শিশুদের সর্দিকাশি নিরাময়ের ঘরোয়া সমাধান

 



শীতকালের আনন্দ কম নয়। গরমের হাঁসফাঁস আর বর্ষার জলকাদার প্যাচপ্যাচানি থেকে শত ক্রোশ দূরে মন ভালো করে দেয় শীতের আমেজ। মিঠে রোদ পোহাতে পোহাতে কমলালেবু খাওয়া, হইহই করে চড়ুইভাতি, চিড়িয়াখানা যাওয়া, খাওয়ার পাতে রঙিন রকমারি সবজির বাহার, নলেনগুড়ের সুঘ্রাণ, জয়নগরের মোয়ার আস্বাদ সবমিলিয়ে শীতকাল হয়ে ওঠে জমজমাট।

তাহলেও এই সময়ের একটি অন্যতম গুরুতর সমস্যা হলো শীতে বাচ্চাদের সর্দিকাশি লেগেই থাকে। ঋতু পরিবর্তনের কারণে গরম থেকে ঠান্ডা হওয়ার সময় সর্দিকাশির কবলে পড়া খুবই সাধারণ ঘটনা। আর যেসব বাচ্চার সর্দিকাশির ধাত রয়েছে অথবা হাঁপানির সমস্যা রয়েছে এবং কাশি হলেই যাদের শ্বাসকষ্ট হয়, তাদের মধ্যে সর্দিকাশির প্রবণতা খুব বেশি। আর সর্দিকাশি থেকে জ্বর তো হতেই পারে।

সর্দিকাশি জ্বর ছাড়াও আরেকটি সমস্যা হলো গলা খুসখুস করা, যার জন্য বাচ্চারা প্রবল অস্বস্তিতে পড়ে। এই গলা খুসখুসের কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে, ঠান্ডা লাগার ফলে সর্দি বা ভাইরাল ইনফেকশনই এর কারণ। এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে বাচ্চাদের অ্যান্টিবায়োটিক ধরিয়ে দেওয়া ঠিক নয়, এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সেক্ষেত্রে আপনি আশ্রয় নিতে পারেন ঘরোয়া টোটকার। সর্দিকাশি হোক বা গলা খুসখুস, সাতদিনের মধ্যে বিনা ওষুধেই সেরে যাবে। একনজরে দেখে নিন ঘরোয়া উপায়গুলি।

১) সদ্যোজাত শিশুদের জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। ছ'মাসের কম বয়সি শিশুদের জন্য সংক্রমণ প্রতিকারক হিসাবে কাজ করে এটি।

২) শিশুর বয়স ছয়-সাতমাসের বেশি হলে তাকে ব্রেস্টমিল্কের পাশাপাশি নানারকম স্যুপ খাওয়ানো যেতে পারে, যেমন চিকেন স্যুপ, ভেজিটেবল স্যুপ, টম্যাটো স্যুপ, গাজরের স্যুপ, পালংশাকের স্যুপ ইত্যাদি।

৩) ছয়মাসের বেশি বয়সী বাচ্চাদের খাবারের ক্ষেত্রে খিচুড়িতে লালশাক, পালংশাক, ডিমের সাদা অংশ (শিশুর বয়স ন'মাসের বেশি হলে) অল্প করে দিতে পারেন। কমলালেবুর রস খাওয়ান। এগুলো তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।

৪) শীতের ঠান্ডা আবহাওয়ায় শিশুকে গরম রাখতে সোয়েটার, টুপি, মোজা, গ্লাভস পরিয়ে রাখতেই পারেন। তবে এক্ষেত্রে আবার অন্য সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত গরম পোশাক পরানোর ফলে শিশুর শরীর গরম হয়ে গিয়ে পেটের গন্ডগোল দেখা দিতে পারে। তাই সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।

৫) সর্দিতে বাচ্চার নাক বন্ধ হয়ে গেলে, কিছুটা জোয়ান শুকনো তাওয়ায় ভেজে সেটিকে একটি পাতলা সুতির কাপড়ে মুড়ে বাচ্চার নাকের কাছে ধরুন। বন্ধ নাকে খুবই কার্যকরী এটি।

৬) দু'কোয়া রসুন এবং কিছু কালোজিরে এক কাপ সরষের তেলে গরম করুন। ঘরের তাপমাত্রায় আসার পর এটি শিশুর হাতের তালুতে এবং পায়ের পাতায় মালিশ করুন। উপকার মিলবে।

৭) গরম জলের সঙ্গে অল্প পরিমাণে হলুদ মিশিয়ে একটি মসৃণ পেস্ট তৈরি করুন এবং এটি শিশুর বুকে, কপাল এবং পায়ের পাতার তলায় লাগিয়ে দিন। কিছুক্ষণ পরে ধুয়ে ফেলুন। হলুদ থেকে নির্গত তাপটি শ্লেষ্মাকে পাতলা করতে এবং বের করে দিতে সাহায্য করবে।

৮) বাচ্চার নাক বন্ধ হয়ে গেলে ব্যবহার করতে পারেন স্যালাইন ড্রপ। একটি জীবাণুমুক্ত চামচ ব্যবহার করে একটি জীবাণুমুক্ত বাটিতে আধ চা চামচ নুন ও ৮ চা চামচ ফিল্টার করা গরম জল মেশান। তবে জরুরী অবস্থা ব্যতীত বাড়িতে স্যালাইন তৈরি না করাই ভালো, কারণ এটিতে ব্যাকটেরিয়া থাকার সম্ভাবনা থাকে।

৯) ন'মাসের বেশি বয়সি শিশুদের জন্য একটি বা দু'টি গোলমরিচ, এক চিমটে জিরে, এক চামচ গুড় এবং এক কাপ জল একসঙ্গে ফুটিয়ে নিন এবং ছেঁকে নিয়ে ঘরের তাপমাত্রায় আসার পর শিশুকে খাওয়ান। তবে দুই চা চামচের বেশি শিশুকে দেবেন না।

১০) শিশুর বয়স একবছরের বেশি হলে তাকে প্রতিদিন মধু দিতে পারেন। বাচ্চাদের সর্দি-কাশি নিরাময়ে মধু বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধুর সঙ্গে গোলমরিচ বা শুকনো আদাও যোগ করা যায়।

১১) আরেকটি উপায় হলো ২ টেবিল চামচ মধুর সাথে ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে কয়েক ঘণ্টা পর পর বাচ্চাদের খাওয়ান। তাছাড়া ১ গ্লাস গরম দুধের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে বাচ্চাদের শুকনো কাশি ভাল হয় ।

১২) একগ্লাস দুধে একচিমটে হলুদ ও সামান্য গুড় মিশিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ানো যায়।। শুষ্ক কাশিতে খুবই সাহায্যকারী।

১৩) গলা খুসখুসানি থেকে আরাম পেতে আপনার বাচ্চার নিয়মিত গার্গেল করার দিকে নজর রাখুন। সাথেই আদা, মধু ও তুলসীপাতা দিয়ে তার জন্য চা বানিয়ে দিতে পারেন।

১৪) এক ইঞ্চি মাপের শুকনো আদা কুচি করা, ৬-৭টা তুলসীপাতা কুচি করা, দু'টো গোলমরিচ গুঁড়োনো, একচামচ গুড় একসঙ্গে নিয়ে এক কাপ জলে ফুটিয়ে নিন। ভালোভাবে ফুটে গেলে গ্যাস বন্ধ করে ছেঁকে নিন। মিশ্রণটিকে ঠান্ডা করে সামান্য উষ্ণ অবস্থায় বাচ্চাকে খাওয়ান।

এগুলি সবই বাচ্চাদের সর্দিকাশি প্রতিকারের ঘরোয়া উপায়। তবে বাচ্চার নিরাময়ে সময় লাগলে অবশ্যই শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

 শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ঘরোয়া উপায়ঃ

বড়ো এক কাপ জলে এক টেবিল চামচ গ্রেট করা আদা ফুটতে দিন। এর মধ্যে যোগ করুন আধ টেবিল চামচ কাঁচা হলুদের রস ও তিন চারখানা গোটা গোলমরিচ। কিছুক্ষণ ফোটানোর পর গ্যাস বন্ধ করে তরলটিকে ঠান্ডা হতে দিন। সপ্তাহে দু'বার খালি পেটে বাচ্চাকে এটি খাওয়ান, তবে বাচ্চার বয়স যেন একবছরের বেশি হয়। তরলটি আপনার শিশুকে দেওয়ার আগে সেটির মধ্যে সামান্য গুড় যোগ করতে পারেন।

 

খেয়াল রাখুনঃ

১) বাচ্চার নাক যেন পরিষ্কার থাকে।

২) ঘন ঘন সর্দি পরিষ্কার করতে হবে।

৩) যথার্থ পরিমাণ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার দিন।

৪) সর্দিকাশি বা জ্বরের কারণে অরুচির জন্য শিশু একবারে বেশি খেতে পারে না। তাই বারবার খাবার দিন। শরীর যাতে ডিহাইড্রেটেড না হয়ে যায় সেইজন্য তরল খাবার বেশি দিন। 

৫) শিশুর ঘুম পর্যাপ্ত পরিমাণে হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখুন।

৬) বাচ্চার ঘরে অতিরিক্ত জিনিসপত্র রাখবেন না, ঘরটি যেন থাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

৭) বাড়িতে পোষ্য থাকলে তাকে অসুস্থ বাচ্চার থেকে দূরে রাখুন।

৮) ছয়মাস বয়সের কম বয়সী শিশুরা যদি বুকের দুধ খেতে না পারে, জ্বর থাকে এবং তিন চার দিন পরেও জ্বর কমার লক্ষণ দেখা না যায়, সে যদি দ্রুত শ্বাস নিতে থাকে অথবা শ্বাসকষ্ট হয় তবে শীঘ্রই শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।



কলমে - গীতশ্রী ঘোষাল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন