আজ পিন্টুর গ্রুপ ডি-র
পরীক্ষা ছিল, তাও বেশ অনেকেই আসেনি
পরীক্ষাটা দিতে। কিছু জায়গায় বন্ধ্ ডেকেছে আজ, কিন্তু
সব জায়গায় নয় বলে পরীক্ষাটা বাতিল করেনি। পিন্টুও ভাবছিল আসবে কিনা। সিট পড়েছে
অনেক দূরে, ভেতরের কোন এক পাড়া গাঁ
এলাকায়। প্রথমে ট্রেন, তারপর বাসে কিছুটা, সেখান থেকে নেমে হেঁটে। অনেক ঝক্কিও পোহাতে
হয়েছে আসতে গিয়ে। ট্রেন চললেও বাস অল্প সংখ্যায় চলছে।
কিন্তু পরীক্ষাটা দিতেই
চাইছিল ও। পুলকদার হোটেলে সারাদিন কাজ করার পর যেটুকু সময় পেয়েছিল তাতে এই
পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিল পিন্টু। সেটা মাঠে মারা যেতে দিতে একেবারেই মন সায়
দিচ্ছিল না ওর। চাকরিটা পাবে কিনা পরের ব্যাপার, চেষ্টা
করতে ক্ষতি কি! সে যাই হোক, পরীক্ষা দেওয়ার পর
বেরিয়ে খুব খিদে পেয়েছে। এতদূরে সিট পড়ায় অনেক সকালে বেরোতে হয়েছে বাড়ি থেকে, কিছু খাওয়ারও সময় পায়নি। তেমন কোনো দোকানও
নেই এখানে। স্টেশনটাও তেমনি,
দু'চারটে দোকান যাও বা আছে, বিড়ি সিগারেট চিপসের।
একটু ভাত হলে মন্দ হতো না, ভেবেই হাসি পেয়ে যায় ওর। এমন জায়গায় আবার
ভাতের হোটেল! সামনে একটা দোকান আছে বটে, গিয়ে
দেখতে হবে কি কি পাওয়া যায়। কাঁচের বাক্স মতো করা। একটাতে কিছু কচুরি আছে, কখনের কেজানে! একটা পাত্রে ঘুগনি আছে, আরেকটায় কিসের একটা তরকারি, আরো কিছু আছে মনেহয়। কৌটোতে বিস্কুট রাখা
আছে ক'টা। অল্প সংখ্যক শোনপাপড়ি, লাড্ডু এসবও আছে, সবই কাঁচের মোটা শিশিতে।
এখান থেকেই কিছু খেতে হবে তাহলে। দোকানের পাশের বেঞ্চে গিয়ে বসে পিন্টু। দু'টো লম্বা বেঞ্চ মুখোমুখি, মাঝে একটা লম্বা সরু মতো টেবিল পাতা। দোকানদার দু'জন লোকের সাথে গল্পে মগ্ন। ফাঁকা হয়ে গেছে জায়গাটা, সবাই চলে গেছে যে যার মতো। দূরের পানে চেয়ে আপনমনে আজকের পরীক্ষার কথা ভাবতে থাকে পিন্টু। হঠাৎ ঠকাস করে সামনে থালা রেখে দিয়ে যায়, ভাত আর ডাল তাতে। চমকে উঠে থালার দিকে তাকিয়েই মনটা খুশি হয়ে যায় পিন্টুর। চেটেপুটে খেয়ে নেয় সবটা।
"দাদা, কতো হলো?"
"কি কতো হলো?"
"ভাত আর ডাল?"
"কিসের ভাত আর ডাল?"
"কেন? ওই যে দিয়ে গেলেন?"
দোকানদার আর লোকদু'টো মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
"ভাত ডাল কোথা থেকে দেবো? আমি এসব রাখি না। কচুরি আর সাথে অন্য তরকারি আছে। কি বলছেন বলুন তো?"
হতভম্ব হয়ে যায় পিন্টু। তাড়াতাড়ি করে টেবিলটা দেখে, কোথায় গেল ওর থালাটা! দোকানের কাঁচের বাক্সগুলো দেখতে থাকে। সত্যিই তো! কোথায় ভাত ডাল? কিন্তু খেয়েছে তো অবশ্যই, টেবিলে রাখা জগের জল দিয়ে হাতও ধুয়েছে। পেটটাও ভরে গেছে বেশ।
সারাটা রাস্তা ভাবতে ভাবতে ফেরে সে, কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। সেইদিনের ঘটনার কথাও মনে পড়ে না ওর, এই ক'মাস আগে যখন প্রথম প্রথম পুলকদার ভাতের হোটেলে কাজ নিয়েছিল। মোটামুটি ভালোই চলে হোটেলের ব্যবসা, সকাল থেকেই ব্যস্ততা লেগে থাকে। সকলের সামনে ভাতের থালা পরিবেশনের ফাঁকে পিন্টুর চোখ যায় রাস্তার ওপারের বুড়ো ভিখারিটার উপর, দু'দিন ধরে দেখছে সে। কি মনে হতে থালায় ভাত আর তার উপর একটু ডাল নিয়ে দিয়ে আসে ওকে। বুড়োমানুষটা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ওর দিকে, যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে ডালভাতটা ওর জন্যই আনা। খাওয়ার শেষে থালাটা ফেরত দেওয়ার সময় কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠেছিল সেই চোখদু'টোয়।
থালা নিয়ে হোটেলে ফিরে আসার পর খুব বকাবকি শুনতে হয়েছিল পুলকদার কাছে। আর কখনও এরকম করলে ওর মাইনে থেকে কেটে নেওয়া হবে এমনটাও শাসিয়েছিল পুলকদা। পরদিন থেকে আর দেখা যায়নি ভিখারিটাকে। হয়তো অন্য কোথাও চলে গেছে, ভেবে নিয়েছিল পিন্টু। ভুলেও গেছে তার কথা।
সারাটা দিন ধরে ডালভাতের ঘটনাটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল ওর মাথার মধ্যে। রাতে শুতে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই বুড়ো মানুষটার মুখখানা মনে পড়ে গেল ওর। কর্মফল বুঝি এভাবেই পাওয়া যায়, সে লৌকিক হোক বা অলৌকিক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন