পল্টু চাঁদে এসেছে আজ দু'দিন হল
। কেউ বুঝতেও পারেনি ও কখন চন্দ্রযান টু-তে সওয়ার হয়েছে । ইসরোর শ্রীহরিকোটার
উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের একজন নিরাপত্তারক্ষীকে ও একটা ম্যাজিক কমলালেবু খাইয়েছিল ।
সেটা খেতেই ওই রক্ষী তার বশংবদ হয়ে গেল । বলল, পল্টুবাবু আপকো চান্দ পর যানা
হ্যায় তো চলে যাও । উঁহা পর কোঠরী বনাকে ঠহর যানা । ইঁহা ফির মত্ আনা । ইঁহা কা
লোগ বহোত খারাব হ্যায় ।
রক্ষী আর কিছু বলতে পারেনি ।
ঘুমিয়ে পড়েছিল । উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের চারদিকে তখন খুব ব্যস্ততা । নিরাপত্তার
ঘেরাটোপে মোড়া । বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকেরা চারদিকে ব্যস্ত হয়ে ছুটছে । তারই ফাঁকে
পল্টু উঠে বসল চন্দ্রযানে । তারপর সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা । শব্দের চেয়েও অনেক
অনেক বেশি গতিবেগে পাঁচলক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গতকালই সে এসে পৌঁছাল চাঁদে
।
এই সেই চাঁদ । যে চাঁদের কথা সে
ঠাকুমার মুখে শুনেছে, অ্যাডভেঞ্চারের বইতে পড়েছে, নিউজপেপারে পড়েছে, এমনকি
দেব-এর চাঁদের পাহাড়েও সে দেখেছে । এখন সে তার চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না ।
একবার চোখদু'টো কচলে নিয়ে দেখল, হ্যাঁ চাঁদই তো বটে ।
একটু দূরে চন্দ্রযান থেকে একটা
রোবট নেমে এসেছে । খচাখচ ছবি তুলছে আর ইসরোকে পাঠাচ্ছে । এখন রাতের বেলা । তাই
রোবট চলতে পারছে না । ওর মাথায় একটা সোলার প্যানেল । রোদ হলে তবেই সে কাজ করতে
পারবে । এখন অন্ধকার হলেও সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । কি স্নিগ্ধ অপরূপ! ভাষায়
বর্ণনা করতে পারছে না পল্টু । পকেট থেকে মোবাইল বের করে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে
নিল সে । জিগরি দোস্ত নন্তুকে পাঠাতে হবে । নন্তুকে সে চন্দ্রাভিযানের কথা বলেনি ।
বললে জানাজানি হয়ে যেত আর সব ভেস্তে যেত । মা তাকে আসতে দিত না । বাবা ভারি গলায়
বলতো সামনে তোমার পরীক্ষা আর তুমি চাঁদে যাবে?
ভোলা কুকুরকে আনা যেত । কিন্তু
চাঁদে তার খাবার কোথায় পাবে? তাই তাকে আনা হয়নি ।
এখন তার একমাত্র কাজ হল জলের খোঁজ করা । কারণ
এখানে থাকতে গেলে জল চাইই চাই । একটু দূরেই দেখতে পেল চাঁদের গর্তগুলোতে অনেক বরফ
জমে রয়েছে । খুব সাদা নয় । একটু ধূসর । তা হোক । এতেই চলবে । তবে এগুলোকে গলিয়ে
জল করতে হবে । অনেক জল চাই । কারণ চাষবাস করতে হবে ।
ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা দূরে প্রায়
ভূতের মতো কয়েকজনকে আসতে দেখা গেল । কাছে এলে দেখল না ভূত নয় । তারই মতো দেখতে ।
একজন যান্ত্রিক গলায় চিৎকার করে বলল, কেন এসেছো এখানে ?
পল্টু না ঘাবড়ে বলল, বন্ধুত্ব
করতে ।
-- তাই ? বেশ বাড়াও হাত । এসো আমাদের চন্দ্রপুরীতে ।
তবে শর্ত, এই চন্দ্রপুরীর কথা কাউকে বলা যাবে না ।
পল্টু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল
। তারপর তারা প্রায়ান্ধকার গর্তের ভিতর দিয়ে চন্দ্রপুরীতে প্রবেশ করল ।
ওপর থেকে কখনোই কল্পনা করা যাবে
না যে চাঁদের পাতালপুরীটা এরকম হতে পারে । যতই ভেতরে প্রবেশ করে ততোই অবাক হতে
থাকে পল্টু । এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য চারদিকে । শ্বেতপাথরে বাঁধানো প্রশস্ত পথ ।
ধুলোবালির ছোঁয়া পর্যন্ত নেই । পথের দু'পাশে ছোট ফুলের গাছ । না পৃথিবীতে সে এরকম
গাছ দেখেনি । বাড়িঘরগুলো খুব বেশি বড় নাহলেও অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত । মাথার ওপরে
আকাশ নেই । আছে সুদৃশ্য ছাদ । যেন আকাশের চাঁদোয়া । কোথাও আলো দেখতে না পেলেও
সবকিছু স্পষ্ট । পথেই ওদের সঙ্গে আলাপ হল কয়েকজনের । ওরা এসেছে ব্রহ্মাণ্ডের
বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ এবং নক্ষত্র থেকে । দূরত্ব সংখ্যায় বলা যাবে না । আলোকবর্ষে
বলতে হবে । মিলক গ্রহ থেকে এসেছে মিনান্দা । এই সৌরজগতের বাইরের একটা জগত থেকে ।
প্রায় চুয়ান্ন আলোকবর্ষ দূরে ছিল তার বিচরণক্ষেত্র । পঁচাশি আলোকবর্ষ দূর থেকে
এসেছে স্যান্টো । একশো পাঁচ আলোকবর্ষ দূর থেকে এসেছে সিজা । শুধু পল্টুর দূরত্বই
সব থেকে কম ।
ওরা কেউ ফিরে যাবে না । তাই চাঁদের
অন্দরেই বানিয়ে নিয়েছে এক অন্য জগত । না, না এখানে পৃথিবীর মতো হানাহানি নেই ,
চোর, ডাকাত, বদমাশ নেই । এখানে সবাই সবার বন্ধু ।
কিছুক্ষণ পরে ওরা একটা
অফিসবাড়িতে এসে পৌঁছাল । যেখানে আগন্তুক অতিথিদের নাম রেজিস্ট্রেশন হয় । তারপর
কয়েকদিন ধরে অতিথিদের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকে । যদি বোঝা যায় অতিথিরা
ক্ষতিকারক নয়, কোনো বদ মতলব নিয়ে আসেনি । তবেই মিলবে চন্দ্রপুরীতে বসবাসের
ছাড়পত্র ।
পল্টুকে ওদের খারাপ মনে হল না ।
তাই সহজেই চন্দ্রপুরীতে থাকার অনুমতি পেল সে ।
পল্টু মনে মনে বলল, বাঁচা গেল ।
পরীক্ষা পাশের ঝামেলা নেই, চাকরি খোঁজার দরকার নেই । ভারত পাকিস্তানের মতো যুদ্ধের
আবহ নেই, মার্কিনি দাদাগিরি নেই, রাজনৈতিক হানাহানি নেই, কাউকে ঠকানোর দরকারও নেই
। শুধু আনন্দ, শুধু আনন্দ ।
ওর বন্ধুরা ওকে রাজার কাছে নিয়ে
গেল । রাজা ওকে বলল, তুমি পৃথিবী থেকে এসেছো । কিন্তু কেন? জানো, পৃথিবী একটা
ভয়ঙ্কর জায়গা । পৃথিবীর লোকেরা গড় উষ্ণতা কমাবার ব্যবস্থা না করে তাহলে আগামী
পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সমস্ত বরফ গলে গিয়ে গ্রহটা একটা জলগ্রহে পরিণত হবে । তাতে
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডেরই ক্ষতি হবে । আমরা চাঁদের মানুষেরাও এর থেকে পালিয়ে বাঁচতে
পারবো না । কারণ কাতারে কাতারে মানুষ ছুটে আসবে চাঁদে । আর চাঁদটাও ভয়ঙ্করভাবে
দূষিত হয়ে পড়বে । তাই চাঁদকে বাঁচাতেই পৃথিবীর দূষণ কমাতে হবে ।
পল্টু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল
। বলল, সেজন্যই তো এসেছি ।
-- ঠিক আছে, এখন তুমি
চন্দ্রপুরীকে চিনে নাও । পল্টু রাজার আদেশে মিনান্দাকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদের
গবেষণাগারে এল । বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রদের জীবন্ত খবর
পাওয়া যায় এখান থেকে । গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে রয়েছে একটা
করে নীল বোতাম । এই বোতামগুলোর একটাকে স্পর্শ করলেই একটা বিরাট টেলিস্ক্রনে তার
ছবিটা ভেসে ওঠে । পল্টু বেশ কিছুদিন হল পৃথিবী থেকে এসেছে । কিন্তু টানটা এখনো
রয়ে গেছে । কি করছে পৃথিবীর লোকগুলো ? বিশেষ করে তার মা বাবা, বন্ধুরা -- এমনকি
দেশের লোকেরা ? আসার সময় দেখেছিল তার দেশ
তীব্র খরায় জ্বলছে । এখন কি সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে ? ভাবতে ভাবতেই 'ই' চিহ্নিত
বোতামটা টিপল পল্টু । সমগ্র পৃথিবীর ছবিটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে । মাউসে হাত
দিয়ে ভারতের ছবিটাকে সামনে নিয়ে এল । বিরাট ভারতবর্ষের মধ্যে এখন শুধুমাত্র বৃষ্টি
হচ্ছে দক্ষিণ ভারতে । বন্যাপ্লাবিত হয়েছে কেরল, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্র । ক'দিন আগে
এইসব রাজ্যে তীব্র জলকষ্ট দেখা দিয়েছিল । তখনই পল্টু ভেবেছিল রেইন কন্ট্রোল
সিস্টেম গড়ে তোলার কথা । কিন্তু কিভাবে ?
এখন সেই ভাবনাটাই আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । যেভাবেই হোক এই ব্যবস্থা সে গড়ে
তুলবেই । কিন্তু চাঁদের রাজা বলেছে, সে চাঁদ থেকে ফিরে যেতে পারবেনা । তাহলে ?
ইতিমধ্যে কয়েকটা বছর কেটে গেল
। চন্দ্রযান টু তার অভিযান শেষ করে ফিরে গেছে । কিছু নুড়িপাথর, ধুলোমাটি আর
মহাবিশ্বের কিছু ছবি নিয়ে গেছে । টের পায়নি চাঁদের অন্দরে থেকে যাওয়া একট
জীবজগতের অস্তিত্ব ।
রেইন কন্ট্রোল সিস্টেম RCS নিয়ে
আগ্রহ প্রকাশ করলো চাঁদের রাজা । কুড়িজন সেরা বিজ্ঞানীকে নিয়ে একটা টিম তৈরি হল।
পল্টু হল ক্যাপ্টেন । পৃথিবীর আকারে তৈরি
হল একটা মডেল স্যাটেলাইট । এই স্যাটেলাইটেই বসানো থাকবে আর সি এস সুপার রেডার । যে
যন্ত্রটা বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করবে, সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর মানুষদের আচরণের কম্পাঙ্কও
ধরা পড়বে ওই সুপার রেডারে । আর পৃথিবীর মানুষেরা যেভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট
করে চলেছে তা অনেকাংশে কমানো যাবে । পল্টুর প্রস্তাব এবং গবেষণার তথ্য সানন্দে
স্বীকার করে নিল চাঁদের রাজা । তারপর চন্দ্রপুরীর সুপার ওয়ার্কশপে তৈরি হল আর সি
এস এবং সুপার রেডার । তাকে বসানো হল একটা কৃত্রিম উপগ্রহে । যে উপগ্রহটা পৃথিবীকে
একবার প্রদক্ষীণ করতে সময় নেবে পনেরো দিনের থেকে একটু কম অর্থাৎ চাঁদের সময়ের
তালেই ঘুরবে সে । আর সুপার রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের সাহায্যে পৃথিবীর সমস্ত দেশেই
সমানভাবে বৃষ্টিপাত সম্ভব হবে । সুজলা সুফলা হবে সাহারা । জলকষ্টে কোনও প্রাণী আর
মারা যাবে না । তেমনি অতিবৃষ্টিও হবে না । তাই বন্যা ও খরা থেকে বাঁচবে পৃথিবীর
সমস্ত দেশ ।
আজ সেই দিন । পৃথিবীর দিকে ধেয়ে
যাবে 'মিশন পৃথিবী আর সি এস' এবং সুপার রেডারকে সঙ্গে নিয়ে । এগিয়ে আসে উৎক্ষেপণের
সময় । কুড়িজন বিজ্ঞানী এবং রাজা উৎক্ষেপণকেন্দ্রে অপেক্ষা করছেন সেই
মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য । ঘড়ির কাঁটা সময়কে পাহারা দিয়ে চলেছে । শুরু হল কাউণ্টডাউন
। নাইন, এইট, সেভেন - - - - টু, ওয়ান,
জিরো । এক বিশেষ রকেটে চড়ে 'মিশন পৃথিবী' ধেয়ে গেল পৃথিবীর দিকে । অবশ্য চাঁদের
মঙ্গলের জন্য নয় । পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যই । চন্দ্রবাসীরা এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা
করছিল । কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর পল্টু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল । আনন্দে চিৎকার করে
বলে উঠল, মিশন ইস সাকসেসফুল, উই আর সাকসেসফুল । ও গড সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড, সেভ দ্য
ইউনিভার্স ।
চাঁদের রাজা পল্টুকে জড়িয়ে
ধরে আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠলেন, আমরা সফল হয়েছি ।
চাঁদের অন্দরে আজ উৎসব আর সেই
উৎসবের মধ্যমণি পল্টু । কারণ সে যদি পৃথিবী থেকে না আসত তাহলে চন্দ্রবাসীরা জানতেও
পারত না পৃথিবীবাসীরা কতটা কষ্টে আছে । বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ থেকে আসা
চন্দ্রবাসীরাও আজ খুব খুশি । কিন্তু পল্টু খুব খুশি নেই । তার সাফল্যের খবর যদি সে
বন্ধুদের জানাতে পারত - ? কিন্তু সে উপায়ও নেই । পৃথিবীর কেউ জানেই না পল্টু নামের
এক ক্ষুদে বিজ্ঞানী আর সি এস বা রেইন কন্ট্রোল সিস্টেম তৈরি করতে পেরেছে । এই খবর
যদি পৃথিবীতে পৌঁছায় মিডিয়ার লোকেরা হূলস্থূল বাধিয়ে ছাড়বে । কিন্তু চাঁদে ওসব
উৎপাত নেই ।
চাঁদের অন্দরে সূর্যোদয় বা
সূর্যাস্ত নেই । তাই দিনও নেই , রাতও নেই । এভাবেই কেটে গেছে কয়েকটা বছর । পল্টু
এখন পরিণত এক মস্ত বড় বিজ্ঞানী । তার হাতে আর সি এস সফল হয়েছে । সিস্টেমের মাউস
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে চলেছে । সাহারার
মরুবাসীরা এখন বেশ খুশি । মধ্যপ্রাচ্যেও তেমন জলকষ্ট নেই । বন্যাও নেই কোনো দেশে ।
কিন্তু পৃথিবীবাসীদের অনেকেই যে বেশি স্বার্থপর । জলের উপযুক্ত যোগান পেয়ে তারা
জলের মূল্য ভুলতে বসেছে । অনেকেই অবিচারে জলের অপচয় করে চলেছে । আর সমানভাবে
কার্বন-মনোক্সাইড বাড়িয়ে চলেছে । চিন্তায় পড়ল পল্টু । না এভাবে চলতে পারে না ।
তার প্রচেষ্টাকে সে ব্যর্থ হতে দেবে না । ঠিক সেই মুহূর্তে নাসা, ইসরো এবং
অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের মনিটরে একটা মেসেজ পৌঁছাল । আমি মহাবিশ্বের
মহাকাশকেন্দ্র থেকে পল্টু বলছি, তোমরা সাবধান হও, বিশ্ব উষ্ণায়ণ বন্ধ করো, জলের
অপচয় বন্ধ করো -- নতুবা অবিলম্বে ধ্বংস হবে তোমরা ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন