বহুদিন আগের কথা। এক অপরাহ্নে যজমান বাড়ি থেকে ফিরছিলেন তারিণী মুখুজ্যে মশাই। পথে বনমালীর সঙ্গে দেখা।
'কি বনমালী,এত
ব্যস্ত হয়ে কোথা থেকে ফিরছ?'
মুখটা কাঁচুমাচু করে মাথা
চুলকোতে চুলকোতে বনমালী বলে,'আর ব'লো না বাবাঠাকুর। পেরে উঠছিনে, এত খাটাখাটুনি করেও সংসার টানা দায় হয়ে
উঠছে।'
'সে কি! কাজে ফাঁকিটাকি দাও না তো?'
'কী যে বলো বাবাঠাকুর, তোমার বাড়িতে তো অনেক সময় কাজ করেছি, ফাঁকি দিতে দেখেছ!'
'কথাটা সেভাবে বলিনি বনমালী। ও নিয়ে চিন্তার
কিছু নেই। তুমি আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে এক ফাঁকে একটু দেখা করতে পারবে?কথা আছে।'
কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে
বনমালী বলল,'পারবো বাবাঠাকুর, সন্ধ্যার পর।'
উভয়ের বাড়ি একই গ্ৰামে।
খুব গরীব বনমালী। বোকা হলেও যথেষ্ট সেয়ানা। চাষ-পোষ মরশুম ছাড়া
প্রায় সারা বছর লোকের বাগান বাড়ি ইত্যাদির কাজ করে বেড়ায়। জনা চারেক ছেলে মেয়ে, তারাও সব পর পর বড়ো হয়ে উঠছে। তাদের নিয়ে
বনমালী দম্পতির আশা-ভরসার শেষ নেই। সন্ধ্যার পর বনমালী এল তারিণীবাবুর বাড়িতে। মুখুজ্যে মশাই তখন চন্ডীমন্ডপে
বসে আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
বনমালী আসাতে ইঙ্গিতে তাকে বসতে নির্দেশ দিলেন।
প্রথম ব্যক্তি চলে যেতে
বনমালীকে নিয়ে ঠাকুরমশাই কিছু কাজের কথা সেরে নিলেন। তারপর কথাচ্ছলে হাসতে হাসতে
বললেন,'এক কাজ করতে পারবে বনমালী?'
'কী কাজ বাবাঠাকুর?'
'ধর, তুমি
সারাদিন কাজ করে দিনের শেষে যা পয়সা হাতে পেলে, সবটাই
তোমার স্নানের ঘাটের কাছে জলে ফেলে দিলে, তারপর
জলে নেমে হাতড়ে হাতড়ে যা উঠল তাতে তোমার সংসার চলে কি না দেখবে,'বলে ঠাকুরমশাই শব্দ করে হেসে ফেললেন।
বনমালী আচমকা কথাটা ঠিক
মগজে ঢোকাতে পারল না। ঠাকুরমশাইকে সে খুব শ্রদ্ধা করে, অন্ধভাবে বিশ্বাসও করে।খানিক ভেবে নিয়ে বলল,'জ-লে ফে-লে দি-লে সব পাওয়া যাবে কি?'
'সব না পাও ,যা
পাবে তা খরচ করে দেখনা।'
বনমালীর মনের মধ্যে একটা
দো-মনা ভাব কাজ করতে থাকল। শেষে গভীর চিন্তাযুক্ত মনে ঠাকুরমশাইকে প্রণাম করে উঠে
পড়ল।
**********************************
আজ কাজের শেষে বাড়ি ফিরে
কাউকে কিছু না জানিয়ে ঠাকুরমশাইয়ের নির্দেশ মতো বনমালী সমস্ত পয়সা কড়ি জলে
ফেলে দিল। অনেক অনুসন্ধানের পর পেল মাত্র দু'আনা পয়সা। বনমালীর মাথায় হাত, সংসার চলবে কীভাবে?ভোর ভোর হন্তদন্ত হয়ে ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে
সাক্ষাৎ করে তার দুঃখের কাহিনী শোনাল। তাকে আশ্বস্ত করে তারিণীবাবু বললেন, 'চিন্তার কিছু নেই, ওতে চলে যাবে ,মন দিয়ে কাজ করো।' পরের দিন সেই একই ঘটনার
পুনরাবৃত্তি করল বনমালী। প্রাপ্তি ঘটলো চার আনা।
মনে মনে তার বেশ মজা লাগছে আর জেদটা যেন পেয়ে বসছে। তৃতীয় দিনে জলে ডুবে ডুবে
পাওনা হলো আট আনা। আজ মনটা তার বেশ খুশি হয়ে
উঠল। একটা ব্যাপার বনমালীর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
আগে সারাদিনের খাটুনির সমস্ত পয়সাতে যে প্রয়োজনগুলো মেটানো সম্ভব হতো না, এখন তা এই চার আনা,আট আনাতে মিটে যাচ্ছ । ঠাকুরমশাইয়ের কথা মতো
সে কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে চেষ্টা করল।
এমনি করে সপ্তম দিনের মাথায়
বনমালী ষোল আনাই পেয়ে গেল। তার আনন্দ দেখে কে! ভীষণ খুশির মধ্যে একটা সার সত্য
কিন্তু বোকা বনমালী উপলব্ধি করতে পারল যে, এতোদিন
তার কাজের মধ্যে ফাঁকি ছিল তাই অভাবও ছিল তার নিত্যসঙ্গী। পরের দিন সন্ধ্যায়
বনমালী বেশ হৃষ্টচিত্তে ঠাকুর মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল। তাকে হঠাৎ দেখে
তারিণীবাবু যথেষ্ট আপ্যায়িত স্বরে বলে উঠলেন,'এসো
এসো বনমালী, বোস। তোমার কি খবর বলো।'
বনমালী ঠাকুরমশাইকে খুব
ভক্তিভরে প্রণাম করে বলতে লাগল,'বাবা ঠাকুর তুমি দেপ্তা
লোক। আশীর্বাদ করো ভগবান যেন এমনি সুমতিটা আমার বজায় রাখে!'
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন