বই-ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণ
লেখক – সৈকত মুখোপাধ্যায়
প্রকাশন-পত্রভারতী
প্রকাশকাল-জানুয়ারী, ২০১৮
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ-প্রদীপ্ত মুখার্জি
পৃষ্ঠা - ১৬২
ইদানিং কালে অলৌকিক, ভৌতিক, তন্ত্র- মন্ত্র, রহস্য-
রোমাঞ্চ - অ্যাডভেঞ্চার সম্পর্কিত বই ভিড় করে প্রকাশিত হচ্ছে। যে কোনও সামাজিক মাধ্যমে
চোখ রাখলে এই বিষয়ে রোজ পাঁজা পাঁজা বইয়ের প্রকাশ, প্রী- বুকিং থেকে শুরু করে পাঠ প্রতিক্রিয়া অবধি খবরে শুধু চোখ
বুলিয়েই চোখ ক্লান্ত হয়ে যায়। বইগুলোর বর্ণনার বিশেষত্ব মোটের উপর সব এক। অসাধারণ-গায়ে
কাঁটা দেওয়া – শিহরণ জাগানো – দম আটকে দেওয়া প্রভৃতি শব্দ বন্ধের সাথে যুক্ত হয় এটিই
বাংলা সাহিত্যে অমুক বিষয়ের উপর লিখিত প্রথম বই।
অতঃপর যখন বইটি পড়তে শুরু করি তখন দেখি সেই-ই-ই
এক গতে বাধা গায়ে চিমটি কেটে ব্যাথা ধরিয়ে জোর করে বিকৃত সমস্ত ঘটনার প্রবাহ গেলানোর
পুনঃ প্রচেষ্টা। আরও বিরক্তিকর হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গল্পের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে
লেখক পথভ্রষ্ট হন। কি লিখতে শুরু করেছিলেন সেটা ভুলে গিয়ে কোনোক্রমে তড়িঘড়ি গল্পের
ভূতকে পাঠকের কাঁধে চাপিয়ে নিস্তার পান।
অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল এই বইগুলোর পাঠ প্রতিক্রিয়া সামাজিক মাধ্যমের পৃষ্ঠা অসাধারনত্বের ব্যাখ্যায় ভরে ওঠে।জানিনা পাঠকের রুচি নিম্নগামী নাকি বাতাসে ভেসে আসা নিন্দুকদের কথাই সত্যি- যে এই সমস্তই লেখকের ধামাধারীদের কার্যকলাপ।এই ধরণের অস্বস্তিকর পরিবেশে ও সাহিত্যের ন্যাক্কারজনক আবহে কিন্তু দু’ একটি ভালো গল্পও লেখা হয়। দুঃখ একটাই যে তারা অনেক সময়েই খারাপের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। তবু সেই রকমই একটি দুটি বই ভাগ্যক্রমে হাতে চলে আসে।
বছর খানেক আগে এইভাবেই হঠাৎ সৈকত মুখোপাধ্যায়ের
লেখা “মৃত্যুর নিপুণ শিল্প” বইটি হাতে আসে। পড়তে পড়তে অন্যান্য বইয়ের মত ঘুমে ঢুলে
না পড়ে বরং রাত জেগে পড়তে শুরু করি এবং ভোরের দিকে তা শেষ করি। অনেক দিন পরে খুব মন
দিয়ে মনে রাখার মত একটি বই পড়তে পাই। তাই তারপরে সৈকত মুখোপাধ্যায়ের লেখা অন্য গল্পের
খোঁজ নিতে থাকি। অবশেষে কিছুদিন আগে ওনার লেখা আরেকটি বই “ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণ” পড়ার
সুযোগ পাই।ছোট ছোট বারোটি গল্পের সংকলন। ডার্ক ফ্যান্টাসি গোত্রের গল্প। শুধু এই টুকু
বলাই যথেষ্ট নয়। আবার এর থেকে বেশী কিছু বলে স্পয়লারও দেব না আমি।
• বাচ্চুমামার বাড়ি
• ছাদের বাগান
• গুহাচিত্র
• জলকষ্ট
• কলঙ্কভাগী
• মড়া ফুলের মধু
• পাশা
• সূর্যাস্তের ছবি
• হাতকাটা মেয়ের হারমোনিয়াম
• তুলোবীজ
এর মধ্যে কয়েকটি গল্প নিয়ে
অবশ্যই বলা দরকার। যারা এই বিষয়ের বই পড়েন বা পছন্দ করেন পড়তে তাঁদের জন্য অত্যন্ত
উপযোগী একটি বই। প্রত্যেকটি গল্প একটি পৃথক বিষয় নিয়ে লেখা। বিজ্ঞানের সাথে বর্তমান বা
অতীতের মেলবন্ধন, অথবা অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের
সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপটের যোগসূত্র ঘটিয়ে পরতে পরতে সত্যিই শিহরণ জাগিয়েছেন লেখক। প্রত্যেকটি
গল্পই প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্কদের জন্য লেখা। ঠিক ভৌতিক নয় অতীন্দ্রিয় অলৌকিক গল্পের
সমাহার। এই সব গল্প অন্ধকারের গল্প, অন্ধকারের এক একটি ভিন্ন রূপের উন্মোচন ঘটেছে গল্পের
বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে। এক একজন পাঠক নিজস্ব দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করে এর রস আস্বাদন
করতে সক্ষম হবেন, তবে আর যাই হোক ছেড়ে বাদ দিতে পারবেন না কোনও মতেই। অন্ধকার মানব
চরিত্রের এক অচ্ছেদ্য দিক। যতই নিজেকে আমরা সাদা কালোর জগতে বিচরণ করাতে চাইনা কেন,
ধূসরতা আমাদের পিছু ছাড়ে না। তাই আমরা সামাজিক কাহিনীর পরিবর্তে অপরাধ জগত নিয়ে লিখিত
বীভৎস রসের গল্প শুনতে বেশী পছন্দ করি।আমরা যতই শিক্ষার মোড়কে আদিম
রিপুকে দমন করে নিজেদের সভ্য ভদ্র রূপে প্রকাশ করতে চাইনা কেন, বিভিন্ন একান্ত মুহূর্তে কি আমাদের অন্ধকারের হাতছানি থাকে না? মনে কি বাসনা জাগে না কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত স্বাদ
গ্রহণের? ঠিক তেমনি মানবমনের বিভিন্ন অন্ধকার কামনা বাসনা লোভ লালসাকে
একত্রিত করে বারোটি গল্পে পেশ করেছেন লেখক ডার্ক ফ্যান্টাসি বা
নষ্টগদ্যের ধারার মাধ্যমে।
ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণঃ প্রথম গল্প
‘ঈশ্বরের
নষ্ট ভ্রূণ’ গল্পটি ‘গোয়েন্দা রহস্য’ পত্রিকায় ছদ্মনামে ছাপা হয়েছিল। ছদ্মনাম
ছিল অঞ্জনা মুখোপাধ্যায়। গল্পটি প্রকাশের পর পাঠক মনে ঝড় উঠেছিল এত অন্ধকার, এত ম্যাকব্রে লেখা কি
বাংলায় আদৌ লেখা সম্ভব?অনেকেই
সত্য ঘটনার আদল খুঁজেছিলেন।অসাধারণ ভাবে লেখক এই গল্পে জটাজালে জড়িয়েছেন আবার নিজেই
তা উন্মুক্ত করেছেন।
বাচ্চুমামার বাড়িঃ অন্ধকারতম গল্প। মফঃস্বলের একজন বৈজ্ঞানিকের
খেয়াল,তাঁর অবচেতনে
থাকা যৌনতা, হারানোকে ফিরে পাওয়ার
বাসনা এবং আবিষ্কারের ফ্রাংকেন্সটাইন হয়ে ওঠা।
ছাদের বাগানঃ একজনের আত্মহত্যায় ইন্ধন জোগাতে থাকার কাহিনী।পরকীয়া সম্পর্ক, অসহায়ের দুর্বলতার
সুযোগ নিয়ে তাঁকে ব্যবহার করা, হত্যার পরিকল্পনা। অতঃপর গাছেদের সাথে সখ্যতা কি মনের
অন্ধকার দূর করে? অসম্ভব এক জটিল ঘূর্ণি। পাঠক শেষ মুহূর্তে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেও ভুলে
যান। সঠিক বেঠিক তাল হারায় ভুঁইচাপার গন্ধে।
গুহাচিত্রঃ বর্তমান যুগের জটিল দাম্পত্যের
জালে জড়িয়ে নিজেদের থেকে শারীরিক মানসিকভাবে বহুদূরে সরে গিয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত এক
দম্পতি এঁকে চলে গুহাচিত্র।জীবন মৃত্যুর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে বাঁচার এক অদম্য চেষ্টায়
হাতে তুলে নেয় রং পেন্সিল। জীবন কি সাড়া দেবে ? নতুন প্রাণ কি সঞ্চার হবে?
পাশাঃ সিনেমায়
প্রপ সাপ্লাই দেওয়ার ব্যাবসায়ীর কাছে একটি বিশেষ ধরণের পাশার অর্ডার আসে। সেটি যোগাড়
করার পর পাশার বিষয়ে জানতে পেরে ব্যবসায়ী হতবুদ্ধি হয়ে যায়। এক ছিল শকুনির পাশা। আরেক
এইটি। এর বৈশিষ্ট্য জানতে পারলে গা গুলিয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।
তুলবীজঃ সদ্য যুবকের মাথার চুল পড়ে গিয়ে মাথা জোড়া টাকের লজ্জা থেকে মুক্তির উপায়
স্বরূপ হাতে পায় এক আজব ওষুধ। যাতে মাথায় ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল তৈরি হয়। কিন্তু চুলগুলো
নড়াচড়া করে কেন? গা ঘিনঘিনে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের সারা শরীরে। সরীসৃপের পদক্ষেপ
যেন শরীর জুড়ে।
বাকি গল্পগুলো নাহয় না বলাই
থাক।পাঠক এই সমস্ত গল্প অনুভব করতে পারবেন। বর্তমান সামাজিক সমস্যার বিভিন্ন বিষয়কে
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রচনা করে লেখক পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেন কি করা উচিত, কি করা
উচিত নয়, কোনটা করলে ঠিক হত, কোনটা ভুল ছিল।
প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা নজরকাড়া ও
আকর্ষণীয় হলেও, গল্পগুলো পড়ার পর মনে হল আরেকটু অন্য রকম ছোঁয়া দিলে ভালো লাগত। আরেকটু
অন্ধকারের ব্যবহার থাকলে যেন যথোপযুক্ত হত। তাও লাল ও কালোর যুগ্ম মিশেল অন্য মাত্রা
যোগ করেছে। তবে প্রতিটি গল্পের পৃথক অলংকরণ পৃথকভাবে নজর কাড়ে।কিছু ছবি সত্যিই গাঁয়ে কাঁটা
দেয়।বইয়ে একটা ছোট্ট বিষয় যোগ করা হলে তা আরও আকর্ষণীয় হত। প্রতিটি গল্প কবে কোথায় একক গল্পরূপে প্রকাশিত হয়েছিল তা যদি স্বল্প বাক্যে উল্লেখ করা থাকত তাহলে আরও ভালো হত।তবে সব মিলিয়ে সত্যিই শিহরণ জাগানো বিকৃত বীভৎস
রসের একটি বই।
কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন