বই- ঠাকুরবাড়ির সারদাসুন্দরী লেখক- কাবেরী রায়চৌধুরী প্রকাশনী- দে’জ পাবলিশিং পৃষ্ঠা- ২৩৯ প্রকাশকাল - এপ্রিল ২০১৯ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ – রঞ্জন দত্ত |
“ভালোবাসা
মানে শুধু সহবাস? তার বেদ-বেদান্ত আমি জানিনে। তবে কি বেদে এই কথা
বলা হয়েছে? নাকি অতিরিক্ত শাস্ত্রপাঠ তাকে…? জানিনে।”
এই কাহিনী একদিকে যেমন সারদাসুন্দরীর জীবনচিত্র তেমনি ঠাকুরবাড়ির অন্দর ও বাহিরমহলের নানা ওঠাপড়া ঘাতপ্রতিঘাতের জীবন্ত দলিল। ঠাকুরবাড়ির সারদাসুন্দরী - কাবেরী রায়চৌধুরীর লেখা অন্যতম একটি উপন্যাস যা গবেষক থেকে সাধারণ শিক্ষিত পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে।উপন্যাসকে কেন্দ্র করে দুই বাড়ির বহু অজানা কাহিনী পাঠক জানতে পারবেন। লেখক গবেষণা করেছেন এবং সাড়ে তিনবছর কাল ধরে লিখেছেন এই উপন্যাস কারণ রবীন্দ্র জননী সারদাসুন্দরীকে নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অপ্রতুলতা।
সারদাসুন্দরীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট ইতিপূর্বে সেইভাবে কোথাও পাইনা। দীর্ঘ গবেষণালব্ধ এই গ্রন্থ অসামান্য নিপুণতায় সারদাসুন্দরীকে উপস্থাপিত করেছে। দিদিশাশুড়ি বা শাশুড়ির মত চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর ছিল না – তাই রাশভারী কর্ত্রী হয়ে ওঠা তাঁর হয়নি। বালিকা থেকে নারীত্বে উত্তরনের পথে শুধুমাত্র স্বামীর আহ্বান ও ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে নিজের আবেগ ও ইচ্ছাকে অবদমিত করে শীতল দাম্পত্যের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছেন পনেরোটি সন্তানের।পরবর্তী সময়ে যাঁরা স্বীয় প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। সন্তানকে কোলে পিঠে নিয়ে বড় করার আনন্দ থেকেও তাঁর মাতৃ হৃদয় বঞ্চিত থেকেছে। কারণ সেই কাজের জন্য নিয়োজিত ছিল দাস-দাসীর দল। পারিবারিক এই প্রথার ফাঁকে তিনি যতটুকু পেরেছেন আপন সন্তানকে আদর যত্নে ভরিয়ে দিয়েছেন। রবিকে নিজে হাতে রূপটান মাখাতেন। পুত্রবধূদের স্বহস্তে ভাত মেখে খাওয়াতেন। মাঘোৎসবে নিজে তদারকি করতেন রান্নাবাড়া খাওয়াদাওয়ার খুঁটিনাটি। দীর্ঘসময় অস্বাস্থ্যকর, অন্ধকারাছন্ন আঁতুড়ঘরে কাটানোর বই ও শিল্পকলার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার সৃষ্টি করে। জীবনযাত্রার শূন্যতা হয়ত এইভাবেই কিছুটা পূর্ণ হত। পুরো উপন্যাস জুড়ে সারদাসুন্দরীর ছোট ছোট কিছু ভালোলাগার মুহূর্ত, তাঁর অন্তরের অবরুদ্ধ ক্ষোভ, বেদনা আমাদের মনকে দ্রব করে। অতীব শারীরিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে স্বামীকে দেখার তীব্র আকুলতা পাঠকের মনে অভিঘাত হানে। নবজাগরণ পরবর্তী পুরুষতান্ত্রিক আলোকিত সমাজের মাঝে এযেন এক বিপন্ন নারীর জীবনআলেখ্য। বিশ্বকবিজননী সারদাসুন্দরী ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রাণ ত্যাগ করলেন। চিরকাল প্রেম বঞ্চিত মানুষটির অন্তিম সময়ে ভালোবাসার মানুষের নির্মম পরিহাস লেখকের লেখনীতে প্রাণবন্ত হয়েছে-
“দেবেন্দ্রনাথ
বিদায়লগ্নে পুষ্প চন্দন অভ্র দিয়ে সাজিয়ে দিলেন তাকে।”
কাবেরী রায়চৌধুরী
লেখক পরিচিতিঃ
পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত কবি ও ঔপন্যাসিক কাবেরী রায়চৌধুরী। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে স্নাতক। পরে মনোবিদ্যা নিয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন আনন্দবাজারসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বই। ‘সাত পুতুলের সাত কথা’,’চাতক জল’,’যে যেখানে দাঁড়িয়ে’,’অর্ধেক আকাশ’,’শরীরী’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
অত্যন্ত দুরন্ত অষ্টমশ্রেনীর ভাড়াটেকন্যাকে কাবেরীকে শান্ত করার অভিপ্রায়ে বাড়িওয়ালা জ্যেঠু হাতে তুলে দেন “বঙ্কিম রচনাবলী”। সেই সাহিত্য জগতে প্রবেশ। ধীরে ধীরে পড়া থেকে লেখার জগতে প্রবেশ। একদা আইপিএস বা আইএফএস হতে চাওয়া কন্যা বাড়ির ছাদের ঘরে বসে আপন মনেই লিখে যেতেন কবিতা ও গল্প। কোনোদিনও লেখক হবেন ভাবেননি। তাই এই সব লেখা প্রকাশের কথা মাথাতেই আসেনি। কিন্তু নিয়তিতে বিশ্বাসী সেই কন্যা হয়ে ওঠেন এই যুগের অন্যতম লেখক। ২০০০ সালে প্রথম “দেশ” পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হয়। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস “ধুসর ডানার কাহিনী” এবং “গর্ভাধান কাব্য কথা”।২০০৬ সালে সানন্দায় “ সাত পুতুলের সাত কথা” ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরিচিতি লাভ ঘটে সাহিত্যমহলে। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড দ্বারা প্রদত্ত পুরস্কার “ প্রতিশ্রুতিমান সাহিত্যক পুরস্কার” এবং লীলা মজুমদার পুরস্কার লাভ করেন। পশু-পাখিদের সংসারে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন বেশি। কাজ করছেন অনাথ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য।ভ্রমনে মুক্তির আনন্দ খুঁজে পান সাহিত্যিক কাবেরী রায়চৌধুরী ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন