বৈদিক যুগের নারী – মৈত্রেয়ী


সংসারজীবন ত্যাগ করে বনবাসে যাচ্ছেন স্বামী। তাঁর দুই স্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, যাওয়ার আগে তাঁর সমস্ত বিষয়সম্পত্তি উভয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যাবেন। কিন্তু সেই দুই নারীর মধ্যে একজন বাদ সাধলেন। এমন একটি প্রশ্ন করলেন যা শুনে চমকিত হয়ে গেলেন স্বামী। স্বামী স্ত্রীর কথোপকথনে স্ত্রীর একখানি উক্তি যুগের পর যুগ ধরে অমরত্ব লাভ করে। 


উপরোক্ত সেই স্বামী হলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। তাঁর দুইজন স্ত্রী – মৈত্রেয়ী ও কাত্যায়নী। মৈত্রেয়ী ছিলেন হিন্দু ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কীয় কাব্য ও ছন্দোবদ্ধ কাব্যগুণের অধিকারিনী। ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ, শাস্ত্র অধ্যয়ন, বেদপাঠ এসব ছিল তাঁর অত্যন্ত আগ্রহের। স্বামীর সঙ্গে ব্রহ্মবিদ্যা আলােচনায় তিনি আনন্দ লাভ করতেন। অপরদিকে কাত্যায়নী ছিলেন গৃহধর্মপরায়ণা। স্বামী-সেবাই তাঁর কাছে মুখ্য। বেদচর্চা, শিষ্যদের শিক্ষাদান, আশ্রম পরিচালনা এবং গার্হস্থ্য জীবন এভাবেই ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের দিন অতিবাহিত হচ্ছিল।

একদিন তিনি ভাবলেন, শাস্ত্র নির্দেশে তাঁর বানপ্রস্থ গ্রহণ করার সময় হয়েছে। উচ্চতর সাধনার সন্ধানে যেতে হবে তাঁকে। তাঁর দুই স্ত্রী এবং শিষ্যদের এই খবরটি তিনি জানালেন। যাজ্ঞবল্ক্যের প্রস্থান সংবাদে শিষ্যদের চোখ অশ্রুসিক্ত। স্বামীর ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া কোনো স্ত্রীর কর্তব্য নয় বিবেচনা করে মৈত্রেয়ী ও কাত্যায়নী উভয়েই মৌন হয়ে রইলেন। যাজ্ঞবল্ক্য প্রসন্নচিত্তে বললেন, "হে প্রিয়তমে, আমার যাবতীয় জাগতিক সম্পদ, সমস্ত গোধন, সমস্ত ধনরত্ন আমি তোমাদের দু'জনের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যেতে চাই যাতে আমার অনুপস্থিতিতে তােমাদের মধ্যে মনের বা মতের অমিলের কারণে এই সম্পত্তি নিয়ে কোনোরূপ বিবাদ না বাঁধে।"

ক্ষণকাল চুপ করে থাকার পর মৈত্রেয়ী বললেন, "হে ঋষিবর, আপনি যে ধনসম্পত্তির উল্লেখ করেছেন সে সম্পর্কে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের অধিকারিনী হলে কি আমি অমৃতের অধিকারিনী হতে পারবো?"

মহর্ষি উত্তর দিলেন, "তা সম্ভব নয় প্রিয়ে। বিত্তের দ্বারা কখনও অমৃতত্ব লাভ করা যায় না, বরং ধনসম্পদ অনেক সময় অমৃতত্ব সাধনায় ব্যাঘাত ঘটায়। অমৃতত্বস্য তু নাশাস্তি বিত্তেন ইতি – বিত্তের দ্বারা অমৃতের আশা নেই। এমনকি ধনীর জীবনও অমরত্ব লাভ করতে পারে না। তবে একজন বিত্তশালী মানুষ হয়ে সুখস্বাচ্ছন্দ্যে তুমি জীবন কাটাতে পারবে।"

স্বামীর উত্তর শ্রবণ করে মৈত্রেয়ী করলেন তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, “যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম্”, অর্থাৎ যা দিয়ে আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারব না তা দিয়ে আমি কী করব! হে ভগবান, জাগতিক সম্পদের ঊর্ধ্বে আপনি যে জ্ঞানে জ্ঞানী হয়েছেন, দয়া করে আমাকে সে সম্বন্ধে উপদেশ দিন। আমাকে অমৃতত্ব লাভের সন্ধান দিন।”

স্ত্রীর কথা শুনে যাজ্ঞবল্ক্য অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, "পতি যে পত্নীর প্রিয় হয় তার কারণ হলো পতিকে ভালােবেসে পত্নীর আত্মা সুখী হয়। পুত্র-কন্যাকে স্নেহ করে বাৎসল্যরসে পিতা-মাতা আত্মিক সুখ অনুভব করেন, এই কারণেই সন্তান-সন্ততিও পিতা-মাতার স্নেহে নিজ নিজ আত্মিক সুখ অনুভব করে। ধনসম্পদের নিমিত্ত কোনো ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির অন্তরাত্মা থেকে তার প্রিয় হতে পারে না। সম্পদ মানুষের প্রিয় হয় নিজ প্রয়ােজন সিদ্ধির জন্য। মূল কথা হল আত্মাই মানুষের মুখ্য প্রীতির বস্তু। আত্মা ব্যতীত ধনসম্পদ, জন, বিত্ত, স্বর্গ সবকিছুই গৌণ। আত্মাই মানুষকে অমর করে।"

ব্ৰহ্মর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যের উপদেশ শ্রবণে তৃপ্ত হলেন মৈত্রেয়ী। স্বামীর পূর্বাশ্রম ত্যাগ করার পর তিনিও সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেন, লোকজনকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানদানে ব্রতী হন। মৈত্রেয়ী উপনিষদ উদ্গাতা হিসাবেও প্রশংসিত হন। বৈদিক ভারতে নারীদের শিক্ষালাভ এবং দার্শনিক জ্ঞানলাভ সম্বন্ধে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। একজন বুদ্ধিদীপ্তা নারী হিসাবে তাঁর সম্মানার্থে আমাদের দেশে তাঁর নামে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এমনই একখানি কলেজ স্থাপিত হয়েছে নতুন দিল্লিতে। তামিলনাড়ুতে গড়ে উঠেছে "মৈত্রেয়ী বৈদিক গ্রাম"।

বৈদিক যুগে জ্ঞানবান পুরুষ সাধকদেরকে বলা হতো ঋষি। অন্যদিকে জ্ঞানঋদ্ধা নারী সাধিকাদের বলা হতো ঋষিকা। তাঁরা সকলেই ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, শাস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। এমনই এক বিখ্যাত ঋষিকা ছিলেন মৈত্রেয়ী। তিনি ছিলেন একজন হিন্দু দার্শনিক। ঋগ্বেদের স্তোস্ত্র-স্তুতির মধ্যে মৈত্রেয়ী সম্পাদিত ১০টি স্তোত্র রয়েছে। ঋগ্বেদে উল্লিখিত আত্মা সম্পর্কে মৈত্রেয়ী বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। স্বামী যাজ্ঞবল্ক্যের আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা এবং সাধনার একান্ত সহযোগিনী ছিলেন তিনি। তাঁদের স্বামী স্ত্রীর কথোপকথনে আধ্যাত্ম বিষয়টি উঠে এসেছে যা বৃহদারণ্যক উপনিষদে বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বৃহদারণ্যকোপনিষদ গ্রন্থে যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে তিনি হিন্দু দর্শনের আত্মা-সংক্রান্ত ধারণাটি পর্যালোচনা করেছেন। 

বৈদিক যুগের নারী ঋষিদের বৈদিক দর্শন, ভাবনাচিন্তা, জ্ঞানগরিমা, প্রজ্ঞার পরিচয় ছত্রে ছত্রে মেলে। বেদের বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা, স্তোত্র রচনা ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁদের প্রজ্ঞার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই প্রজ্ঞার মধ্যে দিয়েই তাঁরা যুগের পর যুগ অমর হয়ে থাকবেন।

---------------------------

কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী 




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন