সুতপার বারো মাস ঋতুস্রাব বন্ধ। কিছু মাস আগেই সে ৫০ বছরে পা রেখেছে। তাই এই বয়সে মেনোপোজ বা ঋতুনিবৃত্তি অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। সেইজন্য সুতপা প্রথমে ব্যাপারটাকে বিশেষ আমল দিতে চাননি। কিন্তু আস্তে আস্তে বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। এই যেমন- অত্যধিক গরম লাগা, অনিদ্রা, শরীরে ও যোনিসংলগ্ন অংশে জ্বালাভাব। সর্বাধিক যে চিন্তা সুতপাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে সেটা হল- এই মেনোপজের ফলে তার নারীসত্তাটি যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। বার্ধক্যের ছাপ ফুটে উঠছে মুখের আনাচে কানাচে। ঠোঁটের উপর দেখা দিচ্ছে হালকা গোঁফের রেখা। আগের মতো কাজে উৎসাহ নেই। সর্বোপরি আগের মতো যৌন সংবেদনে সাড়া দিতে পারছেন না। সবসময় যেন মনে হচ্ছে – তিনি পিছিয়ে পড়ছেন সবার থেকে।
এমন মানসিক টানাপোড়েন অনেক মহিলার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ঋতুস্রাবের
সূচনাকালে এবং ঋতুনিবৃত্তিকালে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত
স্বাভাবিক ব্যাপার। মেনোপজের সময় বর্ধিত সামাজিক ও পারিবারিক
দায়িত্ব এই সমস্যাগুলোকে আরো তীব্র করে তোলে।
মেনোপজ কি?
মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪৫-৫০ বছরের মধ্যে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। যদি কোন নারীর ঋতুস্রাব ১২ মাসের
বেশি বন্ধ থাকে, তবে তাকে ঋতুনিবৃত্তি বা মেনোপজ বলে। ৪০ বছরের
পূর্বে যদি কোন মহিলার মেনোপজ ঘটে, সেটিকে অকাল ঋতুনিবৃত্তি বা প্রিম্যাচুউর
মেনোপজ বলে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জরায়ু বা ডিম্বাশয় বাদ দিয়ে দিলে অকাল
ঋতুনিবৃত্তি হয়।
মেনোপজ কেন হয়?
জরায়ুর মধ্যে ডিম্বাণু সঞ্চিত থাকে। জরায়ুর ইস্ট্রোজেন ও
প্রজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে জরায়ুর থেকে ডিম্বাণু এবং ঋতুস্রাব নিঃসৃত হয়। একটি
নির্দিষ্ট বয়সের পর ইস্ট্রোজেনের উৎপাদন হ্রাস পেতে শুরু করে। এরফলে ডিম্বাণু এবং
ঋতুস্রাব নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়।
মেনোপজের লক্ষণগুলি
বিভিন্ন মহিলা মেনোপজের সময় বিভিন্ন রকম লক্ষণ এবং সমস্যার
সম্মুখীন হন। যেমন-
- অত্যধিক গরম লাগা – আমাদের মস্তিষ্ক পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে আমাদেরকে মানিয়ে নিতে সহায়তা করে। কিন্তু মেনোপজের সময় ইস্ট্রোজেনের ঘাটতির ফলে মস্তিষ্কের থার্মোস্ট্যাট বা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক অংশটি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। এরফলে শরীরের উপরিভাগে গরম ঝলকানি ( hot flashes) অনুভূত হয় এবং অত্যধিক ঘাম হয়। এই গরম ঝলকানি ১০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট স্থায়ী হয়। তাছাড়া মুখ ও গলার কাছে লাল দাগ দেখা যায়।
- ঋতুস্রাবের সমস্যা – অনিয়মিত ঋতুস্রাব এবং স্বল্প পরিমাণে ঋতুস্রাব হওয়া। অনেকের ক্ষেত্রে আবার মেনোপজের পূর্বে ঋতুস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ঋতুস্রাব স্থায়ী হয়।
- ঘুমের সমস্যা – হরমোনের তারতম্যের কারণে ঘুমের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাড়াতাড়ি ঘুম না আসা, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং অনিদ্রা ইত্যাদি সমস্যা পরিলক্ষিত হয়।
- প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি – মেনোপজের সময় বারংবার প্রস্রাবের বেগ অনুভূত হওয়া এবং স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক পরিমাণে প্রস্রাব- অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।
- শারীরিক গঠনের পরিবর্তন – স্থূলতা, তলপেটে মেদ এবং স্তনের পরিবর্তন এই সময়ে পরিলক্ষিত হয়।
- দেহে শুষ্কভাব – যোনি সংলগ্ন অংশ এবং ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়।
- অবসাদ ও বিষন্নতা – হরমোনের তারতম্যের কারণে অবসাদ ও বিষন্নতা দেখা দিতে পারে।
মেনোপজের সমস্যাগুলোকে জীবনশৈলীর সামান্য সদর্থক পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজেই সমাধান করা সম্ভব। তবে খুব বাড়াবাড়ি সমস্যা হলে ডাক্তারি পরামর্শ নিতে হবে। এই পরিবর্তনগুলো হল -
- অনিদ্রা, স্থূলতা এবং মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য নিয়মিত যোগাভ্যাস ও শরীরচর্চা শ্রেষ্ঠ উপায়।
- যোনি সংলগ্ন অংশের শুষ্কতা দূরীকরণের জন্য ডাক্তারি পরামর্শ মেনে লুব্রিকেন্ট বা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে।
- মেনোপজের পর শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা যায়। এরফলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং অস্টিওপোরোসিস হতে পারে। তাছাড়া এই সময়ে ডায়াবেটিস এবং হৃদযন্ত্রের বিবিধ সমস্যার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। সেইজন্য শাকসবজি, ফল এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ভীষণ প্রয়োজনীয়।
মেনোপজ কোন রোগ নয়। এটি জীবনের একটি অংশ। স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মতো এটিও অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই মেনোপজকে যত স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা যায়, তত স্বাভাবিকভাবে এটিকে অতিক্রম করা সম্ভব। যদি দৃষ্টিভঙ্গির সামান্য পরিবর্তন করে দেখা যায় তবে এই মেনোপজ এক নতুন যৌবনের সূচনা। এই সময়ে আগের মতো ঋতুস্রাবের যন্ত্রণা নেই, বারংবার প্যাড বা টেম্পুন পরিবর্তনের চিন্তা নেই, নতুন কোন অবস্থাকে আত্মস্থ করার প্রয়োজনীয়তাও নেই। এক অবারিত স্বাধীনতার সূচনা এই মেনোপজ।
তবে মেনোপজের সময় গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা থাকে না বলে অনেকে
যৌন সঙ্গমের সময় প্রোটেকশন গ্রহণ করে না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে- মেনোপজের সময়
যৌন সঙ্গমের দ্বারা বাহিত রোগগুলো সঞ্চারিত হয়। তাই সেই রোগগুলোর থেকে রক্ষা পেতে
বিশেষ প্রোটেকশন যেমন কন্ডোম ব্যবহার করা দরকার।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন