অপরাজেয় – অপরাজিত

  


অভিনেতা:

জিতু কামাল,অঞ্জনা বসু,সায়নী ঘোষ,দেবাশিষ রায়,অনুষা বিশ্বনাথন, অনসুয়া মজুমদার

পরিচালক: অনীক দত্ত


সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী সুপ্রভা রায় চেয়েছিলেন তাঁদের একমাত্র সন্তান সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতনে শিক্ষা গ্রহন করুন। মায়ের ইচ্ছায় সত্যজিতের শান্তিনিকেতনের কলাভবনে চিত্রকলায় পারদর্শিতা লাভ করেন নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মত শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনে চিত্রকলায় শিক্ষাগ্রহনের পরে কলকাতায় ফিরে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা D. J. Keymer- এর কলকাতা শাখায় জুনিয়ার ভিস্যুয়ালাইজাররূপে যোগদান করেন।এরপরে সিগনেট প্রেসে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা ও বইয়ের অলংকরণ শিল্পীরূপে যোগদান করলে বিভূতিভূষণের চিরন্তন উপন্যাস ‘আম আঁটির ভেঁপু’র অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদ আঁকার ভার পরে তাঁর উপর। সেই প্রথম গ্রাম বাংলার জীবনের সঙ্গে পরিচয় হয় সত্যজিতের। আঁকা ও সিনেমার প্রতি প্রেম তাঁর প্রথম থেকেই।সিনেমার প্রতি এই আগ্রহ থেকেই ডিকে গুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, শাঁটুলবাবুদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করে ফিল্ম সোসাইটি।চাকরির সুবাদে  স্ত্রী বিজয়া রায়কে নিয়ে ৬ মাসের জন্য লন্ডনে থাকাকালীন ইউরোপীয় সিনেমার সান্নিধ্যে আসেন সত্যজিৎ রায়।লন্ডনে থাকাকালীন ভিট্টোরিও  ডি সিকা (Vittorio De Sica) পরিচালিত ‘বাইসাইকেল থিভস’ ছবিটি দেখে উদ্বুদ্ভ হন নিওরিয়ালিষ্টিক ছবি বানানোর প্রতি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত “আম আঁটির ভেঁপু” গল্পকে চলচ্চিত্রে রূপদান করার পরিকল্পনা শুরু করেন। এটিই “পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট রচনা হয়।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রীশ্রীমতী রমা বন্দোপাধ্যায়ের অবদান এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। যিনি বইয়ের চিত্রস্বত্ব হস্তান্তরিত করার সময় বলেছিলেন - এঁরা তিনপুরুষ ধরে বাচ্চাদের বই লিখছেন ও ছবি আঁকছেন, আর এঁর হাত ধরেই 'পথের পাঁচালী' খুব ভালো হবে। 

বিনিময়ে এক টাকাও মূল্য গ্রহন করেননি কারণ সেইসময় সত্যজিতের পক্ষে টাকা দেওয়া অসুবিধাজনক ছিল। অথচ এই চিত্রস্বত্ব হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে কেনার জন্য কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মত সেই সময়ের দিকপাল পরিচালকরাও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। অর্থসংকটে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ বহুবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বন্ধ থেকেছে বছরের পর বছর।স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে অর্থ সংগ্রহ করেও সম্পূর্ণ করতে পারেননি ছবি তৈরির কাজ।শেষে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের হস্তক্ষেপে সরকারী তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য করা হয়।নতুন উদ্যমে শুরু হয় ‘পথের পাঁচালী’র কাজ। 

এরপর ইতিহাস রচনা হল। যদিও শ্যুটিং শুরুর পর কাশবন গরুতে ভক্ষণ করা, কুকুরের ঠিক সময়ে না হাঁটা, বৃষ্টির অপেক্ষায় সারাদিন অপেক্ষা করার মত ছোট বড় বাধা অতিক্রম করে রাত দিন জেগে ছবি সম্পূর্ণ হল। নানা বাধা পেরিয়ে পথের পাচালি মুক্তি পেলেও তা তথাকথিত বাঙালি সমাজের প্রশংসা পেল না। কিন্তু এই ছবিই যখন বিদেশের মাটিতে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করল এবং সেই খবর যখন খবরের কাগজে ছাপা হল তখন ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে ভিড় উপচিয়ে পড়ল।

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র রূপে অভিহিত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবি “পথের পাঁচালী”। এই ছবি নির্মাণের চিন্তাভাবনা, প্রতিটি চরিত্রের জন্য যোগ্য শিল্পী নির্বাচন থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র নির্মাণের শেষ ধাপের বাধা পার হওয়ার ঘটনাগুলোকে একত্রিত করে চলচ্চিত্রের আকারে পরিবেশন করেছেন বর্তমান যুগের অন্যতম পরিচালক অনীক দত্ত “ অপরাজিত” নাম দিয়ে। এই ছবি দেখতে বসে দর্শক হারিয়ে যান সাদা কালোয় মেশানো এক অন্য সময়ে।

 ছবি শুরু হয় বিশিষ্ট সিনেমা ও নাট্যব্যক্তিত্ব শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি বসে অপরাজিত রায়ের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।অপরাজিত রায় অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়। যিনি তাঁর পরিচালিত ছবি “পথের পদাবলী” তৈরির নেপথ্য কাহিনী বর্ণনা করছিলেন। এই সাক্ষাৎকারের মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়েছে অতীতের বিভিন্ন গল্প আর সেই গল্প বুননের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে চিরকালীন বিশ্ব ক্লাসিক তৈরির নেপথ্য ঘটনার এক দলিল। পথের পদাবলী অর্থাৎ “পথের পাঁচালী”। অনীক দত্তের ছবিতে সমস্ত চরিত্রেরই নাম এইভাবেই পরিবর্তন করা হলেও এই বিষয়ে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন পরিচালক। ছবির গতিও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি বা দর্শকের চরিত্রের প্রকৃত পরিচয় জানতে অসুবিধা হয়নি।যেমন অপু হয়েছে মানিক, দুর্গা হয়েছে উমা, সর্বজয়া হয়েছেন সর্বমঙ্গলা, বিজয়া হয়েছেন বিমলা,সুব্রত হয়েছেন সুবীর, বোড়াল গ্রাম হয়েছে সরাল।  এই ছবি এক নস্ট্যালজিক ট্রিপের মত। বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের নমস্য, কিংবদন্তী বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের প্রতি তাঁরই জীবনের সেরা ছবি তৈরির নেপথ্য কাহিনির চলচ্চিত্রায়ণে যে ধারাবাহিক সংগ্রাম,তৎকালীন স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, প্রাচীন পন্থীদের অবজ্ঞা-অবহেলা উপেক্ষা করে সিনেমা বানানোর ব্যকরণটাকেই আমূল বদলে দেওয়ার চেষ্টা, সত্যজিৎ রায় নামের তরুণের সঙ্গে সুব্রত মিত্র,বংশী চন্দ্রগুপ্ত সহ আরও কয়েকজন চলচ্চিত্রপ্রেমী তরুণ যে অসাধ্য সাধন করেছিলেন তারই এক ডকুমেন্টেশন “পথের পাঁচালী” তৈরির প্রায় ৬৬ বছর পরে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরলেন পরিচালক অনীক দত্ত।

পথের পাঁচালী” ছবির আইকনিক কিছু দৃশ্যের শুটিং যেমন ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু, বৃষ্টিতে অপু দুর্গার স্নান, দুর্গার মৃত্যু,দইওয়ালার সঙ্গে অপু দুর্গা ও একটা কুকুরের শট, এমনকী, মৃত ইন্দির ঠাকরুণের শেষ যাত্রার শুটিং নিয়ে হাসি মসকরার ব্যাপারগুলোও বাদ যায়নি। পর্দায় দৃশ্যগুলো এলে, পুরনো ছবির কথা মনে করেই দর্শক আপ্লুত হয়েছেন। ছবি নির্মাণের কৌশলে যে সব যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিলেন সুব্রত মিত্র, তাঁর বাউন্সিং লাইটিং ব্যবহার, স্বাভাবিক আলোয় আউটডোর শুটিং করার সাহস, সেই অপু দুর্গার ট্রেন দেখার শটের অনিচ্ছাকৃত ভুল যে নতুন ব্যাকরণ তৈরি করে দিয়েছিল তারও উল্লেখ রয়েছে। “পথের পাঁচালী”র সঙ্গে মেলাতে বসলে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়, কি অসাধারণ ধৈর্য ও দক্ষতায় অনীক দত্ত নতুন করে তৈরি করেছেন অতীত। তুমুল বৃষ্টিতে ভাইবোনের ভেজার দৃশ্যটির শুটিংয়ে সত্যজিৎ নিজে থাকতে পারেননি, দু-তিনদিন অপেক্ষার পর হঠাৎ প্রচন্ড বৃষ্টি এসে পড়ায় সুব্রত মিত্র ও বংশী দুজনে মিলে শুটিংটুকু করেছিলেন।এই সমস্ত টুকরো টুকরো ঘটনার সমাহারে তৈরি হয়েছে অনবদ্য আরেক চলচ্চিত্র – “অপরাজিত”। বহুবছর মনে রাখার মত, মন ভরিয়ে রাখার মত এবং অবশ্যই বারংবার দেখার মত ছবি উপহার দিয়েছেন পরিচালক অনীক দত্ত। এর জন্য অফুরন্ত অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা পরিচালককে।দর্শক ছবি দেখতে দেখতে সেই সময়কে অনুভব করতে পারবেন। আবেগে ভেসে যাওয়ার মত ছবি।


ছবির অভিনেতাদের নিয়ে অবশ্যই পৃথকভাবে কিছু বলা প্রয়োজন। প্রথমেই উল্লেখযোগ্য ও অনবদ্য অভিনয় করেছেন সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় জিতু কামাল। সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে ছবি মুক্তির অনেক আগে থেকেই ছবির চরিত্র এবং তাঁদের চেহারার সঙ্গে দর্শকরা পরিচিত হয়েছিলেনপরিচালক ও অভিনেতার দিকে কটূক্তি ধেয়েও গেছিল সমান তালে। কিন্তু জিতু কামাল সেই সমস্ত আক্রমণের যোগ্য জবাব দিয়েছেন তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে।তাঁর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় নজর এড়াবে না। পর্দায় এক একটা দৃশ্যে জিতু কমলকে দেখে চমকে যেতে হয়
বারবার। সেই কৃতিত্ব যতটা মেকআপের ততোটাই অভিনেতারও প্রাপ্য। কারণ শুধু চেহারায় সত্যজিৎ হলে বাঙালি ছেড়ে কথা বলত না। অভিনেতার শরীরি ভাষা এ ছবিতে কথা বলেছে। ছবির বক্সঅফিস সাফল্যের দিকটি যেমনই হোক, জিতু কমলের অভিনয় জীবনের একটি মাইলফলক হিসেবে থেকে যাবে এ ছবি।

জীতুর অনবদ্য অভিনয়ের কথা বারবার লিখলেও, নাম ভূমিকার অপরাজিত অসম্পূর্ণ আরও দুজন মানুষ ছাড়া। একজন হলেন চন্দ্রাশীষ রায়, যিনি এ ছবিতে জীতুর চরিত্রের কন্ঠাভিনেতা। তাঁর কন্ঠ কখন যে জীতুর সঙ্গে মিলেমিশে সত্যজিতের হয়ে উঠেছে তা বুঝতেই পারা যায়না। ছবির ‘এন্ড ক্রেডিট’ না দেখলে অনেকে বুঝবেন না হলফ করেই বলা যায়। এক্ষেত্রে আর একটা কথা বলতেই হবে, তা হল অনীকের চন্দ্রাশীষকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়জন হলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের বর্তমান যুগের কিংবদন্তী মেক-আপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডু। মেঘনাদের মত অন্তরালে থেকে যে যুদ্ধ সোমনাথ করেছেন তা তৈরি করে দিয়েছিল অপরাজিত থাকার ভিত্তি।


বিমলা রায়ের (বিজয়া রায়)চরিত্রে সায়নী ঘোষের সঙ্গত করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিল না।তাও এই একটি চরিত্র একটু বেমানান লেগেছে কারণ সায়নী নিজের চিরাচরিত অতি পরিচিত ম্যানারিজমের বাইরে বেরোতে পারেন নি। কিছু কিছু দৃশ্যে বলা ওনার কথা অত্যন্ত কানে লেগেছে ওনার বিশেষ ধরণের উচ্চারণের জন্য।সামান্য তালভঙ্গকারী এই একটি চরিত্র অবশ্য অন্যদের অভিনয় দক্ষতায় চাপা পরে গেছে। 

খুব ভালো লাগল বিভূতিভূষণ পত্নী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে মানসী সিনহার অভিনয়। নিচুস্বর ক্ষেপনের মাধমে ধীর লয়ে স্বল্প গ্রাম্য উচ্চারণে যেটুকু সময় উনি ছবিতে ছিলেন তা মনে রেখে দেওয়ার মত।

সুব্রত মিত্রের ভূমিকায় দেবাশিষ রায়ও বেজায় সাবলীল। সমগ্র ছবিতে সমানভাবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন।

সত্যজিতের মা সুরমা রায়ের (সুপ্রভা রায়) চরিত্রে অনসূয়া মজুমদার, সর্বমঙ্গলার (সর্বজয়া) চরিত্রে অঞ্জনা বসু, মানিকের(অপু) চরিত্রে আয়ুষ মুখোপাধ্যায়, উমার (দুর্গা) চরিত্রে অনুষা বিশ্বনাথন চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। এই ছবি সম্পাদনা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ছিল এবং অর্ঘ্যকমল মিত্র সেই বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ক্যামেরায় সুপ্রতিম ভোল স্বকীয়তার ছাপ রেখেও ধরে রেখেছেন ‘পথের পাঁচালী’র রেশ। সাদা-কালো ছবিতে আলোর ব্যবহার এত চমৎকার যে আলাদা করে চোখে পড়ে। যাঁরা ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন যে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নজর দিয়ে যথেষ্ট যত্ন সহকারে পরিচালক এই ছবি বানিয়েছেন।

এ ছবির আরেক সম্পদ, ছবির সঙ্গীত, পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরস্মৃতি ফিরিয়ে আনার কাজটা দেবজ্যোতি মিশ্র দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। ছবির আলো এবং অন্ধকারের দুইয়ের পরিমিত ব্যবহার প্রশংসার দাবি রাখে।চিত্রনাট্যে কোনও অতিকথন নেই। দেখতে বসে দর্শকের অন্তত একঘেয়ে লাগবে না।


কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় 

চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন