বাবার জন্য একটি দিন

 

মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়

পিতৃস্নেহের কাছে হয়েছে মরণের পরাজয়”

 

মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি ঘটনা সবাইকে হতচকিত করে। তা ছিল সম্রাট বাবর রোগগ্রস্ত পুত্র হুমায়ুনকে বাঁচাতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তার নিজের জীবনের পরিবর্তে পুত্রের জীবন ভিক্ষার। সেই প্রতিজ্ঞার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠে। বিনিময়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সম্রাট বাবর।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঙলা ছোটগল্পের অসাধারণ সৃষ্টি ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের নায়ক রহমত। রহমত দেশে রেখে আসা নিজের ছোট্ট মেয়ের স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করে সওদা করে কলকাতার পথে পথে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “কাগজের উপর একটি ছোট হাতের ছাপ। ফটোগ্রাফ নহে, হাতে খানিকটা ভূসা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে-যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চার করিয়া রাখে”। ছেলে-মেয়ের প্রতি বাবাদের যে স্নেহ তার তুলনা শুধু বাবাই হতে পারেন আর কেউ নয়।

 

বিরামহীন কর্মঠ, শত বাধা ও পরিশ্রমে যে ক্লান্ত নয়-সমস্ত পরিবারের জন্য যাবতীয় দায়িত্বের ধারকরূপে পৃথিবীতে যে ব্যক্তিটি তার সময়কে অতিবাহিত করেন-তিনিই বাবা। বটবৃক্ষের ছায়ার মত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অবিরাম পরম যত্নে যিনি লালন করেন, তিনি বাবা। একটা সন্তানের ভরসা, ছায়া এবং নির্ভরশীলতার প্রতীক তার বাবা। একজন বাবা তার সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে সবসময় প্রস্তুত থাকেন। অন্যদিকে একজন সন্তানের আদর, শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো তার বাবা। বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু। সন্তান বাবার ঋণ কখনো শোধ তো দূরের কথা পরিমাপও করতে পারে না।


সোনোরা স্মার্ট ডোড

 
সর্ব প্রথম বাবা দিবস পালন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। তবে ঠিক কবে থেকে সেটি সঠিক জানা যায়নি। মধ্যযুগের ইতিহাস ঘাঁটলেও ফাদার্স ডে সম্পর্কে জানা যায়। ক্যাথলিক বিশ্বাসে জোসেফ হলেন যীশু খ্রিস্টের পিতা। রাজা হেরোদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে অন্তঃসত্ত্বা মাতা মেরীকে নিয়ে জেরুজালেমে চলে যান তিনি। সেখানেই জন্ম নেন যীশু। তাই জোসেফকে ‘নিউট্রিটর ডোমিনি’ বা ‘নারিশর অফ দ্য লর্ড’ বলা হয়। তাঁরই সম্মানে পালিত হতো ফাদার্স ডে। কেউ কেউ বলেন, ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় চার্চের মাধ্যমে দিনটির প্রচলন। অন্যরা বলেন, ওয়াশিংটনের ভ্যাঙ্কুবারে প্রথম বাবা দিবস পালন করা হয়। বাবা দিবসের প্রবক্তা হচ্ছেন সোনোরা স্মার্ট ডোড। ১৮৮২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। পিতা উইলিয়াম জ্যাকসন ছিলেন কৃষক। ১৬ বৎসর বয়সে ডোড তার মাকে হারান। জানা যায় ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তিনি মারা যান। ৬ ভাই বোনের মধ্যে সোনারই ছিলেন একমাত্র কন্যা। সোনোরা একসময় অনুভব করেন তাদের মানুষ করতে তার বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। মাতৃহীন ওই নারী জন্মের পরপরই বুঝেছিলেন, একজন বাবা তার সন্তানের জন্য কতটুকু ত্যাগ ও তিতিক্ষা সহ্য করতে পারেন। সোনোরার চোখে তার বাবা ছিলেন সাহসী, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগী একজন ভালো মানুষ। যিনি সন্তানের সুখের জন্য নিজের চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দিয়েছিলেন। মায়ের আদর না পেলেও, বাবা তার কাছে ছিলেন মহাপুরুষ। তার বাবা ছিলেন একজন সৈনিক। দেশের কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও সোনোরার বাবা খুব কষ্ট করে তার সন্তানদেরকে মানুষ করেন। সোনোরা স্মার্ট বিয়ে করেন জন ব্রোস ডোডকে। তাদের সন্তান জ্যাক ডোড জন্মের কিছুকাল পরে সোনারের স্বামীও মারা যায়। তখন সোনোরা স্মার্ট ফিরে যায় তার বাবার কাছে। সেই থেকে বাবা আর মেয়েতে মিলেই পুরো জীবন পার করে দেয়। তাই  বাবার প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান জানাতে বাবা দিবস পালনের চিন্তা সোনারের মাথায় আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তার বাবাকে সম্মান জানাতে সেনোরা ও তার ভাই-বোনেরা ঠিক করেন জাঁকজমক করে বছরে একটি দিন পালন করবেন।

 

১৯০৯ সালে মা দিবসের এক অনুষ্ঠানে সোনোরা অংশ গ্রহণ করেন। তখন থেকে তিনি ভাবতে থাকেন মা দিবসের মতো বাবা দিবস নামে একটি দিন পালন করা উচিত। যেখানে মা-দের পাশাপাশি বাবাদের ও ভালবাসা জানানো হবে, শ্রদ্ধা জানান যাবে। এই চিন্তা নিয়ে মূলত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্পোকেনস শহরের  মন্ত্রীজোটের কাছে তার পিতার জন্মদিন ৫ জুনকে বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব পাঠান। তার প্রস্তাবের প্রশংসা করলেও মন্ত্রীজোট ৫ জুনকে বাবা দিবস ঘোষণা করতে রাজি হয়নি। তারা জুন মাসের তৃতীয় রোববারকে বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।

 

১৯১০ সালের ১৯ জুন প্রথম বাবা দিবস উদযাপিত হয় স্পোকেনস শহরে। শহরের তরুণ তরুণীরা শাদা ও লাল দুটি করে গোলাপ নিয়ে যায় বাবা দিবস উৎযাপনের জন্য। লাল গোলাপ জীবিত পিতাদের শুভেচ্ছার জন্য, আর সাদা গোলাপ মৃত পিতাদের। এইভাবে শুরু হয় পৃথিবীর সমস্ত বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার প্রচলন। কিন্তু এই দিনটিকে অনুমোদনের জন্য কংগ্রেস নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন। ১৯১৩ সালে মার্কিন সংসদে ফাদার্স ডে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা সংক্রান্ত একটি বিল আসে। তবে সেটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। পরে ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিষয়টি অনুমোদন করেন। ১৯২৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কোলিজ এটিকে জাতীয় দিবসে রূপ দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন রাষ্ট্রীয়ভাবে জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস উদযাপনের ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জমানায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পিতৃ দিবস উদযাপন শুরু হয়। সোনারার উদ্যোগ সফল হয়। মূলত তার কারণেই বিশ্বে বাবা দিবসের সূচনা। সোনারা ডোড ১৯৭৮ সালে ৯৬ বছরে মারা যান।


 
তারপর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পিতৃ দিবস হিসেবে পালিত হয়। অনেকেই এমন দিন পালনকে গুরুত্বহীন মনে করলেও বাবা দিবসে সন্তানরা তাদের বাবাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভালোবাসা প্রকাশের সুযোগ পান, যা বছরের অন্য দিন সেভাবে সম্ভব হয় না। যেসব সন্তান বাবা-মায়ের ব্যাপারে উদাসীন, তাদেরকেও এমন দিন বাবা-মায়ের অবদান মনে করায়।

দেশ ও সংস্কৃতিভেদে বাবা দিবস বিভিন্নভাবে পালিত হয়। উপহার দিয়ে হোক কি অভিনন্দন জানিয়ে, সন্তানরা এই দিন বাবার জন্য তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে আনন্দ পায়। আর তাদের আনন্দেই আনন্দিত হয় একজন বাবা। তাই দ্বিধা দূর করে এই বাবা-দিবসেই চলুন বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানাই। হাসি ফোঁটাই তাদের মুখে। পৃথিবীর সব বাবার জন্য বাবা দিবসের শুভেচ্ছা।

 

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮৭ দেশে বাবা দিবস পালন করে। তার মধ্যে জুন মাসের তৃতীয় রবিবারে দিবসটি পালিত হয় ৫২ দেশে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, অ্যান্টিগুয়া, বাহামা, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, কানাডা, চিলি, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, জাপান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ে অন্যতম।

 

এরমধ্যে ইরানে বাবা দিবস পালন হয় ১৪ মার্চ। এছাড়া বলিভিয়া, ইটালি, হন্ডুরাস, পর্তুগাল ও স্পেনে মার্চ মাসের ১৯ তারিখ, দক্ষিণ কোরিয়ায় মে মাসের ৮ তারিখ এবং লিথুনিয়ায় জুন মাসের প্রথম রোববার, ডেনমার্কে ৫ জুন পালন করা হয়। এছাড়া জুনের দ্বিতীয় রোববার বাবা দিবস পালন করা হয় অস্ট্রিয়া, ইকুয়েডর ও বেলজিয়ামে। এল সালভেদর ও গুয়েতেমালায় ১৭ জুন, নিকারাগুয়া, পোল্যান্ড ও উগান্ডা ২৩ জুন পালন করে বাবা দিবস। পশ্চিম ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গ বাবা দিবস পালন করে ৫ অক্টোবর এবং একই মাসের দ্বিতীয় রোববার বাবা দিবস পালন করে এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রোববার বাবা দিবস পালন করা হয়। সেপ্টেম্বরে কেন অস্ট্রেলিয়াতে বাবা দিবস পালন করা হয় এ নিয়ে কৌতূহল ছিল অনেক দিনের। পরে জানা গেল শুধু অস্ট্রেলিয়ায় নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে এ বাবা দিবস পালন হয়। এর পেছনে রয়েছে নানা প্রাসঙ্গিক গল্প। এ রকম নিউজিল্যান্ড, ফিজিসহ আরও কয়েকটি দেশে ও সেপ্টেম্বরে বাবা দিবস পালিত হয়। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি প্রভৃতি দেশে সেপ্টেম্বরের প্রথম রোববার বাবা দিবস পালিত হয়।

 

সব জায়গাতে ভালোবাসার প্রথম স্থান দখল করে আছেন মমতাময়ী মা। আর মায়ের পরবর্তী স্থান বাবার। কিন্তু বাবাকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষা, বাবার ভালোবাসা পাবার ইচ্ছা সব সময়ই প্রতিটা সন্তানের একটু বেশিই। কেননা মাকে আমরা সব সময়ই কাছে পাই কিন্তু বাবা ব্যস্ততার কারণে সারাক্ষণ বাইরেই থাকে। পরিবারকে হাসিখুশি রাখতে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শক্ত তালু ও চোপসানো চোয়ালে বাসায় ফেরে সন্তানের জন্য এক চিলতে হাসিমুখ নিয়ে। প্রতিটি সন্তানের কাছে বাবার এই হাসিটা ও বাবার মুখে খোকা-খুকি ডাক অতি প্রিয়। সকল দুঃখ-কষ্ট, সকল প্রকার বিষাদ নিমেষেই দূর হয়ে যায়।

 

সাধারণত সন্তানের বেশিরভাগ আবদার মা’র কাছে হলেও জন্মের পর থেকে এই আবদার পূরণের নেপথ্যে থাকেন মূলত বাবা। যার ত্যাগ ও তিতিক্ষায় ছোট্ট শিশুটি বেড়ে উঠে ধীরে ধীরে। জানতে পারে বাইরের জগৎকে। যিনি কর্মব্যস্ত দিনশেষে বাড়ি এসে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে যান সারাদিনের ক্লান্তিকর মুহূর্তগুলো। সন্তানের প্রতি বাবার যেমন ভালোবাসা তেমনি বাবার প্রতিও সন্তানের হৃদয়ে পুঞ্জিভূত থাকুক গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ।


 
অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কাছে মাকে মনে হয় বেশি আপন, কারণ বেশিরভাগ সময় মা আমাদের চোখের সামনেই থাকেন। বাবা থাকেন বাইরে। দিনের শুরু থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে খেটে যে মানুষটি আমাদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেন, তার অবদান যেন আমরা দেখেও দেখি না। যেন এ-ই স্বাভাবিক। অথচ মায়ের পরে শত আবদার, অনুযোগ পূরণ করার জন্য আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য শত ত্যাগ নিঃস্বার্থভাবে পূরণ করেন যেই মানুষটি তিনি আর কেউ নন, বাবা। দরিদ্র বাবা কিংবা ধনী বাবা বলেও কিছু নেই। সব বাবাই চান সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে সন্তানকে ভালো রাখতে, গড়ে তুলতে। অনেক পরিবারে বাবার সঙ্গে সন্তানের কিছুটা দূরত্ব দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই মায়ের আঁচল ধরে ঘ্যানর ঘ্যানর করার অভ্যাস আমাদের, দিন শেষে বাবা সামনে এলে তাই মনে হয় রাগী এবং গম্ভীর কেউ! এ ক্ষেত্রে সব আবদার মায়ের মাধ্যমে পৌঁছায় বাবার কাছে। বাবা তার গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন সন্তানের সব অনিশ্চয়তা, প্রতিবন্ধকতা। দুশ্চিন্তার এতটুকু আঁচড় যেন সন্তানকে না ছোঁয়! বাবার ভাবনায় থাকে সেটাই। দূরত্ব কিংবা গাম্ভীর্য, যাই থাকুক না কেন কিংবা প্রকাশভঙ্গী যাই হোক সন্তানের জন্য পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে তুলতে চেষ্টার কোনও কমতি থাকে না বাবার।

 

ভাষা ভেদে শব্দ বদলায়। স্থান ভেদে বদলায় উচ্চারণ। ‘বাবা’, ‘আব্বু’ কিংবা ইংরেজিতে ‘ড্যাড’ বা ‘ফাদার’ যাই বলে ডাকি না কেন-বদলায় না শব্দটির সম্পর্কের গভীরতা। উচ্চারণে ভিন্নতা থাকলেও প্রতিটি দেশে প্রতিটি সন্তানের মাথার ওপর বটবৃক্ষের মতো ছায়ার নামই হচ্ছে ‘বাবা’। সন্তানের মুখের হাসি, সব আবদার পূরণের জন্য জীবনের ছোট-বড় সুখ, আরাম-আয়েশ নির্দ্বিধায় ত্যাগ করা, আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার নাম বাবা। বাবার তুলনা শুধুই বাবা। বাবা চির আপন, চিরন্তন এক সম্পর্কের নাম। বাবার প্রতি সন্তানের সেই চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। তারপরও একটি বিশেষ দিনে ঘটা করে ভালোবাসার প্রকাশও মন্দ নয়। কিন্তু বাবাদের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করার এই নির্দিষ্ট দিন ছাড়া কি অন্যদিন গুলোতেও বাবারা ভালোবাসা পাচ্ছেন? বাবারা কি তাদের সন্তানদের থেকে আদর, যত্ন পাচ্ছেন, না তারা অবহেলিত? এমন প্রশ্ন থেকেই যায়। একটা কথা সকল সন্তানকেই মনের ভিতর থেকে অনুভব করতে হবে আর সেটা হল আমরা এখন যে মুখে বা যে ভাষায় বাবাকে বকা দিই বা তাদের সাথে খারাপ আচরণ করি এই ভাষা ওই বাবারই সৃষ্টি আধো আধো করে কথা বলা শেখা ওই বাবার থেকেই। নিজে হাতে যখন খেতে পারতাম না, ওই বাবাই তার নিজ হাতে পরম যত্নে খাইয়ে দিতো।

 


করোনাকালে সন্তানের অসুস্থতায় অসংখ্য বাবাকে দেখেছি সন্তানকে কোলে করে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল দৌড়চ্ছেন। অক্লান্তভাবে হাসপাতালের এক ফ্লোর থেকে আরেক ফ্লোরে যাচ্ছেন। তিনি একজন বাবা। আর অসুস্থ যিনি কোলে - তিনি এই হিমালয়সম বাবার সন্তান। হিমালয় যেমন মেঘকে ভালোবেসে গায়ে মেখে রাখছেন অনন্তকাল, ঠিক তেমনই সকল বাবা তাদের সন্তানদের গায়ে মেখে রাখছেন কি রোদ কি বৃষ্টি কি রোগ আর কি মহামারী!

 

ভালবাসলেও, যত্ন নিলেও কিংবা নিয়মিত ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও নানা জড়তা আর দ্বিধায় বাবাকে হয়তো কখনো বলা হয়ে উঠেনি ‘ভালোবাসি বাবা’। জড়তায় প্রতিদিন বা কখনো না পারলেও আসছে বাবা দিবসে একটু ঘটা করেই বাবাকে জানাতে পারেন তার প্রতি হৃদয়ের গহিনে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার কথা। তাকে দিতে পারেন বিশেষ কোনও উপহার। বাবার জন্য কেনা উপহারটি র‌্যাপিং করে তার ওপর লাগাতে পারেন রঙিন রিবন। আর উপহারে লিখে দিতে পারেন ‘বাবা তোমায় ভালোবাসি’। আপনার দেওয়া সেই উপহারটি যত কম দামিই হউক না কেন তা আপনার বাবার কাছে হয়ে উঠবে মহামূল্যবান। কারণ উপহারটির সঙ্গে মিশে থাকবে আপনার ভালোবাসার প্রকাশ। মুখে কিছু না বললেও ভালোবাসা, গর্বে ছল ছল করে উঠবে বাবার দু’চোখ।

 

শেষ করছি প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের লেখা দিয়ে, তাঁর লেখা ‘নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝক ঝকে রোদ’ গ্রন্থে বাবা সম্পর্কে তাঁর একটি মন্তব্য দিয়ে। তিনি লিখেছেন

পরিবারের সকলকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলসে গিয়েছি। বন্ধুর বাসায় উঠি, রাতে ক্যাম্পিং করতে জঙ্গলে গিয়েছি। গভীর রাতে ২য় মেয়ে শিলার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি শিলা বসে আছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম, মা তোমার কি হয়েছে? শিলা বললো, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমি তাকে সারারাত তার পাশে বসার কথা বলি, তখন শীলা এক পর্যায়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিত মনে ঘুমালো। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে শিলা বলে, বাবা তুমি একজন আদর্শ ও ভালো বাবা। জবাবে আমি বললাম, পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজন খারাপ বাবাও নাই।




কলমে - কমলেন্দু সূত্রধর 

চিত্র সৌজন্যঃ অন্তরজাল  



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন