- স্বামী রামতীর্থ
একটি ভালো বই প্রকৃত বন্ধুর মতো হয়। বই পড়ে অনেক কিছু শেখা যায়। তবে শুধুমাত্র পড়লেই হবে না, সেগুলি হৃদয় থেকে অনুভব করতে হবে। তবেই বই পড়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য সার্থক হবে।
বতর্মানে মানুষের বই পড়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে অধিকাংশ শিশুরা বইয়ের চেয়ে মোবাইল ফোনে গেম খেলতে বেশি পছন্দ করছে, যা সত্যিই চিন্তার বিষয়। তবে ছোট্ট থেকে যদি পরিবারের মানুষ তেমন পরিবেশ তৈরি করতে পারেন তাহলে শিশুটি বই পড়ার প্রতি উৎসাহ পাবে। কিছু ব্যতিক্রমী শিশু থাকে যারা বাড়িতে তেমন পরিবেশ না পেলেও বইয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সে নিজের চেষ্টায় পড়ার অভ্যাস তৈরি করে। কিন্তু এটা উদাহরণ হতে পারে না। তাই পরিবার, পরিবেশ ও বিদ্যালয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় শিশুর বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।
সাধারণত শিশুদের মনে বই দেখলেই প্রশ্ন আসে - "বই কেন পড়ব?" বাড়ির বড়দের এখানে খুব সচেতনভাবে উত্তর দিতে হবে। যে পরিবারের মানুষ এই প্রশ্নের সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারে না তাদের বাড়ির শিশুরা বই-এর উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। দেখা যায়, সেইসব শিশুরা টেনেটুনে বিদ্যালয়ের বই কোনো মতে শেষ করে, তাদের কাছে বই বোঝা মনে হয়। মনে করে, যাক বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম!
আচ্ছা, বই পড়ার গুরুত্ব কি ঐটুকুই? এই প্রশ্নের উত্তর বড়দেরও সঠিকভাবে বুঝতে হবে। তবেই শিশুদের বোঝাতে পারা যাবে।
বই কেন পড়ব?
চাকরি পাওয়ার জন্য বই পড়বে, না হলে খাবে কী? - এইসব উত্তর দিলে বই পড়ার থেকে আগ্রহ হারিয়ে যায়। এইভাবে বলা যেতে পারে - বই থেকে অনেক কিছু জানতে পারবে। নতুন নতুন অনেক কিছু শেখা যায়। নতুন নতুন খেলা শিখতে যেমন আনন্দ পাওয়া যায়, ঠিক তেমন বই পড়ে নতুন কিছু শিখলে আনন্দ পাওয়া যায়। জ্ঞান বাড়ে।
বইকে মূলত আমরা দুই ভাগ করতে পারি, যথা -
ক) বিদ্যালয় / কলেজের পাঠ্য বই। খ) পাঠ্যের বাইরের বই।
অনেক সময় দেখা যায় শিশুটি বিদ্যালয়ের বই পড়তে তেমন পছন্দ করে না। সে বিদ্যালয়ের বাইরের বই পড়তে বেশি পছন্দ করে। এতে একদিকে যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি খারাপ দিকও আছে।
পাঠ্যের বাইরের বই পড়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
বাইরের বই অবশ্যই পড়া ভালো। এতে ভাষাজ্ঞান হয়, শব্দ ভান্ডার বাড়ে এবং মানসিক বিকাশ হয়। কিন্তু পাঠ্যের বই যদি না পড়ে তবে বিদ্যালয়ের পরীক্ষাতে অনুত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।অর্থাৎ জীবনের অগ্রগতি রোধ হয়।পাঠ্যবই না পড়লে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞানলাভ থেকে একজন শিশু বঞ্চিত থেকে যায়।
এইখানে একটা বিষয় বলা দরকার, বতর্মান যুগ প্রযুক্তির যুগ। বাচ্চারা ইন্টারনেট থেকে অনেক কিছু দেখে, এর মধ্যে কিছু জিনিস সত্য হয় না। দেখা গেল কেউ হয়তো বলছে, জনৈক ব্যক্তি বেশি না পড়েও বিখ্যাত হয়েছেন, ধনী হয়েছেন, ইত্যাদি। এতে শিশুদের মনে খুব প্রভাব পড়ে। সেও ঠিক মতো বিষয়টি না বুঝে পাঠ্যে মন দেবে না।এইখানে অভিভাবকদের বুঝতে হবে এবং ভালো করে বোঝাতে হবে।
আবার অনেক অভিভাবক আছেন যাঁরা শিশুদের বাইরের বই একদম পড়তে দেন না। শুধুমাত্র পাঠ্য বইয়ের উপর গুরুত্ব দেন, বকাবকি করেন। এটাও খারাপ। আগেই বলা হয়েছে, পাঁচরকম বই পড়লে মানসিক বিকাশ ঘটে। কল্পনাশক্তি ও সৃজনীশক্তি বৃদ্ধি পায়।
প্রক্রিয়া পদ্ধতিঃ
আদর্শ পরিবেশ তৈরি করা - একদম ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। শিশুর চারপাশে বিভিন্ন রকম বই রাখা যেতে পারে।শিশুটির খেলার মাঝে মাঝেই বইগুলি দেখিয়ে বইয়ের সাথে পরিচয় করানোর চেষ্টা করা উচিত। কিছু দিন এইরকম চেষ্টা করার পর দেখতে হবে শিশুটি নিজে নিজেই বই পড়তে চাইছে কিনা। যদি পড়তে চায়, তবে বুঝতে হবে তার মধ্যে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, যা ইতিবাচক দিক। আর যদি না চায় তবে আবার চেষ্টা করে যেতে হবে। হাল ছাড়লে চলবে না।
'ছাত্রের দৃষ্টিতে জগৎকে দেখা' - স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, 'ছাত্রের দৃষ্টিতে জগৎকে দেখা' উচিত। তিনি শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা অবহেলা করতে পারতেন না। তিনি মনে করতেন, শিক্ষার্থী যেটা ইতিমধ্যে আয়ত্ত করেছে, তারই সহায়তায় তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
একটা বিষয় বুঝতে হবে, সব শিশু এক নয়। সবার মনস্তত্ত্ব আলাদা। তাই যে শিশু দ্রুত বুঝতে পারে তাকে তার মতো করে এগিয়ে যেতে দিয়ে হবে। অন্যদিকে যার বুঝতে কিছুটা সময় লাগে তাকেও তার মতো সময় দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।এইখানে অভিভাবকদের ভূমিকা সাহায্যকারী হিসাবে থাকবে।
মজার প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে - যে বইগুলি ইতিমধ্যেই পড়া হয়ে গিয়েছে অভিভাবকদের তার থেকেই মজার মজার প্রশ্ন তৈরি করতে হবে। শিশুটিকে এই সব প্রশ্ন খেলার মাঝে মাঝেই জিজ্ঞাসা করতে হবে। তবে মনে রাখা উচিত, এক্ষেত্রে শিশুটিকে ভুলের জন্য শাসন করা চলবে না। প্রাথমিক অবস্থায় বেশি শাসন করলে বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
উৎসাহ দেওয়া - প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারলে শিশুটিকে উৎসাহ দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, হাততালি দেওয়া যেতে পারে, বিভিন্ন প্রশংসাসূচক শব্দ বলা যেতে পারে। যেমন - খুব ভালো (very Good),ভালো ছেলে/মেয়ে ( Good boy/girl ) ইত্যাদি।
অন্যদিকে সে যদি ভুল বলে তাও উৎসাহ দিতে হবে। তখন এভাবে
বলা যায় - শুরুর দিকে ভুল হতেই পারে। আবার চেষ্টা করো,
আমি তোমার সাথে আছি, সবাই
ভুল করে, ইত্যাদি।
শিশুকে স্বাধীনতা দান - যে শিশু মোটামুটি বই পড়ার প্রতি আগ্রহ পাচ্ছে তাকে তার মতো করে এগিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে। অভিভাবক শিশুটিকে বলতে পারেন, তুমি নিজে নিজে যতটা পড়েছো সেখান থেকে নিজেই প্রশ্ন তৈরি করো। তারপর নিজেই উত্তর লিখো। নিজেই নম্বর দাও। - এইভাবেই ধীরে ধীরে সে সাবলম্বী হয়ে উঠবে।
অনেক সময় দেখা গেছে, ছোটবেলায় পড়াশোনার জন্য যে শিশু অভিভাবকের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয় সে বড় হয়ে খুব অসুবিধার মধ্যে পড়ে। নিজের মধ্যে সৃজনশীলতা না থাকলে বড় হয়ে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে যায়। জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। তাই ছোট্ট থেকেই নিজেই প্রশ্ন তৈরি করে উত্তর দিতে শিখলে ঐরকম সমস্যার মধ্যে পড়বে না।
বই উপহার হিসাবে দেওয়া - ভালো ভালো বই উপহার দিয়ে শিশুদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা যেতে পারে। তার জন্মদিন হোক অথবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে, বই সর্বদা একটি উত্তম উপহার হিসাবে বিবেচিত হয়।বয়স অনুযায়ী বই পছন্দ করতে হবে। শিশুবয়েসে ছবিযুক্ত রঙিন বই শিশুদের সহজেই আকৃষ্ট করে। তাই রঙিন ছবিযুক্ত ছোট গল্পের বই বা ছড়ার বই দেওয়াই উচিত। একটু বড় হলে- কিশোর বয়সের উপযুক্ত বই দেওয়া ঠিক হবে।
অভিভাবকের ভূমিকা - সবচেয়ে বড় কথা শিশুদের বই পড়ায় আগ্রহ বৃদ্ধি করতে হলে অভিভাবকদের নিজেকে সেই অভ্যাস তৈরি করতে হবে। কারণ, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বড়দের দেখেই সে শেখে। রোজ নিয়ম করে শিশুর সাথে বই পড়তে হবে। বাড়ির বড়দের বই পড়ার অভ্যাস খুব সহজেই একটি শিশুকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে। এক – দু’বছর বয়েস থেকে যেই শিশু কথার অর্থ বুঝতে পারঙ্গম হয়ে ওঠে, তখনই বইয়ের অভ্যাস করানো উত্তম সময় হয়। এই সময় অভিভাবকদের বই পড়ে পড়ে গল্প বলার অভ্যাসের মাধ্যমে শিশুমনে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করা সহজ হয়।
বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সাথে আলোচনা - অভিভাবকদের উচিত বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করা। শিশুর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা। আমাদের দেশে এখনও অনেক অভিভাবক আছেন যাঁরা শিক্ষকদের কাছে গিয়ে কিছু বলতে লজ্জা পান। অনেক শিক্ষক আছেন এইসব ব্যাপারে কথা বলেন না। ফলে, দূরত্ব তৈরি হয়। তার ফলে সেইসব অনভিজ্ঞ অভিভাবকরাও শিশুদের জন্য পঠনপাঠনের আদর্শ পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হন, যেটা সমাজের জন্যও খারাপ। স্কুলছুট বাড়ে। সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যর্থ হয়।
সবশেষে আবারও বলব, সব শিশু এক নয়। সবার আলাদা আলাদা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার
আছে। ছোটবেলায় অনেকে নিজে নিজেই বই পড়তে পছন্দ করে। আনন্দ পায়। কেউ কেউ বিরক্ত
প্রকাশ করে। অনেকেই
বড় হয়ে ছোটবেলার তুলনায় বেশি পড়ে। কেউ আবার ছোটবেলার অভ্যাস হারিয়ে চরম ফাঁকিবাজ
হয়ে ওঠে।
এরজন্য অনেক কিছু দায়ী হতে পারে। চরম আঘাত পেলেও আগ্রহ হারিয়ে যায়। এইসময় অভিভাবকদের ধৈর্য্য না হারিয়ে শিশুটিকে বুঝতে হবে।তাঁর অসুবিধা ও অপছন্দের কারণ বিশ্লেষণ করে তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে।বিশেষক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়লে শিশু মনস্তত্ত্ববিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
কলমে - সোমা লাই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন