বর্তমানের ব্যস্ত জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নতুন বাবা – মাকে এমন অনেক জিনিসের উপর নির্ভরশীল হতে হয়, যার থেকে অনেক সময়েই শিশুর ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়। সঠিকভাবে সব জিনিসের ব্যবহারের অজ্ঞানতা থেকে শিশু শরীরে তৈরি হয় রোগ ব্যাধি। “ন্যাপির্যাশ” বর্তমানে বহুল পরিচিত এমনই একটি চর্মরোগ, যা প্রায় প্রতিটি শিশুই অল্প থেকে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়। শহরাঞ্চলের শিশুদের জন্মের পরবর্তী মুহূর্ত থেকে শুরু করে তিন – চার বছর বয়স পর্যন্ত দিনের বেশিরভাগ সময়েই বিভিন্ন ধরনের ডায়াপার বা ন্যাপি ব্যবহার করা হয়। এই ধরণের ন্যাপিতে শিশুর মল, মূত্র জমা হতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ভিজে ন্যাপি ত্বকের সংস্পর্শে এসে লাল ঘামাচির ন্যায় র্যাশ বা ফুসকুড়ি জাতীয় চর্মরোগের সৃষ্টি করে। এই ধরণের রোগকে “ডায়াপার ডারমাটাইটিস” বলা হয়।
শিশুদের দুই পায়ের সংযোগস্থল,
কোমর, জঙ্ঘা ও নিতম্বে ন্যাপির দ্বারা আচ্ছাদিত
অংশে লাল বা গোলাপি রঙের ছোট ছোট ফুসকুড়ি সহ অল্প ফুলে যাওয়া,
ত্বকে জ্বালা এবং চুলকানি হল ন্যাপির্যাশের
লক্ষণ। এই ধরণের র্যাশের ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা হওয়া দরকার। নতুবা এর
থেকে বড় ধরনের ঘা বা দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিশুদের ত্বক
তুলনামূলকভাবে অতিরিক্ত সংবেদনশীল হওয়ায় ক্ষতিকর চর্মরোগের প্রভাব বেশি হয়।
ন্যাপির্যাশের প্রকারভেদঃ
ন্যাপির্যাশ সামান্য থেকে
গুরুতর প্রকারের হতে পারে। সামান্য বা স্বল্প প্রকারের ক্ষেত্রে এক বা দু’দিনে নিজে
থেকে র্যাশ সেরে গেলেও, গুরুতর প্রকারের ক্ষেত্রে সারতে দেরী হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে
চিকিৎসকের সঠিক পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করাই উচিত।
ন্যাপির্যাশ হওয়ার কারণঃ
- দীর্ঘক্ষণ ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে কাপড় দিয়ে ত্বক ঢেকে রাখলে র্যাশ হতে পারে।
- ন্যাপিতে মল ও মূত্র সঠিক সময়ে পরিষ্কার না করলে র্যাশ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- অপরিচ্ছন্নতাজনিত কারণে ছত্রাক সংক্রমণ ঘটেও ন্যাপির্যাশ তৈরি হয়।
- শিশুর ন্যাপি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন না করা হলে ন্যাপিতে অবস্থিত প্লাস্টিকের সাথে ত্বকের ঘর্ষণজনিত কারণে র্যাশ হওয়া স্বাভাবিক।
- Candida Albicans নামক ছত্রাকের দ্বারা সংক্রমনের ফলেও ন্যাপির্যাশ হতে পারে। সাধারণ লাল বা গোলাপি বর্ণের ছোট ছোট ফুসকুড়ি জাতীয় এই সংক্রমণ অনেক সময় শিশুর পেট, কোমর, পা থেকে ঠোঁট ও মুখগহ্বরেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে ঠোঁটে বা মুখের ভেতরে এই সংক্রমণ সাদা রঙের হয়। ত্বক ফুলে ওঠে, অসম্ভব জ্বালাসহ চুলকানি হয়।
- ছত্রাক সংক্রমণ সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে ছড়িয়ে পড়ে ঘা তৈরি করে, যা দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি তৈরি করে।
- অনেক সময় টক ফল বা সব্জি থেকেও র্যাশ হতে পারে। বিশেষ করে কমলালেবু, স্ট্রবেরি এবং টমেটো থেকে এই ধরণের র্যাশ হয়। তাই অন্তত দুই বছর বয়েস পর্যন্ত এই সব খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো।
- কিছু শিশুর ক্ষেত্রে দাঁত বেরোনোর সময় র্যাশ দেখা যায়। তবে এগুলো সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়।
- কিছুক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ওষুধের (antibiotics) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও এই ধরণের র্যাশ হয়।
- কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এই ধরণের ছত্রাক সংক্রমণ থেকে মূত্রনালির সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা পরবর্তীকালে দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত করতে পারে।
- ন্যাপি বা ডায়াপার ব্যবহার কম করা উচিত। একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত ন্যাপি ব্যবহার না করাই শিশুর ক্ষেত্রে মঙ্গল। নরম সুতির কাপড়ের তৈরি প্যান্ট পরানো সর্বাধিক উপকারী হয়।
- নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ন্যাপি পরিবর্তন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
- ন্যাপি পরিবর্তনের সময় প্রতিবার শিশুর ত্বক হালকা উষ্ণ জলে তুলো বা নরম কাপড় ভিজিয়ে সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
- সারাদিনে অন্তত ৬-৮ বার এবং মলত্যাগের ক্ষেত্রে প্রতিবার ন্যাপি বদল করা একান্ত জরুরী।
- ন্যাপি পরানোর সময় খুব শক্ত বাঁধন যেন না থাকে। এমনভাবে ন্যাপি পরাতে হবে যাতে সহজে বায়ু চলাচল করতে পারে, অর্থাৎ ত্বক আর্দ্র হওয়ার সম্ভাবনা যেন না থাকে।
- প্রতিদিন কিছু সময় অন্তত শিশুকে ন্যাপিহীন থাকতে দিতে হবে। যাতে ত্বক হাওয়ার সংস্পর্শে আসার ও শুষ্ক থাকার সুযোগ পায়।
- ন্যাপি ব্যবহারের আগে প্রতিবার শিশুদের জন্য তৈরি বিশেষ ক্রিম দিয়ে ত্বক মালিশ করে দিতে হবে। যাতে মল, মূত্র এবং ন্যাপিস্থিত প্লাস্টিক বা রাসায়নিক দ্রব্যাদি শিশুর ত্বকের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে না আসতে পারে। এইক্ষেত্রে জিঙ্ক ক্রিম খুবই কার্যকারী ভূমিকা পালন করে।
- ক্রিম না থাকলে ভালো মানের নারকোল তেল দিয়েও মালিশ করে দেওয়া যেতে পারে। এতেও উপকার পাওয়া যায়। র্যাশ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তবে জোরে মালিশ না করাই উচিত। হালকা হাতে মালিশ করে ত্বকের সাথে তেল বা ক্রিম মিশিয়ে একটি স্তর করে দিতে হবে।
- পাউডার বা অ্যান্টি সেপটিক ওয়াইপস শিশুর জন্য ব্যবহার না করাই বাঞ্ছনীয়। শিশুর সংবেদনশীল ত্বকে এগুলো সংক্রমণ বা জ্বালা – চুলকানির সৃষ্টি করে।
- অ্যান্টি ফাঙ্গাল ক্রিম বা Hydrocortisone cream র্যাশে ব্যবহার করলে র্যাশে আরাম পাওয়া যাবে। তবে এই ক্রিম ব্যবহারের আগে শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া একান্ত দরকার।
- স্নানের সময় প্রতিদিন শিশুকে হালকা ধরণের সাবান বা শ্যাম্পু দিয়ে পরিষ্কার করানো দরকার। উগ্র গন্ধযুক্ত এবং অতিরিক্ত ফেনাযুক্ত সাবান-শ্যাম্পু কোনও ভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি সামগ্রীই ব্যবহার করা উচিত।
- ডায়াপার বা ন্যাপি পরানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে তা যেন কোনোমতেই ত্বকের ওপর চেপে না বসে। ন্যাপির মাপ যেন শিশুর শরীর এবং ওজনের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ হয়। ছোট মাপের ন্যাপি জোর করে পরানো ক্ষতিকর হতে পারে। এর ফলেও ত্বকে জ্বালা, চুলকানি সমেত র্যাশ বের হবার সম্ভাবনা থাকে।
- কাপড়ের ন্যাপি ব্যবহার করলে তা অবশ্যই নিয়মিত ভালো করে জীবানুনাশক ওষুধে ধুয়ে পরিষ্কার করে সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
- রাতে ন্যাপি ব্যবহার করলে শিশুকে রাতের খাবারে সাথে অল্প পরিমানে তরল খাওয়ানো উচিত। যাতে ঘুমের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণ মূত্রত্যাগের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। ফলে ঘুমও ভালো হবে এবং ভিজে ন্যাপিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার জন্য র্যাশ হবার সুযোগও কমে যায়।
সাধারণত এই ধরণের র্যাশ ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই সেরে যায়। তবে যদি তা না সারে বা ত্বকে বেশিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে, ত্বক লাল বর্ণ ধারণের সাথে সাথে ফুলে ওঠে বা ফোসকা পড়ে যায়, জ্বর আসে, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
কলমে - আবীর সেনগুপ্ত
চিত্রঃ সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন