জরায়ুর অভ্যন্তরীণ আস্তরণ বা
টিস্যুকে এন্ড্রোমেট্রিয়াম বলে। কখনো জরায়ুর এই অভ্যন্তরীণ টিস্যু যদি জরায়ুর
অভ্যন্তরের পরিবর্তে বাইরে ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী বা
মলাশয়ের গাত্রে (রেক্টাম) অবস্থান করে, তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস
(Endometriosis) বলে।
লক্ষণঃ
সাধারণত রজঃস্রাব শুরু হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর থেকে এন্ডোমেট্রিওসিসের বৃদ্ধি শুরু হয়। প্রাথমিক উপসর্গ
তলপেটের যন্ত্রণা, যা সিংহভাগ ক্ষেত্রে ঋতু চলাকালীন
হয়। অনেকের ক্র্যাম্প হয়, তবে এন্ডোমেট্রিওসিস হলে
স্বাভাবিকের তুলনায় ঋতুকালীন যন্ত্রণা অনেক অনেক বেশি হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
যন্ত্রণা বাড়তেও পারে।
কয়েকটি লক্ষণের মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়ামের সম্বন্ধে অবগত হওয়া সম্ভব। যেগুলো হল-
যন্ত্রণাদায়ক ঋতুস্রাব - ঋতুস্রাবের আগে ও পরে বহুদিন শ্রোণী সংলগ্ন অংশে এবং তলপেটের কাছে তীব্র যন্ত্রণা। ৭০% ক্ষেত্রে ঋতুকালীন সময় তলপেটে তীব্র ব্যথা হয়। এই ব্যথা ঋতুস্রাবের ৫-৭ দিন আগে শুরু হয়ে ঋতুকালীন সময়ে তীব্র আকার ধারণ করে। এমনকি ঋতুস্রাব শেষ হওয়ার পরেও তলপেটে মৃদু থেকে তীব্র ব্যথা থেকে যায়।
সঙ্গমের সময় যন্ত্রণা - এই ক্ষেত্রে যৌনসঙ্গমের আগে ও পরে ব্যথা হতে দেখা যায়।
মলমূত্র ত্যাগের সময় যন্ত্রণা - সাধারণত ঋতুস্রাব চলাকালীন মলমূত্র ত্যাগের সময়েও তীব্র যন্ত্রণা হয়।
অতিরিক্ত ঋতুস্রাব - অনেকসময় স্বাভাবিকের থেকে অত্যধিক হারে ঋতুস্রাব নিঃসৃত হয়। ২০% ক্ষেত্রে ঋতুকালীন সময় অতিরিক্ত রক্তস্রাব হতে পারে।
বন্ধ্যাত্ব – অনেকক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার সময় এটা ধরে পড়ে যে রোগিনীর এন্ডোমেট্রিওসিস আছে।
অন্যান্য উপসর্গ - অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে ক্লান্তি, বমি বমি ভাব (বিশেষ করে ঋতুস্রাব চলাকালীন), আমাশয় বা কোষ্ঠকাঠিন্য, জ্বর, মাথা যন্ত্রণা দেখা যায়। এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে যন্ত্রণা বেশি হওয়া মানে রোগ তীব্র পর্যায়ে রয়েছে। প্রবল যন্ত্রণা হওয়া সত্ত্বেও কারও রোগ মৃদু পর্যায়ের কিংবা সামান্য যন্ত্রণা হওয়া সত্ত্বেও কারও রোগ তীব্র পর্যায়ের হতে পারে। এন্ডোমেট্রিওসিসকে অনেক সময় তলপেটে যন্ত্রণা সৃষ্টিকারী অন্যরোগ যেমন, জরায়ুর ফাইব্রয়েড কিংবা ওভারিয়ান সিস্টের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়।
অনেকসময় শ্রোণী প্রদাহকে পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিসিজ অথবা ওভারিয়ান সিস্ট ভেবে
ভুল করতে দেখা যায়। এন্ডোমেট্রিওসিসের
সময় পেটখারাপ এবং ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা যায়। এটাকে অনেকে
আবার ইরিটেবল বাওয়াল মুভমেন্ট ভেবে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন
না। ফলে অনেকক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিওসিস খুব খারাপ স্তরে না পৌঁছালে সেটিকে শনাক্তকরণ
করা সম্ভব হয় না। তাই ঋতুস্রাবের সময় কোন অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হলে তৎক্ষণাৎ
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
কারণঃ
যদিও এর আসল কারণ এখনও পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি। তবে সম্ভাব্য কারণের বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে –
বিপরীতমুখী ঋতুস্রাব – এইপ্রকার ঋতুস্রাবের সময় মাসিকের রক্ত শরীরের বাইরে নির্গত হওয়ার পরিবর্তে পুনরায় ফ্যালোপিয়ান টিউব এবং শ্রোণীদেশে ফিরে যায়। এর ফলে এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু শ্রোণীদেশ এবং শ্রোণীদেশ সংলগ্ন অঙ্গের গায়ে লেগে যায় এবং আস্তে আস্তে সেটি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ফলস্বরূপ প্রতি ঋতুস্রাবের সময় সেই অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হয়।
পেরিটোনিয়াল কোষের পরিবর্তন - বিশেষজ্ঞের মতে অনেকসময় হরমোনের প্রভাবে পেরিটোনিয়াল কোষ যেটি আমাদের উদরগহ্বরের অভ্যন্তরে থাকে, সেটি এন্ডোমেট্রিয়াল কোষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এর প্রভাবে এন্ডোমেট্রিওসিস সমস্যাটি সৃষ্টি হতে পারে।
এন্ডোমেট্রিয়াল কোষের পরিবহন - অনেকসময় রক্তবাহিকা বা লসিকাবাহিকার মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ শরীরের অন্য অঙ্গে বাহিত হতে পারে।
যে সব মহিলাদের ঝুঁকি বেশি
·
২৫-৪৫ বছর বয়সী নারী
·
যাঁদের
সন্তান হয়নি বা বন্ধ্যাত্ব আছে
·
খুব কম বয়সে ( ৮-৯
বছর) যাঁদের ঋতুস্রাব
শুরু হয়েছে
·
যাঁরা
প্রথম সন্তান দেরিতে নিয়েছেন
·
যাঁদের
পরিবারে এই রোগের ইতিহাস আছে
·
ঋতুচক্র
যদি ছোট হয় (যেমন, ২৭ দিনের কম)
·
৭
দিনেরও বেশি সময় ধরে যাঁদের ঋতুস্রাব হয়।
·
ইস্ট্রোজেন
মাত্রা বেশি থাকলে।
·
বি
এম আই কম হলে।
সমস্যা
এন্ডোমেট্রিওসিসের প্রভাবে বিবিধ রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়-
বন্ধ্যাত্ব
অল্প বয়সে ঋতুস্রাবের সূচনা
বেশি বয়সে ঋতুস্রাবের সমাপ্তি
স্বল্প দৈর্ঘ্যের ঋতুচক্র
নিম্ন মানের বডি মাস ইন্ডেক্স
জনন অঙ্গের সমস্যা
অতিরিক্ত সময় ধরে রোগ নির্ণয় না হলে পরবর্তীকালে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।এন্ডোমেট্রিওসিসের মূল সমস্যাটি হল সন্তান ধারণ করা। এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু যদি জরায়ুর চারিদিকে আবৃত করে থাকে, তবে ডিম্বাণু জরায়ু থেকে বাইরে আসতে পারে না। এই টিস্যু আবার শুক্রাণুকে ডিম্বনালীতে প্রবেশ করতে বাধা দান করে। নিষিক্ত ডিম্বাণুও জরায়ুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না অনেক ক্ষেত্রে। এর ফলে সন্তান ধারণে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়।
তবে কি এন্ডোমেট্রিওসিস হলে কখনো মা
হওয়া সম্ভব নয় ?
এটি একেবারেই অসত্য। বর্তমানে চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতির মাধ্যমে অনেক অসাধ্য
সাধন করা সম্ভব হয়েছে। শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে এই এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু
যেটি বাধা দান করছে , সেটিকে বাদ দেওয়া সম্ভব। এর ফলে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিষেকের
সময় কোনরকম কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না।
যদি শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে এটি করা সম্ভব না হয়, তবে ইন্ট্রাইউটেরিয়ান ইনসেমিনেসান
পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে শুক্রাণুকে সরাসরি জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত
করা হয়। তাছাড়া ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) অর্থাৎ টেস্টটিউব
বেবীর মাধ্যমে এই কাজটা করা সম্ভব। সন্তান ধারণে সমস্যা
হলে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বা
ইনফার্টিলিটি ফিজিশিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করানো উচিত।
চিকিৎসা
ব্যথা উপশমকারী অসুধঃ এন্ডোমেট্রিওসিস যদি খুব সামান্য মাত্রার হয়, তেমন উল্লেখযোগ্য উপসর্গ না থাকে এবং অবিবাহিত বা নতুন বিবাহিত, যাঁরা বাচ্চা নিতে প্রস্তুত এবং যাঁদের মেনোপজ আসন্ন, এমন মহিলাদের চিকিৎসা না করলেও চলে। সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে ব্যথার ওষুধ যথা anti-inflammatory drugs (NSAIDs), ibuprofen (Advil, Motrin IB প্রভৃতি) অথবা naproxen sodium (Aleve) জাতীয় ওষুধ দিয়ে ঋতুকালীন ব্যথা প্রশমণ করা হয়।
হরমোন চিকিৎসাঃ
- হরমোন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেঃ অনেক সময় উপযুক্ত হরমোন ওষুধের প্রয়োগেও এই রোগের উপশম করা হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি বা প্রজেস্টেরোন বড়ি একটানা ৯ - ১২ মাস খেলে অথবা জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রজেস্টেরোন ইনজেকশন বা মিরেনা (mirena) ব্যবহারের মাধ্যমেও এন্ডোমেট্রিওসিসের টিস্যুগুলো শুকিয়ে যায়। ওরাল পিল নিয়ে অনেকের মনেই ভুল ধারণা আছে। অথচ এন্ডোমেট্রিওসিসের গোড়ার দিকে ওরাল পিল দিয়ে চিকিৎসা করলে রোগকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- গোনাডোট্রপিন রিলিসিং হরমোন (Gn-RH) -এর উপযুক্ত ব্যবহারঃ এই ধরণের ওষুধ ডিম্বাশয়ের উদ্দিপক হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে, ইস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসরণ কমায় এবং ঋতুস্রাবকেও নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে রজঃস্রাব বন্ধ করে কৃত্রিম মেনোপজ ঘটে এবং এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু শুকিয়ে যায়।
অস্ত্রোপচারঃ অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে এবং প্রাথমিক অল্প পরিমাণ এন্ডোমেট্রিওসিস আক্রান্তদের ক্ষেত্রে কিছু অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু ও ডিম্বাশয় থেকে এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু তুলে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। তবে এই ক্ষেত্রে পুনরায় টিস্যু ও যন্ত্রণা ফিরে আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাড়াবাড়ি রোগের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা দরকার। অস্ত্রোপচার করে প্রয়োজন অনুসারে সিস্টগুলোকে কাটা ও এন্ডোমেট্রিওসিসের টিস্যুগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা যায় এবং জরায়ু ও তার আশেপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে অনেকটাই ঠিক করা সম্ভব। এই ব্যাপারে ভয় পেলে চলবে না।
হিস্টেরেক্টটোমি (hysterectomy)ঃ জটিলতম ( severe and acute) ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ জরায়ু, ডিম্বাশয় এবং সারভিক্স অপারেশনের মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়। টোটাল হিস্টেরেক্টটোমি করা হলে পরবর্তী পর্যায়ে বেশ কিছু শারীরিক অসুবিধা যেমন – শুষ্ক যোনি,হট ফ্লাশ, খাবারে অনীহা, অবসাদ, হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগ এবং কিছু ক্ষেত্রে হৃদরোগ (cardiovascular) হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে ইদানিংকালের উন্নত মানের চিকিৎসা পদ্ধতিতে হরমোন থেরাপির মাধ্যমে এই সমস্ত শারীরিক অসুবিধাও দূর করা সম্ভব হয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ নির্ণীত হয় না। জটিল ও
দুরারোগ্য এই রোগের উপসর্গ ওপর আরও অনেক রোগের কারণ নির্দেশ করার ফলে এই রোগ নির্ণয়
করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে শরীরের গভীরে এটি বিস্তার লাভ করে। সঠিক সময়ে রোগের চিকিৎসা
রুগীকে সুস্থতা দান করতে পারে। তাই ছোট ছোট উপসর্গগুলিকেও অবহেলা করে জীবন সংকট তৈরি
না করাই উচিত।
কলমে - সুকৃতি দাস
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন