'নারী'র প্রথম অক্ষরটিই 'না'। তাই হয়তো একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসেও নারীকে শুনতে হয় 'না'। মানবচক্রের যেই মাধ্যমে আমাদের এই পৃথিবীতে আসা,
তার একটি অপার মাধ্যম এই নারী। এই নারী কখনো আপনার মা,
কখনো আপনার বোন আবার কখনো স্ত্রী। নিজেকে অন্যের সুখে হাসতে
হাসতে বিলিয়ে দিতে পিছপা হন না এই নারী। তাই হয়তো একাই ভালোবাসে সমস্যা ও সমাধানের
হালটি কাঁধে তুলে নিতে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার করেই চলে এই নারীর জীবন। যার জন্য
উৎসর্গ করা যায় বছরের প্রত্যেকটি দিন। তাকে উদ্দেশ্য করে যা-ই করা হয়,
তা-ই হয়তো তার করা কাজের কাছে কম। তাই তার উদ্দেশ্য করে আর
তাকে সম্মান জানাতে বিশ্বে একটি দিন পালিত হয় নারী দিবস হিসেবে। সেই দিনটি হল ৮
মার্চ। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন ৮ মার্চ। এর পিছনেও আছে নারীর এক বিশাল আন্দোলনের
গল্প।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস রচনা করেছেন নারী শ্রমিকরা। প্রায় দু' শো বছর আগে মেরি ওলস্টোনক্রাফটের লেখা 'ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উওম্যান' গ্রন্থে নারী স্বাধীনতার কথা প্রকাশিত হওয়ার পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরতা মহিলাদের মধ্যে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। সেই সময় সংসার চালানোর তাগিদে ইউরোপ, আমেরিকার মেয়েরা বিভিন্ন কল-কারখানায় কাজ করতেন। নিউইয়র্কের পোশাক তৈরির কারখানাগুলিতে অধিক সংখ্যক মহিলা শ্রমিক নিযুক্ত ছিলেন। শ্রমিক হিসেবে নারীরা ছিল ভীষণ অমানবিক আচরণের শিকার। স্বল্পমজুরি দিয়ে তাদের সস্তা শ্রম কেনা হত। এমনকি নির্ধারিত ছিল না তাদের শ্রম ঘণ্টাও। এমন কাজ তাদের দেয়া হতো যা ছিল সময়সাপেক্ষ। অথচ মজুরি ছিল পুরুষদের তুলনায় অর্ধেক। কাজ চলাকালীন মালিকরা বাইরে থেকে কারখানা তালাবন্ধ করে রাখতেন। কিন্ত জীবনধারনের জন্য শ্রম বিক্রি ছাড়া নারীদের আর কোন উপায়ও ছিল না। সেইসময়ও শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি, ছুটি ও কর্মঘণ্টার দাবি তুলেছিল।
১৮২০ সালের দিকে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বিভিন্ন কারখানায় অমানবিক কাজের পরিবেশ, বেতন বৈষম্য এবং নানা নির্যাতনের প্রতিবাদে নারী শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ে সামিল হয়ে ধর্মঘট আহ্বান করেন। একই সময়ে আমেরিকায় বর্ণবাদের প্রতিবাদেও শ্রমিকরা প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় বস্ত্র কারখানার প্রায় ৫০০০ নারী-পুরুষ আন্দোলনে অংশ নেয়। দানা বাঁধতে থাকে আন্দোলন। ১৮৫৬ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকরা উপযুক্ত বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশ ও ১০ ঘণ্টা কর্মদিবসের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে। এ আন্দোলন দমনে পুলিশ সেদিন হাজার হাজার নারী শ্রমিকদের মিছিলে গুলি চালায়। ধারণা করা হয়, নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম গুলি চালানোর ঘটনা। সংগঠিত ছিলেন না বলে সে দিন পুলিশি দমনে আন্দোলনকারীদের পিছু হঠতে হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন থামেনি। গ্রেফতার হন অসংখ্য নারী শ্রমিক। ফলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়।
এর তিন বছর পর ১৮৬০ সালে সুঁই কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। একদিকে নারী আন্দোলন যেমন সংগঠিত রূপ নিতে থাকে, অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে। সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে ১৮৮৬ সালের ১ মে। জন্ম নেয় মে দিবসের ইতিহাস।
ক্লারা জেটকিন নারীদের সমস্যা নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি শুরু করেন। নারীর রাজনীতি এবং নারীর ভোটাধিকার ও সমানাধিকার নিয়ে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি জার্মানিতে সমাজ-গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন বিকশিত করেন; ১৮৯১ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দলের পত্রিকা 'সমতা' বা 'Die Gleichheit' সম্পাদনা করেন। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান যে, জার্মান নারীরা পুঁজিবাদের শ্রম শোষণের শিকার এবং যৌন নিপীড়নের শিকার, পুঁজিবাদ নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে। “গৃহে স্বামী বুর্জোয়া ও স্ত্রী সর্বহারা শ্রেণি গঠন করে”- এঙ্গেলসের এই বিখ্যাত উক্তিকে তিনি জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরে তার ব্যাখ্যা করেন। এছাড়াও তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, এটা শুধু জার্মান নারীদের সমস্যা নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমস্ত দেশের নারীদেরই এটাই সমস্যা।
এরপর ১৯০৭ সালে স্টুটগার্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ১৫টি দেশের ৫৯ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই সালে 'আন্তর্জাতিক নারী সংস্থা' (International Women's Bureau) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনেই নারীদের ভোটাধিকারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।
এরপর ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্কে শ্রমঘণ্টা কমানো, মজুরি বৃদ্ধি ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় ১৫,০০০ নারী ও অভিবাসী শ্রমিকদের অংশগ্রহণে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাদের স্লোগান ছিল 'Bread and Roses' . 'Bread' ছিল তাদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার প্রতীক এবং 'Roses' হলো তাদের জীবনমান উন্নয়নের প্রতীক।
এই সমাবেশ বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ঐ দিবস স্মরণে 'সোসালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা' ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি আমেরিকাব্যাপী 'জাতীয় নারী দিবস' পালনের ঘোষণা করেন। একই বছরের নভেম্বর মাসে ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেন। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই ছিলো নারী। তাদের এ ধর্মঘট ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকে। সেবছরের 'মে দিবসে' ৬০ হাজার শ্রমিক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সবদিক থেকেই এ আন্দোলনের প্রভাব ছিল প্রচুর। একদিকে শ্রমিক আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, অন্যদিকে নারী-পুরুষের ভোটাধিকারের দাবিও জোরালো হয়ে উঠেছিল।
এই উত্তাল পরিস্থিতিতে ১৯১০ সালের আগস্ট মাসে কোপেনহেগেনে সমাজতন্ত্রীদের 'দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ১৭টি দেশের শতাধিক নারী-প্রতিনিধিযোগদান করেন। এই সম্মেলনে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক দলের নারী-কার্যালয়ের (Women's Office) নেত্রী হিসাবে ক্লারা যোগদান করেন এবং ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক সর্বহারা ও নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়ের প্রতীক দিবস করার একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। কংগ্রেস ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রস্তাবে তিনি বলেন, প্রতি বৎসরে একই দিনে প্রত্যেকটি দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করতে হবে। একই সাথে তিনি ৮ মার্চকে "আন্তর্জাতিক নারী দিবস" হিসেবে নিজে পালন করেন। তবে, সম্মেলনে প্রথমে ঠিক হয় মার্চ মাসের যেকোন দিন এই দিবসটি পালন করা হবে। ১৯ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইৎজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস চিহ্নিত হয়েছিল। একই সঙ্গে রাশিয়ান মহিলারাও প্রথমবার ২৮ ফেব্রুয়ারি 'রুটি ও শান্তি'র দাবিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। ইউরোপের নারীরা ৮ মার্চ শান্তি বিষয়ক কার্যক্রমকে সমর্থন করে বিশাল মিছিলে নামেন। ১৯১৩ ও ১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়।
১৯১১ সালে মার্চ মাসে নিউইয়র্কের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে। বন্ধ কারখানায় সে দিন দেড়শো মহিলা কর্মরত অবস্থায় প্রাণ হারান। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পাশ্চাত্য দেশগুলিতে নারীমুক্তি আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। এর পর ১৯১২ সালে ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে প্রথম 'ন্যূনতম বেতন আইন' চালু হয়। সেই সময়ে আমেরিকার মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না। বরং, তাঁদের বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থও স্বামীরা আত্মসাৎ করতেন। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হন মহিলারা। তাঁদের আন্দোলনের ফলে, ১৯২০ সালে আমেরিকায় নারীদের নাগরিক ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়।
নানা ঘটনা পরম্পরায় ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘ নারী বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ৮ মার্চ কে "আন্তজার্তিক নারী দিবস" হিসেবে পালনের ঘোষণা করে। ১৯৭৬-১৯৮৫ জাতিসংঘ নারী দশক ঘোষণা করে এবং ১৯৭৯ সালে "নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যবিলোপ সনদ" ঘোষণা করে যা ১৯৮১ সাল থেকে কার্যকর হয়।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারী দিবস নানাভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়, যেমন- আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়া। এইসব দেশের নাগরিকরা ৮ই মার্চ দিনটিতে সবেতন ছুটি উপভোগ করেন। অন্যদিকে নেপাল, চীন, মাদাগাস্কার ও আরও কিছু দেশের মহিলা কর্মীদের জন্য এই দিন সরকারি ছুটি বরাদ্দ। অনেক দেশে এই দিনটিতে পুরুষরা স্বতস্ফূর্ত হয়ে তাঁদের মা, স্ত্রী, বান্ধবী, বোন, মেয়েকে ফুল উপহার দেওয়ার মাধ্যমে দিনটিকে বিশেষভাবে উদযাপন করে থাকেন।
দেশে বিদেশে নারী দিবস বিভিন্নভাবে উদযাপন করার রীতি রয়েছে। এই প্রসঙ্গে
সংক্ষিপ্ত আকারে বলা যায় -
চীন - চীনে এই দিনটিতে নারীদের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা, যত্ন ও সম্মানের বহিঃপ্রকাশ করা হয়ে থাকে। অফিস ও অন্যান্য কর্মস্থলে এই দিনে মেয়েদের পুরো দিন ছুটি অথবা হাফ ছুটি দেওয়া হয়। বিভিন্ন সম্মেলন আয়োজিত হয়। পুরুষরা তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত নারীদের জন্য ফুল, গ্রিটিংস কার্ড ও বিশেষ উপহারের ব্যবস্থা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৮ই মার্চ নারী দিবসের পাশাপাশি চীনে ৭ই মার্চ মেয়ে দিবসও পালিত হয়ে থাকে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে এই দিনটি।
রাশিয়া - এখানে নারী দিবসে জনসাধারণের জন্য সরকারি ছুটি বরাদ্দ। দিনটি সকলে মিলে একসঙ্গে উদযাপন করে। পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনরা দেখাসাক্ষাৎ করে, একত্রে খাওয়াদাওয়া করে। পরিবারের পুরুষরা নারীদের জন্য ফুল, গ্রিটিংস কার্ড, চকোলেট, সুগন্ধী অথবা অন্যান্য উপহার ইত্যাদি নিয়ে আসে। উপহারের জন্য সর্বাধিক জনপ্রিয় হলো মিমোসা ফুল এবং গোলাপ।
ইতালি - ইতালিতে নারী দিবসের নাম La Festa Della Donna। এখানেও উপহার হিসাবে মিমোসা ফুল দেওয়া হয়ে থাকে। এই ফুলটি মার্চ মাসেই প্রস্ফুটিত হয়। সজীব ফুলের তুলনায় অধিক ভালো উপহার আর কিই বা থাকতে পারে!
পোল্যান্ড - এখানেও এই দিনটি নারীদের প্রতি বিশেষ সম্মান জানানোর অভিপ্রায়ে উদযাপিত হয়ে থাকে। এখানকার সর্বাধিক জনপ্রিয় উপহার হলো টিউলিপ ফুল। এই দিনে একজন নারী তার পরিচিত যেকোনো পুরুষ, তিনি তার বাবা, দাদা, ভাই, স্বামী, বন্ধু, ছেলে অথবা অফিসের বস যেই হোক না কেন, টিউলিপ ফুল উপহার পাবেনই। বড়ো বড়ো শহরে অপরিচিত পুরুষরাও গুচ্ছ গুচ্ছ টিউলিপ নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। পথচলতি যেকোনো নারী সেই গুচ্ছের একটি করে ফুলের অধিকারিনী।
বুলগেরিয়া - বুলগেরিয়ায় নারীদের বিশেষ সম্মান প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মায়েদের প্রতিও বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এই দিন নারীরা ফুল, চকোলেট, গ্রিটিংস কার্ড এবং অন্যান্য উপহার পেয়ে থাকেন। বাচ্চারা স্কুলে তাদের শিক্ষিকাদের জন্য ফুল ও হাতে বানানো কার্ড নিয়ে যায় এবং স্কুলে বসে নিজেদের মায়েদের জন্য গ্রিটিংস কার্ড বানায়। অনেক কোম্পানি তাদের নারী কর্মচারীদের জন্য লাল গোলাপ ও গ্রিটিংস কার্ডের ব্যবস্থা রাখে।
আমাদের দেশের প্রসঙ্গে এলে বলা যায়, চতুর্বেদ শাস্ত্রের জননী স্বরূপা হিসেবে সেখানে প্রণম্য হয়ে
আছেন গায়ত্রী। 'মাতা' হিসেবে পূজিতা হয়ে এসেছেন তিনি। শাস্ত্রীয় যাবতীয় হোম-যজ্ঞ,
পুজোপাঠ, উপনয়ন সর্বত্রই গায়ত্রী মন্ত্র পাঠের বিধান আছে।
মাতৃপূজার ভাবনা আমাদের দেশে বহু প্রাচীন। মাতৃশক্তিকে পরামারাধ্যা জ্ঞানে
ভাবা হয়। সভ্যতার আদিযুগ থেকে এই মাতৃশক্তি জাগতিক দুর্দশা থেকে মানুষকে রক্ষা
করবে এই বিশ্বাস রয়ে গেছে মানবমনে। মার্কন্ডপুরাণেও উল্লেখ আছে দেবতাদের মতোই
অন্যান্য উপদেবতারাও ঐশ্বরিক মাতৃশক্তির কাছেই নতজানু হয়ে ছিলেন। দেবী অদিতি সমস্ত
প্রধান দেবতা যথা, ইন্দ্র, বরুণ, রুদ্র, আর্যমন, মিত্র এঁদের মাতা হিসেবে উল্লেখিত রয়েছেন। দেবী সরস্বতীকে
জ্ঞান ও সাহিত্যসঙ্গীতের প্রতিরূপ বলা হয়। দেবী অন্নপূর্ণাকে শস্য সুজলা সুফলার
প্রতিরূপ মানা হয়ে থাকে। লক্ষ্মীকে ধনসম্পদ ও গৃহলক্ষ্মী হিসাবে,
বনদেবীকে গাছপালা বনজঙ্গলের প্রতিভূ ইত্যাদি হিসাবে কল্পনা
করা হয়। কখনও দেবতাও 'অর্ধনারীশ্বর' রূপে ধর্ম নির্মাণে মূর্ত হন,
যেমন বিষ্ণু। বিষ্ণুর স্ত্রীর নাম 'শ্রী' , আমরা বলি 'শ্রীবিষ্ণু'।
বৈদিক যুগে বহু ঋষিকার উল্লেখ আমরা পাই - গার্গী, মৈত্রেয়ী, লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, ঘোষা, অপালা এবং আরও অনেকে। শাস্ত্র চর্চা, বেদ পাঠ, তর্কসভা সর্বত্র ছিল তাঁদের অবাধ বিচরণ। যথোপযুক্ত সম্মান তাঁরা পেতেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে নারীর অধিকার ও প্রগতি খর্ব হতে শুরু করে।
বহু অত্যাচার ও অবিচারের পথ অতিক্রম করার পর ভারতে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে মেয়েদের অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকারের দাবিতে নারী দিবস পালন শুরু হয়। এর পাশাপাশি পণ, ধর্ষণ, মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গার্হস্থ্য হিংসা, পরিবারে মেয়েদের অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নারী আন্দোলনের দাবির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে এবং প্রতি বছর এই সব দাবি আদায়ের আওয়াজ তোলা হয় নারী দিবসে। সমালোচকদের মতে, যেহেতু ভারত-সহ নানা দেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মহিলারা মূলত একটা সময় পর্যন্ত বাড়ির কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। তাই তাঁদের এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতটা পাশাচাত্যের থেকে একটু আলাদা। এখানে নারীশিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের জন্য কাজের সুযোগের দাবি ওঠে। বিবাহ বিচ্ছিন্না বা বিধবা মহিলাদের বেশিরভাগই থাকতেন তাঁদের বাপের বাড়িতে। সেখানে বাবা-দাদাদের কাছে আশ্রিত হয়ে থাকার বদলে, ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। ফলে, এই দেশে সমাজের বেশিরভাগ মহিলাদের নারীমুক্তি আন্দোলনের ঢেউকে গ্রহণ করতে স্বাধীনতার পরেও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ভারতীয় সমাজের বিবর্তনের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মূলত পুরুষতান্ত্রিক ভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চালিত হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজে বেশ কিছু নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। মধ্যযুগে সুলতানা রাজিয়া থেকে শুরু করে উনিশ-বিশ শতকে রানি রাসমনি, সারদাদেবী, সাবিত্রী ফুলে, সিস্টার নিবেদিতা, ঠাকুরবাড়ির নানা মহিলা সদস্য— সাহিত্য, ধর্ম, রাজকার্যের মতো ক্ষেত্রে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছিলেন। নারীস্বাধীনতার বিষয়টিকে নিয়ে রাজনীতির ময়দানেও প্রয়াসের খামতি নেই। মহিলাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে, নির্বাচনে তাঁদের জন্য একটা নির্দিষ্ট শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের বহু প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে বসেছেন মহিলারা। চিকিৎসা থেকে শুরু করে সাহিত্য— সর্বত্র মহিলাদের যোগদানের হার বাড়ছে।
২০২১ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম ছিল #ChooseToChallenge। এক কথায় বলতে গেলে, এই বিশ্ব তথা যেখানে হাজার চ্যালেঞ্জ, বাধা, বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেই জায়গা ততটাই সচেতন ও অভিজ্ঞ। আর এই চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা থেকেই চেঞ্জ তথা পরিবর্তন আসে। এবারের থিমের মূল লক্ষ্য হল করোনা চ্যালেঞ্জ। মূলত করোনাভাইরাস উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতাগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে। এক্ষেত্রে মহিলাদের ভূমিকার বিষয়টি নিয়েও বিশদে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে পরিস্থিতির মোকাবিলায় যে নীতি নির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হচ্ছে, সেখানে মহিলাদের কতটা ভূমিকা রয়েছে, তা দেখা হচ্ছে।
২০২২ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম হল - "Gender equality today for a sustainable tomorrow" অর্থাৎ ভবিষ্যৎকে মজবুত করার জন্য বর্তমানে লিঙ্গ সমতা। সুস্থ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে লিঙ্গ সমতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই এই থিমকে এই বছর বেছে নেওয়া হয়েছে।।
এ তো গেল নারী দিবসের ইতিহাস। কিন্তু আসল প্রশ্ন প্রয়োজনীয়তার এবং
সমানাধিকারটা ঠিক কী সেটা। প্রশ্ন আরও একটা। নারী এবং পুরুষ কি কোথাও আলাদা নয়?
সব ক্ষেত্রে এক হওয়ার লড়াইটা কি খুব দরকার। না,
নারী এবং পুরুষ এক নন। পার্থক্য আছে। একটি বিরাট পার্থক্য
আছে- শারীরিক পার্থক্য। তা হলে লড়াইটা কীসের?
লড়াই প্রকৃতি প্রদত্ত পার্থক্যের নয়,
লড়াই মানুষের তৈরি ভেদাভেদ নিয়ে।
বাসে ট্রেনে রিজার্ভড সিটের লড়াই নয়, লড়াইটা বাড়ি থেকে শিক্ষাক্ষেত্র,
কর্মক্ষেত্র থেকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নারীর যোগ্যতা
অনুযায়ী সম-অধিকার পাওয়ার। উদ্দেশ্য এইটা নয় যে আমার বেতন আমার পুরুষ সহকর্মীর
সমান হবে না কেন? উদ্দেশ্য এইটা আমার বেতন আমার যোগ্যতা অনুযায়ী হোক। আমি
ছেলে না মেয়ে— সেই নিরিখে মাপা নয়। বাবা, মা, পরিবারের বড়দের একটি মেয়ের ভালো মন্দ ভাববার অধিকার অবশ্যই
আছে, কিন্তু
সেই ভাবনার মাপকাঠি তার জেন্ডার হলে সমস্যার।
পৃথিবীর সব ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও, মেয়েরা ভালো গাড়ি চালাতে পারে না বা মেয়েদের মন বোঝা খুব শক্ত, লড়কি হাসি তো ফাঁসি কিংবা মেয়েদের মতো কাঁদিস না। সমস্যা এই মানসিকতাগুলো নিয়ে। আরে বাবা, গাড়ি চালাতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাতে জেন্ডারের সমস্যা কোথায়? মন বোঝা শক্ত বুঝলাম কিন্তু মনটাকে তার মতো করে বুঝতে চেষ্টা করা হয় কি? না নিজের মতো করে? আর হাসলেই কেল্লাফতে? কারও বোকামি দেখেও যদি হাসি, তার মানে ফাঁসি? আর কান্না? মন খারাপটাকে কেবল আমি খুব শক্ত এইটা প্রমাণ করতে চেপে রাখার কি খুব দরকার? তা এতে মেয়ে বা ছেলের পার্থক্যটা এল কোথায়?
হ্যাঁ, এটা ঠিক ফেমিনিজমের আড়ালে, ক্ষেত্র বিশেষে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা অনেকেই করেন। কিন্তু তাতে তো সবার মানসিকতার প্রকাশ পায় না? একদিন নারী দিবস পালন করে কিছুই পরিস্থিতি বদলানো যায় না। বরং তাদের জন্য উদ্যাপন করা যায় যাঁদের হাত ধরে ঘটেছে পরিবর্তন। যাঁদের দৌলতে শুরু হয়েছে সমান অধিকারের লড়াই। যদি সমান হয়েই থাকি তবে একটি বিশেষ দিন কেন? প্রতিটা দিনই নারী দিবস, প্রতিটা দিনই পুরুষ দিবস। বিচার হোক যোগ্যতায়।
তথ্যসূত্রঃ-
আন্তর্জাতিক নারী দিবস- উইকিপিডিয়া
প্রথম আয়োজক ক্লারা জেটকিন- সমকাল
ক্লারা জেটকিন- রোদ্দুরে.com
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন