রেডিও-তে বারবার ঘোষণা করা
হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা। দক্ষিণবঙ্গের নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী
এলাকায় বিগত তিনদিন ধরে মাইকে প্রচার চলছিল। সময় থাকতে সবাই স্থানীয়
ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিন। ১৩০- ১৭০ কিলোমিটার গতিবেগে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় 'ইয়াস'
আসছে, সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিপাত।
ইতিমধ্যে অনেকেই ঘর-দুয়ার ছেড়ে
আশ্রয়শিবিরে চলে গিয়েছে। যাব কি যাব না করে তখনও দোটানায় অনেকে। যাব বললে তো যাওয়া
যায় না! মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পুরুষানুক্রমে গড়ে তোলা নিজস্ব নিরাপদ আশ্রয়ের মায়া
কাটানো বড়ো কঠিন। ঝড়-জল আসতে এখনও দু'দিন বাকি বলে আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট
এলাকার বাসিন্দাদের কেউ কেউ এখনও ভাগ্যের উপর ভরসা রেখে ঝড়ের গতি প্রকৃতিটা যেন দেখে
নিতে চাইছে। ফলে কিছু কিছু মানুষ গড়িমসি করে বাড়ি ছাড়ব ছাড়ব করেও এক-আধটা বেলা
পার করে দিতে চাইছে। দোনামোনা করতে করতে বাকিদের মধ্যে অনেকেই গৃহপালিত পোষ্যদের বাঁধন
খুলে দিয়ে, নামমাত্র সম্বল করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।
পূর্ণিমার ভরা কোটাল। ঝড়ের দাপটে
সুন্দরবন অঞ্চলের বহু নদীর বাঁধ ভেঙে হু-হু করে নোনাজল ঢুকছে লোকালয়ে। সমুদ্র উপকূলের
অবস্থা আরো ভয়াল-ভয়ংকর। দীঘা, মন্দারমণি, বকখালি প্রভৃতি স্থানে কয়েক মিটার উঁচু
সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস মুহুর্মুহু এসে আছড়ে পড়ছে সমুদ্র বাঁধের বাইরে। বাঁধসংলগ্ন
বসতি এলাকা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। লোকজনকে অবশ্য আগেভাগেই নিরাপদ জায়গায়
সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। উপকূল থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বসতগুলিতে ঝড়ের দাপটে বহু
ঘরের চাল উড়ে গিয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের ফলে ধেয়ে আসা জল ঘরে ঢোকায় বহু মাটির দেয়াল
ধ্বসে পড়েছে। শ'য়ে শ'য়ে গবাদিপশু ভেসে গিয়েছে জলের তোড়ে। সাগর, ঘোড়ামারা, মৌসিন
দ্বীপের অবস্থা শোচনীয়। গ্ৰামের পর গ্ৰাম জলমগ্ন, খাদ্য নেই, পানীয় নেই, মাথা গোঁজার
ঠাঁই নেই। ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত মানুষজন দিশেহারা, ত্রাণশিবিরে স্থান সংকুলান অপর্যাপ্ত।
প্রশাসন ব্যতিব্যস্ত। ত্রাণকার্যে সেনাবাহিনী ও NDRF নেমেছে। প্রবল ঝড়জলের মধ্যে
তারা দুর্গত মানুষজনের উদ্ধারে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছে। দেখতে দেখতে নতুন নতুন
এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে।
স্ত্রীকে বারবার তাগাদা দিতে দিতে
বড়ো ছেলেমেয়েদু'টিকে আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে অর্জুন বাগ বাড়ি ছেড়ে আগেই বেরিয়ে
গেল। দেড়বছরের কোলের বাচ্চাটিকে নিয়ে কী নেবে আর কী ফেলে রেখে যাবে বাছাবাছি করতে
করতে বাগ পাড়ায় জল ঢুকতে শুরু করল। বাইরে থেকে ঘর-ছাড়া লোকজনের আওয়াজ কানে আসছিল।
আর অপেক্ষা করা চলে না। মাঝারি একটা পোঁটলা ও কোলের বাচ্চাটিকে নিয়ে অলকা বাগ ব্যস্ত
হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে রাস্তায়
জল। সামনের দিকে তাকিয়ে পরিচিত কাউকে দেখতে পেল না। স্রোত বইছে প্রবলবেগে, ঠেলে এগিয়ে
যাওয়া দুষ্কর। তীব্রবেগে জলের স্রোত রাস্তার একপার থেকে অপরপারে গড়িয়ে নামছে।
জলের তোড়ে রাস্তার মাটি ঝুপ ঝুপ করে ধ্বসে পড়ছে। আগেপিছে তখনও দু'একটা ঘরছাড়া পরিবার
বালবাচ্চাসমেত পরস্পর ধরাধরি করে পা টানতে টানতে কোনক্রমে সামনে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ
একটা দমকা হাওয়ার বেগে টাল সামলাতে না পেরে স্রোতের জলের মধ্যে পড়ে গেল অলকা। পোঁটলাটি
ধরে রাখতে পারলেও কোলে থাকা বাচ্চাটি ছিটকে পড়ল স্রোতের মধ্যে। চিৎকার করে উঠল অলকা।
আগেপিছে চলছিল যে ক'জন, ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে ফিরে তাকাল। কয়েক পলক। হতচকিত
অলকা মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলের মধ্যে। হায় হায় করে উঠল সবাই। এরই মধ্যে বৃষ্টিটা
আবার জোরে নামল।
এভাবেই বছরে বছরে বিধ্বংসী প্রাকৃতিক
দুর্যোগ উপকূলবর্তী দিন আনা দিন খাওয়া মেহনতি মানুষজনের জীবনযাত্রা তছনছ করে দিয়ে
যায়। সেই ধ্বংসস্তূপের উপর মানুষ আবার নতুন করে জীবন শুরু করে, আবার মরতে মরতে বেঁচে
থাকে!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন