরের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। "বলা বাহুল্য মহিষাসুরের মতো পূর্ণাঙ্গ পৌরাণিক পরিচিতি নেই করিন্দ্রাসুরের।
পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত। বীরভূমের হেতমপুর শিবমন্দিরে, চন্ডীদাস নানুরের শিবমন্দিরে , ইলামবাজারের দেউলমন্দিরে টেরাকোটা জগদ্ধাত্রীর মূর্তি আছে। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয়। জগদ্ধাত্রী দেবীর প্রতিমার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন, “অর্ক বা সূর্যই বিশ্বের পোষণকর্তা। পৃথিব্যাদি আবর্তনশীল গ্রহ-উপগ্রহদিগকে সূর্যই নিজের দিকে আকর্ষণ করে রেখেছেন। দেবী জগদ্ধাত্রীর মধ্যেও ধারণী ও পোষণী শক্তির পরিচয় বিদ্যমান। তাই তাঁকে বলা হয়েছে বালার্কসদৃশীতনু। একই কারণে জগৎপালক বিষ্ণুর শঙ্খ-চক্র-শার্ঙ্গধনু-আদি আয়ুধ দেবীর শ্রীকরে। দেবীর রক্তবস্ত্র ও রক্তবর্ণের মধ্যে, দেবীর সিংহাসনস্থ রক্তকমলে সেই রজোগুণেরই ছড়াছড়ি। রজোদীপ্ত বলেই জগদ্ধাত্রী মহাশক্তিময়ী। তাঁর অস্ত্রশস্ত্র, তাঁর বাহন – সকলই তাঁর শক্তিমত্তার ভাবটি আমাদের অন্তরে উদ্দীপ্ত করে দেয়। তবে দেবীর এই বীর্য সংহারের নয়। পরন্তু সমগ্র বিশ্বকে মহাসর্বনাশ থেকে রক্ষাপূর্বক তাকে আত্মসত্তায় – ঋতে ও সত্যে সুস্থির করে রাখবার জন্য। নাগ বা সর্প যোগের পরিচায়ক। উপবীত ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতীক। দেবী জগদ্ধাত্রী ব্রহ্মময়ী; তিনি পরমা যোগিনী। মহাযোগবলেই ব্রহ্মময়ী ধরে আছেন এই নিখিল বিশ্বসংসারকে। এই জগদ্ধারণই জগদ্ধাত্রীর পরম তপস্যা – তাঁর নিত্য লীলা, তাঁর নিত্য খেলা। জননীরূপে তিনিই বিশ্বপ্রসূতি, আবার ধাত্রীরূপে তিনিই বিশ্বধাত্রী।”
তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হত। জগদ্ধাত্রী পূজা প্রথমে কট্টর ভাবেই প্রচলিত ছিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে। দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক যা ব্রাহ্মণদের একটি বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করা হয়। দেবীর গলায় থাকে নাগযজ্ঞোপবীত যা স্পষ্টভাবেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পরিচায়ক। আবার, মন্ত্রে এই দেবীকে সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে বিকল্প এবং শ্রেণিবিভাগ। সত্ত্বগুণধারিণী জগদ্ধাত্রীর পূজা করবেন ব্রাহ্মণরা, রজোগুণধারিণী দুর্গার পূজা ক্ষত্রিয়রা এবং তমোগুণধারিণী কালীর পূজা অন্যরা। পরে ব্রাহ্মণদের এই জগদ্ধাত্রী আরাধনার সূত্রটি গ্রহণ করলেন বণিকশ্রেণি। দুর্গাপূজায় তাঁদের অধিকার নেই, কালীপূজা তন্ত্রসম্মত বলে সবার সামর্থ্য নয়, অতএব রইলেন কেবল এই জগদ্ধাত্রী দুর্গাই!
তবে জগদ্ধাত্রীর সাথে বৌদ্ধ তন্ত্রেরও একটি ক্ষীণযোগসুত্র আছে জানা যায়। গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে কর্ণসুবর্ণে এসেছিলেন। তাঁর প্রভাবে গোটা কর্ণসুবর্ণ জুড়ে বৌদ্ধপরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে সম্রাট অশোক সেই ভ্রমণকে স্মরণীয় করে তুলতে কর্ণসুবর্ণের রাক্ষসী ডাঙাতে চারটি বৌদ্ধস্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। শশাঙ্ক পরবর্তী সময়েও চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ কর্ণসুবর্ণ সহ রাঢ়দেশীয় উত্তরভূমির গ্রামগুলি ভ্রমণ করেছিলেন। এই অঞ্চলের গ্রামগুলির বৌদ্ধসংস্কৃতির কথা তাঁর লেখাতে পাওয়া যায়। এইসময়ের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রাম ছিল সাল্যগ্রাম (বর্তমানে যার নাম সালার)। সাল্যগ্রাম ছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের স্থান। বৌদ্ধপরিমণ্ডল দ্বারা আবৃত অঞ্চল। বর্তমানে সালার বাদ দিয়েও সুনুটিয়া, সুনিয়া থেকে গীতগ্রাম পর্যন্ত ছিল বৌদ্ধ পরিমণ্ডলের অংশ। যদিও বর্তমান কাগ্রামে তেমন কিছু পুরানো নিদর্শন মেলেনি। অথচ কাগ্রামের নাম এসেছে কঙ্কগ্রাম থেকে এবং কঙ্কগ্রামের নামটি কঙ্ক দেবী থেকে।
সালারে 'দহ পুষ্করিণী' থেকে প্রচুর বৌদ্ধ দেবদেবীর ভগ্নাবশেষ এবং বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসশেষের চিহ্ন পাওয়া গেছে। অনেকে মনে করেন, এটাই ছিল সেনরাজাদের রাজধানী স্বর্ণগ্রাম। প্রচলিত জনশ্রুতি, এককালে এখানেই ছিল শালিবাহন রাজাদের রাজধানী এবং শালিবাহন নাম থেকে সালার নামের উৎপত্তি। যদিও শালিবাহনরাজের কোনও ঐতিহাসিক নিদর্শন মেলেনি। বলা যায়, সেনযুগ থেকেই এই অঞ্চল বৌদ্ধসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সাল্য গ্রাম বা সালার ও কঙ্কগ্রাম বা কাগ্রাম একই অঞ্চলের পাশাপাশি অংশ এবং এখানকার জাগ্রত অধিষ্ঠাত্রী হলেন দেবী কঙ্ক। দেবী কঙ্ককে অনেকে বৌদ্ধ তন্ত্রযানের দেবী মনে করেন। কালক্রমে তা হিন্দুত্বের আকার নিয়ে দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে পূজিত হয় বলে মনে করা হয়।
জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, দুর্গা বা কালীপূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ঘটে। জগদ্ধাত্রীর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় মায়াতন্ত্রে, বৃহস্পতি রায়মুকুটের স্মৃতিরত্নহারে (১৫-১৬শ শতক), কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে (১৬শ শতক) এবং শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণির কৃত্যতত্ত্বার্ণবে। অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। মহামহোপাধ্যায় শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন সেটা আগেই জানানো হয়েছে। শূলপাণির পর পঞ্চদশ ষোড়শ শতকে বৃহস্পতির রায় মুকুটের স্মৃতিরত্নহার এবং শ্রীনাথ আচার্য চূড়ামণির কৃত্যন্তত্ত্বার্নব গ্রন্থে ওই একই পক্ষমাস ও তিথিতে শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পূজার কথা উল্লেখ আছে। বাঙালি পণ্ডিত শরনদেব ১১৭২ বঙ্গাব্দে যে চন্ডীটীকা লেখেন তাতেও দেবী জগদ্ধাত্রীর কথা আছে। মোহিত রায় রচিত নানা রূপে দুর্গা গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, স্বামী জগদীশ্বরানন্দের মতে প্রায় প্রত্যেক হিন্দুতন্ত্রেই, এমনকি অসংখ্য বৌদ্ধতন্ত্রেও জগদ্ধাত্রীর কথা উল্লেখ আছে । পালরাজাদের আমলেবাংলায় তন্ত্রের বিপুল প্রভাব ছিল। সেই সময় রচিত তন্ত্র পুঁথি সমূহে জগদ্ধাত্রী দেবীর উল্লেখ আছে বলে লিখেছেন পন্ডিত ভান্ডারকর। শ্রী মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সমসাময়িক বাঙালি স্মার্ত রঘুনন্দন কর্তৃক দুর্গোৎসবতত্ত্ব পুঁথিতে জগদ্ধাত্রী পূজার কথা উল্লেখ আছে।
প্রচলিত আছে বঙ্গদেশে অন্নপূর্ণা আর জগদ্ধাত্রী পূজা নাকি নদিয়াধিপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে শুরু হয় বা তাঁর রাজত্বকালেই এর ব্যাপক প্রচলন হয়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজত্বের সময়কাল ছিল ১৭২৮ থেকে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দ। মহারাজ যেহেতু গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের প্রবল পরাক্রান্ত সমাজপতি এবং হিন্দু সংস্কৃতির একজন অধিনেতা, তাই তাঁর পক্ষে কোন পূজা প্রচলন বা মূর্তি পরিকল্পনা করা অসম্ভব ছিলনা। হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবনের কাজের মহারাজের উদ্যম ছিল অপরিমিত। সেই সময় বিশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে অগ্নিহোত্র বাজপেয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন করে তাঁর অভিধা হয়েছিল ‘রাজ রাজেন্দ্র অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়’। অন্নদাপুজোর ব্যাপারটা নয় ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্য থেকে অনুমান করা গেল, কিন্তু জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়টা কখন? অনেকে বলেন, সেটা নবাব আলিবর্দির আমল কিন্তু সেটা কিছুতেই সম্ভব না। বরং কিছুটা সারবত্তা আছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা স্বনামধন্য দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত’এর অনুমানে কিংবদন্তী অনুসারে নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালে মহাবদজঙ্গ রাজার নিকট থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। নজরানা দিতে অপারগ হলে তিনি রাজাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। মুক্তির পর নদীপথে কৃষ্ণনগরে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘাটে বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে তিনি বুঝতে পারেন সেই বছর দুর্গাপূজার কাল উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপূজার আয়োজন করতে না পেরে রাজা অত্যন্ত দুঃখিত হন। সেই রাতে দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী দুর্গার পূজা করার আদেশ দেন। অনেকে বলে থাকেন মিরকাশিমের মুঙ্গের কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুক্তিলাভের জন্য ভান করে রাজা নাকি এই দেবীর পূজা করতে বসেছিলেন।
আরও এক মতানুসারে, রাজা নাকি দেবীর স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত হন মিরকাশিমের হাজত থেকে মুক্ত হয়ে নৌকাযোগে ফেরার পথে। এই মুক্তি পাওয়ার গল্পে দেবীমহিমার কতটা হাত আছে, তা ভগবান জানেন। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনাশ্রিত উপন্যাস লেখার জন্য ওই সময়ের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে ইঙ্গিত পেয়েছি, সময়কালটা ১৭৬৩ সাল। সেই সময়ের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটার্ট, যিনি প্রায় নিজ দায়িত্বে মিরজাফরকে সরিয়ে তখ্তে বসিয়েছিলেন মিরকাশিমকে। কিন্তু নবাব হওয়ার পর নানা কারণে মিরকাশিম বেঁকে বসলেন আর পলাশির চক্রান্তের শাস্তি দেওয়ার জন্য একের পর বন্দি ও খুন করতে লাগলেন ইংরেজ ঘনিষ্ঠ ষড়যন্ত্রী রাজন্যদের। নবাবের প্রতিশোধ প্রবণতায় ছাড় পেলেন না তৎকালীন জগৎ শেঠ মহাতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপচন্দ, ঢাকার নায়েব রাজবল্লভ সেন প্রমুখ। যুবরাজ শিবচন্দ্র সহ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটক করা হল বিহারের মুঙ্গেরের কয়েদখানায়। এ দিকে ২ অগস্ট গিরিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে হেরে মিরকাশিমের সব রাগ গিয়ে পড়ল তাঁর আর্মেনিয়ান সেনাপতি গর্গিনখাঁয়ের ( বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস চন্দ্রশেখরের চরিত্র গুরগনখাঁ, আসল নাম খোয়াজা পেট্রাস গ্রেগরি) উপর। গর্গিনখাঁকে হত্যা করানোর পর হননের নেশায় পেয়ে বসল নবাবকে, আরও কয়েকজনকে প্রাণদণ্ড দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হল নদিয়ারাজেরও।
কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর দূত মারফত এই সংবাদ মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এবং তাঁর প্রাণ রক্ষার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাজা কী করে প্রাণে বেঁচে ফিরলেন, সেটা রীতিমত রহস্যময় ব্যাপার। কারাগারেই কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীর স্বপ্নাদেশ লাভ করেন এবং কারাগার থেকে মুক্তিলাভের প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন। প্রসঙ্গত রাজপরিবারের শ্রুতি থেকে জানতে পারা যায় যে কৃষ্ণচন্দ্র যে দেবীমূর্তি দেখেছিলেন তিনি চতুর্ভূজা, রক্তাম্বর-ধারিণী, নরসিংহ আসীন, হাতে ধনুর্বাণ । পূর্বেই বলেছি একদিনের জগদ্ধাত্রী পূজায় চতুর্বর্গ ফল লাভ হয়। কৃষ্ণনগরের কার্তিক নবমীতে একই দিনে জগদ্ধাত্রী পূজা সাত্ত্বিকী, রাজসিকী ও তামসী পূজা হয় প্রাতে, মধ্যাহ্নে ও সন্ধ্যায়। চন্দননগরে চার দিন ব্যাপী পূজা হয়। এই পূজা দেবী দুর্গার পূজার অনুকল্প। রাজা তাই করলেন। সেই থেকেই কৃষ্ণনগরের চালু হল জগদ্ধাত্রী পূজা।
অনুমান সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাসের পাঁচ কি ছয় তারিখ, উদয়নালার যুদ্ধে ইংরেজবাহিনীর কাছে আবার হেরে মিরকাশিম রোহতাসগড় দুর্গের দিকে পালালে কিছু সপ্তাহের ভিতর ইংরেজবাহিনী মুঙ্গের দুর্গের দখল নেয় এবং কৃষ্ণচন্দ্র ও শিবচন্দ্রকে উদ্ধার করে। পালানোর আগে অবশ্য মিরকাশিমের আদেশানুসারে জগঠ শেঠ মহাতব রায়, স্বরূপচাঁদ, রাজবল্লভ সেন প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের গঙ্গার জলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয় (নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনি)। কিন্তু ভাগ্য অত্যাধিক সুপ্রসন্ন থাকায় সে যাত্রায় কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণরক্ষা হয়। এর পরেই কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে নিয়ে উপস্থিত হন মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে। কৃষ্ণচন্দ্র এই স্বপ্নের কথা জানান এবং জানতে চান কে এই দেবী? কালীশঙ্কর তাঁকে জানান, এই দেবী স্বয়ং চণ্ডী। প্রাচীন কালে এই দেবীর পুজোর প্রচলন ছিল। রাজা তখন জানালেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি এই দেবীর পুজোর আয়োজন করতে চান। এর উত্তরে কালীশঙ্কর জানান, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবীর পুজোর বিধান আছে। হাতে সময় কম থাকলেও কৃষ্ণচন্দ্র পুজোর সমস্ত আয়োজন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন পুজোয় পৌরোহিত্যের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। শোনা যায় কালীশঙ্কর রাজাকে যথাযথ সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
তবে, একটা সমস্যার কথা অনুমান করে কৃষ্ণনগরে না ফিরে সেখান থেকেই কৃষ্ণচন্দ্র সরাসরি গিয়েছিলেন চন্দননগরে তাঁর বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে। যাওয়ার আগে পুজোর সব দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে। তাঁরাই জগদ্ধাত্রী পুজোর সব আয়োজন করেছিলেন। আর বলেছিলেন, পুজোর আগের দিন রাত্রে তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরে আসবেন।
রাজপরিবারের কূলগুরু ছিলেন বৈষ্ণবাচার্য। তিনি নতুন এই শাক্ত দেবীর পুজোয় অনুমতি না দিলে পুজো করা সম্ভব হত না। তাই রাজা ঠিক করেছিলেন, পুজোর আগের দিন মধ্যরাত্রে কৃষ্ণনগরে ফিরবেন। আর পরের দিন সকালে অঞ্জলি দেবেন। তখন কূলগুরুর কোনও বাধাই কার্য্যকর হবে না।
ইতিমধ্যেই শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড় পুজোর সব আয়োজন করে রেখেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুজোর আগের দিন গভীর রাতে গোপনে কৃষ্ণনগরের প্রাসাদে ফিরে এসেছিলেন। এবং পর দিন সারা দিন উপবাসী থেকে পুজোয় অঞ্জলিও দিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হল রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো। গবেষকদের মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক। অনেকেই মনে করেন, পরের বছর থেকে চন্দননগরে পুজোর প্রচলন হয়েছিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে।
তবে লোকশ্রুতিতে গল্পটি আর রাজার মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার সময়কাল কিঞ্চিত আলাদা। সুধীর চক্রবর্তী তাঁর ‘উৎসবে মেলায় ইতিহাসে’ নদিয়ার হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো সেই বিশ্বাসকে ভাষা দিয়েছেন এই ভাবে যে, “যখন কারাগার থেকে মুক্ত হলেন রাজা তখন আশ্বিন মাস। এখানে দুর্গাপূজা। বিজয়াদশমীর বিকালে পৌঁছলেন নদিয়ার রুকুনপুর ঘাটে। শ্রান্ত আশাহত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ঢলে পড়লেন ঘুমে। তারপরেই সেই স্বপ্ন। তবে স্বপ্নের সেই দেবীমূর্তি দুর্গা নন, অথচ ত্রিনয়নী চারহাত রক্তাম্বরধারিণী। সাদা নরসিংহে যোদ্ধার মতো বসে আছেন। দুই হাতে শঙ্খচক্র আর দুই হাতে ধনুর্বাণ। স্বপ্নে দেবীর প্রত্যাদেশ হল: সামনের শুল্কা নবমীতে একইদিনে সপ্তমী-অষ্টমী-নবমীপূজা করলেই দুর্গাপূজার অনুকল্প হবে। রাজা তাই করলেন। সেই থেকে কৃষ্ণনগরে চালু হল জগদ্ধাত্রীর পূজা।”
কিন্তু কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী তাঁর ‘নবদ্বীপ মহিমা’য় স্পষ্টই বলেছেন, কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র মহারাজা গিরিশচন্দ্রের (রাজত্বকাল ১৮০২-১৮৪১) পূর্বে আমাদের বঙ্গদেশে জগদ্ধাত্রীপুজার প্রচলন ছিল না। “উক্ত মহারাজের যত্নে তন্ত্র হইতে ওই মূর্তি প্রকাশিত হয়। শান্তিপুরের নিকটবর্তী ব্রহ্মশাসন গ্রামনিবাসী চন্দ্রচূড় ন্যায়পঞ্চানন নামক জনৈক তন্ত্রশাস্ত্র বিশারদ পণ্ডিতকর্তৃক এই মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। পরে নবদ্বীপের পণ্ডিতগণের অনুমোদিত হইলে ওই মূর্তির পূজা আরম্ভ হয় ।” গিরীশচন্দ্র নিজে যেহেতু ছিলেন তন্ত্রচর্চাকারী রাজা আর দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপ বিবর্তনে যেহেতু তন্ত্রের প্রভাব স্পষ্ট (জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায় “মায়াতন্ত্র” ও কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ‘তন্ত্রসার’, এমনকি বেশ কিছু বৌদ্ধতন্ত্রেও) তাই কান্তিচন্দ্র রাঢ়ীর দাবিকে কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনও হতে পারে, জগদ্ধাত্রী পুজো সর্বজনীন অর্থে পূর্বপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে শুরু হলেও তার জাঁকজমক ও শ্রীবৃদ্ধি হয় রাজা গিরীশের আমলে।
যদিও এই সব পরস্পরবিরোধী জনশ্রুতির মধ্যে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনার ঠিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া ভার। মনে রাখতে হবে, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ জগদ্ধাত্রী পুজোর কোনও উল্লেখ নেই। আলিবর্দির কারাগার থেকে বেরিয়েই কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী পুজো করলে তা ভারতচন্দ্র নিশ্চয়ই ‘অন্নদামঙ্গল’-এ (রচনাকাল ১৭৫২) তার উল্লেখ করতেন। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেবের মতে, “যতটুকু জানা যায় ১৭৫২-৫৬, এই সময়কালের মধ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বারোদোল, রাস বা জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। কেননা, ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তাঁর আর্থিক সঙ্কট প্রবল হয়েছিল। ফলে, সে সময়ে এত বড়মাপের পুজোর আয়োজন করা সম্ভব ছিল না।” একই কথা বলা যায় মিরকাশিম প্রসঙ্গেও। অলোককুমার চক্রবর্তী তাঁর ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এবং তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এ লিখেছেন, “যাঁরা বলেন যে মিরজাফরের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে কৃষ্ণচন্দ্র এই পূজা করেন, তাঁদের কথাও ঠিক নয়। কেননা, মিরজাফরের কারাগারে কৃষ্ণচন্দ্র কোনওদিন বন্দি ছিলেন না।” তাঁর মতেও, “আলিবর্দির রাজত্বের ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি হয়তো এই পূজা করে থাকবেন। আলিবর্দির কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেই তিনি এই পূজা প্রচলন করেছিলেন এমন কথাও মেনে নেওয়া যায় না। কেননা, ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই তিনি আলিবর্দির কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন। মুক্তিলাভ করেই যদি তিনি এই পূজা করতেন তা হলে ভারতচন্দ্র নিশ্চয়ই এর উল্লেখ করতেন।”
ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত দেবী জগদ্ধাত্রীর পটচিত্র, ১৮৮৫ সাল
অন্য দিকে, কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী কৃষ্ণচন্দ্রের নাতি গিরীশচন্দ্রকে (১৮০২- ১৮৪১) এই পুজোর প্রবর্তক বলে যে দাবি করেছেন তা-ও ঠিক নয় বলেই মনে করেন পণ্ডিতেরা। তিনি যদি জগদ্ধাত্রী পূজোর প্রবর্তক হবেন, তা হলে নদিয়ার জলেশ্বর শিবমন্দির (১৬৬৫) এবং দিগনগরের রাঘবেশ্বর মন্দিরের (১৬৬৯) গায়ে জগদ্ধাত্রী মূর্তি খোদাই করা থাকত না। সব মিলিয়ে ইতিহাস গবেষকেরা নিশ্চিত— মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই বঙ্গদেশে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। এ কথা বলেছেন রাজ পরিবারের ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য লেখক দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র। তবে এ কথাও ঠিক যে কৃষ্ণচন্দ্র-পরবর্তী সময়ে গিরীশচন্দ্রের আমলে জগদ্ধাত্রী পুজোয় ব্যাপক জাঁকজমক হত। সে সময়ে ইংরেজরাও পুজো দেখতে আসত। অন্য দিকে, কৃষ্ণচন্দ্রের বন্ধু চন্দননগরের ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই পুজো শুরু করেন।
ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরীর দেওয়ানীর কার্যকাল ১৭৩০ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময় তাঁর সঙ্গে লেনদেন চলত মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের। এই ইন্দ্রনারায়ণই তাঁর বান্ধব মহারাজ কৃষ্ণ চন্দ্রের হাতে কবি ভারত চন্দ্রকে তুলে দেন। সুতরাং , মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দেবীর পূজার সূচনা করলে স্বাভাবিক ভাবেই ইন্দ্রনারায়নও পূজা করবেন নিজের মত করে ,সেটাই স্বভাবিক। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। লক্ষ্মীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই পূজার সূচনা। এই পূজা চন্দননগরে আদি পূজা নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প হয়। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। শোনা যায়, বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা।
কিন্তু কিছু তথ্য বিচার বিবেচনা করলে এই কাহিনীর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় । কারণ ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মারা যান ১৭৫৬ সালে । ড: বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত "জগদ্ধাত্রী পূজা ও চন্দননগর প্রসঙ্গ" বইটি থেকে ও ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর দাদা রাজারাম চৌধুরীর বংশের বর্তমান পুত্রবধূ শ্রীমতি মাধুরী চৌধুরীর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই শহরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন ১৭৬২ সালে । তাহলে একজন মৃত ব্যক্তি তার মৃত্যুর 6 বছর পর কি করে একটি শহরের পূজার প্রচলন করতে পারেন ? এই প্রশ্নটা আজও রয়ে গেছে । আবার ড: বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত "জগদ্ধাত্রী পূজা ও চন্দননগর প্রসঙ্গ" বইটি থেকে জানা যায়, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক দেওয়ান দাতারাম সুর চন্দননগরের অন্তর্গত গৌরহাটি অঞ্চলে তার বিধবা কন্যার বাড়িতে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন ১৭৬২ সালে, যা ছিল চন্দননগরের প্রথম পারিবারিক জগদ্ধাত্রী পূজা। আবার চন্দননগরের চাউল পট্টি অঞ্চলে প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী জানতে পারা যায় যে, এই অঞ্চলের তৎকালীন চালের ব্যবসায়ীরাই (কিছুজনের মতে কৃষ্ণনগরের চাল ব্যবসায়ীরা একবার জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় কৃষ্ণনগরে ফিরতে না পেরে এখানকার ফরাসি সরকারের অনুমতি নিয়ে চাউলপট্টিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন) এখানে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন । আবার চন্দননগরের "আদি মা" হিসেবে খ্যাত চাউলপট্টি জগদ্ধাত্রী পূজা কমিটি তাদের পূজার বর্ষ ৩০০ বছর বলে উল্লেখ করেন, যার অর্থ ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর অনেক আগেই চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন হয়েছে । যে তথ্যটিও সঠিক নয় । তাহলে উপরিউক্ত আলোচনাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবক্তা ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী নয়। বরং কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক দেওয়ান দাতারাম সুর এবং চন্দননগর শহরের জগদ্ধাত্রী পূজার বয়স ২৫৯ বছর ।
চন্দননগর শহরের এক ইতিহাস অনুসন্ধানী অভিজিৎ সিংহ রায়ের মহাশয়ের লেখা একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, James Darmesteter নামক এক ফরাসি লেখক তাঁর বইতে আঠারো শতকের আশির দশকে উল্লেখ করেন যে, এই শহরে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তৈরি করতে মোট ১১ টাকা এবং এই বিশাল আকার মূর্তিকে অলংকার দিয়ে সুসজ্জিত করতে মোট ১১০ টাকা খরচ হতো, যা তৎকালীন সময়ে যথেষ্ট ব্যয়বহুল বলেই মনে করা হতো। বর্তমানে এই খরচ প্রায় সহস্রাধিক।
জগদ্ধাত্রী দেবীর প্রসঙ্গ পাওয়া যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণের বাণীতেও। তিনি বলেন, ‘জগদ্ধাত্রীরূপের মানে কী জান? যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন। তিনি না ধরলে জগৎ পড়ে যায়— নষ্ট হয়ে যায়। মনকরীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হয়।’
মদমত্ত হাতি, তার উপরে শক্তির প্রতীক সিংহ আর তার উপরে দেবী জগদ্ধাত্রী। স্বামী প্রমেয়ানন্দের মতে,
|
"ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি জগদ্ধাত্রী। সগুণ ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশরূপ তিনগুণের যুগপৎ প্রকাশ যেমন কালীরূপের বৈশিষ্ট্য, তাঁর ধারণী ও পোষণী গুণের যুগপৎ প্রকাশও জগদ্ধাত্রীরূপের বৈশিষ্ট্য।... ধা ধাতুর অর্থ ধারণ বা পোষণ। ভগবতী নিখিল বিশ্বকে বক্ষে ধারণ করে পরিপালন করেন বলে মুনিগণ কর্তৃক তিনি ত্রৈলোক্যজননী নামে অভিহিত।... নিয়ত-পরিবর্তনশীল এই জগতের পেছনে রয়েছে তার রক্ষণ ও পোষণের জন্য অচিন্তনীয়া মহাশক্তির এক অদ্ভুত খেলা। সতত পরিবর্তনশীল জগৎ সেই মহাশক্তির দ্বারা বিধৃত – যিনি নিত্যা, শাশ্বতী ও অপরিবর্তনীয়া। দেবী জগদ্ধাত্রীই সেই ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি।" |
কলমে - কমলেন্দু সূত্রধর
তথ্যসূত্রঃ-
১. জগদ্ধাত্রী-তত্ত্ব : পূজা-বিজ্ঞান - স্বামী প্রমেয়ানন্দ
২. দেবদেবী ও তাঁদের বাহন - স্বামী নির্মলানন্দ
৩. পৌরাণিকা : বিশ্বকোষ হিন্দুধর্ম, প্রথম খণ্ড - অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. জগদ্ধাত্রী পূজা ও চন্দননগর প্রসঙ্গ - অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
৫. চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী - কল্যাণ চক্রবর্তী ও লিপিকা ঘোষ ।
৬. চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার শোভাযাত্রার ইতিকথা
৮. বৌদ্ধ তন্ত্রযানের দেবী কঙ্কই কি পরবর্তীকালের জগদ্ধাত্রী?
৯. কৃষ্ণচন্দ্র ও জগদ্ধাত্রী পুজো
১০. সৃষ্টিশীলতায় জগদ্ধাত্রী পুজো
১১. জগদ্ধাত্রী
১২. শ্রী শ্রী মা জ্জগদ্ধাত্রী দুর্গায়ৈ ও রাজরাজেন্দ্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন