চন্দ্রাভিযানে পল্টু - রথীন্দ্রনাথ রায়


 

পল্টু চাঁদে এসেছে আজ দু'দিন হল । কেউ বুঝতেও পারেনি ও কখন চন্দ্রযান টু-তে সওয়ার হয়েছে । ইসরোর শ্রীহরিকোটার উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের একজন নিরাপত্তারক্ষীকে ও একটা ম্যাজিক কমলালেবু খাইয়েছিল । সেটা খেতেই ওই রক্ষী তার বশংবদ হয়ে গেল । বলল, পল্টুবাবু আপকো চান্দ পর যানা হ্যায় তো চলে যাও । উঁহা পর কোঠরী বনাকে ঠহর যানা । ইঁহা ফির মত্ আনা । ইঁহা কা লোগ বহোত খারাব হ্যায় ।

রক্ষী আর কিছু বলতে পারেনি । ঘুমিয়ে পড়েছিল । উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের চারদিকে তখন খুব ব্যস্ততা । নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মোড়া । বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকেরা চারদিকে ব্যস্ত হয়ে ছুটছে । তারই ফাঁকে পল্টু উঠে বসল চন্দ্রযানে । তারপর সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা । শব্দের চেয়েও অনেক অনেক বেশি গতিবেগে পাঁচলক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গতকালই সে এসে পৌঁছাল চাঁদে ।

এই সেই চাঁদ । যে চাঁদের কথা সে ঠাকুমার মুখে শুনেছে, অ্যাডভেঞ্চারের বইতে পড়েছে, নিউজপেপারে পড়েছে, এমনকি দেব-এর চাঁদের পাহাড়েও সে দেখেছে । এখন সে তার চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না । একবার চোখদু'টো কচলে নিয়ে দেখল, হ্যাঁ চাঁদই তো বটে ।

একটু দূরে চন্দ্রযান থেকে একটা রোবট নেমে এসেছে । খচাখচ ছবি তুলছে আর ইসরোকে পাঠাচ্ছে । এখন রাতের বেলা । তাই রোবট চলতে পারছে না । ওর মাথায় একটা সোলার প্যানেল । রোদ হলে তবেই সে কাজ করতে পারবে । এখন অন্ধকার হলেও সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । কি স্নিগ্ধ অপরূপ! ভাষায় বর্ণনা করতে পারছে না পল্টু । পকেট থেকে মোবাইল বের করে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে নিল সে । জিগরি দোস্ত নন্তুকে পাঠাতে হবে । নন্তুকে সে চন্দ্রাভিযানের কথা বলেনি । বললে জানাজানি হয়ে যেত আর সব ভেস্তে যেত । মা তাকে আসতে দিত না । বাবা ভারি গলায় বলতো সামনে তোমার পরীক্ষা আর তুমি চাঁদে যাবে?

ভোলা কুকুরকে আনা যেত । কিন্তু চাঁদে তার খাবার কোথায় পাবে? তাই তাকে আনা হয়নি ।

 এখন তার একমাত্র কাজ হল জলের খোঁজ করা । কারণ এখানে থাকতে গেলে জল চাইই চাই । একটু দূরেই দেখতে পেল চাঁদের গর্তগুলোতে অনেক বরফ জমে রয়েছে । খুব সাদা নয় । একটু ধূসর । তা হোক । এতেই চলবে । তবে এগুলোকে গলিয়ে জল করতে হবে । অনেক জল চাই । কারণ চাষবাস করতে হবে ।

ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা দূরে প্রায় ভূতের মতো কয়েকজনকে আসতে দেখা গেল । কাছে এলে দেখল না ভূত নয় । তারই মতো দেখতে । একজন যান্ত্রিক গলায় চিৎকার করে বলল, কেন এসেছো এখানে  ?

পল্টু না ঘাবড়ে বলল, বন্ধুত্ব করতে ।

-- তাই  ? বেশ বাড়াও হাত । এসো আমাদের চন্দ্রপুরীতে । তবে শর্ত, এই চন্দ্রপুরীর কথা কাউকে বলা যাবে না ।

পল্টু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল । তারপর তারা প্রায়ান্ধকার গর্তের ভিতর দিয়ে চন্দ্রপুরীতে প্রবেশ করল ।

ওপর থেকে কখনোই কল্পনা করা যাবে না যে চাঁদের পাতালপুরীটা এরকম হতে পারে । যতই ভেতরে প্রবেশ করে ততোই অবাক হতে থাকে পল্টু । এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য চারদিকে । শ্বেতপাথরে বাঁধানো প্রশস্ত পথ । ধুলোবালির ছোঁয়া পর্যন্ত নেই । পথের দু'পাশে ছোট ফুলের গাছ । না পৃথিবীতে সে এরকম গাছ দেখেনি । বাড়িঘরগুলো খুব বেশি বড় নাহলেও অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত । মাথার ওপরে আকাশ নেই । আছে সুদৃশ্য ছাদ । যেন আকাশের চাঁদোয়া । কোথাও আলো দেখতে না পেলেও সবকিছু স্পষ্ট । পথেই ওদের সঙ্গে আলাপ হল কয়েকজনের । ওরা এসেছে ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ এবং নক্ষত্র থেকে । দূরত্ব সংখ্যায় বলা যাবে না । আলোকবর্ষে বলতে হবে । মিলক গ্রহ থেকে এসেছে মিনান্দা । এই সৌরজগতের বাইরের একটা জগত থেকে । প্রায় চুয়ান্ন আলোকবর্ষ দূরে ছিল তার বিচরণক্ষেত্র । পঁচাশি আলোকবর্ষ দূর থেকে এসেছে স্যান্টো । একশো পাঁচ আলোকবর্ষ দূর থেকে এসেছে সিজা । শুধু পল্টুর দূরত্বই সব থেকে কম ।

ওরা কেউ ফিরে যাবে না । তাই চাঁদের অন্দরেই বানিয়ে নিয়েছে এক অন্য জগত । না, না এখানে পৃথিবীর মতো হানাহানি নেই , চোর, ডাকাত, বদমাশ নেই । এখানে সবাই সবার বন্ধু ।

কিছুক্ষণ পরে ওরা একটা অফিসবাড়িতে এসে পৌঁছাল । যেখানে আগন্তুক অতিথিদের নাম রেজিস্ট্রেশন হয় । তারপর কয়েকদিন ধরে অতিথিদের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকে । যদি বোঝা যায় অতিথিরা ক্ষতিকারক নয়, কোনো বদ মতলব নিয়ে আসেনি । তবেই মিলবে চন্দ্রপুরীতে বসবাসের ছাড়পত্র ।

পল্টুকে ওদের খারাপ মনে হল না । তাই সহজেই চন্দ্রপুরীতে থাকার অনুমতি পেল সে ।

পল্টু মনে মনে বলল, বাঁচা গেল । পরীক্ষা পাশের ঝামেলা নেই, চাকরি খোঁজার দরকার নেই । ভারত পাকিস্তানের মতো যুদ্ধের আবহ নেই, মার্কিনি দাদাগিরি নেই, রাজনৈতিক হানাহানি নেই, কাউকে ঠকানোর দরকারও নেই । শুধু আনন্দ, শুধু আনন্দ ।

ওর বন্ধুরা ওকে রাজার কাছে নিয়ে গেল । রাজা ওকে বলল, তুমি পৃথিবী থেকে এসেছো । কিন্তু কেন? জানো, পৃথিবী একটা ভয়ঙ্কর জায়গা । পৃথিবীর লোকেরা গড় উষ্ণতা কমাবার ব্যবস্থা না করে তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সমস্ত বরফ গলে গিয়ে গ্রহটা একটা জলগ্রহে পরিণত হবে । তাতে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডেরই ক্ষতি হবে । আমরা চাঁদের মানুষেরাও এর থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবো না । কারণ কাতারে কাতারে মানুষ ছুটে আসবে চাঁদে । আর চাঁদটাও ভয়ঙ্করভাবে দূষিত হয়ে পড়বে । তাই চাঁদকে বাঁচাতেই পৃথিবীর দূষণ কমাতে হবে ।

পল্টু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল । বলল, সেজন্যই তো এসেছি ।

-- ঠিক আছে, এখন তুমি চন্দ্রপুরীকে চিনে নাও । পল্টু রাজার আদেশে মিনান্দাকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদের গবেষণাগারে এল । বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রদের জীবন্ত খবর পাওয়া যায় এখান থেকে । গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে রয়েছে একটা করে নীল বোতাম । এই বোতামগুলোর একটাকে স্পর্শ করলেই একটা বিরাট টেলিস্ক্রনে তার ছবিটা ভেসে ওঠে । পল্টু বেশ কিছুদিন হল পৃথিবী থেকে এসেছে । কিন্তু টানটা এখনো রয়ে গেছে । কি করছে পৃথিবীর লোকগুলো ? বিশেষ করে তার মা বাবা, বন্ধুরা -- এমনকি দেশের লোকেরা  ? আসার সময় দেখেছিল তার দেশ তীব্র খরায় জ্বলছে । এখন কি সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে ? ভাবতে ভাবতেই 'ই' চিহ্নিত বোতামটা টিপল পল্টু । সমগ্র পৃথিবীর ছবিটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে । মাউসে হাত দিয়ে ভারতের ছবিটাকে সামনে নিয়ে এল । বিরাট ভারতবর্ষের মধ্যে এখন শুধুমাত্র বৃষ্টি হচ্ছে দক্ষিণ ভারতে । বন্যাপ্লাবিত হয়েছে কেরল, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্র । ক'দিন আগে এইসব রাজ্যে তীব্র জলকষ্ট দেখা দিয়েছিল । তখনই পল্টু ভেবেছিল রেইন কন্ট্রোল সিস্টেম গড়ে তোলার কথা । কিন্তু কিভাবে  ? এখন সেই ভাবনাটাই আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । যেভাবেই হোক এই ব্যবস্থা সে গড়ে তুলবেই । কিন্তু চাঁদের রাজা বলেছে, সে চাঁদ থেকে ফিরে যেতে পারবেনা । তাহলে ?

ইতিমধ্যে কয়েকটা বছর কেটে গেল । চন্দ্রযান টু তার অভিযান শেষ করে ফিরে গেছে । কিছু নুড়িপাথর, ধুলোমাটি আর মহাবিশ্বের কিছু ছবি নিয়ে গেছে । টের পায়নি চাঁদের অন্দরে থেকে যাওয়া একট জীবজগতের অস্তিত্ব ।

রেইন কন্ট্রোল সিস্টেম RCS নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলো চাঁদের রাজা । কুড়িজন সেরা বিজ্ঞানীকে নিয়ে একটা টিম তৈরি হল। পল্টু হল ক্যাপ্টেন । পৃথিবীর আকারে  তৈরি হল একটা মডেল স্যাটেলাইট । এই স্যাটেলাইটেই বসানো থাকবে আর সি এস সুপার রেডার । যে যন্ত্রটা বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করবে, সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর মানুষদের আচরণের কম্পাঙ্কও ধরা পড়বে ওই সুপার রেডারে । আর পৃথিবীর মানুষেরা যেভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে চলেছে তা অনেকাংশে কমানো যাবে । পল্টুর প্রস্তাব এবং গবেষণার তথ্য সানন্দে স্বীকার করে নিল চাঁদের রাজা । তারপর চন্দ্রপুরীর সুপার ওয়ার্কশপে তৈরি হল আর সি এস এবং সুপার রেডার । তাকে বসানো হল একটা কৃত্রিম উপগ্রহে । যে উপগ্রহটা পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষীণ করতে সময় নেবে পনেরো দিনের থেকে একটু কম অর্থাৎ চাঁদের সময়ের তালেই ঘুরবে সে । আর সুপার রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের সাহায্যে পৃথিবীর সমস্ত দেশেই সমানভাবে বৃষ্টিপাত সম্ভব হবে । সুজলা সুফলা হবে সাহারা । জলকষ্টে কোনও প্রাণী আর মারা যাবে না । তেমনি অতিবৃষ্টিও হবে না । তাই বন্যা ও খরা থেকে বাঁচবে পৃথিবীর সমস্ত দেশ ।

আজ সেই দিন । পৃথিবীর দিকে ধেয়ে যাবে 'মিশন পৃথিবী আর সি এস' এবং সুপার রেডারকে সঙ্গে নিয়ে । এগিয়ে আসে উৎক্ষেপণের সময় । কুড়িজন বিজ্ঞানী এবং রাজা উৎক্ষেপণকেন্দ্রে অপেক্ষা করছেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য । ঘড়ির কাঁটা সময়কে পাহারা দিয়ে চলেছে । শুরু হল কাউণ্টডাউন । নাইন, এইট, সেভেন  - - - - টু, ওয়ান, জিরো । এক বিশেষ রকেটে চড়ে 'মিশন পৃথিবী' ধেয়ে গেল পৃথিবীর দিকে । অবশ্য চাঁদের মঙ্গলের জন্য নয় । পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যই । চন্দ্রবাসীরা এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল । কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর পল্টু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল । আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, মিশন ইস সাকসেসফুল, উই আর সাকসেসফুল । ও গড সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড, সেভ দ্য ইউনিভার্স ।

চাঁদের রাজা পল্টুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠলেন, আমরা সফল হয়েছি ।

চাঁদের অন্দরে আজ উৎসব আর সেই উৎসবের মধ্যমণি পল্টু । কারণ সে যদি পৃথিবী থেকে না আসত তাহলে চন্দ্রবাসীরা জানতেও পারত না পৃথিবীবাসীরা কতটা কষ্টে আছে । বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ থেকে আসা চন্দ্রবাসীরাও আজ খুব খুশি । কিন্তু পল্টু খুব খুশি নেই । তার সাফল্যের খবর যদি সে বন্ধুদের জানাতে পারত - ? কিন্তু সে উপায়ও নেই । পৃথিবীর কেউ জানেই না পল্টু নামের এক ক্ষুদে বিজ্ঞানী আর সি এস বা রেইন কন্ট্রোল সিস্টেম তৈরি করতে পেরেছে । এই খবর যদি পৃথিবীতে পৌঁছায় মিডিয়ার লোকেরা হূলস্থূল বাধিয়ে ছাড়বে । কিন্তু চাঁদে ওসব উৎপাত নেই ।

চাঁদের অন্দরে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত নেই । তাই দিনও নেই , রাতও নেই । এভাবেই কেটে গেছে কয়েকটা বছর । পল্টু এখন পরিণত এক মস্ত বড় বিজ্ঞানী । তার হাতে আর সি এস সফল হয়েছে । সিস্টেমের মাউস ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে চলেছে । সাহারার মরুবাসীরা এখন বেশ খুশি । মধ্যপ্রাচ্যেও তেমন জলকষ্ট নেই । বন্যাও নেই কোনো দেশে । কিন্তু পৃথিবীবাসীদের অনেকেই যে বেশি স্বার্থপর । জলের উপযুক্ত যোগান পেয়ে তারা জলের মূল্য ভুলতে বসেছে । অনেকেই অবিচারে জলের অপচয় করে চলেছে । আর সমানভাবে কার্বন-মনোক্সাইড বাড়িয়ে চলেছে । চিন্তায় পড়ল পল্টু । না এভাবে চলতে পারে না । তার প্রচেষ্টাকে সে ব্যর্থ হতে দেবে না । ঠিক সেই মুহূর্তে নাসা, ইসরো এবং অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের মনিটরে একটা মেসেজ পৌঁছাল । আমি মহাবিশ্বের মহাকাশকেন্দ্র থেকে পল্টু বলছি, তোমরা সাবধান হও, বিশ্ব উষ্ণায়ণ বন্ধ করো, জলের অপচয় বন্ধ করো -- নতুবা অবিলম্বে ধ্বংস হবে তোমরা ।

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন