তিন কালের আবহমান অতীশ দীপঙ্কর - নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা

 


বই :  নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা – অতীশ দীপংকরের পৃথিবী

লেখক:  সন্মাত্রানন্দ

প্রকাশনী: ধানসিড়ি পাবলিকেশন

প্রকাশকাল:  নভেম্বর, ২০১৭

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ:  সৌজন্য চক্রবর্তী 

পৃষ্ঠা: ৩৬৮ 

বছর দুই আগের কথা। সদ্য আতিমারিতে পৃথিবী আক্রান্ত। বিশ্ব গৃহবন্দী। এক নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আমরা সবাই নাজেহাল। বহির্বিশ্ব সংকুচিত হয়ে ঘরের মধ্যে আটকা পড়েছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে। বাড়ির বাইরে খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে যে ফুস্ফুস ভরে মুক্ত বায়ু টেনে নেব তাও সম্ভব নয়, কারণ মুখ নাক সব মুখোশে বন্দী। এই দমবন্ধ পরিবেশের হাঁপিয়ে ওঠা সময়ে এক পরিচিতের কাছ থেকে প্রথম নাম শুনলাম – সন্মত্রানন্দের লেখা “নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটে” বইয়ের। সাথে বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কেও মুগ্ধকর প্রতিক্রিয়া জানতে পারলাম। কৌতূহলী মন বই যোগাড় করে পড়া শুরু করল।

বই পড়তে শুরু করার কিছু পর থেকে, গ্রীষ্মের দাবদাহে বহুদুর থেকে হেঁটে আসা শ্রান্ত ক্লান্ত পথিকের মাথায় যদি হঠাৎ শ্রাবণের ধারা নেমে আসে তাহলে যে শান্তি ও আরাম অনুভুত হয়, ঠিক সেই এক রকমের শান্তি অনুভব করলাম।ধীরে ধীরে প্রবেশ করলাম এক অজানা স্বর্গীয় জগতে। আশে পাশে যেন সেই পরিবেশের ছোঁয়া পেলাম। এমনই জাদুর লেখনী উপন্যাসের ভাষায়।ইট-কাঠ- কংক্রিটের পৃথিবী যেন মুছে গেল। পরিবর্তে চারপাশে জেগে উঠল প্রাচীনকালের এক স্বর্গীয় পরিবেশ। যেখানে সবুজ গাছপালা, নদী-জঙ্গলে ঘেরা পাখির কলরবে ভরে ওঠা  এক রাজ্য। এই বইয়ের বিশেষত্ব হল এর চরিত্ররা অতীত – বর্তমান – ভবিষ্যৎ এই তিন কালেই সমান্তরালে বহমান। বইয়ের নাম থেকেই বিষয় সম্পর্কে ধারণা করা যায়। অতীশ দীপঙ্করের জীবনকে উপপাদ্য করে গড়ে উঠেছে এক মায়ার জগত।বইয়ের আলাপে ব্যক্ত করা হয়েছে - 

অতীশ দীপংকরের জীবনের উপর রচিত বাংলাভাষার প্রথম প্রামাণ্য উপন্যাস। হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে আজকের পৃথিবীও জড়িয়ে আছে এ উপন্যাসের আখ্যানভাগে।

আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে তুরস্কের ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খিলজি ভারত আক্রমণ করেন। ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার বৃহত্তর থেকে ক্ষুদ্রতর উপাদানসমূহ যেমন – মূর্তি, শাস্ত্র, শিল্প,অসংখ্য মুলবান তথ্য লিপিবদ্ধ করা পুঁথি তাঁর ধর্মান্ধতার রোষানলে পুড়ে ধংস হয়ে যায়। এই ভয়াবহতার মাঝেই সেই সময়েই তিব্বত থেকে আগত পর্যটক – চাগ্ লোচাবা, নালন্দা দর্শনে ও অতীশ দীপঙ্করের জ্ঞানের অনুসন্ধানে আসেন।নালন্দার তৎকালীন অধ্যাপক আর্য শ্রীভদ্র তাকে ফেরালেন না। নালন্দা কাউকে খালি হাতে ফেরায় না - বলে তিনি অতীশ দীপংকর ব্যবহৃত একটি কাষ্ঠপেটিকা তুর্কি আক্রমণ থেকে বাঁচাতে তিব্বতে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাগ লোচাবার হাতে তুলে দেন।যাত্রাপথে বিক্রমণিপুর গ্রামের এক তন্ত্রবিদ্যাপটিয়সী গৃহকর্ত্রী স্বয়ংবিদার সাথে পরিচয় হয় তাঁর। এরপর দুশো বছর পিছিয়ে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ হলো – চন্দ্রগর্ভ, অবধূত, কুন্তলার সাথে৷

রাজপুত্র চন্দ্রগর্ভ জীবনের অর্থ সন্ধান করতে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন মহর্ষি জিতারির সাথে, পরে অবধূত অদ্বয়বজ্র নামে তান্ত্রিকের পাল্লায় পড়ে তন্ত্রচক্রে পড়ে যান৷ রাহুলগুপ্তের শিষ্যত্বে তান্ত্রিক অভিষেক হয়। তার বাল্যসঙ্গী- প্রেমিকা কুন্তলা তাঁকে প্রত্যাখান করেন!

যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস,
নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলীকালীন মেঘ,
পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে,
আর পালতোলা নৌকা ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতধারায়….
সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে-
আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালাঃ
তখন… কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব…..
এ রূপে নয়। এ ভাবে নয়। এখানে আর নয়।”


এই কথা বলে মৃত্যুর নিঃসীম অন্ধকারে ডুব দেন কুন্তলা। হাজার বছর আগে এই কথা বলে যে নারী ডুব দিয়েছিলেন মৃত্যুর গভীরে, গোটা উপন্যাস জুড়ে তাঁর সেই কথার মর্মার্থ অন্বেষণ চলেছে। জীবনে চলার পথ সন্ধানে ব্যর্থ হয়ে, প্রিয়তমা কে হারানোর পর একের পর দুঃস্বপ্ন দেখে রাজপুত্র চন্দ্রগর্ভ বেরিয়ে পড়লেন অনন্তের উদ্দেশ্যে। ওদন্তপুরী মহাবিহারের অধ্যক্ষ আচার্য শীলরক্ষিতের সাক্ষাতে তার জীবনের প্রকৃত পথ সন্ধানে তিনি ব্রতী হোন। এক বৈশাখী তিথিতে চন্দ্রগর্ভকে শ্রামণ্যে দীক্ষিত করেন পণ্ডিত – ভিক্ষু শীলরক্ষিত। শ্রামণ্যের প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণের সাথে সাথে চন্দ্রগর্ভের অবসান হলো, জন্ম নিলো অতীশ দীপংকর চিরজাগ্রত জ্ঞানদীপ যার হৃদয়কন্দরে সতত দেদীপ্যমান!

অপরদিকে বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের অনঙ্গ দাস নামের এক কৃষকের জমি থেকে পাওয়া এক কাঠের বাক্স উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু অধিকার করে বসে। রহস্য আবৃত সেই শ্যাওলা পড়া কাষ্ঠপেটিকার অভ্যন্তরস্থ পুঁথি এবং ধাতব মূর্তির রহস্য সমাধানের দায়িত্ব পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি হয়ে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার গবেষক কলকাতা নিবাসী সম্যক ঘোষের হাতেতিনি সেই দায় ন্যস্ত করেন অমিতায়ুধ এবং শ্রীপর্ণার ওপর।

দশম-একাদশ শতকে বজ্রযোগিনী গ্রাম থেকে নেপাল হয়ে তিব্বতের সুদূর প্রান্তদেশ, ত্রয়োদশ শতকে নালন্দা আর বিক্রমণিপুর, শেষে একবিংশ শতকের বাংলাদেশে এক বিস্মৃতপ্রায় গ্রাম, এইসব স্থান ও কালের বাসিন্দা মানুষেরা, তাদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-হতাশা মিলে মিশে একাকার হয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে এক অপূর্ব গ্রন্থ রচনা হল। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে সমান্তরালের রেখে তিনটি আলাদা যুগে স্থানবিশেষে আলাদা রকম ভাষারীতি প্রয়োগ করে এরকম রচনা সম্ভব, সে কথা একজন সামন্য পাঠক হিসেবে কল্পনা করা দুঃসাধ্যই!তিন যুগের তিন নারীর প্রণয়কথায় , শাশ্বত নারীসত্তার জন্মজন্মান্তরে  চিত্রায়িত এই উপন্যাসবাংলা ভাষায় অতীশ অনুসন্ধানের এক অনন্য ইতিবৃত্ত, এক অসামান্য আলেখ্য, যা বাংলা ভাষার অমুল্য সম্পদ হিসেবে পরবর্তী কালেও ঠাঁই করে নেবে বলে আশা রাখি৷


কলমে - শ্বেতা মিত্র

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন