পঞ্চাশোর্ধ পলাশ আজ বহুবছর পর অফিসের সবাইকে নিয়ে সেই ছোট্টবেলার জায়গায় স্মৃতি মাখতে এসেছে হঠাৎ। আবেগতাড়িত সে, বেশ অন্যমনস্ক। ঘুরে-ঘুরে হাতড়ে চঞ্চলভাবে কিছু খুঁজছে আজ...। দু'চোখে জমা হয়েছে বিস্ময়! চোখেমুখের চপলতায় বোঝা যাচ্ছে মানসিক বয়সটা অনেক বছর কমে গেছে।
খুঁজছে ছেলেবেলার সেই নানা স্মৃতিমাখা গ্রামটা।
আজ তার গায়ে আধুনিকতার ঝকঝকে প্রলেপ লেগেছে। পুরনো মাটির বাড়িগুলোতে কেমন নতুন
বালি সিমেন্টের আস্তরণ এখন। যতোদূর নজর চলে মাল্টিস্টোরিডও যে দু-একটা হয়নি তা নয়।
গ্লোবালাইজেশনে এখন পুরোপুরি শহুরে সভ্যতার পোশাকি ছাপ, তবু দু'চোখ
দেখছে প্রকৃতি দেবীর দু'হাত উজাড় করা সৌন্দর্য।
আবার সে কৈশোর, যৌবনের হাতছানিতে মোহিত
হল।
মাঘের গাঢ় কুয়াশা ভেজা
রাস্তার পাশে সারারাত হিমের অতি আদর সহ্য করা ঘাস, বাহারী
ফুলগুলো সকালের হালকা রোদের স্পর্শে যেন প্রাণ পেয়ে ঝিকিয়ে উঠেছে। পায়ে পায়ে
এগোতেই শৈত্যের তীক্ষ্ণ ছোঁয়ায় বহু স্মৃতি জলছাপ থেকে মূর্ত হচ্ছে সরণী বেয়ে।
----
ফুটিফাটা দরমার বেড়ার
ফাঁকগুলো দিয়ে হিমেল হাওয়া কামড় বসাচ্ছে সারা গায়ে। মায়ের শাড়িটা চার ভাঁজ করে
গায়ে মাথায় জড়িয়ে তবু শুয়ে আছে ভোমলা। আগে প্রতিবার এইসময় গোলাভর্তি নিজেদের নতুন
ওঠা ধানের মিঠে গন্ধ, ইঁদুরদের বেড়ে যাওয়া
ব্যস্ততা বিছানার আড়ে চুপ করে শুয়ে দেখতে ভারি মজা পেত সে। ঐসময় বাড়ির বড়দের
ছোটাছুটির অন্ত থাকতো না – ধানকাটা, ঝাড়াই, বাছাই গোলায় ভরা। মেয়েরাও নানা পুজোপার্বণ, ইতুরঘট বসানো, তিথি
মেনে উপোস করা, ঢেঁকিতে চাল ছাঁটা, গুড় জ্বাল দেওয়া প্রভৃতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো।
নানা ধরণের বাহারি নক্সী পিঠে তৈরীর তোড়জোড়েও ততটাই ডুবে যেতো। দম ফেলার পথ পেতে
না। আশপাশের কাকিমারাও আসতো। একসাথে গোল হয়ে চলতো ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ, সাথে মনের জমানো কথা বিনিময়। শীতটার মতোই
বড্ড জড়িয়ে, জাপটে থাকতো একে অপরকে।
এতো ব্যস্ততার শেষে তৈরী
হতো কতরকম পিঠে। রোয়াকে বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে ওরা বুক ভরে নিত সেই ঘ্রাণ।
বন্ধুরাও ভাগ পেতো। হাঁড়ির ঢাকাটা সরালেই ভাপা পিঠের ম-ম গন্ধ... এখনো বুক ভর্তি
শ্বাস টেনে পলাশ চেষ্টা করলো সে গন্ধ অনুধাবন করতে। ওইতো বেগুনের বোঁটায় তেল
মাখিয়ে মায়েরা চাটুতে... ছ্যাঁক-ছ্যোঁক আওয়াজ.. ওফ্! এখনো স্বাদকোরকগুলো অবাধ্যতায়
অস্থির। অনর্গল লালায় ভরে উঠছে মুখ। তখন শুধু সকলের কলাপাতা কেটে বসার অপেক্ষা
ছিল। পাশে একটু নারকেল কোরা,
ঝোলা
গুড় বা জ্যাঠাইমার কাঁসার জামবাটি ভর্তি দুধপুলি.. না! চোখ বুজল পলাশ। আর এখন
দক্ষিণ কলকাতার বহুতল আরামের ফ্ল্যাট থেকে পিঠেপার্বণ উপভোগ করতে যাওয়া এক পোশাকী
উৎসব মাত্র। সম্পূর্ণটাই ব্যবসায়িক হয়ে উঠেছে।
শীতের আদরে ভোমলার শুষ্ক
ঠোঁট, খড়ি ফোটা হাতপায়ে। এত
ব্যস্ততার মধ্যেই চলত পিঠে দু'ঘা দিয়ে মায়ের কাছে টেনে
বোরোলীন ল্যাপা। সারা মাঠময় পর্যন্ত রোদে টায়ার নিয়ে দৌড়ের ফাঁকে কখন যে আচারের
বয়ামগুলো কমে যেত তার নাগাল কেউ পেত না! কাজ গুছিয়ে শীতের শেষবেলায় মা কামিনী আতপ, নানা ডাল, ক্ষেতের
সব্জি দিয়ে বানাতো অমৃতের মতো খিচুড়ি।
রাস্তায় হাঁটার সাথে সে
হেঁটে চলেছে স্মৃতির সরণী। এই তো চাষ জমিটা, মাথাতোলা
ধানের শিষগুলোয় আহ্বান জানাচ্ছে হিরের দ্যুতি শিশিরবিন্দু। এখানে ধান পাকলে বাবা কাকার
সাথে কতো রাত খাটিয়া পেতে ধান পাহারা দিয়েছে। একটু বড় হতে পলাশের বসন্তকালে
ভালো লাগতো এ কাজটা। রাত গভীর হলে মেঠো খরগোসগুলো রাতচরা পাখিদের সাথে বেরিয়ে
পড়তো খাবারের খোঁজে। লম্বা ঘাসের সারির মাঝে উজ্জ্বল গুলির মতো জ্বলতো চোখগুলো।
ইচ্ছে হতো একটাকে ধরে নিয়ে পুষতে।
ওই তো তাদের এককালের
অবস্থাপন্ন বাড়িটা। টুপটাপ করে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ছাঁটে ভরে যাচ্ছে পলাশের দামী
লাল গাড়িটার কাঁচ। এমন বৃষ্টিটাকে ও বলতো বুন্দি বারিষ। একরাশ ধুলো উড়িয়ে পাশের
খালি জমিটায় ব্যবসায়ী ঘোষবাবুরা পেল্লায় বড় বাড়ি করে যেদিন এল, শীতের বিকেল ছিল। ক্লান্ত সূর্যটা সবে হাত পা
মেলেছে। পর্দার আড় ভেঙ্গে রিয়াকে একটু দেখেছিলো সে। ঠিক তার বয়সী একটি রোগা
একবেণীর মেয়ে। গায়ের রঙ পরিষ্কারই বলা চলে। ভর্তি হল তাদের স্কুল লাগোয়া বালিকা
বিদ্যালয়ে। প্রথম শুরু হলো দু'বাড়ির মায়েদের আলাপ। ক্রমে
জমে উঠলো যাতায়াত। পরে দু'বাড়ি যাতায়াতে তাদেরও
ছাড়পত্র মিলল দেখা করার।
মনে তখন কামিনী, ছাতিম, গন্ধরাজ
ফুলের আনাগোনা হৃদয়ের প্রতিটা দুয়ার ছুঁয়ে যাচ্ছে। রিয়া ডাকলেই মনটা কেন যে এমন
উতলা হত না গেলেই নয়! কেমন অন্যরকম দেখতে ছিল ওর খেলনাগুলো, ভোমলা ভ্যালভ্যাল করে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে
দেখতো সেসব। মা বলত ওগুলো শহুরে খেলনা। কোনদিন ওদের ছাদে চলতো পুতুল খেলা। কেমন
হাতে একটা যন্ত্র থেকে রিয়া বোতাম টিপে নির্দেশ দিত, ব্যস
তাতেই গাড়িগুলো চলত, ভোমলা লোভে প্রায়ই যেত
ওবাড়ি। গ্রামে ভোমলাদের অবস্থাপন্ন ঘর হলেও রিয়াদের কেমন শ্বেতশুভ্র পাথর বসান
বাড়ি ছিল, যা আগে এখানে কক্ষনো দেখা
যায়নি।
রিয়া এমন হালকা শীতের
দুপুরে ভোমলাদের বাড়ি এলে রোদ্দুরে পিঠ পেতে কাঁচের বয়াম থেকে খাবলা করে আচার
সাবাড় করতো দু'জনে, বাড়ির সবাই তখন হয় চাষে, নয় খাবার পর বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছে। সন্ধ্যায়
কখনো সারা বাড়িময় ছড়িয়ে যেত কড়াইশুঁটির কচুরির গন্ধ। রিয়ারা সেদিন নিমন্ত্রণে আসত
সপরিবারে।
হঠাৎ দক্ষিণ আকাশে কালো
মেঘ ঘনাল!পরপর দুই জ্যাঠা সাপের কামড়ে মারা গেল... টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই
সরকারি চিঠি এল। বড় ব্যবসায়ীরা,
রিয়ার
বাবাও ছিল সে দলে, সরকারের সাথে অধিগ্রহণ
করবে ভোমলাদের জমির বেশীটাই। সেখানে নাকি শহর ঠান্ডা করার মেশিন ও আরও নানা
কারখানা হবে। বাবা আর সেজো কাকার মাথায় হাত। মোড়লঘরে ওদের ছোটাছুটি বাড়লো।
“শোন
বিষান চাষি, সকলেই সরকারের সাথে চুক্তি
করেছে। কিছু টাকার বিনিময়ে তোমাকেও জমি ছাড়তেই হবে। এইবেলা ভালোয় ভালোয় না দিলে
সেবারের রহমতের জমিটার মতো দাঙ্গা বাঁধবে কিন্তু!”
কথাগুলো যেন গরম শিশা হয়ে
কানে বাজলো। এমন শীত কুয়াশার সন্ধ্যায় দু'জনে
একেবারে ভিজে সপসপে। একরাশ চিন্তার বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল ওরা।
একদিন রাতে সারা গ্রামে
হঠাৎ মশাল জ্বলল। সেদিন গ্রামে নবান্নের উৎসব চলছিল ঘরে ঘরে। ক্যানেস্তারা পিটে
কেমন বিচ্ছিরি কিছু লোক বাড়িটাকে ঘিরে ধরলো একেবারে, চললো
হুমকির পর হুমকি। পটলা মায়ের শাড়ির নিচে সারা রাত ভয়ে একসা হয়ে ভরসা খুঁজছিল। বাবা
এসব সহ্য করতে না পেরে অচিরেই অসম্মানে কড়িকাঠ আর দড়ির সাথে নিজেকেও...। কাকাও
হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন কিছুদিনের মধ্যেই। তারা একদম শূন্য হল।
ছিন্নভিন্ন সংসারে প্রায়
সব বিধবারা অলক্ষ্যে তবু কার প্রতি যে জোড়হাত করতো রোজ সকাল সন্ধ্যায় ভোমলা বোঝে
না। রিয়াদের সাথে সম্পর্কটা চিরতরে শেষ হয়ে গেল। এরপর কত হেমন্ত- শীত এল। রিয়াদের বাড়ির
পিছনে লুকিয়ে চলল পিঠের গন্ধে মন শান্ত করা, বাড়িতে
সেসব কথা মা'কে বললে মিলত নোলা কাটানোর
ওষুধ। যেখানে রোজ খাওয়ার সংস্থানে প্রশ্নচিহ্ন ঝোলে সেখানে আবার পিঠে! অন্তর্জামী
রিয়া বাড়ির অমতেও কিন্তু তার লোভের খবর রাখত ঠিক।
-----
একজন সহৃদয় ব্যক্তি ভোমলার
ভালো রেজাল্ট দেখে চাকরির জন্য হঠাৎ ইঁট কাঠের শহরে নিয়ে গেল। কত জোয়ার-ভাঁটা
পেরোল এরপর। ক্রমে গোঁফের রেখায় ভোমলার দায়িত্ববোধের সাথে দেখা দিল আরো বহু কিছু।
সেই হাভাতের উষ্ণ হাতটা ধরে অন্ধকার হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গিটাতে শুধু
তখনো বিশ্বাস জুগিয়েছিল রিয়া। ওরা তখন পাকাপাকি কলকাতায়। ওরও ফ্রক ছেড়ে শাড়ি হল।
এরপর ট্রামলাইন ধরে ফেলে আসা রঙিন স্মৃতিরা গড়িয়ে গেছে। অপছন্দের বাকবিতণ্ডার বেড়া
পেরিয়ে দু'জনে হাত ধরাধরি করে হেঁটে
গেছে ফুলের বাগান, সিনেমা হল। হাড়ভাঙা
খাটুনির রক্ত জল করা পয়সা জমিয়ে ভোমলা ধীরে ধীরে বাড়িয়েছে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স।
প্রতিশোধ স্পৃহাটা ধিকিধিকি আগুন হয়ে বুকে তাপ পুহিয়েছে শুধু। রিয়া উজাড় করে পাশে
থেকেছে। শীতের কলকাতার ময়দান,
সার্কাস
থেকে পরিযায়ী পাখি দেখার কমলা কোয়া রোদ মেখেছে এক মনের দু'টো অর্থনৈতিক দূরত্বের মানুষ।
আজ সেই জমিতেই বোস
ইন্ডাষ্ট্রিজের উদ্বোধন। সাথে অফিস পিকনিকটাও সেরে নেবার প্ল্যান। এসেছেন মালিক
পলাশ বোস ও অর্ধাঙ্গিনী রিয়া বোস। মাকে দেওয়া কথা পলাশ রাখতে পেরেছে। ধীরে ধীরে মা'র ইচ্ছে পূরণ করে কলকাতার ফুটপাথ জুড়ে নেই
রাজ্যে বাসিন্দাদের সে দেবে ছাদের ঠিকানা। চোখের বিন্দুগুলো লুকিয়ে মুছে নেয়। আর
একটু এগোলেই বোধহয় মনের কোণের গুড়পাটালির গন্ধটা সজীব হবে। আজ আর কেউই বেঁচে নেই।
ভোমলা মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসে,
ভাবে
সম্পর্কগুলো আসলে পিঠের মত নরম,
সোনালী
মখমলি রোদটা বা গুড়ের মত তুলতুলে,
মিষ্টি।
আমরাই অযথা বহু কিছু প্রয়োগ করে তাকে তেঁতো করে তুলি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন