কাঠের পাটাকে চেঁছে একটা ব্যাট তৈরির চেষ্টা করছিল শিবু। সুবীর হন্তদন্ত হয়ে এসে বললে, - “দত্তদের শ্যালোয় চান করতে যাবি শিবু? নতুন শ্যালো বসিয়েচে, যা জল বেরোচ্ছে না! গদগদ করে, দমকলের নল থেকে জলকে অ্যাকেবারে সাতফুট দূরে ফিঁকচে ”।
এই কথাগুলো বলেই আগ্রহের
আতিশয্যে হাঁফাতে লাগলো সে।
শিবু বন্ধু বর্ণিত এই অত্যাশ্চর্য শ্যালো টিউবওয়েল দর্শন এবং স্নান
করার জন্য গায়ে মাথায় খানিকটা সরষের তেল ঘষে নিয়ে আলনায় ঝোলানো গামছাটা টান
মেরে নিয়েই বেরিয়ে পড়লো।
পুকুরের পাড় শেষ হলেই
চাষের মাঠ শুরু, দু'তিনটে জমির সংযোগস্থলে, খানিকটা জায়গা গোল করে কেটে নিয়ে বসেছে
শ্যালো।
নতুন
কেনা ভারত শক্তি পাম্পসেটের ভটভট আওয়াজের সাথে সত্যিই ফুট ছয় সাত দূরে নিক্ষেপিত
হচ্ছে স্বচ্ছ জলরাশি, তারপর চওড়া নালা বেয়ে
বেরিয়ে যাচ্ছে ক্ষীণ একটা নদীর মতো। ক্রমাগত জল পড়ে পড়ে একটা ফুট তিনেক ব্যাসের ক্ষুদ্র জলাশয়ের সৃষ্টি
হয়েছে। তার তলদেশে গোটাকতক ইঁট পাতা, স্নান
করার সুবিধার জন্যই হয়তো।
সুবীর ও শিবু স্নান করার
জন্য নেমে পড়লো, লোভনীয় কাঁচের মতো স্বচ্ছ
জল দমকলের মুখ থেকে তীব্রবেগে বেরিয়ে ওদের গায়ে মাথায় এসে আছড়ে পড়তে লাগলো।
ওরাও সেই ঠেলা সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়,আবার
পড়ে যায় জলের তোড়ে। এটা স্নানও বটে, খেলাও
বটে। জলকেলিরত এই দুই কিশোরের দাপাদাপিতে নালার স্বচ্ছ জল কিছুক্ষণের মধ্যেই
কর্দমাক্ত হয়ে উঠলো।
শোভন, দত্তদের ঘরের ছেলে, ওদের সঙ্গেই একই স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে, এসে রাগতস্বরে বললে – এই তোরা করছিস কি? নালাটা ভাঙবি নাকি?
শিবু মাথার চুল বেয়ে ঝরে
পড়া জলস্রোতকে হাত দিয়ে মুখের ওপর থেকে সরিয়ে বললে – “দেকচিস তো চান করচি, নালা ভাঙবো ক্যানে”!
“নিজের বাপের শ্যালোয় গিয়ে লাফা, কেউ কিচু বলবেনে” – রেগে বললে শোভন।
শিবুর অভিধানে মৌখিকভাবে
এর কোনো উত্তর জানা ছিলো না,
তাই
জলে ভেজা হাতের একটা চড়ের মাধ্যমে উত্তর দিলে। এরপরের ঘটনার মধ্যে খুব একটা
বৈচিত্র্য ছিল না,যথারীতি বাবার কাছে এসে
নালিশ এবং গরু তাড়ানো লাঠিটার স্থায়ী দাগ পিঠের বেশ কিছু জায়গায়।
বাবা লাঠিটা গোয়ালের কোণে
রেখে দিয়ে বিড়ি দেশলাই হাতে আমবাগানের দিকে চলে গেল। মা এসে ভিজে হাফপ্যান্ট
পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিবুর মাথা গামছা দিয়ে মোছাতে মোছাতে বললে – “কাঁদিসনি, চুপ কর, কেন
যাস ওদের শ্যালোয় চান করতে?
চল
ভাত খাবি”।
কান্না এবং গর্জন মেশানো
একটা মিশ্রিত শব্দের মাধ্যমে শিবু বুঝিয়ে দিলে যে সে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্যে মোটেও
উৎসুক নয়।
মা দু'তিনবার অনুনয় বিনয়ের পর
রেগে বললে – “না খাবি, না খাবি,ছাড়, আর
ডাকবো না”।
শিবু কলতলায় আধঘন্টা বসে, মা আর ডাকে না। এদিকে পেটে প্রচন্ড খিদে, শিবু ভাবলো এবার ডাকলেই খেতে যাবে। কিন্তু মা
আর ডাকছে না কেন! শেষটায় মরিয়া
শিবু উপযাচক হয়েই বললে – “যদি কতা দাও বাবাকে বলে আমাদেরও শ্যালো বসিয়ে দেবে, তাহলে খাবো”। মা আপাততঃ একটা রফাসূত্র পেয়ে
হেসে বললে – “আচ্ছা ঠিক আছে,
তুই
খাবি আয়”।
এরপর মা ভুললেও শিবু ভোলে
না, প্রতিদিন স্কুল যাবার সময়
মনে করিয়ে দেয় মাকে – “আজ বলবে কিন্তু বাবাকে”। স্কুল ফেরত আরেকবার জিজ্ঞেস করে
- “বলেছিলে মা?”
ক্রমাগতঃ অনুসন্ধানের ঠেলা
সহ্য করতে না পেরে একদিন কথাটা পেড়েই ফেললো শিবুর মা।
সন্তোষ মন্ডল গম্ভীর হয়ে
স্ত্রীকে বলল – “ শ্যালো বসালে তো ভালোই হয়, দত্তদের
কাছ থেকে বোরো সিজনে জল কেনার খরচটা বাঁচে, উপরন্তু
অন্যের জমিতে জল বিক্রি করেও দু'পয়সা হবে। দু'শো টাকা ঘন্টা! রেট তো কম নয়! কিন্তু শ্যালো বসানোর টাকা
কই হাতে!”
আরতি একটু চুপ করে থেকে
তারপর বললে – “যদি লাভ হয় সত্যিই তাহলে আমার বাপেরবাড়ির দেওয়া গয়না দু'একটা বেচতে পারো।"
সন্তোষ উজ্জ্বল মুখে বললে
–“তোমাকে দু'বছরের মধ্যে আবার গড়িয়ে
দেবো দেখো”।
এরপর মিস্ত্রি এলো , দু'তিন জায়গায় পাইপ পুঁতে পুঁতে পরীক্ষার পর ওদের তিনবিঘে
জমির কোণটায় ভালো ওয়াটার লেভেল পাওয়া গেল। যে পদ্ধতিতে টিউবওয়েল বসানো হয়, তাকে বলে ঢেঁকিকল। তিনটে বাঁশ দিয়ে একটা
ত্রিকোণ ধাঁচা করে তার ওপর লাগালো হলো কপিকল, এর
পর একটা নীচে ফলা লাগানো জলপূর্ণ পাইপকে ঐ ঢেঁকিকলের বাঁশকে অনেকটা নলকূপ টিপে জল
বের করার মতো স্টাইলে ব্যবহার করে মাটিতে প্রবেশ করানো, একটা পাইপ প্রায় ঢুকে গেলে মাঝে সকেট দিয়ে
আরেকটা পাইপ জুড়ে দেওয়া। শ্যালো বসানোর দিনটা ছিল রবিবার, শিবুর স্কুল নেই, ওর বিভিন্ন প্রশ্ন ক্রমান্বয়ে ধেয়ে
যাচ্ছিলো মিস্ত্রি কাকুর দিকে,
- আর
কটা পাইপ পুঁতলে তবে জল বেরোবে,
পাইপ
জোড়ার সময় যে সাদা অর্ধতরল চটচটে পদার্থটি লাগানো হচ্ছে তাকে কি বলে, মোটা বালির লেয়ারে বেশি জল হবে না সরু
বালিতে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
দু'দিনের মধ্যেই পাইপ বসানোর
কাজ সারা। আজ মঙ্গলবার হলেও শিবু
স্কুলে যায়নি, বন্ধু সুবীরও। শহর থেকে
নতুন দমকল এলো, এটাও সবুজ রঙের, তবে কির্লোস্কার। শ্যালো টিউবওয়েলের সাথে
হোস পাইপ দিয়ে জুড়ে মিস্ত্রিকাকু হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট করলো দমকল। প্রথমে
ঘোলাজল, তারপর আস্তে আস্তে জলের
স্বচ্ছতা ও বেগ দু'টোই বাড়লো। দু'তিন ঘন্টা চলার পর দেখা
গেল দমকলের মুখ থেকে স্বচ্ছ কাঁচের মতো গোলাকৃতি জলধারা প্রায় ফুট আষ্টেক দূরে
গিয়ে আছাড় খাচ্ছে। কলমিস্ত্রি কৃতিত্ব দাবী করার দৃষ্টিতে শিবুর বাবার দিকে
তাকিয়ে বললে, - “এ কচি মিস্ত্রির হাতের কাজ, দেখে নিন সন্তোষদা, যা জলের স্পীড আধঘন্টাতেই একবিঘে জমি পাইয়ে
দেবে”।
সন্তোষ হাসিমুখে আরতির
দিকে তাকালো, আরতি হাতে করে আনা
শাঁখটায় তিনবার সজোরে ফুঁ দিলে। শিবু আর সুবীর হাততালি দিয়ে উঠলো – “হো হো, দত্তদের শ্যালোর থেকেও জল বেশি, হো ও ও ও”।
পাড়াপ্রতিবেশীদের অনেকেই
নতুন শ্যালোর জল দেখতে এসেছে। হাততালি থামিয়ে সুবীর আঙুল দিয়ে শোভনকে দেখালে। শিবু তাকিয়ে দেখলো শোভনের মুখ চুন, ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। সুবীর
শোভনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশি করে হাততালি দিতে লাগলো। কিন্তু কি আশ্চর্য! শিবুর আর
একটুও রাগ নেই, শোভনকে ডেকে বললে – “শোভন
রে, কাল আমাদের নতুন শ্যালোর
জলে চান করতে আসবি, তিনজনে একসঙ্গে চান করবো”।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন