মাতৃদিবস ও কিছু কথা…

 





মা’ - শব্দটি ছোট হলেও এর পরিধি বিশাল।মা শব্দটি এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। মা যেমন আমাদের গর্ভধারিনী অন্যদিকে মায়া ও মমতার এক চির উৎস। সেইসুদূর অতীতকাল থেকে মা ও সন্তানের সম্পর্ক চিরন্তন ও শাশ্বত। উপনিষদে একটি কথা আছে যেখানে বলা হয়েছিলো “মাতৃ দেব ভব” অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী। সনাতন ধর্মে উল্লেখ আছে স্ববংশবৃদ্ধিকামঃ পুত্রমেকমাসাদ্য..”। আবার সন্তান লাভের পর নারী তাঁর রমণীমূর্তি পরিত্যাগ করে মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা করবেন। তাই মনু সন্তান প্রসবিনী মাকে গৃহলক্ষ্মী সম্মানে অভিহিত করেছেন। তিনি মাতৃগৌরবের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন এভাবে-

উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচায্যাণাং শতং পিতা

সহস্রন্তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে”


অর্থাৎ “দশজন উপাধ্যায় অপেক্ষা একজন আচার্য্যের গৌরব অধিক, একশত আচার্য্যের গৌরব অপেক্ষা পিতার গৌরব অধিকতর; সর্বোপরি, সহস্য পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানার্হ।” মায়ের অবদান সত্যিই পর্বতসম। বছরের মে মাস আমাদের সকলের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। কারণ আগামী ৮ই মে বিশ্ব মাতৃদিবস। ইংরাজীর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার এই দিনটি পালন করা হয়ে থাকে। তবে মায়েদের জন্য এই দিনটি বিশেষভাবে বরাদ্দ থাকলেও সারাটা বছরই তারা আমাদের কাছে শ্রদ্ধেয়, ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু এই মাতৃদিবস এলো কিভাবে? কবে থেকে এর প্রচলন শুরু হলো? সেই প্রসঙ্গেই আমরা জেনে নেবো এই দিনটি উদযাপন করার নেপথ্যের কাহিনীটি।


মাতৃদিবসের প্রচলন নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ রয়েছে। একটি মত অনুযায়ী এটি শুরু হয় প্রথম প্রাচীন গ্রিসে। সেখানে প্রতি বসন্তকালে একটি দিন দেবতাদের মা ‘রিয়া’ যিনি ক্রোনাসের সহধর্মিণী তাঁর উদ্দেশ্য উদযাপন করা হত। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় মাতৃদিবস পালিত হত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। রোমানরা পালন করত ১৫ই মার্চ থেকে ১৮ই মার্চের মধ্যে। তারা দিনটিকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘জুনো’র প্রতি।

মা দিবসের ঐতিহ্যের সাথে শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাস ও জড়িয়ে আছে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে এই দিনটি যুক্তরাজ্যেও উদযাপন করা হতো ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে। ‘মাদারিং সানডে’ পালনের সময় অনেক গৃহকর্তা তাদের বাড়ির চাকরদের ছুটি মঞ্জুর করতেন বেশ আনন্দের সাথেই। অনেক নির্যাতিত শ্রমিকও এ সময় ছুটি পেয়ে মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে দেখা করতো। এ সকল বিষয় তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশেই আলোচিত হতো এবং তা নিয়ে সংবাদপত্রের পাতায় চমৎকার সব মতামত ফিচার ইত্যাদি লেখা হতো। অন্য মতে সর্বপ্রথম ১৯১১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আমেরিকাজুড়ে মায়েদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ‘মাদারিং সানডে’ নামে একটি বিশেষ দিন উদযাপন করা হয়। এরপর আমেরিকার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে মা দিবসটি সর্বজনীন করে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে আসেন মার্কিন সমাজকর্মী পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়ার লেখক গবেষক জুলিয়া ওয়ার্ড হাউয়ি। তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে নারীদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানানোর পাশাপাশি দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রচারণা চালানো ও প্রচুর লেখালেখি করেন। দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে তখন (১৮৭২খ্রিঃ) ব্যাপক লেখালেখি এবং জনমত গঠন করেন তিনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। ১৮৭২ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার নিজের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে জুলিয়া ওয়ার্ড নিজে মাতৃদিবস পালন করেন।

 

অ্যানা জার্ভিস


জুলিয়া ওয়ার্ড হাউয়ি-এর প্রচেষ্টার সাথে শরীক হয়ে কাজ শুরু করেন আরেকজন মা ভক্ত নারী অ্যানা মেরী জার্ভিস যাকে আধুনিক মা দিবসের ধারণার প্রবর্তক বলা হয়। অ্যানা জার্ভিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর ও ওহাইওর মাঝামাঝি ওয়েবস্টার জংশন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর মা অ্যানা মেরি রিভস জার্ভিস সারা জীবন অনাথদের সেবায় জীবন ব্যয় করেছেন। ১৯০৫ সালে ৯ মে মারা যান মেরি। অনাথদের জন্য মেরির এই নিঃস্বার্থ উৎসর্গিত জীবনের কথা অজানাই থেকে যায়। অ্যানা মেরী জার্ভিস-এর জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ওরেব স্টারে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১ মে। সময়টা ছিল সে দেশের জন্য এক ক্রান্তিকাল অর্থাৎ ১৮৬১ খ্রিঃ শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের পরবর্তী সময়। গৃহযুদ্ধে মৃত মায়েদের স্মৃতির উদ্দেশে প্রুনটি টাউনের কোর্ট হাউসে জার্ভিসের মা অ্যানা মেরী ১৮৬৫ খ্রিঃ চালু করেন `Mothers Friend Ship Day’

 

লোকচক্ষুর অগোচরে কাজ করা মেরিকে সম্মান দিতে চাইলেন মেয়ে অ্যানা জার্ভিস ১৯০৭ খ্রিঃ শুরু করেন মা দিবসের প্রচারণা। তাঁর মায়ের মত দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব মাকে স্বীকৃতি দিতে আনা জার্ভিস প্রচার শুরু করেন। সে বছরের ৯ মে মায়ের মৃত্যু বার্ষিকীতে স্থানীয় অ্যান্ড্রুজ মেথডিস্ট চার্চে ছোটখাটো স্মরণসভার আয়োজন করেন। তখন থেকে তিনি দিবসটি নিয়মিত পালন শুরু করেন। ওই চার্চটিই এখন ইন্টারন্যাশনাল মাদার্স ডে শ্রাইন। তবে তখনও ‘মাদার্স ডে’ কোনও সরকারি ছুটি ছিল না। মায়েদের জন্য একটি বিশেষ দিনকে চিহ্নিত করার জন্য প্রচার শুরু করেন অ্যানাসুন্দর ও সার্থকভাবে এই দিবসটি পালনের জন্য তিনি যোগাযোগ করতে লাগলেন সকল পেশার মানুষ বিশেষ করে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের সাথে। তাদের প্রত্যেকের কাছে পৃথক পৃথকভাবে লিখলেন চিঠি, সে সব চিঠিতে থাকতো মা দিবসের বিশেষ বক্তব্য এবং বিস্তারিত আলোচনা। অ্যানা জার্ভিসের মতো পৃথিবীতে যাদের মা বেঁচে নেই তাদের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো বিষয়টি। সমাজে সকল পেশার মানুষ সেদিন সোচ্চার হয়ে দাবি জানিয়েছিলো সরকারের প্রতি। সমাজের নানা প্রকার সংগঠন, সচেতন কৃষক, ব্যবসায়ী, সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা/ কর্মচারী সেদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিল মাকে। শেষ পর্যন্ত উড্রো উইলসন মাদার্স ডে-কে একটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেনতখনও অবশ্য তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের দায়িত্বভার পাননি। ১৯১০ সালে অ্যানা যেখানে থাকতেন সেই পশ্চিম ভার্জিনিয়া স্টেটেই প্রথম সরকারিভাবে এই দিনটি উদযাপিত হয়। ১৯১১-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব স্টেটেই উদযাপিত হয় মাদার্স ডে। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন-ই স্থির করেন যে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মাদার্স ডে হিসেবে উদযাপিত হবে  তাঁর চেষ্টায় ১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় মাতৃদিবস।

এই হলো মাতৃদিবস উদযাপনের ইতিহাস। মায়েদের জন্য বিশেষ এই দিনটিতে মাকে বিশেষভাবে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে দেশে বিদেশে দিনটি বিভিন্নভাবে পালন করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে মায়েদের জন্য গ্রিটিংস কার্ড, শো পিস, জামাকাপড়, অলঙ্কার, ফুল, গিফ্ট কার্ড ইত্যাদি উপহার হিসাবে গণ্য করা হয়। অন্যান্য দেশে মাতৃদিবস উদযাপনের পদ্ধতিটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদারকমভাবে ধরা দেয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র :

এই দেশের মাতৃদিবসকে ঘিরে ইতিহাসের কাহিনী তো আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। ১৮৭০ সালে ইংলিশ কবি জুলিয়া ওয়ার্ড গৃহযুদ্ধকে নিয়ে “Battle Hymn of the Republic” নামে একটি গান লেখেন । সে গানে সুরে সুরে তিনি মাতৃদিবসের কথা বলেন। ১৮৭২ সালে তিনি বছরের একটি দিনকে মা দিবস ঘোষণা করে দিনটিকে অফিসিয়ালি পালন করার জন্য প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে অ্যানা জাভিসের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ ১৯১৪ সালে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মাতৃদিবস হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।

ইংল্যান্ড :

১৬০০ অব্দে ইংল্যান্ড সর্বপ্রথম মাতৃদিবস পালন করার জন্য একটি দিন ঠিক করে যা Mothering day নামে পরিচিত ছিল। ইংল্যান্ডে প্রথা অনুসারে পরিবারের ছেলে মেয়েদের কাজ এবং পড়াশুনার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বছরের একটা দিন তারা পরিবার এবং মায়েদের সাথে দেখা করতে আসে এবং মায়ের পছন্দের ফুলটি উপহার দেয়। মেয়েরা মায়ের জন্য তাঁর পছন্দের কেক বানায়। দিনটি ছিল ইস্টার সানডের ঠিক তিন সপ্তাহ আগে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে এ প্রথাটি বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে USA-এর সাথে মিল রেখে মে মাসেই মা দিবস পালন করা শুরু হয়।

জাপান :

জাপানে এই দিনটি Haha-no-hi নামে পরিচিত। এ দিনটিতে ছেলেমেয়েরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে একটি সুন্দর বার্তার মাধ্যমে মাকে শুভেচ্ছা জানায় এবং মাকে তাঁর পছন্দের ফুল উপহার দেয়। এটি মূলত জাপানের সম্রাজ্ঞী কুজন-এর জন্মদিন পালনের সময়, জাপানী ভাষায় যাকে বলা হয় শওয়া। তবে অনেকেই মনে করেন খ্রিস্টধর্মালম্বীদের অনুসরণে ১৯১৩ সালে এ দিনটি পালন করা শুরু হয়। ১৯৪৯ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দিনটি উদযাপন করা হয়।

জার্মানি :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জার্মানিতে একটি বিশেষ প্রথা চালু ছিল। মায়েদের সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য স্বর্ণ, রৌপ্য ও তামার মেডেল দেয়া হতো। পরবর্তীতে প্রথাটি বাতিল হয়ে যায়। মাকে সুন্দর একটি ফুলের তোড়া ও কার্ড উপহার দিয়ে দিনটি উদযাপন করা হয়।

 ফ্রান্স :

ফ্রান্স ইউরোপের বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যা অনেক কম। নেপোলিয়ন এজন্য মাতৃদিবস পালনের কথা ভাবেন। কিন্তু তখন এটি তেমন করে সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকান প্রথা অনুযায়ী ফ্রান্সে মা দিবস পালনের প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু ফ্রান্সে মা দিবস পালিত হয় মে মাসের শেষ রবিবার যা Fête des Mères নামে পরিচিত। এই দিনটিতে সন্তানরা তাদের মায়েদের জন্য গল্প ও কবিতা লিখে মায়ের জন্য তাদের ভালবাসা প্রকাশ করে।

 


মাতৃ দিবস বা মাদার্স ডে হল এক সম্মান প্রদর্শন জনিত অনুষ্ঠান যা আমরা আমাদের মায়েদের সম্মান দানের জন্য বিশেষতঃ করে থাকি। সারা বিশ্ব-ব্যাপী এই দিবস পালিত হয়। কিন্তু মাকে ভালোবাসার জন্য আলাদা করে বিশেষ কোনও দিনকে পালন করতে হবে, যে এই দিনটাতেই শুধু মাকে ভালোবাসব; তা কিন্তু আমার মনে হয়না। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন থেকে জন্মগ্রহণ করা এবং জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে আমৃত্যু তথা আজীবন আমরা প্রত্যেকে মাকে ভালোবাসি। তাই আলাদা করে মাতৃদিবসের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই আমি মনে করি। আসলে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে প্রত্যেকটা দিনই হল মাতৃদিবস। কারণ মা আমাদের জীবনে যে কি বড় জায়গা জুড়ে থাকে, তা আমাদের সকলেরই জানা। মা মানেই মমতা, নিরাপত্তা, এক অমোঘ নিশ্চয়তা, যেন এক বুক ভরা ভালোবাসা।  তেমনি মায়ের কাছে তাঁর সন্তান হল সবথেকে আদরের। আসলে মাকে ভালোবাসার জন্য বোধহয় কখনই কোনও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ সময়ের প্রয়োজন পড়েনা। কিন্তু মা তাঁর সন্তান-সন্ততিকে কোনো প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে। তাই মা-সন্তানের সম্পর্কই হল পৃথিবীতে সবথেকে মধুর।

 মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে

মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।

তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে

দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতাটি আমরা পড়েছি। মাকে নিয়ে এমন বীরোচিত স্বপ্ন কে না দেখেছে। জম্মের পরে যার সাথে আমাদের সবচেয়ে বেশি মিতালি, সবচেয়ে বেশি আপন মনে হয় তিনি আমাদের মা। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর ম্যারিজ এন্ড মোরালস বইয়ে বলেছেন, “মাতৃত্ব সহজাত প্রবৃত্তি, পিতৃত্ব সহজাত নয়। সেজন্য প্রকৃতির কিছু ব্যতিক্রম বাদে সর্বত্র দেখা যায় সন্তানের জন্য মায়েরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে না। ইংরেজ মনীষী হাওয়ার্ড জনসন সেই কবে বলে গেছেন, “যে গৃহে মা নেই সে গৃহের আকর্ষণ নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে একটি গৃহের সজ্জার আকর্ষণও মা। জন অষ্টিনের মতে, “যে গৃহে মা নেই স্নেহের শীতল হাতের স্পর্শ সে গৃহে নেই। প্রায় সমার্থক এ সকল কথা। কবি ক্রিস্টিনা রসেটির মতে, “যে ঘরে মা আছে সে ঘরে শৃঙ্খলা আছে।  ফরাসী সেনানায়ক বিশ্বখ্যাত নাপোলিয়ঁ বোনাপার্ত বলেছিলেন, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।  মাকে নিয়ে অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে। কবি আল মাহমুদের প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, শামসুর রাহমানের কখনও আমার মাকে’, কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমানের ‘জননী’, সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভ ধারিণী’, পার্ল এস. বাকের ‘মাদার’, ‘গ্রেসিয়া’ ইত্যাদি মাকে নিয়ে অনবদ্য রচনা। মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা’ এমনই এক মর্মস্পর্শী কালজয়ী এক উপন্যাস। এতে প্রধান চরিত্র মায়ের এক ছেলে নকশাল রাজনীতির সক্রিয় সদস্য। পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হওয়া মামলায় তার ক্রমিক নম্বর ১০৮৪। এক পর্যায়ে ছেলেটি মারা গেলে পুলিশি হয়রানির ভয়ে তখন বাড়িতে শোক প্রকাশ বা কান্নাকাটিও নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু মা পারেননি চুপ থাকতে। ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসের কথাও আমরা জানি। অনেক গান আছে মাকে নিয়ে মাকে নিয়ে নির্মলা মিশ্রের গাওয়া সেই গান-

 ও তোতা পাখিরে

শিকল কেটে উড়িয়ে দেবো আমার মাকে যদি এনে দাও

আমার মাকে যদি এনে দাও

 

কিংবা অখিল বন্ধু ঘোষের কন্ঠে যখন শুনি-

 মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে

মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে

 

তখন সত্যি মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। কিংবা শ্যামল মিত্রের কন্ঠে-

 মা গো তুমি এমন করে ডেকোনা আমায়

তোমার চোখের জলে পথ যে আমার পিছল হয়ে যায়।

 

বিখ্যাত সেই নজরুল সংগীতের কথা সবাই জানেন-

ওমা তোর ভুবনে জ্বলে এতো আলো

আমি কেন অন্ধ হয়ে দেখি শুধুই কালো


মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে এই গান মনে হয় অনবদ্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে সেই অমর গান-

 

পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা বুকে তব মাগো বল কবে শীতল হব

কত দূর আর কত দূর।

 

অথবা

 

মাগো ভাবনা কেনো, আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে

তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি

তোমার ভয় নাই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।

 

গানগুলিতে মায়ের কথাই উঠে আসে নানা ভাবে, নানা রূপে, নানা ভঙ্গিমায়।

 তা সত্ত্বেও, আমরা কি কখনও জানতে বা বুঝতে চেয়েছি কি যে আমাদের মায়েরা ঠিক কিসে কিসে খুশী হয়? বিশ্বাস করুন একদম ডিমান্ড থাকেনা মায়েদের। তাঁরা সবথেকে বেশী খুশী হয় সন্তানের মঙ্গল কামনায়, খুশীতে, সন্তানের আনন্দে---তাঁর সাফল্যে। আমরা যদি কোনও কারণে দুঃখ পাই, মায়েরা আমাদের থেকেও বেশী সেই ব্যাপারে দুঃখ পায়। আমাদের শরীর খারাপ হলে আমাদের মায়েরা নিদ্রাহীন অবস্থায় থেকে সেবা যত্ন করে আমাদের সুস্থ করার চিন্তায় দিন অতিবাহিত করে। কোথাও না কোথাও মায়েদের সমস্ত সুখ, দুঃখ-আনন্দ সবকিছুই গড়ে ওঠে তাঁর সন্তানকে কেন্দ্র করে। আমার জীবনে আমার মায়ের স্থান যে কি গুরুত্বপূর্ণ আমার পক্ষে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

আজ সময় বদলেছে। বদলেছে আমাদের রুচি ও মননশীলতার। আজ আধুনিকতায় স্পর্শ লেগেছে সবকিছুতে। মাতৃদিবস আজ পালিত হয় অনেক জায়গায় অনেক ঘটা করে। ছবি তুলে দেদার সোস্যাল নেটওয়ার্ক সাইসেটেও অন্যদের দেখানো হয়। তবে মাতৃদিবস পালনের তাৎপর্য এই ক্ষুদ্রগণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ না। মাতৃদিবস মায়ের সম্মানার্থে এক সম্মানজনক অনুষ্ঠান। আশা রাখি মায়েদের প্রাত্যাহিক জীবনের কর্মব্যস্ততার মধ্যে তাঁদের শখ আহ্লাদগুলি যেন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকে। তবেই মাতৃদিবসের সার্থকতা। মা মানেই যে শুধুমাত্র আত্মত্যাগ নয়, নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছা পছন্দ অপছন্দ নিয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা একজন মানুষ সেটি যেন আমাদের সকলের বোধগম্য হয়। স্বামী সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করা আমার মা, আপনার মা, ঘরে ঘরে মায়েরা যেন সকলে দীর্ঘজীবী হোন এই কামনাই করি। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে মা যে জায়গা নিয়ে আছেন তা উপলব্ধি করাই যেন মাতৃদিবস পালনের এক গভীর তাৎপর্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আমরাও যেন বলতে পারি, 

 মায়ের প্রাণে তোমারি লাগি

জগত মাতা রয়েছে জাগি”।

 

বিশ্ব মা দিবসে আজ স্মরণ করছি সেই সব মায়েদের যারা ঘুমিয়ে আছেন দৃষ্টির আড়ালে। জীবিত এবং মৃত সব মায়ের প্রতিই আমাদের শ্রদ্ধা। মা দিবসের এই মুহূর্তে শুনি কে যেনো দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে তার সন্তানকে আয় সোনা, আমার কোলে আয়।


কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

 চিত্রঃ সংগৃহীত

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন