'কী
রে, কেমন আছিস'?
'ভালো'।
'এই এলি না কী'?
'হ্যাঁ, এইমাত্র এলাম'।
খুশি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছুটি উপলক্ষ্যে বাবা মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই ওর বয়সী বাচ্চাদের তুলনায় খুশি একটু বেশি বাড়ন্ত। স্বাভাবিকভাবেই শরীরের গঠনেরও পরিবর্তন হয়েছে।
রাতের বেলায় সব দাদা, ভাই, বোন মিলে খুব আনন্দ করল। গল্প করল। গ্রামের বাড়িতে যেমন হয় তেমনি! তারপর সবাই এক জায়গাতেই বিছানা করে শুয়ে পড়ল।
ঘুমে চোখটা সবে লেগে এসেছে, হঠাৎই অন্যরকম একটা স্পর্শ অনুভব করে খুশি। একটা শক্ত হাত ওর জামার ভিতর! খুব ভয় পেয়ে যায় সে। সবাই তো পরিবারের লোক, কে করবে এমন! পাশে জ্যেঠুর ছোটছেলে শুয়ে রয়েছে। সে এমন করছে কেন! ভয়ে খুশি কোনোরকমে হাতটা বের করে এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। টেনশন করতে করতে একটা সময়ে ঘুমিয়েও পড়ে।
কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে যায়। আবার সেই! সারাটা রাত আর ঘুমোতে পারে না খুশি। স্বল্প পরিসরের মধ্যে অন্য জায়গাতে যাওয়াও যাচ্ছে না। ওর মা, জ্যেঠিমা একটু দূরের ঘরে রয়েছে। অনেকটা রাত হয়ে গেছে। সেখানে এখন গেলেই সবাই হাজারটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে। 'কেন এত রাতে উঠেছিস?'...ইত্যাদি ইত্যাদি , - তখন কী উত্তর দেবে খুশি!
পরের দিন শোওয়ার সময় খুশি ওর মাকে বলে, 'মা আমি আজ থেকে তোমার কাছে শোব'।
'কেন? কিছু হয়েছে'?
'না, এমনি'।
খুশির বুক ঢিপঢিপ করছে এখনও। আরও বড় বিপদ হতে পারত! সেটা থেকে রক্ষা পেয়েছে এটাই অনেক।
তারপর থেকে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। খুশি এখন অনেকটাই বড়ো, নিজের লেখাপড়া সম্পূর্ণ করেছে। বেশ কয়েকবছর আগে সেই দাদারও বিয়ে হয়ে গেছে, একটি কন্যাসন্তান আছে তার। খুশি ভাবে, ধর্ষকেরও মেয়ে হয়! যে শ্লীলতাহানি করে তারও মেয়ে হয়! তারা সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক। বাবার কুকর্মের ফল যেন তাদের কপালে না এসে জোটে!
দিন কাটতে থাকে। খুশির বান্ধবীদের, তুতো বোনদের বিয়ে হয়ে যায়। খুশির বিয়ের জন্যও সম্বন্ধ আসতে শুরু করে। ব্যস্ত হয়ে পড়েন তার বাবা মা। কিন্তু বেঁকে বসে খুশি নিজে, বিয়ে সে কিছুতেই করবে না।
খুশির বাবা মা বিস্মিত হন। একাধিকবার কারণ জিজ্ঞাসা করেও মেয়ের কাছ থেকে কিছুই জেনে উঠতে পারেন না তাঁরা। অবশেষে খুশির মা জয়া দেবী আলাদা করে খুশির সঙ্গে কথা বলেন।
'কি হয়েছে মা? বিয়ে করতে তোর আপত্তি কিসের? আমাদের খুলে না বললে আমরা বুঝবো কিভাবে? তোর কি বিশেষ কোনো বন্ধু আছে?'
বিশেষ বন্ধু! নাহ্, বিশেষ কোনো বন্ধু এখনও হয়ে ওঠেনি তার। বিয়ে না করতে চাওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ হলো স্পর্শ। সেই স্পর্শ, যা খুশি আজও ভুলতে পারেনি। সে রাতের ভয়ংকর স্মৃতি তাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়।
খুশি আর থাকতে পারে না, সব বলে দেয় মাকে। সব শুনে জয়া দেবী বলেন, 'এসব কথা আগে কেন আমাকে বলিসনি?
'ভয়ে'।
'আমাকে কিসের ভয়? আমি তো তোর মা'।
'এখন বলছ তো মা। তখন হলে আমাকেই পাকা বলে বকতে'।
খুশির মা আর কিছু বললেন না। তখন সময়টা অন্যরকম ছিল এটা বুঝলেন। ভালো স্পর্শ মন্দ স্পর্শ নিয়ে সেসময় সত্যিই তেমনভাবে কোনো সচেতনতা ছিল না। ছোটোরা বুঝতে পারতো না বাড়ির বড়োদের জানাবে কিনা, আর জানালেও সত্যিই হয়তো ধমক খেতে হতো তাদের। ভয়ে, কুণ্ঠায় এসব কথা না বলাই রয়ে যেত। উপলব্ধি করেন জয়া দেবী। মেয়েটার জন্য কষ্টও হচ্ছে। এতকিছু এতদিন একা একা সহ্য করেছে মেয়েটা! যাইহোক, এই সমস্যা থেকে ওকে বের করতে আনতেই হবে, নাহলে এই ভয় সারাটা জীবন তাঁর মেয়ের সঙ্গী হয়ে উঠবে।
জয়া দেবী মেয়েকে বললেন, 'দেখ মা, সব মানুষ তো সমান হয় না। এই পৃথিবীতে খারাপ মানুষ যেমন আছে, ভালো মানুষও রয়েছে। এই ট্রমা থেকে বেরোতে না পারলে তোর নিজেরই অসুবিধা হবে। এই সমস্যা থেকে বের হতে তোকে আমি সাহায্য করব।'
খুশি চুপচাপ শোনে মায়ের কথা, তারপর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়ের অলক্ষ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জয়া দেবী। তাঁরা অভিভাবকরা যদি সন্তানের ছোটো বয়সেই তার মনে স্পর্শের রকমফের সম্পর্কে সচেতনতা ও সাহসের জায়গা তৈরি করতে পারতেন এবং নিজেরাও সেই বিষয়ে সাবধান থাকতেন তাহলে হয়তো মেয়েটাকে এভাবে একটা খারাপ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হতো না। এই স্মৃতি থেকে তাঁদের সন্তানকে বার করে আনতেই হবে। মেয়েটা এতোদিন ধরে গুমরে বেঁচেছে। এবার প্রাণ খুলে বাঁচুক, মন খুলে হাসুক। বিয়ের কথা নাহয় পরে ভাবা যাবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন