বিদ্যাসাগর ও বিধবাবিবাহ প্রচলনের গোড়ার কথা

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 


হা পরমেশ্বর, কোন মহৎ পাপে এদেশে কন্যাগণ জন্ম লভিতে আসে!

 আর যেন অবলাগণ এ পোড়া দেশে জন্মগ্রহণ না করে...

এদেশ নারীশূন্য হউক...

 -ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

 

************

 

সালটা ১৮৫৩। হুগলী বর্ধমান সীমান্ত অঞ্চলে দশঘরার কাছে এক অভিজাত বাড়ি। বেলা ১১টা হবে। ঘরের মধ্যে আয়োজন করা হয়েছে এক আলোচনা সভার। পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত, রয়েছেন গৃহকর্তা স্বয়ং। জলখাবারে লুচি, ছোলার ডাল, নানা মিষ্টি পরিবেশিত হচ্ছে। সুখাদ্যের সুঘ্রানে ঘর মাতোয়ারা। আহার সমাপনে হবে আলোচনা। বিষয়বস্তু একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যাতে মেয়েদের জন্যও শিক্ষার সুযোগ থাকবে। গৃহকর্তা উদার মানসিকতা সম্পন্ন। তিনি খুবই উদ্যোগী এই ব্যাপারে। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা মেয়েদের বাইরে আসতে দিতে নারাজ। তাই আজ তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমন্ত্রন জানিয়ে এনেছেন মানুষকে বোঝানোর জন্য। চলছে তারই প্রস্তুতি।

এমন সময় একটি ছোট্ট ৬-৭ বছরের মেয়ে দৌড়ে এলো ঘরে, পড়নে সাদা থান, বেশভুষায় বৈধব্যের লক্ষণমেয়েটি করুন স্বরে বলল,

বাবা বাবামা কে বলোনা, আমার খুব খিদে পেয়েছে। দাদারা লুচি খাচ্ছে, আর আমি চাইলেই মা বলছে, ‘ছিঃ আজ একাদশী না।খাবার কথা বলতে নেই মা’। কিন্তু বাবা,আমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাইনি। একটু জল পর্যন্ত না। তুমি, মা, দাদারা কেউ একাদশী করোনা। আমায় কেন করতে হবে! আমার বুঝি খিদে পায়না?”

সকলের সামনে লজ্জায়, আর মেয়ের প্রতি মায়ায় করুন হয়ে ওঠে জমিদারবাবুর মুখ। আস্তে করে বলেন,

এখানে সভা চলছে মা, তুমি ঘরে যাও।

করুন দৃষ্টিতে সকলের পাতের দিকে তাকিয়ে বিফল মুখে ভেতরের ঘরে ঢুকে যায় একরত্তি অভাগা মেয়েটি। আর তারপরেই রূপোর থালাবাটিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্য সুখাদ্য সাজিয়ে ঘরে আসে বামুন ঠাকুর। বিদ্যাসাগর বলেন,

শরীরটা ঠিক নেই, আমি খাবোনা কিছু। নিয়ে যাও।”

বামুন ঠাকুর নিয়ে যান থালা ধরে। গৃহকর্তার অনুরোধ উপরোধেও দাঁতে কাটেন না কিচ্ছু। শুরু হয় সভা। গ্রামের মানুষদের কাছে প্রথমেই তিনি তুলে ধরেন নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। সমাজে নারীদের অবদানের কথা। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে ধরেন পশুপালন, কৃষিকাজ সবকিছুরই সূত্রপাত নারীদের হাত ধরে, সেই অমুল্য তথ্য। এক এক করে বলে চলেন ইউরোপে কিভাবে শিক্ষিত নারীরা বিপ্লবে, সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে তার উদাহরণ। জোরালো আপত্তি ওঠে গ্রামের মানুষগুলির কাছ থেকে। ইউরোপের কথা বাদ দিন, আমাদের ধর্মে সমাজে নারীদের বাইরে বেরনো, শিক্ষা নেওয়া পাপ। ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়েন বিদ্যাসাগর। কালিদাস কার বরপুত্র? শিক্ষার জন্য আমরা কার কাছে প্রার্থনা করি? দেবী সরস্বতী, তিনি একজন নারী। এর পরেও বলবেন পাপ? তারপর বেদের পাতা থেকে তুলে আনেন অপালা, ঘোষা, গার্গী, লোপামুদ্রাদের। নারী শিক্ষা বিষয়ে শ্লোকগুলি বলতে থাকেন একের পর এক। তীক্ষ্ণ যুক্তি, উদাহরণ আর বাগ্মীতার সামনে ভেঙে পড়ে সংস্কারের দেওয়াল। সকলে সম্মত হন নারীশিক্ষার বিষয়ে। বিদ্যাসাগর মহাশয় উপলব্ধি করেন, ইউরোপ নয়, সংস্কার ভাঙতে হবে বেদ কে হাতিয়ার করেই। গৃহকর্তার মুখে তখন বিজয়ীর গৌরব

সকলে চলে যাবার পর গৃহকর্তা বলেন,

এবার আপনার ভোজনের ব্যবস্থা করি। একাদশী তাই অন্নের ব্যবস্থা নেই। এইবার লুচি খান কয়েকটা। শরীর আশা করি সুস্থ হয়েছে।

বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,

শরীর আমার সুস্থই আছে, ক্ষত আমার মনে। আমি নারীদের শিক্ষার জন্য ছুটছি, কিন্তু এই বিধবা নারীরা, তাদের দুঃখ, তাদের প্রতি এই ধর্মীয় অমানবিকতা -- এই দিকে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলাম আমি। ছিঃ ছিঃ, ভাবতেই আমার গ্লানি হচ্ছে। রামমোহন রায় মহাশয় তাদের বাঁচিয়ে ছিলেন জ্বলন্ত চিতা থেকে। কিন্তু ওরা মরছে, রোজ জ্বলছে খিদেয়, অবহেলায়, অমানবিকতায়। আপনার কন্যা আজ চোখ খুলে দিয়েছে। আচ্ছা, আপনি পারেন না, মেয়ের পুনর্বিবাহ দিতে? ওর সামনে তো সারা জীবনটা পড়ে আছে। ও বাঁচুক নতুন করে। বিদেশে তো কতো হচ্ছে। আপনি শুরু করুন।

গম্ভীর হয়ে উঠলো গৃহকর্তার মুখ। তিনি বললেন,

প্রথমত সমাজ মানবে না। আমাদের প্রাচীন ধর্মেও এর কোন স্বীকৃতি নেই। তারপর হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টেও রি-ম্যারেজের কোন আইন নেই। তাই ওর কপাল নিয়েই ওকে এইভাবেই বাঁচতে হবে। আমি নিরুপায়।

বিদ্যাসাগর মহাশয় বললেন,

স্ত্রী শিক্ষার পাশাপাশি আমার নতুন লড়াই শুরু হোল। এদেশের ছোট ছোট অসহায় বিধবা কন্যাদের বাঁচানোর লড়াই। সমাজ এবং আইন দুটোই পরিবর্তন করবো। শপথ নিলাম আজ। আমায় বিদায় দিন।

 জলগ্রহন না করে বেরিয়ে পরলেন তিনি।

শুরু হোল লড়াই, আক্ষরিক অর্থেই লড়াই। একদিকে কলেজে অধ্যাপনা, বই ছাপানোর কাজ, তাঁর গড়ে তোলা বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ, সেগুলিকে তো আর বন্ধ হতে দেওয়া যায় না, তার সঙ্গে রাতের পর রাত জেগে বেদ-উপনিষদ-পুরাণ-সংহিতা ঘেঁটে চলা, কোথায় আছে নারীর পুনর্বিবাহের বিধান। সিন্ধুর থেকে মুক্তো তোলার মতোই কঠিন সে অনুসন্ধান। দিনের পর দিন,রাতের পর রাত।অবসরের সময় কই? এর সঙ্গে কলকাতার শিক্ষিত সমাজের স্বাক্ষর সংগ্রহসরকারের কাছে বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য পিটিশন জমা দেওয়া। এদিকে শুরু হয়েছে নতুন বিপত্তি। কলকাতার রক্ষনশীল দল, পুরোহিত সমাজ বিধবা বিবাহের ঘোর বিপক্ষে। তারা কিছুতেই মেনে নেবেনা এই অনাচার। তারা পাল্টা আবেদন করেছে সরকারের কাছে, ধর্মবিরোধী এই আইন চালু হলে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে তারা। বিদ্যাসাগরের বাড়ির সামনে চলছে প্রতিবাদ ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ঝড়। নারীদের প্রতি তাঁর সহানুভুতি নিয়ে অশ্লীল কটূক্তি। বাড়িতে যখন তখন পড়ছে ঢিল, ময়লা, আবর্জনা। একদিন বিদ্যাসাগরকে হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে রাস্তায়।

তাও কিন্তু বিদ্যাসাগর অনড়। লড়াই তাঁর জীবনে। যিনি ওই দারিদ্র কাটিয়ে কলকাতায় ছাপাখানার ব্যবসা খুলতে পারেন, যিনি উত্তাল নদী সাঁতরে পার হতে পারেন দুর্যোগের রাত্রে, যিনি নিজ খরচে ২১টি বালিকা বিদ্যালয় চালানোর সাহস দেখান, যিনি স্পর্ধা রাখেন ব্রিটিশের সামনে জুতো পড়া পা তুলে ধরার, তার কাছে কোন বাধাই বাধা নয়। কিন্তু বড়লাটের দপ্তর বলেছে বেদ পুরাণে কী কোন উদাহরণ আছে পুনর্বিবাহের? না হলে আইন পাশ করা মুশকিল। রক্ষনশীলদের চটিয়ে কিছু করার ইচ্ছা নেই ডালহৌসির।

তাই রাতের পর রাত জেগে পুঁথি পত্র পড়ছেন তিনি। কম আলোয় চোখের সমস্যা হচ্ছে, ক্লান্তিতে অনিদ্রায় শরীর ভেঙে পড়ছে, হতাশা আসছে মনে। কিন্তু পরক্ষনেই চোখে ভাসছে ওই একরত্তি বিধবা মেয়েটির করুণ মুখখানি, সারা দেশের হাজার হাজার বিধবা নাবালিকার অসহনীয় জীবনের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছেন তিনি। আবার শুরু হচ্ছে তাঁর অন্বেষণ। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মনে বিধবা বিবাহ নামক চিন্তার সূত্রপাত সম্পর্কে এরকম বহু গল্প প্রচলিত আছে। শশিভূষণ সিংহের লেখায়,

বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একটি বাল্য সহচরী ছিল। ........ বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন কলিকাতায় পড়িতে আসেন, তখন ঐ বালিকার বিবাহ হয়; কিন্তু বিবাহের কয়েক মাস পরে তাহার বৈধব্য ঘটে। বালিকাটি বিধবা হইবার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় কলেজের ছুটিতে বাড়ীতে গিয়াছিলেন। বাড়ী যাইলে তিনি প্রত্যেক প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন, কে কি খাইল? ইহাই তাঁহার স্বভাব ছিল। এবার গিয়া জানিতে পারিলেন, তাঁহার বাল্যসহচরী কিছু খায় নাই; সে দিন তাহার একাদশী; বিধবাকে খাইতে নাই এ কথা শুনিয়া বিদ্যাসাগর কাঁদিয়া ফেলিলেন। সেই দিন হইতে তাঁহার সঙ্কল্প হইল, বিধবার এ দুঃখ মোচন করিব; যদি বাঁচি, তবে যাহা হয় একটা করিব।

 

বিদ্যাসাগরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকারও রাইমনি নামের সেই অভাগিনীর কাহিনীই তুলে ধরেছেন। তবে, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির মৃত্যুতে তাঁর বালিকাবধূর অকাল বৈধব্য বিদ্যাসাগরকে এই মহৎ কাজে ব্রতী হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে।

যে জ্বলন্ত চিতার আগুন থেকে বিধবাদের ফিরিয়ে এনেছিলেন রামমোহন রায় তার চেয়েও ভয়ঙ্কর তদানীন্তন সমাজের অত্যাচারের লেলিহান শিখায় ধিকিধিকি জ্বলছিল অসংখ্য ভাগ্য-বিড়ম্বিতা নারী সে জ্বালা অসহনীয়! শত শত বিধবারা ব্যাভিচার দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ছে , তাতে তাঁদের পতিকুল , পিতৃকুল ও মাতৃকুল কলুষিত হচ্ছে, সমাজে নিরন্তর বেশ্যাবৃত্তি বাড়ছে, নির্বিবাদে ভ্রুণহত্যা চলেছে বিদ্যাসাগর ভাবলেন বিধবাবিবাহ প্রচলিত হলে যদি এ জ্বালার থেকে খানিক রেহাই পাওয়া যায় অতএব সংসার-চিতার আগুন নেভানোর উদ্দেশ্যে বিধবা বিবাহের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পিত করলেন বিদ্যাসাগরএরপরই যথারীতি তাঁর শাস্ত্র-সমুদ্রে ঝাঁপ ও গভীর অবগাহন শুরু কারণ তিনি বুঝেছিলেন তখনকার পণ্ডিতমণ্ডলী এতো সহজে বিধবাদের যন্ত্রণার পঙ্কিল গহ্বর থেকে উঠে আসতে দেবেন না একমাত্র শাস্ত্রের কর্তব্য কর্মের দোহাই দিয়েই যদি বিধবা-বিবাহ প্রচলন করা যায় এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনাগ্রন্থে বলেছেন –

 

বিধবাবিবাহ কর্ত্তব্য কর্ম কিনা, অগ্রে ইহার মীমাংসা করা অতি আবশ্যক যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্ত্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এদেশীয় লোকে কখনই ইহাকে কর্ত্তব্য কর্ম বলে স্বীকার করিবেন না যদি শাস্ত্রে কর্ত্তব্য কর্ম বলে বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্ত্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন

ঊনবিংশ শতকের বাংলার সমাজ সংস্কার ও নারীমুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে রামমোহনের প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথার অবলুপ্তির পর বিধবা বিবাহের প্রবর্তন ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মধ্যযুগ থেকে প্রচলিত কৌলিন্য প্রথার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল স্বরূপ সমাজে প্রচলিত ছিল বহুবিবাহ, পণপ্রথা, সতীদাহ, বাল্যবিবাহের মত কুপ্রথাগুলি। পরিবারের সম্ভ্রম রক্ষার্থে অধিক বয়স্ক পাত্রের সাথে এমনকি অনেকসময় মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সাথে অল্পবয়সী(বালিকা বয়সে বা শিশু বয়সে) মেয়েদেরকে বিবাহ দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে। সমাজে ব্রাহ্মণরা বিবাহকে জীবিকা হিসাবে দেখত। তাই বৃদ্ধ বা পৌঢ় এমনকি মৃত‍্যু পথযাত্রী কিশোরী কন‍্যাদের বিয়ে করে মেয়েদের উদ্ধার করত। যার ফলশ্রুতি অকাল বৈধব্য। এই অল্পবয়সী বিধবাদেরকে সহমরণে যেতে অথবা ব্রহ্মচর্য পালনে বাধ্য করা হত। এই বাল্যবিধবাদের জীবন ছিল শোচনীয়। আমিষ খাদ্যগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে একাদশীতে নির্জলা উপবাস, কখনও আবার তারা পরিবারের লোকজনের দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। বৈধব্যের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেক মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিত আবার কেউ বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হত। সকলের পক্ষে দৈহিক কামনা বাসনা দমন করে ব্রহ্মচর্য পালন করা সম্ভপর ছিল না। যার অনিবার্য ফল ছিল ভ্রূণহত্যা। এভাবেই নরক যন্ত্রণা ভোগ করত বিধবারা।

 

ঊনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের বহু আগে মুঘল বাদশাহ আকবরের পরামর্শ দাতা আবুল ফজল, আকবরের সহায়তায় সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহের প্রচলনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এমনকি অষ্টাদশ শতকে (১৭৫৬ সালে) ঢাকার রাজা মহারাজা রাজবল্লভ তাঁর কন্যার বালবৈধব্যে বিচলিত হয়ে বিবাহের পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিকূলতায় তা ব্যর্থ হয়। বিদ্যাসাগরের পূর্বেই ঊনবিংশ শতাব্দীর চারের দশক থেকে ডিরোজিওর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকায় বিধবা বিবাহের পক্ষ নিয়ে তাদের চিন্তাধারা ও সংস্কার আন্দোলনের মত প্রকাশ করে ১৮৪২  খ্রিষ্টাব্দেবেঙ্গল স্পেক্টেটর’-এর রিপোর্ট অনুসারে বাংলায় বিধবা বিবাহ নিয়ে সর্বপ্রথম বিস্তৃত আলোচনা বা তর্কের ধারাবাহিক আয়োজন করা হয়। ফলে এ বিষয়ে  সমাজে ব‍্যাপক আলোচনা শুরু হয়। রাজা রামমোহন রায় নারী সমাজের কল‍্যাণে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ করেই ক্ষান্ত হন নি। ১৮১৫ সালে রামমোহন প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভা’ ১৮১৯-এ এই বিধবাদের সমস‍্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

 

ভারতীয় আইন কমিশন জে.পি. গ্রান্টের নেতৃত্বে ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে বিধবা বিবাহ প্রচলনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন। ভারতীয় আইন কমিশনের সেক্রেটারী গ্রান্ট সাহেব  এবিষয়ে কলকাতা, এলাহাবাদ, মাদ্রাজ সহ অন‍্যান‍্য এলাকার বিচারপতিদের মত চান এবং বিচারপতিগণ হিন্দু ধর্মীয় নিজস্ব বিষয়ে হস্তক্ষেপে দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও বিদ্রোহের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন। এ সময় রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ‍্যায়ের ভাই নীলকমল বন্দোপাধ‍্যায় ও পটলডাঙার শ‍্যামাচরণ দাস বিধবা বিবাহ প্রদানের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টাও ব‍্যর্থ হয়। এছাড়াও তত্ত্ববোধিনী গোষ্ঠী, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি ছাড়াও আরও অনেক সভা সমিতি বিধবা বিবাহের প্রবর্তনে আগে থেকেই উদ্যোগী হয়েছিল। কলকাতার প্রখ‍্যাত ধনী মতিলাল শীল  বিধবা বিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করে অসফল হন। এ সময় বিধবা বিবাহ শাস্ত্রীয় ভাবে  সমর্থন করে এগিয়ে আসেন কয়েকজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। তাদের মধ্যে কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, ভাস্কর বিদ‍্যারত্ন, ঠাকুরদাস চূড়ামণি, হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত, মুক্তারাম বিদ‍্যাবাগীশ, রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ ছিলেন অন‍্যতম। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা তাদের উদ্যোগকে গতিশীল করে তোলে।

 

বিধবা বিবাহ প্রচলন নিঃসন্দেহে তৎকালীন সমাজের এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিদ্যাসাগর জ্ঞাতি-গোষ্ঠী-সমাজের বিপরীতে গিয়ে সুদীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেন। তৎকালীন কলকাতার প্রতিষ্ঠিত সমাজনেতা রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের সাথেও তাঁর মতান্তর হয়েছে এবং রাধাকান্ত দেব বিধবা বিবাহের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। রাধাকান্ত দেবের দৌহিত্র আনন্দকৃষ্ণ বাবু বিদ্যাসাগরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আনন্দকৃষ্ণ বাবু বলেছেন,

 

কোন বালিকা বিধবা হইয়াছে শুনিলে বিদ্যাসাগর কাঁদিয়া আকুল হইতেন। এই জন্য তাঁহাকে বলিতাম, তুমি কি ইহার কোন উপায় করিতে পার না? তাহাতে তিনি বলিতেন, শাস্ত্র প্রমাণ ভিন্ন বিধবা বিবাহের প্রচলন করা দুস্কর। আমি শাস্ত্র প্রমাণ সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছি।”

বিদ্যাসাগর তার পরম সুহৃদ রাজকৃষ্ণ বাবুকে বলেছিলেন যে শাস্ত্রীয় প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। রাজকৃষ্ণ বাবু লিখেছেন,

১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে একদিন রাত্রিকালে বিদ্যাসাগর মহাশয় ও আমি একত্র বাসায় ছিলাম। আমি পড়িতে ছিলাম। তিনি একখানি পুঁথির পাতা উল্টাইতেছিলেন। এই পুঁথি খানি পরাশর সংহিতা। হঠাৎ তিনি আনন্দে বেগে উঠিয়া পড়িয়া বলিলেন, ‘পাইয়াছি, পাইয়াছি।’ ”

রাজকৃষ্ণ বাবু কি পাইয়াছ?’ জিজ্ঞাসা করায়  তিনি তখন শ্লোকটি বললেন,

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।

পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরন্যো বিধিয়তে।”

 

অর্থাৎ স্বামী নিরুদ্দেশ হলে, মৃত হলে, ক্লীব হলে, সংসার ত্যাগ করলে অথবা পতিত হলে এই পাঁচ ক্ষেত্রে স্ত্রীগণের পুনরায় বিবাহ শাস্ত্র সঙ্গত।

 সমস্ত কলকাতায় আগুন জ্বলে উঠল। বিধবার আবার বিয়ে হবে? সে কি কথা। তর্ক বিতর্কের ধূম পড়ে গেল। সমাজের যারা মাথা তারা সব বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করতে লাগল। বিদ্যাসাগরের সমর্থক অতি নগণ্য। বিদ্যাসাগরের সমর্থকগণ সংখ্যায়  এত নগণ্য ছিলেন যে তারা কোন প্রতিবাদ করার অবস্থায় প্রায় ছিলেন না। বিধবা বিবাহ সমাজে নারীদের স্বার্থে কিন্তু নারীরা তখন গৃহে অন্তরীণ। তাদের সমর্থন পাওয়ার কোন আশাই ছিল না। আর পুরুষরা কেউ একঘরে হওয়ার ভয়ে আর কেউ বা সমাজ নেতৃত্বের থেকে সুবিধা ভোগের আশায় বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন নি। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসকরা তাঁকে সমর্থন করেছেন। জন সমর্থনের আশায় বিদ্যাসাগর লিখলেনবিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না” নামক ২২ পৃষ্ঠার বই। ১৮৫৪  সনের ২৮শে জানুয়ারী বইটি প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের সাত দিনের মধ্যে সমস্ত কপি বিক্রি হয়, প্রথম সংস্করণ দুহাজার কপি মুহূর্তে উড়ে গেলো, তিনি আরো ছাপালেন শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব  বাহাদুরের দৌহিত্র আনন্দকৃষ্ণ বাবু বলেছেন,

বিধবা বিবাহ হওয়া উচিত কি না; এই সম্বন্ধে পুস্তিকা মুদ্রিত করিয়া বিদ্যাসাগর আমাদের বাড়িতে আসেন। তাঁহার পুস্তিকার সুন্দর লিপিচতুরতা ও তর্ক প্রখরতা দেখিয়া আমরা বিমোহিত হইয়াছিলাম। স্বয়ং রাজা রাধাকান্ত দেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ডাকিয়া বলেন," দেখ তুমি যে প্রণালীতে পুস্তিকা লিখিয়াছ তাহা অতি মনোহর... এক দিন পণ্ডিত মণ্ডলীকে ডাকাইয়া এ সম্বন্ধে বিচার করাইবার ইচ্ছা করি। তুমি যদি সম্মত হও,‌ তাহা হইলে দিন ধার্য করিয়া পণ্ডিত মন্ডলী কে আহ্বান করি।”

 

বিদ্যাসাগর সম্মত হলেন। রাধাকান্ত দেব তাঁর লেখা ও যুক্তিতে তুষ্ট হয়ে তাঁকে একটি শাল উপহার দিয়েছিলেন। পণ্ডিত সমাজ মনে করল যে রাধাকান্ত দেব বিধবা বিবাহের সমর্থক। তারা সমবেত ভাবে রাধাকান্ত দেবকে বললেন,

আপনি কি সর্বনাশ করিলেন। আপনি কি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ রূপ পাপ প্রথার প্রচলন করিতে চাহেন। বিদ্যাসাগরকে পুরস্কৃত করিলেন কেন?”

রাধাকান্ত দেব উত্তরে বলেছিলেন,

আমি বিধবা বিবাহ প্রচলনের পক্ষপাতী নহি।..... তর্ক প্রণালীতে তুষ্ট হইয়া তাহাকে শাল উপহার দিয়াছিলাম।”

এ সংবাদ বিদ্যাসাগরের কাছে পৌঁছালে তিনি আশাহত হন। কারন তিনি আশা করেছিলেন যে রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর মহাশয়ের সমর্থন একাজে তিনি পাবেন। নির্ধারিত দিনে তর্কসভা অমীমাংসিত থাকল। পণ্ডিত সমাজ প্রশ্ন তুললেন যে পরাশর সংহিতা কলি যুগে কার্যকর নয় এবং বিদ্যাসাগর সে শ্লোকের অপব্যাখ্যা করেছেন। এর  উত্তরে বিদ্যাসাগর ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,

কৃতে তু মানবা ধর্মাস্ত্রেতায়াং গৌতমা স্মৃতাঃ।

দ্বাপরে শাঙখ লিখিতাঃ কলৌ পরাশরাঃ স্মৃতাঃ ।।”

 

অর্থাৎ মনুর ধর্ম সত্যযুগের, গৌতমের ধর্ম ত্রেতা যুগের , শাঙ্খের ধর্ম দ্বাপরের এবং কলিতে পরাশরের ধর্ম পালনীয়।

বিতর্ক ক্রমশ বাড়তে লাগলো। রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের স্ব-বিরোধী কাজের ফলে বিদ্যাসাগরকে অনেক বেশী শ্রম দিতে হয়। বিদ্যাসাগরের পুস্তিকার বিরুদ্ধে বহু পণ্ডিত বহু বই লিখলেন। যশোহর হিন্দু ধর্ম রক্ষিণী সভা, কলিকাতা ধর্ম সভা  প্রবল বিরোধিতা শুরু করে। পরাশর সংহিতা থেকে বিদ্যাসাগরের সেই শ্লোকটি মেনে নিয়ে পঞ্চানন তর্করত্ন ব্যাখ্যা করলেন যে এই শ্লোকের যথাযথ অর্থ হল-

 “যে পাত্রের সহিত বিবাহের কথাবার্তা স্থির হইয়া আছে, তাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে; তবে যদি ঐ ভাবী পতি নিরুদ্দেশ হয়মরিয়া যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব বলিয়া স্থির হয় বা পতিত হয়, তবে এই পঞ্চ প্রকার আপদে, ঐ কন্যা অন্য পাত্রে প্রদান বিহিত।”

 তিনি আরো বলেন যে বিদ্যাসাগর ঐ শ্লোকের পরের অংশ গোপন করেছেন যাতে বলা আছে,

 মৃতে ভর্ত্তরি যা নারী ব্রহ্মচর্যে ব্যবস্থিতা

সা মৃতা লভতে স্বর্গম যথা তে ব্রহ্ম চারিণঃ ।।

তিস্রঃ কোট্যোহর্ধকোটি চ যানি রোমানি মানবে।

যাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গঙ ভর্তারং যানুগচছতি।।

 

অর্থাৎ, যে নারী স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে স্বর্গলাভ করে। মনুষ্য শরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বর্গ বাস লাভ করে।

 

তাহলে সামগ্রীকভাবে, বিধবা নারীদের জন্য বিধান হল সহমরণে স্বামীর সঙ্গে এক চিতায় মৃত্যু বরণ করা অন্যথায় ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করা অথবা ঐ পাঁচ ক্ষেত্রে অন্য পাত্রে বিবাহ করা। এই পন্ডিতেরা আদিত্য পুরাণ, বৃহন্নারদীয় পুরাণ থেকে অনেক শ্লোক তুলে ধরে প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন যে হিন্দু বিধবার বিবাহের কোন বিধান হিন্দুশাস্ত্রে নেই। বিদ্যাসাগর প্রস্তাবিত বিধবা বিবাহ শাস্ত্র রহিত এবং শাস্ত্র নিষিদ্ধ। এবং স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু ধর্ম বিরোধী ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

 

জনৈক ব্যাকরণতীর্থ পণ্ডিত মতে পরাশর সংহিতার শ্লোকে যে ‘পতিরন্যো বিধীয়তে’ খুঁজে পেয়ে বিদ্যাসাগরের এত পুলক শ্লোকটির ওই অংশে প্রকৃতপক্ষে 'পতি' নাই, 'অপতি' আছেওই স্থলে সন্ধির নিয়ম অনুযায়ী অ-কারটি লুপ্ত হয়েছে। বস্তুত অ-কার ওখানে আছেই, আর তার ফলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে তাঁর  অভিপ্রেত অর্থের বিপরীত, ‘ ...এই পাঁচটি আপৎকালে নারীরা অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারেন না’।

 

বক্র হেসে বিদ্যাসাগর বললেন,

ছাত্রপাঠ্য সন্ধির নিয়ম আমি বিলক্ষণ অবহিত আছি। সন্ধি হওয়ার ফলে অ-কার যদি বিলুপ্ত হয়ে থাকে, তবে ওই স্থলে লুপ্ত অ-কারের চিহ্ন থাকার কথা। কিন্তু আলোচ্য শ্লোকে লুপ্ত অ-কারের চিহ্ন বা অবগ্রহ তাহলে কোথায় গেল?”

 বৈয়াকরণ উত্তর দিলেন,

প্রাচীন পুঁথি তো। তাই এক পুঁথি থেকে অন্য পুঁথি নকল করবার সময় লুপ্ত অ-কারের চিহ্নটি বাদ পড়ে থাকবে।

বিদ্যাসাগর শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন,

এমন আশ্চর্য অনুমানের হেতু কী? এমন কোনও প্রাচীন পুঁথি কি আপনার হস্তগত হয়েছে, যাতে ওই লুপ্ত অকারের চিহ্নটি পাওয়া যায়? যদি আপনি এমন কোনও পুঁথি পেয়ে থাকেন, সভাস্থ সকলকে দেখান।

 

ব্যাকরণবিদ নীরব হলেন। কল্পিত অনুমানের হেতুও কল্পিতই হয়। নানা প্রশ্ন উঠতে লাগল। বিদ্যাসাগর একেক করে সবগুলিই খণ্ডন করলেন। শেষে শাস্ত্রীয় যুক্তিতে পেরে না ওঠায় পণ্ডিতরা বাঁকা পথ ধরলেন।

তর্কচূড়ামণি এক পণ্ডিত নাকে নস্য নিয়ে রসালো ভঙ্গিমায় জিজ্ঞাসা করলেন,

বাপু হে, শুনিয়াছি বীরসিঙ্গা গ্রামে সুরবালা নাম্নী তোমার এক বাল্যসঙ্গিনী সম্প্রতি বিধবা হইয়ে পিতৃগৃহে আগমন করিয়াছে। সেই বাল্যসঙ্গিনীটিই কি তোমার এ মহৎ কর্মের প্রেরণা?”

ক্রোধে বিদ্যাসাগরের অধরোষ্ঠ কম্পিত হতে লাগল। হস্ত মুষ্টিবদ্ধ, চক্ষু দীপ্ত, স্কন্ধদেশ বঙ্কিম ও ভ্রুকুটি কুটিল। শ্লেষপূর্ণ বিকৃত স্বরে তিনি বলতে লাগলেন,

হাঁ, সেই অভাগিনী আমার প্রেরণা। কিন্তু সে একাই নয়, ওই যে ন্যায়রত্ন মশাই চোদ্দো বছরের বিধবা ভগিনীকে কঠোর ব্রত পালন করিয়ে নিজে তৃতীয়বার দারপরিগ্রহ করে সন্তান উৎপাদন করছেন, ওনার সেই চতুর্দশী বিধবা ভগিনীটিও আমার প্রেরণা। ওই যে ব্যাকরণ তীর্থ পণ্ডিত মহাশয় তাঁর ষোড়শী বিধবা কন্যাটি গত একাদশীর দিন ক্ষুধার জ্বালায় চুরি করে সামান্য চিপিটক আহার করেছিল বলে শিলনোড়া দিয়ে সেই বিধবা কন্যাটির কপালে আঘাত করে রক্তপাত ঘটিয়েছিলেন এবং তারপর অনুশোচনাহীন এই পণ্ডিত আজ এই সভায় লুপ্ত অ-কারের পিণ্ড আহার করছেন, ওঁর সেই বিধবা কন্যাটিও আমার এ কর্মের প্রেরণা, আর আপনি তর্কচূড়ামণি এই জরাগ্রস্ত দশায় নবমবর্ষীয়া যে কন্যার পাণিপীড়ন করেছেন, আপনি মরলে সেই কন্যাটিও বিধবা হবে, সেই কন্যাটিও আমার প্রেরণা!

 

বিদ্যাসাগরের এই ক্রোধাগ্নির সম্মুখে সন্ত্রস্ত এক পণ্ডিত জরদ্গবের মতো বলে উঠলেন,

আচ্ছা বেশ। স্বামীসংসর্গ হওয়ার আগেই বিধবা হয়েছে এমন অক্ষতযোনি কন্যার পুনর্বিবাহে আমার আপত্তি নেই।

এমন অশ্লীল প্রস্তাবের উত্তরে তিনিও সক্রোধে অশালীন উত্তর ফেরৎ দিলেন,

হাঁ, হাঁ, পণ্ডিত মহাশয়, আপনাকেই আমি ক্ষতাক্ষত বাছিবার ভার দিব। ছি, ছি! আমি ভাবিয়াছিলাম ইহা পণ্ডিত সভা। এখন দেখছি সভ্যতাবিগর্হিত মূর্খদের সমাবেশ!

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রস্তাবিত বিধবা বিবাহের বিরোধী শিবিরের এক অংশ বিশ্বাস করতেন যে আবেগপ্রবণ বিদ্যাসাগর মহাশয় আত্মসংযমে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর এই ভ্রান্ত বিশ্বাস তাকে এই অকীর্তিকর কার্যে লিপ্ত করে। সারল্য, স্ত্রী জাতির প্রতি অত্যাধিক মমতা, করুণা প্রাবল্যে তিনি হিন্দু শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ সমূহের অপব্যাখ্যা করেছেন। এরা মনে করতেন যে বিদ্যাসাগর “...স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে অকার্য করিবার লোক নহেন।

বিদ্যাসাগর মহাশয় তো দমবার পাত্র নন। তিনিও ল কমিটির পরীক্ষায় আইন পাশ করেছেন স্মৃতিশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ত্রিপুরার আগরতলায় জেলা জজ পন্ডিতের চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু দুরত্ব বিবেচনা করে তাঁর বাবা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় আপত্তি জানালে তিনি ঐ চাকরিতে যোগদান করেন নি।) অর্থাৎ তিনিও সিভিল ল বা দেওয়ানী বিধি বিশেষজ্ঞ। মনুস্মৃতি শাস্ত্র, যার ভিত্তিতে হিন্দুদের দেওয়ানী আইন ও বিচারালয় পরিচালিত হত সে মনুস্মৃতিতে তিনি ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তাই তিনিও এর উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন। বিধবা বিবাহ বিরোধী পন্ডিতেরা আদিত্যপুরাণ থেকে  তুলে ধরলেন,

দত্তায়াশ্চেব কন্যায়াঃ পুনর্দানংপরস্য চ।

ইমান ধর্মান কলিযুগে বর্জ্যানাহুর্মনীষিণঃ।।

 

অর্থাৎ একজনকে কন্যাদান করে সেই কন্যার অন্য বরে দান কলিযুগে বর্জনীয়।

বৃহন্নারদীয় পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁরা বলেন যে, দীর্ঘকাল ব্রহ্মচর্য, কমন্ডলু ধারণ, দেবর দ্বারা পুত্র উৎপাদন, দত্তা কন্যার দান মহাত্মা ব্যাক্তিগণ লোক রক্ষার প্রয়োজনে কলির আদিতে নিষিদ্ধ করেছেন।

তর্ক যুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন ধর্মশাস্ত্রের আদি পুরুষ বেদব্যাস রচিত সংহিতা থেকে তুলে ধরেন,

শ্রুতিস্মৃতিপুরাণানাং বিরধো যত্র দৃশ্যতে।

তত্র শ্রৌতংপ্রমানস্তু  তসোদ্ধর্ধে স্মৃতির্বরা।”

 

অর্থাৎ যেখানে বেদ, স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা দেবে সেখানে বেদই প্রমাণ এবং স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা দিলে স্মৃতিই প্রমাণ। বিদ্যাসাগর বেদব্যাস কৃত এ নিয়ম তুলে ধরে বলেন যে পরাশর স্মৃতির সাথে যদি আদিত্য পুরাণ এবং বৃহন্নারদীয় পুরাণের কোন বিরোধ দেখা দেয় তবে পরাশর স্মৃতির নির্দেশ কার্যকর হবে। অতএব কলিযুগে কার্যকরী পরাশর সংহিতা অনুসারে বিধবা বিবাহ শাস্ত্র সঙ্গত। প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগর কেন ঋগ্বেদ থেকে নির্দেশ উল্লেখ্ করেননি সেটি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কিন্তু ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের ৪০ নং সুক্তে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে,

 কুহ স্বিন্দোষা কুহ বস্তারোশ্বিনা কুহাভিপি‌ত্বং করতঃ কুহোষতুঃ

মোঃ বাং শযুত্রা বিধবেব দেবরং মর্য না ঘোষা কৃণুতে সধ্যস্থ আঃ।।”

 

অর্থাৎ, যেরূপ বিধবা রমনী শয়নকালে দেবরকে সমাদর করে, অথবা কামিনী নিজ কান্তকে সমাদর করে............- প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ঋকে বিধবার অসচ্চরিত্র অবলম্বন করা প্রকটিত হয়নি, স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর ভ্রাতা বা দেবরকে বিবাহ করার প্রথাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

 অথবা ঋক বেদের দশম মন্ডলের ১৮ নং সুক্তে,

 ইমা নারীরবিধবা সুপত্নী- রাঞ্জনেন সর্পিষা  সং বিশন্তু।

অনশ্ররোহনমীবাঃ সুরত্না আং রোহন্তু জনয়ো যোনিমন্ত্রে।।”

 

অর্থাৎ, বিধবা নারীরা বৈধব্য দুঃখ অনুভব না করে, মনোমত পতি লাভ করে অঞ্জন ও ঘৃতের সাথে গৃহে প্রবেশ করুন। এই সকল বধূ অশ্রুপাত না করে, রোগে কাতর না হয়ে উত্তম উত্তম রত্ন ধারণ করে সর্বাগ্রে গৃহে আসুন।

 

বিবাহ ব্যতীত তো পতি লাভ হয় না। অতএব ঋক বেদের এ ঋকে স্পষ্টভাবে বিধবা বিবাহকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। তাই বেদব্যাস প্রণীত সর্বোচ্চ আইনেই বিধবা বিবাহ সম্ভব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এছাড়া অনেক নজির ধর্ম শাস্ত্র থেকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু বিরোধী শাস্ত্রজ্ঞরাও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে নানা উদ্ধৃতি প্রদান করে বিদ্যাসাগর প্রস্তাবিত বিধবা বিবাহের সক্রিয় বিরোধিতা করতে শুরু করেন। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান বিরোধী ছিলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুক্তি উপস্থাপন ও বাগ্মীতায় সন্তুষ্ট হয়ে রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর যে তাঁকে শাল উপহার দিয়েছিলেন সে ঘটনা বিরোধী পণ্ডিতগণকে হতোদ্যম করে। এ অবস্থায় পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন বিতর্কে অবতীর্ণ হন।

ইতিমধ্যে রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের দৌহিত্র আনন্দকৃষ্ণ বাবু (যিনি বিধবা বিবাহ বিষয়ে বিদ্যাসাগর সমর্থক ছিলেন) বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বিধবা বিবাহ প্রস্তাব বাস্তবায়িত করার‍ জন্য অনুরোধ করেন। এতে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,

যখন এ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন ইহার জন্য প্রাণান্ত পণ জানিও। ইহার জন্য যথাসর্বস্ব দিব। তবে তোমার মাতামহ যদি সহায় হন, তবে এ কার্য অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে ও সহজে সিদ্ধ হইবে।”

 

কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আশা পূর্ণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তাই বিধবা বিবাহ বিরোধী নবদ্বীপ বাসী পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন যখন বিধবা বিবাহ বিষয়ে রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের বাড়ীতে এক বিতর্ক সভায় বিধবা বিবাহ বিরোধীতা করেন তখন সভা অমীমাংসিত থাকা সত্বেও রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর বিধবা বিবাহের বিরোধী পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন বাবুকেও একটি শাল উপহার দেন। সেই সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় রাজা রাধাকান্ত দেবের সমর্থনের আশা। যে তর্ক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা শুধু পণ্ডিত সমাজে সীমাবদ্ধ থাকল না। সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। সাহিত্যে, কাব্যে, গানে, নাটকে, কারখানায়, চাষের ক্ষেতে সর্বত্র বিধবা বিবাহের পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

 কবি সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার তার  মহিলাকাব্যে বিধবার যন্ত্রণার কথা লিখেছেন,

 ভালো ছিল হিন্দু দেশে সবলে বাঁধিয়া

বিনাশিত বিধবায় চিতায় দহিয়া,

এক দিনে এড়াইত জীবনের দায়,

দিন দিন আমরণ দহিত না অনুখণ,

শাসন বন্ধনে শুয়ে ক্ষোভের চিতায়।”

 

স্বভাব কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস লিখেছেন,

 নিবিল চিলাইর চিতা-- জ্বলিতে সর্বদা,

ঘরে গেল মহাচিতা --- বিধবা মোক্ষদা।”

 

হেমচন্দ্র তাঁর বিধবা রমনী কবিতায় লিখেছেন,

 বালিকা যুবতী ভেদ না করে বিচার,

নারীবধ কোরে তুষ্ট করে দেশাচার।

এই যদি এদেশের শাস্ত্রের লিখন,

এ দেশে রমনী তবে জন্মে কি কারণ?"

 

গিরিশ চন্দ্র ঘোষের “শাস্তি কি শান্তি” নাটকে বিধবা মেয়ে ও বিধবা পুত্রবধূর দুঃখ দেখে প্রসন্ন কুমার বলেছেন,

আগে চিতায় চেপে ধরে যে পুড়িয়ে মারতো সে যে ছিল ভালো। দিন দিন এ কি যন্ত্রণা। সন্তানের দিন দিন এ কষ্ট কি করে দেখবো। এ অধর্ম, এ নারীহত্যা, এ বালিকা হত্যা।”

কথিত আছে যে বিদ্যাসাগর এ নাটক দেখতে গিয়ে বিধবার দুঃখ দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ সনে অক্টোবর মাসে বিরোধী পণ্ডিতদের সমস্ত অভিযোগ খন্ডন করেবিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না” দ্বিতীয় পুস্তক  লিখলেন এবং এতে মানবিক আবেদন রেখে বললেন,

তোমরা মনে কর পতি বিয়োগ হইলেই স্ত্রী জাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়, দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া মনে হয় না, যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না; দুর্জয় রিপুবর্গ এক কালে নির্মূল হইয়া যায়। কিন্তু তোমাদের এই সিদ্ধান্ত যে ভ্রান্তিমূলক পদে পদে তাহার উদাহরণ প্রাপ্ত হইতেছ।”

 এ প্রসঙ্গে তিনি আরো লিখেছেন,

হায় কি পরিতাপের বিষয়! যে দেশের পুরুষ জাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম; আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলা জাতি জন্ম গ্রহণ না করে।

 কিন্তু তা বলে বিরোধী পক্ষ বসে ছিল না। বিরোধী পক্ষে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন,

 বাধিয়েছে দলাদলি, লাগিয়াছে গোল

বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল ।।

কত বাদী , প্রতিবাদী করে কত রব

ছেলে বুড়ি আদি কবি, মাতিয়াছে সব ।।

কেহ উঠে শাখাপরে, কেহ থাকে মূলে

করিছে প্রমান জড়ো, পাঁজি পুঁথি খুলে ।।


এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রও বিধবা বিবাহ প্রবর্তন নিয়ে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় নেতিবাচক মন্তব্য করেন, সাহিত্যসম্রাট তাঁর বিষবৃক্ষ উপন্যাসে সূর্যমুখী চরিত্রের মুখ দিয়ে সেই রকম ব্যঙ্গবিদ্রূপ ধ্বনিত হয়েছে। সূর্যমুখীকে দিয়ে বলালেন-

 যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করে, সে যদি পণ্ডিত হয়, তবে মূর্খ কে!"

এরই মধ্যে তর্ক বিতর্ক পৌঁছে গেল সাধারণ মানুষের মধ্যে। হাটে বাজারে, ক্ষেতে, ছোট ছোট কারখানায় সর্বত্র আলোচনা শুরু হল বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রয়নের দাবীর সমর্থনে। ধনী, দরিদ্র, বিদ্বান, মূর্খ, বালক, যুবক, বৃদ্ধ, স্ত্রীলোক সকলের মধ্যে দিন রাত এই আলোচনা। গাড়োয়ান গাড়ি চালাতে চালাতে, কৃষক ক্ষেতে চাষ করতে করতে ও লাঙ্গল চালাতে চালাতে, তাঁতী তাঁত বুনতে বুনতে বিধবা বিবাহের সমর্থনে গান করত। সে সময় শান্তিপু্রে এক রকম শাড়ি তৈরি হত যার পাড়ে বিদ্যাসাগরের নামে রচিত একটি গান লেখা থাকত। সে শাড়ীর নাম ছিল বিদ্যাসাগর পেড়ে শাড়ি। সে শাড়ীতে এই গানটি লেখা থাকত।

 বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে!

সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।।

কবে হবে শুভদিন, প্রকাশিবে এ আইন,

দেশে দেশে জেলায় জেলায় বেরবে হুকুম,

বিধবা রমনীর বিয়ের লেগে যাবে ধূম,

মনের সুখে থাকব মোরা মনোমত পতি লয়ে।

এমন দিন কবে হবে, বৈধব্য যন্ত্রণা যাবে,

আভরণ পরিব সবে, লোকে দেখবে তাই-

আলোচাল কাঁচকলার মুখে দিয়ে ছাই,

এয়ো হয়ে যাব সবে বরণডালা মাথায় লয়ে।।”

 

সমসাময়িক কবি সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার স্পস্ট ভাবে তার কবিতায় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বিধবা বিবাহের বিষয়ে সমর্থন করেছেন। অন্যান্য কবিরা বৈধব্য যন্ত্রণা তাদের কাব্যে লিখলেও তাদের সমস্যা সমাধানে বিধবা বিবাহের বিষয়ে স্পষ্ট কথা বলেন নি। কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন লিখেছেন,

 

তোরি মত শত শত                  নব তপস্বীনি

              আছে বঙ্গ ঘরে

আশৈশব শ্বেতবাস                  অশ্রুজল  বারোমাস

               দেশাচার শৃংখলে তাহারা বন্দিনী।।

 

কিন্তু তিনি বিধবাদের দুঃখকে বিধির বিধান বলে ক্ষান্তি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,

মা! তুমি বাঙ্গালীর ঘরে কুললক্ষ্মী। আমি কবি মুখে শুনিয়াছি, দিব্যকর্ণে শুনিয়াছি, দেবতাদিগের মুখে শুনিয়াছি যেদিন বঙ্গ গৃহে তপস্বী ব্রতধারিণী বিধবা থাকিবে না, সেদিন বাঙ্গালীর অস্তিত্ব লোপ হইবে।”


এদিকে বিধবা বিবাহ বিরোধীরা কলকাতার পথে পথে খোল করতাল নিয়ে গান করে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অপদস্থ করার জন্য উঠেপড়ে লাগলো। তর্ক প্রতর্ক বিতর্ক চরম রূপ ধারণ করল। বিরোধী পক্ষে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন,

 কেহ কহে এই বিধি কেমনে হইবে?

হিঁদুর ঘরের রাঢ়ী, সিঁদুর পড়িবে।।”

 

অথবা

 

শরীর পড়েছে ঝুলি, চুল গুলি পাকা।

 কে ধরাবে মাছ তারে, কে পরাবে শাঁখা।।”

 

গানে, কবিতায়, নাটকে যে আলোড়ন উঠেছিল সমাজে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কবি দাশরথী রায় লিখেছিলেন,

 বিধবার বিবাহ কথা কলির প্রধান স্থান কলিকাতা

নগরে উঠেছে অতি রব।

কাটাকাটি হচ্ছে বাণ          ক্রমে দেখছি বলবান,

হবার কথা হয়ে উঠেছে সব।।”

 

আবার তিনি লিখেছেন,

হাকিমের এই বুদ্ধি  ধর্ম বৃদ্ধি, প্রজা বৃদ্ধি

এ বিবাহ সিদ্ধি হলে পরে।

বিধবা করে গর্ভপাত অমঙ্গল উৎপাৎ

তাতে রাজার রাজ্যে হতে পারে।।”

 

১৮৫৫ সালে বিধবা বিবাহের বিষয়ে আরো তিনটি নাটক- উমেশ চন্দ্র মিত্রের লেখাবিধবা বিবাহ’, উমাচরণ চট্টোপাধ্যায়েরবিধবোদ্বাহএবং রাধামাধব মিত্রেরবিধবা মনোরঞ্জনলেখা হয় ও মঞ্চস্থ হয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বিদ‍্যাসাগরেরবিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কি নাপ্রকাশিত হওয়ার পরের সংখ‍্যাতেই বিরোধীদের শাসানি উপেক্ষা করে তত্ববোধিনী পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্ত বিদ‍্যাসাগরকে এবং বিধবা বিবাহ সমর্থন করে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।

 

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর পরিবারের কোন বিধবার দুঃখ দেখে  এ আন্দোলনে প্রবৃত্ত হন নি। সমাজে অনাথীনি বিধবাদের দুঃখে তিনি বিগলিত চিত্ত। সমগ্র নারী জাতিকে তিনি মাতৃরূপে, কন্যারূপে সম্মান করতেন। এ গুণ ছিল তাঁর সহজাত। তাই কত লাঞ্ছনা, বিদ্রুপ, সমালোচনা, ব্যক্তিগত আক্রমণ সহ্য করেও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে ছিলেন পর্বতের মত অনড়, স্থির ও দৃঢ়। তাঁকে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন,

সাগর যদ্যপি করে সীমার লঙ্ঘন

তবে বুঝি হতে পারে বিবাহ ঘটন।।”

 

বিরোধী পক্ষের কেউ কেউ এমনকি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে শারীরিক নিগ্রহ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। তাঁর প্রাণ নাশের চেষ্টাও শুরু হল। এ প্রসঙ্গে ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু ১২৯৮ সালের ২০ শে ভাদ্রের  হিতবাদীতেলিখেছিলেন যে বিদ্যাসাগরমশাই পথে বেরোলে লোকজন তাঁকে ঘিরে ধরতো, কেউ পরিহাস করতো কেউ মারধর করার বা মেরে ফেলারও চেষ্টা করতো একদিন বিদ্যাসাগর শুনলেন যে কলকাতার কোনো বড়োলোক মানুষ তাঁকে মারার জন্য লোক লাগিয়েছে এবং সেই গুন্ডারা তাঁকে মারার জন্য অপেক্ষা করছে সেই শুনে বিদ্যাসাগরমশাই অকুতোভয়ে একেবারে সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন যেখানে সেই বড়োলোক মানুষটি স-পারিষদ বিদ্যাসাগরমশাইয়ের মারের কল্পনায় মশগুল হয়ে বসে আছেন এমন সময় একেবারে সভার মধ্যিখানে সটাং বিদ্যাসাগর হাজির হলেন সবাই হতবম্ভ , সম্বিৎ ফিরে পেয়ে একজন পারিষদ জিজ্ঞাসা করলেন বিদ্যাসাগরমশাইয়ের আগমনের হেতু বিদ্যাসাগর উত্তর দিলেন যে,

লোকপরম্পরায় শুনিলাম , আমাকে মারিবার জন্য আপনাদের নিযুক্ত লোকেরা আহারনিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া  আমার সন্ধানে ফিরিতেছে ও খুঁজিতেছে ; তাই আমি ভাবিলাম , তাহাদিগকে কষ্ট দিবার আবশ্যক কি, আমি নিজেই যাই এখন আপনাদের অভীষ্ট সিদ্ধ করুন ইহার অপেক্ষা উত্তম অবসর আর পাইবেন না


সমাজে জনমত গঠনের পর বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজ পুরুষদের সম্মতি আদায়ের জন্য উদ্যোগ নেন। তাই বিদ্যাসাগর তাঁরবিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি নাপুস্তিকার ইংরাজী অনুবাদ করেন। ইংরাজী অনুবাদ সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রধান প্রধান সাহেবদের সঙ্গে আইন প্রয়নের দাবীতে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর, ১৮৫৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর ৯৮৭ জন লোকের স্বাক্ষরিত আবেদন পত্র জমা দিলেন। সে আবেদনের সুচনায় লেখা ছিল,

ভারতের মহামান্য বড়লাট বাহাদুরের সভা সমীপেষু, বঙ্গদেশস্থ নিম্ন স্বাক্ষরকারী হিন্দু প্রজাদিগের সবিনয় নিবেদন এই যে বহুদিন প্রচলিত দেশাচারানুসারে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ। আবেদনকারীগণের মত এবং দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, এই নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক দেশাচার নীতিবিরুদ্ধ এবং সমাজের বহুতর অনিষ্টকারক। হিন্দু দিগের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন আছে। অনেক হিন্দু কন্যা চলিতে বলিতে শিখিবার পূর্বেই বিধবা হয়। ইহা সমাজের ঘোরতর অনিষ্টকারী। যাহাতে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ পক্ষে বাধা না থাকে এবং সেই বিবাহ জাত সন্তান সন্ততি যাহাতে বিধিসম্মত সন্তান সন্ততি বলিয়া পরিগৃহীত হয়, তাহার জন্য আইন প্রচলন করিবার সঙ্গতিবিষয়ে মহামান্য ব্যবস্থাপক সভা আশু বিবেচনা করুন।”

 

তদানীন্তন লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রস্তাবে এই বিলটি পেশ করেছিলেন জে.পি. গ্রান্টবিরোধী পক্ষের সমবেত বিরোধিতার উত্তরে তিনি বলেছিলেন,

 “If I know certainly that but one little girl would be saved from the horrors of brahmacharya by the passing of this act, I will pass it for her shake.”

 

বহু বিরোধিতা সত্ত্বেও দাবী মেনে নেওয়া হল। শুরু হল আইন প্রয়নের কাজ। কলকাতায় তখন রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর মহা শক্তিশালী সমাজপতি। তিনি এবার সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে বিরোধিতা করতে নামলেন। বিরোধীদের মতে বিধবা বিবাহ যদি শাস্ত্রে নিষিদ্ধ নাও হয় তাও তা দেশাচার বিরুদ্ধ, যদি বিধবা বিবাহ শাস্ত্র সঙ্গত হত তাহলে তার দেশাচারে নেই কেন।

রামায়ণ, মহাভারতেও বিধবা বিবাহের দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় যে সে যুগেও বিধবা বিবাহ প্রচলিত ছিল। রামায়ণে কিষ্কিন্ধা কাণ্ডে বালীবধের পর বিধবা তারা পতিরূপে লাভ করেন বালীর ভাই সুগ্রীবকে। লঙ্কাকাণ্ডে রাবণবধের পর মন্দোদরী বিবাহ করেন বিভীষণকে। অবশ্য এ দৃষ্টান্ত বিদ্যাসাগর নিজে উপস্থাপন করেন নি। তিনি শুধু বলেছিলেন যে আচারে ব্যবহারে সে যুগে বিধবা বিবাহ দেশাচার সম্মত ছিল। বিশ্বাস করা কঠিন যে এসব শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতেরা জানতেন না। তবু তারা সমাজ শাসনে পুরুষের একাধিপত্য বজায় রাখতে এবং নারীর অধিকার খর্ব করতে ছিলেন বদ্ধ পরিকর।


বিধবা বিবাহ প্রচলনের দাবীতে বিদ্যাসাগরের আবেদন পত্র ( সূত্রঃ উমাপদ রক্ষিত) 

যাহোক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দাবী পত্রের ভিত্তিতে ১৮৫৫ সনের ১৭ই নভেম্বর ব্যবস্থাপক সভায় বিলের পান্ডুলিপি পেশ হয় এবং প্রথম পঠিত (First Reading) হয়। বিল পেশ করে গ্রান্ট সাহেব বলেছিলেন,

“The Young widows, being forbidden to marry, almost without exception, become prostitutes." 

 

বিদেশী শাসকের এ মন্তব্য আগুনে ঘৃতাহুতি ঢালে যার ফলে তাঁর এ বক্তব্য ঘিরে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। স্যার জেমস কলভিল গ্রানট সাহেবের প্রস্তাব সমর্থন করেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে জানুয়ারি পান্ডুলিপি সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়। তীব্র ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর ও অন্যান্যরা ৩৬৭৬৩ জনের স্বাক্ষরিত আবেদন পত্র পেশ করে প্রস্তাবিত বিধবা বিবাহ আইন প্রনয়ণের বিরোধিতা ‌করেন এবং যে কোন মূল্যে এই আইন পাশ বন্ধ করতে উদ্যোগী হন।

আইন প্রনয়নের পথে তীব্র বাধা সৃষ্টি হল। কিন্তু বিদ্যাসাগর এতটুকুও বিচলিত হলেন না। বিধবা বিবাহ আইন প্রনয়ণের জন্য বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর পরে এবং বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হওয়ার পরে এই আন্দোলন কলকাতার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। নদীয়া, ত্রিবেণী, ভাটপাড়া, বাঁশবেরিয়া এবং পাশাপাশি সংলগ্ন সমস্ত এলাকায় পণ্ডিতরা সভা সমিতি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সমস্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের স্বাক্ষরিত আপত্তি পত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের কাছে জমা দিয়ে জানান যে হিন্দুদের বিধবা বিবাহ অশাস্ত্রীয় এবং কোম্পানির সরকারের এ বিষয়ে আইন প্রনয়ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ।

যে সব পন্ডিতেরা তীব্র আপত্তি করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আগরপাড়ার শ্রীযুক্ত মহেশ চন্দ্র চূড়ামণি, কোন্নগর নিবাসী শ্রীযুক্ত দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন, কাশীপুরের শ্রীযুক্ত শশিজীবন তর্করত্ন প্রমূখ অন্যান্য বহু পন্ডিতেরা তীব্রভাবে লিখিত আপত্তি পত্রে ব্যক্ত করেন যে,

পরাশর সংহিতার বিবাহ বিধায়ক বচনের অভিপ্রায় এই যে, যদি বাগদত্তা কন্যার বর নিরুদ্দেশ হয় তাহা হইলে তাহার পুনরায় অন্য বরের সহিত বিবাহ হইতে পারে; নতুবা, বিবাহিতা বিধবাদি স্ত্রীর পুনর্বার বিবাহ হইতে পারে, এরূপ অভিপ্রায় কদাচ নহে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর উত্তরে পরাশর সংহিতা থেকে উদ্ধৃতি ও নারদসংহিতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে এ যুক্তি সমূহ বিরোধিতা করেন ও নস্যাৎ করেন। বিদ্যাসাগর এবার এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত মানবিক আবেদন রাখেন-

 

দুর্ভাগ্যক্রমে, বাল্যকালে যাহারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা যাবজ্জীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা যাহাদের কন্যা, ভগিনী, পুত্রবধূ প্রভৃতি অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন। কত শত বিধবারা, ব্রহ্মচর্য নির্বাহে অসমর্থ হইয়া, ব্যাভিচার দোষে দূষিত ও ভ্রুণ হত্যা পাপে লিপ্ত হইতেছে; এবং পতিকুল, পিতৃকুল ও মাতৃকুল কলঙ্কিত করিতেছে। বিধবা বিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণা, ব্যাভিচার দোষ ও ভ্রুণ হত্যা পাপের নিবারণ ও তিন কুলের কলঙ্ক নিরাকরণ হইতে পারে। যাবৎ এই শুভকরী প্রথা প্রচলিত না হইবেক, তাবৎ ব্যাভিচারদোষ ও ভ্রুণহত্যা পাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্যযন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক।”

 

পণ্ডিত সম্প্রদায়ের আপত্তি পত্র সমূহ সিলেক্ট কমিটির সভায় পঠিত হয় এবং বিদ্যাসাগরের জবাবগুলিও পঠিত হয়। বিরোধী পক্ষের পণ্ডিতগণের আপত্তি প্রত্যাখ্যান করা হয়। কারণ হিসেবে সিলেক্ট কমিটির সদস্যগণ ও কোম্পানি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলেন যে, তাদের সরকার কোন ভাবেই এই আইন দ্বারা কারো অধিকার কেড়ে নিচ্ছে না এবং নেবে না। এই আইন শুধু মাত্র অধিকার প্রদান করবে। হিন্দুদের বাল্যবিধবার আমৃত্যু অন্যের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করা হয় এবং এতে তার ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হয়। এই আইন হিন্দু বিধবাদের বিবাহ করতে বাধ্য করছে না। কাজেই যেহেতু এই প্রস্তাবিত আইনে কারো অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি বরঞ্চ অধিকার প্রদান করা হয়েছে এবং যেহেতু এটি দেওয়ানী বিধির বিষয়, তাই এই বিষয়ে যে আপত্তি জমা হয়েছে তা বিবেচনা করে বাতিল করা হল।

 ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে মে সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট জমা হয় এবং ঐ বছরের ১৯ শে জুলাই বিলের পান্ডুলিপি তৃতীয় বার ব্যবস্থাপক সভায় পঠিত হয়। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে জুলাই The Hindu Widows Remarriages Act of 1856 ( Act XV of 1856)’ প্রণীত হয়। আইন প্রনয়ণের আগে চল্লিশটিরোও বেশী আপত্তি পত্র জমা হয়েছিল যাতে সর্বমোট প্রায় ষাট হাজার লোকের স্বাক্ষর ছিল। আইন প্রনয়নের পক্ষে মোট পঁচিশটি আবেদন জমা পড়ে এবং তাতে সর্বমোট পাঁচ হাজার লোকের স্বাক্ষর ছিল। তবুও এই আইন পাশ করার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সঠিক ভাবে কোম্পানির শাসকদের বোঝাতে পেরেছিলেন। তাই কোম্পানির শাসকরা এই আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন,

হিন্দু- বৈধব্য বড় নিষ্ঠুর কান্ড; ইহা প্রকৃতির বিরুদ্ধ; এ নিষ্ঠুর কান্ড নিবারণের জন্য বিধবা বিবাহের প্রয়োজন; পুনর্বিবাহে বিধবা যাহাতে আইন সম্মত অধিকার হইতে বঞ্চিত না হয়, তাহার জন্য আইন করা প্রয়োজন; সেই প্রয়োজন বশতঃ এই আইন হইল; এ আইনের জন্য যে সকল লোক আবেদন করিয়াছেন, তাহারা গণ্য, মান্য ও বুদ্ধিমান।”

আইন তো পাশ হল। কিন্তু দেশাচার? দেশাচার বা যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘Custom’ অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক- ‘The Hindu Marriage Act of  1955’ এর নং ধারায় বলা আছে যে, হিন্দু বিবাহ ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারে অনুষ্ঠিত হবে এবং যেখানে সপ্তপদী প্রচলিত সেখানে সাত পাক ঘোরা শেষ হলেই বিবাহ সম্পন্ন হবে। আইনে তো শাখা পরা, হোম, মালা বদল অনুষ্ঠান বাধ‍্যতামূলক নয়। কিন্তু এগুলো দেশাচার। তাই বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতগণ বিদেশী কোম্পানী সরকারের দেশাচার বিরোধী আইন অনুসরণ না করার  জন‍্য এবং হিন্দু  ধর্ম রক্ষার সমগ্র হিন্দুদের আহ্বান করলেন। সমাজ রক্ষার দোহাই দিয়ে বিধবা বিবাহ বিরোধিতা করতে লাগলেন।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর এই দেশাচারের বিরুদ্ধে শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং অনেক মানবিক আবেদন করেছেন। মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেছেন,

ধর্মং জিজ্ঞাসমানানং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ।

দ্বিতীয়ং ধর্মশাস্ত্রন্তু  তৃতীয়ং লোকসংগ্রহঃ।।”

 

অর্থাৎ, যারা ধর্ম জানতে আগ্রহী তাদের জন‍্য বেদ প্রধান প্রমাণ, ধর্ম শাস্ত্র দ্বিতীয় প্রমাণ, দেশাচার তৃতীয় প্রমাণ। শাস্ত্র থেকে তুলে ধরলেন,

 স্মৃতের্বেবদবিরোধে তূ পরিত‍্যাগো যথা ভবেৎ।

তথৈব লৌকিকং বাক‍্যং স্মৃতিবাধে পরিত‍্যজেৎ।”

 

অর্থাৎ বেদের সঙ্গে বিরোধে যেমন স্মৃতি অগ্রাহ‍্য হয় ঠিক তেমনি স্মৃতির সঙ্গে অসঙ্গতি হলে দেশাচার অগ্রাহ‍্য হবে।

 বিধবা বিবাহ বিরোধীরা আরও প্রশ্ন তুলেছিলেন যেমন,

১. পূর্বে দানকৃত বিধবার তো গোত্র পরিবর্তন হয়ে শ্বশুরবাড়ির গোত্র হয়েছে। বিধবার বিয়ে হলে তার গোত্র কী হবে? তাকে দান করার অধিকার কার

২.ক্ষতযোনি হলে তো সে কন‍্যা নয়। সে  তো অকন‍্যা। তাহলে সে তো পুনর্ভূ হবে।

৩. বিধবার মৃত স্বামীর সন্তান তার পিতার উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হবে কি না

৪. বিধবার অর্থাৎ পুনর্ভূর সন্তান হবে পৌনর্ভব। সে সন্তান তো ঔরসজাত সন্তান নয়। তাই সে তো পুত্র হবে না। কারন পরাশর সংহিতা অনুসারে কলিতে ঔরসজাত পুত্র, দত্তক পুত্র  আর কৃত্রিম তিন প্রকার পুত্রের উল্লেখ  আছে। পৌনর্ভবের কোন উল্লেখ নাই। তাই মনুর মতে পুত নামক নরক থেকে ত্রাণকারী পুত্র হচ্ছে  স্বজাতীয়া বিবাহিতা স্ত্রীর গর্ভে ঔরসজাত পুত্র, সে তো বিধবার গর্ভজাত পৌনর্ভব  হতে পারে না। 

৫. বিধবার বিবাহে কোন মন্ত্র পাঠ হবে? ইত‍্যাদি।

 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন,

 বরগোত্রং সমুচ্চার্য‍্য প্রপিতামহপূর্ব্বকম্।

নাম সঙ্কীর্ত্তয়েদ্বিদ্বান্ কন‍্যায়াশ্চেবমেব হি।।”

 

অর্থাৎ,  বরের প্রপিতামহ, পিতামহ ও পিতার নাম ও  গোত্র উচ্চারণ করে বরের নাম উল্লেখ করতে হবে। কন‍্যারও একই ভাবে প্রপিতামহ, পিতামহ, পিতার নাম ও গোত্র উচ্চারণ করে কন‍্যাকে দান করতে হবে। কন‍্যা কার প্রপ‍ৌত্রী, কার পৌত্রী, কার কন‍্যা উল্লেখ করে গোত্র উল্লেখ করে কন‍্যাদান করতে হবে। কন‍্যার পিতার গোত্র তো মৃত স্বামীর গোত্র নয়। তাই বিধবার পিতৃগোত্র থেকেই দান হবে। এ প্রসঙ্গে মহর্ষি কাত‍্যায়নের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বিদ‍্যাসাগর বলেছেন,

 সংস্কৃতায়ান্তু ভার্য‍্যায়াং সপিন্ডীকরণান্তিকম্।

পৈতৃকং ভজতে গোত্রমূর্দ্ধন্তু পতিপৈতৃকম্।।”

 

অর্থাৎ, বিবাহসংস্কার হলে স্ত্রী সপিন্ডীকরণ পর্যন্ত পিতৃকুলে থাকে।

প‍ৌনর্ভবের পুত্রের মর্যাদা প‍্রাপ‍্য। মনু বার প্রকার পুত্রের স্বীকৃতি দিয়ে বলছেন,

 ঔরসঃ ক্ষেত্রজশ্চৈব দত্তঃ কৃত্রিম এব চ।

গৃৃঢ়োৎপান্নোহপবিদ্ধশ্চ দায়দা বান্ধবাশ্চ ষটন।।

কানীনশ্চ সহোঢ়শ্চ ক্রীতঃ পৌনর্ভবস্তথা।

স্বয়ংদত্তশ্চ শৌদ্রশ্চ ষড়দায়াদবান্ধাবাঃ।।”

 

অর্থাৎ ঔরস, ক্ষেত্রজ, দত্তক, কৃত্রিম, গৃঢ়োৎপন্ন, অপবিদ্ধ, কানীন, সহোঢ়, ক্রীত, পৌনর্ভব, স্বয়ংদত্ত ও শৌদ্র এই বার প্রকার পুত্র। অতএব পৌনর্ভব অবশ‍্যই পুত্র। মৃত স্বামীর উত্তরাধিকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া ছিল। পরাশর সংহিতাতে তিনি খুঁজে পেলেন-

 স্বে ক্ষেত্রে সংস্কৃতায়ান্তু স্বয়মুৎ পাদয়েদ্ধি যম

ত মৌ রসং  বীজনীয়াৎ পুত্ৰং প্রথমকল্পিকম ।।

 

অর্থাৎ বিবাহিতা সজাতীয়া স্ত্রীর গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্র ঔরস পুত্র সুতরাং বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রে ঔরস জাতপুত্রের লক্ষণ সম্পূর্ণ   বিধবার গর্ভজাত বলে তাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না

বিধবাকে দান করার অধিকার পিতার। শাস্ত্রে আছে,

পিতা দদ‍্যাৎ স্বয়ং কন‍্যাং ভ্রাতা  বানুমত পিতুঃ।

মাতামহো মাতুলশ্চ সকুল‍্যো বান্ধবস্তথা।

মাতা ত্বভাবে সর্ব্বেষা প্রকৃতৌ যদি বর্ত্ততে।

তস‍্যামপ্রকৃতিস্থায়াং কন‍্যাং দদ‍্যুঃ সজাতয়ঃ।।”

 

অর্থাৎ, বাবা নিজে কন‍্যাকে দান করবেন, অথবা বাবার অনুমতিতে ভাই দান করবেন। তাঁর অভাবে মাতামহ, মামা, জ্ঞাতি, বন্ধু দান করবেন। সকলের অভাবে মা দান করবেন। মা যদি অপ্রকৃতিস্থা হন তবে স্বজাতীয়রা দান করবেন। বিবাহের জন‍্য নির্দ্ধারিত  মন্ত্র পাঠ করে বিধবার বিয়ে হবে। কারন শাস্ত্রে তাতে কোন নিষেধ নেই

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর দেশাচার সংক্রান্ত আপত্তির জবাব দিয়ে বিরোধীদের অপচেষ্টা প্রতিহত করতে সফল হলেন। করূণাসাগর বিদ‍্যাসাগরের কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি থেকে তাঁর আবেগপ্রবণ হৃদয় ও কঠিন ব‍্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়-

আমি দেশাচারের দাস নহি ; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিৎ বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব।”

 হায়কি আক্ষেপের বিষয়, দেশাচারই এ দেশের অদ্বিতীয় শাসনকর্তা, দেশাচারই এ দেশের পরম গুরু; দেশাচারের শাসনই প্রধান শাসনদেশাচারের উপদেশই প্রধান উপদেশ।”

 ধন‍্য রে দেশাচার ! তোর কি অনির্বচনীয় মহিমা। তুই তোর অনুগত ভক্তদিগকে দুর্ভেদ‍্য দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ রাখিয়া, কি একাধিপত‍্য করিতেছিস!  তুই ক্রমে ক্রমে আপন আধিপত‍্য  বিস্তার করিয়া, শাস্ত্রের মস্তকে পদার্পণ করিয়াছিস, ধর্মের মর্ম ভেদ করিয়াছিস, হিতাহিতবোধের গতিরোধ করিয়াছিসন‍্যায় অন‍্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করিয়াছিস।.............."

 

১৮৫৬ সালের হিন্দু বিধবা বিবাহ আইনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা পড়লেই পরিস্কার ভাবে প্রমাণ হবে যে বিদ‍্যাসাগরের প্রতিটি দাবী ঐ আইনে স্বীকৃতি পেয়েছিল।

 The Hindu Widow Re-Marriage Act of 1856.

Section 1: Marriage of Hindu widows legalized.

“No marriage contracted between Hindus shall be invalid, and the issue of no such marriage shall be illegitimate by reason of the woman having been previously married or betrothed to another person who was dead at the time of such marriage, any custom or any interpretation of Hindu law to the contrary notwithstanding."

 

Section 2: All rights and interests which any widow may have in her deceased husband's property by way of maintenance or by inheritance to her husband or to his lineal successors, or by virtue of any will or testamentary disposition conferring upon her, without express permission to remarry, only a limited interest in such property with no power of alienating the same shall upon her remarriage cease and determine as if she had then died; and the next heirs of her deceased husband or other person entitled to the property on her death, shall thereupon succeed to the same."

 

Section 6: Ceremonies constituting valid marriage to have effect on widow's remarriage.

“Whatever words spoken; ceremonies performed or engagements made on the marriage of a Hindu female who has not previously married are sufficient to constitute a valid marriage, shall have the same effect if spoken, performed or made on the marriage of a Hindu widow and no marriage shall be declared invalid on the ground that such words, ceremonies or engagements are inapplicable to the case of a widow."

 

অতএব টিকিধারী পণ্ডিতগণের সমস্ত বিরোধিতা ব‍্যর্থ হল। বিধবা বিবাহ আইন পাশ হল। এখন আর বিধবা বিবাহে প্রায় কোন বাধা রইল না।  কিন্তু বিরোধী পক্ষ প্রচার করল যে সাহেবরা যে আইন করেছে সে আইন বইতেই থাকবে। কোন হিন্দু ধর্মের নির্দেশ অমান্য করে বিধবা বিবাহ দেবে না এবং কেউ বিধবা বিবাহ করবেও না। অতএব পাত্র পাত্রী সন্ধান করা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো। বাংলার গভর্নর হ্যালিডে সাহেব ও গ্রান্ট সাহেব বিধবা বিবাহের বিষয়ে খোঁজ খবর করতে লাগলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায় প্রমূখ স্বনামধন্য ব্যক্তিগণ পাত্র পাত্রীর সন্ধান করতে লাগলেন।

 

বিধবা বিবাহ বিরোধীরা ধৈর্যচ‍্যুত হয়ে পড়েছিলেন। পথে তারাই সংখ‍্যাধিক। প্রকাশ‍্যে তাঁকে বিরোধীরা গালাগালি করত।  একদিন বিদ‍্যাসাগর বর্ধমান থেকে কলকাতা ফিরছিলেন। মাঝে কোন এক স্টেশন থেকে এক টিঁকিধারী ব্রাহ্মণ ঐ কামরাতে উঠেছিলেন। তিনি বিদ‍্যাসাগরকে চিনতেন না। কামরায় বসেই সেই ব্রাহ্মণ বিদ‍্যাসাগরকে অবিরাম গালমন্দ করতে শুরু করেন। নামার সময় তিনি জানতে পারেন ষে বিদ‍্যাসাগরের সামনেই তাঁকে গালাগালি করেছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। বিদ‍্যাসাগর নেমে তাকে সেবা শুশ্রুষা করে কিছু পাথেয় হাতে দিয়ে বিদায় দেন।

 

এমত অবস্থায় মদনমোহন তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেল। কোটার রাজা বিধবা বিবাহের জন্য চৌদ্দ হাজার টাকা খরচ করতে প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেন। তৎকালীন কলকাতায় প্রথিতযশা ধনকুবের, দাতা ও সমাজসেবক মতিলাল শীল মহাশয় ঘোষণা করলেন যে, যিনি বিধবা কন্যার বিবাহ দেবেন এবং  যিনি বিধবা বিবাহ করবেন তাদের প্রত্যেককে তিনি দশ হাজার টাকা করে প্রদান করবেন। কিন্তু তার সে ঘোষণা সম্ভবত বাস্তবায়িত হয়নি। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ও এককালীন অর্থ প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন

শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন 
 

মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের মনোনীত পাত্র জজ পণ্ডিত শ্রীযুক্ত শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। এই শ্রীশচন্দ্র বাবু সংস্কৃত কলেজের নামকরা সফল ছাত্র এবং সংস্কৃত কলেজ থেকেই তিনি বিদ‍্যারত্ন উপাধি পান। পিতার নাম প্রসিদ্ধ রামধন তর্কবাগীশ। অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগণার গোবরডাঙা -  খাটুয়ার বাসিন্দা তিনি। পাত্রীর নাম কালীমতি, তাঁর আসল নাম ছিল জগৎকালী মুখোপাধ্যায়। পাত্রীর বাবা ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ‍্যায় মায লক্ষ্মীমণি দেবী।  ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বা ১২৬৩ বঙ্গাব্দের ১৫ই অগ্রহায়ণ, শনিবার বিয়ের দিন ধার্য হয়েছিল।

 ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বিয়ের দিন ঠিক হবার পর বিধবা বিবাহের বিরোধী পক্ষ সরাসরি সম্মুখ বিরোধিতা করতে শুরু করেন। লাঠিয়াল বাহিনী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করলেন। সৌভাগ্যক্রমে বিদ্যাসাগর প্রাণে বেঁচে যান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার গুপ্তচর বাহিনী সুত্রে জানতে পারেন যে বিধবা বিবাহ বিরোধী পক্ষ গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং তারা শারীরিক নিগ্রহের এমনকি গুপ্ত হত‍্যার জন‍্য বিভিন্ন স্থান থেকে লাঠিয়াল এনে জমায়েত করছে। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার আগে থেকেই বিদ্যাসাগরকে নিরাপত্তা দিতে চেয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট থানাকেও এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়।  কিন্তু প্রবল আত্ম বিশ্বাসী বিদ্যাসাগর সে নিরাপত্তা নেননি। আক্রমণের সময় তার সঙ্গে ছিলেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দক্ষ লাঠিয়াল শ্রীমন্ত। সেই লাঠিয়াল একাই আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং বিদ্যাসাগর অক্ষত অবস্থায় বাড়ী ফিরতে সক্ষম হন।

 

শ্রীশচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তাঁর বড় ভাই গণেশ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ। শ্রীশচন্দ্র ছিলেন বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের অত্যন্ত স্নেহভাজন। বিধবাবিবাহের বিরোধীরা শ্রীশচন্দ্রের মাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে শ্রীশচন্দ্র বিধবা বিবাহ করলে তাঁর প্রাণসংশয় এমনকি প্রাণনাশও হতে পারে। স্বভাবতই তাঁর মা পুত্রস্নেহ বশতঃ বিয়েতে বাধা প্রদান করলেন। সমকালীন পত্রিকায় এ সম্পর্কে নানা সমালোচনা হয়েছিল। ২৭শে নভেম্বরের ‘ইংলিশম‍্যান’ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে শ্রীশচন্দ্র বিদ‍্যারত্ন মাতৃ প্রতিবন্ধকতার ছলে বিধবা বিবাহ করতে অসম্মত হন। এদিকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা বিধবা বিবাহের তীব্র বিরোধিতা শুরু করে।সমাচার সুধা বর্ষণবিদ্রূপ করে ছাপার অক্ষরে পত্রিকায় প্রকাশ করে,

 সাজ গো বিধবাগণ ফুটিয়াছে ফুল,

তোমাদের সৌভাগ্য ঈশ্বর অনুকূল।”


এতেও যখন শ্রীশচন্দ্র বিধবা বিবাহের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি তখন একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, একদিন তিনি বিরোধী পক্ষের দ্বারা আক্রান্ত ও প্রহৃত হন, যার প্রেক্ষিতে শ্রীশচন্দ্র তখন বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কাছে গিয়ে জানান যে তিনি বিধবা বিবাহ করতে অক্ষম। এই অবস্থায় বিয়ে আর ৩০শে নভেম্বর হওয়া সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত শ্রীশচন্দ্র পুনরায় মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথায় বিয়েতে সম্মতি প্রদান করেন। শ্রীশচন্দ্র বাবু কালীমতিকে বিয়ে করতে সম্মত হন এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন ষে তিনি কালীমতিকেই বিয়ে করবেন। প্রসঙ্গত, কালীমতির যখন প্রথমবার বিয়ে হয় তখন তার চার বছর বয়স এবং ছয় বছর বয়সে তিনি বিধবা হন।

শ্রীশচন্দ্র বিয়েতে সম্মতি প্রদান করলে বিবাহ অনুষ্ঠানের স্থান ঠিক করার প্রয়োজন দেখা দেয়। বিদ‍্যাসাগরের অন‍্যতম সুহৃদ এবং বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সহযোদ্ধা রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ‍্যায় তাঁর বাড়িতে প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠান করতে সম্মত হন। এই রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ‍্যায় সংস্কৃত কলেজের অধ‍্যাপক ছিলেন এবং তাঁর বাবা ভবানী চরণ বন্দোপাধ‍্যায় সমাচার চন্দ‍্রিকার প্রথম প্রকাশক। অবশ‍্য এর জন‍্য রাজকৃষ্ণ বাবুকে সমাজচ‍্যুত হতে হয়েছিল, প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল এবং সমাজপতি ব্রাহ্মণদের নির্দেশে অর্থদন্ড প্রদান করতে হয়েছিল।

 

যাহোক, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিবাহের দিন পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিল এদিকে আইন প্রণেতা গণ সে আইন কার্যকর করার জন্য ভীষণ ভাবে আগ্রহী হয়ে পড়লেন। বাংলার গভর্নর হ্যালিডে সাহেব সরকারি চিঠি করে সংলগ্ন এলাকার অফিসারদের কাছে এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চান। এই অবস্থায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বিধবাবিবাহের পক্ষাবলম্বনকারীগণ বিবাহের স্থান ও অন্যান্য বিষয় ঠিক করতে শুরু করলেন। স্থির হল যে ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ৭ ই ডিসেম্বর(১২৬৩ বঙ্গাব্দের ২৩ শে অগ্রহায়ণ) রবিবার শুভবিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। অতএব, নিমন্ত্রনপত্র লেখাও হল। পাত্রী পক্ষের নিমন্ত্রণ পত্রে লেখা হল-

শ্রীশ্রী হরিঃ শরণং।”

শ্রী লক্ষ্মীমণি দেব্যাঃ

সবিনয়ং নিবেদনম্।

 

২৩ শে অগ্রহায়ণ রবিবার আমার বিধবা কন্যার শুভ বিবাহ হইবেক। মহাশয়েরা অনুগ্রহ পূর্বক কলিকাতার অন্তঃপাতি সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রীটের ১২ সংখ্যক ভবনে শুভাগমন করিয়া শুভ কর্ম সম্পন্ন করিবেন, পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণ করিলাম। ইতি,

তারিখ ২১শে অগ্রহায়ণ শকাব্দঃ ১৭৭৮।”

 

নিমন্ত্রণ পত্র দেওয়া হয়েছে লক্ষ্মীমণি দেবীর নামে। সমকালীন সমাজে নারী ছিলেন গৃহে অন্তরীণ। সে সময়ে, সে সমাজের নারী, তাও বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারের স্ত্রী লক্ষীমণি দেবী কেমন করে সাহস করলেন বিধবা বিবাহের নিমন্ত্রণ পত্র ছাপতে! অবরোধের গন্ডী অতিক্রম করতে! ভাবলে এবং যথার্থ মূল‍্যায়ণ করলে স্বীকার করতেই হবে যে এমনকি আজকের যুগেও এমন দুঃসাহসিনী দুর্লভ। আসলে বাড়ীর পুরুষরা বিপক্ষের হুমকি ও প্রাণ ভয়ে ভীত হয়ে কেউ নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো, বিলিবন্টন করা তো দূরের কথা বিয়েতে উপস্থিত পযর্ন্ত হতে যখন সাহস করতে পারেন  নি তখন এই বীরাঙ্গনা জননী এগিয়ে এসেছিলেন একা বিদ‍্যাসাগরের গৃহীত কর্মসূচি সফল করতে, জীবনের ঝুঁকি  নিয়ে নিজের বিধবা কন‍্যার ভবিষ্য সুখের আশায়। তাসত্ত্বেও, পরদিন সংবাদ পত্রে সংবাদ প্রকাশিত হল যে লক্ষীমণি দেবী অর্থের লোভে পড়ে বিধবা কন্যার বিবাহ দিতে উদ্যোগী হয়েছেন।


১২, সুকিয়া স্ট্রীটের এই বাড়ীতে প্রথম বিধবা বিবাহ সঙ্ঘটিত হয় 

 

এই নিমন্ত্রণ পত্র অনেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে অন্যতম রামমোহন রায়ের ছোট ছেলে বাবু রমানাথ রায়, বাবু নীলকমল বন্দোপাধ্যায়, বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র, বাবু রামগোপাল ঘোষ, বাবু দিগম্বর মিত্র, আসামের বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক গুণাভিরাম বরুয়া, বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ, বাবু নৃসিংহ চন্দ্র বসু ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের ‌সমস্ত স্তরের আধিকারিক ও বাংলার গভর্নর ফ্রেডারিক হ্যালিডে,  আইন কমিশনের চেয়ারম্যান গ্রান্ট সাহেব সহ অন্যান্য অনেক সাহেবগণ বিয়েতে উপস্থিত থাকতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই বিয়েতে সাহেবদের নিমন্ত্রণ করতে বিরোধিতা করেন। কারণ, বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধপক্ষ সেক্ষেত্রে সঙ্গত কারনেই প্রচার করতে শুরু করত যে এই বিয়ে হিন্দু বিবাহ নয়। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত সাহেবি বিবাহ। তবে, সংস্কৃত কলেজের সমস্ত অধ্যাপক গণ নিমন্ত্রিত ছিলেন। এমনকি যারা বিধবা বিবাহের তীব্র বিরোধিতা করতেন তারাও।

 

লক্ষণীয় যে বিবাহ বাসর স্থির হল ১২ নম্বর, সুকিয়া স্ট্রীটের রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি, যিনি বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে প্রাণের ভয় পর্যন্ত উপেক্ষা করে তাঁর বাড়িটি প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য প্রদান করেছিলেন। যদিও এজন্য পরবর্তীকালে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। এই বাড়ীতেই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং বিয়ের পরে স্ত্রী আচার সমূহ পালিত হয়। বাড়ীর ভিতরেই নিমন্ত্রিত লোকজনের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়। ছয় শতাধিক লোক বিয়েতে খাওয়া দাওয়া করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার অনুমান করেছিল যে বিয়ের সময় বিধবা বিবাহের বিরোধীরা গন্ডগোল করতে পারেন। সে জন্য বিয়ে বাড়ী ও সংলগ্ন সমস্ত পথে ও এলাকায় ব্যাপক পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা হয়েছিল।‌

 

সে সময় সংবাদ প্রভাকর, ‘ভাস্কর, ‘সমাচার চন্দ্রিকা ছিল প্রধান সংবাদ পত্র। সংবাদ প্রভাকর বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিখতো। ভাস্কর আবার বিধবা বিবাহের পক্ষে সংবাদ পরিবেশন করতো। বস্তুত এই নিয়ে প্রভাকর ও ভাস্করের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতা। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য্য ছিলেন ভাস্করের সম্পাদক। বিবাহের আগের দিনও প্রচার করা হয় যে লক্ষীমণি দেবী অর্থাৎ পাত্রী কালিমতির জননী “…চক্রাকার রূপচাঁদের মোহন মন্ত্রে মুগ্ধা হইয়া তাহার কন্যাকে শ্রীশ চন্দ্রের নিকট সম্প্রদান করিয়াছিলেন। এ রকম সমালোচনা ও শুরু হল যে পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন “…কেবলমাত্র রাজ দ্বারে প্রিয়পাত্র হইবার প্রত্যাশায় এতদরূপে তিন কুল পবিত্র করিলেন। এরকম তির্যক মন্তব্য শুধু মাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে ঘিরে নয় স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ঘিরেও প্রকাশিত হল। সংবাদ প্রভাকর প্রকাশ করল যে,

শ্রীশচন্দ্রকে বৃক্ষে তুলিয়া দিয়া নিম্নে বিদ্যাসাগর দন্ডায়মান থাকিয়া সাহস প্রদান করিতেছেন।

ইতিমধ্যে পাত্র কলকাতায় উপস্থিত। পটলডাঙা থেকে পাত্রীও কলকাতায় চলে এসেছেন। বিবাহের প্রস্তুতি চূড়ান্ত।

সকাল থেকেই ১২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রীটের রাজ কৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে খুব ব্যস্ততা। ঊষাকালেই ঘনঘন ঊলুধ্বনি মুখরিত হয়ে উঠল। স্ত্রী আচার সমস্ত কিছুই অনুষ্ঠিত হতে লাগলো। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরেও কন্যাকে সম্প্রদান করার মত কন্যার দাদা, কাকা কেউ এলেন না। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় অনড়। অতএব পুনরায় শাস্ত্রীয় নির্দেশের অনুসন্ধান। কন‍্যাদানে তো দাতা চাই। যে কেউ তো কন‍্যাদান করার অধিকারী নন। প্রসঙ্গত একটু আধুনিক আইনের দিকে নজর দিয়ে সমকালীন সমাজে বিদ‍্যাসাগরের আধুনিকতা ও দূরদৃষ্টি সম্পর্কে উপলব্ধি করার প্রয়াস পাওয়া যেতে পারে। আইন শাস্ত্র বলে, “Nemo debet quid quo non habet” অর্থাৎ যার যা নেই সে সেটা বিক্রি, দান বা অন‍্য কোন ভাবে হস্তান্তর  করতে পারেন না। কালিমতীর অভিভাবক ছাড়া তো কেউ দান করতে পারবে না। আর লক্ষ্মীমণি দেবী তো মেয়ের মা অর্থাৎ মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ কি সম্প্রদান করতে পারে নাকি। তাই কালিমতীর দান নিয়ে দেখা দিল সমস‍্যা। এবার পুর্বে উদ্ধৃত নারদবচন কার্যকর করার সুযোগ এল। সেখানে বলা আছে,

পিতা স্বয়ং কন‍্যাদান করবেন, অথবা পিতার অনুমতি নিয়ে ভ্রাতা দান করবেন। নতুবা মাতামহ, মাতুল, জ্ঞাতি, বান্ধব কন‍্যা দান করবেন। এদের সকলের অভাবে মাতা নিজে কন‍্যাদান করবেন যদি তিনি সমস্ত দিক থেকে প্রকৃতিস্থ হন। আর তিনি যদি অপ্রকৃতিস্থ হন তবে সজাতীয়রা কন‍্যাদান করবেন।

এক্ষেত্রে পাত্রীর মাতা স্বয়ং উপস্থিত এবং তিনি সম্পুর্ণভাবে প্রকৃতিস্থ এবং সুস্থ। তিনি শাস্ত্র অনুসারে কন‍্যাদান করার ন‍্যায‍্য অধিকারী ও যোগ‍্য। তাই স্থির হল যে লক্ষ্মীমণি দেবী স্বয়ং কন‍্যাদান করবেন। পাত্রীর মা স্বয়ং কন্যাকে পাত্রের হাতে দান করতে সম্মত হলেন এবং তাতে সকলে সম্মতি প্রদান করলেন।  শুরু হল চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতি। উঠল সাজো সাজো রব। বিয়ে বাড়ীর সামনে বিকেল গড়াতেই আগ্রহী লোকের ভিড় জমতে শুরু করল। স্কুল, কলেজের ছাত্ররা দলে দলে বিয়ে বাড়ীর রাস্তার সামনে জমা হল।

এই ছাত্রদের প্রায় সকলেই বিয়ে দেখার উদ্দেশ্যে ও বিয়েকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে জমা হয়েছিল। হাওড়া জেলা বিশেষ করে বালী এলাকা থেকে ও অন্যান্য জেলার থেকেও অনেক মানুষ এসেছিলেন। সন্ধ্যার থেকে এতটাই ভীড় হয় যে পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের পর্যন্ত ভীড় সামাল দিতে নামতে হয়।

রাত্রি প্রায় ১১ টার সময় বর স্বয়ং শ্রীশচন্দ্র সুসজ্জিত শকটে সুসজ্জিত হয়ে বিয়ে বাড়ি পৌঁছান। বিবাহ অনুষ্ঠানে কোন প্রকার ঘাটতি ছিল না। বিয়ে বাড়িতে বর নিয়ে আসেন স্বয়ং রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ‍্যায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ, রামগোপাল ঘোষ, দ্বারকানাথ মিত্র প্রমুখ  স্বনামধন্য ব‍্যক্তিবর্গ এবং বিধবা বিবাহে বিদ‍্যাসাগরের সহযোদ্ধাবৃন্দ।

সংস্কৃত কলেজের প্রচুর ছাত্রও উপস্থিত ছিলেন। বাড়ির সামনে শুধুমাত্র আগ্রহী জনতার ভিড়ের জন্যই ভিড় সরিয়ে বিবাহ আসরে বর এসে পৌঁছুতে অনেক  বিলম্ব হয়। ইতিমধ্যে বিবাহ স্থলে এসে উপস্থিত হন  বাবু নীলকমল বন্দোপাধ্যায়, বাবু দিগম্বর মিত্র, বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র, বাবু নৃসিংহচন্দ্র বসু, ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায়, রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রমানাথ, ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু প্রমুখ বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ। বরপক্ষ ও কন‍্যাপক্ষের পৃথক পৃথক পুরোহিত উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় দুই হাজার দর্শক বিবাহের স্থানে উপস্থিত ছিলেন এবং ছয়শত নিমন্ত্রিত লোক বিয়ে বাড়িতে আহার করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে বিধবা বিবাহ বিরোধী অনেক ব্রাহ্মণরাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোন মন্ত্র পাঠ করে বিয়ে হয়, কিভাবে বিয়ে হয় এবং কে সম্প্রদান  করে সেসব প্রত‍্যক্ষ করা। এ ছাড়াওভাস্করপত্রিকার সম্পাদক গৌরীশংকর ভট্টাচার্য্য সর্বক্ষণ বিয়ে বাড়িতে  উপস্থিত ছিলেন। বিয়ে বাড়িতে  উপস্থিত থাকার জন‍্য তাকেও তির্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছিল। সংবাদ প্রভাকর ছেপেছিল যে,  গৌরীশঙ্কর বাবু কি জানতেন যে শ্রীশচন্দ্র বাবু কোন কারনে উপস্থিত না হলে বিকল্প পাত্র বিবাহ স্থলে উপস্থিত ছিল  কি না।

বিয়েবাড়িতে বর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল চরম ব্যস্ততা। বর বিয়ে বাড়ি আসতেই  ঢোল সহ বিয়ের বাজনা বাজতে শুরু করল। প্রচুর সংখ্যক মহিলা উপস্থিত ছিলেন। ঘন ঘন উলুধ্বনি ও শঙ্খ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো বিয়ে বাড়ীর প্রাঙ্গণ। এয়োস্ত্রীরা বরণ ডালা হাতে এগিয়ে এসে বরকে বরণ করেন। বিভিন্ন সংবাদ পত্রের সম্পাদক ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ বিবাহ স্থলে আসন গ্রহণ করেন। স্ত্রী আচার ও রঙ্গ রসিকতায় ভরে ওঠে বিবাহ স্থল। দুজন পুরোহিতই পাত্রকে বিবাহ বাসরে নিয়ে আসার আগেই বিবাহ বাসরে বসেছিলেন। মন্ত্র পাঠ হচ্ছিল। এ বিয়েতে কি কি মন্ত্র পাঠ হয়‌ বা কোন মন্ত্র উচ্চারণ করে কি পদ্ধতিতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সে বিষয়ে জানতে অনেকেই আগ্রহী ছিলেন। এমনকি বিধবা বিবাহের ঘোর বিরোধী দুই চার জন ও বিধবা বিবাহের বিপক্ষের সমর্থক সংবাদ পত্রের লোক ও উপস্থিত ছিলেন।

যথাসময়ে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিবাহ। অন্য সব বিয়েতে যেভাবে ও যে সকল মন্ত্র পাঠ করে বিয়ে হয় ঠিক সেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় এবং সেসব মন্ত্র উচ্চারিত হয়। বিয়ে বাড়ীতে ও সংলগ্ন স্থানে দুই হাজারের বেশী লোক উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সকলের সামনেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। দেশাচার ও লোকাচার বিস্তৃত ভাবে পালিত হয়। এই বিয়েতে দান সামগ্রী ও অলঙ্কার প্রায় সবই ছিল। বিয়ে শেষ হওয়ার পর বর - বউকে আচার পালনের জন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তখনকার দিনের প্রচলিত নিয়ম অনুসারেদ্বারষষ্ঠী ঝাঁটাকে প্রণাম করানো হয়। এয়ো স্ত্রীরা উলুধ্বনি দিয়ে বরকে বলেছেন এখানে বরকে নাকমলা খেতে হয়, এখানে কানমলা খেতে হয় এবং তারা বরকে বাধ্য করেন নাক, কান মলতে। এয়ো স্ত্রীরা বরের হাতে কড়ি দিয়ে বললেন, ‘কড়ি দে কিনলেম, দড়ি দে বাঁধলেমএভাবে রঙ্গ তামাশায় ভরে উঠলো বিয়ে বাড়ী। এ সময় একটি মাকু নিয়ে গিয়ে বরকে  বলেন এটি হাতে ধরতে হয়। যেই বর সেই মাকুটি ধরেছে এয়ো স্ত্রীরা সমবেত কণ্ঠে ছড়া কেটে  বলে‌ উঠলো, ‘হাতে দিলাম মাকু, একবার ভ্যা কর তো বাপু।‌ পাত্র শ্রীশচন্দ্র বাবু তো কিছুতেই ভ্যা করতে রাজি নন। এয়ো স্ত্রীরাও বরকে ছাড়তে রাজি নন। বিয়ের প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন,

 শেষ পর্যন্ত রমণীগণের একান্ত প্রার্থনায় বর বাহাদুর ভ্যাও করিয়াছিলেন।”

এদিকে যখন এ রকম রঙ্গ রসিকতা চলছিল তখন বিয়ে বাড়ীতে আমন্ত্রিত অতিথিদের আহারের ধূম পড়ে যায়। ঢোল ও অন‍্যান‍্য বাজনা বাজানোর উচ্চ শব্দ ও চিৎকার চেঁচামেচির মধ‍্যে প্রায় ছয় শত লোক আহার করেন। গৃহ কর্তা বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অন্যান্য সহকারীরা সারা রাত পরিশ্রম করেন।


পটচিত্রে বিদ্যাসাগর ও বিধবা নারীকুল 

প্রথম বিধবা বিবাহ সুসম্পন্ন হল। যদিও তখন অনাগত ভবিষ্যতের জন্য অলক্ষে বিধাতা অনেক অবাঞ্ছিত ফল লিখেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজস্ব প্রায় দশ বার হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। এরপর আরও কত বিধবা বিবাহ হয়েছে। পরের দিনই কৃষ্ণকলি ঘোষের পুত্র মধুসূদন ঘোষের সঙ্গে নিমাই চরণ মিত্রের পৌত্রী তথা ঈশানচন্দ্র মিত্রের বিধবা কন‍্যার বিয়ে হয়। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ই আগষ্ট  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগরের একমাত্র পুত্র  নারায়ণ বিদ‍্যারত্ন ও বিধবা ভবসুন্দরীকে বিয়ে করেছিলেন। আইনসিদ্ধ হওয়ায় বিধবার বিবাহে আর বাধা রইল না, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে থাকে বিধবা বিবাহের খবর। অমৃতবাজার-এর মতো হিন্দু ধর্মের প্রতি নিষ্ঠ পত্রিকাও সোৎসাহে এমন সব বিবাহের খবর ছাপতে কসুর করেনি- 

 “২৪ শে কার্ত্তিক রবিবার রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় শ্রীযুক্ত বাবু ব্রজসুন্দর মিত্র মহাশয়ের ঢাকাস্থ বাসাবাটীতে একটী বিধবা বিবাহ হইয়া গিয়াছে। বরের নাম শ্রীযুক্ত নবকুমার বিশ্বাস, বয়স প্রায় ২৬ বৎসর। পাত্রীর নাম শ্রীমতী ভুবনময়ী দেবী, বয়স প্রায় ২০ বৎসর। ১৫/১৬ বয়ঃক্রমের সময় ইনি বিধবা হন(১৯ নভেম্বর ১৮৬৮)।”

মাঝে মাঝে আবার বিজ্ঞাপনও প্রচারিত হয়েছে অমৃতবাজার পত্রিকাতেই, এই কায়দায়,

“রাঢ়ী শ্রেণী অতি প্রধান ব্রাহ্মণ বংশীয় একটি বিধবা কন্যা বিবাহ করিতে সম্মত আছেন। বয়ঃক্রম ১৭ বৎসর, পরমা সুন্দরী লেখাপড়া অল্প জানেন। ৮ বৎসর বয়ঃক্রম কালে বিধবা হয়েন ও কন্যার কর্ত্তৃপক্ষেরা সম্মত আছেন।(১৮ নভেম্বর ১৮৬৯)

 

বিধবা বিবাহ দিতে বিদ‍্যাসাগর প্রচুর দেনাগ্রস্ত হয়েছিলেন। নিজে প্রচুর টাকা খরচা করেছেন বিধবা বিবাহের জন্য। শুধু বিয়ের খরচ নয়, বিয়ের দিন যাবতীয় খরচখরচা ছাড়াও কন্যার অলঙ্কার, যৌতুক, বিয়ে বাড়ি সাজানো, ভোজন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বিদায়ের সমস্ত খরচ তিনি করতেন। ১৮৬৭ সালের একটা হিসেবে দেখা গিয়েছিল, ১৮৫৬ থেকে ৬৭,  এই ১১ বছরে  বিদ্যাসাগর মোট ৬০ টি বিধবা বিবাহের জন্যে খরচ করেছিলেন তখনকার সময়ে  ৮২ হাজার টাকা। তবু অনেকেই বিধবা বিবাহ নিয়ে তাঁকে প্রবঞ্চিত করেছেন। বিধবা বিয়ের নাম করে টাকা নিয়েছেন। বিধবা বিয়ে করে বিদ‍্যাসাগরের অর্থে প্রদত্ত অলঙ্কার ও দানসামগ্রী নিয়ে কদিন পরে নব বিবাহিতা স্ত্রীকে ফেলে পালিয়েছেন। সেমেয়েদের বিধবা হিসাবে তবু একটা আশ্রয় ছিল। কিন্তু সে তখন আশ্রয়হীনা এবং স্বামী পরিত‍্যক্তা। তাই তার পরবর্তীকালের জীবন সহজেই অনুমেয়। এভাবে নৈতিকতা বোধহীন সমাজের প্রতি তাঁর বিরক্তি জন্মে। বিদ‍্যাসাগর তাই এক চিঠিতে দুর্গাচরণ বন্দোপাধ‍্যায়কে লিখেছিলেন,

 

“.... আমাদের দেশের লোক এত অসাড় ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে, আমি কখনই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না। ত‍ৎকালে সকলে যেরূপ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন তাহাতেই আমি সাহস করিয়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম নতুবা বিবাহ ও আইন প্রচার করিয়া পযর্ন্ত করিয়া ক্ষান্ত থাকিতাম। দেশহিতৈষী সৎকর্মোৎসাহী মহাশয়দিগের বাক‍্যে বিশ্বাস করিয়া ধনে প্রাণে মারা পড়িলাম। অর্থ দিয়া সাহায্য করা দূরে থাকুক কেহ ভুলিয়াও এ বিষয়ে সংবাদ লয়েন না।”

 

অন‍্যদিকে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ সমাজ নানাভাবে বিধবা বিবাহ বিরোধিতা করতে থাকেন। বিধবা বিবাহের সমর্থকদের উপরে নানা রকম অত‍্যাচার হয়। তাদের অনেকে সমাজ চ‍্যূত হন। প্রথম বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রও তার ব‍্যতিক্রম নয়। রাজকৃষ্ণ বাবু এবং শ্রীশচন্দ্র বাবুকেও এমনকি  দর্শকদের  অনেককে মূল‍্য দিতে হয়েছিল পরবর্তীতে এসব কার ছাড়াও অন‍্যান‍্য আরও অনেক কারণে শেষ জীবনে বিদ‍্যাসাগর স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। তবু বিদ‍্যাসাগর সফল। বিধবা বিবাহ আজ ঐ আইনেই সিদ্ধ। সে আইন বর্তমানেও প্রচলিত  আছে।

অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও হিমালয় পর্বতের মতো বিদ্যাসাগর ছিলেন নিজ কার্যে অচল অটল ও স্থিতধী এই কাজের জন্য তিনি নিজের আত্মীয়দের বিরাগভাজন হওয়া সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি কোনোদিনও কারো সাথেরমেশচন্দ্র দত্তের কথায়,

“An ordinary man would have despaired in those circumstances, but determined Vidyasagar was not such a man. On one side there were selfishness, inertia, foolishness and hypocrisy, on the other side there was Ishwar Chandra Vidyasagar. On one side social torture on widows, the heartlessness of males, the immobility of a spineless nation, on the other side Ishwar Chandra Vidyasagar.  On one side the power of superstitions and selfish priests about fake Hinduism, on the other side Ishwar Chandra Vidyasagar.”

 

কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বঙ্গবিধবারা বিবাহের সুযোগ কত দূর পেলেন, বিধবা বিবাহ প্রচলনের সার্ধশতাধিক বর্ষ পরেও সেই আলোচনাও আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিধবা বিবাহ একটি বিশেষ শ্রেণির মধ্যে এর সীমাবদ্ধ থাকার কথা সে কালের কাগজে বার বার এসেছে। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’(১৯ অগস্ট ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ) স্পষ্টই লিখেছিল, নতুন আইনে বিধবা বিবাহের উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে না। তন্তুবায়, নাপিত, ধোপা প্রভৃতিদের মধ্যে লোকসংখ্যা কমছে। বিধবা বিবাহানুরাগী নব্য সম্প্রদায় উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে বিধবাবিবাহ প্রচলন করিতে এত দিন যত আয়াস স্বীকার ও অর্থ ব্যয় করিয়াছেন, যদি শিল্প ও শ্রমজীবী লোকের হিতার্থে সেই প্রকার আয়াস স্বীকার ও অর্থ ব্যয় করিতেন তা হলে কাজের কাজ হত। উচ্চশ্রেণিতে এই ব্যয় আসলে ‘মরুভূমে জলসিঞ্চনের’ মতো। যে অমৃতবাজার পত্রিকা বিধবা বিবাহের এত খবর বা বিজ্ঞাপন ছেপেছে, তারাই আবার লিখেছে (১১ মার্চ ১৮৬৯), অনুসন্ধান করলেই জানা যাবে যে ‘কুকাণ্ডের হেতু বিধবারা’ এবং লাম্পট্য দোষ এত প্রচলিত হইবার প্রধান কারণ বিধবা দিগের বিবাহ না দেওয়ায়... কত প্রধান লোকে বাধ্য হইয়া আপনার কন্যা, কি ভগ্নির উপপতি আপনি যোগাইতেছেন— তবু, সমাজের ভয়ে বিধবাবিবাহ দিতে পারেন না। শেষে সংযোজন— বহু ব্রাহ্মণ-প্রধান গ্রাম স্ত্রীলোক শূন্য। বিধবা বিবাহ প্রচলন ছাড়া তাদের আর উপায় নেই। তা চালু হলে কনের বাজার সস্তা হবে ও ‘তাঁহাদের বংশ রক্ষার উপায় হইবে।’

 

আসলে ওই ‘সমাজভয়’টি কাটিয়ে ওঠা তো সহজ ছিল শ্রীশচন্দ্রকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর রীতিমতো প্রায়শ্চিত্ত করেই জাতে উঠতে হয়েছিল। মেদিনীপুরে কেদারনাথ দাসের ‘প্রযত্নে’ ও উৎসাহে হৃদয়নাথ দাসের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে যে বিধবার বিবাহ হয়েছিল, ‘সোমপ্রকাশ’ (১৪ মার্চ ১৮৬৪) লিখেছে, পরে তা একেবারেই ‘নির্ব্বাণ প্রাপ্ত’ হয়েছিল। কেদারনাথ ক’দিন পরই প্রায়শ্চিত্ত করে ঘোষণা করেন যে তিনি ভাইয়ের আবার বিয়ে দেবেন এবং ওই বিধবাকে তাঁরা ‘ত্যাগ’ দিলেন। দুঃখের কথা, বিধবাটির ভাইও সপরিবারে প্রায়শ্চিত্ত করে সভামধ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘আমি ভগিনীকে একেবারে ত্যাগ করিলাম।’ এই তো অবস্থা! আর বাঙালি বিধবারা-এর অসারতা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন। সে কালের প্রহসনগুলোয় তাঁদের সেই অনুভূতির অজস্র নমুনা পাই। ‘বেশ্যা বিবরণ নাটক’-এ (১২৭৬ বঙ্গাব্দ) লেখক তাই তো সুধামুখীর মুখ দিয়ে বলালেন,

 

‘জবন কূলেতে জন্ম গ্রহণ করিব। স্বামীহীন হলে পুনর্বিবাহ করিব। হিন্দু কূলে জন্ম আর নাহিক লইব। হিন্দু কূলে মনুষ্য নাহিক এক জন।...’

এই অমৃতবাজার পত্রিকাই (২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৮) ‘কুলকামিনীগণ কি নিমিত্ত কুৎসিত বেশ্যাবৃত্তি’ গ্রহণ করে তার কারণ অনুসন্ধানার্থে প্রায় ২০০ বেশ্যার ‘পরিচয়’ নিয়ে গুটিকয়েক ছেপেছিল। বিচিত্র তাঁদের অভিজ্ঞতা। স্বামীর মৃত্যুর পর ইচ্ছা বাগদীকে তাঁর শাশুড়ি এক বেশ্যার কাছে বেচে দেন। বিধু, গয়া, আহ্লাদী বা স্বর্ণ-র মতো মেয়েরা ‘লাইনে’ আসেন স্রেফ স্বামী হারিয়ে, খাওয়া-পরার জন্য। বামা বা হরমণি গোয়ালার মতো মেয়েরা আবার বিধবা হয়ে কারও প্রেমে পড়েন, যারা তাদের কুলটা করে। আর গতি না থাকায় শেষে বেশ্যাবৃত্তি। ব্রহ্ম কৈবর্ত্ত বলেই ফেলেন,

‘বিধবার যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া কুলে’ কলঙ্ক দেন। সবাই তাঁকে পরিত্যাগ করায় অগত্যা এই পেশায় নামা। লক্ষ্মী নাপিত স্বীকারই করেন,

‘এয়েছিলাম হইয়াছিল ভাল, কারণ বিধবার কষ্ট সহ্য চেয়ে বেশ্যা হওয়া ভাল।’ সত্যিই বেশ্যা হয়ে তাঁরা বোধহয় সুখে ছিলেন। ওই ‘বেশ্যা বিবরণ নাটক’-এই সুধামুখী বলছেন,

 ‘হইয়ে বিধবা দুক্ষে কত দিন গেল।। বেশ্যা হইয়ে কিঞ্চিৎ সুখ হয়ে ছিল।’

তবে এই পথ তো আবার সকলে ধরতে পারেননি। পাছে ‘কলঙ্ক’ লাগে তাই অনেকে আবার আত্মহননের মাধ্যমে চিরশান্তির পথটি বেছে নেন। মনে পড়ছে কুসুমকুমারী নামের সেই মেয়েটির কথা, লম্বা এক চিঠি লিখে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ১৮ বছরের এই বিধবাটি লিখছেন,

অধিকদিন আর বাঁচিয়া থাকিলে পাছে আবার জীবনে কলঙ্ক হয়, এই লজ্জায় আমি আত্মহত্যা করিলাম।’’

 হাজার টাকার দুটো কোম্পানির কাগজ রেখে যান বোন কদমের জন্য, ভাইয়ের স্ত্রীকে গলার চিক। বাড়ি ইত্যাদি দেন মা’কে। নিজের পারলৌকিক কাজের খরচও রেখে যান কুসুম। ‘সুলভ সমাচার’ (১৯ অক্টোবর ১৮৭৫) লিখেছিল,

যাঁহারা বিধবা বিবাহের বিরোধী তাঁহারা কুসুমকুমারীর পত্রখানি পড়িয়া বুঝিতে পারিবেন যে, বিধবাদিগের কি ভয়ানক যন্ত্রণা।

স্বর্ণকুমারী, সরলা বা অবলাদের আমরা স্মরণ করি। কুসুমদের কণ্ঠস্বর অশ্রুতই রয়ে গেল। বিদ্যাসাগর কিন্তু অগণিত বিধবার যন্ত্রণায় কাতর হয়েই এই কাজে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বিধবা বিবাহ বিষয়ক প্রথম পুস্তকের ভূমিকায় লিখেছিলেন,

‘বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা, ব্যভিচার দোষ ও ভ্রূণহত্যাপাপের নিবারণ ও তিনকুলের কলঙ্ক নিরাকরণ হইতে পারে। যাবৎ এই শুভকরী প্রথা প্রচলিত না হইবেক, তাবৎ ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্যযন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক।’

বিধবাবিবাহ আইনসম্মত হওয়ার পরেও ব্যভিচার দোষ আর ভ্রূণহত্যা— কোনওটাই কমেনি। প্রশমিত হয়নি বৈধব্যযন্ত্রণার অনল। সংবাদপত্রে বিধবা বিবাহের সংবাদ যত না ছিল, তার তিনগুণ ছিল বিধবার ‘কিস্‌সা’। কখনও দু-এক লাইনে, যেমন,

শুনা গেল রাজাবাড়ী স্টেশনের অন্তর্গত রাউৎভোগ গ্রামে একটি সামান্য জাতীয়া বিধবার গর্ভ হওয়াতে সমাজভয়ে উহার আত্মীয়গণ ঔষধ প্রয়োগবশতঃ তাহা নষ্ট করে।...বিধবা বিবাহ না দেওয়ার এই বিষম ফল,  (রঙ্গপুর দিক্‌প্রকাশ, ২৬ নভেম্বর ১৮৬৮)

আবার কখনও বিশদে। তেমন দুটি মর্মস্পর্শী খবর একটু দেওয়া যাক।

কোন্নগরে এক বিধবা চমৎকারী গোয়ালিনী গর্ভবতী হন দেবর উমেশের কৃপায়। উমেশ তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এসে প্রতিবেশী গোপীনাথের কাছে ওঠে। তার পর বিপদ বুঝে এক রাত্রে শ্মশানঘাটের কাছে উন্মুক্ত জায়গায় ফেলে রাখে বেশ কয়েক দিন। চমৎকারী একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করেন। অবস্থা ক্রমশ খারাপ হলে উমেশ তাঁকে গরুর গাড়ি, নৌকোয় চাপিয়ে নিয়ে যায় কলকাতার ইডেন হাসপাতালে। হাসপাতালের লোকেরা বলেছেন,

তাহাকে এমন অবস্থায় তথায় আনা হয় যে, প্রসবের পর ৪/৫ দিন তাহাকে কেহ স্পর্শ করে নাই। তখন সে অতি অপরিষ্কার অবস্থায় ছিল। সাক্ষীরা আরও বলেন যে, “পুরুষের (পড়ুন উমেশের) সম্ভবতঃ খুব ইচ্ছা ছিল যে, স্ত্রীলোকটী ‘আর না থাকে’

হাসপাতাল-কর্মী রামচন্দ্র মিত্র, যিনি সুরতহাল করেছিলেন মৃত মেয়েটির, বলছেন

 একটী পূর্ণগর্ভা স্ত্রীকে মাঠে... এবং বারান্ডায় হাওয়ায় ফেলিয়া রাখা কোনও সুসভ্য দেশে হয় না।

 সত্যিই তাই। না হলে কি আর উমেশের মোটে দু’বছরের কারাদণ্ড হয়! ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায় ১৮৯০-এ ধারাবাহিক ভাবে এই কাহিনিটি ছাপা হয়েছিল।

 

আর একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে কলকাতায়। ১৮৯১-এর ১৭ এপ্রিল ‘এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ’ পত্রিকায় এ রকম একটি খবর প্রকাশিত হয়,

 

গিরিজাসুন্দরী নামিকা একটী বিধবা ব্রাহ্মিকার হত্যা হইয়া গিয়াছে। অম্বিকাচরণ বসু নামক এক ব্যক্তি হত্যা করা স্বীকার করিয়াছে। সমকালীন অন্যান্য পত্রিকা থেকে জানা যায়, বরিশাল বানরীপাড়ার গিরিজা ১১ বছরে বিধবা হন। পরবর্তী কালে অম্বিকার প্রেমে পড়েন, অতঃপর ‘…গর্ভ হয়, পরে ভ্রূণহত্যা করে।’ ‘নব্যভারত’ সম্পাদক, সুপ্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী মেয়েটিকে ‘নিষ্পাপ’ করার জন্য কলকাতায় এনে হেদুয়ায় মিস নীল-এর স্কুলে লেখাপড়া শিখতে পাঠান। বরিশাল থেকে ১১২টি চিঠি লেখে অম্বিকা। শেষে উত্তেজিত হয়ে অম্বিকা কলকাতায় এসে এক রাতে বর্তমান বিধানসরণির ওপর, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে গিরিজাকে। সে দিন কেবল এক জনই এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর রক্ষার্থে, প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর বাবা মহেশ আতর্থী। এই গিরিজাকে নিয়েই দেবীপ্রসন্ন ‘মুরলা’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন।

 

প্রেমাস্পদ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এই দুশ্চিন্তায় বিধবা মেয়েটিই কখনও কখনও ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বীরভূমের গোনাটিয়ার কাছে গনেড়া গ্রামের একটি বিধবা প্রতিবেশী এক যুবকের প্রেমে উন্মত্ত হলেন। গোল বাধল ছেলেটির বিয়ের প্রস্তাব এলে। মেয়েটি ভাবল, এ বার তো ছেলেটি তাকে ছাড়বে। এই শঙ্কায় হবু পাত্রীটিকে এক দিন সে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ‘গৃহ মধ্যে প্রবেশ করাইয়া, বস্ত্র দ্বারা মুখ আবৃত করিয়া গলায় লাঠি দিয়া নোড়া দ্বারা মস্তক চূর্ণ করিয়া’ প্রাণ নাশ করে। দেহ লোপাটের চেষ্টা করে শেষ অবধি ধরা পড়ে বলে ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছিল (২১ মার্চ ১৮৬৪)।

 

হাতুড়ের ওষুধে ‘গর্ভ নষ্ট’ করতে গিয়ে কত বিধবার প্রাণ গেছে বলা শক্ত। নদিয়া বিভাগের আরক্ষা দফতরের কেবল ১৮৫৯-এর প্রতিবেদনেই এমন বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশ পায়। বয়ান একই— “a Hindoo widow, who had intrigued and became pregnant.” তার পর লোকলজ্জায় পাশের গ্রামের এক বৃদ্ধাকে তলব, যার ওষুধে গর্ভপাত হল বটে, তবে বিধবার জীবনের বিনিময়ে। না হলে আবার ‘স্ত্রীলোকের গর্ভে পদাঘাত করিয়া তাহার গর্ভপাত’ করা হত। ‘তাহাতে সন্তানের সহিত প্রসূতীর’ মৃত্যু হত। যেমনটি হয়েছিল কুমারখালির পাংসা স্টেশনের অধীন দক্ষিণবাড়ি গ্রামের সেই বিধবাটির (‘সংবাদ প্রভাকর’, ২৯ জুলাই ১৮৬৯)। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভধারিণীও বিধবা কন্যার ‘বেয়াদপি’ মানেননি। দশ বছরের মেয়ে প্রতিমার জন্য ৫০/৬০ বছরের পাত্র। কয়েক মাসেই বিধবা। ক্রমে প্রতিমা ‘প্রলোভনে গ্রাম্য এক যুবকের প্রণয়ে পড়িয়া পাপসাগরে ডুবিল।’ সন্তানও হল। শিশুপুত্রকে মেরে ফেলার প্রস্তাবে মেয়ে রাজি না হওয়ায় তার ‘রাক্ষসী মা সমাজের ভয়ে গলায় পা দিয়া ছেলেটিকে মারিয়া’ ফেলে। অবশেষে ‘হতভাগিনী প্রতিমা জাহ্নবীবক্ষে ডুব দিয়া সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা দূর’ করেছিল (‘হিতকরী’, ৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯১)। ভিলেন তো অনেক ক্ষেত্রে নিজের দাদাও হতেন। ‘দেবগণের মর্ত্যে আগমন’ বইয়ের দৃশ্যটি মনে পড়ছে। রুদ্ধদ্বার এক ঘোড়ার গাড়ি থেকে শোনা যাচ্ছে এক মহিলার কান্না। নিজের দাদার কাছে তিনি জানতে চাইছেন তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যখন জানলেন বাগানে, অবাক হলেন। দাদা বলছেন, “তোর পেটের ওটাকে নষ্ট কর্‌তে হবে। নচেৎ ছেলে হলে কি মুখ দেখাতে পার্‌বি?” বরুণদেব ব্রহ্মাকে বলছেন, “কোন বাবুর বিধবা ভগ্নীর গর্ভ হইয়াছে, সেইজন্য বাগানে ভ্রূণহত্যা করিতে লইয়া যাইতেছেন। ব্রহ্মার উত্তর, “এ সব শুন্‌লে পাপ, দেখ্‌লেও পাপ।

 

হতভাগিনীরা এ সবই ‘অদ্দেষ্ট’ বলে মেনে নিয়েছিলেন। জানতেনও, সব বিধবার ‘বে’ হওয়ার নয়। সাধারণ ঘরে দু-চারটে যা হচ্ছিল তারই বা পরিণতি কী ছিল? ‘হিতৈষী’-তে (১০ ডিসেম্বর ১৮৯৫) একটি খবর প্রকাশিত হয়, জামতাড়ার এক ব্যক্তি এক বিধবাকে বিয়ে করেই তাকে কুলির আড়কাঠির কাছে বেচে দেয়। জোর করে স্বামী ও শাশুড়ি মিলে তাকে রেলে তুলে দেয়। মেয়েটি সর্দারের আশ্বাসেও কান্না থামায়নি। শেষে শ্রীরামপুরে এসে পুলিশকে জানালে তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন তো কতই হয়েছিল। ‘বিধবাবিরহ’ (১৮৬০) প্রহসনে বিধবা মনোহরী চরিত্রটি বলছেন, বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ নিয়ে এত উদ্যোগ করলেন, বিধবারাও আনন্দে নেচে উঠলেন। দু’দিন যেতে না যেতেই সে আন্দোলনের জোর কমে গেছে—

 

‘এখন সেই সাগরের (পড়ুন বিদ্যাসাগরের) ঐরূপ তেজ ও কল্লোল কিছুই নাই— এখন কেউ তাঁর রবও শুন্তে পায় না... বিধবাদিগের বিরহ আগুনে বারিপ্রদান না করে ঘৃত ঢেলে দিয়াছেন, কিনা যে কর্ম্মেতে হাত দিলেন তাহা শেষ কর্ত্তে পাল্‌লেন না কেন?’

 

প্রহসন বলছে যখন এই সব হচ্ছে, তখনই ‘দুষ্ট নিমকহারাম সিপাইগণ’ খেপে উঠল, ফলে সব মাঠে মারা গেল। এটা ভেবেই অনেকে সন্তুষ্ট ছিলেন। হুতোম কিন্তু এমন ইঙ্গিত করেছিলেন— বিধবাবিবাহের আইন পাস ও বিধবাবিবাহ হওয়াতেই সিপাইরা খেপে ওঠেন। বাজারে রটেছে সরকার আইনটি তুলে নিয়েছেন, ‘বিদ্যেসাগরের কর্ম্ম গিয়েচে— প্রথম বিধবাবিবাহের বর শিরীশের (শ্রীশচন্দ্র) ফাঁসি হবে।’

 

আরও অনেক রকম খবর উড়ত। ‘রাড়ের বিয়ে ডিস্‌মিস্‌’-এ (১৮৬৭) প্রহসনকার বলছেন, বিধবার বিবাহ প্রচলিত করতে গেলে যেমন ভ্রূণহত্যার হ্রাস হইবে, তেমন স্বামী হত্যা প্রবল হইয়া উঠিবে। ‘চপলা চিত্ত চাপল্য’-তে (১৮৫৭) যদুগোপাল চট্টোপাধ্যায় কামিনীর স্বামীর মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন,

 

পোড়া কি এক সাগর (বিদ্যাসাগর) তার জ্বালায় মাগ্‌ নে নিশ্চিন্তি হয়ে শোবার যো নাই। যে বিধবা বের বিধি দিয়েছে। এখন আবার মেয়েগুলোর মন যুগিয়ে চল্‌তে হবে, তা না কল্লে বিষ খাইয়ে কি আর কোন রকমে মেরে ফেলে আর একটা বে কর্ব্বে।

 আসলে ‘বুড়ো ভাতার’কে ‘খেয়ে’ কমবয়সি স্বামী পাওয়ার লোভেই নাকি মেয়েরা স্বামীহত্যা করবে।

 কাজের কাজ হচ্ছে না বুঝেই ‘ভারত-সংস্কারক’ (২ অক্টোবর ১৮৭৪) এক মোক্ষম কথা লিখেছিল,

 

পূর্ব্বে বিধবাদিগের প্রতি সহমরণ ব্যবস্থা ছিল। অধিকাংশ বালবিধবা পতির সঙ্গে জ্বলন্ত চিতারোহণ করিয়া চিরজীবনের ক্লেশের শান্তি করিত। সহমরণ প্রথা যতই নিষ্ঠুর হউক না কেন, ইহা বেশ্যাবৃত্তি ও ব্যভিচার পাপের প্রাদুর্ভাব কথঞ্চিৎ নিবারণ করিত সন্দেহ নাই। এখন রাজাজ্ঞায় সহমরণ প্রথা রহিত হইয়াছে। ইহাতে বিধবার সংখ্যা বৃদ্ধি হইয়াছে। অথচ তাহাদের বিবাহের রীতি প্রচলিত হইতে পারে নাই। এরূপ অবস্থা যে বেশ্যাবৃত্তির প্রশ্রয় দান করিবে তাহা বিচিত্র নহে।

 

একটি গল্প মনে পড়ছে। তখন সদ্য সহমরণ প্রথা রহিত হয়েছে। জানবাজারের বাড়িতে এক রাতে রাজচন্দ্র ‘হাসিতে হাসিতে স্বীয় পত্নী’ রাসমণিকে সে খবর দিচ্ছেন। জীবনীকার হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, শুনে নাকি ‘সুমিষ্ট হাসি হাসিয়া’ রানি রাসমণি উত্তর দেন,

 সহমরণ প্রথায় আমাদের অনেক সুবিধাও ছিল। অসুবিধাও ছিল।... বড়লাট সাহেব সহমরণ প্রথা উঠাইয়া দিলেন ভালই বটে, কিন্তু বঙ্গ বিধবাদের পরিত্রাণের অন্যবিধ উপায় রহিল না। তাহারা যে কত কলঙ্করাশিতে কলঙ্কিত হইবে বলা যায় না। ভাবলে অবাক লাগে। প্রথম বিধবা বিবাহের মাস দশেক আগেই তো ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ (২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬) এক বিধবার মুখে এই সংলাপ বসানো হয়েছিল,

 যাবজ্জীবন দুঃখানলে দগ্ধ হওয়া অপেক্ষা এক দিবস দগ্ধ হইয়া প্রাণবিনাশ করা কতই ক্লেশকর বল?”

 আসলে সমস্যা তো সেই মানসিকতাতেই আবদ্ধ। বিশ শতকের সূচনায় ‘রঙ্গালয়’ পত্রিকা (৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৮) লিখেছিল,

 

স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় পুরুষশ্রেষ্ঠ যখন সর্ব্বস্বপণ করিয়া বাঙ্গালায় বিধবাবিবাহ চাপাইতে পারেন নাই, তখন আপাততঃ বাঙ্গালায় কাজের মত কোন কাজই হইতে পারে না।



বিধবাবিবাহের প্রচলনে তাঁর ভূমিকা স্মরণে রেখে সমকালে রচিত গান, ‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’ তিনি শুনেছেন, তেমনই তার ব্যঙ্গরূপটিও, ‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে’ ঠাকুরদাস-তনয়কে শুনতে হয়েছিল। আইন প্রণয়ন বিদ্যাসাগরের অক্ষয় কীর্তি, কিন্তু দেড়শো বছর পেরিয়ে আজও কি তেমন ভাবে বিধবার বিবাহ ‘চাপাইতে পারা গিয়াছে’?

অনেকে বলেন যে বিদ্যাসাগরের প্রায় কোনো আন্দোলনেই সফল হয়নি। বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন হলেও সমাজের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা একে গ্রহণ করেনি(যদিও শুদ্রশ্রেনী, সাঁওতাল, অন্যান্য উপজাতির মধ্যে কিন্তু বিধবা -বিবাহ চলন ছিল) বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ রদ  আইনও তিনি করাতে পারেননি যদিও এই তর্ক নিষ্ফলা  এটুকুই জানা দরকার যে, সে সময়ের গোঁড়া মনোভাবাপন্ন সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে তিনি যা করার স্পর্দ্ধা দেখিয়েছিলেন তা তখন কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারতো নাএইজন্যই, তিনি বিদ্যাসাগর। বাংলা সাহিত্য ও সমাজে অতলস্পর্শী অবদান তাঁর। বিধবাবিবাহ প্রচলনের ফলে আর্থিক, সামাজিক নানান বাধার মুখে পড়েছেন তিনি, হতে হয়েছে লাঞ্ছিত, অপমানিত। তা সত্ত্বেও তিনি গর্ব করে বলতে পারেন,

 

বিধবা বিবাহের প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সত্‍কার্য। জন্মে ইহা অপেক্ষা অধিক কোনো সত্‍কর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই; এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত করিয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাম্মুখ নহি।”

 

 কলমে --কমলেন্দু সূত্রধর



তথ্যসুত্রঃ-

  • প্রসঙ্গ বিধবা বিবাহ- উমাপদ রক্ষিত 
  • বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর- শেখর ভৌমিক 
  • বিদ্যাসাগর- বিহারিলাল সরকার 
  • প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর- বিমান বসু 
  • দ্বীশতবর্ষে বিদ্যাসাগর- দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক 
  • বিদ্যাসাগর ও বিধবাবিবাহ- সন্মাত্রানন্দ শোভন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন