সদ্যোজাত শিশুর স্নান


সদ্যোজাত শিশুর যে কোনো বিষয় নিয়েই বাবা মায়েরা উদ্বিগ্ন থাকেন। কিভাবে তার যত্ন নেবেন, কি করা উচিত, কি করা উচিত নয় – এইসব নিয়ে চিন্তার শেষ থাকে না। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার প্রতিটা বিষয়ের উপর পৃথকভাবে নজর রাখা এবং বিশেষজ্ঞর মতামত অনুযায়ী পরিচর্যা করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। তার খাওয়া, ঘুম, প্রাকৃতিক কার্যাবলীর সাথে সাথে তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দিকেও নজর দিতে হয়।

সদ্যোজাত শিশুর তেল মালিশ নিয়ে আমরা আগের সংখ্যায় আলোচনা করেছিলাম।আজ সদ্যোজাত শিশুকে স্নান করানোর জন্য কোন কোন বিষয়ের উপর নজর দেওয়া উচিত সেই নিয়ে আলোচনা করব।

সদ্যোজাত শিশুর ত্বক স্বাভাবিকভাবে সংবেদনশীল হয়। তাই তার পরিচর্যার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সতর্কতা নেওয়া জরুরী। বাড়িতে আসার পর সদ্যোজাতকে স্নান করানো অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিশুর ত্বক খুব নরম কোমল হয় যা বহিরাগত দূষণকারী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হতে পারে। বহিরাগত বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়া, খাবার বা এমনকি শিশুর জন্য ব্যবহৃত পণ্য যেমন ভেজা ওয়াইপ, সাবান এবং ময়শ্চারাইজার, পাউডার প্রভৃতির মাধ্যমেও সংক্রম হতে পারে। শিশুকে তাই সাবধানে স্নানের মাধ্যমে রোগ জীবাণু মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।

কখন প্রথম স্নান করানো উচিতঃ

সাধারণত ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে প্রথম স্নান করানো হয়। এরপর পরিস্থিতি অনুযায়ী দিনে একবার বা দু’দিনে একবার স্নান করানো হয়ে থাকে। এই স্নান সাধারণত অভিজ্ঞ নার্স বা শিশু বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানেই করানো হয়।

 

ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাতদিন পর থেকে স্নানের বিধিঃ

  • স্নান শুরুর পূর্বে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
  • সদ্যোজাত শিশুর ত্বক অতিরিক্ত সংবেদনশীল হওয়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত কম হওয়ায়, স্নানের পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা নেওয়া একান্তই দরকার।
  • গ্রীষ্মের সময় শিশুকে প্রতিদিন একবার করে এবং শীতকালে তিনদিনে একবার করে স্নান করানো আবশ্যক।
  • শিশুর ত্বকে জমা হওয়া জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সদ্যোজাতের শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি থাকে না তাই স্নান করালে ত্বকের উপরে জমে থাকা অস্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া অপসারিত হয়, ত্বকের ছিদ্র বা রোমকূপের উপর জমা আস্তরণ পরিষ্কার হয়। ফলে শরীরে জমে থাকা অশুদ্ধি (toxic) ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। 
  • শিশুর ত্বকে কোনও প্রকারের সংক্রম যেমন ঘা অথবা ফুসকুড়ি থাকলে বিশেষজ্ঞর মতানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 
  • শিশুর স্নানের জন্য সঠিক স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ । স্নান করানোর ক্ষেত্রে ঘরের তাপমাত্রা খেয়াল রাখতে হবে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা অতিরিক্ত গরম যেন না হয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ঘরের জানলা দরজা বন্ধ করে বড় গামলা বা টাবে স্নান করাতে হবে। 
  • শীত – গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই শিশুকে নাতিশীতোষ্ণ জলে স্নান করাতে হবে। ঠাণ্ডা ও গরম জল মেশানোর পরে নিজের কনুই ডুবিয়ে জল পরীক্ষা করে নেওয়ার পরেই শিশুর গায়ে সেই জল ঢালা উচিত। জলের উষ্ণতা ৯০-১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইটের মধ্যে রাখতে হবে। 
  • খুব ভোরবেলায় বা দুপুর শেষে বিকালের দিকে স্নান না করানোই উচিত। সাধারণত সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যের সময়কে সদ্যোজাত শিশুর স্নানের উপযুক্ত সময় হিসাবে ধরা হয়।
  • দু’মাস বয়েসের পর থেকে অতিরিক্ত গরমকালে সন্ধ্যার দিকে নরম কাপড় ভিজিয়ে গা মুছিয়ে দিলে শিশুর আরাম হয়। ত্বকের জন্যও উপকারী হয়। 
  • স্নানের শুরুতে নরম ও পরিষ্কার তুলো জলে ভিজিয়ে জল চেপে বার করে চোখ মুছে দিতে হবে। দু’তিনবার খুব সাবধানে এইভাবে চোখ মুছে দিলে চোখের ময়লা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
  • স্নানের সময় শিশুকে হাতের মধ্যে শুইয়ে মাথা অল্প নীচের দিকে করে অল্প অল্প করে জল ঢেলে স্নান শুরু করাতে হবে।
  • মাথা ধোয়া হয়ে গেলে সোজাভাবে ধরে রেখে শরীরে জল ঢালতে হবে। 




  • শিশুর স্নানের জন্য শিশুদের জন্য তৈরি বিশেষ সাবান বা বডি ওয়াশ ব্যবহার করাই শ্রেয়। সাবান বাছাই করার সময় সামান্য অ্যাসিডিক বা নিরপেক্ষ পিএইচ ভারসাম্য ভিত্তিক তরল সাবান বেছে নেওয়া উচিত। কারণ স্বল্প মাত্রার অ্যাসিডিক সাবান শিশুর কমনীয় ত্বককে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলে, যা ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে । অ্যালক্যালাইন সাবান, যা প্রাপ্তবয়স্করা ব্যবহার করে, তা শিশুর ত্বকের জন্য খুব কড়া ধরণের ও ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়। এই ধরণের সাবান ব্যবহারে ত্বক শুকিয়ে যায় ও র‍্যাস সৃষ্টি করে। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের সাবান ব্যবহার একবারেই বর্জনীয়।
  • নরম তোয়ালে বা সুতির কাপড়ে সাবান মাখিয়ে আলতো হাতে তা সারা গায়ে মাখিয়ে, হালকা হালকা করে মালিশ করে দিতে হবে। 
  • হাত - পায়ের ভাঁজ, গলার ভাঁজ, আঙুলের ফাঁক প্রভৃতি জায়গায় ময়লা জমে থাকার সম্ভাবনা থাকে। জমে থাকা ময়লা থেকে ত্বকের বিভিন্ন সংক্রম তৈরি হতে পারে। তাই স্নান করানোর সময় এই সমস্ত জায়গাগুলি ভালো করে পরিষ্কার করানো দরকার। 
  • মাথায় শিশুদের জন্য তৈরি হালকা শ্যাম্পু দিয়ে ১৫ দিনে একবার চুল পরিষ্কার করতে হবে। মাথায় চুল না থাকলেও মাথা পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
  • মাথায় শ্যাম্পু করানোর সময়ও কাপড়ের সরাসরি মাথায় শ্যাম্পু না লাগিয়ে, নরম কাপড়ের মধ্যে শ্যাম্পু নিয়ে মাথায় আলতো করে লাগাতে হবে।
  • সাবান – শ্যাম্পু দিয়ে ত্বক মালিশ করা হয়ে গেলে অল্প অল্প জল ঢেলে ভালো করে সারা শরীর ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
  • এই সময়ও কাপড় বা তোয়ালে ভিজিয়ে ব্যবহার করাই শ্রেয়। এতে ঠাণ্ডা লাগার হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করা যায়। খেয়াল রাখতে হবে সমগ্র স্নানের প্রক্রিয়াটি ৫/৭ মিনিটের বেশি যেন না হয়।
  • স্নানের পরেই শিশুকে একটি শুকনো নরম তোয়ালের মধ্যে মুড়ে নিতে হবে। যাতে তার গায়ের সব জল মুছে তাকে শুকনো করা যায়।
  • মাথা থেকে পা – প্রতিটি অঙ্গের জল মুছে দিতে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে সব কিছুই ধীরে ধীরে এবং আলতো স্পর্শে যেন করা হয়। গায়ে জোরে জোরে তোয়ালে দিয়ে জল  মুছলে নরম ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।
  • গা মোছার সাথে সাথেই সুতির জামা পরিয়ে দেওয়া দরকার। শিশুর গা মোছার সময়ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ভাঁজগুলো সাবধানে ও যত্ন সহকারে মুছে দিতে হবে। নতুবা জল জমে সংক্রমণের ভয় থাকে। 
  • এরপর শুকনো নরম কাপড় দিয়ে কানের আশেপাশের অঞ্চল ও কানের লতির ভেতরের অংশ আলতো করে মুছে পরিষ্কার করতে হবে। কানের ভেতরে বেশি গভীরে পরিষ্কার করার চেষ্টা না করাই উচিত, কারণে এতে শিশুর কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 
  • গায়ের জল মোছানো হয়ে গেলে সারা শরীরে শিশুদের জন্য তৈরি ক্রিম বা ময়শ্চারাইজার মাখিয়ে দিতে হবে।

স্নান সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ

  • শিশুর বেশিরভাগ সময় স্নানের পরে ঘুমিয়ে পড়ে তা স্নানের সময় নির্ধারণ করার সময় এই কথা মনে রাখতে হবে।
  • স্নান করানোর আগে খাবার খাইয়ে দেওয়া ভালো, যাতে ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে।
  • কানের ভিতরের অংশ বা নাকের ভিতরে পরিষ্কার করার চেষ্টা না করাই উচিত
  • যেখানে শিশুর স্নান করাবার স্থানে একটি পিছলরোধ মাদুর রাখা দরকার। এটি যে কোন দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করবে। 
  • শিশুকে কখনোইলে একা ছেড়ে যাওয়া উচিত নয় অল্প সময়ের জন্যও না। প্রয়োজনে তাকে জল থেকে তুলে শুকনো ও সুরক্ষিত জায়গায় শুইয়ে দিয়ে, তারপর যেতে হবে।
  • যদি শিশু ক্ষুধার্ত হয়, তাহলে আগে খাইয়ে নিয়ে স্নান করাতে হবে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় শিশু স্নানের আনন্দ পাবে না।
  • যদি জ্বর, সর্দি - কাশি থাকে, তবে স্নান করানো থেকে বিরত থাকতে হবে এছাড়াও ভ্যাকসিন নিলে স্নান করানো যাবে না।
  • যদি ত্বকের সমস্যা থাকে, তবে আপনি স্নান করানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া একান্ত দরকার।

শিশুর বয়েস বাড়ার সাথে সাথে স্নানের প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করতে হয়। তবে শিশুর ক্ষেত্রে যে কোন নতুন জিনিস শুরু করার আগে এবং শুরু করার পর যদি কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।


কলমে - শ্বে তা  মি ত্র

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন