শিশুর জন্য ফলের রসের উপযোগিতা

  


 

জন্মক্ষণ থেকে শুরু করে ছয়মাস বয়স অবধি শিশুর আহারে শুধুমাত্র স্তনদুগ্ধ পান করানো বাধ্যতামূলক হওয়ায় শিশুর বাবা – মায়েদের মনে শঙ্কা শিশুর পুষ্টির বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। তাই শিশুর বয়েস ছয়মাস পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তাকে ফলের রস খাওয়ানো শুরু করে দেন অনেক বাবা- মায়েরাই। বহু যুগ ধরেই ফলের রসকে স্বাস্থ্যকর মনে করে এসেছি আমরা। শিশু চিকিৎসকরা কিন্তু বলছেন, এক বছরের আগে ফলের রস খাওয়ানোর কোনও প্রয়োজনই নেই। ফলের রস থেকে কোনও পুষ্টিই শিশুরা পায় না।


শিশু চিকিৎসকদের মতে, মাতৃদুগ্ধ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক খাবারই একবছরের নীচে শিশুদের পুষ্টির জন্য যথেষ্ট। ছয়মাসের শিশু যেহেতু ফল কামড়ে চিবিয়ে খেতে সক্ষম হয় না তাই ফলের রস বের করে ছেঁকে তাকে খাওয়ানো হয়। অনেকসময় কিছু ফল যেমন আপেল প্রভৃতি সেদ্ধ করেও খাওয়ানো হয়। এইভাবে খাওয়ালে ফলে উপস্থিত ডায়েটারি ফাইবার ও পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। এতে শিশু পুষ্টি তো পায়ই না, বরং ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়


আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসের গবেষক মেলভিন হেম্যান বলেন, “বাবা-মায়েরা মনে করেন ফলের রস খুবই পুষ্টিকর। কিন্তু ফলের রস কখনই টাটকা ফলের বিকল্প হতে পারে না। আবার বাচ্চার মুখের স্বাদের জন্য অনেক মায়েরা এর মধ্যে চিনিও মেশান। ফলে অযথা শর্করাযুক্ত ক্যালোরি যোগ হয়। একবছরের নীচের বাচ্চাদের জন্য তা অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকারকও। একবছর বয়সের পর ফলের রস দেওয়া গেলেও তা বেশি পরিমাণে খেলে পুষ্টির বদলে ক্যালোরিই পৌঁছবে শরীরে, সেই সঙ্গেই দাঁতের ক্ষয়ও হতে পারে


২০০১ সালে এই বিষয়ে প্রথম একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস। এই রিপোর্টে বলা হয়েছিল ছয়মাসের নীচে শিশুদের ফলের রস খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। তবে নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে - এক বছর বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ ও অন্যান্য স্বাভাবিক খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে যাবে শিশুরা। এক বছর বয়সের পর থেকে সুষম খাদ্যের সাথে ফলের রস খাওয়ানো যেতে পারে। তবে তা যেন ১০০ শতাংশ টাটকা ফলের হয় এবং মাত্রা সীমিত থাকে। ১-৩ বছর বয়স পর্যন্ত ৪ আউন্স (১১৩.৩ গ্রাম) ফলের রসই যথেষ্ট।


শিশুদের বোতল বা টাম্বলার কাপে ভরে ফলের রস দেওয়া উচিত নয়। এভাবে তারা সারা দিন ধরে ফলের রস খেতে থাকে। ফলের মধ্যে থাকা কার্বোহাইড্রেট থেকে দাঁতের ক্ষয় হতে পারে। বিশেষ করে শোওয়ার সময় কখনই শিশুকে ফলের রস দিয়ে ঘুম পাড়ানো উচিত নয়। দাঁত ওঠার পর থেকেই শিশুদের গোটা ফল খেতে শেখান। এতে ফলের সম্পূর্ণ পুষ্টি ও ডায়েটারি ফাইবার ওদের শরীরে পৌঁছবে। অতিরিক্ত ওজনও বাড়বে না।




বাচ্চাদের ফলের রস দেওয়ার সময় যে বিষয়গুলি মনে রাখতে হবে -

  • রস দেওয়ার জন্য বোতলের বদলে বাটি / কাপ ও চামচ ব্যবহার করতে হবেঅল্প অল্প পরিমানে খাওয়ানো শুরু করতে হবে।
  • ফলের রস হজমের সুবিধার জন্য প্রথমে ফলের রসের সাথে হালকা উষ্ণ জল মিশিয়ে পান করাতে হবে। কারণ প্রাথমিকভাবে শিশু ফলের রস হজমে সক্ষম কিনা তা জানা দরকার। তাই শুরুতে ৪ ভাগের ১ ভাগ রস ও ৩ ভাগ জল মিশিয়ে নিতে হবে। ধীরে ধীরে হজমক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে জলের পরিমাণ কমিয়ে ফলের রসের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
  • প্রথমে একটি একক ফল বা সবজির রস দিয়ে শুরু করতে হবে যাতে শিশুর অভ্যস্ত হয়ে যায়। ৫ দিন অন্তর ফল বা সব্জি বদল করে রস পান করানো উচিত। 
  • রস পান করানোর পর শিশুকে পর্যবেক্ষণ করা দরকার কোনও অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা। যদি এই জাতীয় কোনও অ্যালার্জি লক্ষ্য করা যায় তবে অবিলম্বে রস পান বন্ধ করতে হবে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে
  • ফলের রস খাওয়ানো শুরু করার পর অনেক শিশুরই সর্দি, কাশি, বমি, আমাশয়, শরীরে লাল র‍্যাশ প্রভৃতি অ্যালার্জি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই লক্ষ্য রাখা দরকার কোন ফল বা সব্জি থেকে এই অ্যালার্জি হচ্ছে। তা পরবর্তীকালে পুনরায় না দেওয়াই ভালো। 
  • সবসময় ফল / শাকসব্জি ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। রস বানানোর অন্তত ৩০ মিনিট আগে হালকা উষ্ণ জলে এক চিমটে নুন দিয়ে ফল বা সব্জি ভিজিয়ে রেখে তারপর তা ব্যবহার করা উচিত। এতে এর মধ্যে থাকা বিষাক্ত কীটপতঙ্গ বা কীটনাশকের প্রভাব নষ্ট হয়ে যায়।
  • সাধারণ স্থানীয় খাবার যেমন মুসাম্বি, কমলালেবু, কলা, আপেল, নাশপাতি, গাজর প্রভৃতি দিয়ে শুরু করতে হবে।
  • বাজারজাত ফলের রস শিশুকে না দেওয়াই উচিত। যথাসম্ভব ঘরোয়াভাবে তৈরি রসই শিশুকে খাওয়ানো উচিত।
  • জল বা শক্ত খাবারের বিকল্প হিসাবে ফলের রসের ব্যবহার করা উচিত হবে নাফলের রস দিনে একবার দেওয়াই যথেষ্ট।
  • একবছরের পর থেকে শিশুকে ফলের রসের পরিবর্তে ছোট ছোট ফলের টুকরো চিবিয়ে খাওয়ানো শেখানো দরকার। এইভাবে খেলে ফলের পুষ্টিগুণ শিশুর শরীরে গৃহীত হবে।
  • ৮ মাসের পর থেকে একাধিক ফলের সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকারের সব্জিও সেদ্ধ করে খাওয়ানো যাবে। তবে প্রথমে স্বল্প পরিমানে শুরু করতে হবে। 


বাচ্চাদের জন্য স্বাস্থ্যকর রসের একটি তালিকা:

  • আপেল সেদ্ধ
  • নরম কচি নারকোএবং নারকোলের জল
  • আঙুরের রস (কাঁচা)
  • তরমুজের রস (কাঁচা)
  • সিদ্ধ গাজরের রস
  • কমলালেবুর রস (কাঁচা)
  • সিদ্ধ টমেটোর রস
  • সবেদার রস (কাঁচা)
  • সিদ্ধ নাশপাতির রস
  • সিদ্ধ পিচের রস
  • পাকা পেঁপের রস
  • সিদ্ধ কাঁচা পেঁপে
  • কলার রস বা কলা চটকে মণ্ড করে খাওয়ানো (পাকা কলা)
  • সিদ্ধ কাঁচা কলা
  • লিচুর রস (কাঁচা)
  • সিদ্ধ আলু
  • সিদ্ধ পেয়ারা
  • বেদানার রস (কাঁচা, বীজ বাদ দিয়ে)
  • শশার রস ( কাঁচা)
  • আমের রস (কাঁচা)
  • সিদ্ধ পালংশাকের জল

কোন বয়সে কত পরিমাণ এবং কিভাবে খাওয়াতে হবে :


বয়স থেকে দৈনিক ৪ আউন্স
• ৪ থেকে বছর বয়স: দৈনিক থেকে আউন্স জলহীন শুধু ফলের রস। 
• ৭ থেকে ১৮ বছর বয়স: ৮ আউন্স দৈনিক বা প্রতিদিন কাপ জলহীন শুধু ফলের রস। 

 

২ বছরের পর থেকে শিশুকে ফলের রসের পরিবর্তে গোটা ফল চিবিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস করানো উচিত। যদি শিশুর সর্দিকাশি প্রভৃতি ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা থাকে তবে ফলের রসের ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণ উষ্ণ জল মিশিয়ে পান করাতে হবে। চিনি বা নুন যোগ না করাই উচিত। কিছু ফল অনেক সময় টক হয় যেমন বিভিন্ন ধরণের লেবু। সেক্ষেত্রে মিষ্টতার জন্য মধু ব্যবহার করাই শ্রেয়।  

শিশুর আহারের ক্ষেত্রে সবসময় একটা কথা মনে রাখা উচিত। যখনই কোনো নতুন খাবার খাওয়ানো শুরু করা হয়, তারপর শিশুটির শারীরিক অবস্থা কেমন থাকে তার দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। সামান্যতম শারীরিক সমস্যা দেখা দিলেই শিশু চিকিৎসকের মতামত অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা বাঞ্ছনীয়।

 

কলমে - আবীর সেনগুপ্ত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন