আজ্ঞে না,
সিরিয়া, চিন বা বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে না এখানে। এমন কল্পনাতীত
ঘটনা খোদ আমাদের ভারতেই ঘটেছে। এতো নৃশংস অথচ কেন যেন খুবই অল্প আলোচিত,
উপেক্ষিতও। ঘটনার স্থান? ‘ভুস্বর্গ’ কাশ্মীর। কাল?
নব্বইয়ের দশক। পাত্র- কাশ্মিরী হিন্দু পন্ডিত জনগোষ্ঠী। এই
কাহিনী তাদেরই বাসভুমি থেকে বিতাড়ন ও গণহত্যা নিয়ে। বত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই
মর্মান্তিক ঘটনাকেই নিজের ক্যামেরায় বন্দি
করার চেষ্টা করেছেন পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী।
প্লট আবর্তিত হয় মুলত
প্রথমে পুষ্করনাথ পন্ডিত ও পরে তাঁর নাতি কৃষ্ণ পন্ডিতকে ঘিরে। গল্পের কেন্দ্রবিন্দু
প্রবীণ পুষ্করনাথ (অনুপম খের)। তাঁর পরিবারের সকলেই খুন হন। একমাত্র ছোট নাতি
কৃষ্ণ(দর্শন) বেঁচে থাকে। পুষ্করকে আশ্রয় নিতে হয় উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। ৩২ বছর পর
দাদুর চিতাভস্ম শ্রীনগরের পরিত্যক্ত বাড়িতে পৌঁছতে তার সঙ্গে আসে দাদুর চার বন্ধু
- প্রাক্তন আই.এ.এস. অফিসার ব্রহ্ম দত্ত(মিঠুন চক্রবর্তী), অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ
কর্তা হরি নারায়ন(পুণীত ইসার), সাংবাদিক বিষ্ণু রাম(অতুল শ্রীবাস্তব) ও ডাক্তার
মহেশ কুমার(প্রকাশ বেলাওয়াড়ি)। কৃষ্ণের সঙ্গে এঁদের কথোপকথনের মধ্য দিয়েই অতীত ও
বর্তমান উঠে আসে। দেখানো হয়েছে রক্তপিপাসু
জঙ্গিরা কিভাবে হিন্দু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের খুঁজে বের করে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
গোটা পরিবারকে শেষ করে দেয়। মেয়ে বউদের গণধর্ষণের পর করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে
দেয় শরীর। রেয়াত করে না শিশুদেরও। সিনেমার প্রথম ভাগে পুষ্করনাথ পন্ডিত ও তাঁর
পরিবার ও তাদের উপর নির্মম অত্যাচারের উপাখ্যান বলে তুলে ধরে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের
হৃদয়ের দগদগে ঘা। দ্বিতীয় ভাগ বোঝায় যা হয়ে গিয়েছে,
তা অতীত হলেও আজও প্রাসঙ্গিক। আজও খোঁচালে সেই ঘা থেকে
চুঁইয়ে পড়ে বঞ্চণার শোণিত স্রোত। কাশ্মিরী পণ্ডিতদের বর্তমান প্রজন্মও ভিটে
হারালে কেনও আজও ভুলতে পারেনি সেই যন্ত্রণার দিনগুলো।
কাশ্মীরী পুলিশের ফাইল
থেকে যতটুকু জানা যায়, শিক্ষাবিদ সর্বানন্দ কাউল প্রেমী যেখানে তিলক পরতেন কপালের
ঠিক সেই অংশে পেরেক ঠুকে হত্যা করা হয়েছিল। জেহাদিদের বন্দুকের মুখে খুন হওয়া স্বামী
বিকে গাঞ্জোর রক্তে ভাত মেখে খেতে হয়েছিল স্ত্রীকে। সরলা ভাটকে গনধর্ষনের পর উলঙ্গ
দেহ পড়েছিল রাস্তায়। মাট্টানের রবীন্দর পন্ডিতকে খুন করে তাঁর দেহের উপর নেচেছিল জেহাদীরা।
সোপিয়ানে ব্রিজলাল ও ছোটি’র দেহ জীপে বেঁধে প্রকাশ্য রাস্তায় টানা হয়েছিল। বন্দীপুরার
স্কুলশিক্ষিকা গিরিজা টিক্কু মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত গণধর্ষিতা হয়েছিলেন। এমন
লাখ লাখ ঘটনার অংশবিশেষ উঠে এসেছে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এ।
“এটা
দেশত্যাগ নয়, গণহত্যা”, “ভাঙা মন কথা বলে না, কিন্তু, তাদের কথা শুনতে হয়” “ধর্মান্তরিত হও, দেশ ছাড়ো নইলে মর” এরকম একাধিক ডায়লগ ধাক্কা দেয়। কাশ্মীরি পণ্ডিত
হত্যাকারীদের মূল মাথা বিট্টার কোনও আত্মগ্লানিহীন স্বীকারোক্তি যেকারও রক্ত গরম
করতে যথেষ্ট। কাশ্মীর ফাইলস-এ বিট্টার (চিন্ময় মন্দলেকর) একটি সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছে যাতে সে বলে যে তাকে হত্যার
নির্দেশ দেওয়া হত। তার মাকে হত্যা করতে বললেও তা করতে সে দ্বিধা করত না। গলার কাছে দলা পাকায় কান্না, গা গুলিয়ে ওঠে, হিন্দু পণ্ডিতকে জোর করে রক্ত মাখা ভাত গেলানোর দৃশ্যে।
যোগ্য সঙ্গত করেছে রোহিত শর্মার সুর-আবহ এবং স্বপ্নিল বান্দোড়করের
নিঃসঙ্গতার শব্দ।
ছবিতে দেখানোও হল অস্ত্র-শস্ত্র
নিয়ে জেহাদিদের হিংস্র স্লোগান “কাশ্মীরকে
আমাদের পাকিস্তান বানাতে হবে হিন্দু স্ত্রীদের সাথে, তাঁদের স্বামীদের ছাড়া”। বাড়ি, ঘর জ্বালিয়ে, পুলিশ সেনাদের পোশাক পরে নাদিমার্গে ২৪ জন কাশ্মীরি
পণ্ডিতকে জবাই করেছে তথাকথিত জেহাদিরা। বিবেক অত্যন্ত সাহসের সঙ্গেই ঘটনাগুলোর
হিংস্রতা ও ভয়াবহ মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় তুলে ধরেছেন। বিরতির ঠিক আগে গাছে গাছে পণ্ডিতদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখার
মতো নৃশংস দৃশ্য দেখলে কষ্ট হয়, দুঃখ হয়, বিরক্ত লাগে, রাগ হয়।
সিনেমায় দুটি ভিন্ন
সময়ের গল্প তুলে ধরা হয়েছে, একটি হল বর্তমান সময় আরেকটি ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে
নব্বইয়ের দশক। তা সত্ত্বেও, দুটি টাইমলাইনই সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে ও একে অপরের পরিপুরক
হিসেবে চিত্রিত হয়েছে, যার ফলে সিনেমার মুল স্টোরিলাইন বুঝতে দর্শকের সমস্যা হয়না।
তবে গল্পের বিষয়বস্তু ও পর্দায় সেটির চিত্রায়ণ অন্যান্য সমস্ত টেকনিক্যাল
ত্রুটিগুলিকে ঢেঁকে দেয়। সিনেমার ঘটনাপ্রবাহ দর্শকের সামনে যে রূপে উঠে আসে,
তাতে অন্যান্য কারিগরিগত খামতিগুলি নিতান্তই গৌণ হয়ে পরে।
সিনেমার স্ক্রিনপ্লে আরও আঁটোসাটো হলে স্টোরিটেলিং পোক্ত হতে পারতো। দুটি ভিন্ন
সময়ধারার মধ্যে অহরহ বদল আসার ফলে দর্শকদের কাছে কিছুটা ক্লান্তিকর মনে হতে পারে,
এতে সিনেমার বিষয়বস্তুর সাথে জড়িত আবেগ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। সিনেমার দৈর্ঘ্য প্রায় তিন ঘন্টা, ভুস্বর্গের নরকে পরিণত হওয়াটা যদি আরও কম সময়ের মধ্যে
উপযুক্ত স্টোরিটেলিং এর মাধ্যমে বাঁধা যেত, তাহলে মন্দ হতো না। বর্তমানে কেমন আছেন কাশ্মিরী পন্ডিতরা,
এই বিষয়ে একটু আলোকপাতেরও অভাব মনে হয়েছে ছবিতে। তবে যাই
হোক, টেকনিক্যালিটির
উর্ধে এই ছবিটি এক সামাজিক দলিল, অনেক না-বলা-কথার এক জলজ্যান্ত প্রমাণস্বরূপ হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা সমব্যাথী দর্শকের বিবেক ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। তার সাথে এই
ছবি দর্শকের সামনে যেন একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “যতদিনে আমরা জাগব, ততদিনে দেরি হয়ে যাবে না তো?”
বস্তুত,
কাশ্মিরী পন্ডিত গণহত্যা সংক্রান্ত সঠিক তথ্য-উপাত্ত সাধারণ
জনগণের আয়ত্তের বাইরে। তা সত্ত্বেও সিনেমার নির্মানে প্রয়োজনীয় গবেষণায়
পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর অধ্যবসায় সত্যি প্রশংশার যোগ্য। যে ভয়াবহ পরিস্থিতি
তৈরি হয়েছিল, এই ছবি তারই গল্প বলে। বাস্তবের নিষ্ঠুরতার অভিঘাত কাঁপিয়ে দেয় অন্তরাত্মায়।
সবই ঠিক এমনই ছিল সেদিন, এই তথ্যটি স্বস্তি দেয় না দর্শকদের। কাশ্মীর,
যা কিনা নিজের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত,
তাকে উপভোগ করার কোন অবকাশ রাখেননি পরিচালক,
বরং সৌন্দর্যের পেছনে বহুকাল লুকিয়ে থাকা ঘৃণা ও নৃশংসতার
বাস্তবতাকে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। ছবির পরতে পরতে রয়েছে হিংস্রতার বাস্তব প্রতিচ্ছবি,
যা দর্শককে ধাক্কা দেয়, ভাবায়। বিবেকের চিত্রনাট্য শুধু স্বাধীন কাশ্মীর পাবার
হিংস্র আন্দোলন দেখায়নি, দেখিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মানবতাবাদী গোষ্ঠী, নরম ও চরমপন্থীদের সুবিধাবাদী কাজকর্মও। সুবিধা ভোগ করার
জন্য ‘আজাদি আন্দোলন’ জিইয়ে রাখার বিষয়টিও বাদ যায়নি। একটাই অস্বস্তি,
অতীতের ঘটনা যেভাবে দেখানো হয়, বর্তমানেও দৃশ্যের অন্তত লোকেশনের তেমন পরিবর্তন ক্যামেরায়
উঠে আসে না। ভিজ্যুয়ালের জোর নাটকীয়তায়, ঘটনার তীব্রতায়। আসলে এই ছবি স্পষ্ট করেই বলে দেয়,
বাণিজ্যিক ছকের বাইরে সিনেমার অন্য একটা সামাজিক ভূমিকা আছে,
থাকে, থাকা উচিত। বিবেক বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েই বানিয়েছেন এই
সামাজিক দলিল, যেটি শুরুর আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ “ছবির চরিত্র ও ঘটনা সব কাল্পনিক,
বাস্তবের সঙ্গে মিল থাকলে সেটা কাকতালীয়” এমন কার্ডটি
দেখানো হয়নি।
কলমে - কমলেন্দু সূত্রধর
চিত্রঃ সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন