শর্মাজী নামকিন – আমাজন প্রাইমে এই বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩১ শে মার্চ প্রকাশ পাওয়া একটি চলচ্চিত্র, হাসি মজা আবেগ বিনোদনে পরিপূর্ণ। কিন্তু এরকম ধরণের চলচ্চিত্র আগেও বহুবার বানানো হয়েছে, পরবর্তীকালেও বানানো হবে। এদের মধ্যে "শর্মাজী নামকিন" আলাদা কিসে?
ব্যতিক্রম তো অবশ্যই রয়েছে, যার কারণ চলচ্চিত্রটির দু'খানি বিশেষত্ব। প্রথমত, জনপ্রিয় অভিনেতা ঋষি কাপুর অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র এটি। দ্বিতীয়ত, "শর্মাজী নামকিন" এমন একটি চলচ্চিত্র যেখানে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন দুইজন অভিনেতা। হ্যাঁ, এমন চলচ্চিত্র তো অনেকই রয়েছে যেখানে মুখ্য চরিত্রের সঙ্গে অন্যান্য চরিত্রেও ভিন্ন ভিন্ন অভিনেতা অভিনেত্রীদের দেখা গিয়েছে। যেমন ধরা যাক, "দেবদাস" চলচ্চিত্র। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিচালক দ্বারা নির্মিত "দেবদাস" এর চরিত্রগুলিতে আমরা নানাসময়ের অভিনেতা অভিনেত্রীদের পেয়ে থাকি। "শর্মাজী নামকিন" এখানেই অন্যান্য চলচ্চিত্রের থেকে আলাদা। কারণ এটি একবারই বানানো হয়েছে এবং তার মুখ্য চরিত্রে দেখা গিয়েছে দু'জন স্বনামধন্য অভিনেতাকে। তবে যে কারণে এমনটা হয়েছে তা বড়োই দুর্ভাগ্যজনক।
হিতেশ ভাটিয়া "শর্মাজী নামকিন" চলচ্চিত্রটির পরিচালক। প্রযোজনা করেছেন চারজন – ফারহান আখতার, রিতেশ সিধওয়ানি, হানি ত্রেহান এবং অভিষেক চৌবে। কাহিনীর লেখকদ্বয় হলেন সুপ্রতিক সেন এবং হিতেশ ভাটিয়া। চলচ্চিত্রটির শ্যুটিং শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের প্রারম্ভে। ভালোই চলছিলো শ্যুটিং। মুখ্য ভূমিকায় প্রখ্যাত অভিনেতা ঋষি কাপুর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৩০শে এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করেন যার ফলে চলচ্চিত্রের কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায়।
২০১৮ সালে ঋষি কাপুরের লিউকোমিয়া ধরা পড়েছিল, নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাও চলছিলো সেইমতো। একবছর ধরে সফল চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়ে তিনি ২০১৯ এ বাড়ি ফেরেন। শরীরস্বাস্থ্যের খেয়াল রাখার পাশাপাশি তিনি অভিনয়ের কাজ পুনরায় শুরু করেন। অসুস্থতা দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। চলেও গেলেন কাজ করতে করতে। ২৯ শে এপ্রিল শ্বাসকষ্টজনিত কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, আর পরেরদিন ৩০ শে এপ্রিল তিনি সকলকে ছেড়ে এই জগৎ থেকে বিদায় নেন।
ঋষি কাপুরের মৃত্যুর পর অকূলপাথারে পড়েন "শর্মাজী নামকিন" চলচ্চিত্রের পরিচালক এবং প্রযোজকরা। এমনিতেই ঋষি কাপুরের চলে যাওয়া যথেষ্ট দুঃখজনক, তার উপর চলচ্চিত্রটি অসমাপ্ত হয়ে পড়ে রইলো। এর ভবিষ্যত কি হবে কারুর জানা নেই। এমনসময় মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে এলেন অন্যতম প্রখ্যাত অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। "শর্মাজী নামকিন" চলচ্চিত্রের মুখ্য চরিত্র হিসাবে অবতীর্ণ হয়ে তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন।
বলা যতটা সহজ, করা হয়তো তার চেয়েও বেশি কঠিন। কোনো চরিত্রে একজন অভিনেতাকে দেখে এলে তাঁর জায়গায় ওই একই চলচ্চিত্রের একই চরিত্রে অন্য অভিনেতাকে দেখলে দর্শকদের কাছে সেই দ্বিতীয় অভিনেতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। অনেকরকম চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয় দ্বিতীয় অভিনেতাকে। তাঁর অভিনয়ক্ষমতা হতে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খ, অভিব্যক্তি হতে হবে নিখুঁত। তাও হয়তো দর্শকদের মনে খুঁতখুঁতুনি রয়ে যাবে। এসবের মুখোমুখি হতে হবে জেনেও পরেশ রাওয়াল মহাশয় চলচ্চিত্রটির মুখ্য চরিত্রে দ্বিতীয় অভিনেতা হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।এবং শতকরা একশ ভাগ সফল্ভাবে চরিত্রের সাথে মিশে গেছেন। দর্শকের একবারও মনে হয়নি দু’জন পৃথক অভিনেতা একটি চরিত্রে রূপদান করছেন বলে কোথাও কোনো অসঙ্গতি ঘটছে বা চরিত্রায়নে কোনো খাপছাড়া বিশেষত্ব সিনেমার গতি রোধ করছে। অনবদ্য অভিনয় ক্ষমতায় পরেশ রাওয়াল চলচ্চিত্রকে পূর্ণতা দান করেছেন।
চলচ্চিত্রের নাম শুনে মনে হচ্ছে তো এর কাহিনীতে শর্মাজী বলে কোনো ব্যক্তি এবং খাদ্য সম্পর্কিত কিছুর যোগাযোগ রয়েছে? ঠিক তাই। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শর্মাজী তাঁর ফাঁকা সময় নিয়ে একঘেয়েমিতে জর্জরিত। কোনো সুন্দর সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে নিযুক্ত করে রাখতে চান, কিন্তু কি যে করবেন ভেবে উঠতে পারেন না। রান্নাবান্নায় তাঁর বিশেষ পারদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও সেই পথে এগোতে বাধাপ্রাপ্ত হন। অবশেষে সমস্ত সঙ্কোচ কাটিয়ে নিজের পছন্দের কাজ নিয়ে এগিয়ে চলেন তিনি। তবে এতটাও সহজে হয়নি, পদে পদে বাধা এসেছিল। বিশেষ করে নিজের সন্তানদের, নিজের নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে। কিভাবে তিনি শেষপর্যন্ত জয়ী হলেন তা জানতে হলে চলচ্চিত্রটি অবশ্যই দেখে ফেলতে হবে।
"শর্মাজী নামকিন" দেখা শুরু করার সময় সেভাবে কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা রাখিনি। ভেবেছিলাম আর পাঁচটা কমেডি মুভি যেমন হয় এটাও সেরকম গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেই হবে। একই চরিত্রে দু'জন অভিনেতার চমক যেমন ছিল, তেমনই চমক ছিল চলচ্চিত্রটির কাহিনী বুননে। দেখতে দেখতে কখনও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি, কখনও সজোরে হেসে উঠেছি, কখনও আবার মনখারাপের মেঘও ভেসে বেরিয়েছে। সত্যি বলতে কি, চলচ্চিত্রটি খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করেছি। পরিবারের ছোটো বড়ো যেকোনো বয়সী সদস্যদের সঙ্গে বসে দেখার মতো এটি।
অভিনয় নিয়ে আলাদা করে কিছুই বলার নেই। অধিকাংশ অভিনেতা অভিনেত্রীরাই অতীতের বিভিন্ন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পূর্বপরিচিত। প্রত্যেকের অভিনয় অত্যন্ত সাবলীল। "শর্মাজী নামকিন"এর কিছু কিছু জায়গায় রোমান্সের পরশ আছে, কিছু কিছু জায়গা আবার কৌতুকপূর্ণ। ঋষি কাপুর ও পরেশ রাওয়াল দু'জনের অভিনীত বিভিন্ন চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতার জন্যই কিনা জানি না, মনে হচ্ছিল রোমান্সের মাধুর্য্যতে ঋষি কাপুর তুলনামূলকভাবে বেশি মানানসই, হয়তো তাঁর সারল্যে মাখা মিষ্টি হাসির জন্য। অন্যদিকে কৌতুক দৃশ্যগুলিতে পরেশ রাওয়াল ভীষণভাবে মাতিয়ে রেখেছেন, সেটার কারণও হয়তো তাঁর পূর্বে অভিনীত মজার চরিত্রগুলির জন্য। তবে যেখানে যাঁকে যতোই মানানসই লাগুক না কেন, একই চরিত্রে দু'জন অভিনেতাকে দেখে চলচ্চিত্রটি দেখতে গিয়ে কারুর কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না, তাঁরা এমনই পারদর্শী। "শর্মাজী নামকিন" দেখার পর আপনারও যে মুখে হাসি লেগে থাকবে আর হঠাৎ করেই বড্ড খিদে পেয়ে যাবে, এ আমি বলে রাখলাম।
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন