অন্য রূপকথা - পৌষালী ব্যানার্জী




 "মহারাজ, রাণীমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।" মন্ত্রী এসে জানায়।

 বিস্মিত হয়ে সুয়োরাণীর দিকে তাকায় রাজা। এই তো সামনেই বসে আছে সে। তাহলে?

 ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সামান্য ইতস্তত করে মন্ত্রী বলে, "মহারাজ, দুয়োরাণীর কথা বলছিলাম।"

 ব্যস, রাগে মুখ লাল হয়ে যায় রাজার। ওই ভিখারিনীর এতো সাহস যে তাকে তেজ দেখায়!! তাকে!! চন্দ্রগড়ের মহারাজকে!!

"যেখানে খুশি যাক।"

"কিন্তু মহারাজ, পুবদিকের বনে কয়েকমাস যাবৎ এক রাক্ষস বাস করছে শুনলাম। সে বড়োই ভয়ংকর। সেখানে গিয়ে পড়লে তো রাণীমার সমূহ বিপদ।"

"যা পারে হোক, রাক্ষসে খেলে খাক। রাণী আমার সুরাপাত্রটা ভরে দাও তো।"

মন্ত্রীমশাই কি আর করবে, ম্লানমুখে বিদায় নেয়। রাজার সুরাপাত্র ভরতে ভরতে সুয়োরাণী পুলকিত হয়। যাক বাবা, আপদ গেছে।

ওদিকে চোখের জল মুছতে মুছতে বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকে দুয়োরাণী। এখানে যে এক রাক্ষস থাকে সে জানে, ওইজন্যই যাচ্ছে। এ জীবন রেখে লাভ কি! পরপর তিনবার মা হতে গিয়েও হতে পারলো না, গর্ভের সন্তান গর্ভেই মারা গেল। রাজামশাই আজ স্বয়ং তাকে "অপয়া" বলে গেছে। আচ্ছা, তার কি দোষ? সে কি চেয়েছিল যে এমনটা হোক? কষ্ট কি তার হয়নি?

চন্দ্রগড়ের রাণী হওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে ভালোই কেটে যাচ্ছিল জীবন। মা-মেয়ে মিলে নকশী কাঁথা বুনে বিক্রি করতো। তার রূপে মোহিত হয়ে রাজা তাকে বানাল নিজের রাণী। কিন্তু এমনই কপাল, সন্তানসুখ দিতে না পারায় রাজা আরেকটি বিয়ে করল। সে হয়ে গেলো দুয়োরাণী। বাইরের মহলে থাকে, একাই দিন কাটায়। মাঝেমধ্যে তার কাছে আসে রাজা, তাও সন্তানলাভের উদ্দেশ্যে।

কিছুদূর এগিয়ে এক ভয়াবহ আর্তনাদে বুকটা কেঁপে ওঠে দুয়োরাণীর। এ তো কোনো মানুষের চিৎকার নয়! তাহলে কি সেই রাক্ষসটাই? তাতে কি, সে মরতেই তো এসেছে। রাক্ষসটা তাকে খেয়ে নিলে ঝামেলা শেষ।

ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যায় দুয়োরাণী। দেখে সামনে সত্যিই সেই রাক্ষস, অতিকায় চেহারা। কিন্তু অমন করছে কেন? ভালো করে দেখে রাক্ষসটার একটা হাত কিভাবে একটা মোটা গাছের চেরা গুঁড়ির মধ্যে চিমটের মতো আটকে গেছে। বার করতে পারছে না, ব্যথা লাগছে, আর তাতেই এমন চিৎকার।

দুয়োরাণী ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে গাছের গুঁড়িতে হাত রাখে। কি আশ্চর্য! গাছের চেরা অংশটা ফাঁক হয়ে যায়, রাক্ষসটাও হাত বার করে নেয়। দুয়োরাণীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে থাকে। মনে মনে ভয় পেলেও মুখে প্রকাশ করে না দুয়োরাণী। সোজাসুজি রাক্ষসের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

রাক্ষসটা দুয়োরাণীর হাতে একখানা কবচ ধরিয়ে দিয়ে অবিকল মানুষের গলায় বলে ওঠে, "এটা সবসময় গলায় পরে থাকবে। এর কাছে একটাই মনোবাঞ্ছা করতে পারবে, পূরণ হবে তা। একটার বেশি কিন্তু হবে না। এই কবচ তোমায় সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করবে।"

বলে ধীরপায়ে বনের মধ্যে মিলিয়ে যায় সেই রাক্ষস।

ঘটনার আকস্মিকতা দুয়োরাণীকে হতবাক করে দেয়। আচ্ছা, এই কবচ কি তাকে তার চির আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দিতে পারবে??

................................................................................


গ্রামে শোরগোল পড়ে গেছে, আজ এতোদিন পর মনুয়া ফিরে এসেছে। তার মা বাবা আর স্ত্রীয়ের তো খুশির সীমা নেই। এই হাসছে, এই কাঁদছে। গ্রামবাসীদের হাজারো প্রশ্নে মনুয়া জেরবার। অবশেষে তার বাড়ির লোক তাকে ঘরে নিয়ে গেল।

রাতে ঘুম আসে না মনুয়ার, পুরোনো কথা ভাবতে থাকে। সে ছিল বড়োই কুটিল স্বভাবের, খারাপ কাজে হাত পাকিয়েছিল। একদিন এক সাধুর কোপে পড়ে যায় সে। তাকে অভিশাপ দেয়, এক বিশালাকার রাক্ষস হয়ে সে জীবন কাটাবে। আর সত্যি সত্যি নিমেষের মধ্যে মনুয়া মানুষ থেকে হয়ে যায় রাক্ষস। সাধুর পায়ে কেঁদে পড়লে সাধু তাকে একটা কবচ দেয় আর বলে, কোনো ভালো মানুষ তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করলে সে যেন এই কবচটা সেই ব্যক্তিকে দেয়। এই কবচ সেই ব্যক্তির একটিমাত্র মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে। আর তার পরেই মনুয়া রাক্ষস থেকে মানুষের রূপ ফিরে পাবে।

নাহ্, আর কোনো খারাপ কাজ নয়। এবার থেকে সে সৎপথেই উপার্জন করবে। সিদ্ধান্ত নেয় মনুয়া।

 ................................................................................


যথাসময়ে দুয়োরাণীর কোল আলো করে আসে ফুটফুটে এক ছেলে। এতোদিন সে তার মায়ের ঘরেই ছিল। রাজামশাই সুখবর পেয়ে ছুটে আসে।

 "চলো রাণী, আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি।"

 দুয়োরাণী নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে রাজার দিকে।

"আপনি তো বরাবরই জানতেন যে আমি এখানে আছি, কখনও তো নিয়ে যেতে আসেননি! আমার যত্নআত্তিও করেননি। ভেবেছিলেন হয়তো এবারের বাচ্চাটাও বাঁচবে না, তাই এসেই বা কি হবে। এখন সে নিরাপদে পৃথিবীতে আসতে পেরেছে বলে এসেছেন আপনি। ফিরে যান মহারাজ, আমরা এখানেই থাকবো।"

 ফুঁসে ওঠে রাজা।

"তুমি এখানেই থাকো। ভিখারীর মেয়ের ভিখারী স্বভাব যাওয়ার নয়। আমার ছেলেকে আমি নিয়ে যাব।"

বলে দুয়োরাণীর কোল থেকে বাচ্চাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায় রাজা। কিন্তু রাণীকে স্পর্শ করতেই রাজার হাতে প্রচন্ড যন্ত্রণা করে উঠলো, আর্তনাদ করে ওঠে সে।

দুয়োরাণী বুঝতে পারে, সবই কবচের মহিমা।হেসে বলে, "মহারাজ আপনি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না, আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে নিয়েও যেতে পারবেন না। ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে আমার সঙ্গে। আপনি ফিরে যান।"

অগত্যা রাজা নিজের রাজ্যে ফিরে আসে।

"রাণী আমার সুরাপাত্রটা ভরে দাও.." আদেশ করে। কোনো সাড়া না পেয়ে দেখে সুয়োরাণী সাজসজ্জায় ব্যস্ত।

"কি হলো? কি বললাম শুনতে পেলে না?" রাগ ফুটে ওঠে রাজার স্বরে।

"দুঃখিত মহারাজ। এবার থেকে নিজেরটা আপনাকে নিজেই করে নিতে হবে, নয়তো অন্যকাউকে বলুন। আমি চললাম।"

"কোথায় যাবে তুমি?"

"আমার রাজ্যে আমি ফিরে যাচ্ছি। আপনার মত স্বার্থপর মানুষের সঙ্গে আমি গোটা জীবনটা কাটাতে পারবো না। তার চাইতে একা থাকা ভালো।"

ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে রাজা।

"এত বড় সাহস! এর ফল তোমায় ভুগতে হবে।"

সুয়োরাণী এবার ঘুরে তাকায়, "কি করবেন? যুদ্ধ ঘোষণা করবেন প্রতাপনগরের বিরুদ্ধে? সানন্দে করুন, আর সেই যুদ্ধের সেনাপতিত্ব করবো আমি। ভুলে যাবেন না, আপনার তুলনায় অস্ত্রচালনায় আমি অনেক বেশি পারদর্শী।"

রাজা চুপ করে থাকে।

সুয়োরাণী বলে যায়, "আমি এতোদিন ভাবতাম আমার প্রতিদ্বন্দ্বী দুয়োরাণী। কিন্তু মূল সমস্যার লোক তো আপনি। দুয়োরাণীর কোনো খোঁজ রাখেননি এতোদিন, এমনকি তার মৃত্যুকামনাও করেছেন। আর আজ তার সন্তান হতেই সেই নবজাত শিশুকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিতে চলেছিলেন। আমি এ রাজ্যের রানী এবং প্রতাপনগরের রাজকন্যা। গুপ্তচর আমারও আছে। সন্তান লাভের জন্য যে আপনি আবার বিবাহ করবেন বলে পাত্রীর খোঁজখবর করছিলেন সে আমার অজানা নয়। আমাদের প্রতি আপনার কোনো ভালোবাসা নেই, শুধুই বাচ্চা জন্ম দেওয়ার যন্ত্র আমরা। এমন মানুষের জন্য আমি আমার গোটা জীবনটা নষ্ট করতে পারবো না।"

সুয়োরাণী চলে যায়। সুসজ্জিত মহলে একা বসে থাকে রাজা।

 ................................................................................

মা-মেয়ে মিলে আবার নকশী কাঁথার কাজ শুরু করেছে দুয়োরাণী, সংসার ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে তাদের। সন্তানের যথাযথ যত্নও নিচ্ছে সে। সুয়োরাণী প্রতাপনগরে ফিরে গিয়ে শাস্ত্রচর্চায় মনোনিবেশ করেছে, তার সঙ্গে অস্ত্রচালনার অনুশীলনও করছে।

নাহ্, চন্দ্রগড়ের মহারাজের খোঁজ কেউ আর রাখেনি।


কলমে - পৌষালী ব্যানার্জী

চিত্রঃ সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন